সাধনা – ৫

পাঁচ

মহসিন গাড়িটা ব্রেক করল। পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই, এটাই এলেমদারি বন।’

রফিক সাদি গাড়ি থেকে নামলেন। একটা ছোট সাইনবোর্ড নজরে পড়ল। সেখানে লেখা: ‘এলেমদারি বন। অবাঞ্ছিত ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। গাড়ি বা কোনও যানবাহন নিয়ে ভিতরে ঢুকবেন না।’

রফিক সাদি বললেন, ‘তুমি গাড়িতেই থাকো। আমি এক ঘণ্টার ভিতর আসছি। আর যদি আরও দেরি হয়, তোমাকে আমি ফোনে জানাব।’

‘ঠিক আছে, ভাই।’

একটা আধপাকা সড়ক বনের মধ্যে চলে গেছে। রফিক সাদি সেই পথেই হাঁটা শুরু করলেন। বনের পরিবেশটা আশ্চর্যরকম নীরব। পাখির ডাক নেই, পাতার খসখস শব্দ নেই, এমনকী বাতাসের চঞ্চলতাও নেই। বুকের মধ্যে কেমন যেন কাঁপুনি উঠল তাঁর, পায়ের শব্দ যেন নীরবতা ছাপিয়ে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ছে। কিছুদূর হাঁটার পর কিছু বাড়ি দেখতে পেলেন। সবগুলোই টিনের বাড়ি। তবে বাড়ির ভিতর থেকেও কোনও শব্দ আসছে না। রফিক সাদি একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে দেখে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। লোকটার মাথায় একটাও চুল নেই। সবসময় মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে লুঙ্গি ছাড়া কিছু নেই। গলা থেকে তলপেট পর্যন্ত উল্কি আঁকা। অদ্ভুত ধরনের উল্কি। একটা মানুষের অবয়ব বলে মনে হচ্ছে। রফিক সাদির কেন জানি মনে হচ্ছে, এই অবয়বটাকে তিনি চেনেন। যেন উল্কি আঁকা মানুষটা রফিক সাদির দিকে তাকিয়ে হাসছে।

রফিক সাদি উল্কি থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঝমঝম কুঠিটা কোন্ দিকে?’

প্রশ্নটা শুনে মানুষটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কোনও জবাব দিল না। মনে হচ্ছে কথাটা বুঝতে পারছে না।

রফিক সাদি তাগাদা দিলেন, ‘ঝমঝম কুঠিটা কোন্ দিকে?’

লোকটা এবারও জবাব দিল না। তবে তার চোখের উজ্জ্বলতা একটু বাড়ল। ইশারায় ডানদিকে যেতে বলল।

রফিক সাদি ডানদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। আরও চার-পাঁচটা টিনের বাড়ি চোখে পড়ল। কোনও বাড়িতেই তেমন লোকজন চোখে পড়ছে না। মিনিট পনেরো হাঁটার পর ঝমঝম কুঠিটা দৃষ্টিগোচর হলো। পুরনো ধাঁচের বিশাল এক দোতলা বাড়ি। কোথাও-কোথাও খসে পড়েছে চুন ও পলেস্তারা। বাড়ির সামনে জন্মেছে রাজ্যের আগাছা। শ্যাওলাতে সবুজ রং ধারণ করেছে বাড়ির কিছু অংশ। সদর দরজাটা ধাক্কা দিলেন রফিক সাদি। কিছুক্ষণ পর বুড়ো মত এক লোক এসে দরজা খুলে দিল। পোশাক-আশাকে মনে হচ্ছে বাড়ির চাকর।

রফিক সাদি বললেন, ‘আমি রফিক সাদি। জয়ের বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি কি আছেন?’

বুড়ো লোকটি মাথা দোলাল। শোনা যায় না প্রায়, এমন গলায় বলল, ‘আসুন। আমার সাথে দোতলায় আসুন।’

রফিক সাদি অনুসরণ করলেন লোকটিকে। ভুলও হতে পারে, তবে কেন যেন মনে হচ্ছে দোতলায় একটা মেয়ে কাঁদছে।

দোতলায় বাইরের এক রুমে তাঁকে বসতে দেয়া হলো। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল। ভিতর ঘর থেকে কারও উত্তেজিত কথা শোনা যাচ্ছে, একইসাথে পাওয়া যাচ্ছে এক মেয়ের চাপা কান্নার আওয়াজও। খানিকক্ষণ পর বাড়ির পরিবেশ কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। ঠিক তখন একজন পুরুষ এবং মহিলা ঘরে ঢুকলেন। রফিক সাদি বুঝতে পারলেন এঁরাই জয়ের মা-বাবা।

রফিক সাদি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন? আমি নুযহাতের বাবা।’

জয়ের বাবা মাথা দোলালেন। মাথায় কোনও চুল নেই। গা উদোম। ঘামে পুরো শরীর ভেজা।

রফিক সাদি লক্ষ করলেন, মানুষটার শরীরে উল্কি আঁকা। প্রথমে বনে ঢুকে যে লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেই লোকটার মত একই উল্কি।

জয়ের বাবা বললেন, ‘আমি সোলেমান গাজি। জয়নাল আপনার কথা আমাদের বলেছে।’

‘জয়নাল কে?’

‘জয়ই জয়নাল। আপনাদের কাছে জয়, আমাদের কাছে জয়নাল। হা-হা।’ সোলেমান গাজির হাসিটা যেন কেমন, পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

‘আচ্ছা, আচ্ছা। আসলে ছেলে-মেয়ে দু’জন দু’জনকে পছন্দ করেছে, এখন বাবা-মা হিসাবে আমাদের দায়িত্ব ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করা।’

‘দেন, বিয়ে দেন,’ কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন সোলেমান গাজি।

‘হ্যাঁ, বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার জন্যই আসলে আমি এসেছি।’

‘দিন-তারিখ ঠিক করতে হবে না, আপনি একদিন মেয়েকে নিয়ে আসুন। সেদিনই বিয়ে হয়ে যাবে।’

‘আমি মেয়ে এখানে এনে বিয়ে দেব?’ রফিক সাদির বিস্ময় যেন সব সীমা অতিক্রম করল।

এবার জয়ের মা বললেন, ‘হ্যাঁ। আমরা বাইরে তেমন বের হই না। বিয়ে সংক্রান্ত এত ঝামেলা আমাদের পছন্দ নয়। আপনি মেয়ে সাজিয়ে এখানে নিয়ে আসবেন, বিয়ে হবে। তারপর থেকে মেয়ে আমাদের।’ আমাদের কথাটার উপর তিনি অনাবশ্যক জোর দিলেন।

রফিক সাদি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। ক্রমেই খারাপ হচ্ছে মেজাজ। এঁরা কি নির্বোধ?

এমন সময় হেলতে-দুলতে কেউ ঘরে ঢুকল। রফিক সাদি তাকিয়ে দেখলেন-জয়। জয়ের দিকে তিনি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মাথায় কোনও চুল নেই। গলা থেকে পেট পর্যন্ত উল্কি আঁকা। তবে একটা মানুষের অবয়বের পাশাপাশি শরীরে কিছু দুর্বোধ্য অক্ষর। জয়ের জিভ বের করা, মুখ থেকে লালা পড়ছে। বোকার মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

জয়ের বাবা বিরক্তমুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এখানে কেন?’ জয় কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলল, ‘ব্যথা করে। খুব ব্যথা করে। ছোট বাচ্চা যেমন কান্নার আগে ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলে, জয়ও তেমন ভঙ্গি করল।

সোলেমান গাজি ধমক দিয়ে বললেন, ‘খবরদার, কাঁদবি না। বজ্জাত।’

জয় বাবার ধমক শুনে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল।

জয়ের মা-ও ধমকে উঠলেন, ‘যা এখান থেকে!’

চোখ মুছতে-মুছতে চলে গেল জয়।

এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের বিব্রত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু তাঁদের মুখে কোনও অস্বস্তির ছাপ দেখা গেল না। জয়ের মা নিরস গলায় বললেন, ‘মাঝে- মাঝে ছেলেটা কেমন যেন ছোট হয়ে যায়। পাগল-ছাগলের মত আচরণ করে।’ বলতে-বলতে তিনি হাসলেন। যেন ছেলে পাগল-ছাগল হওয়াতে তিনি মহাখুশি।

এমন সময় জয়ের চিৎকার করে কান্নার শব্দ শোনা গেল।

সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রী প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

রফিক সাদির মনে কেমন যেন অজানা ভয় কাজ করছে।

এসব কী হচ্ছে!

তিনি ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালেন।

সোলেমান গাজির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।

হঠাৎ রফিক সাদির সামনে এসে দাঁড়াল এক মেয়ে। আশ্চর্যের বিষয় মেয়েটার মাথায়ও কোনও চুল নেই। মুখে-গলায় ছোপ ছোপ রক্ত। কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে বাঁচান!’

রফিক সাদি বললেন, ‘মানে? কে তুমি?’

ভাঙা গলায় কাতর সুরে বলল মেয়েটি, ‘আমাকে মেরে ফেলবে! সত্যি আমাকে মেরে ফেলবে! আমাকে বাঁচান!’

‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’

মেয়েটা হাতজোড় করে বলল, ‘আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। আমি আপনাকে পরে সব বুঝিয়ে বলব। চলুন।’

রফিক সাদি হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে রইলেন।

এই মেয়ে পাগল নাকি? কেমন উদ্ভট কালো জোব্বা আকৃতির পোশাক পরে আছে। মুখ দিয়ে আসছে বিশ্রী গন্ধ। মনে হচ্ছে মদ জাতীয় কিছু খেয়েছে। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগের চেন খোলা। এমন সময় সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠলেন। ‘তুই? তুই ঘর থেকে বের হয়েছিস? যা! ঘরে যা!’

মেয়েটা চিৎকার করে বলল, ‘না! আমি বাড়ি যাব! আমাকে যেতে দাও!’

সোলেমান গাজির চিৎকার শুনে বুড়ো চাকর এবং আরও দু’জন ছেলে ঘরে ঢুকল। ছেলে দু’জন মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল।

মেয়েটা চিৎকার করছে আর বলছে, ‘আমাকে বাঁচান! আমাকে বাঁচান! এরা আমাকে মেরে ফেলবে!’

ছেলে দু’জন তার হাত ধরে টানতে লাগল। তাদের জোরের কাছে হার মানবে না যেন মেয়েটা! সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রীও মেয়েটাকে চেপে ধরলেন। মেয়েটার ব্যাগটা নীচে পড়ে যেতেই মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন জিনিস। টেনে হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো মেয়েটাকে। এখনও শোনা যাচ্ছে তার চিৎকার। বোঝা যাচ্ছে কেউ তাকে মারছে।

রফিক সাদি লক্ষ করলেন, মেঝেতে মেয়েটার চিরুনি, ছোট আয়না, ক্লিপ, কিছু কাগজপত্র ছড়িয়ে আছে। তিনি নিচু হয়ে লেমিনেটিং করা একটা কাগজ তুলে নিলেন। মনে হচ্ছে ওটা আইডি কার্ড। এক ঝলক চেয়েই তিনি দ্রুত পকেটে পুরলেন আইডি কার্ডটা। হঠাৎ কমে এল মেয়েটার চিৎকার।

সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রী আবার ঘরে ঢুকলেন।

সোলেমান গাজি বললেন, ‘ও আমার দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ে। আমার কাছেই মানুষ হয়েছে। মাথার ঠিক নেই।’

রফিক সাদি দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন। এখান থেকে বেরুতে পারলে বাঁচেন। ‘আমি আজ উঠি।’

‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’

রফিক সাদিকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে এলেন না কেউ। বাড়ি থেকে বের হয়ে তাঁর মনে হলো, কিছু একটা যেন অনুসরণ করছে। আনমনেই হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির পিছন দিকে চলে এলেন। কী আশ্চর্য, পিছনে অনেকখানি খোলা জায়গা। দূরে কবরস্থান আছে বলে মনে হচ্ছে। কবরস্থানের পাশেই মাঠ। বোঝা যাচ্ছে, নিয়মিত জায়গাটার পরিচর্যা করা হয়। বেশিক্ষণ সেখানে থাকার সাহস হলো না রফিক সাদির। তিনি হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। এবার প্রতিটা বাড়ির মানুষগুলোকে ঘরের বাইরে দেখতে পেলেন। সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। সবারই গা উদোম এবং সবার শরীরেই সেই অদ্ভুত উল্কি। রফিক সাদির কেন জানি মনে হচ্ছে, মানুষগুলো হিংস্র জন্তুর মত ঝাঁপিয়ে পড়বে। সবার চোখের দৃষ্টি কঠোর থেকে কঠোরতম হচ্ছে।

রফিক সাদি মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন।

তাঁর পিছু নিল কয়েকজন।

পিছনে না তাকিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, তিনি রীতিমত দৌড়াচ্ছেন। একসময় বন পেরিয়ে চলে এলেন মূল রাস্তায়। পিছনে চেয়ে কাউকে আর দেখতে পেলেন না।

ছয়

রফিক সাদিকে হাঁপাতে দেখে পানি নিয়ে ছুটে এল মহসিন।

এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করলেন সাদি।

মহসিন চিন্তিত গলায় বলল, ‘ভাই, কোনও সমস্যা? প্রায় আধঘণ্টা ধরে আপনার মোবাইলে চেষ্টা করছি, কিন্তু ঠিকমত নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘কোনও সমস্যা নেই,’ নিজেকে শান্ত করে বললেন রফিক সাদি। একটু বিরতি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘তা, তুমি আমাকে ফোন করছিলে কেন?’

‘ইয়ে…মানে…ভাই, আপনি এলেমদারি বনে যাওয়ার পর আমি হাইওয়ে ধরে খানিকটা সামনে গিয়েছিলাম। মাইল খানেক দূরে কয়েকটা চায়ের দোকান পেলাম। ওখানে বসে চা খাচ্ছিলাম। চায়ের দোকানদারের সাথে কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ এলেমদারি বনের কথা উঠল। আমার কথায় যেন চমকে গেল লোকটা। বলল যে, এই বন নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক কথা। কী প্রচলিত আছে তা কেউ বলতে চাইল না। তবে আকার-ইঙ্গিতে মনে হলো, অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়েছে এই বনে। ঝমঝম কুঠিতে নাকি ভূত থাকে, এটাও মুখ ফসকে বলে ফেলল একজন। আমি এসব শুনে আর দেরি করিনি, গাড়ি নিয়ে দ্রুত এলেমদারি বনের সামনে এসে আপনাকে ফোন করেছি। আপনাকে যখন ফোনে পাচ্ছিলাম না, তখন কাঁপতে লাগল বুক।’

‘মহসিন, বুক তো আমারও কাঁপছে। তবে নিজের জন্য যত না, তার চেয়ে বেশি আমার মেয়ের জন্য।’

‘ভাই, আমাকে বলবেন কী হয়েছে?’

খানিক ভেবে রফিক সাদি বললেন, ‘হ্যাঁ, বলব।’

রফিক সাদি সব খুলে বললেন মহসিনকে।

নুযহাতের অদ্ভুত আচরণ, এলেমদারি বন এবং ঝমঝম কুঠির আজব সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন।

মহসিন বলল, ‘ভাই, এদের তো স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।’

‘হ্যাঁ, আমারও তা-ই ধারণা, কিন্তু কী করব বুঝতে পারছি না। নুযহাত আমার কথা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।’

‘আমি একজন মানুষকে চিনি, পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে কিছু লেখাও পড়েছি। কেন জানি মনে হচ্ছে, তিনি এই সমস্যার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন। তাঁর কাছে একবার যাবেন নাকি?’

‘কী ধরনের সাহায্য?’

‘উনি ভৌতিক এবং রহস্যের বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ। মানুষকে এসব ব্যাপারে সাহায্য করেন।’

‘তাঁর নাম?’

‘আনোয়ার।’

‘তুমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চেনো?’

‘আমাদের গ্রামে একবার গিয়েছিলেন। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সাথে। আমাদের গ্রামে শিগব নামে এক অপদেবতার উপদ্রব হয়েছিল, উনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রক্ষা করেছিলেন।’

‘চলো, তা হলে তাঁর কাছে যাই। এতদিন এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিশ্বাস করতেই হবে।’

সাত

আনোয়ারদের ছাদের চিলেকোঠায় বসে আছেন রফিক সাদি ও মহসিন। আনোয়ারের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। কয়েকটা পত্রিকায় তাকে নিয়ে ফিচার হয়েছে। এরপর থেকেই বাসায় মানুষজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। অনেকেই বিচিত্র সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসছে। কিন্তু সে তো বেশিরভাগ সমস্যারই সমাধান দিতে ব্যর্থ। আর তার মূল কাজ রহস্য বা ভয়ের পিছনে ছোটা, মানুষকে সাহায্য করা নয়।

মহসিনকে চিনতে পেরেছে আনোয়ার। পাতাকাটা গ্রামে লোকটির সাথে দেখা হয়েছিল।

রফিক সাদির সাথে আনোয়ারের পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর রফিক সাদি পুরো ঘটনাটা আনোয়ারকে বললেন।

মন দিয়ে শুনল আনোয়ার। কথার শেষে বেশ কয়েকটা প্রশ্নও করল।

‘আচ্ছা, আপনি তো বললেন নুযহাতের হাতে তাবিজের মত কিছু জিনিস দেখতে পেয়েছেন। জয়ের হাতে বা শরীরের কোথাও কি এমন কিছু দেখেছিলেন?’

চমকে উঠলেন রফিক সাদি। আরে, তাই তো! জয়ের হাতেও কয়েকটা তাবিজ বাঁধা ছিল। জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। তার হাতেও ছিল।’

‘আপনি বলছিলেন এলেমদারি বনে যারা বাস করে, সবার শরীরে এক ধরনের উল্কি আঁকা এবং উল্কিটা মানুষের অবয়বের। ভেবে দেখুন তো, আপনার পরিচিত কোনও মানুষের সাথে অবয়বটার মিল আছে?’

‘আমার বারবার মনে হচ্ছিল অবয়বটা আমি চিনি। কিন্তু ….’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, পরে কিছু মনে পড়লে আমাকে তা জানাবেন। আমার মোবাইল নাম্বার রেখে দিন। আর আপনার মেয়ের বিয়ের চিন্তা আপাতত বাদ রাখুন।’

‘মেয়েটা তো বিয়ে নিয়ে কেমন পাগলের মত করছে।’

‘তাকে বোঝান, একটু ধৈর্য ধরতে বলুন। আর শুরুতেই এলেমদারির লোক খারাপ বা ভাল, এসব ভাববেন না। মানুষের কথায় কান দেবেন না। আমি নিজে জায়গাটায় যাব। আশা করছি, দেরি না করেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আপনাকে জানাতে পারব।’

‘ঠিক আছে। তবে আপনার ওখানে যাওয়াটা একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে না?’

‘চিন্তা করবেন না। আমি নির্বোধ নই, নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেই যাব। আপনিও আমার সাথে যাবেন।’ একটু থেমে আনোয়ার বলল, ‘ও, আরেকটা কথা, আপনি বলছিলেন ওখানে একটা মেয়েকে দেখেছেন। তার নাম জানতে পেরেছেন বা অন্য কিছু?’

‘না, আমি ওই সময়ে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তাই এসব জিজ্ঞেস করার কথা মাথায় আসেনি। তবে…’

‘তবে কী?’

‘সম্ভবত মেয়েটার একটা আইডি কার্ড আমি আনতে পেরেছি।’

‘গুড, কোথায় সেই আইডি কার্ড?’

রফিক সাদি আইডি কার্ডটা বের করে আনোয়ারের হাতে দিলেন।

ভাল করে কার্ডটা দেখল আনোয়ার। ইডেন কলেজের রসায়ন বিভাগের এক মেয়ের আইডি কার্ড। নাম ফারহানা সুলতানা।

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, বিষয়টা নিয়ে আজ থেকেই কাজে নামব আমি।’ আনোয়ারের কথায় রফিক সাদি তেমন আশ্বস্ত হননি, বেশ বোঝা যাচ্ছে। আরও দু’চার কথার পর উঠে পড়লেন তিনি।

রফিক সাদি ও তাঁর ড্রাইভার বিদায় হওয়ার পর বন্ধু শাহেদ চৌধুরীকে ফোন করল আনোয়ার।

শাহেদ চৌধুরী ডিবি পুলিশ অফিসার। বেশ কিছু রোমহর্ষক কেস সমাধান করে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। স্কুল ও কলেজে একসাথে পড়েছে আনোয়ার ও শাহেদ। অনার্স থেকে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলাদা হলেও মনের দূরত্ব বাড়েনি।

‘শাহেদ, আনোয়ার বলছি। ব্যস্ত নাকি?’

‘কেমন আছিস, আনোয়ার? না, তেমন ব্যস্ত না।’

‘ভাল আছি। তোর সাহায্য দরকার।’

‘কী বিষয়ে সাহায্য?’

‘এখন তোকে সব বলতে পারছি না। আপাতত এক মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ দরকার।’

‘কোন্ মেয়ে?’

‘ইডেন কলেজে পড়ে, রসায়ন বিভাগে, নাম ফারহানা সুলতানা।’

‘আচ্ছা? প্রেমঘটিত কোনও ব্যাপার নাকি?’

‘হা-হা, আরে না। সিরিয়াস ব্যাপার।’

‘তা হলে বল, এই মেয়ে সম্পর্কে কী জানতে চাস?’

‘আমি জানতে চাই মেয়েটা কি এখন কলেজে যাচ্ছে, নাকি সে নিখোঁজ। আর সে যদি নিখোঁজ হয়ে থাকে, তো এ ব্যাপারে থানায় কোনও জিডি বা মামলা করা হয়েছে কি না।’

‘আচ্ছা, সমস্যা নেই, আমি খোঁজ লাগাচ্ছি। কিছু জানতে পারলে তোকে জানাব।’

‘হ্যাঁ। একটু দ্রুত জানাতে চেষ্টা করিস।’

‘তুই পুরো ব্যাপারটা বললে হয়তো তোকে আরও নানা দিক দিয়ে সাহায্য করতে পারতাম।’

‘আগে নিজে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিই, তারপর অবশ্যই তোকে বলব।’

‘আচ্ছা।’

‘রাখছি এখন। বাই।’

.

রাত হয়ে গেছে।

ল্যাপটপের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আনোয়ার।

বেশ কিছু বিষয়ে ইন্টারনেট থেকে জানা দরকার।

আন্দাজ করতে পারছে অনেক কিছুই, তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

কালকেই সে এলেমদারি বনে যাবে।

তবে একা নয়, রফিক সাদি এবং ড্রাইভার মহসিনকে নিয়ে যাবে। বন্ধু শাহেদকে বলে যাবে, তারা ফিরে না এলে যেন এলেমদারি বন তথা ঝমঝম কুঠিতে অভিযান চালায়।

ফোন করে রফিক সাদিকে প্রস্তুত থাকতে বলল আনোয়ার।

সকালে দেরি না করে রওয়ানা হবে ওরা ওই বনের উদ্দেশে।

আট

এলেমদারি বনের মূল সড়কের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ার এবং রফিক সাদি।

মহসিন বলল, ‘ভাই, আমি কি আপনাদের সাথে আসব?’

‘না,’ বলল আনোয়ার, ‘আপনি গাড়ি নিয়ে সামনে এমন কোথাও চলে যান, যেখানে লোকবসতি আছে। আমরা কাজ শেষে আপনাকে ফোন দেব।’

‘কিন্তু নেটওয়ার্কের তো বড্ড সমস্যা।’

একটা কার্ড বের করে মহসিনের হাতে দিল আনোয়ার। ‘বনের মধ্যে নেটওয়ার্কের সমস্যা হতে পারে, তবে বনের বাইরে পাকা সড়কে তো সমস্যা হবে না। আমরা সড়কে এসেই আপনাকে ফোন দেব। আর যদি দেখেন বিকালের মধ্যে ফোন দিইনি, তবে আপনি এই নাম্বারে ফোন দেবেন। এটা ডিবি পুলিশ অফিসার শাহেদ চৌধুরীর নাম্বার।’

মহসিন নিতান্ত অনিচ্ছায় রাজি হলো। তারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল।

রফিক সাদি সঙ্গে করে নিজের লাইসেন্স করা রিভলভার নিয়ে এসেছেন। কোনও কাজে লাগবে কি না জানেন না, তবু মনের জোর বাড়াতে নিয়ে এসেছেন ওটা।

.

এলেমদারি বনে ঢুকে রফিক সাদির গলায় এবং ঘাড়ে কালো রং দিয়ে কয়েকটা বৃত্ত এঁকে দিল আনোয়ার।

রফিক সাদি আপত্তি করলেন না।

‘আপনি আজকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাবেন,’ বলল আনোয়ার, ‘কারও দিকে তাকাবেন না। চিন্তা, ভয় এসব কিছুকেই মাথায় স্থান দেবেন না।’

মাথা নাড়লেন রফিক সাদি। আনোয়ারকে দেখে ভয়টাও এখন অনেকটা কমে গেছে। তবে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘কিন্তু জয়ের বাবা-মা যদি জিজ্ঞেস করেন, আজ আবার কেন এলাম? বা আপনাকেই বা কেন নিয়ে এলাম?’

‘বলবেন, আপনি মেয়েকে এখানে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছেন। বিয়েতে আপনার কয়েকজন আত্মীয় উপস্থিত থাকবে। এসব কথা ফাইনাল করতেই আজ এসেছেন। আর আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আমি আপনার ভাগ্নে। বিয়ের কথাবার্তা যখন চলছে, একজন আত্মীয় তো সাথে আসতেই পারে।’

‘ঠিক আছে। চলুন, এগোনো যাক।’

‘আমাকে তুমি করে বলবেন,’ হাসতে-হাসতে বলল আনোয়ার, ‘আমি কিন্তু আপনার ভাগ্নে। ভাগ্নেকে আপনি করে বললে কিন্তু ধরা পড়ে যাবেন।’

হাসিতে যোগ দিলেন রফিক সাদিও।

গুমোট পরিবেশটা যেন একটু হালকা হলো।

দু’জন হেঁটে চলেছে বনের ভিতর দিয়ে, এমন সময় এক লোককে দেখতে পেল আনোয়ার। তার শরীরের উল্কি ভাল করে লক্ষ্য করল। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লোকটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। হাতে মাছ ধরার কোঁচ।

আনোয়ার হাঁটছে, কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ।

কিছুক্ষণ পর ঝমঝম কুঠিতে পৌঁছে গেল ওরা। পথিমধ্যে আর কোনও মানুষের দেখা পায়নি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল আনোয়ার, ‘কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। চলুন, এই সুযোগে বাড়ির পিছন দিকটা চক্কর দিয়ে আসি।’

রফিক সাদি সায় দিলেন।

বাড়িটা ঘুরে পিছন দিকে এসে চারপাশ ভাল করে লক্ষ্য করল আনোয়ার। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কিন্তু এক জায়গায় এলোমেলোভাবে পড়ে আছে কিছু জিনিস। তার ভিতর রয়েছে বেশ কিছু কাগজ, ব্যাগ, পলিথিন ইত্যাদি।

কয়েকটা খালি রক্তের ব্যাগ দেখল আনোয়ার। দেরি না করে দুটো রক্তের ব্যাগ পুরে ফেলল নিজের ব্যাগে।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রফিক সাদি, ‘এসব ময়লা জিনিস ব্যাগে ভরছ কেন?’

কিছু না বলে হাসল আনোয়ার।

বাইরে থেকে দেখা যায় না কবরস্থানটা। ভিতরে ঢুকে ঘুরে দেখল ওরা। থমথমে পরিবেশ, কেমন যেন ভয়ের অনুভূতি হবে যে-কারও।

আনোয়ার সাইনবোর্ডে দেখল: ‘পারিবারিক কবরস্থান।

কবরস্থান ছাড়িয়ে একটু দূরে যাওয়ার পর আনোয়ার দেখতে পেল এক মাঠ। এক মাথায় ছোটখাট মঞ্চের মত জায়গা। ঠিক এমন সময় রাশভারী গলায় কেউ বলল, ‘আপনারা এখানে কী করছেন?’

রফিক সাদি দেখলেন, তাঁদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই বুড়ো চাকরটা। হাসিমুখে বললেন রফিক সাদি, ‘আসলে সোলেমান গাজি সাহেবের কাছে এসেছি। ভাবলাম, বাড়িতে ঢোকার আগে জায়গাটা একটু ঘুরে দেখি।’

‘কাজটা ঠিক করেননি। এটা কবরস্থান এলাকা। পবিত্র জায়গা। অনুমতি না নিয়ে এখানে ঘোরাঘুরি করে অন্যায় করেছেন। চলেন, বাড়ির ভিতরে চলেন।’

.

আনোয়ার আর রফিক সাদি দোতলার ঘরে বসে আছে। সামনে বসে আছেন সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রী। আগের দিনের মত ঘোরাঘুরি করছে জয়ও। আজও মাথাটা একদিকে কাত হয়ে আছে, মুখ দিয়ে ঝরছে লালা। আজকে সোলেমান গাজির চোখ দিয়ে যেন বের হচ্ছে রক্ত। চেঁচিয়ে বললেন, ‘আপনি আবার কী মনে করে? আর বাড়ির পিছনে ঘুরঘুর করছিলেন কেন?’

‘আসলে বিয়ের বিষয়টা ফাইনাল করতে এসেছিলাম। আমার ভাগ্নে বাড়ির আশপাশে একটু ঘুরে দেখতে চাইছিল, তাই…’

‘আবার ফাইনালের কী আছে? বললাম না একদিন মেয়েকে নিয়ে আসবেন, বিয়ে দিয়ে দেব।’ কঠোর গলায় সোলেমান গাজি বললেন, ‘না, আপনাদের সাথে পোষাবে না। আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেব না।’

মুখে একটা কষ্টের ছাপ ফুটিয়ে তুললেও মনে-মনে খুশি হলেন রফিক সাদি। বললেন, ‘আমরা কিছু অন্যায় করেছি?’

‘আপনাদেরকে আমার পছন্দ হয়নি, একটুও না। আর আপনি গলায় এসব কী লাগিয়েছেন, খুব বিশ্রী।’ সোলেমান গাজি নীচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। মনে হচ্ছে রফিক সাদির সাথে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছেন।

মন দিয়ে জয়কে লক্ষ্য করছে আনোয়ার, মনে অনেক প্রশ্ন। জয়কে দেখে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। ইশ্, আরেকটু সময় যদি কবরস্থানটা ঘুরে দেখা যেত।

আনোয়ারকে পেয়ে কি না কে জানে, রফিক সাদি আজকে অনেক বেশি নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। মনে কোনও ভয় দানা বাঁধছে না। তিনি স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘আপনার ভাগ্নি কেমন আছে? কোথায় সে?’

ঘরের ভিতর যেন সবকিছু থমকে গেল।

সোলেমান গাজি চোখ সরু করে বললেন, ‘তাকে কী দরকার? সে নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। আপনারা আজ আসুন।’ এই কথাগুলোও মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।

মুখ কালো করে উঠে পড়লেন রফিক সাদি। মনে-মনে বেশ প্রফুল্ল অনুভব করছেন।

হঠাৎ করে বলল আনোয়ার, ‘একটু বাথরুমে যাব। বাথরুমটা কোন্ দিকে?’

সোলেমান গাজির মুখ থমথমে হয়ে গেল। নিতান্ত অনিচ্ছায় বাথরুমটা দেখিয়ে দিলেন।

বাথরুমে যাওয়া আনোয়ারের উদ্দেশ্য নয়, একটু ঘুরে দেখবে চারপাশ। ধীর পায়ে বাথরুমের দিকে চলেছে আনোয়ার, দেখতে পেল পাশাপাশি পাঁচ-ছয়টা রুম। প্রতিটা রুমের দরজা বন্ধ করা। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে কিছু চুল। মেঝেতে লেপ্টে রয়েছে কালো কালি। ঘরে ধূপের গন্ধ। তীব্র আলোতেও অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে ঘরগুলোকে।

বাথরুমে ঢুকে আনোয়ারের প্রচণ্ড বমি এল। মেঝেতে নিথর পড়ে আছে এক মেয়ে, কেশহীন মাথাটা বিচ্ছিন্ন, রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো শরীর। মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল ও, আর তখনই অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।

তা হলে কি সব চোখের ভুল?

কোথায় যেন মেয়েটাকে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে ওর। মনে হতে লাগল, পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। যে-কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে আনোয়ারের উপর। চোখ বন্ধ করে ভাবতে চাইল সে, সব মিথ্যা, তাকে ভয় দেখাতে চাইছে কেউ।

নয়

ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন রফিক সাদি আর আনোয়ার। আগের মত সপ্রতিভ নয় আনোয়ার, কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় আছে সে। রফিক সাদি বললেন, ‘আমার মেয়েটাকে ওঁরা বউ হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি নন। যাক, ভালই হলো। বেঁচে গেল আমার মেয়েটা।’

জবাব দিল না আনোয়ার।

‘কেন জানি মনে হচ্ছে অবসান হয়েছে আমার সব দুশ্চিন্তার, ভুলেও আর কোনও দিন ঝমঝম কুঠিতে পা দেব না।’

‘আমাকে ফার্মগেট নামিয়ে দেবেন,’ হুট করেই বলল আনোয়ার। তার কেন জানি মনে হচ্ছে রফিক সাদির মুখের হাসি থাকবে না।

রফিক সাদি বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই মহসিনের স্ত্রী করিমন এগিয়ে এল। চিন্তিতমুখে বলল, ‘মামণি একটা সুটকেস নিয়ে কোথায় যেন গেছেন। যাওয়ার আগে আপনাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছেন।’

রফিক সাদির মনে হলো সোজাভাবে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি।

কাঁপা হাতে খুললেন চিঠিখানা।

বাবা,

আমি ঝমঝম কুঠিতে জয়ের কাছে চলে যাচ্ছি। সত্যি বলতে, কাজি অফিসে গিয়ে বেশ আগেই আমরা বিয়েটা সেরে ফেলেছি। তোমার সম্মানের কথা চিন্তা করে ভেবেছিলাম, দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়েটা আবার হোক। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, জয় আর জয়ের মা-বাবার সাথে তুমি দুর্ব্যবহার করেছ। তাঁরা কেউ তোমাকে পছন্দ করেননি। তাই জয় আমাকে ওর বাসায় চলে যেতে বলেছে। জয় ডাকলে আমি তো না গিয়ে পারি না, বাবা। আর তুমি অন্ধ, তাই হয়তো দেখতে পাওনি যে, আমি মা হতে চলেছি। আমার শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে। এজন্য বাইরে বের হওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মহসিন চাচা ও করিমন চাচী কিন্তু বিষয়টা টের পেয়েছিল। হয়তো ভয়ে তোমাকে বলতে পারেনি। আমি আমার স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখেই থাকব, বাবা। তুমি আর আমাদের উৎপাত করতে এসো না।’

চিঠিটা শেষ করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন রফিক সাদি। চিৎকার করে বললেন, ‘মা রে, তুই এটা কী করলি?’

.

শাহেদ চৌধুরী ফোন করেছে আনোয়ারকে।

‘ফারহানা সুলতানার খোঁজ পেয়েছি।’

‘হ্যাঁ, বল।’ তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে বসল আনোয়ার।

‘ফারহানা নামের এই মেয়েটা দু’মাস আগে নিখোঁজ হয়। মেয়েটার মা-বাবা কেউ নেই। চাচার কাছে বড় হয়েছে। মেয়েটার চাচা ওর নিখোঁজ বিষয়ে নিউ মার্কেট থানায় জিডি করেছিলেন। তারপর আর তাঁদের তেমন মাথা-ব্যথা দেখা যায়নি। মা-বাবা না থাকলে যা হয় আর কী। মেয়েটার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে। পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে, ফারহানার নীরব নামে এক ছেলের সাথে ফোনে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্ভবত নীরবের সাথে ফারহানার তেমন একটা দেখা হয়নি।’

একটু বিরতি দিয়ে শাহেদ বলল, ‘নিখোঁজ হওয়ার আগেও সে নীরব নামের ওই ছেলেটার সাথে কথা বলেছে। মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে পুলিশ নীরবের নাম-ঠিকানা বের করেছিল। কিন্তু সে ঠিকানায় গিয়ে পুলিশ বুঝতে পারে, নীরবের নাম-ঠিকানা, ন্যাশনাল আইডি সবই ভুয়া। এরপর পুলিশের কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে।’

‘বাহ্! তুই তো অনেক তথ্য জোগাড় করেছিস!’

‘এখন বল, তুই ফারহানাকে চিনিস কীভাবে? ওর সম্পর্কে কিছু জানিস নাকি?’

‘সব তোকে বলব। তার আগে আরেকটা খবর বের করতে হবে। তোকে কাল সকালে ফোন দেব। আশা করি, কালকেই সব জানতে পারবি।’

শাহেদের সাথে কথা শেষ করে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল আনোয়ার। সামনেই রেখেছে রক্তের ব্যাগদুটো।

ব্যাগের ওপরের কাগজে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার, একজনের নাম, ব্লাড নেয়ার তারিখ আর সময় লেখা।

ইন্টারনেটে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কের রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের সাথে তা মিলিয়ে দেখে নিতে চাইল আনোয়ার।

বড় কোনও হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের সাথে মিলছে না।

এবার কিছু বেসরকারি ক্লিনিকের ব্লাড ব্যাঙ্কের সাথে মিলিয়ে দেখতে লাগল।

কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে সময় লেগে গেল, কিন্তু সফল হলো অবশেষে। বনানীর সোনালি ক্লিনিকের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে নেয়া হয়েছে ওর পাওয়া ব্যাগ।

শাহেদকে নিয়ে কাল সকালেই যেতে হবে ওখানে, ঠিক করল আনোয়ার।