০৭৬. দ্রোণাচার্য্যের দক্ষিণা প্রার্থনা

তবে কতদিনে দ্রোণ শিষ্যগণ প্রতি।
আমারে দক্ষিণা দেহ, বলেন সুমতি।।
দ্রোণ বলিলেন, শুন পার্থ দুর্য্যোধন।
রত্ন আদি ধনে মম নাহি প্রয়োজন।।
পাঞ্চাল-ঈশ্বর খ্যাত দ্রুপদ ভূপতি।
রণমধ্যে তারে আন বান্ধিয়া সম্প্রতি।।
বিশেষ প্রতিজ্ঞা কৈল কুন্তীর নন্দন।
পূর্ব্বে সত্য কৈলা না করিতে অধ্যায়ন।।
যেমতে পারহ আন করিয়া বন্ধন।
আমার দক্ষিণা এই, শুন শিষ্যগণ।।
এতেক শুনিয়া যুধিষ্ঠির দুর্য্যোধন।
বলিলেন সৈন্যগণে সাজিতে তখন।।
রথ গজ অশ্ব সাজে পদাতি বহুল।
সাজ সাজ বলি ধ্বনি হৈইল তুমুল।।
সৈন্যগণ সাজিল দেখিয়া ধনঞ্জয়।
এক রথে চড়ি যায় নির্ভয়-হৃদয়।।
করপুটে জ্যেষ্ঠেরে করেন নিবেদন।
তুমি তথাকারে যাবে কিসের কারণ।।
আমা হৈতে কর্ম্ম যদি না হয় সাধন।
তবে প্রভু পাঠাইও অন্য কোন জন।।
এতেক বলিয়া পার্থ হইয়া সত্বর।
প্রবেশ করেন ক্ষণে পাঞ্চাল-নগর।।
দ্রুপদ পাইল অর্জ্জুনের সমাচার।
আজ্ঞা কৈল আপনার সৈন্য সাজিবার।।
দ্রুপদ চিন্তিত অতি না জানি কারণ।
অর্জ্জুনের আগমন কোন্ প্রয়োজন।।
মন্ত্রী পাঠাইয়া দিল অর্জ্জুন গোচর।
মন্ত্রী বলে, অর্জ্জুনে করিয়া যোড়কর।।
কহ কুরুবর তব কেন আগমন।
আজ্ঞা কর, কোন কর্ম্ম করিব সাধন।।
রাজার মন্দিরে চল, লহ রাজপূজা।
তোমা দরশনে বড় ইচ্ছা করে রাজা।।
অর্জ্জুন বলেন, সব হবে ব্যবহার।
রাজারে জানাও এই সংবাদ আমার।।
অতিথির যত পূজা পাইলাম আমি।
কেবল আমারে আসি যুদ্ধ দেহ তুমি।।
সসৈন্যে আসিতে বল সংগ্রামের স্থলে।
নহিলে অনিষ্ট বড় হইবে পাঞ্চালে।।
কহিলেন মন্ত্রী গিয়া রাজার গোচর।
শুনি ক্রোধে কম্পিত দ্রুপদ নৃপবর।।
ক্ষত্র হৈয়া হেন বাক্য সহে কার প্রাণে।
চতুরঙ্গ-দলে রাজা আসে ততক্ষণে।।
অশ্ব গজ রথ আর না যায় গণনে।
সসৈন্যে বেড়িল গিয়া পাণ্ডুর নন্দনে।।
বসিয়া আছেন পার্থ নিঃশঙ্ক হৃদয়।
নানা অস্ত্র বরিষণ করে সৈন্যচয়।।
অস্ত্র-বরিষণ দেখি উঠেন অর্জ্জুন।
আকর্ণ পূরিয়া টঙ্কারিল ধনুর্গুণ।।
দ্রোণের চরণ ভাবি এড়েন যে শর।
মুহূর্ত্তেকে আচ্ছাদিল দেব দিবাকর।।
আষাঢ় শ্রাবণে যেন নবজলধর।
বৃষ্টিধারা পড়ে তথা সৈন্যের উপর।।
রথী কাটা গেল যদি পলায় সারথি।
দশন কাটিল পলাইয়া যায় হাতী।।
পলায় তুরঙ্গ, কাটা গেল আসোয়ার।
পদাতি পলায়, হাত কাটা গেল যার।।
পলাইল যত জন পাইল সে প্রাণ।
আর যত সৈন্য রণে হইল নিধন।।
হত সৈন্য হ্ইয়া পলায় নরপতি।
পাছু থাকি ডাকিয়া বলেন পার্থ কৃতী।।
নির্ভয় হইয়া রাজা বাহুড় দ্রুপদ।
আমার নিকটে তোর নাহিক আপদ।।
প্রাণে ভয় পেয়ে যেই ভঙ্গ দেয় রণে।
নিশ্চয় লইব ধরি, না যায় খণ্ডনে।।
বাহুড়িল নরপতি অর্জ্জুন-বচনে।
হইল দারুণ যুদ্ধ দ্রুপদ-অর্জ্জুনে।।
মন্ত্র পড়ি দিব্য-অস্ত্র ছাড়েন অর্জ্জুন।
কাটিলেন তখনি তাহার ধনুর্গুণ।।
ধনু কাটা গেল, রাজা লাগিল চিন্তিতে।
ধরিলেন অর্জ্জুন তাহারে দুই হাতে।।
নিজ রথে চড়াইয়া করেন গমন।
হেনকালে সম্মুখে আইল দুর্য্যোধন।।
চতুরঙ্গ দলে আসে কৌরব-ঈশ্বর।
দ্রুপদে দেখিল পার্থ-রথের উপর।।
দুর্য্যোধন বলে, পার্থ নহিল শোভন।
গুরু-আজ্ঞা দ্রুপদেরে করিতে বন্ধন।।
এত বলি আপনি উঠিল দুর্য্যোধন।
হস্তপদ দ্রুপদের করিল বন্ধন।।
ভূমে চালাইয়া নিল করে কেশ ধরি।
সেইমত উত্তরিল দ্রোণ-বরাবরি।।
ফেলাইল দ্রুপদেরে দ্রোণের চরণে।
দ্রুপদে দেখিয়া দ্রোণ বলেন তখনে।।
এবে গব্বী, দ্রুপদ কোথা তব সিংহাসন।
কোথা রাজছত্র কোথা প্রজা অগণন।।
কোথায় ধন জন রাজ-আভরণ।
এবে দেখি পরিয়াছ শৃঙ্খল ভূষণ।।
পুনরপি হাসিয়া বলেন গুরু দ্রোণ।
স্থির হও ভয় নাই আমার সদন।।
জাতিতে ব্রাহ্মণ আমি ক্ষণমাত্র ক্রোধ।
বিশেষ বাল্যের সখা চিত্তে উপরোধ।।
পূর্ব্বের বচন সখা হয় কি স্মরণ।
সেবকে বলিলা দিতে একটি ভোজন।।
এখন সমান হইলাম দুইজন।
এবে সখা বলিবা কি আমারে রাজন।।
বাল্যকালে করিয়াছিলা যে অঙ্গীকার।
আমি রাজা হৈলে রাজ্য অর্দ্ধেক তোমার।।
পালিতে নারিলা তুমি আপন বচন।
এবে সব রাজ্য হৈল আমার শাসন।।
তুমি না পালিলা, আমি চাই পালিবারে।
অর্দ্ধেক পাঞ্চাল রাজ্য দিলাম তোমারে।।
গঙ্গার দক্ষিণ তীর কর অধিকার।
উত্তর তটের রাজ্য সকলি আমার।।
অর্দ্ধা-অর্দ্ধি রাজ্য এই দোঁহার সমান।
পুনঃ সখা হবে যদি, হও যত্নবান।।
এত শুনি বলিল দ্রুপদ নৃপবর।
পরম মহৎ তুমি জগৎ ভিতর।।
যে আজ্ঞা করিলা তাহা স্বীকার আমার।
তুমি হও সখা, আমি হইনু তোমার।।
দ্রোণ কহিলেন, তবে ঘুচুক বন্ধন।
মুক্ত হয়ে যাও তুমি দ্রুপদ রাজন।।
সহজে ক্ষত্রিয় জাতি, ক্ষমা নাহি মনে।
দেশে নাহি গেল রাজা অতি অভিমানে।।
মাকন্দীনগরে বৈসে ভাগীরথী-তীরে।
তথায় রহিল দুঃখ ভাবিয়া অন্তরে।।
দ্রোণেরে জিনিব আমি কেমন উপায়।
কুরুকুল আদি শিষ্য যাহার সহায়।।
বলেতে নহিব শক্ত দ্রোণের সংহতি।
এই মনে চিন্তে সদা দ্রুপদ-ভূপতি।।
ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র দুষ্টমতি দুর্য্যোধন।
আমারে সভাতে নিল করিয়া বন্ধন।।
দ্রোণ দুর্য্যোধন দুই বধের কারণ।
যজ্ঞ করিবারে দ্বিজ কৈল নিয়োজন।।
দ্বিজবাক্য মন্ত্র বিনা নাহিক উপায়।
এত ভাবি যজ্ঞ করে পাঞ্চালের রায়।।
অর্দ্ধেক পাঞ্চাল ভাগীরথীর দক্ষিণে।
তার অধিকারী হৈল দ্রুপদ রাজনে।।
অহিচ্ছত্র নামে ভূমি গঙ্গার উত্তর।
অর্দ্ধেক পাঞ্চালে দ্রোণ হইলা ঈশ্বর।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
একমনে শুনিলে বাড়য়ে দিব্যজ্ঞান।।