০৫১. মহাভিষ রাজার প্রতি ব্রহ্মার অভিশাপ এবং শান্তনুর উৎপত্তি

জন্মেজয় বলে, মুনি কহ আরবার।
সংক্ষেপে কহিলা কহ করিয়া বিস্তার।।
ত্রৈলোক্যপাবনী গঙ্গা বিষ্ণু-অংশে জন্ম।
শান্তনুর ভার্য্যা শুনি এ অদ্ভুত কর্ম্ম।।
মুনি বলে, কহি শুন তাহার কারণ।
মহাভিষ নামে রাজা ইক্ষবাকু-নন্দন।।
ইন্দ্রে সম তেজ যজ্ঞ করিল বিস্তর।
সহস্রেক অশ্বমেধ কৈল নৃপবর।।
দেব-দ্বিজ-দরিদ্রে তুষিল মহামতি।
দানেতে পৃথিবী পূর্ণ কৈল নরপতি।।
ব্রহ্মলোকে গেল রাজা যজ্ঞপুণ্যফলে।
ব্রহ্মার সহিত তথা বৈসে কুতূহলে।।
বহুকাল তথায় আছয়ে নরপতি।
একদিন দেখে রাজা দৈবের যে গতি।।
ধ্যানেতে আছেন ব্রহ্মা বসিয়া আসনে।
সম্মুখে বেষ্টিত যত সিদ্ধ-মুনিগণে।।
ব্রহ্মার সভার তুল্য, নাহি পাঠান্তর।
সবে তথা চতুর্ম্মুখ, গৌর-কলেবর।।
দক্ষ-আদি প্রজাপতি, ইন্দ্র আদি দেবে।
দেব-ঋষি-মুনিগণ নিত্য আসি সেবে।।
সভা করি বসিয়াছে মুনির সমাজ।
তথায় আছয়ে মহাভিষ মহারাজ।।
গঙ্গাদেবী আইলেন ব্রহ্মার সদন।
হেনকালে তেজোবন্ত বহিল পবন।।
বায়ুতেজে জাহ্নবীর উড়িল বসন।
দেখি হেঁটমুণ্ড করিলেন সিদ্ধগণ।।
অপূর্ব্ব গঙ্গার অঙ্গ দেখিয়া সঘনে।
মহাভিষ রাজা দেখে নিশ্চল-নয়নে।।
মহাভিষ রাজা অতি রূপে অনুপাম।
তাঁর দিকে গঙ্গাদেবী চান অবিরাম।।
দোঁহার দেখিয়া দৃষ্টি কহে প্রজাপতি।
মোর লোকে আসি রাজা করিলা দুর্নীতি।।
ব্রহ্মলোকে আসি কর মনুষ্য আচার।
মর্ত্ত্যে জন্ম লয়ে ভোগ কর পুনর্ব্বার।।
পুনরপি হেথায় আসিবা পুণ্যবলে।
চন্দ্রবংমে জন্ম লহ গিয়া ভূমণ্ডলে।।
ব্রহ্মার পাইয়া আজ্ঞা চিন্তে নরপতি।
তমা হৈতে পতন হইল শীঘ্রগতি।।
চন্দ্রবংশে মহারাজ প্রতীপ আছিল।
মহাভিষ রাজা তাঁর গৃহে জন্ম নিল।।
বাহুড়িল গঙ্গা করি ব্রহ্মা দরশন।
পথেতে দেখিল আসে বসু অষ্টজন।।
বিরস-বদন গঙ্গা দেখি বসুগণে।
জিজ্ঞাসিল তোমরা চিন্তিত কি কারণে।।
বসুগণ বলে, চিন্তা করি নিজ দোষে।
বশিষ্ঠ দিলেন শাপ সবে মহারোষে।।
পৃথিবীতে জন্ম হবে, কাঁপিছে অন্তর।
বিশেষে মনুষ্য-যোনি নরক দুস্তর।।
উপায় না দেখি সবে, চিন্তি সে কারণ।
ভাল হৈল তব সঙ্গে হৈল দরশন।।
কোটি কোটি পাপী পাপে করহ উদ্ধার।
আমা সবাকার তুমি কর প্রতিকার।।
গঙ্গা বলে, কি করিব কহ সন্নিধান।
যে করিব অঙ্গীকার না করিব আন।।
বসুগণ বলে, মর্ত্ত্যে জন্মিব নিশ্চয়।
নরযোনি জন্মিতে হতেছে বড় ভয়।।
আপনি মনুষ্যলোকে হয়ে রাজ-নারী।
আমা সবাকার তুমি হও গর্ভধারী।।
আর এক দিবেদন করি যে তোমারে।
জন্মমাত্র ভাসাইয়া দিও তব নীরে।।
বসুগণ-বাক্যে গঙ্গা স্বীকার করিল।
শুনি অষ্ট বসু তবে আনন্দিত হৈল।।
কুরুবংশে আছিল প্রতীত নামে রাজা।
ধর্ম্মেতে তৎপর বড়, তপে মহাতেজা।।
দেবাপি নামেতে তাঁর প্রথম নন্দন ।
অল্পকালে সন্ন্যাসী হইয়া গেল বন।।
দেবাপি বিহনে রাজা হৈল পুত্রহীন।
গঙ্গাকূলে থাকে সদা, বয়সে প্রবীণ।।
তপ জপ ব্রত করে, বেদ অধ্যয়ন।
বৃদ্ধকালে নরপতি রূপেতে মদন।।
তাঁর রূপ গুণ দেখি প্রীতি যে পাইল।
জল হৈতে গঙ্গাদেবী বাহির হইল।।
জাহ্নবীর রূপে নিন্দে এ তিন ভুবন।
দ্বিতীয় চন্দ্রের যেন হইল কিরণ।।
দক্ষিণ ঊরুতে গিয়া বসিল রাজার।
দেখিয়া বিস্মিত হৈল কৌরব-কুমার।।
রাজা বলে, কি করিব, কি বাঞ্ছা তোমার।
সত্য করি কহ যেই বাঞ্ছা আপনার।।
কন্যা বলে, কুরুশ্রেষ্ঠ তুমি মহামতি।
তোমায় ভজিনু আমি, হও মোর পতি।।
রাজা বলে, পরদার আমি নাহি ভজি।
পরদার পরশিলে নরকেলে মজি।।
কন্যা বলে, নহি আমি পরের গৃহিণী।
দেবকন্যা আমি, মোরে ভজ নৃপমণি।।
রাজা বলে, কন্যা নাহি বল হেন বাণী।
দক্ষিণ ঊরুতে বৈসে পুত্রবধূ গণি।।
পুরুষের বাম ঊরু ভার্য্যার আসন।
বুঝিয়া এমত বাক্য কহ কি কারণ।।
সে কারণে তোমারে বধূর মধ্যে গণি।
কেমনে করিব ভার্য্যা, অনুচিত বাণী।।
গঙ্গা বলে, রাজা তুমি ধর্ম্ম-অবতার।
তোমার মহিমা যত বিখ্যাত সংসার।।
তোমার বচনে আমি হইনু স্বীকার।
বরিব তোমার পুত্রে এই অঙ্গীকার।।
আমার নিয়ম এই শুন মহারাজ।
নিষেধ না করিবে আমার প্রিয়কাজ।।
তবে সে তোমার পুত্রে করিব বরণ।
এত বলি অন্তর্ধান হইল তখন।।
কন্যার বচনে রাজা আনন্দিত হৈল।
পুত্র হবে বলি রাজা ভার্য্যারে কহিল।।
ভার্য্যা সহ ব্রতাচার করিলেন ভূপ।
কতদিনে জন্মে তাঁর পুত্র অনুরূপ।।
দশমাস দশ দিনে হইল কুমার।
রাজীব-লোচন মুখ চন্দ্রের আকার।।
শান্তশীল পুত্র, নাম শান্তনু থুইল।
তাঁহার অনুজে নাম বাহ্লীক রাখিল।।
দিনে দিনে বাড়ে তাঁর যুগল তনয়।
কত দিনে দেখি পুত্র যৌবন সময়।।
শান্তনুরে নিকটেতে আনি নৃপবর।
রাজনীতি ধর্ম্ম-শিক্ষা দিলেন বিস্তর।।
একদিন পুত্রে ডাকি কহিলা রাজন।
বিস্মৃত না হও বৎস আমার বচন।।
একদা শুনহ পুত্র বিধির বিধানে।
আসিল সুন্দরী এক মম সন্নিধ্যানে।।
বধূত্বে তাহারে আমি করিনু বরণ।
অঙ্গীকার করি কন্যা করিল গমন।।
পরিচয়ে দেবকন্যা জানিনু তাঁহায়।
তোমার সদনে যদি আসে পুনরায়।।
ভজিবে তাহারে যদি সে তোমারে বরে।
নিষেধ না করিবা সে যেই কর্ম্ম করে।।
স্বীকৃত হইল পুত্র পিতার বচনে।
শান্তনুরে রাজ্য দিয়া রাজা গেল বনে।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে, শুনি ভববারি হই পার।।