দু একজনের কাছে জিগ্যেস করতেই বাসাটা খুঁজে পেল বাবর। কাজী সাহেব তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
আরে আপনি! কখন এলেন? কীভাবে এলেন? আসুন, আসুন।
চলে এলাম। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ এমন কী দূর! গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম।
পরীক্ষণেই বাবরের মনে হলো আসবার কারণ কিছু না বললে উপস্থিতিটা শোভন হচ্ছে না। তাই সে যোগ করল, এখানে একটা কাজ ছিল।
দুহাত নেড়ে কাজী সাহেব বলে উঠলেন, কাজ পরে হবে, আগে বিশ্রাম করুন। কতদিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা, আগে ভাল করে গল্প-টল্প করি।
আজ সেরেই এসেছি। এখন আর কাজ নেই। ভাবছি আজই ঢাকায় ফিরে যাব।
যেতে দিলে তো! কাল যাবেন।
কাল?
হ্যাঁ কাল। অসুবিধো কী!
না, অসুবিধে কিছু নেই।
আলাদা বিছানার ব্যবস্থা আছেই। শুধু পেতে দিলেই হলো। একটু বসুন, ভেতরে খবর দিয়ে আসি। সিগারেট খান। আপনার তো এ ব্ৰ্যাণ্ড চলে না বোধহয়। আচ্ছা, আমি এক্ষুণি আনিয়ে দিচ্ছি।
সে-কী! না, না।
আপনি বসুন তো। চা না কফি? দুটোই আছে।
চা।
কাজী সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। বাবর পা জোড়া সামনে ঠেলে আরাম করে বসল। কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পা যেন জমে গিয়েছে। মাথায় কয়েকটা চুলের গোঁড়া ব্যথা করছে, পেকেছে বোধহয়। বয়স তো কম হলো না। গত মার্চে আটত্রিশ পেরিয়ে উনচল্লিশে। চুল উঠতেও শুরু করেছে কিছু কিছু। পরাজিত সৈন্যদলের মত কপাল থেকে ক্ৰমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে তারা। গত সপ্তাহে মেকাপম্যান কামাল তার মুখে রং লাগাতে লাগাতে বলছিল, একটু যত্ব নিন স্যার। চুলের গোঁড়ায় কালো পেন্সিল বুলিয়ে আর কতকাল চালাবেন? গত সপ্তাহে তার টেলিভিশন প্রোগ্রামটা বেশ ভাল হয়েছিল। সবাই খুব প্ৰশংসা করেছে। কাগজেও লিখেছে। প্রোগ্রামটা কি লতিফা দেখেছে? এ বাসায় ঢোকার আগে দেখা উচিত ছিল বাড়ির মাথায় এন্টেনা আছে কি-না। ময়মনসিংহে তো টেলিভিশনের ছবি ভালই আসে সে শুনেছে। কী বোকা সে! এতক্ষণ তার চোখেই পড়েনি টেলিভিশন সেটটা। বসবার ঘরে এক কোণায় স্যাতস্যাতে আঁধারিতে কার্পেটের ওপর সামনের দুপা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটটা। তাহলে প্রোগ্রামটা লতিফা নিশ্চয় দেখেছে।
লতিফা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। পরনে কালো পাজামা, শাদার ওপরে কালো সবুজ বর্ডার আঁকা কামিজ। লতিফার সতের সুন্দর একজোড়া স্তন নিঃশব্দে ওঠানামা করছে, প্ৰায় বোঝা যায় কী যায় না।
নিঃশব্দে হাসল বাবর। কিন্তু লতিফা হাসল না। বাবর তখন একটু অপ্রতিভ হলো।
একদৃষ্টে বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে লতিফা।
কাজী সাহেব এসে মেয়েকে বললেন, যা চা-টা নিয়ে আয়।
লতিফা চলে গেল।
একটা চেয়ার টেনে জুৎ করে তার সামনে বসলেন কাজী সাহেব। বললেন, আজ তো যাওয়া হবে না। কালও যেতে দিই কি-না সন্দেহ।
কাল না গেলে অসুবিধে হবে খুব।
কী এমন অসুবিধে? আমাদের মত তো চাকরি করতে নেই আপনার।
তা নেই। সত্যি।
বেশ আছেন। আপনার প্রোগ্রাম মাঝে মাঝে টেলিভিশনে দেখি! খুব ভাল লাগে। চমৎকার হয়।
ধন্যবাদ।
শুধু টেলিভিশন নিয়েই আছেন, না অন্য কিছু?
ব্যবসা আছে।
কীসের?
ইনডেনটিং। ভাবছি, আমিও চাকরি থেকে রিটায়ার করে একটা ব্যবসা-ট্যাবসা করব। বড় ছেলেটা আর্মিতে এখনও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। তারপরে লতিফা। ওর বিয়েটা দিলেই থাকে আরেক ছেলে।
আপনার আর চিন্তা কী তবে? বেশ গুছিয়ে এনেছেন।
কই আর? আপনার ছেলেমেয়ে কটি?
বাবর অবাক হলো কাজী সাহেব জানেন না যে সে বিয়েই করেনি। লতিফার একবার কলেজের ছাত্রীদের প্রোগ্রাম করতে টেলিভিশনে এসেছিল, সেখানে আলাপ। তখন ঢাকায় ছিলেন কাজী সাহেব। তারপর বদলি হয়ে এলেন ময়মনসিংহে। ঢাকার বাড়িতে বেশ কয়েক দিন গিয়েছিল বাবর। দু একবার রাতে খেয়েছেও। না, সেই আলাপে বাবরের নিজের কথা কিছু ওঠেনি। বাবরকে প্ৰায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই দেখে কাজী সাহেব ধরেই নিয়েছেন তার সংসার আছে।
বাবর মিথ্যে করে বলল, ছেলেমেয়ে দুটি।
তবে যে লতিফার কাছে শুনেছিলাম তিনটি।
বাবর ভাবল, দুষ্ট মেয়ে, কীভাবে মিথ্যে কথা বলেছে দেখ। মুখে সে বলল, ভুল করেছে, এক ছেলে এক মেয়ে।
লতিফা আপনাকে কিন্তু খুব শ্রদ্ধা করে। বলে বাবর চাচার মত মানুষ হয় না।
বাড়িয়ে বলে।
কী যে বলেন। আপনারা হলেন আমাদের গৌরবের বস্তু। আর মেয়েকে আমি আজীবন সেই শিক্ষাই দিয়েছি, মানীজনকে সম্মান দেওয়া। সতের বছর বয়েস হলে কী হবে লতিফার, বুদ্ধিতে, বিবেচনায়, নিজের মেয়ে বলে বলছি না, যে কারো সাথে পাল্লা দিতে পারে। আমি জানি। এবার তো আই.এ দিল।
হ্যাঁ, দিয়েছে। ভাবছিলাম বি.এ পর্যন্ত পড়াব।
তা কী হলো?
একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসে গেল।
বিয়ে দিচ্ছেন লতিফার?
অবাক হয়ে গেল বাবর। এজন্যেই কি তাকে কোনো খবর না দিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছে লতিফা? ওভাবে তার হঠাৎ অন্তর্ধানের কোনো কারণ খুঁজে না পেয়েই বাবরের এতদূর আসা। আসার ঝুঁকিটাও কম ছিল না। যদি কাজী সাহেব সহৃদয় ব্যবহার না করেন? যদি তিনি কিছু সন্দেহ করে বসেন? কিম্বা লতিফাই যদি কঠিন হয়?
লতিফা চা নিয়ে এলো। চায়ের সঙ্গে নানা রংয়ের পাঁপড় ভাজা।
ভাল আছেন বাবর চাচা?
তার অপূর্ব সেই উজ্জ্বল মুখখানা সৃষ্টি করে লতিফা বলল। বলে মাথা কাৎ করে চা বানাতে লেগে গেল। কোনো কিছুতে মনোযোগ দিলেই লতিফার মাথাটা কাৎ হয়ে আসে। ভঙ্গিটা বাবরের ভারি চেনা।
হ্যাঁ, ভাল আছি। তুমি? তুমি কেমন?
ভাল। চায়ে কতটা চিনি?
এই ছলনাটুকু ভাল লাগল বাবরের। লতিফা জানে বাবর চায়ে কতটা চিনি খায়।
এক চামচ। ব্যাস। ওতেই হবে।
বাবা, তোমাকে কতটা চিনি?
বাড়িতে তো থাকিস না জানিসও না। চায়ে আমি চিনি খাই না।
ও, মনে ছিল না।
কাজী সাহেব প্ৰীত মুখে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, জানেন বাবর সাহেব, আমার এই মেয়েটাকে আমি কত ভালবাসি।
যেন তোমার আরো দুপাঁচটা মেয়ে আছে। ঠোঁট গোল করে লতিফা বলল। বাবর জিগ্যেস করল, তুমি চা খাচ্ছ না?
না, এইমাত্র খেয়ে উঠেছি।
বিকেল চারটায় ভাত খেয়েছ?
আর বলবেন না, মেয়টা যদি কোনো কথা শোনে। শুধু অনিয়ম করবে। এইতো সারা দুপুর বাথরুমে বসে বসে পানি ঢেলেছে।
বলেছে তোমাকে!
তা নয়তো কী?
আচ্ছা। আপনিই বলুন বাবর চাচা, চুল ঘষতে, শ্যাম্পু করতে সময় লাগে না? বাবা কিছু বুঝে না।
কিন্তু ঠাণ্ডা লাগতে পারে। ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হতে পারে।
জুর আমার হয় না।
সে-কী!
জিজ্ঞেস করে দেখুন না বাবাকে, কবে আমার জ্বর হয়েছে।
কেন, ৬৬ সালে দেশে গিয়ে এক ঝুড়ি কাঁচা আমি খেয়ে যে জ্বর বাধালি। সেটা বুঝি জ্বর না!
মফঃস্বলে আমন রোদে গায়ে করে তা অভ্যোস নেই। তাই গা গরম হয়েছিল একটু।
হা হা করে হেসে উঠলেন কাজী সাহেব। বললেন, লতিফার সঙ্গে কারো পারবার উপায় নেই।
সত্যি কথা বলি বলেই পার না।
লতিফার গলায় একটু ঝাঁঝ, একটু তিক্ততা টের পেল বাবর। কেন? কেন এই উষ্মা? কার ওপর? একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে, হঠাৎ কাপ পিরীচের শব্দে জেগে উঠল। লতিফা ট্রে গুছিয়ে ভেতরে যাবার উদ্যোগ করছে।
বাবর বলল, বাপ মায়ের কাছে এসে তোমার স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে।
ছাই হয়েছে।
তুই কী বুঝিস? অ্যাঁ তুই বুঝিস কী। কাজী সাহেব হাসতে হাসতে তিরস্কার করে উঠলেন মেয়েকে। বুঝলেন বাবর সাহেব, হোস্টেলে থেকে থেকে খাওয়া দাওয়াই ভুলে গেছে। মেয়েটা। এক টুকরোর বেশি দুটুকরো মাংস দিলে তেড়ে ওঠে এখন।
হ্যাঁ খাইয়ে খাইয়ে আমাকে একটা হাতি বানাও।
শুনছেন, কথা শুনছেন ওর। রাতদিন এই বলবে। আর না খেয়ে থাকবে। আচ্ছা বলুন তো কী এমন মোটা ও?
মোটেই না।
আপনাদের ও দুটো চোখ, না বোতাম? বলে লতিফা হাসতে হাসতে ট্রে নিয়ে চলে গেল। তার পেছনটা দুলে উঠল। নরোম একটা ছোট্ট শাদা জন্তুর মত। ময়মনসিংহে এসে স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে লতিফার। গাল দুটো লাল হয়েছে। শরীরে একটা তরঙ্গ এসেছে।
আপনার মেয়েটি চমৎকার। অসাধারণ বুদ্ধিমতি। মাথা অত্যন্ত পরিষ্কার। ওর সায়েন্স পড়া উচিত ছিল। ডাক্তার হতে পারত। কিন্তু অংকে বড্ড কাঁচা বলেই তো দিইনি।
অংকে কাঁচা নাকি?
ম্যাট্রিকে মাত্ৰ চল্লিশ পেয়েছিল। তাছাড়া কী জানেন, আমিও আগেই বুঝেছি লেখাপড়া বিশেষ ওর হবে না।
এটা আমি স্বীকার করলাম না।
কাজী সাহেব বলে চললেন, আমি ওকে শুধু ভাল হাউস-ওয়াইফ হতে যা দরকার তাই করে দিচ্ছি। যেন কোনো অবস্থাতেই অপ্রতিভ না হয়।
অবশ্যি এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি; কিন্তু আমি সমর্থন করি না।
মৃদু হাসছিলেন কাজী সাহেব তখন থেকে। এবার হাসিটা আরো স্পষ্ট দেখােল! বোধহয় কিছু বলতে চান। বাবর উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। তাঁর দিকে।
কই, সিগারেট খান।
কাজী সাহেব তার ব্ৰ্যাণ্ড বাড়িয়ে দিলেন।
আপনার ব্ৰ্যাণ্ড আনতে দিয়েছি।
কেন আবার কষ্ট করতে গেলেন?
না, না, কষ্ট কীসের। আপনি এসেছেন, কত যে খুশি হয়েছি। মনে মনে আপনার কথাই ভাবছিলাম কদিন থেকে। আপনি খুব ভাল সময়ে এসেছেন। খুব ভাল হয়েছে।
কী ভাল হয়েছে জানতে পারার আগেই কাজী-গৃহিণী এলেন। চট করে একটা ধোয়া শাড়ি পরে মাথার চুল গুছিয়ে গাছিয়ে এসেছেন।
উঠে দাঁড়াল বাবর।
আদাব ভাবী। ভাল আছেন।
জি ভাল। বসুন। ছেলেমেয়ে সব ভাল?
ভাল।
কাজী-গৃহিণী হাসলেন।
মিথ্যেটার জন্যে বাবর একটু অস্বস্তি বোধ করল। বিয়ে সে করেনি, এই কথাটা এদের আর জানাবার উপায় নেই।
আপনাকে টেলিভিশনে মাঝে মাঝে দেখি।
বিজ্ঞানের এই এক অবদান! নিজে না আসতে পারলেও কেমন দেখা হয়ে যাচ্ছে।
স্বামী স্ত্রী উভয়েই অনাবিল উপভোগ করলেন রসিকতটুকু।
আজ থেকে যেতে হবে কিন্তু।
কাজী ভাইকে তো বলেছি থাকব।
কাজী সাহেব ভাই সম্বোধনে খুব প্রীত হলেন, উৎসাহ পেলেন, কৃতাৰ্থ বোধ করলেন। বললেন, কয়েক দিন থাকলে সত্যি খুব খুশি হতাম।
আরেকবার এসে না হয় থাকব।
তখন তো বাড়ি খালি হয়ে যাবে। বিষণ্ণ স্বরে কথা কটি উচ্চারণ করলেন কাজী সাহেব।
বাবর ঠিক বুঝতে পারল না অর্থটা। জিজ্ঞেস করল, মানে?
লতিফার বিয়ে দিচ্ছি যে।
কানে শুনেও যেন কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারল না। বাবর।
বিয়ে দিচ্ছেন?
হ্যাঁ। একটা ভাল ছেলে পেয়ে গেলাম।
শুকনো গলায় বাবর জিজ্ঞেস করল, কবে?
দিন তারিখ ঠিক হয়নি। তবে খুব শিগগির। পাকা দেখা হয়ে গেছে।
ছেলে কী করে?
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়তে বিলেতে যাচ্ছে এ বছরে। লতিফাকে নিয়ে যাবে।
বিলেত যাবার এতদিনের স্বপ্নটা তাহলে সত্যি হবে লতিফার— ভাবল বাবর। চুপ করে রইল সে।
কাজী গৃহিণী বললেন, পাত্র আমারই খালাতো বোনের ছেলে। লতিফাকে দেখে ওর খুব পছন্দ। আমি পড়ানোর পক্ষে। ছেলে বলল, বিয়ের পরেও তো পড়তে পারে। বিলেতে পড়াশুনা আরও ভাল হবে।
তা হবে।
মনটা যেন কোথায় এক চিলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু কেন, বাবর তা বুঝতে পারল না। বাহ লতিফার কোনোদিন বিয়ে হবে না নাকি? সে নিজেই তো কতদিন লতিফাকে বিয়ের কথা বলেছে। বলেছে, বিয়ে হলে তার বাড়িতে যাবে। কী খেতে দেবে লতিফা? থাকবার জন্যে জোর করবে না? স্বামীর সঙ্গে কী বলে আলাপ করিয়ে দেবে তাকে?–আরো কত কী! আর, লতিফার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এদিকে, অথচ কিছুই সে জানে না। এ জন্যেই কি হঠাৎ ঢাকা থেকে সে চলে এসেছে কোনো খবর না রেখে? কই লতিফার সঙ্গে তার যখন শেষ দেখা হয়েছে তখন তো কিছুই বোঝা যায় নি। অথচ কতদিন বাবরকে বলেছে, কোনো কিছুই তার কাছে সে গোপন করে না।
কাজী-গৃহিণী বললেন, সন্ধ্যে হয়ে এলো। আমি রান্না ঘরে যাই।
ভাল করে রান্না করো কিন্তু।
সে তোমাকে বলতে হবে না। ওঁর মত লোক আসা ভাগ্যের কথা।
কী যে বলেন। সলজ্জ শোভন হবার চেষ্টা করল বাবর। কী এমন মানুষ আমি।
বাপরে বাপ! টেলিভিশনে এত সুন্দর প্রোগ্রাম করেন। আপনার ধাঁধার আসরগুলো এত মজার হয়। লোকজনকে যখন বলি উনি আমাদের চেনা, তারা বিশ্বাসই করে না।
মনে করে আমরা গল্প করছি। গৃহিণীর সঙ্গে যোগ করলেন কাজী সাহেব।
ভাল কথা, উনি তো শিল্পী মানুষ–কাজী-গৃহিণী স্বামীকে বললেন, লতিফার গয়নার ডিজাইনগুলো ওঁকে দেখাও না। বাবরকে বললেন, আপনি দু একটা পছন্দ করে দিন, কেমন? আমি ডিজাইনের বইটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
কবিতা লেখে না, গল্প লেখে না, অভিনয় করে না, ছবি আঁকে না, গান গায় না–টেলিভিশনে শুধু ধাঁধার আসর পরিচালনা করে বাবর। আর এরা কি-না তাকে শিল্পী বলছে। মনে মনে হাসল বাবর। নিজের সম্বন্ধে অহেতুক উচ্চ ধারণা কোনো সময়েই তার ছিল না। তবু কেমন যেন খুশিও হলো শিল্পী বিশেষণটা শুনে।
হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও। না, আমি নিজেই নিয়ে আসছি।
বাবর আরো খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখল। লতিফার চেহারাটা ঠিক মনে করতে পারছে না সে। মনে করতে পারলে কল্পনায় মিলিয়ে নেয়া যেত কোনটা তাকে মানাবে। ছোট ছোট আয়তক্ষেত্র একটা করে আংটা দিয়ে ঝুলানো–এমনি একটা নকসা চোখে ধরল। বাবরের। তাকিয়ে দেখল কাজী সাহেব উন্মুখ হয়ে আছেন চশমার ভেতর দিয়ে।
বাবর বলল, এটা কেমন?
এইটা?
হ্যাঁ। কিম্বা। আরো দেখতে পারি। দাঁড়ান দেখছি।
আরো কয়েকটা পাতা ওন্টাল বাবর। আবার প্রথম থেকে দেখল। কিন্তু কোনো নকসা চোখে ধরল না। তার। তখন সে প্ৰথমে যেটা পছন্দ করেছিল সেটাই আবার বের করল।
আমার মনে হয় এটাই ওকে মানাবে। চমৎকার। খুব আধুনিক। অথচ জমকালো নয়।
বলেই বই থেকে চোখ তুলে দেখে কাজী সাহেবের পেছনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে লতিফা। ঠাণ্ডা স্থির চোখে তাকে দেখছে। বেড়ালের মত সরু তার চোখের তারা।
এক মুহুর্ত কোনো কথা বলতে পারল না। বাবর। টেলিভিশনে অমন তুখোর অমন সপ্রতিভ কথা বলিয়ে যার খ্যাতি সেই বাবর একেবারে বোবা হয়ে গেল। তার চোখে শুধু অর্থহীনভাবে খেলা করতে লাগল লতিফার ভিজে ভিজে চুল যা ঘাড়ের উপর মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। একটু লালচে। গোঁড়ার দিকে একটু কুঞ্চিত। ঢাকাতে এ রকম খোলা চুল কখনো দেখেনি সে লতিফার। নিত্য নতুন বাঁধনে আবদ্ধ তার চুল বাবরকে প্রীত করেছে। আজকের এই খোলামেলা ছেড়ে দেওয়া চুলের রাশ লতিফাকে যেন কন্যারূপে তুলে ধরেছে।
কিন্তু টেলিভিশনে আসর পরিচালনা করে বাবর খ্যাতিমান। যে কোনো অবস্থায় সপ্রতিভ হয়ে থাকাটা তার প্রতিভা। এখনও তার প্রমাণ পাওয়া গেল। মুহুর্তে সপ্রাণ হয়ে উঠে সে। বলল, বাতিটা জ্বালো লতিফা। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
হ্যাঁ, আরে তাইতো, বাতি জ্বল মা, কখন সন্ধ্যে হয়েছে। কাজী সাহেব ব্যস্ত গলায় বললেন। মেয়ের সামনে মেয়ের গয়নার নকসা তাকে অপ্ৰস্তুত করে ফেলেছে।
বাবার মত আপনিও একটা চশমা নিন না। বাতিটা জ্বালাতে জ্বালাতে লতিফা বলল।
চমশাতে কি আর অন্ধকার আলো হয়?
তা হয় না, তবে বয়স হলে চশমাটা মানায়।
ও-কী কথা! কাজী সাহেব শাসন করেন মেয়েকে।
বাবর হেসে বলল, পাগল মেয়ে একটা।
হঠাৎ লতিফা বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল, বাবা, সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তুমি এখনো ঘরে! কী যে বুড়ো হয়েছ, যাও একটু বেড়িয়ে এসো।
বারে, তোর বাবর চাচা এসেছেন যে!
তা তাকেও নিয়ে যাও। তাকে কি রেখে যেতে বলছি! আর আসবার পথে একটা টম্যাটো কেচাপের বোতল নিয়ে এসো।
আচ্ছা, আচ্ছা।
গৃহিণীর সাথে সাথে কাজী সাহেবও ভেতরে চলে গেলেন।
ভেতরে একা একা লতিফা কী করছে? কেন সে আসছে না? বাবরের কপাল কুঞ্চিত হলো। লতিফা কী তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? অসুখী হয়েছে সে আসতে? হয়ত সেজন্যেই কথায় অত ঝােঝ ছিল তার। বাবার উপরেও নিশ্চয়ই খুব চটে যাচ্ছিল তাঁর অমন সহৃদয়তা দেখে। লতিফার সঙ্গে দেখা হলে ভাল হতো। বাবর তাকে জিগ্যেস করত। এভাবে ঢাকা থেকে হঠাৎ তার গা ঢাকা দেবার অর্থটা কী? সে কেন সেদিন কথা দিয়েও আসেনি? বাবর তার জন্যে সারা দিন বসবার ঘরের পর্দা টেনে টেপ রেকর্ডার ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করেছিল।
অপেক্ষাটা এখনো বড় অসহ্য মনে হচ্ছে। সামান্যক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে লতিফা গোল কোথায়? কাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে বাঁ ডেকে দিতে বলবে, কেমন সঙ্কোচ হলো। এমনিতেই এভাবে এসে পড়ে অবধি অপরাধ বোধটা যাচ্ছে না। পাছে ওরা কেউ টের পেয়ে যায়। ময়সনসিংহে আদতেই তার কোনো কাজ ছিল না এক লতিফার খোঁজ নেয়া ছাড়া।
গয়নার একটা ছোট বই আর চশমা নিয়ে কাজী সাহেব ঘরে এলেন। বসলেন চেয়ার টেনে ঘন হয়ে। মেলে ধরলেন বই।
আপনি চশমা ব্যবহার করেন নাকি? সলজ্জ হেসে কাজী সাহেব উত্তর করলেন, ঐ পড়ার সময়। বয়স তো কম হলো না।
কত আর হবে?
এই নভেম্বরে চুয়াল্লিশ পড়বে।
বেশ অল্প বয়সেই তাহলে বিয়ে করেছিলেন।
অল্প আর কোথায়? আমার তখন বাইশ কী তেইশ। বড় খোকা এখন কুড়িতে। ছেলেবেলায় বাবা মারা গিয়েছিলেন তো, তাই ঝটপট সংসারী হতে হয়েছিল।
আমার চেয়ে মাত্র চার সাড়ে চার বছরের বড়, ভাবল বাবর। তার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, দুদিন বাদে নানা হবেন, আর সে এখনও বিয়েই করল না। সময় হলো না সংসারী হবার। বিলেতে একবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বছরখানেক জয়েসির সঙ্গে বাস করেছে। মাখনের মত রং সেই তার নগ্ন শরীরটা এখনো চোখে ভাসে বাবরের। বিছানায় চমৎকার সাড়া দিত মেয়েটা। বিয়ের জন্যে শেষ দিকে বড্ড ঝুল ধরেছিল। তাকে কোনোক্রমে সোবহানের ঘাড়ে এবং ঘরে চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছিল সে। বিয়ের কথা কিছুতেই ভাবতে পারত না। কল্পনা করতে পারত না স্বামী হিসেবে। মানুষ কী করে সংসার করে, বাবা হয়, শ্বশুর হয়, নানা-দাদা হয় কে জানে?
প্রথমে গলার হার দেখুন। এইটেই জরুরি। এর সঙ্গে মিলিয়ে কানে আর হাতে। দেখুন। ডিজাইনের চলচ্চিত্র সরে যেতে থাকে বাবরের চোখের সম্মুখে। পাতার পর পাতা উল্টে যান কাজী সাহেব।
কোনটা পছন্দ?
আপনারা কোনটা পছন্দ করেছেন?
আগে আপনি পছন্দ করুন, তারপর বলব।
লতিফা বাবরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল। চলে গেলে কাজী সাহেব হেসে বললেন, বুঝলেন না মেয়ের লজ্জা হয়েছে।
কেন?
বিয়ের গয়না পছন্দ করছি যে আপনাকে নিয়ে।
হুঁ, তাই। বাবর যোগ করল, মেয়েদের এই লজ্জাটা স্বাভাবিক।
কাজী সাহেব উত্তরে বললেন, আজকাল অবশ্য অনেক নির্লজ্জ মেয়ে দেখবেন। আমার মেয়েকে আমি সব রকম আধুনিকতা শিখিয়েছি, কিন্তু তাই বলে কোনোদিন নির্লজ্জ হবার শিক্ষা দিই নি।
আপনি অনেক ভাবেন দেখছি।
হ্যাঁ ভাবি। অনেকের অনেক রকম উচ্চাশা থাকে। আমার একটি মাত্রই অ্যাম্বিশন, আর তা হচ্ছে ছেলেমেয়েদের মানুষ করা। তারা শিক্ষিত হবে, আধুনিক হবে, আবার ভয়ভক্তি থাকবে। গোঁড়া হবে না।
আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আপনি সফল।
লতিফাকে দেখে বলছেন তো? তবুও বেয়াড়া, মেজ কি-না তাই। দেখতেন। আমার ছেলেটাকে।
কী যেন নাম?
ডাকি বড় খোকা বলে। ভাল নাম কাজী আসাদুল্লাহ। ওর কম্যাণ্ডিং অফিসার ভারি পছন্দ করে খোকাকে। কুমিল্লা ক্যান্টে আছে। যদি কখনো যান খোঁজ করবেন।
হ্যাঁ, নিশ্চয় করব। আমি সব সময়েই ঘুরে বেড়াই। যেমন আজ এই হঠাৎ ময়মনসিংহে আসতে হলো।
এসেছেন খুব খুশি হয়েছি। কুমিল্লায় গিয়ে বলবেন ব্রিগেডিয়ার সাহেবের এডিসি-র কথা। আমার ছেলেই এখন এডিসি। দেখলে আলাপ করলে বুঝতে পারবেন। ছেলেমেয়েকে কোন শিক্ষায় আমি মানুষ করেছি।
হ্যাঁ, আলাপ করব। বোধহয় সামনের মাসে যাব কুমিল্লায়।
এটাও একটা মিথ্যে। এক মিথ্যের জন্য কত মিথ্যে যে বলতে হয়। ময়মনসিংহে আসাটা যে নেহাতই ব্যবসার কাজে সেই মিথ্যেটার সমর্থনে এখন কুমিল্লা যাবার প্রতিশ্রুতি এমনকি সম্ভাব্য সময়ও দিতে হলো।
চলুন বেরই। ময়সনসিংহে এসেছেন কখনো এর আগে?
না।
তাহলে প্ৰথমে শহরটা একবার ঘোরা যাক, কী বলেন।
না, না এসেছি কাজে, কাজ শেষ হয়েছে, আপনাদের দেখা পেলাম। শহর দেখার চেয়ে আপনাদের সাথে বসে দুটো কথা বলার ইচ্ছে। মনের মত মানুষই আজকাল পাওয়া যায় না যে কথা বলবেন।
চলুন তাহলে ক্লাবে যাওয়া যাক। সেখানে বসে গল্প হবে। কাজী সাহেব গাড়ি বের করলেন। বাবর বলল আমার গাড়িটাই নিতাম।
সারাদিন চালিয়ে এসেছেন ঢাকা থেকে। এখন বিশ্রাম দরকার।
আমার না। গাড়ির? বাবর একটু রসিকতা করল।
দুজনেরই। তাছাড়া আপনাকে নিয়ে যাব এত আমার সৌভাগ্য।
খাঁটি ভদ্রলোক কাজী সাহেব। বোধহয় খুব একা থাকেন। একা থাকলে অনেক সময় মানুষ এ রকম আগ্রহ হয়ে উঠে কারো উপস্থিতিতে। বাবর লক্ষ করল, কাজী সাহেব গাড়ি খুব চালান না। তার একটু ভয়ই করল। যখন তিনি গেট দিয়ে গাড়ি বের করার সময় দেয়ালের সঙ্গে প্রায় লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। ওদিকে পথে পড়েই একটা রিকশাকে বাচাতে গিয়ে এমন জোরে ব্রেক করলেন যে বাবরের মাথাটা উইণ্ডশিন্ডে প্রায় ঠুকে গেল।
কাজী সাহেব অপ্ৰস্তৃত হয়ে একটু হাসলেন। বলেলেন, ব্রেকটা একটু ট্রাবল দিচ্ছে।
বাবর ভাবছিল লতিফার কথা। একটু অন্যমনস্ক ছিল।
কী ভাবছেন?
না, কিছু না।
নিশ্চয়ই কোনো প্রোগ্রামের কথা।
প্রোগাম মানে টেলিভিশন প্রোগ্রাম। বাবর ভাবল, এরা বাইরে থেকে মনে করেন আমরা একেকটা প্রোগ্রামের জন্য সারাক্ষণ চিন্তা করি। ভুলটা সংশোধন করবার লোভ হলো তার, কিন্তু করল না। বাবর তার প্রোগ্রাম নিয়ে কখনোই আগে থেকে কিছু ভেবে রাখে না। সে মুহুর্তের প্রেরণায় বিশ্বাসী। প্রোগ্রাম রেকর্ড করবার ঘণ্টাখানেক আগে খানিকটা সুরা পান করে এবং একা থাকে। তার যা কিছু করণীয় বাঁ বক্তব্য সেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বের করে ফেলে সে। তারপর সোজা চলে যায় ক্যামেরার সামনে রেকর্ড করবার জন্যে। যতক্ষণ রেকর্ড না হচ্ছে অস্বাভাবিক রকমে গম্ভীর থাকে। বাবর। আয়েশা বলে যে মেয়েটা, সে একবার বলেছিল, বাবর যখন সঙ্গম করে তখন এত গম্ভীর থাকে যে মনে হয়। অংক করছে। নিন, সিগারেট নিন।
আপনি শুধু শুধু কিনলেন। আমিই নিতাম।
ও একই কথা। কোনদিকে যাব বলুন?
যেদিকে ইচ্ছে।
শহর দেখবেন?
না। ক্লাবে যাবেন বলছিলেন।
ঘড়ি দেখলেন কাজী সাহেব। বললেন, ক্লাব খোলার এখনো মিনিট কুড়ি বাকি আছে। আচ্ছা চলুন।
গাড়ি ক্লাবের দিকে ঘোরালেন কাজী সাহেব।
বাবর বলল, আমার কিন্তু ঐ ডিজাইনটা ভারি পছন্দ। লতিফাকে মানাবেও। ওটারই একটা সেট বানিয়ে দিন।
লতিফা অন্য একটা পছন্দ করেছিল।
কোনটা?
ঐ যে একটার মধ্যে ছোট ছোট সার্কল-ক্ৰমে বড় হচ্ছে যত নিচে নামছে, – ঐটা, মাঝে পাথর বসানো।
মনে পড়েছে। ওটাও ভাল।
আসলে বাবরের মনে পড়েনি। কোন ডিজাইনের কথা কাজী সাহেব বলছেন কে জানে। বাবর বলল, বানাতে দেয়া হয়ে গেছে?
না, হয়নি। আজকেই দোকানে যাবার কথা ছিল। আপনি এলেন-।
আমার জন্যে কী ছিল। তাহলে আমিও যেতাম।
কাল যাওয়া যাবে। কাজী সাহেব একটু পর আবার বললেন, আপনি যেটা পছন্দ করছেন সেটাও খুব ভাল। আমারও খুব মনে ধরেছে। ভাবছি, ওটাও এক সেট বানিয়ে দেব।
হ্যাঁ, একই মেয়েতো আপনার।
হ্যাঁ, ঐ একটাই মেয়ে। বড় আদরে যত্নে ওকে মানুষ করেছি। বাবর সাহেব। মেয়ের বাপ হবার ট্রাজেডি কী জানেন? নিজ হাতে মানুষ করে তাকে অন্যের কাছে দিতে হয়। এই যে এত আপন, সব মিথ্যে, পর হয়ে যাবে। আপনার মেয়ে বড় হোক তখন বুঝবেন।
বাবর চুপ করে রইল।
আপনার মেয়ের নাম কী রেখেছেন? চমকে উঠল বাবর। আরো একটা মিথ্যে কথা বলতে হবে তাকে। সে বলল, বাবলি।
বাবলির কথাই একটু আগে সে ভাবছিল।
বাহ, ভারি সুন্দর নাম। ভাল নাম কী?
বাবলি বাবর।
অবলীলাক্রমে সে বানিয়ে ফেলল। নামটা। বানিয়ে ভারি পছন্দ হয়ে গেল! তাই আবার সে উচ্চারণ করল, বাবলি বাবর। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছি।
খুব সুরেলা নাম। কবছর যেন বয়েস হলো?
এখন পাঁচ।
যাক, আরো অন্তত বছর পনের কাছে পাবেন। তার পরই মেয়ে আপনার পর।
বিয়ে দিলেই মেয়ে পর হয়?
কী জানি, আমার যেন তাই মনে হয়। আমি কিন্তু আপনার পছন্দ ঐ ডিজাইনেরও একটা সেট বানিয়ে দেব।
নিশ্চয়ই।
ক্লাবের সামনে এসে পড়ল তারা। কাজী সাহেব গাড়ি একটা মনমত কোণে রাখতে রাখতে বললেন, সাধারণত ক্লাবে আসি না। অনেকদিন পরে আজ আসছি। তা প্ৰায় মাস তিনেক হবে।
শুধু শুধু তাহলে এসে কী দরকার ছিল?
শুধু শুধু কেন? আপনি আছেন যে। মনের মত লোক না পেলে এখানে এসে দুদণ্ড বসা যায় না। ছোট শহর। বসলেই পরিচর্চা আর চাকরির গল্প, ভাল লাগে না সাহেব। পরিচর্চার মত সুস্বাদু আর কিছু নেই যে।
খুব ভাল বলেছেন পরিচর্চা যারা করে তাদের আমি এক মুহুর্ত সহ্য করতে পারি না।
ক্লাবটা ভারি সুন্দর। নিচু একতলা লম্বা দালান। সামনে পেছনে বাগান। খেলার জায়গা। বসবার কোণ।
বাইরে বসবেন, না ভেতরে?
বাইরের বসি।
বাইরে বেশিক্ষণ বসা ঠিক হবে না।
কেন?
ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে যে! ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
আপনাদের বাথরুমটা কোথায়?
এতক্ষণ একবারও যাবার সুযোগ হয়নি। পেটটা ফুলে রয়েছে। লতিফাদের বাসাতেই লেগেছিল। কিন্তু ভদ্রতা করে বলেনি।
ঐ তো বাঁ ধারে, সোজা চলে যানে। সুইচ ঠিক দরোজার বাইরেই আছে। যান।
বাবর গেল। বাতি জ্বলিয়ে ভেতরে ঢুকল। আয়নায় নিজেকে দেখল। খানিক। অহেতুক মাথায় পাকা চুলের সন্ধান করল সে। থাকলেও রাতে তা চোখে পড়ল না। গালের দুপাশে ডলল কয়েকবার। সেভ ঠিকই হয়েছে। ট্রাউজারের বোতাম খুলল সে! ঘণ্টা সাতেক প্রস্রাব করা হয়নি। হলুদ হয়ে গেছে রং। যন্ত্রটাও বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রায় ভীমাকার ধারণ করেছে। ভারমুক্ত হবার পর এত আরাম লাগল যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সে একটা হাসি উপহার দিল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে এলো বাইরে।
এদিকে আসুন। বলে একটা দরোজার দিকে হাত তুলে ইশারা করলেন কাজী সাহেব। বাবর চোখ তুলে দেখল দরোজার মাথায় সবুজ রংয়ে লেখা BAR.
সে-কী!
অভ্যোস আছে তো?
তা আছে।
তবে আর কী? আসুন, আসুন। অনেকদিন আমি নিজেও বসি না।
কী দরকার?
রেখে দিন তো দরকার। আসুন।
কাজী সাহেব তাকে ঠেলে নিয়ে ঘরে ড়ুকলেন। এক কোণে কাউন্টার। কাউন্টারের সামনে উঁচু কয়েকটা টুল। ওদিকে কয়েকটা নিচু চেয়ার। হালকা বাতি জুলছে। কাজী সাহেব বললেন, বার খোলার সময় হয়নি। বেয়ারাকে ধরে এনে খোলালাম। একটু না হয় অপেক্ষাই করতাম।
কী খাবেন?
আপনি?
আপনার পছন্দ বলুন।
হুইস্কি।
আমারও ঐ। দাও, দুটো বড়। সোডা?
না, সোডা না, পানি।
আমি আবার সোডা ছাড়া পারি না।
সোডা শেষ পর্যন্ত আপনার পেটের ক্ষতি হবে।
তাই নাকি? তাহলে আমি পানি দিয়েই।
দুটো গেলাশ সামনে রাখল বেয়ারা। ওরা টুলে পা বুলিয়ে কাউন্টারে ঠেস দিয়ে বসল। চিয়ার্স।
চিয়ার্স। আপনাকে যেন মাঝে মাঝে পাই।
ধন্যবাদ।
কিছু বলুন না? বাবর নীরবতা ভঙ্গ করল।
আপনি বলুন। আপনাদের কাছ থেকে দুটো ভালমন্দ শোনা তো ভাগ্যের কথা।
হঠাৎ কেমন রাগ হলো বাবরের। লোকটা নিজেকে এত হীন ভাবতে ভালবাসে কেন? এ কোন ধরনের আনন্দ। অথচ সত্যি সত্যি আমি যদি তাকে বলি, আপনি তুচ্ছ, আপনি সাধারণ, আমার কথা শুনুন, আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাহলে বোমা বিস্ফোরণ হবে। এই অতি ভদ্র অতি বিনয়ী লোকটাই হিংস্র ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। মানুষ কেন এ অভিনয় করে?
ভাবতেই চমকে উঠল বাবর। সে নিজেও কি একজন শক্তিশালী অভিনেতা নয়? না, না ও কথা থাক। ও কথা এখন ভাবতে চায় না। বাবর। ভাবনাটাকে ভাসিয়ে দেবার জন্য সে ঢাক ঢক করে এক সঙ্গে বেশ খানিকটা হুইঙ্কি গলায় ঢেলে দিল।
আপনি যে হঠাৎ এভাবে আসবেন, তা ভাবতেই পারিনি।
আমিও না।
ভাবছিলাম, আজকের সন্ধ্যেটা খুবই খারাপ কাটবে। দৈবের কী কাজ দেখুন, আজকের সন্ধ্যেটাই এমন হলো যে আমার অনেকদিন মনে থাকবে।
আমারও।
আপনাকে অনেকে তাকিয়ে দেখছে।
দেখছে নাকি?
দেখবে না? আপনাকে টেলিভিশনে দেখে। ওরা অবাক হয়ে গেছে, আপনি কী করে এখানে এলেন।
আর বলবেন না, ঢাকাতেও এই কাণ্ড। কোনোখানে যেতে পারি না, বসতে পারি না, একটু একা থাকতে পারি না–লোকে চিনে ফেলে।
লতিফার কাছে শুনেছি। ঢাকায় খুব পপুলারিটি আপনার। ও তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বলে বাবর চাচার মত প্রোগ্রাম আর কেউ করতে পারে না।
বলে নাকি?
বলে। আপনি আছেন বলে আমার ভরসাও কম নয়। মেয়েটা একা একা ঢাকায় থাকে। জানি, কিছু একটা হলে আপনি আছেন, দেখতে পাবেন, খবর পাব।
তাতো নিশ্চয়ই।
তাছাড়া আমি জানি, আপনিও ওকে খুব স্নেহ করেন। আপনার ওখানে যায় তো মাঝে মাঝে? যায় না?
হ্যাঁ, যায়।
আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম, ঢাকায় কোথাও যেতে হলে বাবার সাহেবের বাসায় যাবি। আর কোথাও না। বোঝেন তো বার-বাড়ন্ত মেয়ে। সব জায়গায় যেতে দিতে নেই। আমার নিকট সম্পর্কেরও দুজন আত্মীয় আছেন, আমি তাদের বাসায় পর্যন্ত লতিফাকে যেতে দিই না।
কেন?
নিজের মেয়ে বড় হোক তখন বুঝবেন। ভাবছি হোস্টেলে গিয়ে আপনার নাম ভিজিটারদের খাতায় তুলে দিয়ে আসব।
কিন্তু যে বললেন লতিফার বিয়ে দিচ্ছেন। বিলেত যাচ্ছে।
ওহো! এই দেখুন। একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। বলে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে লাগলেন কাজী সাহেব। বাবর বুঝতে পারল হুইস্কি কাজ করতে শুরু করেছে। কাজী সাহেব নেশার আমেজে কী বলতে কী বলছেন। কাজী সাহেব বললেন, আমার জামাইটা খুব ভাল হচ্ছে।
নিশ্চয়ই।
নিজের জামাই বলে বলছি না।এ-কী আপনার গ্লাস খালি, বেয়ারা জলদি দাও।
আপনি?
আমিও নেব। কী বলছিলাম?
বলছিলেন। আপনার হবু জামাইয়ের কথা।
দুটো ছোট ছোট দ্রুত চুমুক দিয়ে কাজী সাহেব বললেন, হবু বলছেন কেন? জামাই হয়েই গেছে। বড় ভাল ছেলে। অমন ব্ৰিলিয়েন্ট ছেলে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। আমার অনেকদিন থেকেই চোখ ছিল ছেলেটার ওপর।
আপনার তো আত্মীয়ের মধ্যেই?
জি, আমার এক কাজিন শালীর একমাত্র ছেলে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে যাচ্ছে। লতিফাকেও নিয়ে যাবে।
বাবর অত্যন্ত সাবধান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, লতিফা কী বলে।
ওতো বিলেত যাবার নামে ওড়ে।
না, বিলেতের কথা বলছি না।
তবে?
এত অল্প বয়সে–মাত্র তো সতের–বিয়ে হচ্ছে, তাই বলছিলাম।
তা বিয়ের জন্যে বয়েসটা একটু কম। সেজন্য আমিও ঠিক সাহস পাচ্ছিলাম না। কামাল ওর মাকে বলেছিল–
কামাল কে?
কেন, আমার জামাই!
ও, বলুন।
কামাল ওর মাকে বলেছিল বিয়ে করলে লতিফাকেই করবে। ওর মা বিলেত যাবার আগে ছেলের বিয়ে নিয়ে চাপাচাপি করেছিলেন কি-না তাই।
তারপর?
কাজী সাহেব আরেকটা বড় চুমুক দিলেন গ্লাসে। মুখটা মুছলেন। তারপর চোখ স্তিমিত করে বললেন, অনেকদিন পরে খাচ্ছি কি-না তাই কেমন কেমন লাগছে।
সে-কী, মাত্র দুপেগ তো খেয়েছেন।
আমি খাই-ই কম। আপনি নিন।
নেব। এটা খালি হোক। এখানে চিপস-টিপস কিছু—
বেয়ারা, চিপস।
সে বলল, চিপসের তো ব্যবস্থা নেই।
যেখান থেকে পার ব্যবস্থা কর। প্রায় হুংকার দিয়ে উঠলেন কাজী সাহেব। তার এ মূর্তি বাবর দেখেনি। উনি যে কাউকে ধমক দিতে পারেন সেটা একেবারে অচিন্তনীয়। অপ্রস্তুত হয়ে গেল বাবর। বলল, থাক না, আমি এমনি বলেছিলাম।
না, থাকবে কেন? ড্রিংসের সঙ্গে চিপস নেই। সেক্রেটারীর কাছে কমপ্লেন করব। আবার কেমন বেয়াদপ, মুখের উপর কথা বলে। তুমকো হাম দেখা লেগা।
আরে, করছেন কী?
এই তুমহারা বাড়ি কাঁহা? কাজী সাহেব ধমক দিয়ে উঠলেন আবার।
জি, রাজশাহী।
রাজশাহী।
রাজশাহী কাহাঁ?
চাঁপাই নবাবগঞ্জ, হুজুর।
চল, তব ঠিক হ্যায়। বলে তাকে রেহাই দিলেন কাজী সাহেব এবং মুখ ফিরিয়ে বাবরকে বললেন, আমার দেশেরই লোক কি-না, তাই ছেড়ে দিলাম।
বেশ করছেন। আপনারা তাহলে রাজশাহীর?
হ্যাঁ। আপনি?
বর্ধমান।
পাটিশনের পর ঢাকায় এসেছেন?
ঠিক পার্টিশনের পর নয়। ১৯৫৪ সালে।
খুব অবাক কাণ্ড।
অবাক কীসের?
আরে, চাকরি নিয়ে আমার প্রথম পোস্টইং যে ছিল বর্ধমানে।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী! খোকার জন্ম হয়। বর্ধমানে।
আর লতিফার?
চাঁটগায়ে।
আর ছোটটি?
মন্টুর কথা বলছেন? ওটি খাস ঢাকাইয়া। আপনি বিয়ে করেছেন কোন ডিস্ট্রীক্টে?
সত্যি মিথ্যের চাষ যাকে বলে আজ তাই হচ্ছে। বাবর একটু স্মিত হেসে সলজ্জ হবার অভিনয় করে সময় নিল। তারপর বলল, ঢাকাতেই।
তাহলে এক হিসেবে আপনিও ঢাকাইয়া। কী বলেন?
ভারি আমোদের একটা কথা যেন তিনি বলেছেন এমনিভাবে দুলে দুলে হাসতে লাগলেন কাজী সাহেব। বেয়ারা তার গ্লাশটা ভরে দিল। আর সে বকুনি খাবার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।
কিন্তু বাবরের এখনও জানা হলো না, বিয়েটা ঠিক হলো কী করে? আর লতিফার প্রতিক্রিয়াই বাঁ কী? বাপ মা কি তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে? খুব সম্ভব। তাই। কারণ, লতিফা এই সেদিনও বলছিল, বিয়ে সে জীবনে করবে না। এই এক মাসের মধ্যে এমন কী হয়ে গেল?
কথাটা কীভাবে তোলা যায়। ভাবতে লাগল বাবর। চারদিকে তাকাল সে। একেবারে নীরব নিঝুম সারা ক্লাব। ভেতরে শুধু তারা দুজন। বাইরেও কেউ নেই। বাবর জিজ্ঞেস করল, বিশেষ কাউকে দেখছি না।
দেখতেন। আগে এলে দেখতেন। কী জমজমাট থাকে।
এখন কী হয়েছে?
চারদিকে যেমন আন্দোলন চলছে সাহেব, সবাই সন্ধ্যের পর ঘর থেকে আর বেরোয় না। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরা। তাদের কীর্তির তো অন্ত নেই সাহেব। ভয়ে, স্রেফ ভয়ে বাসায় বসে থাকে।
ও।
হাসল বাবর। লতিফার কথাটা তোলা যায় কী করে? একটু পর সে আবার চেষ্টা করল, মেয়েরা আসে না ক্লাবে?
ব্যবস্থা তো আছে। মেয়েদের জন্যে আলাদা একটা কামরাও রাখা আছে। কিন্তু সপ্তাহে এক আধাদিন ছাড়া আসে না। আর সময় কই বলুন? ঘর সংসার ছেলে মেয়ে সবারই তো এক অবস্থা।
এবারে আশার আলো দেখতে পেল বাবর। বলল, ছেলেমেয়েদের আপনি খুব ভালবাসেন, না?
ছেলেমেয়েরাই আমার সব। লতিফাকে তো চেনেন, ওকে দেখলেই বুঝতে পারবেন, কী আদরে ওদের বড় করেছি আমি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন কাজী সাহেব। তারপর গ্রাশের দিকে চোখ রেখেই তন্ময় কণ্ঠে বললেন, বিয়ে দিলেই মেয়ে পর হয়ে যায়। তবুও বিয়ে দিচ্ছি। ভাবতে এখনই আমার খারাপ লাগছে।
আর কিছু দিন পর না হয় বিয়ে দিতেন। ছেলেটা ভাল। তাছাড়া, কদিনই বাঁ বাঁচব। বেঁচে থাকতে থাকতে সব বিলিব্যবস্থা করতে পারলে শান্তিতে মরতে পারব।
এটা স্বার্থপরের মত বলছেন।
তা। আপনি বলতে পারেন।
তাহলে কেন দিচ্ছেন?
আমাকে স্বার্থপর বললেন, না?
আপনি ভুল বুঝবেন না।
না, না ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার কেন যেন কিছুদিন থেকে কেবল মনে হচ্ছিল লতিফার বিয়ে দেওয়া দরকার।
হঠাৎ গলার কাছে কেমন দলা পাকিয়ে এলো বাবরের। অত্যন্ত সন্তৰ্পণে জিজ্ঞেস করল সে, কেন এ রকম মনে হচ্ছিল?
জানি না। ঠিক আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। গত ছুটিতে দিন কয়েকের জন্য বাড়িতে এসেছিল লতিফা—
বাবরের মনে পড়ল, সে তাকে গাড়িতে করে ইস্টিশনে দিয়ে গিয়েছিল। শখ করে লতিফা সেদিন একটা শাড়ি পরেছিল গাঢ় নীল রংয়ের। বাবর বলেছিল, সকাল বেলার এই চড়া রদ্দুরে গাঢ় নীলটা চোখে লাগছে, তার উত্তরে লতিফা বলেছিল, চোখে লাগাবার জন্যেই তো পরা।
দিন কয়েকের জন্যে বাড়িতে এসেছিল লতিফা। ও যখন আসে। আমি তখন অফিসে। বাসায় ফিরে দেখি মেয়েটা শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে। সেই তখনই কথাটা চমক দিয়ে গেল মনে। লতিফার বিয়ে দেওয়া দরকার।
তবু স্পষ্ট বুঝতে পারল না বাবর। সে আরো কিছু শোনার প্রত্যাশায় উৎকৰ্ণ হয়ে রইল। তার মাথাতেও সুরার ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কাজী সাহেব অনেকক্ষণ আর কিছু বললেন না বলে বাবরই সরব হলো।
তখনই বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন বুঝি?
সুস্থ অবস্থায় থাকলে এ রকম একটা হাস্যকর কথা না বক্তা বলতে পারত না শ্রোতা শুনতে পারত। গাম্ভীৰ্য না হারিয়ে। কাজী সাহেব উক্তিটা বিবেচনা করে উত্তর দিলেন, না ঠিক তখনই ব্যবস্থা করা যায় নি। তবে ওর মাকে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম।
ভাবী কী বললেন?
তিনি বললেন মেয়ের বয়স কম। আমি বললাম, রাখি বয়স। আগের দিনে সতের বছরে চার ছেলের মা হতো। আমার মা পনের বছরে আমাকে পেয়েছিলেন। আপনার মা?
সুরাপানে বাবর অভ্যস্ত। তাই সে অবিরাম এতক্ষণ পান করার পরও কোনোক্রমে বুঝতে পারল কাজী সাহেবের বেশ নেশা হয়েছে। শেষ প্রশ্নটা তার প্রমাণ।
আপনার মায়ের কত বছরে আপনি হয়েছিলেন বলুন তো? কাজী সাহেব এবারে বিশদভাবে প্রশ্নটা করলেন।
আমার মনে নেই।
হাঃ হাঃ হাঃ। আপনার মনে থাকবে কী করে? আরে, আপনার তো তখন জন্মই হয়নি। হাঃ হাঃ হাঃ!
বাবর হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, বলল নয়, বলে টের পেল সে বলে ফেলেছে, লতিফাকে আমি পছন্দ করি।
লতিফাও বলে বাবর চাচা আমাকে খুব স্নেহ করে।
বলেছে আপনাকে?
কতবার বলেছে। বিশ্বাস না হলে বাসায় ফিরে আপনার সামনেই জিজ্ঞেস করব। নিজ কানে শুনে যাবেন।
আপনার মেয়ের মত মেয়ে আমার চোখে পড়েনি, জানলেন কাজী ভাই।
দোয়া করবেন।
তা সব সময়েই করি।
বাপের মনতো, বেশি প্রশংসা শুনলে মনটা ভয় পেয়ে যায়।
না, না কী যে বলেন ও সব কুসংস্কার।
আপনি আরো নিন। বেয়ারা!
আপনি?
ব্যাস, আমি আর না।
সে হয় না।
আচ্ছা বলছেন যখন, আরেক পেগ নিচ্ছি। বেয়ারা, সাবকে দুটো দাও। দাও, দাও এক সঙ্গে ঢেলে দাও।
স্যার, দশটা বাজে, এখন বন্ধ করতে হয়।
চুপ হারামজাদা।
স্যার, সেক্রেটারী সাহেবের অর্ডার।
ফের কথা।
বেয়ারা চুপ করল।
বাবর বলল, চলুন, গ্লাশটা শেষ করেই উঠা যাক। ভাবী ওদিকে রান্না করে বসে আছে।
আরে আপনি আছেন বলে আমি নিশ্চিন্তে আছি। যত রাতই করি না কেন, কিছু বলতে পারবে না। হাঃ হাঃ। তবে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে ভয়।
লতিফা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ একটাই তো আমার মেয়ে। ওর মা বুঝলেন কোনোদিন আমাকে শাসন করে জুৎ করতে পারেনি, আর সেদিনের মেয়ে, আমারই পেটে হলো, আরে কী বলছি, আমারই ইয়েতে, মানে আমারই মেয়ে, বুঝতেই পারছেন কী বলছি–
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
সেই মেয়ে আমাকে এমন শাসন করে–হাঃ হাঃ। আপনার মেয়ে আছে তো, বুঝবেন, নিজেই বুঝতে পারবেন, মাশআল্লা বড় হোক। কী যেন নাম আপনার মেয়ের?
তাইতো কী যেন একটা বানিয়ে বলেছিল বাবর ভারি মুশকিল হলো তো! কিন্তু বানিয়ে কথা বলা আর কথা বিক্রি করে খাওয়া বাবরের পেশা। সে পাল্টা বলল, লতিফার বিয়ে তাহলে আপনিই ঠিক করলেন। কী করে কথাটা পারলেন ওর কাছে?
আরে বাবার সাহেব, সেই কথাই তো বলছি। মেয়ে আমার বাড়িতে এসেই মাকে বলে, বিয়ে টিয়ে দেবে না আমাকে? শুনুন কথা।
লতিফা নিজে বলেছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনে দেখবেন আপনার ভাবীর কাছে।
অবাক হয়ে গেল বাবর। লতিফা নিজে বলেছে, যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। তার মুখ দিয়ে একটা শব্দ গড়িয়ে পড়ল।
আশ্চর্য।
জানি, জানি, আপনি অবাক হবেন। কিন্তু মেয়েকে আমি সে শিক্ষা দিইনি যে, মনের কথা মনে পুষে রাখবে। আমরা বাবা মা চিরদিন ওকে বুঝিয়েছি যে আমরা তোর বন্ধু, সবচে ভাল বন্ধু। তাই যে কথাটা আর দশটা মেয়ে বলতে লজ্জায় হার্টফেল করত, সে কথা আমার মেয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলতে পেরেছে।
তারপর?
তারপর আর কী? বিয়ে দেবার কথা আমিও ভাবছিলাম। ঐ যে বললাম, তাছাড়া আপনি বললেন, আমি স্বার্থপর। মেয়েকে পর করে নিশ্চিন্ত হতে যাচ্ছি। সেটাও আছে। লিখে দিলাম কামালের মাকে চিঠি। আপনাকে দাওয়াত করব। আসতেই হবে। আপনি না এলে লতিফার বিয়েই হবে না।
আসব, আসব।
আসব বললে হবে না, আসতেই হবে।
আসব। কেন আসব না? এই যে না বলে না কয়ে হঠাৎ চলে এলাম।
সত্যি কী যে খুশি হয়েছি।
এক চুমুকে গ্লাশ শেষ করল বাবর। কিছুতেই এ বিস্ময় তার যাচ্ছিল না যে লতিফা নিজে বিয়ে করতে চেয়েছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে লতিফার মুখ। লম্বা ডিমের মত। লাল লাল ফর্সা। একটা নীল শিরা, কোথায় যেন সুন্দর একটা কাঁথায় নীল সুতার মত। লতিফাকে একবার চোখে দেখতে ভারি ইচ্ছে করছে বাবরের।
বাবর বলল, চলুন।
আর একটু খান।
আর না। সত্যি একটু বেশিই হয়ে গেছে।
এই বলে বাবর পকেট থেকে টাকা বের করল। খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন কাজী সাহেব।
আরে, আরো করছেন কী? মাথা খারাপ? এখানে সব সাইয়ের কারবার বলে বেয়ারার হাত থেকে মেমো নিয়েই সই করে দিলেন কাজী সাহেব। বললেন, চলুন।
বাইরে বেরিয়ে তিনি বললেন, ভাবছেন, মাতাল হয়ে গেছি, না? গাড়ি চালাব কী করে?
কী যে বলেন?
চলুন, এমন আরামে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব যে, জানতেও পারবেন না। তারপর হঠাৎ আচমকা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কাজী সাহেব বললেন, আমার জীবনটা খুব কষ্টে গেছে, জানেন? খুব দুঃখে মানুষ হয়েছি।
আর কিছু বললেন না। তিনি। বাবর কোনো উৎসাহ পেল না যে প্রশ্ন করে। তার মাথায় এখন লতিফার নাম, আর চোখে লতিফার ছবি। লতিফা নিজে বিয়ের কথা বলেছে, আশ্চৰ্য।
প্ৰচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট নিল। অ্যাকসেলেটারে হঠাৎ বেশি চাপ পড়ে গিয়েছিল বোধহয়। বাবর সে কথা তুলে তাকে আর লজ্জা দিল না। পরে হঠাৎ বাবরের মনে পড়ল তার মেয়ের নাম সে বলেছিল বাবলি বাবর। নিজের কাছেই খুব মিষ্টি লাগছে নামটা। বাবলির সাথে নিজের নাম যোগ করার ফলে সুন্দর একটা সঙ্গীতের জন্ম হয়েছে যেন। বাবলি বাবর। ঢাকায় ফিরে বাবলির সঙ্গে দেখা করতে হবে। অনেক দিন দেখা হয় না। নাকি সেও এব। মধ্যে লতিফার মত না কয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে? আজকাল এই সব তরুণী মেয়েদের তাল বুঝতে পারে না সে। বয়সের দুযুগ ব্যবধান। কুড়ি বছর। কুড়ি বছর আগে কলকাতায় ছিল। সে আরেক জীবন। আর এক জগৎ।
এর আগে এতটা কোনোদিন ভাবেনি বাবর। লতিফার হঠাৎ চলে আসা তাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে কোথায়। না, ও কিছু না, সে ভাবল। আমি আজ খানিকটা বেশিই সুরা পান করে ফেলেছি। অতিরিক্ত সুরা পান করলে কখনো কখনো এ রকম রিক্ত পরাজিত মনে হয় নিজেকে।
ভাবনাটাকে পাশ কাটাবার জন্য কাজী সাহেবের দিকে মনোযোগ ফেরাল বাবর। দেখল, মিটমিট করে হাসছেন তিনি, চোখ পথের উপর স্থির নিবদ্ধ।
হাসছেন যে।
এমনি। আজি সন্ধ্যেটা বেশ কাটল।
চমৎকার।
আপনাকে খুব ভাল লাগে আমার। ঢাকায় আসুন না ছুটি নিয়ে। জমিয়ে গল্প করা যাবে কয়েকদিন।
আসব। এলে আপনাকেই প্ৰথম ফোন করব।
আপনি তখন আমার মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন নাম?
বাবলি বাবর।
বাসার কাছে এসে গেল তারা। সদর ফটক বন্ধ। বাবর বলল, দাঁড়ান, আমি নেমে খুলে দিচ্ছি।
হাতঘড়ি আলোর দিকে ধরে কাজী সাহেব শীস দিয়ে উঠলেন।
এ-গা-র-টা বাজে। আমার আবার ভোরে অফিস কি-না। তাই দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ার অভ্যেস।
সন্তৰ্পণে ফটকের ভেতর দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে গ্যারেজে রাখলেন কাজী সাহেব। বাবর সেখানে দাঁড়িয়েছিল। কাজী সাহেব কাছে এলে বারান্দার দিকে এগুলি তারা। ওঠার সিড়িতে পা দিতেই নিশ্চল হয়ে গেল বাবর।
লতিফা দরোজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঢিলেঢালা জামা পাজামা পরনে। আধা স্বচ্ছ নীল রং। চোখে ঘুমের ভাব। রোঁয়া ফোলান আদুরে বেড়ালের মত দেখাচ্ছে মুখটা। দৃষ্টিতে ভ্ৰকুটি। বাবর নিঃশব্দে একটু হাসল। তার কোনো জবাব দিল না লতিফা। তখন সে বলল, এই যে, জেগে আছ।
কাজী সাহেব বললেন, তোর মা কোথায়?
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে একরোখা গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা গিয়েছিলে কোথায়?
বাবর সাহেবকে শহর দেখিয়ে আনলাম। অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলাম, তাই না বাবর সাহেব?
জি।
দরোজা ছেড়ে দিল লতিফা। ওরা ভিতরে ঢুকল। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। এখানে একটা বড় শেড দেয়া বাতি জ্বলছে মৃদু আলো ছড়িয়ে। ঐ কোণে চৌকি পাতা হয়েছে। তাতে কালো শাদা নকসা করা বেড কভার। বাবরের ভাবতে ভাল লাগল বিছানাটা লতিফা নিজ হাতে করেছে। সেদিকে তাকিয়ে সে বলল, অনেক কষ্ট দিলাম তোমাকে।
বিছানা আমি করিনি, মা করেছেন। বলে লতিফ বাবাকে বলল, খাওয়া হয়েছে তোমাদের?
নাহ্। বলে একটা সোফার ওপর ধাপ করে বসে কাজী সাহেব জুতো খুলতে লাগলেন।
কেমন একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা সরসর করে যনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সেটাকে ঘায়েল করার জন্য বাবর একবার হাসবার চেষ্টা করল। গলা দিয়ে শব্দ বেরুল জং ধরা একটা মেশিনের মত।
নাক সরু করে লতিফা বাবার মুখের কাছে মুখ এনে ঘ্রাণ নিল।
তোমরা মদ খেয়েছ?
নাতো। না। এই একটুখানি। বলে অনাবিল হাসবার ভঙ্গি করলেন কাজী সাহেব।
লতিফা বলল, তোমাদের ভাত দেয়া আছে। খাবে এসো।
লতিফাকে দেখে মনে হচ্ছে বাবর যেন এ ঘরে নেই।
খাওয়া শেষে লতিফা জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ পর এই প্রথম বাবরকে, চা খাবেন? না, খেলে আপনাদের নেশা ছুটে যাবে?
সে যে একটা কথা অন্তত বলেছে এতে বড় স্বচ্ছন্দ বোধ করল বাবর। বলল, রাতে তো একবার চা খাওয়া আমার অভ্যোস কিন্তু তোমার যে কষ্ট হবে।
নিঃশব্দে চায়ের পানি গরম করতে গেল লতিফা।
কাজী সাহেব বললেন, আপনি কিন্তু বিয়েতে আসবেন।
আসব, আসব না কেন? লতিফার বিয়েতে আসব।
বাবর নিজেই টের পেল হুইস্কির ওজনে স গুলো সব শ হয়ে যাচ্ছে জিভেয়। চোর চোখে একবার সে তাকাল লতিফার দিকে। কিন্তু তার মনোযোগ কেতলি কাপের দিকে।
নিঃশব্দে চা খেলো ওরা। কাজী সাহেব মাঝখানে কী একটা প্রসঙ্গ তুলতে গেলেন। কিন্তু নিজেই কী বুঝে আর তুললেন না।
লতিফা বাবরকে দ্বিতীয়বার কথা বলল, আপনি তো ক্লান্ত, শুয়ে পড়ুন।
বাবা ঘরে চল।
হ্যাঁ, যাচ্ছি। এত তাড়া দিচ্ছ কেন?
রাত কত তার খেয়াল আছে?
আছে, আছে। বলতে বলতে কাজী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আচ্ছ। আপনি ঘুমোন তাহলে। সকালে দেখা হবে। বাঁ পাশের দরোজা দিয়ে বাথরুম।
আর লতিফা যেতে যেতে তাকে বলল, শোবার সময় বাতি নেভাতে ভুলবেন না।
শূন্য ঘরে একবার মনে হলো বাবরের, লতিফা কথায় এত বিষ ব্যবহার করছে কেন? তারপর ভারি ক্লান্ত উদ্যমহীন মনে হলো নিজেকে। সে শুয়ে পড়ল।
শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল। ঘরের শ্যাওলা পড়া ছাদ, শেড দেয়া বাতি থেকে উর্ধমুখে বেরুনো আলোর চক্র, পর্দা টানা জানালাগুলো। কানের ভেতরে অতি উচ্চগ্রামের কিছু শব্দ তোলপাড় করতে লাগল অবিরাম। এ শব্দ কীসের? কোথেকে আসছে? ও, লতিফা বাতির কথা বলছিল। বাবর বাতি নিভিয়ে দিল।
একবার মনে হলো তখন, সে জাহাজে করে কোথাও যাচ্ছে, যেমন গতবার চাটগাঁ থেকে করাচি গিয়েছিল। আরেকবার ভাবল সে ঢাকায় তার নিজের ঘরেই আছে। কোনটা সত্যি ভালো করে স্থির করার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুমিয়ে পড়ল না। চৈতন্য হারাল সেটাও বিতর্কের বিষয়।