পরদিন উল্কার মত গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় ফিরল বাবর। পরদিন লতিফার সঙ্গে আর দেখা হয়নি তাঁর। ভোর রাতে ক্রমবর্ধমান অথচ অপূর্ণ, প্রতিহত সেই বাসনাকে নিজ হাতেই বইয়ে দিতে হয়েছে। সেই থেকে কোথায় যেন একা জ্বালা, একটা আক্রোশ, একটা প্ৰায় দৃশ্যমান স্তব্ধতা বড় হতে হতে জগৎ সংসার গ্রাস করবার উপক্রম করেছে।
ঢাকায় ফিরে ঘরের তালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে শুনতে পেল ভেতরে টেলিফোন বাজছে। অদ্ভুত যোগাযোগ তো! আর এক মিনিট পরে পৌঁছলেই টেলিফোনটা সে পেত না। কে হতে পারে?
হ্যালো। হ্যালো। কে?
চিনতে পারছেন না?
তারপর হাসির একটা তরঙ্গ।
বাবর ভেবে পেল না কে হতে পারে? মেয়েদের হাতের লেখার মত তাদের কণ্ঠস্বরও সবার কেমন এক মনে হয় বাবরের। চট করে ঠাহর করতে পারে না। কারো চিঠি এলে ওপরে ঠিকানা দেখেও এ রকম হয় তার। অনেক সময়, যখন মেজাজ খুব ভাল থাকে, নিজের সঙ্গেই বাজি ধরে সে-– যদি অমুক হয় তাহলে আজ আবার দেবব্ৰতের রেকর্ডটা বাজাব আর না হলে শাস্তি হিসেবে বাথরুমের বালবের দিকে তাকিয়ে থাকিব যতক্ষণ না চোখে পানি আসে।
টেলিফোনে বাবর সপ্রতিভ সুরে বলল, পারছি, নিশ্চয়ই চিনতে পারছি।
পারছেন?
হ্যাঁ। আপনার মুখে কিন্তু আপনার নাম ভারি সুন্দর শোনায়।
তাই নাকি?
ভদ্র মহিলা প্রীত হলেন। বললেন, আমি মিসেস নাফিস।
উচ্চারণটা শোনাল যেন–ইস্ ইস্ ইস। এবারে বাবর চিনতে পেরেছে।
আরে হ্যাঁ তাইতো! মিসেস নিফিসের গলাই তো।
সে বলল, কেমন আছেন?
ভাল। সকালে ঘরে ছিলেন না?
না। কেন, টেলিফোন করেছিলেন?
হ্যাঁ, একবার দুবার। কী ব্যাপার, দেখাই নেই?
বাবর মিথ্যে করে বলল, একটা জরুরি কাজে চিটাগাং যেতে হয়েছিল। ট্যাক্স বেশি ধরেছিল, সেইটে কমাতে।
আবার হঠাৎ আক্ৰোশটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল বাবরের ভেতরে। আর লতিফাকে যে কাল রাতে পায়নি তার জ্বালাও টগবগা করে উঠল সারা দেহে।
মিসেস নাফিস বললেন, বেশ আছেন, লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছেন।
আপনি কি ইনকাম ট্যাক্স অফিসে কাজ নিয়েছেন?
নিইনি। তবে যদি বলেন তো তাদের জানিয়ে দি।না, না, এত বড় শক্রতা আপনার করব না। নিশ্চিন্ত থাকবেন।
আপনাকে নিয়ে আমার ভয় নেই।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি আমাকে ভয় করেন।
কেন বলুন তো?
নইলে আমাকে একবার দেখতে আসতেন।
কেন, কী হয়েছে। আপনার?
কিছু না হলে কি দেখতে আসতে নেই?
নিশ্চয় আছে। আমি, টেলিফোনে হাত দেখা যাচ্ছে না, তবু আপনাকে কল্পনা করতে বলছি, আমি এই করজোড়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
রিনটিনটিন হেসে উঠলেন মিসেস নাফিস। বললেন, নাহ, কথায় আপনার সঙ্গে পারবার জো নেই। টেলিভিশনে কাজ করেন তো! কথা খুব বলতে পারেন।
বাবর বলল, শুধু কথা নয়, কাজেও।
তাহলে আজ প্ৰমাণ দিন। নইলে বিশ্বাস করব না।
আচ্ছা, আজই আসব। আসলে আমি ভাবছিলামও আজ। আপনার বাসায় যাব। তাহলে আজ। যাচ্ছি। কেমন? রাখি।
অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলতে পারে বাবর। সেটা সে নিজেও জানে তবু প্রতিবারই একটা মসৃণ মিথ্যে বলে নিজেই চমৎকৃত হয় সে। যেমন এখন হলো।
বাথরুমে যাচ্ছিল বাবর, আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
আমি মিসেস নাফিস বলছি। কখন আসবেন বললেন না তো?
ও, বলিনি? চারটে?
সাড়ে চারটে।
ঠিক, সাড়ে চারটেই আসব। রাখি?
আচ্ছা।
বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রস্রাব করল বাবর। এখনও রংটা গাঢ় হলুদ। কাল থেকে এই রকম। একটা অ্যালক্যালি মিকচার আনা দরকার। বেরিয়ে এসে গুমুধটা এনে কয়েক চামচ খেল সে। কেমন টকটক ঝাঁঝাল। কিন্তু বেশ লাগল খেতে। তারপর শাওয়ার খুলে গোসল করে লম্বা হয়ে পড়ল বাবর। ঘুম এলো সঙ্গে সঙ্গে। ঘুমের ভেতরে সে দেখল তার দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে লতিফা। তার পরনে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। কিন্তু একটুও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। চোখে পুরু কাজল। কাজল গলে অশ্রুর ধারা নামছে।
আরে তুমি, দেখি, দেখি কী হয়েছে?
তাকে আদর করতে করতে ঘরে নিয়ে এলো বাবর। আর ভেতরে দেখল তারই বিছানায় এক হাঁটু পিরামিডের মত তুলে শুয়ে আছেন মিসেস নাফিস। তার ঠোঁটে স্থির একটা হাসির বিদ্যুৎ। বাবরের এ রকম মনে হলো লতিফা যেন মিসেস নফিসের মেয়ে। সে খুবই লজ্জিত এবং অপ্ৰস্তুত হলো। পরীক্ষণে সারা শরীর হিম হয়ে গেল তার। পা কাঁপতে লাগল। পালাবার জন্যে দৌড়ে বাথরুমের দিবোজাটা খুলতেই শাওয়ারের তীব্র ছটা এসে তাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
ধরমর করে উঠে বসল বাবর। সম্মুখে তাকিয়ে দেখল বাবলি দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চেহারায় হাত রেখে টের পেল সেখানে পানি। জিগ্যেস করল, মানে?
এত ঘুম আপনার?
কখন এলে?
এইমাত্র। নাম ধরে ডেকেছি। পায়ে শুড়াশুড়ি দিয়েছি। শেষে মুখে পানি ছিটাতে হলো। এ সময় কেউ ঘুমায়?
শরীরটা ভাল নেই।
বলে বাবর আবার শুয়ে পড়ল। ভেবেছিল বাবলি এসে পাশে বসবে। তারপর–তারপর আজকেই হয়ত প্ৰথম সেই সময় আসবে; বাবলি যখন ফিরে যাবে তখন অন্য মানুষ। কত দীর্ঘ দিন সে এর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। একটু একটু করে এগুচ্ছে বাবলির অন্তরঙ্গতার দিকে।
কিন্তু বাবলি তার পাশে তো বসলই না, তার শরীর খারাপ বলে কোনো উদ্বেগও দেখাল না। তার বদলে সরাসরি বলল, এখন একটা ব্যবস্থা করুন।
আচ্ছা, একে কী বলে?
বাবর বাবলির কালো পাজামার দিকে আঙুল তুলে জিগ্যেস করল।
কেন, পাজামা?
আহা, একটা নাম আছে তো?
বেল বটম। — আমার কথাটা শুনুন না?
শুনছি। তোমার সব কথা শুনব। তার আগে একটা কথা বল। বাবর উঠে বসে কোলে একটা বালিশ জড়িয়ে বলে চলে, বেল বটম বলতে তোমাদের একটু কেমন, লজ্জা করে না।? বেল বটম পাজামা?
কেন? ওমা সে-কী!
অবাক হয়ে বাবলি একটা মোড়ার ওপর ধাপ করে বসে পড়ল।
লজ্জা করবে কেন?
মিটমিট করে হাসতে লাগল বাবর।
বলুন না, কী?
তুমি ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ছ না?
হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? আমি তো এখন বাংলা শিখছি।
আহা সে কথা নয়। সে তো আমি জানিই। তুমি এখন কী সুন্দর অ আ ক খ পড়তে পার। যাহ, আপনি ঠাট্টা করছেন। কী বলবেন তাই বলুন আর নইলে আমার কথা শুনুন। খুব বিপদে পড়েছি।
বিপদ?
বাবর ভাল করে বাবলির দিকে তাকাল। ঘাড় পর্যন্ত ছাটা চুল। মাথায় অসংখ্য চুলের চাঁদ এলাপাতাড়ি হয়ে আছে। শ্যামল লম্বাটে মুখটায় গালের ওপর উঁচু হাড়, অনেকটা বিদেশিনীদের মত। চিবুকটা পেস্ট্রীর প্রস্থের মত সরল ও চওড়া। চোখ সব সময় নাচ করছে যেন এইমাত্র মুখ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। বিজ্ঞাপনের মত ঝকঝকে একসারি সুন্দর দাঁত সারাক্ষণ একটি হাসিকে ফ্রেম করে রেখেছে। এখানে কৈ, বিপদ তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না?
বাবর আবার জিগ্যেস করল, বিপদ? কোথাও প্রেম ট্রেম করছ নাকি?
যাহ!
বাবর বুঝতে পারে না, প্রেমের উল্লেখমাত্রে মেয়েরা এমন লজ্জিত, অপ্ৰতিভ হয়ে যায় কেন? তার আরো আশ্চর্য লাগে, সে দেখেছে, মেয়েরা যখন প্ৰথম নগ্ন হয়, যখন প্রথম তাদের সেই অভিজ্ঞতা হয়, পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন তাদের যে লজ্জা তা এর চেয়ে অনেক কম। তখন লজ্জার বদলে তাকে শংকা, থাকে শিহরণ, থাকে মিনতি, থাকে সম্মোহন। কিন্তু লজ্জা? না। লতিফার কথা মনে পড়ে। প্রথম দিন, সেটা ছিল বিকেল, লতিফাকে এতটুকু লজ্জিত হতে সে দেখেনি। লতিফা ছিল চোখ বুজে। তার ঠোঁট জোড়া শাদা হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত শরীরকে পাথর করে একটা হাত দুই ঊরুর মাঝখানে শক্ত করে চেপে লতিফা বিছানায় আড়াআড়ি পড়েছিল একটি আয়তক্ষেত্রের নিখুঁত কর্ণের মত।
বাবর বলল, প্রেম নয়, তবে?
কী যে বলেন!
কার সঙ্গে কিছু হয়েছে?
আর কী হবে?
মানে, ডাক্তার দেখাতে হবে নাকি?
আমি চললাম। বাবলি উঠে দাঁড়াল। বাবর তাকে আটকে বলল, যাওয়া অত সোজা নাকি? বসো। লক্ষ্মী মেয়ের মত চুপ করে এখানে বসো। বলে তাকে প্রায় শূন্যে তুলে খাটের কোণায় বসিয়ে দিল বাবর। জিগ্যেস করল, চকোলেট খাবে? বিলেত থেকে এক বন্ধু দিয়েছে।
আপনি এখনো ঠাট্টা করছেন?
মোটেই না।
জানেন, আমি এই এপ্রিলে উনিশে পড়ব?
জানতাম না, জানলাম। তাতে চকোলেট খাবার বয়স চলে যায়নি। বরং চকোলেট টকোলেট খেলে একটু মোটা হবে। দেখতে ভাল হবে।
দেখতে আমি এমন কী খারাপ শুনি? আপনি যে লতিফার প্রশংসায় একেবারে গলে যান, তার চেহারা তো আমার চেয়েও বাজে। আর যা ধুমসি!
ভালুকের মত।
মুখে বলছেন। কিন্তু মন থেকে স্বীকার করেন না।
বাবর এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে চকোলেট এনে বাবলির কোলে ফেলে দিল। বলল, খাও। সব তোমার। এবার শুনি কী বিপদ?
বিশটা টাকা হবে? বাবলি ডান হাত তুলে আঙুলগুলো নাচাল, যেন নিজের দিকে সে কয়েকটা অদৃশ্য সুতো টেনে নিল তাঁতিদের মত।
বিশ টাকা! সে তো মেলা টাকা।
হবে কি-না বলুন।
হবে। দিন। চটপট দিন। আবার সামনের মাসে ভাইয়ার কাছ থেকে হাত খরচা পেলেই শোধ করে দেব।
ভাল কথা, তোমার ভাইয়া কোথায়?
কেন, অফিসে?
তাকে বল ফারুক এসেছে ঢাকায়।
ফারুক কে?
ও তুমি চিনবে না। আমরা ছেলেবেলা থেকে এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছি। তোমার ভাইয়া হতো ফাস্ট, ফারুক সেকেন্ড আর আমি বরাবর–
তাকে বাধা দিয়ে বাবলি অসহিষ্ণু কষ্ঠে বলে উঠল, টাকাটা পাব?
পাবে, পাবে।
আসলে বাবর চাইছিল বাবলি যেন চলে না যায়। ঐ যে তার মনে হচ্ছিল, আজকেই হয়ত সেই প্রথম দিন বাবলির সাথে, সেই সম্ভাবনাটা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। কিন্তু এটাও সে জানে এই মেয়েরা যৌবনে পা দিলেও, মনে মনে এখনো কিশোরী। তাদের কথা চটপট শোনা শেষ পর্যন্ত ভাল ফল দেয়।
বাবর টাকাটা বের করে দিল। খটাস করে ভ্যানিটি ব্যাগ বন্ধ হয়ে গেল। পায়ে স্যান্ডেলজোড়া ফের উঠে এলো। বাবলি বলল, ধন্যবাদ, যাই।
যাবে তো। যাবে তো বটেই। চকোলেটগুলো শেষ করে যাও।
পথে খাব। যেতে যেতে খাব।
ওটি হবে না। এখানে সব খেতে হবে।
কেন?
খেয়ে এক গ্ৰাস পানি খাবে। তারপর যাবে। নইলে দাঁতে পোকা লাগবে।
বাব্বা। আপনার সঙ্গে পারি না।
বাবলি আবার বসল। চিবোতে লাগল চকোলেট। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে খয়েরি রং লাগল। তখন যেন তাকে আরো সুন্দর দেখাল। বাবলিকে এখনই যেতে দেয়া যায় না, বাবর ভাবল। কিন্তু কী করে? বাবর জিজ্ঞেস করল, টাকাটা কী হবে?
বলব না। সিক্রেট।
বল।
না।
বল।
বললাম তো, সিক্রেট।
এত সিক্রেট রাখতে নেই। এক আধজনকে বলতে হয়। তাতে সিক্রেট আরো জমে ভাল।
দূর।
বাবলি চকোলেট চিবোতে চিবোতে পা নাচাতে নাচাতে বলল।
তা হলে আমি রাগ করলাম।
বাবলি এবার আড়চোখে বাবরকে দেখল। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। হঠাৎ বলল, বলছি, বলছি। এমন কিছু সিক্রেট না। সেদিন কলেজ থেকে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। আমরা চারজন।
ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে সাহেব, মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গে আমি মোটেই বেরোই না। আমি ওদের হেট করি।
আমাকেও?
আপনি কী ছেলে?
তার মানে?
আপনি তো কত বড়? ভাইয়ার বন্ধু।
ও তাতো বটে, তারপর?
ভাইয়ার বন্ধু শুনে বাবর যেন একটু থেমে গেল। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য।
তারপর সবাই মিলে তো রাক্ষসের মত খেয়েছি। সবাই ভেবেছি সবার কাছেই টাকা আছে এক আমার কাছে ছাড়া। বিল দিতে গিয়ে মাথায় বাজ। পুরো সাতাশ টাকা বার আনা–আর সবার কাছে সব মিলিয়ে এগার টাকা সাতষট্টি পয়সা।
মাথা খারাপ! ঐ ভাবে খেতে যায়?
মজা শুনুন না। সবার মুখ তো শুকিয়ে এতটুকু। পাশে এক বুড়ো বসে খাচ্ছিল। বণি বলল, ওর কাছে চল ধার করি।
বণি কে?
আপনি চিনবেন না।
চিনিয়ে দিয়েছ নাকি যে চিনব?
আচ্ছা, একদিন নিয়ে আসব। তারপর বুড়োর দিকে আমরা চারজন এক সঙ্গে তোকালাম। বুড়ো হঠাৎ চোখ তুলে দেখে ড্যাবডোবে আটটা চোখ। সে বেচারা স্বপ্নেও ভাবেনি এ রকম করে আমরা তাকিয়ে থাকব। কেন? তাই দেখে তার গলার কাছে ঝুলঝুলে চামড়াটা থর থর করে কাঁপতে লাগল। আর আমাদের হাসি পেয়ে গেল।
সত্যি?
আমরা এক সঙ্গে হেসে উঠতেই বুড়ো আর পালাবার পথ পায় না। একবার এক চেয়ারের সঙ্গে, আরেক বার টেবিলের সঙ্গে–ধাক্কা! হাসতে হাসতে পেটের সব হজম।
খুব অন্যায়। বুড়োটার খাওয়া মাটি করে দিলে।
বারে, আমাদের কী দোষ। আমরা শুধু তাকিয়েছি–তার গলার চামড়া ওরকম নড়তে শুরু করল কেন?
তারপর বেরুলে কী করে?
বেয়ারাকে তিন টাকা বকশিস দিলাম। কাউন্টারে চীনে ব্যাটা বিমোচ্ছিল। তাকে আট টাকা দিয়ে বললাম, কুড়ি টাকা কাল দিয়ে যাব। বলে চারজন লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে এলাম। চীনেটা কিছু বলল না?
বলবে কী? তার বলবার আগেই আমরা দরোজার বাইরে।
ছি ছি ছি।
কী ছি ছি? আমরা তো টাকা মেরে দিচ্ছি না? এক্ষুণি যাবার পথে এই কুড়ি টাকা তার মুখের ওপর ফেলে দিয়ে আসব।
আমাকে একটা টেলিফোন করলেই তো হতো।
তা হতো। আপনার কথা মনেই হয়নি।
তা হবে কেন? আমার কথা তো মনে হবে না। বলে বাবর লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শুয়ে চোখ বুজল। ভান করল যেন মনে খুব লেগেছে তার কথা মনে হয়নি বলে। হঠাৎ সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। বাবলি তার পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে টানছে।
এই যে, কী হলো?–শুনুন।–আচ্ছ। এরপর কখনো এ রকম হলে নিশ্চয় ফোন করব। — কই, শুনুন।
চোখ মেলে মিষ্টি করে হাসল বাবর। নিঃশব্দে। তারপর বাবলির একটা হাত নিয়ে খেলা করতে করতে বলল, তুমি মনে করেছ, আমি রাগ করেছি, না? পাগল মেয়ে, আমার কি সে বয়স আছে?–একেক সময় কী ভাবি জান?
কী?
বাবর লক্ষ করল বাবলির গলা অত্যন্ত সূক্ষ্ম তারে যেন কেঁপে উঠল। এতে সে খুশিই হলো মনে মনে। বলল, ভাবি, আমার বয়স দশ বছর কম হলো না কেন? কিংবা তুমিও তো আরো দশ বছর আগে হলে পারতে।
বাবলি মাথাটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে অনির্দিষ্ট চোখে একবার তাকিয়ে হঠাৎ বলল, তখন বেল বটমের কথা কী বলছিলেন?
মনে মনে হাসল বাবর। বাবলি ঠিকই বুঝতে পেরেছে। তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইছে। বাবর আরো কিছুক্ষণ নিঃশব্দে খেলা করল বাবলির আঙুল নিয়ে। তার কড়ে আঙুলটা আলতো করে মুচড়ে দিল। কেমন লাল হয়ে উঠল আঙুলটা এক পলকের জন্যে।
লাগছে বাবলি?
বাবলি মাথা নেড়ে জানাল–না। তখন আবার এমনি করে দিল বাবর।
বললেন না, বেল বটমের কথা?
বাবর সন্তৰ্পণে হাত রাখল, বাবলির ঊরুর ওপর। তারপর এক চিমটি পাজামা তুলে সে বলল, এর নাম বেল বটম পাজামা?
বাবলি মাথা নাড়াল–হ্যাঁ।
বেল বটমের বাংলা জান?
নাতো।
মানে, যার নিচ দিকটা ঘন্টার মত।
গোল ঘন্টা?
হ্যাঁ।
বলতে বলতে বাবর করতল দিয়ে বাবলির হাঁটুর নিচে গোঁড়ালি পর্যন্ত স্পর্শ করে বলল, এই পাজামার নিচের দিকটা চওড়া তো, অনেকটা ঘন্টার মত, তাই বেল বটম বলে।
জানি।
কিন্তু ইংরেজিতে বটমের আরেকটা মানে আছে।
কী?
বলেই বাবলি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। এক মুহূর্তে অর্থটা তার মনে পড়ে গেছে। আর সে জানতে চায় না। কিন্তু বাবর ততক্ষণে তার পেছনে করতল দিয়ে ব্রাশ করতে করতে বলছে, বটম মানে এটা। বাংলায় একটা সুন্দর শব্দ আছে। নি-ত-ম্ব। মানে বটম। তাই বলছিলাম, বেল বটম বলতে একটু লজ্জা করে না তোমাদের?
কোনো উত্তর দিতে পারল না বাবলি। নিঃসাড় নিষ্পন্দ হয়ে বসে রইল। কিন্তু হাত আর সরিয়ে নিচ্ছে না বাবর। অনেকক্ষণ। অথচ ওঠাও যাচ্ছে না।
বাবর তার পেছনে দুটো মৃদু চাপড় দিয়ে বলল, তুমি খুব সুন্দর হয়েছ। বলে সে তাকে কাছে টানল। মুরগির তুলতুলে একটা বাচ্চার মত বাবলি তার বুকের মধ্যে পড়ে হাঁফাতে লাগল চোখ বুজে। এইটুকু কাছে পাওয়া যতটা শক্ত হবে বলে বাবর ভেবেছিল তার চেয়ে সহজে হয়ে গেল। বহুবার বাবর এটা দেখেছে, আসলে একটু সাহস করলেই হয়, হয়ে যায়, তবু বারবার, প্রথম বার, এত কঠিন মনে হয়, যেন এর চেয়ে বাঘের বাসায় যাওয়া অনেক সোজা।
বাবর তাকে চুপচাপ বুকে নিয়ে শুয়ে রইল। এতটুকু নিজেকে সে নড়াল না। বাবলি অনেকক্ষণ পড়ে থেকে বলল, এখন যাই।
না। আরো একটু থাক।তোমাকে একটু দেখি। বলে সে তার মুখ তুলে ধরল। খুব আস্তে একটা চুমো দিল তার চোখে। বলল, চোখ বুজে থাক।
চোখ বুজেই ছিল বাবলি, কিন্তু এই কথা শুনে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল বাবরের হাতের ওপর দিয়ে। সেইভাবে থাকতে থাকতে কী হলো তার, হঠাৎ বাবলি বাবরকে ঠোঁটে দ্রুত একটা চুমো দিয়ে বুকের মধ্যে মুখ লুকাল।
বাবর বলল, ভয় কী? আমি তো তোমার। এখন থেকে তোমারই। সব সময়ের জন্যে।
এবার বাবরই তাকে চুমো দিল, দীর্ঘক্ষণ ধরে পাতলা দুটি ঠোঁট সে সুখাদ্যের মত খেল। তারপর কামিজের একটা বোতাম খুলে বাবলিকে উপুড় করে তার পিঠে ঠোঁট রাখল। ঠোঁটে সুড়সুড়ি দিতে লাগল বাবলির পিঠের প্রায় অদৃশ্য পশমগুলো।
বাবলি বলল, যাই।
না, থাক। তোমার পিঠে তিল আছে?
হ্যাঁ।
একটা চুমো দিই তিলে? বাবলি কিছু বলল না। বাবরকে তার ইচ্ছে রাখতে দিল। বাবর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, আরো তিল আছে?
হ্যাঁ।
দুটো বোতাম একসঙ্গে খুলে ফেলল বাবর। প্ৰায় কোমর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
কই আর তো দেখছি না?
বাবলি চুপ করে রইল।
কই, আর তিল কই? তুমি বললে যে আছে?
এখানে নেই।
তাহলে সামনে?
বলে বাবর তাকে সামনে ফেরাতে চেষ্টা করল। কিন্তু উপুড় হয়ে শক্ত করে নিজেকে ফেলে রাখল বাবলি। মাথা নেড়ে মুখে শুধু বলল, না।
তখন জোর করে তাকে ফেরাল বাবর। ফেরাতেই শাদা কাচুলির ভেতরে অপুষ্ট একজোড়া স্তন কেঁপে উঠল। বাবর তাদের আবরণ সরিয়ে সেখানে মুখ রেখে ধীরে ধীরে আরোহণ করতে লাগল যেন ছিপছিপে একটা পেয়ারা গাছে। যখন সম্পূর্ণ সে পেল তাকে তার নিচে, সে চুপ করে রইল। নিঃশব্দে স্ফীত হতে লাগল। কিন্তু আজ নয়। প্রথম দিনে নয়। বাবর সময় নিতে ভালবাসে। সময় নেবার পর যখন পাওয়া যায়। তখন আর সময় নেয় না। তখন তার মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিঃশেষ হয়ে ফিরে আসে।
শেষ একটা চুমো দিয়ে এবার বাবর নিজেই বলল, বাড়ি যাও, কেমন?
বাবলি উঠে বসে বোতাম লাগাল কামিজের। কোনো কথা বলল না। বাথরুমে গেল। ফিরে যখন এলো, মুখ সাবান দিয়ে ধুয়েছে, একটু পাউডার দিয়েছে। কিন্তু মুখে একটা নতুন ছাপ। কেমন এলানো, মন্থর, নিঃশব্দ। সে বেরিয়ে আসতেই বাবর একটু হেসে বলল, পৌঁছে দেব?
না। আমি নিজেই যেতে পারব।
রিকশা ডাকিয়ে দি।
আমি নিয়ে নেব।
যাবার সময় আমাকে একটা চুমু দিয়ে যাও।
বাবলি চুপ করে রইল।
এসো।
বাবলি নড়ল না। তাকিয়ে রইল আপলক চোখে বাবরের দিকে।
এসো বাবলি।
বাবলি হঠাৎ এসে বাবরের কানের কাছে মুখ রাখল আলতো করে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। দরোজার দিকে যেতে যেতে শুধু বলল, আপনার তো কোনো ক্ষতি নেই। ক্ষতি শুধু আমার।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বাবর চমকে উঠল। পাঁচটা বাজে।