১৫. হেডা, ও হেডা

খুর ভোরে ঘুম থেকে উঠল বাবর। জেগে দেখল জাহেদ আর সে পিঠ ফিরিয়ে শুয়েছিল। জাহেদাকে এখন জাগাল না। দ্রুতপায়ে নেমে বাথরুমে গেল, পরিষ্কার করে গাল কামাল, গরম পানি আনিয়ে গোসল করল অনেকক্ষণ ধরে। পরল তার শাদা ফ্ল্যানেলের সুট। সবুজ ফোঁটা দেয়া টাই বাধল গলায়। মন খুব ভাল থাকলে এই পোশাকটা সে পরে। টাইটা আলজিরিয়া থেকে আনিস তাকে পাঠিয়েছিল।

তারপর জাহেদার জন্যে গরম পানি আনিয়ে তার কানের কাছে মুখ রেখে ডাকল, হেডা, ও হেডা।

চোখ মেলে অচেনা চোখে এক পলক তাকিয়ে রইল জাহেদা। হঠাৎ একটা সলজ্জ স্নিগ্ধতায় ভরে গেল। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা মুখ।

শিগগির তৈরি হয়ে নাও। আমি নাশতা নিয়ে আসছি। কেমন।

বলে সে হাত ধরে জাহেদাকে তুলে দিয়ে বেরুল। বেরিয়ে দেখল। সারারাত শিশিরে গাড়িটা ভিজে আছে। কাচ অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। কাচের ওপর আঙুল বুলাতেই সুন্দর পরিষ্কার দাগ ফুটে উঠল। তখন বড় বড় করে সে লিখল H-E-D-A. কৌতুকভরা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল, আবার মুছে দিল। রুমালটা ভিজে গেল সারা রাতের শিশিরে।

চৌকিদার এসে বলল, নাশতা দেবে কি? হ্যাঁ, একটু পর। চৌকিদার তখন বলল, ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিই, গাড়ি মুছে দেবে? হ্যাঁ, তাই দাও। বাবর গাড়িতে বসে এঞ্জিন স্টার্ট করে গরম করল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ফটকের দিকে গেল। জাহেদার তৈরি হতে অন্তত আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। এই সময়টুকু হেঁটে বেড়ান যাক।

ঘুম থেকে আস্তে আস্তে জেগে উঠছে রংপুর। দালানের খরখাড়িতে, থামে, বারান্দায়, পথের ওপর রোদ পড়ছে। ঠিক যেন ঘুম ভাঙ্গা জাহেদার মত হাসছে। শহরটা। মিষ্টির দোকানে কয়লার উনুন থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, সিঙ্গারা সাতার কাটছে গরম তেলে। একপাল কাক মোড়ে জনসভা করছে যেন, কলরবে নাচানাচিতে জমজমাট। চাদরে কান মাথা ঢেকে লাঠি হাতে বুড়োরা বেড়িয়ে ফিরেছে। মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি থেমে থেমে পরিচ্ছন্ন করছে পথ। ফুটপাতের পাশে দেয়ালে শূন্য সব রশি টানান, গত রাতে যেখানে ঝোলান ছিল রং-বেরং-এর শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা। পানের দোকান থেকে ধোয়ামোছার পানি গড়িয়ে ছোট ছোট হ্রদ সৃষ্টি করেছে। চারদিক থেকে কুয়াশার পর্দা, হিমের পর্দা, ঘুমের পর্দা ক্রমশ নিঃশব্দে নাতিদ্রুত উঠে যাচ্ছে। খুব ভাল লাগল বাবরের। বিশেষ কোনো বিষয়, ব্যক্তি বা সমস্যা তাকে এখন অন্যমনস্ক করে রইল না। মনে হতে লাগল সব কিছুই ভাল, সবকিছুর সমাধান আছে এবং বেঁচে থাকার একটা বিস্ময় আছে যার সঙ্গে কোনো বিস্ময়ের তুলনা নেই।

হাঁটতে হাঁটতে ধাপ পর্যন্ত গেল বাবর। এখানে আরো শান্ত পরিবেশ। গাছপালার মধ্যে বেড়া দেয়া বাড়িগুলো উঁকি দিচ্ছে। লম্বা লম্বা গাছের ছায়া পড়ে নিবিড় দেখাচ্ছে পথটাকে। মাটির একটা তাজা গন্ধ সর্বক্ষণ নাকে এসে নেশা সৃষ্টি করছে।

বাবর এবার ফিরল। খবর কাগজের জন্যে এদিক ওদিক তাকাল। তারপর মনে পড়ল এটা ঢাকা নয়। এখানে কাগজ আসে একদিন পরে। আশ্চৰ্য, সকালটা এরা খবরের কাগজ ছাড়া কাটায় কী করে? অথচ সে নিজেও যে একটা পড়ে তা নয়। কিন্তু সকালে টুথব্ৰাশের মতই ওটা একটা জরুরি বস্তু, নইলে সকালটাকে সম্পূর্ণ মনে হয় না। যেদিন কাগজের ছুটি থাকে, মনে হয়। সারাদিন ভারি মনমরা যাচ্ছে।

আসসালামো আলাইকুম।

অতি বিশদভাবে উচ্চারিত এই সম্ভাষণে ঘুরে তাকাল বাবর। লোকটাকে পাশ কাটিয়েই চলে এসেছিল সে। ফিরে তাকিয়ে দেখল রেডিও পাকিস্তানের আসগরউল্লাহ। এই যে বাবর সাহেব। এখানে?

আরে আপনি? আপনি এখানে কী করছেন?

আমি তো এখন রংপুর রেডিও স্টেশনের চার্জে আছি। মাস তিনেক হয়ে গেল।

তাই নাকি। আমি তো কিছু জানি না।

আর জানবেন কী করে? টেলিভিশন আসার পর তো রেডিওর পথ আপনারা ভুলেই গেছেন।

তা সত্যি। বাবর অপরাধী হাসি একটা ফুটিয়ে তুলল। বলল, তারপর বলুন চলছে কেমন?

এই এক রকম। আপনাদের খেদমত করে যাচ্ছি। রংপুর কবে এসেছেন? কাল সন্ধ্যায়।

কী ব্যাপার?

এই বেড়াতে টেড়াতে।

উঠেছেন কোথায়?

ডাকবাংলোয়। অফিসে যাচ্ছেন বুঝি?

জি, আর কোন চুলোয় যাব বলুন। চলুন না। আমাদের স্টেশনটা দেখে আসবেন।

আচ্ছা, আচ্ছা।

না, না, আপনাকে আসতেই হবে। এই সোজা গিয়ে ডান দিকে মোড় নেবেন, যেতে যেতে জেলখানা পড়বে, সোজা চলে যাবেন, হাতের ডানে রেডিও অফিস। ও দেখলেই চিনতে পারবেন। কখন আসছেন বলুন?

দেখি।

দেখি টেখি না। আসতেই হবে। আপনাকে যখন পেয়েই গোলাম, একটা কিছু করিয়েও নেব। রংপুর স্টেশন থেকে ব্রডকাস্ট হবে।

শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন।

সে-কী কথা বাবর সাহেব। এতো আমাদের সৌভাগ্য। ছোট্ট একটা বক্তৃতা মাত্র। আপনি এখনই চলুন না? কতক্ষণ লাগবে?

আসগরউল্লাহ হাত ধরে ফেলল।

বাবর তখন বলল, আচ্ছা আসব। এখনো নাস্ত হয়নি।

আপনার অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু।

অবশ্যই। তবে বক্তৃতা টক্তৃতা হবে কিনা বলতে পারছি না।

সে আপনাকে দিয়ে করিয়ে নেব। চলি।

আসগরউল্লাহ চলে গেল। বাবর একটু খুশিই হয়েছিল তাকে বক্তৃতা দেবার জন্যে অনুরোধ করাতে। সেই খুশিটা তাকে নাচিয়ে নিয়ে এলো ডাকবাংলোর দোতলা পর্যন্ত। তার দরোজায় টোকা দিল। মধুর গুঞ্জন করে উঠল, আসতে পারি।

দরোজা ঠেলে দেখল জাহেদা আরাম চেয়ারে বসে আছে পিঠ সোজা করে। একদিকে একটু পাশ ফিরে। গোলাপি আর গাঢ় সবুজে আঁকা মনোরম একটা ছবির মত। গোলাপি পাজামা পরেছে। পায়ে সবুজ ফিতের চটি। হাতকাটা গাঢ় সবুজ কামিজ, পিঠে গোলাপি বোতাম বসান। ঠোঁটে গোলাপি বংয়ের আবাস বার্নিশের মত উজ্জ্বল। কপালের মাঝখানে গোলাপি টিপ। ভ্রু টেনেছে সরু করে, চোখে কাজলের ফ্রেম। মাথার পেছনে টানটান করে চুল বাধা। অত্যন্ত প্ৰশান্ত আত্মস্থ স্নিগ্ধস্নাত মনে হচ্ছে তাকে। মুখটাকে দেখাচ্ছে কোমল ব্ৰাউন। এত কোমল যেন স্পর্শ করলেই ভেঙ্গে যাবে। গভীর চোখ তুলে তাকাল জাহেদা। বসে বসে নোখে রং পরছিল সে। সমুখে নাশতা সাজান। বাবর মিষ্টি করে হাসল। বলল, তুমি বসে আছ?

কতক্ষণ নাশতা দিয়ে গেছে। এই আপনার আসা? খান।

তুমি?

আপনি শুরু করুন।

গতরাতে যেন কিছুই হয়নি, গতরাত যেন অন্য কারো নাটকের রাত ছিল, জাহেদাকে দেখে এখন তাই মনে হলো বাবরের। তার মনে একটুখানি আশঙ্কা ছিল এই সকালের জন্য, এখন তা একেবারে নির্মল হয়ে গেল। সে একবার তার প্রশংসা করবে ভাবল, কিন্তু করল না। দুচোখ ভরে দেখল জাহেদাকে তার বদলে। আজ সকালে যেন আরও সুন্দর লাগছে তাকে। উঃ, আপনার এই হাসিটা।

রং রেখে নোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে জাহেদা বলল।

কেন কী হয়েছে? গম্ভীর থাকা বুঝি ভাল?

নিন খান।

চৌকিদার চা দিয়ে গেল। নাশতা শেষে বাবর বলল, ভেবেছিলাম আজ রংপুর ছাড়ব। তা বোধহয় হলো না।

আশংকায় করুণ দেখাল জাহেদাকে। বলল, কেন?

এই মাত্র নিচে রেডিওর একজনের সঙ্গে দেখা। বলল, একটা বক্তৃতা দিতে হবে। এখানে আমার এক বন্ধু থাকে, প্রণব বাবু, ভাবছি। তার সঙ্গেও দেখা করব, মানে এলাম যখন। চল, আগে রেডিও সেরে আসি।

আমি যাব?

কী হয়েছে তাতে? চল, চল। তারপর শহর দেখাব তোমাকে। রেডিও থেকে ফেরার পথে।

জাহেদা হেসে ফেলল।

হাসছ, যে?

আবার ফেরার পথে বলেছেন।

কালকের কথা মনে পড়ল বাবরের। কাল সবকিছুই সে ফেরার পথে জাহেদাকে দেখাবে বলছিল ক্রমাগত। তার জন্যে শাসনও শুনছিল। আজকে আবার। বাবর বিস্তৃত হাসিতে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। বলল, আজ থেকে আর ফেরার পথে নয়।

কথাটা একটু ওজন দিয়ে উচ্চারণ করল বাবর। জাহেদা উঠে দাঁড়াল। তখন বেরুতে বেরুতে বাবর বলল, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। খুব মানিয়েছে তোমাকে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে বলল, জান জাহেদা, আমার মনে হয়, একেক সময় আমি ভাবি, ঈশ্বর যদি থাকেন, আমি তার খুব আদরের তৈরি। তিনি নিজ হাতে আমাকে বানিয়েছেন।

কেন?

কেন আবার? আমার মত ভাগ্যবান আর কে বল?

বাবর মুখ ফিরিয়ে জাহেদার দিকে অর্থভরা চোখে দেখল। জাহেদা সমুখে চোখ রেখেই বুঝতে পারল সেটা। অনাবশ্যকভাবে বলল, গাড়িটা সারারাত বাইরেই ছিল নাকি?

হাসতে হাসতে গাড়ির দরোজা খুলে দিল বাবর। একটু রসিকতা করার লোভে সামলাতে পারল না সে। গাড়ির গায়ে চাপড় দিয়ে বলল, এ বেচারার জন্যে কাল কোনো ব্যবস্থা করা গেল না।

শীতের উজ্জ্বল রোদে গাড়িটা বেরিয়ে গেল ওদের নিয়ে। জাহেদার গাঢ় সবুজ ফোঁটা চমৎকার ম্যাচ করেছে। এইসব ছোট্ট কিন্তু সুন্দর যোগাযোগগুলো ভারি প্রীত করে বাবরকে।

বাঁ দিকে জেলখানা পড়ল। আসগরউল্লাহ বলেছিল; সোজা আরো কিছুদূর যেতে হবে। বাবর বায়ে দেখিয়ে বলল, এই হচ্ছে রংপুর জেলখানা।

আমাকে দেখাচ্ছেন কেন?

তবে?

ওটা তো আপনার জায়গা।

তা বটে। যদি তুমি জেলার হও।

আমার বয়ে গেছে।

ঐ বোধহয় সামনে রেডিও স্টেশন।

নাম পাঠাতেই আসগরউল্লাহ নিজে সদর দরোজাবী কাছে এসে ত্যভ্যর্থনা জানাল। আসুন, আসুন।

কিন্তু চোখ তার জাহেদার দিকে। বাবর হেসে বলল, জাহেদা আমার বোন। সবচেয়ে ছোট।

ও, উনিও এসেছেন।

হ্যাঁ, চিরকাল রাজধানীতে মানুষ। বেড়াতে নিয়ে বেরিয়েছি।

খুব ভাল করেছেন।

জাহেদা বাবরের দিকে চোখ কালো করে একবার অনেকক্ষণ তাকাল। বাবর তা না দেখার ভাণ করে আসগরউল্লাহকে বলল, আপনার স্টুডিও দেখান।

সমস্ত স্টেশনটা ঘুরিয়ে দেখান হলো ওদের। সবার সঙ্গে আসগরউল্লাহ আলাপ করিয়ে দিতে লাগল।

এই যে ইনি বাবর আলী খান। আর তার ছোট বোন।

বাবর যে রংপুরে সেটা যেন আসগরউল্লারই অনেক কীর্তির মধ্যে একটি, এই রকম একটা যাদুকর-শোভন গর্ব তার চোখেমুখে। ভারি মজা লাগল বাবরের। আপিসে বসতে বসতে বলল, কীসের বক্তৃতা দিতে হবে বলুন।

জি, বিষয় আমি ঠিক করে রেখেছি। রংপুরের ভাওয়াইয়া গানে বিরহ।

গান? গানের আমি কী বুঝি?

তবু।

আর বিরহ? হাঃ হাঃ। আসগরউলাহ সাহেব, এই শীতের চনমনে সকালে আর কোনো বিষয় পেলেন না? বিরহ!

মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল বাবর। জাহেদা বিরহ শব্দটা বোঝে না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর বাবরকে হাসতে দেখে তার ভেতরেও সংক্ৰমণ হলো যেন। সে ঠোঁট টিপে মুখ নামিয়ে রইল। আসগরউল্লাহ বুঝতে পারল না বাবর কী ঠাট্টা করছে না। সত্যি সত্যি বলছে। খুব সপ্ৰতিভ হয়ে বলল, বিরহ তো শীতের সকালেরই ব্যাপার সাহেব।

তাই নাকি? আরো মজা পেল বাবর। হা হা করে হেসে উঠল সে। তার চেয়ে বাংলাদেশের জাহাজ শিল্পের ভবিষ্যৎ বাঁ গবাদি পশুর যক্ষ্মা গোছের কোনো বিষয় দিন, মিনিট দশেক বক্তৃতা করে দিচ্ছি।

এবারে হা হা করে হেসে উঠল আসগরউল্লা। বলল, ঠাট্টা করছেন? স্বীকার করি, আমাদের অধিকাংশ বক্তৃতার বিষয়ই ঐ রকম। তাই বলে তা আপনাকে দেব কেন।

আচ্ছা তাহলে ঐ ভাওয়াই গানে বিরহই?

জি, আপাতত এটাই আছে। দশ মিনিটের বক্তৃতা। মিনিট আটেক বললেই হবে।

কিন্তু কী বলি বলুন তো! ভাবতে হবে, লিখতে হবে, কখন লিখব, কখন পড়ব?

আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আপনার বক্তৃতায় উদাহরণ হিসাবে কিছু গানের অংশ তো থাকবেই। আমি রেকর্ড বাছাই করেও রেখেছি। গানেই যদি বলেন মিনিট পাঁচেক সবশুদ্ধ চালিয়ে দেয়া যাবে। মাত্র তিন মিনিট কথা বলবেন। ব্যাস।

জাহেদার পাশে নিজেকে খুব চটপটে লাগছিল বাবরের। মনের কোণে তাকে একটু তাক লাগিয়ে দেয়ার ইচ্ছেটাও হচ্ছিল থেকে থেকে। সে বলল, বেশ, সোজা স্টুডিওতে চলুন। মুখেই বলছি। ফাইলের জন্যে টেপ থেকে কাউকে দিয়ে টুকে নেবেন।

বেশ তো তাই হবে। স্টুডিওতে চলুন! গানগুলো শুনে নেবেন।

চল জাহেদা।

জাহেদার কাঁধে হাত রেখে বাবর বলল। জাহেদা আবার চোখ কালো করে দেখল তাকে। কয়েক পালকের জন্যে। তখন আরো সুন্দর লাগল তাকে।

বক্তৃতা রেকর্ড করে বেরুতে বেরুতে সাড়ে এগারটা বেজে গেল। যাবার সময় বাবর বলল, চেকটা ঢাকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন।

খুব খুশি হলাম। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আবার আসবেন। ঢাকায় গেলে দেখা করব।

করবেন।

বাগান থেকে একটা বড় সূর্যমুখী তুলে বাবর জাহেদাকে দিল। জাহেদা আবার চোখ কালো করে তাকাল।

আরে, কী হয়েছে?

আপনার এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হওয়া উচিত।

অবশ্যই।

বলে সাঁ করে গাড়ি পথের ওপর তুলে আনল বাবর। রওয়ানা হলো শহরের দিকে। হাসতে হাসতে বলল, জানি না। কীভাবে কথাটা ইংরেজিতে অনুবাদ করব, বাংলায় একটা কথা আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমার হয়েছে সেই অবস্থা।

আমি বেশ বাংলা বুঝি সাহেব। আপনি খামোক সৰ্বক্ষণ ইংরেজি বলেন।

কী জানি। বাংলায় বললে মনে হয় তুমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কী বলতে চাইছি। ইংরেজিটা অনেক নির্ভরযোগ্য মনে হয় তাই।

জাহেদা সীটো গা এলিয়ে বসল।

নিপুণ হাতে গাড়ি চালাতে চালাতে বাবর বলল, তখন ঐ বিরহ শব্দটা বুঝেছ?

না।

কী করে বোঝাই তোমাকে ইংরেজি কী হবে বুঝতে পারছি না। এটা একটা বিচ্ছেদের অবস্থা। সঙ্গে অনন্ত বেদনা আছে, প্ৰতীক্ষা আছে।

লঙ্গিং?

না, না, লঙ্গিং নয়। তার চেয়েও বেশি। বিরহ বুঝতে হলে তোমাকে রাধার কথা জানতে হবে। রাধা।

আমি রাধাকে চিনি। রাধা হচ্ছে হিন্দুদের একজন সুন্দরী দেবী। ইন্ডিয়ান লাভ মেলোডিজ বলে একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড, তার কভারে আছে রাধার ছবি।

বাবর হাসল।

কি, ভুল বলেছি।

না, নাতো। বোধহয় জান না, রাধা শুধু দেবী নয়, কল্পনা নয়, রাধা যে-কোনো মেয়ের নাম কোনো বিশেষ মুহূর্তে।

অর্থাৎ?

কিছু না, ও কিছু না। তুমি আমার রাধা। সবুজ আর গোলাপি দিয়ে আঁকা, চোখে বর্ষার মেঘ টানা, কাচুলিতে নীল পয়োধর বাঁধা, তুমি আমার রাধা।

বাংলা ভাল বুঝি না বলে যা খুশি তাই বলছেন, বুঝি না বুঝি। আপনি এখন থেকে ইংরেজি বলবেন। শুধু ইংরেজি।

তাইতো বলছিলাম কাল থেকে।

তাই বলবেন সাহেব এরপর থেকে।

ইয়েস, ইয়োর ম্যাজেস্টি।

বাবর পথের দুদিকে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে তাকাতে লাগল। কী দেখছেন?

এইখানে কোথায় মিলন স্টোর বলে একটা দোকান আছে।

কী কিনবেন?

কিছু না। আমার এক বন্ধু আডা মারতে আসেন শুনেছি। ঢাকায় বহুবার বলেছেন রংপুরে এলেই যেন খোঁজ করি। চমৎকার মানুষ। এই যে!

পেট্রল পাম্প পেরিয়েই দোকানটা। বাবর সেখানে প্রণব বাবুর খোঁজ করল। না, তিনি তো নেই। হ্যাঁ, তিনি এখানে সকাল বিকেল আসেন। আজো আসবেন। বাবর একটা টোকা লিখে দোকানির হাতে দিল। হ্যাঁ, এলেই প্রণব বাবুকে দেবে। লোকটা সারিসের মত গলা বাড়িয়ে যদ্দুর দেখা যায় বাবরকে দেখল। পাম্প থেকে পেট্ৰল ভরে নিল বাবর। বলল, চল তাহ হাটের মহারাজার প্রসাদটা দেখিয়ে আনি।

মহারাজা?

ছিলেন, এখন নেই। শুনেছি শেষ যিনি মহারাজা ছিলেন। কলকাতা যাবার পথে গাড়িতে হার্টফেল করে মারা গেছেন।

বেচারা। জাহেদা দুঃখিত মুখ করল।

মানুষ তো মরেই। মরবে না?

তবু কী আশ্চর্য, এইটুকু জীবনের জন্য কত না হৈচৈ।

সেটা দোষের নয়। মানুষ এত হৈচৈ করে কেন জান? করে সে যে বেঁচে আছে সেইটে অনুভব করার জন্যে।

এবং করাবার জন্যে। জাহেদা যোগ করল।

হয়ত। তবে আমার মনে হয়, না। আমার মত তোমারও যখন বয়স হবে তখন তুমিও বুঝতে পারবে, মানুষের নিজের কাছে নিজেই প্রমাণ দেয়া যে সে বেঁচে আছে এইটে বড়। কটা লোক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে সে বেঁচে আছে?

জাহেদা সে চ্যালেঞ্জের ধারে কাছে দিয়েও গেল না। মুখ গোল করে বলল, আপনি সব সময় নিজেকে খুব বুড়ো ভাবতে ভালবাসেন, না?

হেসে ফেলল বাবর।

আবার হাসছেন?

হাসছি? না, হাসছি না। কী জানি, হয়ত নিজেকে বুড়েই মনে করি। বয়স তো হচ্ছেই। কী জানি তোমাদের দেখে একেক সময় ঐ রকম হয়। দুদিন পরে এই তুমি গম্ভীর হয়ে যাবে, চঞ্চলতা কমে যাবে, শাড়ি পরবে, সংসার করবে, মা হবে।

কখনো না।

আইবুড়ো থাকবে?

হ্যাঁ, থাকব।

কেন?

কেন আবার? বিয়ে টিয়ে আমি পছন্দ করি না। হাসছেন যে?

কই?

আপনার হাসি দেখলে আমার গা জ্বালা করে। কেন, আপনিও তো বিয়ে করেননি। আমি যদি হাসি?

আমি ধন্য হব।

আমার কী দায় পড়েছে। আপনাকে ধন্য করব?

রাগ করেছ।

জাহেদা চুপ করে থাকে। বাবরের সত্যি সত্যি একবার মনে হয় তার হয়ত বয়সই হয়ে যাচ্ছে এবং তাই সে বুঝতে পারছে না। এই সদা কৈশোর পেরুনো তরুণীকে। সে বলল, একটা লিমেরিক শুনবে? বলে সে আর জাহেদার মতামতের অপেক্ষা করে না। বলে চলে–

আল্লাতালা বানিয়েছিলেন আদম এবং হাওয়া।
হাওয়া বলেন, দুর্ভাবনা বেবাক হলো হাওয়া।
ব্যাটাছেলে বলতে এক,
আমারই সে তাকিয়ে দ্যাখ!
কারো সাথে করতে তো নেই চুলোচুলি বাওয়া।

হেসে ফেলল জাহেদা। তারপর লজ্জায় একটু মাথা দুলিয়ে চিবুক নামাল। বলল, আপনার মাথায় কী কী যে সব খেলে। এটা বললেন কেন?

বললাম এই জন্যে যে, আমাদের অবস্থাটা খুব ভিন্ন নয়। তোমার এখন রাগ করতে আমি, ঝগড়া করতে আমি, আবার আদর করতেও–

জি না।

জাহেদা পা গুটিয়ে বসল। চুপচাপ গাড়ি চালাল কিছুক্ষণ বাবর। ভেতরটা আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে তার। আজ সকালে এই প্ৰথম। যেন ভোরের মিঠে সূর্যটা এখন মাথায় চড়ে গনগন করছে।

বাবর তার নাম ধরে ডাকল। জাহেদা তাকাল তার দিকে। হাসল বাবর। আস্তে আস্তে জাহেদাও হেসে ফেলল। বাবর তখন একটি হাত ষ্টিয়ারিং থেকে তুলে চিকিত ছুঁয়ে দিল জাহেদার কাঁধ। বলল, এই মেয়ে, কথা বলছ না? আচ্ছা, আরেকটা লিমেরিক বলি।

না, না, বাবা আর না।

শুধু এইটে। বলেই ব্যাস।

খারাপ কিছু বললে আমি কিন্তু কাঁদব।

কেঁদ। তোমাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি।

কাঁদলে খুব বিচ্ছিরি দেখায় আমাকে। আমি যদি কোনোদিন কাঁদি, আমার মুখের দিকে কিন্তু আপনি তাকাতে পারবেন না।

আচ্ছা, কথা দিলাম।

বলুন লিমেরিকটা।

এক রূপসী বাড়ি তেনার সুদূর টিটিকাকা
উড়ে এলেন এয়ার মেলে মস্ত খামে ঢাকা।
পিয়ন দিল বসিয়ে ছাপ।
বলল মেয়ে, বাপরে বাপ,
তলিয়ে গেল প্যারিস রোম, করল ফতে ঢাকা।

জাহেদা চোখ কালো করে বলল, এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই তো?

বাবাব হাসল রহস্যময় ভাবে।

তার মানে, আছে?

থাকলেই বা। যখন কেউ কারো এই রকম কাছে হয় তখন খারাপ বলে কিছু থাকে না, থাকতে পারে না। সব ভালো, সব সুন্দর। সব কিছুর ভেতর দিয়ে তারা একটা কথাকেই ফুটিয়ে তোলে। সেটা হচ্ছে, আমরা আমাদের।

জাহেদা কয়েক মুহূর্ত পর বলল সত্যি, আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারি না। ঠাট্টার মধ্যে হঠাৎ গুরুগম্ভীর কথা বলেন, বলেন সেই ঠাট্টার সুরেই। আবার পাদ্রীদের মত গলায় এমন কথা বলেন যা আসলে রসিকতা।

আসলে কী জান, জীবনে সিরিয়াস হয়ে দেখেছি, কিছু পাইনি। আবার যখন সেই খোলসটা ছেড়ে ফেললাম, দেখি সব আমার হাতে।

তার মানে আপনি এখন সিরিয়াস নন?

একপলক জাহেদাকে দেখল বাবর। কথাটার মৰ্মাৰ্থ বুঝতে চেষ্টা করল। বুঝে দেখল, একটু আটকে ফেলেছে তাকে মেয়েটা। বাবর তখন তার বহু ব্যবহৃত অস্ত্রটা আবার প্রয়োগ করল–হাসল। বলল, তোমার কী মনে হয়?

জাহেদা চুপ করে রইল।

বাবর জানে কী এখন বলতে হবে তাকে। কুটনৈতিক মিশনের নিপুণ কোনো সদস্যের মত উচ্চারণ করল, সত্যি বলতে কী আগে ছিলাম না, কিন্তু কাল সন্ধে থেকে হয়েছি। কখন জান? যখন তুমি গায়ে পুলওভার চাপিয়ে পা ক্রস করে বসলে সেই তখন কোথা থেকে কী হয়ে গেল, তোমাকে নতুন করে দেখলাম। সে দেখার বিস্ময় আর কাটল না। ওভাবে কেন বসলে তুমি? তা হলে তো কিছু হতো না।

আমি কিছু ভেবে তো বসিনি। পা ক্রস করে ছিলাম। তাই জানতাম না। আপনি বলছেন তবু মনে করতে পারছি না।

আকাশ কি জানে সে রঙ্গিন হয়ে আমাদের রঙ্গিন করে। না মনে রাখে।

জাহেদার মুখটা চিকচিক করে উঠল।

বাবর গাড়ি থামিয়ে নামল। বলল, এটা মহীগঞ্জ। এক সময়ে, সে অনেক আগে রংপুরের প্ৰধান এলাকা ছিল এইটে। দাঁড়াও তাজহাটের রাস্তাটা কাউকে জিগ্যেস করি।

দুদিকে সারি সারি গুদাম ঘর, বাসা ভাঙ্গা দালান। মনে হয় মানুষ ছিল কিন্তু কোনো মহামারীর ভয়ে পালিয়ে গেছে। যাদের দেখা যাচ্ছে তারাও যেন নিঃশব্দে চলাফেরা করছে, এপার থেকে ওপারে মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ঘুঘু ডাকছে দূরে ঘন ঝোঁপের ভেতর থেকে। পরাজয়ের একটা বিষণ্ণ বর্ণের প্রলেপ চারদিকে। জাহেদার মনে হলো, অবিকল একটা গোলডরাশ শহরের মত, আমেরিকায়, ছবিতে দেয়া, সোনার লোভে মানুষ গড়েছে এবং ফেলে চলে গেছে যেখানে সোনা আছে। মনটা খুব খারাপ করে উঠল তার। বাবর ফিরে এলো। খুলে রাখল জ্যাকেট।

যা গরম লাগছে। আরো খানিকটা যেতে হবে, বলেই অবাক হয়ে গেল বাবর। শুনল জাহেদ আপন মনে বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে।

কী বলছি জাহেদা?

ম্লান হাসল মেয়েটা। তাকে সুদূরের মনে হলো।

বলবে না আমাকে?

কী শুনবেন সব ছেলেমানুষী।

তবু।

টেবল পড়ছিলাম। ফোর থ্রিজা টুয়েলভ; ফোর ফোরজা সিক্সটিন; ফোর ফাইভজা টুয়েন্টি।

হঠাৎ নামতা কেন?

এমনি। এমনি মাঝে মাঝে বলি। ভাল লাগে। ফোর সিক্সজা টুয়েন্টি ফোর, ফোর সেভেনজা টুয়েন্টি এইট। কই চলুন।

যাচ্ছি।

বাবর থমকে গিয়েছিল। একটা নতুন খবর শুনেছে যেন। নামতা পড়তে ভাল লাগে। আশ্চর্য! সংখ্যার কী সম্মোহনী শক্তি! ঘুম না এলে একশ থেকে উল্টো দিকে গুণতে হয়। জাহেদার মন কি খুব বিক্ষিপ্ত এখন?

গাড়ি সচল হয়ে উঠল। বলল, হোস্টেলের জন্যে ভয় করছে?

নাহ। যা হবার হবে। ওসব ভেনে; আর মন খাবাপ করতে চাই না।

বাবর হাসল। বলল, জানি, এই একদিনে অনেক বয়স বেড়ে গেছে তোমার। তুমি বড় হয়ে গেছ।

হঠাৎ ব্রেক করল বাবর। জাহেদা প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল, কী হলো?

ঐ দ্যাখ।

সমুখে একটা কালো অতিদীর্ঘ সাপ মন্থর গতিতে এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। আতঙ্কে পাথর হয়ে রইল জাহেদা। বাবর সেই সাপটার দিকে তাকিয়ে রইল সম্মোহিত স্মিতহাস্যে। ধূলায় তার দেহের দাগ পড়ে যাচ্ছে। এই যে বাঁ দিকের শটি বনে ঢুকাল। ধীরে ধীরে ঢুকে গেল তার রাজকীয় দেহটা। লেজের তাড়নায় ফট ফট করে শব্দ হতে লাগল শটি বনে। তারপর শব্দটাও মিলিয়ে গেল। তখন শুধু শূন্য সংবলিত এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল।

জাহেদা জিগ্যেস করল, কী সাপ?

গোখরা। পৃথিবীর ভীষণতম গোখরা এই অঞ্চলে দেখা যায়। এদের যে বিষ তার এত তীব্র ক্রিয়া হয় যে–

দোহাই। দুহাতে মুখ ঢাকল জাহেদা। চুপ করুন।

একটা নিয়ম আছে জাহেদা। সাপ দেখলে আশেপাশের গেরস্তকে খবর দিয়ে যেতে হয়। আমি গায়ের ছেলে তো। ওটা মানি। বলে সে গাড়ির দরোজা খুলতে গেলে জাহেদা খাপ করে হাত টেনে ধরল তার। না, আপনি যেতে পারবেন না।

থরথর করে কাঁপছে জাহেদার হাত নোখগুলো বসে গেছে। বাবরের হাতে। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত তারা তাকিয়ে থাকল একে আরেকজনের চোখে। তারপর হঠাৎ বাবর তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখল অত্যন্ত কোমল করে। পরে মুখটা সরিয়ে কানের লতির উপর ছুঁইয়ে বলল, না, যাব না। তুমি যদি বল যাব না।

গাড়ি ফিরিয়ে নিল বাবর। বাঁ হাতে জাহেদার ডান হাতটা ধরে গাড়ি চালাতে লাগল সে। জাহেদা নীরবে নিজেকে সমৰ্পণ করে বসে রইল শূন্য চোখে দুপুরের রোদজ্বলা শালবনের রাস্তার দিকে।

সারা রাস্তায় আর একটা কথাও হলো না। সারা রাস্তা সেই রাজকীয় সাপটা এপার ওপার করতে লাগল। অলস মন্থর গতিতে সারাক্ষণ। জাহেদা খোদিত একটা মূর্তির মত একভাবে বসে রইল। তারপর ক্রমশ যখন শহরে ঢুকল তারা, তখন জীবনের লক্ষণ দেখা গেল তার ভেতরে। একটা নিঃশ্বাস পড়ল। একটা হাত স্থান বদল করল। একটা পা স্যান্ডেল সন্ধান করল।

বাবর বলল, মৃত্যুকে তুমি ভয় পাও?

আমি মরতে চাই না।

কেউ চায় না–পাগল, প্রেমিক, কবি ছাড়া।

তা জানি না। আমি বেঁচে থাকতে চাই।

কিন্তু মৃত্যুই তো নিয়ম।

বুঝি না।

মৃত্যুকে যেভাবেই দ্যাখ জাহেদা, পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক এই মৃত্যু। যদি একটা কোনো অনড় অবিচল সত্য থেকে থাকে তো তা মৃত্যু।

দোহাই আপনার, চুপ করন।

সত্য আর স্বাভাবিক থেকে তুমি কেন পালাবে জাহেদা?

আহ আমি শুনতে চাই না।

অব্যক্ত যন্ত্রণায় জাহেদা মাথা এপোশ ওপাশ করতে লাগল। সুদক্ষ গলফ খেলোয়াড় যেমন সন্তৰ্পণে টি-তে বল ঢোকায়, তেমনি যত্ন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বাবর গাড়িটা ডাকবাংলোর ভেতর আনল। পরমশীলতার সঙ্গে দরোজা খুলে দিল জাহেদার। এবং নিঃশব্দে অনুসরণ করতে লাগল দোতলার দিকে। জাহেদা একটু দ্রুত হাঁটছে। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দুজনের ভেতরে দূরত্ব আরো বেড়ে গেল। কিন্তু সিঁড়ির কাছে গিয়ে অপেক্ষা করল জাহেদা। তখন আবার পাশাপাশি হলো তারা। এক সাথে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

দোতলায় উঠেই দেখে প্রণব বাবু দ্রুতগতিতে বারান্দায় পায়চারি করছেন। পরনে শাদা খদ্দরের মোটা পাঞ্জাবি, সাদা জহর কোট, পাট ভাঙ্গা ধুতি, পায়ে লাল চটি। মাথায় রূপালি একরাশ তরঙ্গায়িত চুল ঝিকঝিক করছে। পাতলা ঠোঁটে সহাস্য পানের ছোপ।

বাবর ফিসফিস করে জাহেদাকে বলল, তুমি ঘরে যাও। প্রণব বাবু ততক্ষণে পায়চারি করে উল্টোদিকে ফিরতেই বাবরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। শরৎ কালের মেঘের মত হাসতে হাসতে কাছে এসে প্রণব বাবু হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, কী সৌভাগ্য! মশাই দোকানে আপনার চিঠি পেয়েই সেই থেকে পায়চারি করছি।

তাই নাকি?

আরে হ্যাঁ। একবার ভাবি চলে যাই, পরে আসব। আবার ভাবি দেখিই না একটু। সেই যে অভিজ্ঞান শকুন্তলম-এ আছে— গচ্ছতি পুরঃ শরীরং ধাবতি পশ্চাদ সংস্থিতং চিতঃ। চীনাংশুকামিব কেতোঃ প্ৰতিবাতংনীরমানস্য। অর্থাৎ কিনা যাচ্ছি বটে, মন পেছনে পড়ে রইছে, যেন নিশান যাচ্ছে সমুখে, পতপত করছে পেছনে। হাঃ হাঃ। আছেন কেমন?

ভাল। এলাম। আপনাদের দেশ দেখতে।

খুব ভাল করেছেন, খুব ভাল করেছেন। আমি মশাই সৰ্বক্ষণ আপনার কথা চিন্তা করি। এই কালও কাকে যেন বলেছিলাম। চলুন, কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবেন, নিয়ে যাই আপনাকে। সঙ্গে মহিলা দেখলাম।

আমার বোন।

বা বা বা। প্রীত হলাম। তাহলে দয়া করে একবার গরিবের বাড়িতে পদধূলি দিতে হয়। চাট্টি খাবেন।

নিশ্চয়ই। আপনার নিরামিষ খাবার গল্প কত শুনেছি।

মশাই, সাত পুরুষের অভ্যোস। সাত পুরুষ থেকে নিরামিষাশী। আপনাদের কেমন লাগবে জানি না, তবে যত্নের কোনো ক্রটি রাখব না। হাঃ হাঃ। আজ রাতে?

হ্যাঁ, আজ রাতটা আছি। আজ রাতে মন্দ কী।

সেই ভাল। বসে বেশ গল্প গুজব কিবা যাবে। অনেক দিন থেকে মশাই আড্ডার জন্যে প্ৰাণটা আইটাই করছে। এখন কী করছেন?

এই বাইরে থেকে বেড়িয়ে এলাম। তাহলে যান মশাই, স্নানাহার করে নিন, একটু বিশ্রামও হোক। আমি ও-বেলা আসব। এই চারটের সময়?

সে-কী! একটু বসবেন না? একটু বসুন। কদিন পর দেখা।

তাতো বটেই। তবে কিনা দ্বিপ্রাহরিক আহামের সময়। চোখের দেখা হয়ে গেল, মনটাতে আর আক্ষেপ নেই। আপনি আরাম করুনগে। ঐ কথাই রইল। রাতে গরিবালয়ে চাট্টি খাবেন। ন চেন্দন্যকাৰ্য্যাতিপাতঃ প্রবিশ্য প্রতিগুহ্যতামাতিথেয়ঃ সৎকারঃ। আর বিকেলে আমি আসছি।

পিঠ চাপড়ে দিয়ে চটি ফটফট করতে করতে প্রণব বাবু চলে গেলেন। যেন একটা নির্মল আনন্দ কোথা থেকে হঠাৎ মনটাকে আলোকিত করে চলে গেল। তিন পুরুষ আগে এখানে জমিদারি কিনেছিলেন ওরা। এখন শুধু শীলতাটুকু আছে। মাঝে মাঝে জন্মভূমি বারানসিতে যান, ছেলেমেয়েরা সব সেখানেই, কিন্তু নিজে থাকতে পারেন না। রংপুরে পড়ে থাকে মনটা। জমিজমার কাজে হাইকোর্ট সেক্রেটারিয়েট আছে, সেই সূত্রে ঢাকা যেতে হয়। একবার এক ভাওয়াইয়া গায়কের সঙ্গে টেলিভিশনে বেড়াতে এসেছিলেন প্রণব বাবু। সেই তখন আলাপ। প্রথম আলাপেই ভারি ভাল লেগেছিল তাঁকে, বিশেষ করে ঐ সংস্কৃত উচ্চারণগুলো ভারি চমৎকার শোনায়। কতবার বলেছেন, রংপুরে এলেই মশাই আমাকে স্মরণ করবেন।

চৌকিদারকে খাবার আনতে পাঠিয়ে ঘরে ঢুকল বাবর। দেখল জাহেদা ছোট্ট আয়না তুলে মুখ দেখছে। জিগ্যেস করল, চলে গেলেন?

হ্যাঁ।

এই রকম চুল শাদা বুড়ো আপনার বন্ধু?

আমিও তো বুড়ো। হাসতে হাসতে বাবর খাটের ওপর বসল। যোগ করল, বুড়ো নাই? তুমি যে তখন বলছিলে।

জাহেদা ভ্রুকুটি করে তাকাল। তারপর আয়নার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, আমার কথা জিগ্যেস করেনি?

করেছে।

পরিচয়টা কী দিলেন?

নিঃশব্দে সব কটা দাঁত বের করে হাসল বাবর। জাহেদা আবার চোখ কালো করল। নিঃশব্দে সালতামামী করতে লাগল চেহারার। বাবর একটা সিগারেট ধরাল। খাবার এলে খেল ওরা দুজন। খেতে খেতে নেমন্তনের কথা জানাল বাবর। খাওয়া শেষে জাহেদা বলল, আপনি বাইরে যান।

কেন? বাইরে কেন?

আমি একটু শোব। যান।

বাবর আবার নিঃশব্দে হাসল। তারপর বনবেড়ালের মত পায়ে আরাম চেয়ারটা বাইরে এনে বসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *