সারা দুপুর সুরাপান করল বাবর।
হাঃ হাঃ। তুমি কোথায় আছ? অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে, যেখানে আগেও ছিলে, এখন আছ এবং পরেও থাকবে। তার এক বন্ধুকে প্ল্যান্টার্স পাঞ্চ খেতে দেখেছে মাঝে মাঝে। সে নিজে কোনোদিন চেষ্টা করেনি। কোন কোন সুরা মিশিয়ে করে তাও জানে না। গেলাশের নিচের দিকটা লালচে, ওপরে সোনালি–অস্বচ্ছ, দয়াহীন একটি পানীয় বলে ওটাকে তার মনে হয়েছে। আজ সে আনিয়ে চেখে দেখল এবং পছন্দ করল!
আবার আনাল একটা। মাথার ভেতরটা নিমিষে শূন্য হয়ে গেল যেন। মনে হলো ফেরেশতার মত জ্যোতির্ময় তার দেহ। আদিতে ইবলিসও তো ফেরেশতাই ছিলেন। না, যদি আমাকে পছদন করতে বভলা হয়, আমি হতে চাইব মিকাইল, বৃষ্টির ফেরেশতা, কিন্তু ইস্রাফিলের শিঙ্গা আমি চাই। ওটা আমার খুব পছন্দ। বাবর নিজেকে যেন দেখতে পেল ঘন কালো মেঘের অন্তহীন স্তরে জ্যোতির্ময় দেহে দাঁড়িয়ে আছে নগ্ন নিরাভরণ মিকাইলের শিঙ্গা হাতে। নিচে লাল কার্পেটে আচ্ছাদিত নীল দেয়ালে জানালাবিহীন এক বিশাল হলে মেয়েরা আসে যায় এবং মাইকেল এঞ্জেলোর গল্প করে। সেই ছবিটা কি মাইকেল এঞ্জেলোরই আঁকা? ঈশ্বরের প্রসারিত তর্জনী থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের হাত–ব্যগ্র একটি হাত। মাঝে সামান্য দূরত্ব কিন্তু কী অসীম, অলংঘনীয়; অনন্ত তো দেখা যায় না। কিন্তু দেখা গিয়েছে। এখানে। বিবৰ্ণ ব্ৰাউন একটি অনন্ত, ঈশ্বর ও মানুষের আঙুলের মাঝখানে।
সিগারেট কিনতে, প্রস্রাব করতে এবং বাইরের বাতাস নিতে বাবর বেরুল। সিগারেট কিনতে গিয়ে উল্টা দিকের কাউন্টারে দেখল সারি সারি প্রসাধনী সাজানো। মৃত সুন্দর সব শিশুদের বিয়োগ স্মরণে নির্মিত মিনারের মত দাঁড়িয়ে আছে লিপস্টিকের পেন্সিলগুলো। একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব সুসম। এক উচ্চতা, এক বোধ, এক নিস্তব্ধতা। প্রত্যেকটির মাথায় ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার বৃত্তাকার বর্ণলেখ। সেই সব বর্ণে মৃত শিশুদের সহাস্য দুর্বোধ্য কাকলি প্রস্তরীভূত হয়ে আছে। দেখাতে বলল। যখন হাতে নিল তখন আর কিছু মনে হলো না। বাবর হাসল। এবং নিতান্ত চক্ষুলজ্জার খাতিরেই একটা কিনল।
তারপর এলো বাথরুমে। ঝাঁঝাল অনিশ্চিত একটা সুগন্ধ বাতাসে ঝকঝকে শাদা শাদা পাত্র ন্যাপথালিনের বল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কোথায় যেন অপারেশন থিয়েটারের সঙ্গে অত্যন্ত সাদৃশ্য আছে। তেমনি যেন মৃত্যুকে স্মরণ করায়। নিঃসঙ্গ করে তোলে সহসা। বোতাম খুলে চোখ তুলে তাকিয়ে বাবর দেখতে পেল নিজেকে ঝকঝকে আয়নায়। সমস্ত মুখ ফোলা ফোলা লাগছে, মনে হচ্ছে দীর্ঘ একটা স্বপ্নহীন ঘুম থেকে এইমাত্র উঠেছে সে। গালে হতে দিয়ে দেখল। এরই মধ্যে কর্কশ হয়ে এসেছে, কালচে দেখাচ্ছে। গলার উপর হাত রেখে অনুভব করল সেখানে জীবন স্পন্দিত হচ্ছে টিপ টিপ করে। ঠোঁটের দুপাশে ময়লা জমে শুকিয়ে আছে। বাবর পকেটে হাত দিল রুমালের জন্য। রুমালের বদলে হাতে ঠেকল সদ্য কেনা লিপস্টিকটা।
বের করল সে। আস্তে আস্তে তার ক্যাপ খুলে নিচের চাকতি ঘুরিয়ে দিতেই মাথা উঁচু করে উঠল। লাল মাথাটা। ঘুমের মধ্যে প্রস্রাব পাওয়া শিশ্নের মত। কার্তিকের কুকুরের মত। লাল, দৃঢ়, মসৃণ, আলো ঠিকরাচ্ছে, যেন আমন্ত্রণ করছে। বাবর তার নিচের দিকে তাকাল। শেষ বিন্দুটা এখনো মাথায় জ্বলজ্বল করছে, এখনো যথেষ্ট হয়নি বলে পড়ছে না। বাবর একটা আলতো টোকা দিয়ে ফোটোটাকে ফেলে দিল এবং সেখানে ছোঁয়াল লিপস্টিকের লাল মাথা। সঙ্গে সঙ্গে একটা শিহরণে কুঞ্চিত হয়ে উঠল যেন তার সমস্ত স্নায়ু। দ্রুত হাতে সরিয়ে নিতেই দেখল। লাল দাগ পড়েছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সে। বাবলির কথা মনে পড়ল। বাবলির ঠোঁটের রং ঠিক এই রকম–আবছা লাল।
চারদিকে তাকিয়ে দেখল বাবর। না, কেউ নেউ। কান পেতে শুনল। না কেউ আসছে না। দ্রুত হাতে আয়নার ওপর লিপস্টিক দিয়ে লিখল MAKE LOVE NOT VVAR তারপর পেছনে আরেকটা দরোজা খুলে কমোডের মধ্যে ফেলে দিল লিপস্টিকটা। চলে আসছিল, দেখে ক্যাপটা হাতেই রয়ে গেছে। সেটা আরেকটা কমোডে ফেলে দিল। সাদা পোর্সিলিনে লেগে টং করে শব্দ করে উঠল, যেন চমকে উঠল একটি নিস্তব্ধতা।
বইটা দেখে বাবলি দপ করেজ্বলে উঠবো! কিন্তু কিছু বলতে পারবে না। বাবর কল্পনা করে মজা পেল, ভেতরের চাপা আক্ৰোশে বাবলি শুধু এঘর ওঘর করছে। এক সময় হয়ত সে টেলিফোন করবে। টেলিফোন তাকে করতেই হবে। আজ রাতেই সে করবে। যাক, একটা ভাল চাল দেয়া গেছে। বইটা কিনে বড় উপকার করেছে সে নিজের।
কে একজন খুব লম্বা লম্বা পা ফেলে বাথরুমে ঢুকল। লোকটার একটা হাত এখনি ট্রাউজারের বোতামে। বড্ড জোর লেগেছে বোধ হয়। প্রস্রাব বেরিয়ে যাওয়ার পর অনাবিল তৃপ্তিতে চোখ তুলেই লোকটা আয়নায় দেখতে পাবে MAKE LOVE NOT VVAR হাঃ হাঃ। বাবর কি বাইরে অপেক্ষা করবে লোকটা ফিরে আসা পর্যন্ত?
আচ্ছা, দেখা যাক না। লোকটা বেরিয়ে এলে তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। লেখাটা দেখে প্ৰতিক্রিয়া কী হয়েছে।
চকিতে বাবরের মনে পড়ল শ্যারণ টেটকে হত্যা করার পর হত্যাকারীরা বড় বড় করে লিখে গিয়েছিল PIGS — শুয়োরের দল। সব শালা শুয়োর। উদ্দেশ্যহীন একটি হত্যা—একটি নয়, এক সঙ্গে চারটি। যারা হত্যা করেছে তারা স্বীকার করেছে নিহতদের সঙ্গে আগে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না। প্রথম দৃষ্টিতে প্ৰেম! হাঃ প্রথম দেখাতেই মৃত্যু, রক্তপাত, হত্যা। প্রথম দেখাতে যদি প্রেমে পড়া সম্ভব হয়, চিরকাল লোকে তো একে আদর্শ একটা ঘটনা বর্ণনা করে এসেছে, তবে প্রথম দেখাতেই কাউকে হত্যা করার ইচ্ছে হবে না কেন। আমাকে বোঝাও বাপ। হাঃ। যত সব কেঁদো শুয়োরের দল।
লোকটা বেরিয়ে এলো। মুখ তার লাল। বাবরের দিকে চোখ পড়তেই লজ্জায় দ্রুত চোখ নামিয়ে এলোমেলো পায়ে প্রায় দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। যেন বাথরুমে লেখাটা সে-ই লিখেছে। আরে, আরে, মজা দেখ। এই রকম অনুভূতি, এই রকম প্রতিক্রিয়া প্রবল হলে লোকে যাজক হয়, নেতা হয়, বিশ্বপ্রেমিক হিসেবে অভিনন্দন কুড়োয়, তার জীবনী পড়ে পরীক্ষা পাশ করতে হয়। তোমার পাপে আমি অনুতপ্ত, লজ্জিত। তোমার দুঃখে আমি কাঁদি। তোমার পতনে আমি রক্তাক্ত হই।–ব্যাস, এই তো কথা! যীশুখ্রিষ্টও এই বলেছেন। হযরত সারারাত জেগে খোদার কাছে মুক্তি চেয়েছেন মানুষের।
হাঃ খেলে যা। খেলে যারে খেলারাম। খেলে যা।
বাবর বারে এসে বিল শোধ করে বেরুল। পকেটে এখনো একরাশ টাকা। সেই হাজার টাকা থেকে একশ টাকাও এখনো পুরো ভাঙ্গেনি। হতরনকে একবার টেলিফোন করে দিতে হয়, আলতাফকে যেন না বলে গহনার টাকা সে দিয়েছে।
হ্যালো। আমি বাবর।
হতরন অধীর গলায় উচ্চারণ করলেন, আপনাকে অফিসে টেলিফোন করেছিলাম। ওরা প্ৰথমে বলল আছেন, তারপর বলল—
বেরিয়ে গেছিলাম। টেলেফোন করেছিলেন কেন?
কিছু না, এই এমনি। আপনাকে শুধু বলতে যে, বুলুর মা বলল..
বুলু কে?
আমার মেয়ে। ঐ যার বিয়ে। বুলুর মা বলল, আপনাকে নাকি ঠিক মত আমি যত্ন করিনি। এক কাপ চা খেয়ে গেলেন না। আপনার মত দয়ালু, মহৎ লোক পৃথিবীতে আছে বলেই—
বাবর যোগ করল, পৃথিবী এখনো চলছে, তাই না?
জি? হতরন সাহেব যেন হকচাকিয়ে গেলেন।
বাবর বলল, আমি আপনার কথাটাই শেষ করে দিলাম–আমার মত মহৎ, দয়ালু, না দয়ালু আগে বলেছেন, দয়ালু, মহৎ লোক পৃথিবীতে আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো আছে, চলছে।
জি।
হতরন সাহেবের ঢোক গেলার শব্দটা পর্যন্ত স্পষ্ট শুনতে পেল বাবর। তখন বলল, আসব। নাকি চা খেতে। বলুন তো আসি।
জি।
হতরন এবার সত্যি সত্যি বিমূঢ় হয়ে গেছেন। বাবরের খুব মজা লাগল তখন।
কি আসব?
আসবেন না কেন? সে তো আপনার অনুগ্রহ।
নাহ, এখন আসব না।
কেন, কেন?
এখন মাল খাচ্ছি।
জি!
মাল! মানে মাদ। হুইঙ্কি। খেয়েছেন কখনো?
জি, ওসব মানে আমি, আমার, আমি গোঁড়ামি পছন্দ করি না, তবে খাইনি কোনোদিন। খান আপনি খান। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম আপনার এই উপকারের কথা সারা জীবন মনে থাকবে। বলতে গেলে বাপের কাজ করলেন আপনি।
বাপের কাজ আর কাকে কাকে দিয়ে করালেন।
মানে?
বাবরের ভারি রাগ হলো লোকটার ওপর। চটছে না কেন? এখন যদি তাকে দুটো কড়া কথা শোনাত, টেলিফোন ঠাস করে রেখে দিত তাহলে বোঝা যেত তার পৌরুষ আছে। মানুষ এত ভীরু হয় কী করে? নিজেকে এতটা বিকিয়ে দেয় সে কীসের অভাবে? কীসের তাড়ায়?
কিছু না, কিছু না। বলল বাবর।
নইলে বুলুর মা খুব মাইণ্ড করবেন। আমাকে বারবার করে বলে দিয়েছেন।
দুস সাহেব। আপনার বৌ মাইণ্ড করবে। আস্তে বলুন। লোকে কী ভাববে।
জি।
যান, মাথা ঠাণ্ডা করে শুয়ে থাকুন গে। রোজার দিন।
জি।
কি, রোজা আছেন তো?
জি, আছি। থাকব না কেন?
পরকালের রসদ যোগাড় করছেন?
কী যে বলেন।
এ কালের রসদ তো অনেক হয়েছে কী বলেন।
জি?
না, কিছু না। আর শুনুন, আলতাফকে বলবেন না ঐ টাকার কথাটা।
জি না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, তাকে বলবই না। বলার কোনো সুযোগই হবে না। যে উপকার আপনি করলেন—
তার বিনিময়ে এই ঠাস করে রেখে দিলাম টেলিফোন-মনে মনে বলতে বলতে লাইন কেটে দিল বাবর। ওহ, কৃতজ্ঞতা! ল্যাজ থাকলে আদুরে কুত্তার মত তিরতির করে এখন নাড়াত হতরন। কুঁই কুঁই করত। আর পা শুঁকত। মানুষের আবার কত বড় কথা—আমরা পশু নই, মানুষ। বাবার তাকে টাকা দিয়ে নিজের জন্য আর একটা প্রমাণ সংগ্ৰহ করল, মূলত পশুর সঙ্গে মানুষের কোনো তফাৎ নেই। বরং মানুষ পশুরও অধম। এতক্ষণ একটা পশুকে খোঁচালেও সে থাবা বের করে দাঁত খিচিয়ে উঠত। আর হতরন বেমালুম সব হজম করে। গেল। মানুষ যে বুদ্ধি বিবেচনা রাখে! কত ধানে কত চাল হয় তার হিসেব বোঝে!–তাই।
বড় ক্লান্তি লাগছে। ঘুম পাচ্ছে বাবরের। মনে হচ্ছে, একটা দিন, একটা জীবন যেন অপচয়ে নিঃশেষ হয়ে গেল আজ। খুব ধীরে গাড়ি চালিয়ে সে পথের পর পথ অতিক্রম করতে লাগল। পেছনে যার তাড়া আছে তাকে পথ করে দিতে লাগল ক্ৰমাগত। যাও সবাই এগিয়ে যাও। কারণ যাওয়াই তোমরা জীবনের মোক্ষ বলে মনে কর। সবাইকে পেছনে ফেলে। এগিয়ে যাওয়া। সেই জন্যই পথ তোমরা ক্রমশ প্রশস্ত করে তৈরি কর, নইলে পালা জমবে কেন? কাউকে পেছনে ফেলে যেতে কী সুখ মানুষ নামক জন্তু না হলে উপলব্ধি করা যায় না।
দিই আটকে?
একটা সাদা ফুরফুরে গাড়ি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ তাকে খেলাবার ইচ্ছে হলো বাবরের। চট করে ডাইনে কেটে গতি শ্লথ করল সে। ঘ্যাঁস করে ব্রেক করল সাদা গাড়ি। ঘাড়ের পরে উঁচু করে বাঁধা খোঁপার নিচে এক মহিলা চালাচ্ছিলেন। বিপ্লক্তিতে ভ্রুকুটি করে তাকালেন তিনি বাবরের দিকে। ভ্রুকুটি বোঝা গেল তার কালো চশমার ওপরে ভ্রু যুগলের আকস্মিক উর্ধ্ব বিন্যাসে। বাবর হাঃ করে হেসে নিজের গাড়ি সরিয়ে নিল। মহিলাটি তীরের মত বেরিয়ে গেলেন পেছনে সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে! সমাজে অনুচ্চার্য একটি কথা মনে হতেই বাবার টিপে আপন হাসি সংবরণ করল।
বাসায় এসে দেখল দরোজা খোলা, খোলা মানে ভেজান। তালা লাগান নেই। অথচ কতদিন সে বলে গিয়েছে তালা লাগিয়ে রাখতে।
মান্নান, মান্নান।
পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল ব্যাট। ডাক শুনে চোখ ডলাতে ডলাতে এলো।
দরোজা খুলে ঘুমাচ্ছিস? কতদিন এক কথা বলব? কত দিন বলতে হবে?
স্যার–
ইডিয়েট! ফের যদি দরোজা খোলা দেখি পাঁচ টাকা জরিমানা করব। লাট সাহেব হয়েছ। লর্ড লিনলিথগো?
স্যার–মান্নান কী যেন বলতে চাইল।
চুপ! কোনো কথা শুনতে চাই না। আউট।
দরাম করে দরোজা লাগিয়ে ভেতরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বাবর। ড্রইংরুমের চারদিকে পর্দা টানা। প্ৰায় সন্ধ্যার মত অন্ধকার। তেমনি শীতল। দেয়ালে ঝোলান মাটির তৈরি নিগ্রো মেয়েটার মাথা। টেলিভিশনের ওপর একটা তেলাপোকা স্থানু হয়ে আছে। লাইফ ম্যাগাজিনের খোলা পাতায় হাঁ করে বিকট গোলাপি মুখ দেখাচ্ছে এক শিম্পাঞ্জী। ড্রামের দুই বীটের মাঝখানে তুরিত স্তব্ধতার মত টানটান হয়ে আছে। সারাটা ঘর। বাবর একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। চোখ বুজল। তারপর ক্লান্ত পায়ে ড্রইয়ং রুমের দৈর্ঘ্যটা কোণাকোণি পার হয়ে খাবার ঘরের পাশ দিয়ে জাল ঢাকা করিডোর অতিক্রম করে শোবার দরোজায় ঠেলা দিল।
নিভাঁজ বিছানা কোল বাড়িয়ে ডাকল তাকে। এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে দেখল সে। ছবির মত সাজানো বালিশ, চাদরের হালকা নকসা, পায়ের কাছে সরু কার্পেটের কোমলতা, পাশে পরিষ্কার ছাইদানি, ঘাড় নামানো পড়ার বাতি।
উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল বাবর পায়ে-পায়ে মোকাসিন জোড়া খুলে ফেলতে ফেলতে। মুখ গুঁজে পড়ে থাকল ঠাণ্ডা পাউডার নীল বালিশের ওপর। উপলব্ধি করতে পারল, কী উত্তপ্ত হয়েছিল তার সারা দেহ এতক্ষণ। মুখ আরো গুঁজে দিয়ে, মায়ের কোলে শিশুর মত মাথা ঘষতে ঘষতে সে কয়েকটা অব্যয় ধ্বনি সৃষ্টি করল। তখন আরো ভাল লাগল। সে ঘুমে উচ্চারিত ছড়ার মত বলে যেতে লাগল–আহ, ইস, ইস, ইস।
মোজা জোড়া বড্ড অস্বস্তিকর লাগল তার পায়ে। সে মোজা খোলার জন্যে পাশ ফিরে হঠাৎ দরোজার দিকে চোখ পড়তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। এক হাত রইল তার গুটিয়ে আনা পায়ের পাতায়, আরেক হাত পাঁজরের নিচে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে এলো কিছু বলার জন্যে কিন্তু বলতে পারল না। কুয়াশার মধ্যে সূর্যোদয়ের মত সেখানে ফুটে উঠতে লাগল, ধীরে, অতি ধীরে একখণ্ড চাপা হাসির আলো।
দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জাহেদা। জাফরান রংয়ের পাজামা পরনে। গায়ে সাদার ওপরে বড় বড় জাফরান সূর্যমুখী জামা। চোখে একটা ভয়।
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। একটা শ্লথ বিদ্যুৎ যেন এর চোখ থেকে ওর চোখে ক্ৰমাগত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল। কিম্বা একটি প্রজাপতি, বাগানে যে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, কোন ফুলে বসবে।
বাবার উঠে বসল। বলল, তুমি? তুমি কখন?
বাবার উঠে গিয়ে জাহেদার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, কখন এলে?
তাকে হাত ধরে বিছানার পাশে লাল চামড়ায় ঢাকা মোড়ার ওপর বসিয়ে, নিজে বিছানায় বসে, আবার বলল, কতক্ষণ এসেছ?
এই প্রথম জাহেদকে সে স্পর্শ করেছে। এখন মনে হচ্ছে জাহেদার এক মুঠো রেণু তার আঙুলে জড়িয়ে গেছে। বাবর আঙুলগুলো একটার ডগায় আরেকটা তখন অনবরত ছোঁয়াতে লাগত।
জাহেদা বলল, সকালে।
সকালে এসেছ? আমি যে তোমার কলেজে গিয়েছিলাম।
আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। নইলে সিসটার খোঁজ করবেন।
কী ব্যাপার?
পাঁচটার পর সিসটার ঘরে ঘরে দেখে যে।
তা নয়। আমি ভাবতেই পারিনি তুমি আসবে।
এলাম।
দুপুরে খাওনি?
না।
এ ভারি অন্যায়। মান্নানকে বললেই পারতে। বলা উচিত ছিল তোমার। কেন বলনি?
ও বলল আপনি আসবেন, এক্ষুণি আসবেন।
আমি খুব লজ্জিত, দুঃখিত। একটু খবর দিয়ে আসতে হয় না?
জাহেদা চুপ করে রইল। তারপর বলল, ফ্ৰীজ থেকে একটা কোকাকোলা খেয়েছি।
যাহ, শুধু ঐ খেয়ে দুপুর কাটায় নাকি? আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি। এক মিনিট।
না, না, আমি এখন যাব।
অসম্ভব। আগে খাবে, তারপর।
না, যেতে হবে যে!
তাহলে চল, কোথাও বসে খাই।
বাইরে যাব না।
সেই তো বলছি। মান্নান এক্ষুণি পরোটা বানিয়ে দেবে। ওমলেট দিয়ে খাও। আচ্ছা, স্যাণ্ডউইচ। কোন্ড বীফ আছে। আমি নিজে করে দিচ্ছি।
জাহেদা অস্পষ্ট একটু হাসল।
বাবর বলল, বিশ্বাস হলো না বুঝি? আচ্ছা, খেয়েই দ্যাখ আমি বানাতে পারি কি-না! দুমিনিট লাগবে।
খাবার ঘরে গিয়ে রুটি কেটে চটপট দুটো বড় স্যাণ্ডউইচ বানাল বাবর। কেটলিতে পানি চাপিয়ে দিল। তারপর ট্রেতে স্যাণ্ডউইচ, গেলাশ, ঠাণ্ডা পানি বোতল সাজিয়ে শোবার ঘরে এসে দেখে জাহেদা নেই; হৃদপিণ্ড ধ্বক করে উঠল তার।
চলে গেল?
ড্রইংরুমে এসে দেখে জাহেদা বড় সোফার মাঝখানে হাঁটু জড়ো করে বসে আছে। দেখে তার ভীষণ মায়া হলো। মনে হলো হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি মেয়ে।
তুমি এখানে?
জাহেদা আবার অস্পষ্ট ম্লান হাসল।
খাও। আগে খেয়ে নাও। তারপরে কথা। কফি হচ্ছে। কই খাও? আচ্ছা আমি কফিটা দেখে আসছি।
দুপেয়ালা কফি বানিয়ে ফেরত এলো বাবর। দেখল জাহেদা তখন সবে একটা স্যাণ্ডউইচের কোণ ভেঙ্গেছে মাত্র।
কেন, ভাল হয়নি?
ক্ষিধে নেই।
তা বললে চলবে কেন? খেতেই হবে। না খেলে রাগ করব। আমি নিজ হাতে বানালাম তোমার জন্যে।
খাচ্ছি।
খাও। হোস্টেলে তো আর খেতে পাও না।
কী যে বলেন। আমরা বাইরে থেকে কত কিছু আনিয়ে খাই।
কফি খাও। কফির সঙ্গে ভাল লাগবে। কী আশ্চৰ্য, সকালে এসেছি, আর আমি কলেজে খুঁজে এলাম। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি এসেছি, আমার সামনে বসে আছ, আমি তোমার জন্যে স্যাণ্ডইউচ বানিয়েছি, তুমি খাচ্ছি। মাঝে মাঝে বাস্তব এত ভাল মনে হয় যে মনে হয় স্বপ্ন, বেশি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, পাছে নষ্ট হয়ে যায়।কই আরেকটা রইল যে! ওটাও খেতে হবে। খাও। পারবে খেতে। তোমার কলেজে দুবার গিয়েছিলাম। আমি বলি, জাহেদা গেল কোথায়। আর তুমি আমার এখানে বসে আছ। নিজেকে ক্ষমা করতে ইচ্ছে হয় না। আরেকটু কফি দিই? দাও কাপটা দাও।
বাবর কাপটা নিয়ে খাবার ঘরে গেল; কাপের রীমে জাহেদার ঠোঁট থেকে আবছা রং লেগেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল বাবর। তারপর সেখানে ঠোঁট দিয়ে সমস্তটা রং তুলে নিল। মোমের মত মসৃণ লাগল এখন তার নিজের ঠোঁট। শিরশির করল সমস্ত শরীর। আবার সেই বিদ্যুৎ চলাচল করতে লাগল স্নায়ুতে। সে তাড়াতাড়ি কফি বানিয়ে ফিরে এলো জাহেদার কাছে।
বলল, বাবলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
এমন সাধারণ কণ্ঠে বাবর প্রশ্নটা করল যেন সিগারেট ধের করে দেশলাই আছে কি-না ख्रिgठन दरिद्धक्ष्।
জাহেদা উত্তর করল, বাবলি?
হ্যাঁ, ঐ যে তোমার বান্ধবী।
কাল এসেছিল।
কোথায়। হোস্টেলে?
হ্যাঁ।
ভাল আছে তো।
বোধ হয়।
বোধ হয় কেন?
বড্ড মনমরা দেখলাম।
প্ৰেমে ট্রোমে পড়েছে নাকি।
দূর।
দূর কেন? এই বয়সে একটা প্রেমে না পড়লে কেমন কথা?
যান। আপনি। কী যে বলেন।
তাহলে মনমরা দেখলে?
না, তাও ঠিক না। কেমন যেন। অনেকক্ষণ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকল। তারপর আমি সুপারের কাছে গেলাম বাড়ি থেকে টাকা এসেছিল, আনতে। এসে দেখি বাবলি নেই।
শুনলাম চলে গেছে।
শরীর খারাপ ছিল না তো?
প্রশ্নটা শুনে জাহেদা ভীষণ লজ্জা পেল। এই বয়সের মেয়েরা শরীর খারাপ বলতে প্ৰথমেই একটা কথা বোঝে। তুলোর রোল চোখে দেখতে পায়। জাহেদা আড়চোখে একবার বাবরকে দেখল। তারপর বলল, না বোধহয়।
বাবর একবার ভাবল চিঠিটার কথা জিগ্যেস করে। আবার ভাবল, না, থাক। বাবলি যদি চুরি করে দেখে থাকে তাহলে জাহেদা খামকা বিচলিত হয়ে পড়বে। হয়ত তার সঙ্গে উত্তর বাংলায় যেতে রাজি হবে না। অথচ তাকে নিয়ে যাবে বলে মনে মনে পণ করে বসে আছে বাবর।
জাহেদা চুপচাপ কী যেন ভাবতে লাগল। কফির পেয়ালা হাতে করে।
আরেকটা স্যাণ্ডউইচ দিই?
না না।
চকোলেট খাবে?
না।
আজ সব কিছুতেই না করছি যে।
কই, না।
বলেই হেসে ফেলল জাহেদা। আবার একটা না বলেছে সে। বলল, আপনি কথা এত ধরতে পারেন!
যাদের পছন্দ করি তাদের কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি যে! তুমি বোধহয় আমাকে একটুও পছন্দ কর না।
কেন?
উদ্বেগ ভরা চোখে জাহেদা তার দিকে তাকাল।
এই জন্যে বলছি যে, তুমি আজ কিছু বলছ না। শুধু আমি বলে যাচ্ছি।
জাহেদা চুপ করে রইল।
বাবর বলল, কি সত্যি। কিনা, বল?
জাহেদা বলল একেবারে অন্য কথা, যেন কথা বলে প্রমাণ দিতে চায় বাবর যা মনে করে তা ভুল। বলল, এসে পরপর দুকাপ চা খেয়েছি। আপনার যত পুরনো ম্যাগাজিন ছিল সব পড়েছি।
এতক্ষণে বাবর বুঝতে পারল শিম্পাঞ্জির ছবিটা আমন খোলা পড়ে ছিল কেন?
জাহেদা বলে চলল, যা ঘুম পাচ্ছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর হঠাৎ শুনি আপনি চেঁচামেচি করছেন। শুনে কী যে ভয় করতে লাগল। কোনোদিন তো আপনাকে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি।
লজ্জিত কণ্ঠে বাবর বলল, এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারিনে। কাজে কর্মে শুধু ভুল করে। না চেঁচিয়ে উপায় থাকে না।–তাই বুঝি দরোজায় লুকিয়ে ছিলে?
লুকাইনি তো।
তবে তোমাকে দেখলাম না যে।
দেখবেন কী। আপনি তো এসেই দুম করে শুয়ে পড়লেন।
বাবর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তা ঠিক।
জাহেদা মুখ গোল করে বলল, যদি কোনো চোর হতো।
কী আর হতো। চুরি করে নিয়ে যেত।
মুখে ও-রকম বলা যায়। চুরি হলে তখন দেখতাম।
চুরি যে হয়নি। তাই বা কী করে বলি?
বলেই বাবর চকিতে দৃষ্টি গাঢ় করে তাকাল জাহেদার দিকে। জাহেদা একটু অপ্ৰস্তুত, একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। তবু জেদ করেই যেন বলল, কী চুরি হয়েছে। আপনার শুনি?
তখন কথাটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে, যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমনি আকস্মিকতার সঙ্গে বাবর বলে উঠল, আরে, লতিফার খবর রাখ?
কে?
লতিফা, লতিফা।
সেই যে আপনার ভাই-ঝি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তার খবর শুনেছ? সে বিয়ে করছে।
মেয়েরা বিয়ে করে নাকি? তাদের তো বিয়ে হয়।
এটাকে বিয়ে করাই বলতে পার। ও নিজে সোধে বিয়ে বসছে।
কার সাথে?
আমারই এক ভাইপোর সাথে। ব্ৰিলিয়ান্ট ছেলে। ভালই তো। কবে বিয়ে?
এই সামনেই। তোমরা একে একে এভাবে বিয়ে করলে আমার কী অবস্থা বল তো। মনে হয় বুড়িয়ে যাচ্ছি।
বারে! বয়স হলে বুড়ো হবেন না?
তা ঠিক। না, ঠাট্টা নয়। তোমরাই আমার বয়সটা বাড়িয়ে দিলে। এই তো দ্যাখ না। দুদিন বাদে শাড়ি পরবে, তখন রীতিমত মহিলা। তোমাকে দেখে মনে হবে, নাহি সত্যি সত্যি সময় চলে গেছে।
আমি কোনোদিন শাড়ি পরব না।
কেন?
এমনি। আমার ভাল লাগে না।
আমারো ভাল লাগে না। তুমি ঠিক বলেছ। তোমার এই জামাতে তোমাকে যা ভাল লাগে, শাড়িতে তার অর্ধেকও লাগবে না।
জি না। শাড়িতেও আমাকে মানায়। সবাই বলে। মাঝে মাঝে শখ করে পরি।
তোমার নীল জামাটা কই?
কোন নীল জামা?
সেই যে, যেটা পরলে তোমাকে খুব ভাল দেখায়। একদিন আমার সঙ্গে নিউ মার্কেটে বই কিনতে গেলে, সেদিন পরেছিলে।
ও, সেইটা।
তাহলেই দ্যাখ, বলেছিলাম না তুমি আমাকে পছন্দ কর না?
এর মধ্যে ও-কথা কেন?
এই জন্যে যে, পছন্দ করলে আমার কথাটা মনে থাকত। আমি যখন যা বলি মনে রাখতে।
জাহেদা চুপ করে রইল কথা খুঁজে না পেয়ে।
বাবর বলল, আচ্ছা, সে যাকগে। এই জাফরান রংটাও খুব মানিয়েছে।
নতুন বানালাম। আজকেই পরেছি।
কী কাপড়?
সুতি।
দেখে তো অন্যরকম মনে হচ্ছে। বাহ দেখি।
বলে বাবর উঠে এসে জাহেদার কামিজের একটা কোণ হাতে নিযে দেখতে লাগল মনোযোগ সহকারে। আসলে, তার ভারি ইচ্ছে করছে আবার একটু স্পর্শ করতে। হাত সরিয়ে আনবার সময় ইচ্ছে করে একটু ছুঁয়ে দিল ঊরুটা। যেন একটা রাবার ফোমে এক মুহৰ্তের জন্যে হাত রেখেছিল সে। হাতটা ফিরিয়ে এনে আপন চিবুকে ছুঁইয়ে রাখল সে।
জাহেদা বলল, আজকাল কত সুন্দর প্রিন্ট বেরিয়েছে।
বাবর আরেকটা সিগারেট ধরালা।
আপনি এত সিগারেট খান?
কী করব? এছাড়া আর তো নেশা নেই।
তাই বলে একটার পর একটা?
তাছাড়া থাকি একা। সিগারেট বন্ধুর মত কাজ দেয়।
তা হোক। খাবেন না এত। এইতো আপনার এই ম্যাগাজিনেই পড়ছিলাম সিগারেট খেলেই ক্যান্সার হয়।
ক্যান্সার হলেই মৃত্যু, তাই না।
তাই তো। মৃত্যু কীসে হয় না বল। আমার কোনোদিন মৃত্যু হবে না। যদি এ ভরসা দিতে পার, ছেড়ে দেব সিগারেট।
সে ভরসা কেউ দিতে পারে?
আসলে কী জান—
আবার বক্তৃতা দেবেন তো? আপনাকে চিনি না? থাক। আপনার যদি মরতেই ইচ্ছে করে, খাবেন সিগারেট।
আচ্ছা, তুমি বলছি, তোমার কথা কি ফেলতে পারি? খাব আজ থেকে কম করে। এই এটা ফেললাম। আসলে আমার কথা হচ্ছে, যতক্ষণ বেঁছে আছি যা ভাল তাই করব। একবারের বেশি দুবার তো বাঁচব না। এই সামান্য কদিনের জন্য কী হবে এত বিধিনিষেধ মেনে আত্মাকে কষ্ট দিয়ে? যে লোকটা সিগারেট খায় না, কিম্বা শুধু সিগারেট কেন, যা করতে ইচ্ছে করে তা করে না সে যে আমার চেয়ে ভাল আছে, তার জীবন যে আদর্শ জীবন, সুখের জীবন তাও তো নয়?
বুঝি না বাবা আপনার কথা।
বুঝবে। বয়স হলে বুঝবে। এখন তো ছেলেমানুষ। বড় হও। তখন বুঝবে।
আমি এখন কিছু কম বুঝি না?
কী বোঝ।
কী আবার? সব কিছু। কটা বাজে দেখুন তো।
পৌনে পাঁচটা। তোমার ঘড়ি কী হলো?
বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। উঠি।
আর একটু বস।
উহুঁ। তাহলে হোস্টেল থেকে বের করে দেবে।
দিক, আমার এখানে এসে থাকবে।
আপনি মেয়েদের হোস্টেল খুলেছেন নাকি?
ভরসা দাও তো খুলি।
জাহেদা হেসে উঠল, বলল, মেয়েদের ঝামেলা অনেক। মাথার ঘিলু নাড়িয়ে দেবে। জিজ্ঞেস করবেন আমাদের দারোয়নকে।
সে বেটা সেই জন্যই বোধহয় গলায় ক্রুশ বেঁধেছে।
জাহেদা দ্রুত স্লিপার পরে নিল। দরোজার কাছে গেল। গিয়ে একবার ইতস্তত করল।
বাবর বলল, আমার চিঠি পেয়েছিলে?
ঘাড় কান্ত করে নীরবে হ্যাঁ বলল জাহেদা। আর সেই সঙ্গে ভারি উদ্বিগ্ন দেখাল তাকে। বাবর জিগ্যেস করল, কোনো গোলমাল হয়েছে নাকি?
না।
তাও ভাল। আমি ভাবলম চিঠিটা সুপারের হাতে পড়েছে বুঝি।
ও চিঠি পড়লেই কী।
আমিও তাই বলি। তবে তোমার কাছে শুনেছিলাম যে বেটি নাকি একটা শকুন। কেবল ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায়। চিঠি খুলে খুলে পড়ে।
এটা পড়েনি। কিন্তু–
কী কিন্তু?
যাব কেমন করে?
আনন্দে লাফিয়ে উঠল বাবরের হৃৎপিন্ড। যাবে তাহলে জাহেদা। যাবে তার সঙ্গে। এত সহজে রাজি হবে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। খুশিতে প্ৰায় জড়িয়ে এলো তার উচ্চারণ। কোনো মতে বলল, যাবে কী করে মানে? গাড়িতে যাবে।
সে নয়। হোস্টেল থেকে বেরুব কী করে?
পারবে না?
না।
কিছু একটা বলে? মাত্র তিন চার দিনের জন্য।
তিন-চার-দিন!
হ্যাঁ। যেতে একদিন, আসতে একদিন, একদিন দুদিন ঘোরাফেরা।
তাহলে থাক। অসম্ভব। বেরুনোই যাবে না।
খুব যাবে। আমি ব্যবস্থা করব।
কীভাবে?
দ্যাখ না তুমি।
তবু শুনি।
আমি একটু ভেবে দেখি।
আসলে বাবর আগে থেকেই ভেবে রেখেছে কী করে জাহেদাকে সে হোস্টেল থেকে বের করবে। চিঠিটা লেখার সময়ই ভেবে রেখেছে সে।
বলল, ভেবে দেখি কেমন? আমরা পরশু দিন সকালে রওয়ানা হবো। তুমি সকালে তৈরি হয়ে একটা স্কুটার ডেকে সোজা আমার বাসায় চলে এসো। আটটার মধ্যে। ঠিক আটটার সময় বেরুতে হবে। নইলে সন্ধ্যের আগে রংপুর পৌঁছন যাবে না।
উদ্বিগ্ন শংকিত চোখে নীরবে জাহেদা কথাগুলো শুনল। তার একটা মন রাজি হতে চাইছে না, আরেকটা মন কীসের আকর্ষণে যে এগিয়ে যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না, বারণও করতে পারছে না। কোনোমতে ঢোকা গিলে সে শুধু উচ্চারণ করল, আচ্ছা।
পরশু আটটার মধ্যে।
আচ্ছা।
আমি পৌঁছে দিয়ে আসি হোস্টেলে?
না।
আবার না বলছ?
জাহেদা করুণ ভাবে হাসল। তখন আবার সেই রকম মায়া হলো বাবরের। তাকে আদর করতে ইচ্ছে করল বাচ্চা মেয়ের মত। বদলে বলল, আচ্ছা, মান্নানকে বলছি স্কুটার ডাকতে। ততক্ষণ বস।
জাহেদা সোফার এককোণে চুপ করে জড়সড় হয়ে বসে রইল। তার কান পথের দিকে।
কখন কুঁটারের শব্দ শোনা যায়।
বাবর বলল, এখুনি এসে যাবে স্কুটার।
বাবর তাকে গভীর চোখে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে চারদিকের প্রতিটি বস্তু যেন অবলুপ্ত হয়ে গেল। রইল। শুধু জাহেদার মুখ। সে মুখে জামার জাফরান রংয়ের বিছুরিত আভা। জাহেদার ঠোঁট নড়ে উঠল একবার। টলটল করে উঠল যেন রংটা। জাফরান রংয়ের লিপিস্টিক। একটু আগে তার থেকে খানিকটা লেগেছিল। কফির পেয়ালায়। পেয়ালা থেকে নিঃশেষে তা বাবর তুলে নিয়ে নিয়েছে ঠোঁট দিয়ে। প্ৰত্যুত্তরে বাবরের ঠোঁটও যেন নেড়ে উঠল তার ইচ্ছার অপেক্ষা না করেই।
বাবর হাসল।
তখন জাহেদাও হাসল। তেমনি ভীত করুণ এক চিলতে হাসি। বলল, আজ সারাদিন কোথায় ছিলেন?
বাবর যেন কোনো কবিতার পংক্তি উচ্চারণ করছে এমনি সুরে বলল, কাজে। কাজে ছিলাম, জাহেদা। ব্যবসার কাজে। এত কাজ। যদি কাজ না করতে হতো।
জাহেদা আবার হাসল। সেই রকম।
বাবর তখন বলল, তুমি যদি যেতে না চাও তো ঠিক আছে। উদ্বিগ্ন তীক্ষ্ণ চোখে জাহেদা তাকাল। তোমার অসুবিধে হলে থাক না। পরে কখনো যাওয়া যাবে।
পরে কেন?
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, যেতে চাও না।
নাতো। কত কিছু দেখব। বাবা কোনোদিন কোথাও নিয়ে যাননি। যাব না কেন? যাব।
অনেক কিছু দেখতে পাবে। বাংলাকে জানবে। তোমরা সব ইংরাজি পড়। দেশ চেন না। নিজের দেশ না চিনলে হয়?
জানি।
সেই জন্যেই যাবার কথা যখন হলো, সবার আগে তোমার কথা মনে পড়ল। বাবা কোথাও নিয়ে যাননি তো কী হয়েছে? তুমি বড় হয়েছ। নিজেই যাবে। শুধু বাংলা কেন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। আমার এক বান্ধবী ফ্রান্সে আজ তিন বছর–
বাইরে স্কুটারের শব্দ শোনা গেল।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল জাহেদা।
যাই।
এসো জাহেদা। পরশু আটটার মধ্যে?
আচ্ছা।
আটটার আগেই এসো।
কী যেন ব্যবস্থা করবেন, বললেন না?
বাবরের একবার ইচ্ছে হলো, বলে দেয়। বলবে? না, থাক। এখন না বলাই ভাল। বলল, কাল ভোরে আমাকে টেলিফোন কোরো হোস্টেল থেকে। রাতটা ভেবে দেখি।
আচ্ছা।
জাহেদা স্কুটারে গিয়ে বসল। ড্রাইভার ভাবল, বাবরও বুঝি আসবে। বাবর তখন তাকে ইশারা করল যেতে। জাহেদা গলা বাড়িয়ে বলল, খোদা হাফেজ।
বাবর হাত নাড়ল। শূন্য ফটকে দাঁড়িয়ে ভাবল, মেয়েটা এত বিশ্বাস করে তাকে। হোস্টেল থেকে কী করে বেরুবে সেইটো জানার জন্যে সারাদিন এখানে বসেছিল। দ্বিতীয় বার অনুরোধ পর্যন্ত করতে হলো না।
বিশ্বাস?
বাবর হাসল। বিশ্বাস বস্তুটাই আপেক্ষিক, এই উপলব্ধি জাহেদার এখনো হয়নি। বিশ্বাস একটা পণ্যের নাম। এর কিছু জাত স্বদেশে তৈরি হয়, কিছু বিদেশে, আমদানি করতে হয়, কিছু রফতানী করি। অবিকল একটা পণ্য।
ঘরে এসে জাহেদার পেয়ালাটা ছোঁ মেরে তুলে নিল বাবর। পেয়ালায় আবার রং লেগেছে, জাহেদার ঠোঁটের রং, জাফরান লিপস্টিক। বাবর দুই ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল সেখানে। সম্পূর্ণ রংটাকে গ্ৰাস করে নিল। ঠাণ্ডা কটু কফির তলানি দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখে চুকে গোল তার। কিন্তু সে ফেলে দিল না। পেয়ালার ভেতরে এখনো যেন জাহেদার নিঃশ্বাস ঘুরছে। তুষিতের মত এক ঢোকে সবটুকু উচ্ছিষ্ট পান করল সে। তারপর বিহ্বললের মত খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, একটা পোকা খাবার পর টিকটিকির মত স্ফীত স্তব্ধ হয়ে থেকে, সে টেলিফোনের কাছে গেল। দ্রুত পাতা উলটে বার করল রশিদ ট্র্যাভেল এজেন্সির নম্বর।
বাবর বলছি।
স্নামালেকুম স্যার, কী খেদমত করতে পারি?
খেদমত? এমন খেদমত করার সুযোগ তুমি আর কখনো পাওনি–মনে মনে বলল বাবর এবং হাসল।
কাল চাটগাঁয়ে যাব। কালই ফিরব। রিটার্ন টিকিট চাই।
কাল কখন?
ধরুন, যাব দশটা এগারটা নাগাদ, ঘণ্টাখানেক পরে।
আচ্ছা, আমি একটু পরেই জানাচ্ছি।
যে করেই হোক সিট দিতে হবে।
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব স্যার।
ব্যবসার কাজে ভীষণ দরকার। না হলেই নয়। কাউকে ক্যান্সেল করিয়ে হলেও–
ও-কে স্যার।
টেলিফোন রেখে দিল বাবর। অধীর হয়ে পায়চারি করল বার কয়েক। হাঁ করে শিম্পাঞ্জির ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন এ জন্তু এর আগে সে কখনো দেখেনি। তারপর বসল। ঠিক সেই জায়গায় যেখানে এতক্ষণ জাহেদা বসেছিল। এতক্ষণ বসে থাকার ফলে সেখানে একটা কুলোর মত গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। গর্তটা নিখুঁতভাবে মিলিয়ে সেখানে নিজের নিতম্ব স্থাপন করল বাবর। হেলান দিল সোফার পিঠে। পা টান করে দিল সমুখে। ভাবতে লাগল জাহেদার কথা। আশ্চর্যজনকভাবে জাহেদার মুখটাকে মনে হলো অবিকল বাটপাতার মত।–তেমনি সবুজ, সপ্ৰাণ, পাতলা, তীক্ষ্ণধার।
সমস্ত কামরায় ঝনঝনি তুলে বেজে উঠল টেলিফোন।
হ্যালো।
ওপার থেকে তখুনি সাড়া এলো না। বাবর আবার অধীর গলায় বলল, হ্যালো।
তখন বাবলির গলা শোনা গোল।
আমি বলছি।
বল।
চুপ করে রইল বাবলি।
কই, বল। আমি শুনছি।
এটা কী করেছেন?
কোনটা?
বই।
ওহ, বই? হ্যাঁ, বইটা বেশ ভাল, পড়।
নিজেকে খুব চালাক মনে করেন?
কে না করে? কেউ নিজে বলে, সে বোকা?
বলে। চালাক যারা তারাই বলে। আর যারা বোকা তারা নিজেদের চালাক ভাবে। বুঝেছেন?
তোমার বয়স হয়েছে।
তার মানে?
তুমি বুদ্ধিমতির মত কথা বলতে শুরু করেছ। আমি খুব খুশি হলাম। আমার কাছে কাল না এলে আজ একদিনে এতটা বড় হতে না।
বইটা ফেরত নিয়ে যাবেন।
যদি না নিই?
নিয়ে যাবেন।
আমি যা দিই ফিরিয়ে নিই না। বাবলি, তুমি শুধু শুধু রাগ করছি। যদি সত্যি চাও, আমি আর কোনোদিন তোমাকে ডাকব না, তোমার কথা মনে করব না। আমি কখনো কারো ওপর জোর করি না। সেটা আমার স্বভাবই নয়। বাবলি, শুনছ? হ্যালো।
হ্যালো। নিষ্প্রাণ গলায় বাবলি সাড়া দিল।
বাবর তখন আবার মুখর হলো, আমি অপর পক্ষের ইচ্ছার খুব বড় দাম দিই। আমার কোনো ইচ্ছা নেই। বলতে গেলে ইচ্ছা কী?–তা আমি জানি না। বিশ্বাস কর। কাল যা হয়েছে তা মনে কর অন্য কারো জীবনে হয়েছে। সে তুমি নও, সে আমি নই। আর যদি মনে কর বইটা ফিরিয়ে দিলে তোমার ভাল লাগবে, দিও।
বাবলি চুপ করে রইল।
কিছু বল। কথাও বলবে না? বেশ তো।
হ্যালো।
বল বাবলি।
আপনি–আপনি আমার এ কী করলেন?
আমি তো কিছু করিনি।
আমিও তো নিজে কিছু–
আমি জানি। আমরা কেউ কিছু করিনি। হবার ছিল হয়ে গেছে। মনে কর একটা স্বপ্ন দেখেছি। খারাপ স্বপ্ন। আসলে এই অনুতাপ হওয়াটাই খারাপ। অনুতাপ কখনো করবে না। অনুতাপ করে চেহারা বদলান যায় না। তোমাকে একটা কথা বলি জীবনে কাজে লাগবে। অনুতাপ কখনোই করবে না। অনুতাপ জীবনের শত্রু। ভাল না লাগে, ভুলে যাবে। যা করতে ইচ্ছে হয়, তাই করবে। আসলে আমি জানি, তোমার মন বলছে আমার সঙ্গে আবার দেখা হোক। কিন্তু লোক-ভয়, সমাজের ভয়, কত রকম ভয় তোমাকে ভাবিয়ে তুলছে। বাবলি একদিন এসো। যেদিন তোমার ইচ্ছে। যখন তোমার সময় হয়। আসবে? বাবলি। আসবে?
জানি না।
এও ভাল। ভুল জানার চেয়ে কিছু না জানা অনেক ভাল! এসো। কিন্তু! মন খারাপ কর না! আজ পড়াশোনা কর না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আমি হয়ত স্বপ্নে আসল।
কিছু বলল না বাবলি। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর টেলিফোন বেখে দিল সন্তৰ্পণে। ঘুমের মধ্যে খুঁট করে একটা শব্দ হলো যেন, আর কিছু নয়। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। বাতিটা জেলে দিল বাবর। নানা আকারের ছযা মুহোর্ত ইতস্তত সৃষ্টি হলো চারদিকে, নানা ঘনত্বে আলো! দেয়ালে নিগ্নে। মেয়েটায় মুখ যেন হেসে উঠল। হঠাৎ। অকাবণে বায়াফ্রার কথা মনে পড়লে তার। মনে পড়ল সেই কথাটা বায়াফ্রার গোটা একটা পুরুষ ভুলে যাচ্ছে কী করে খেতে হয়, চিবোতে হয়, জিহ্বা ব্যবহার করতে হয়। নতুন করে তাদের শেখাতে হবে। আর এই সৰ্ব্বগ্রাসী ক্ষুধা আর উলঙ্গ দেহে যুদ্ধের মধ্যেও রমণীরা সেখানে গর্ভবতী হচ্ছে, জন্ম দিচ্ছে চক্ষুসার উদরসর্বস্ব শিশুকে। সেই সব শিশুকে কি শেখাতে হবে সঙ্গম কী করে করতে হয়? উত্থিত শিশ্ন মুঠো করে ধরে বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থাকবে তারা?
না।
বাবর হাসল। আহার এবং সঙ্গম কাউকে শেখাতে হয় না। বায়াফ্রার ওরা ঐ চমকপ্ৰদ কথা ছেড়েছে নিছক সহানুভূতি আদায়ের উপায় হিসেবে। অর্থাৎ আমাদের খাদ্য দাও, আমাদের বাঁচিয়ে রাখা। আমন কাব্য করে না বললে আমার গোলার দরোজা আমি খুলে দেব কেন?
কথা। শুধু কথা। কথা তার জীবিকা। কথা তার পন্থা। টিভিতে সে সুন্দর করে কথা বলে দুটো পয়সা আসে বলে। বাবলি জাহেদা ওদের সঙ্গে কথা বলে সঙ্গমে তাদের সম্মত করতে। সে যেমন চুরি ডাকাতি করে বাঁচতে চায় না, তেমনি ধর্ষণে বিশ্বাস করে না।
সেই গল্পটা মনে পড়ে গেল বাবরের। নতুন বিবাহিত স্বামী স্ত্রীকে বলছে, দ্যাখ, চাঁদ উঠেছে, আকাশে। কত তারা চিকমিক করছে, কী মিষ্টি বাতাস দিচ্ছে। স্ত্রী শুনে যাচ্ছে। স্বামী বলেই
চলেছে, বাগানে ফুল ফুটেছে, আর দ্যাখ—। তখন তাকে থামিয়ে স্ত্রী উত্তর করল, বুঝছি, তুমি আমারে করবার চাও।
অশিক্ষিতা হলেও গল্পের এই নায়িকাটি বুদ্ধিতে প্রখরা। সে জানে কথার পরিণামে কী আসবে।
এতটুকু বুদ্ধি আমাদের অনেক নাগরিকই রাখেন না। পল্টনে যখন বক্তৃতার তুবড়ি ছোটান নেতারা, কজন বোঝে, পরিণামে নতুন উপায়ে শোষণই হচ্ছে বক্তার লক্ষ্য?
রশিদ ট্রাভেল এজেন্সি থেকে টেলিফোন এলো।
স্যার, দশটা পঁয়ত্ৰিশে যেতে পারবেন, ফেরার সীট দুপুরে নেই, বিকেলেও নেই, লাস্ট ফ্লাইটে আছে, রাত সাড়ে নটায়। এতক্ষণ আপনার ফোন এনগেজড ছিল।
হ্যাঁ। তাহলে ঐ টিকিটাই করে রাখুন। আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি।
কী নামে হবে?
কেন? আমার নামে।
ও-কে স্যার।