পতেঙ্গা এয়ারপোর্ট থেকে সোজা শহরে এসে টেলিগ্রাফ অফিসে ঢুকল বাবর। একটা ফরম নিয়ে খসখস করে লিখল–কী লিখবে আগে থেকে ভাবা ছিল তারা—
এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম
জাহেদা ইসলাম
সেইন্ট মেরি কলেজ হোস্টেল
ইস্কাটন, ঢাকা
ফাদার সিরিয়াসলি ইল, কাম শার্প।
–মাদার।
পয়সা গুণে দিল বাবর। গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, টেলিগ্রামটা আজকেই পাবে তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
কখন পাবে? এই ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে।
ধন্যবাদ।
বাইরে বেরিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল বাবর, হাসল। একটা সিগারেট ধরাল যত্ন করে। জাহেদা আজ সকালে টেলিফোন করেছিল। তখন তাকে সে বলেছিল। এই রকম একটা নিয়ে। তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল জাহেদা।
না, না, বাবার অসুখ বলে দরকার নেই।
দূর পাগল অসুখ বললেই সত্যি সত্যি অসুখ হয় নাকি? ওসব কুসংস্কার।
যদি কেউ ধরে ফেলে।
কারো সাধ্য নেই। চাটগাঁ থেকে টেলিগ্রাম আসবে। তোমার বাবা তো ওখানেই থাকেন। কেউ ধরতে পারবে না। বলে বাবর আর বেশি সময় দেয়নি জাহেদাকে। চট করে যোগ করেছে, কাল আটটার মধ্যেই আসা চাই। কেমন? এখন রাখি।
জাহেদাকে কেবল যেটা বলেনি তা হচ্ছে সে নিজে চাটগাঁ যাবে টেলিগ্রাম করতে।
একটা রিকশা নিল বাবর। বেশ মিষ্টি, স্বচ্ছন্দ, সুন্দর লাগছে সব কিছু। অনেকদিন পর চাটগাঁ আসা হলো। কেমন নতুন লাগছে সব। সাইনবোর্ড, মানুষ, গাড়ি, উঁচু নিচু পথ, বাতাস, রোদ–সব কিছু। কোন দিকে যাবে? খানিক্ষণ ঘুরে বেড়ালে হয়। এখন আর কিছু করার নেই, ভাববার নেই। এখন শুধু অবসর। শুধু আলস্য।
বাবর রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে লাগল।
আজ ঢাকায় ফিরে রাতেই গাড়িটা দেখেশুনে রাখতে হবে। লম্বা জার্নি। তেলও আজই কিনে রাখবে সে। মান্নানকে বলবে গাড়িটাকে একটা গোসল দিতে। অনেকদিন যত্ন নেয়া হয়নি। সেদিন ময়মনসিংহ থেকে ফেরার পথে লক্ষ করছিল ক্লাচে কেমন একটা শব্দ হচ্ছে চাপ দিলেই-অল্প বয়সী কুকুরের মত আর্তনাদ। কাল জাহেদার সঙ্গে দেখা হবে। কাল রাতে তারা থাকবে রংপুরে।
আজ শুধু অবসর। একটু ঘুমিয়ে নিলে হয়! হ্যাঁ, ঘুমুঝে সে। এখন মোটে সোয়া বারোটা বাজে। রাত সাড়ে নটায় তার ফিরতি প্লেন। স্কুটার নিয়ে হোটেল শাজাহানে এলো বাবর। হাসল। বাবরের ছেলে হুমায়ূন। হুমায়ুনের ছেলে আকবর। আকবরের ছেলে শাজাহান। যোগাযোগ মন্দ নয়। বাবা তার নামটা রেখেছিলেন বাজা বাদশার নামে। বেঁচে থাকলে বুড়ো আরামে থাকতে পারত। সারা জীবন তো ইস্কুলে মাস্টারি করে গেছেন। আলস্য পরম শত্ৰু, উর্ধ্বমুখে পথ চলিও না, ইক্ষুরস অতি মিষ্ট–লেখ বাবারা, হাতের লেখা লেখ। এরপর আঁক কষতে হবে-তিন তিরিক্ষে নয়, তিন চারে বারো। এরপরে ইংরেজি আছেসান নেভার সেটস ইন ব্রিটিশ এম্পায়ার।
হাঃ। সত্য মাত্রেই আপেক্ষিক।
রেজিস্টারে নাম লেখাল বাবর। রিসেপসনিস্ট চাবি নিল বোর্ড থেকে। তখন চোখে পড়ল
বাবরের, একটা রুমের কার্ডে লেখা এম ডি ফিরোজ মাজমা। এ নাম তো গণ্ডায় গণ্ডায় থাকার কথা নয়।
সে জিগ্যেস করল, ভদ্রলোক ঢাকা থেকে এসেছেন?
বিজনেস ম্যান?
জি, হ্যাঁ।
লম্বা? ফর্সা মত? গোফ আছে সরু?
জি, তিনিই।
বাবর ওপরে এসে ম্যাজমাদারের কামরায় নক করল।
অন্দর আও।
ভেতর থেকে মাজমাদারের উর্দুই শোনা গেল। দরোজা ঠেলে ঢুকল বাবর। দেখল ফিরোজ বিছানায় কান্ত হয়ে শুয়ে তাস খেলছে, সমুখে এক ভদ্রলোক, মাঝখানে একরাশ টাকা খুচরো পয়সা।
আরে, আপনি? আসুন, কখন এলেন ঢাকা থেকে?
আজই। কাজ ছিল। তিন তাস?
এই আর কী! সময় কাটানো। ইনি আমার বন্ধু নজমুল হক।
ভদ্ৰলোক যন্ত্রের মত হাত বাড়িয়ে দিলেন নিঃশব্দ।
বাবর বলল, বোর্ডে আপনার নাম দেখলাম। কবে এসেছেন?
দিন চারেক হয়ে গোল।
ব্যবসার কাজে?
তাতো বটেই। তবে কাজ শেষ। এখন একটু অকাজের ধান্দায় আছি। বলে চোখ খাটো করলেন ফিরোজ মাজমাদার। ব্যাখ্যা করলেন, মানে বোঝেন তো? একটু টেষ্ট বদলানো। হক সাহেব বললেন ভাল ভাল জিনিস আছে, কোথায় যেন বললেন হক সাহেব?
নজমুল হক বিকারহীন উচ্চারণ করলেন শিয়ালকুক্কা।
শিয়ালবুক্কা কী? বাবর অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।
একটা জায়গা। রাঙ্গামাটি যেতে পড়ে।
অদ্ভুত নামতো।
হ্যাঁ। শিয়ালবুক্কা।
নজমুল হক উচ্চারণ করলেন না তো যেন শেয়ালের ডাক ডেকে উঠলেন। তারপর ঘোঁৎ করে একটা শব্দ তুলে তাসে মনোযোগ দিলেন।
ফিরোজ মাজমাদার বললেন, শিয়ালবুক্কায় নাকি খাসা পাহাড়ি মাল পাওয়া যায়। যেমন ঊরু, তেমনি দুধ, তেমনি শরীর! কি?
ভালই তো।
খ্যা খ্যা করে হাসতে হাসতে ফিরোজ গোলাশ চুমুক দিয়ে কাবার করলেন। বাবর এতক্ষণে দেখল একটা হুইস্কির বোতল টিপয়ের নিচে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে নাকি বাবর সাহেব?
কী?
হুইস্কি। যদি বলেন শিয়ালবুক্কায়ও হতে পারে। যাবেন?
নজমুল হক আড়ে একবার দেখে নিলেন বাবরকে।
বাবর বলল, আপনিই যান।
ভয় পেলেন নাকি? আরো আপনার ভয় কী সাহেব? বিয়ে করেননি, আছেন বেশ। আমরা শালা বিয়ে করে পস্তাচ্ছি। নিত্য অসুখ বিসুখ। মেজাজ মাশাল্লা বাঁধিয়ে রাখার মত। দিন রাত্রির খ্যাচ খ্যাচ ফ্যাচ ফ্যাচ। শুয়েও সাহেব শান্তি নেই। শালা রোজগার করি। কার জন্যে? জায়গাটার নাম যেন কী হক সাহেব?
শিয়ালবুক্কা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ শিয়ালবুক্কা। ফিরোজ মাজমাদার গা দুলিয়ে দুলিয়ে ছড়ার মত বার কয়েক নামটা উচ্চারণ করলেন। তারপর একটা গেলাশ নিয়ে খানিকটা হুইঙ্কি ঢেলে বাবরের হাতে দিয়ে বললেন, চলুন না। ভাইসাব। বিকেলে যাব। হক সাহেবের গাড়ি আছে। রাতে থাকব। দুই ভাই মিলে খেলাধুলা করে আবার সকালে ফিরে আসব চলুন।
থাকগে।
আরে বললাম তো, বিশ্বাস না হয়। হক সাহেবকে জিগ্যেস করে দেখুন না, কেমন খাসা জিনিস। পম পমপম। মাল নয় তো পশমি মোজা। যেমন গরম, তেমনি আরাম, কী বলেন হক সাহেব।
দ্বিগুণ মনোযোগের সঙ্গে নজমুল হক তাস। শাফল করে চললেন। তারপর চূড়ান্ত গাম্ভীৰ্য সহকারে উচ্চারণ করলেন, মাল ভাল।
বললাম না? চলুন মজা হবে।
নজমুল হক তাস দিলেন ফিরোজ মাজমাদারের হাতে। তিনি তাস রেখে দিলেন। থাক, পরে খেলব।
তখন নজমুল হক নিজেই খেলতে লাগলেন বধির এবং কালার একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে।
বাবর বলল, আপনার ব্যবসা কেমন চলছে বলুন মাজমাদার সাহেব? ঢাকায় তো দেখাই হয় না।
ব্যবসার কথা বলবেন না। এসেছিলাম। একটা ধান্দায়। যাওয়া আসাই সার।
কেন?
টু পারসেন্ট থাকলেও বুঝতাম। এক পারসেন্ট হয় কি-না সন্দেহ।
চালিয়ে যান।
আল্লা ভরসা ভাইসাব আল্লা ভরসা। অটোনমি না। আসা তাক শান্তি নাই। আগাখানি আর পাঞ্জাবিরাই মধু খেয়ে যাচ্ছে, আর আমরা শালা বুড়ো আঙুল চুষে চুষে নৃত্য করে গেলাম।
শেখ মুজিব তো এবার পাওয়ারে আসবেন মনে হচ্ছে।
অটোনমি পাব তবে?
ওঁর প্রোগ্রাম তো তাই।
আল্লার কাছে দোয়া করি, ভাইসাব। আমি শেখ মুজিবের পক্ষে। তার মত একটা বাঘের বাচ্চা হয় না, আপনাকে এই বলে রাখলাম হক সাহেব। কী বলেন বাবার সাহেব? ঠিক কিনা কেন? অত বড় কলিজাটা কার?
বাবর শেষ চুমুক দিয়ে গেলাশটা খালি করল। সঙ্গে সঙ্গে ভরে দিলেন ফিরোজ মাজমাদার। ঢেলে দিতে দিতে বললেন, এই বলে রাখছি। হক সাহেব, শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কারো বাকসে ভোট দেবেন তো আপনার সাথে আর কথা নাই।
নজমুল হক বিকারহীন কষ্ঠে মন্তব্য করলেন, ইলেকশন হয় কি-না দেখেন।
হবে না মানে? ঊরুতে চাপড় দিয়ে উঠলেন ফিরোজ মাজমাদার।
ভাসানীর কথাটা মনে রাখবেন। নজমুল হক তাসের দিকে চোখ রেখে বললেন।
রেখে দিন ভাসানী। অটোনমি চাই। অটোনমি না হলে রক্ষা নাই। আপনার মার্গেও বাঁশ, আমার মার্গেও বাঁশ। বুঝলেন? শেখ সাহেব আছে বলেই দেশটা এখন চোখে দেখেন। কী বলেন ভাইসাব?
বাবর হাসল। বলল, পলিটিকস আমি বুঝি না।
আঃ হা। ফিরোজ মাজমাদার বিরক্ত হয়ে উঠলেন। পলিটিকস না বোঝেন নিজের ভাত কাপড় তো বোঝেন?
চুপ করেন, চুপ করেন। নির্মীলিত চোখে মৃদুকণ্ঠে নজমুল হক বললেন। বলে একটা বিলাসী হাই তুললেন দীর্ঘক্ষণ ধরে। লোকটার অর্ধেক দাঁত নেই, লক্ষ করল বাবর।
নীরব হয়ে গেলেন ফিরোজ মাজমাদার। একটা বড় ঢোক হুইঙ্কি গিলে অনাবিল হাসি সৃষ্টি করে বাবরকে বললেন, রেখে দিন পলিটিকস। শালার ওসব মানুষে আলোচনা করে? সময় নষ্ট। হ্যাঁ ভাইসব, যাবেন শিয়ালবুক্কায়? অ্যাঁ?
বাবর বলল, আসলে কী জানেন, ওসব বাইরে টাইরে আমি কখনো যাই না।
তা যাবেন কেন? আপনার টেলিভিশনে অভাব কী?
ছি, ছি, তা নয়। আরে, ঢাকায় আমিও থাকি। সেদিন দেখলাম এক সুন্দরীর সাথে কাফে আরামে বসে আছেন। বয়সটা কমই দেখলাম। কে?
আমার ভগ্নি।
দুরো সাহেব! বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিছে কথা কইতে নাই। প্ৰেম-ট্রেম করেন নাকি?
কী যে বলেন।
তাহলে আর আপত্তি কী? চলুন শিয়ালবুক্কায়।
আপনারাই যান।
বুঝেছি, বুঝেছি, প্ৰেম নাহলে চড়তে মজা লাগে না আপনার।
মনের মধ্যে কোথায় যেন হোঁচট খেল বাবর। ফিরোজ মাজমাদারের কথাটা কি সত্যি? না। যদি হবে তাহলে পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে শুতে বাধা কী?
লতিফার সঙ্গে তার কীসের সম্পর্ক ছিল? বাবলির সঙ্গে কী সম্পর্ক সে তৈরি করতে চেয়েছিল? জাহেদাকে কেন নিয়ে যাচ্ছে উত্তর বাংলায়। তাদের কাছে তো ঐ একটা বস্তুই সে আশা করে যা শিয়ালবুক্কাতেও পাওয়া যায়। তবে বাধাটা কোথায়?
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন ফিরোজ মাজমাদার।
কি, ঠিক বলিনি?
বাবর উঠে দাঁড়াল। বলল, আপনি খাওয়া-দাওয়া একটু বেশি করেছেন। আমার আবার কাজ শেষ হয়নি, এক্ষুণি আগ্রাবাদ যেতে হবে। চলি।
বলে সে নিজের ঘরে এসে হুইস্কির হুকুম করল। জামা জুতো খুলতে খুলতে একরোখার মত দুপেগ নীট উজার করে নিঃশ্বাস নিল একটা। তারপর সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়। বলল, বেয়ারা, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আমাকে জাগিয়ে দিও। আর কেউ আমাকে খোঁজ করলে বলবে সাহেব কামরায় নেই।