১৯. দুপাশে আখের খেত

দুপাশে আখের খেত। সোনার মত রং। সবুজ ফেটি বাঁধা লাঠিয়ালদের মত ভিড় করে আছে, এই হাসছে, এই কানাকানি করছে। দ্রুত সরে যাচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে পথের দুপাশে। জাহেদা আর বাবরের চোখে মুখে এসে লাগছে ভোর সকালের নির্মল হিম হিম হাওয়া। রংপুর থেকে দিনাজপুরের দিকে চলেছে ওরা।

জাহেদা তখন থেকে কী একটা সুর গুন গুন করছিল।

কী গাইছ? মিষ্টি করে হাসল জাহেদা। অনেকটা কাল রাতে দেখা সুষমার মত।

বাবর বলল, গাইতে পার জানতাম না তো।

কতটুকুই বা জানেন?

মানে?

আমার কতটুকই বা আপনি জানেন!

তা সত্যি। বাবার হাসল। পরে যোগ করল, আমার সব জান?

হুঁ, জানি।

কী জান?

বলব না। বলে জাহেদা হঠাৎ বাবরের হাত চকিতে ছুঁয়ে দিল। আপনাকে জানি না? আপনাকে চিনতে বাকি নেই আমার। বুঝছেন?

বাবর বাঁ হাত জাহেদার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। সে আলতো করে সরিয়ে দিয়ে বলল, গাড়ি চালান।

বলে আবার সে গুন গুন করতে লাগল। তখন বাবরও গুন গুন করে উঠল। ইচ্ছে করে নয়, জাহেদার সঙ্গে পল্লা দিতে নয়, একেবারে ভেতর থেকে।

জাহেদা হেসে বলল, কী গাইছেন?

একটা গান।

সে তো বুঝতেই পারছি। জোরে গাইলে শুনতে পেতাম।

বাবর গান থামিয়ে বলল, এই গানটা মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে। গানটা কিছু নয়, ছেলেদের একটা কবিতা। বাংলা পড়লে ছেলেবেলার বইতে পেতে। বাংলাদেশের এমন কোনো ছেলেমেয়ে নেই জানে না।

শুনিই না।

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। এইভাবে শুরু–মেঘের কোলে রোদ হোসেছে বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। ছেলেবেলায় খুব ভাল বুঝতে পারতাম এটা। সারাদিন সারারাত সারাদিন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, তারপর হঠাৎ করে মেঘ দরোজা খুলে দিল, রোদ পা বাড়ােল পৃথিবীর মস্ত আঙিনায়। তখন কী যে খুশি হতো। কে যেন ডাক দিত কোথা থেকে। মাতামাতি করে বেরুতাম ঘর ছেড়ে, একেবারে পাখির মত মনে হতো। এখনো যখন কিছু হয়ে যায়, কিছু পেয়ে যাই যার জন্যে গুমোট অপেক্ষা করেছিলাম, তখন ঐ পাখির মত লাগে। গানটা মনে পড়ে। রবি ঠাকুরের লেখা।

টেগোর?

বাবর হেসে সস্নেহে বলার, হ্যাঁ, টেগোর।

শুনুন। জাহেদা পাশ ফিরল, আদুরে গলায় বলল, ভাল কথা মনে পড়েছে। টেগোরের শ্যামা বলে একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড আছে না?–আমাকে যোগাড় করে দিতে পারেন?

কেন? কী হবে?

বারে, বাজাব, শুনব। কত নাম শুনেছি রেকর্ডটার। দেবেন?

আচ্ছা। নিশ্চয়ই দেব। তোমার প্লেয়ার নেই?

শরমিনের একটা ছোট্ট আছে।

তোমাকে একটা প্লেয়ারও কিনে দেব।

না বাবা না।

কেন? বাড়িতে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না? তখন কী বলব?

বলবে, মাসে মাসে টাকা জমিয়ে কিনেছ। সারপ্রাইজ দেবার জন্য এতদিন বলনি।

জাহেদা চোখ পাকিয়ে বলল, আপনার মাথায় যত নষ্ট বুদ্ধি জোটে। বলেই হেসে ফেলল।

বাবর বলল, হ্যাঁ স্বীকার করি, এবার করলাম তুমি আমাকে জান।

জানিই তো। কী ভেবেছেন সাহেব?

বলে সীটে গা এলিয়ে জাহেদা আবার গুন গুন করতে লাগল।

সৈয়দপুর পার হয়ে গেল ওরা।

জাহেদা নীরবে চোখ মেলে তাকিয়েছিল সমুখে। তার শরীরের চমৎকার একটা সুবাস থেকে থেকে নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল; জাহেদাকে আরো কাম্য বলে মনে হচ্ছিল তখন। স্মিত মুখে বাবর বাসনার সেই আসা-যাওয়া উপভোগ করছিল তার সারা শরীর দিয়ে।

হঠাৎ জাহেদা প্ৰায় আচমকা একটা প্রশ্ন করল।

যদি কিছু হয়?

বাবর চমকে উঠল যেন।

কী কিছু হয়?

যদি কিছু হয়?

সাবধানে সামান্য একটু হাসল বাবর প্রথমে। তারপর বাঁ হাতে জহেদার কাঁধ জডিয়ে নিল। দুষ্টুমি গলায় বলল, কিছু হয়ত হবে।

জাহেদা বোবা চোখে বড় করে তাকাল বাবরের দিকে।

হ্যাঁ, কিছু হয়ত হবে। তার জন্যে এত ভাবনা কীসের? আমার ছোট বোন থাকে আজাদ কাশ্মীরে। ওর স্বামী আর্মির ডাক্তার বলেছি তোমাকে?

জাহেদা মাথা নাড়ল।

বলিনি? তার ওখানে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। তোমার বাবা জানবে কোনো ছাত্রীদলের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়াতে গেছ। সেখানে আমার বোনের কাছে বাচ্চা হবে। তুমি চলে আসবে। বাচ্চা থাকবে ওর কাছে। একটু বড় হলে নিয়ে আসব। আমার মেয়ে পছন্দ। তোমার?

জাহেদা শুনছিল আর ক্রমশ মাথা নিচু করছিল। এবার চোখ তুলে বলল, না, না, সত্যি কিছু হয়ে গেলে?

আদর করে হঠাৎ জাহেদাকে একটু কাছে টেনে নিল বাবর, তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠাট্টা করছিলাম। কিছু হবে কেন? আমি জানি কী করে কী করতে হয়।

জাহেদা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরোজার সাথে ঠেস দিয়ে বসল।

কাল তুমি কাদছিলে কেন?

অনেকক্ষণ পর জাহেদা বলল, আচ্ছা, এইসব ছাড়া আমরা ভালবাসতে পারি না? বলেই সে হাসিতে সপ্ৰতিভ হবার চেষ্টা করল। খুব ছেলেমানুষ দেখাল তাকে এখন।

বাবর এক মুহূর্ত ভােবল। ভালবাসা সম্পর্কে তার ধারণা পরশু রংপুরে আসতে আসতে জাহেদাকে সে বলেছিল। ভুলে গেল কী করে এরই মধ্যে মেয়েটা? এখন আবার বলবে? না, থাক। কাল আর পরশু রাতের পর এখন ওভাবে বললে অন্যরকম মনে করবে জাহেদা।

কথা আজ পর্যন্ত তাকে প্রতারণা করেনি। এখনো করল না। বাবর বলল, সেদিন রাতে মন্দিরে গান শুনেছিলে মনে আছে?

এটা কী উত্তর হলো বুঝতে না পেরে হকচকয়ে জাহেদা বলল, হ্যাঁ।

গানে বলছিল না?–চাই না। স্বর্ণসীতা চাই না?

হ্যাঁ।

স্বৰ্ণসীতা বুঝেছ?

জাহেদা মাথা নাড়ল।

না বোঝবারই কথা। আমরা যে কালে বড় হয়েছি রামায়ণ মহাভারত তখন এমনিতেই জানা হয়ে যেত। রামায়ণে আছে, সীতাকে রাবণ চুরি করে নিয়ে গেল। যুদ্ধ করে তাকে উদ্ধার করে আনল রাম। অযোধ্যায় রাজা হলো রাম আর সীতা তার রাণী। প্ৰজারা বলাবলি করতে লাগল, সীতা এতদিন বাবণের কাছে বন্দি ছিল, সীতা কি সতী আছে? প্ৰজাদের মনোরঞ্জনের জন্য রাম তখন সীতাকে নির্বাসন দিলেন।

কী নিষ্ঠুরতা! জাহেদা চোখ গোল করে মন্তব্য করল।

তারপর শোন। সীতাকে নির্বাসন দিয়ে রামের অন্তরে সুখ নেই। বিমর্ষ দিন কাটতে লাগল তার। শরীর কৃশ থেকে অতিকৃশ হয়ে গেল। মলিন হলো উজ্জ্বল ক্লান্তি। তখন অনুতপ্ত প্ৰজারা রামের তুষ্টির জন্যে রাজ্যের সেরা কারিগর দিয়ে সীতার একটা স্বর্ণমৃতি বানিয়ে রামের সামনে আনল। বলল, এই নিন। আপনার সীতা। রাম তখন প্রশ্ন করল, তোমার এই সোনার সীতা কি কথা বলতে পারে? উত্তর এলো, না। কানে শুনতে পায়?–না। —সে কি চোখে দেখতে পায়।–না, তাও পারে না। তখন রাম বলল, হোক না সোনার তৈরি, হোক না সেরা কারিগরের সৃষ্টি, চাই না। আমি এই সোনার সীতা, চাই না।

সুন্দর। জাহেদার গাঢ়স্বরে ঐ একটি মাত্র শব্দ শোনা গেল।

হ্যাঁ সুন্দর। এবং সত্যি। আমার মনের কথাই রামের মুখে শোনা গেছে। আমি যাকে চাই রক্তমাংসে চাই তাকে। সপ্ৰাণ তাকে চাই। জীবন্ত তাকে চাই। এই তুমি যেমন তেমনি করে চাই।

জাহেদা সমুখে তাকিয়ে রইল অঙ্কিত একটা চিত্রের মত।

কী ভাবছ?

না, কিছু না।

নিশ্চয়ই কিছু ভাবছ। বাবর প্রীত মুখে উচ্চারণ করল জোর দিয়ে।

জাহেদা তখন নিঃশব্দে এক টুকরো হাসল।

বাবর বলল, তুমি ভাবছ, এ কেমন কথা বলছি আমি। নয়? ভাবছ, তাহলে মানুষের মন কিছু না? শরীরটাই সব? এতকাল যা জেনে এসেছ তা ভুল? এই ভাবছ তো?

আপনার কী দোষ জানেন?

কী?

আপনার দোষ, নিজেই বলে চলেন, অন্যে যে অন্য কিছু ভাবতে পারে, অন্য কিছু বলার থাকতে পারে তার, তা আপনার মনেই হয় না।

অপরাধীর মত হাসল বাবর। বলল, তোমার কথা তাহলে বল।

চুপ করে রইল জাহেদা। নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগল বাবর। কিন্তু এটাও খুব শান্তিকর বলে মনে হলো না। কথা বলার জন্যে ভারি তৃষ্ণার্ত হয়ে রইল সে। বারবার তাকাতে লাগল জাহেদার দিকে।

জাহেদা বলল, বকা খেয়ে চুপ করেছেন তো!

হুঁ। বোধহয়।

আচ্ছা বলুন, আপনার যা মনে আসে বলুন।

এভাবে কথা বলা যায় না।

কেন?

এক তরফা কথা হয় না। আমি তো শুনছি। তারপর কী হলো? রামের কী হলো?

রাম?

হ্যাঁ, এই যে বলছিলেন।

বাবর হেসে ফেলল। বলল, ঐ তো, বললামই তো। সীতাকে যে চায়, রক্ত মাংসের সীতা। সীতার স্মৃতি নয়, প্রতিকৃতি নয়; যে সীতা জীবন্ত, যে সীতা বর্তমান। আমাদের একটা দোষ কি জান? আমরা স্বাভাবিকতাকে ভয় পাই। শরীরকে ভয় পাই। ইচ্ছাকে ভয় পাই। আমরা আমাদের কামনাকে নিয়ে বিব্রত। বুকে হাত দিয়ে কটা লোক বলতে পারবে কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখে তার ইচ্ছে হয়নি? যদি কেউ বলে যে তার হয়নি, আমি বলব, হয় সে অসুস্থ নয়তো মিথ্যুক।

ব্যতিক্রম তো আছে।

আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম নিয়মের অস্তিত্বই প্রমাণ করে জাহেদা। বিশ্বাস কর, কাউকে দেখে আমার তাকে পেতে ইচ্ছে করবে, তার অন্তৰ্গত হতে ইচ্ছে করবে–এর চেয়ে স্বাভাবিক এবং সাধারণ আর কোনো ইচ্ছে আমি জানি না।

জাহেদা নির্বিকার মুখে চোখ দ্রুত ধাবমান দৃশ্যের দিকে রেখে শুনে যেতে লাগল, যেন ক্লাশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণসমূহ সে অধ্যাপকের কাছ থেকে শুনছে।

বাবর বলে চলল, কিন্তু ঐ যে বললাম, আমরা আমাদের দেহকে ভয় পাই, যেমন সাপকে, তুমি তো সাপের উল্লেখে শিউরে ওঠ, যেমন ভয় পাই অ্যাটম বোমাকে। কিন্তু ভয় পেলেই তো কিছু মিথ্যে হয়ে যায় না। কী বল?

বোধহয়।

বাবর সুদূরের দিকে তাকিয়ে হাসল।

হাসছেন যে?

একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমার বড় চাচা। ইয়া ছফুট দুইঞ্চি লম্বা, টকটকে গায়ের রং, গালে সুন্নতি দাড়ি, সৰ্বক্ষণ মাথায় টুপি, কী প্রশান্ত পবিত্র দর্শন তাঁর। দেখলে ভক্তিতে মাথা নুয়ে আসত। এখনো ছবিগুলো স্পষ্ট চোখের ওপর ভাসে। এই তো সেদিনের কথা। কত দিন হবে? মাত্র তিরিশ বছর আগে। তুমি তখন কোথায়?

জাহেদা হাসল নিঃশব্দে।

তুমি তখন হওনি। আমার সেই চাচার কথা মনে পড়ল হঠাৎ।

কেন?

না, থাক। বলব না। বললে মন খারাপ হয়ে যাবে।

আপনাকে বোধহয় খুব ভালবাসতেন?

হ্যাঁ, খুব। বলতে গেলে আমি তার কাছেই মানুষ।

মারা গেছেন?

হ্যাঁ। আমি তখন ঢাকায় এসেছি। চিঠিতে জানলাম।

জাহেদা বলল, আপনিই তো বলেন মৃত্যু সবচেয়ে স্বাভাবিক, তাহলে মন খারাপ করছেন কেন?

না, সেজন্যে নয়।

বাবর চকিতে উপলব্ধি করল জাহেদা ভুল ধারণা করেছে।

তাহলে?

তুমি ভেবেছ, আমার মন খারাপ হবে? না, আমি তোমার কথা বলছিলাম। শুনলে তোমার খারাপ লাগবে। কারণ, সংস্কার তোমার রক্তের মধ্যে আছে। ভাল মন্দের চলিত ধারণায় তুমি মানুষ হয়েছ।

জাহেদা তার গায়ে টোকা দিয়ে বলল, বাহাদুরি না করে বলুন। আমি শুনব। আমার মন খারাপ হবে না।

শুনবে? শোন তাহলে। আমি তখন চাচার বাড়িতেই থাকি। পাশাশাশি বাড়ি আমাদের। চাচি তার ছেলেমেয়ে নিয়ে গেছেন বাপের বাড়িতে। তখন নামাজ পড়তাম। চাচার সঙ্গে। একদিন আছরের সময় ওজু করে চাচার কাছে গেলাম, চাচা বললেন, তিনি নামাজ পড়ে নিয়েছেন। একটু অবাক লাগল। কোনোদিন তো চাচা আমাকে ফেলে নামাজ পড়েন না।? ভাবলাম, কী জানি, হয়ত আমারই দেরি হয়ে গেছে। নামাজে দাঁড়িয়েছি, ঠিক তখন, মনে হলো উঠানে নিচু গলায় চাচা কী যেন কাকে বলছেন। এ রকম কণ্ঠ চাচার কখনো শুনিনি। আমার সেই বয়সেই বুদ্ধি হয়েছিল খুব, আমি বুঝতে পেরেছিলাম। গলা শুনেই যে গোপন কিছু একটা চলছে যা আমার শোনা উচিত নয়।

থামালেন কেন? তারপর?

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, উঠানে চাচা আব্বাসের মাকে কী যেন বলছেন। আব্বাসের মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সারা গা যেন থর থর করে কাঁপছে তার।

আাব্বাসের মা কে?

চাচার বাড়িতে কাজ করত। মাঝ বয়সী। বিধবা। আব্বাসকেও আমরা কোনোদিন দেখিনি, তিনি মাঝ বয়সেই নাকি মারা গিয়েছিল। গোলমত মুখ, শ্যামল, ঘন ভ্রু ছিল মনে আছে আব্বাসের মা-র। আর মনে আছে পায়ের তোলো ঘেয়ো শাদা ছিল তার। সারাদিন মাঢ় দিয়ে কাপড় কাচতে হতো, তাই। সন্ধ্যের সময় দেখতাম কাঠ পুড়িয়ে ধোঁয়া দিত পায়ে।

কেন?

ওটা ঘায়ের ওষুধ। লালচে একটা দাগ হয়ে যেত পায়ের চারদিকে অনেকটা আলতার মত।

আলতা কী?

ও চিনবে না। এককালে বাংলার মেয়েরা শখ করে পায়ে পরত। আরো আগে নাপিত বৌ চুবড়িতে করে আলতা নিয়ে আসত বাড়ি বাড়ি, বৌদের পায়ে দিত। দেখি, ঢাকায় ফিরে, খুঁজে তোমাকে এক শিশি আলাতা কিনে দেব। এখনো হয়ত পাওয়া যায়। তোমার পায়ে চমৎকার লাগবে।

বাবর পা দিয়ে জাহেদার পা ছুঁয়ে দিল। জাহেদা পা টেনে বলল, আপনার শুধু প্রমিজ আর প্রমিজ। তারপর গল্পটা কী হলো?

গল্প নয়। সত্যি। একেবারে চোখে যা দেখেছি। সেদিন সারা বিকেল সারা সন্ধে কেন যেন গা ছমছম করতে লাগল আমার। মগরেবের নামাজ পড়লাম চাচার সঙ্গে, কিন্তু ভাল করে তার মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। রাতে দেখলাম, চাচা চোখে দিচ্ছেন সুরমা। আমি তাকাতেই কেমন তড়বড়ে গলায় চাচা বলে উঠলেন, চোখ ভাল থাকে, তুই ঘুমো!

তারপর?

আহ অতি উতলা হয়ে না।

জানেন। আপনার দোষ কি?

বলতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। তোমার কোনটা চোখে পড়েছে তাই বল।

আপনি গল্প বলেন এত ঘুরিয়ে যে আসল কথাই হারিয়ে যায়।

আচ্ছা, আচ্ছা। তারপর পড়েছি ঘুমিয়ে। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে যেন মনে হলো, পানির শব্দ। খুব সরু করে পানি পড়ছে কোথাও। যেন রাতের অন্ধকারের মধ্যে একটা তরল শব্দ পথ করে চলেছে। আস্তে আস্তে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখন টের পেলাম, পানি গড়াচ্ছে আমাদের আঙ্গিনায় এক কোণে যে পোসলখানা, তারই পাকা ড্রেন দিয়ে, গিয়ে পড়ছে বাইরে। কেউ গোসল করছে। কান খাড়া করে রইলাম। কে? কে এত রাতে গোসল করে। অনেকক্ষণ পরে দেখি, চাচা! গোসল করে চাচা এলেন। ভারি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কেমন খাপছাড়া ঠেকেছিল সে রাতেই, সেই ছেলে বয়সেই। এত রাতে কেন চাচা গোসল করবেন? কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি–

আর আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আপনার এতে এত চমকাবার কী ছিল।

ছিল না? শোন তাহলে। চাচা সে রাতে আব্বাসের মাকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন।

জাহেদা কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কথাটা যেন পুরোপুরি, উপলব্ধি হলো তার। চট করে সামলে নিল নিজেকে। একেবারে চুপ করে গেল।

কী, কথা বলছ না?

জাহেদা তবু কিছু বলল না।

বাবর বলল, তাই বলছিলাম, চরিত্র বলে যা আমরা জাহির করি আসলে তা কতটা খাঁটি সত্য সেটা বিবেচনার বিষয়। আমার তো মনে হয়, সব মানুষেরই দুটো চেহারা। একটা তার নিজের, আরেকটা সে তোলে অপরের জন্যে।

আপনারও?

তার মানে?

আপনারও দুই চেহারা?

এবার থমকে গেল বাবর। একটু হাসল। কী বলবে গুছিয়ে নিতে চাইল মনের মধ্যে। এক লহমা পর বলল, হ্যাঁ আমারও। আমাকে তুমি যা জান, আমি তা নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *