আঁধার জগতের খুনি

আঁধার জগতের খুনি

এক

এক শ’ বিশ বছর পর অন্ধকার জগৎ থেকে মুক্তি পেল ফ্যাফ্যাস নামে দুটি প্রাণী, এখন ঘুরে বেড়াবে তাদের একজন মর্ত্যে। অন্ধকার জগতের জীব ওরা। অসম্ভব বুদ্ধিমান, হিংস্র ও ক্ষমতাশালী। পৃথিবীর দিকে রওনা দেয়ার আগে সঙ্গম করেছে নারী এবং পুরুষ ফ্যাফ্যাস দুটি। এর পরেই মারা গেছে পুরুষটি। নারীটি তার পেটে ডিম নিয়ে চলে এসেছে পৃথিবীতে। বাঁচাতে চাইছে তার সন্তানদের। এখন দরকার পোষক দেহ। মানুষের চেয়ে ভাল পোষক দেহ আর একটিও নেই।

ফ্যাফ্যাসটি প্রথম পা রেখেছে চিনে, কিন্তু জায়গাটা পছন্দ হয়নি তার। যেতে চেয়েছে এই মহাদেশের দক্ষিণে। ওখানকার আবহাওয়া তার সন্তানদের জন্য সেরা। তবে বেশি দেরি করতে পারবে না। ত্রিশ দিনের মধ্যে জোগাড় করতে হবে ভাল পোষক দেহ। একটা কন্টেইনার ভর্তি জাহাজে চেপে বসল ফ্যাফ্যাস, লুকিয়ে থাকল জাহাজের এক নির্জন কোণে। ক্যামোফ্লেজ বিষয়ে খুব পারদর্শী সে। জানে, জাহাজের কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। বারোতম দিনে জাহাজটি পৌছাল চট্টগ্রাম বন্দরে। খিদের তাড়নায় এই বারো দিনে জাহাজের তিনজন কর্মীকে কৌশলে মেরে ফেলেছে ফ্যাফ্যাস। মানুষের শরীর ভিটামিনের আধার, ভালভাবে বাঁচতে এই ভিটামিন তার খুব প্রয়োজন।

বাইশতম দিনে জাহাজটি থেকে মাল খালাস শুরু হলে বন্দর থেকে বেরিয়ে পড়ল ফ্যাফ্যাস। আবারও আশ্রয় নিল ক্যামোফ্লেজের। বন্দরের বাইরে অনেক গাড়ি দেখতে পেল সে। এর মধ্যে একটা গাড়ির মালামাল রাখার জায়গায় ঢুকে পড়ল ফ্যাফ্যাস। একটু পর গাড়িটি রওনা দিল রাজধানী ঢাকার দিকে।

গাড়িটি ছিল শিল্পপতি ইলিয়াস মোল্লার।

.

মহাখালি, ঢাকা। রাত একটা।

বার থেকে বাড়ি ফিরছিল জাফর। মদ খেয়ে সহজে মাতাল হয় না সে। তবে আজ তার লিমিট থেকে দুই পেগ বেশি খেয়ে ফেলেছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গেলে অসুবিধা হবে বলে সে গাড়ি আনেনি। তার বন্ধু ইলিয়াস তাকে উত্তরা তিন নম্বর সেক্টর পর্যন্ত লিফট দিয়েছে। এবার নির্জন দুটো গলি পার হয়ে তাকে বাড়ি যেতে হবে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল জাফর, টাল সামলে নিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কস, ইলিয়াস।’

‘সাবধানে যেয়ো, বন্ধু,’ জবাবে বলল তার বন্ধু।

‘রাজার কোনও ক্ষতি হয় না।’

‘দুই পেগ বেশি খেলে সবাই রাজা হয়ে যায়।’

‘হা-হা-হা! ভালই বলেছ, বন্ধু!’

‘বাই।’

গাড়িটা হুশ্ করে চলে গেল। ইলিয়াসের গাড়ি থেকে কিছু একটা বেরিয়ে জাফরের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। জাফরের গান গাইতে ইচ্ছা হচ্ছে। সুজানাকে সে প্রতি রাতে গান শোনায়। সুজানাও তখন গুনগুন করে গান করে। জাফরের মনে হয় অপূর্ব ওর বউয়ের গলা।

সুজানা জাফরের স্ত্রী। দুই বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে।

সন্তানের মা হতে চলেছে সুজানা। ওদের সন্তানটি মেয়ে।

ওরা মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছে: রোমি।

সপ্তাহে একদিন বার-এ যায় জাফর। সপ্তাহে একদিন ওখানে যাওয়া বোধহয় তেমন দোষের নয়। সুজানারও এ নিয়ে অভিযোগ নেই। আগে প্রায়ই সঙ্গী হত জাফরের। কিন্তু গত দু’মাস ধরে খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে তাকে। ভারী হয়ে গেছে শরীর, সামনের মাসেই ডেলিভারি ডেট।

হেলেদুলে হাঁটছে জাফর। খুব নির্জন গলিটা। এ পথ দিয়ে সে প্রায়ই বাসায় ফেরে। কিছুক্ষণ পর তার মনে হলো, কেউ যেন আসছে পিছে-পিছে। সে পিছনে তাকাল, কেউ নেই। ভয়-ভয় করতে লাগল তার। কয়েক মাস আগে গলির মুখে বড় রাস্তায় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। মাথা থেঁতলে গিয়েছিল এক বৃদ্ধা মহিলার। কথিত আছে, প্রায় নাকি এখানে দেখা যায় সে মহিলাকে। তিনি নাকি তাঁর থেঁতলানো মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর নাকি স্বরে কাঁদতে থাকেন।

আবার সেই খস খস শব্দ। বিকট এক গন্ধ পেল জাফর। গন্ধটায় গুলিয়ে উঠল তার শরীর। রাস্তার পাশে বসে বমি করতে লাগল সে। উঠে দাঁড়াল কিছু সময় পর। দুর্বল লাগছে শরীর। এমন সময় বুঝতে পারল, পিছে দাঁড়িয়ে কেউ 1 পিঠে লাগছে গরম ভাপ। সাহস সঞ্চয় করে পিছনে তাকাল সে। একটা অদ্ভুত, কুৎসিত, ভয়ঙ্কর প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। প্রাণীটার তিন শুঁড় নড়াচড়া করছে ক্রমাগত। সরীসৃপের মত নমনীয় মাথা, ঘুরে যায় পিছনেও। একটা মাত্ৰ পা, সব মিলে দুটো হাত। প্রয়োজনে হাত ব্যবহার করে পা হিসাবে, বাড়াতে পারে হাঁটার গতি। হাত-পায়ে ধারাল নখ। সূচালো দাঁত ঢেকে রাখার জন্য ঠোঁট নেই। বিশাল নাক দিয়ে শুঁকে দেখছে সে জাফরকে।

হ্যাঁ, তার পছন্দ হয়েছে জাফরকে। দেরি করল না প্রাণীটা। শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল জাফরকে। সূচালো দাঁত বসিয়ে দিল ওর গলায়। চিৎকার করারও সুযোগ পেল না জাফর।

কাজ শুরু করে দিয়েছে প্রাণীটা। নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল জাফরের বুক থেকে পেট পর্যন্ত। ওখানে হাত ঢুকিয়ে তৈরি করল গর্ত। জাফরের দেহে ঢুকে গেল নিজে। আর তখনই জাফরের শরীরের গর্তটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু শরীরে রয়ে গেল কাটা দাগের চিহ্ন।

এখন থেকে জাফরের শরীর ব্যবহার করবে ফ্যাফ্যাস, নিয়ন্ত্রণ করবে শারীরবৃত্তীয় সব কাজ। অর্ধমৃত জাফর এখন অন্ধকার জগতের ভয়ঙ্কর প্রাণী ছাড়া কিছুই নয়।

তার শরীরে ডিম দেবে ফ্যাফ্যাস। দু’ সপ্তাহে জাফরের শরীরের যেন কোনও ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে। দুই সপ্তাহ এই পোষক দেহে থাকতে হবে তাকে। এ সময়ে জাফরের বড় কোনও ক্ষতি হলে, সে-ও বাঁচবে না।

দু’ সপ্তাহ পর যখন ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোবে, এমনিতেই মারা যাবে জাফর। মরবে ভয়ঙ্কর ফ্যাফ্যাসও। কিন্তু থেকে যাবে তার অসংখ্য বাচ্চা এই পৃথিবীতে।

তাদের থেকে জন্ম নেবে আরও বাচ্চা। এক সময় পৃথিবী হবে ফ্যাফ্যাসদের রাজ্য, শাসন করবে তারা গোটা এই জগৎ।

দুই

কাল রাতের ঘটনায় প্রচণ্ড অবাক হয়েছে সুজানা। রাতে কখন জাফর বাসায় ফিরেছে, সে কিছুই টের পায়নি। জাফর অন্য একটা রুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। এমন তো কখনও করে না!

সুজানা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল, ‘জাফর, অ্যাই, জাফর!’

জাফর উঠে দরজা খুলল, চোখ-মুখ অন্যরকম। তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন

আতঙ্ক লাগে। সুজানা বলল, ‘কী হয়েছে, জাফর, তোমার?’

জাফর কিছু না বলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

জাফরের হাত ধরে কেঁপে উঠল সুজানা।

জাফরের হাতটা বরফের মত ঠাণ্ডা। ‘জ-জ-জাফর!’

এবার হাত বাড়িয়ে দিল জাফর। বড় হতে লাগল ওর নখগুলো। বিচিত্র ভাষায় কিছু বলতে লাগল জাফর। প্রাচীন গ্রীক ভাষা? সুজানাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল জাফর।

মেঝেতে ছিটকে পড়ে গেছে সুজানা, ঠোঁট কেটে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা রক্ত।

‘কে তুমি?’ সুজানার গলায় শঙ্কা এবং আতঙ্ক।

‘থাকব, আমি থাকব,’ গলায় শ্লেষ নিয়ে বলল জাফর। বেশ বোঝা গেল তার হিংস্রতা। বাংলা কথাগুলো তেমন গুছিয়ে বলতে পারছে না। তবে কথাগুলোর মূল ইঙ্গিতটা বুঝতে সমস্যা হলো না।

সুজানা কাঁপা গলায় জানতে চাইল, ‘তোমার কী হয়েছে, জাফর?’

কিন্তু জাফরের উত্তর একই: সে থাকবে। তাকে থাকতেই হবে।

ইঙ্গিতটা পরিষ্কার, সুজানা তাকে না ঘাঁটালে সে-ও ঘাঁটাবে না সুজানাকে।

সুজানা বুঝল, অশুভ কিছু ভর করেছে জাফরের উপর। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে থাকল, কী করবে।

ঠিক করল, ওখান থেকে সরে এসে মাকে ফোনে সব খুলে বলবে। কিন্তু মোবাইল ফোন কানে তুলে বুঝল সিগনাল নেই। জাফরের শরীর থেকে বেরোচ্ছে নীল রঙের আভা। সুজানার কেন জানি মনে হচ্ছে, জাফরের কারণেই এই ঘরে মোবাইল নেটওঅর্ক কাজ করছে না। বাসা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করল সুজানা। কিন্তু জাফর পথ আগলে দাঁড়াল। মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল ও বের হতে পারবে না।

দু’ সপ্তাহের জন্য ফ্যাফ্যাসের কাছে বন্দি সুজানা। কোনও ভুল বা চালাকি করলে ওকে মেরে ফেলবে ফ্যাফ্যাস।

জাফর ইঙ্গিতে বোঝাল, সে ক্ষুধার্ত। নিজের পেট এবং সুজানার পেটের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘তোমার পেটে বাচ্চা। আমার পেটে বাচ্চা বেঁচে থাকবে। অবশ্যই বেঁচে থাকবে। আমার বাচ্চা মারা গেলে তোমার বাচ্চাও মারা যাবে।’

মাথা কাজ করছে না সুজানার। আতঙ্কে ওর শরীর ভারী হয়ে আসছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা।

সুজানা বলল, ‘কী খেতে চাও?’

একটু হাসল জাফর। বলল, ‘মানুষ চাই। মানুষ নিয়ে আসো।

‘কী? মানুষ!’

‘হ্যাঁ। ডেকে আনো। ওটা দিয়ে ডেকে আনো।’ মোবাইলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল জাফর।

‘কাকে ডেকে আনব? এসব কী বলছ?’

মুহূর্তেই রক্ত হিম হয়ে গেল জাফরের চোখ। স্পষ্ট বোঝা গেল রাগ। ফুঁসে উঠে জাফর বলল, ‘ডেকে আনো। ডেকে আনো। না হলে তোমাকে…’

এবার জাফর বুঝিয়ে দিল কাউকে ফোন করে ডেকে না আনলে, সে ক্ষুধা মেটাবে সুজানাকে দিয়েই। সুজানার মোবাইলের নেটওঅর্ক ফিরে এসেছে। বুঝে উঠতে পারল না, কাকে ফোন দেবে সে? কাকে মেরে ফেলার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে? কিন্তু ও জানে, জাফরের কথা না শুনলে মারা পড়বে।

সুজানা তার বান্ধবী সুমিকে ফোন দিল। চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইছে না। তবু গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে ও বলল, ‘হ্যালো, সুমি।’

‘হ্যালো, সুজ। কী খবর তোর?’

‘ভাল। আমার বাসায় একটু আসতে পারবি? খুব দরকার।’

‘অবশ্যই। জাফর ভাইয়া বাসায় নেই?’

‘আছে। তোকে খুব মনে পড়ছে।’

‘আচ্ছা, আমি এক ঘণ্টার মধ্যে আসছি। রিমিকেও নিয়ে আসছি।’

‘রিমিকে না আনলে হয় না?’

‘আমার বাসায় কেউ নেই রে। বাচ্চা মেয়ে একা-একা কী করে থাকবে?’

‘আচ্ছা, নিয়ে আয় তা হলে।’

‘ওকে।’

‘আর একটা কথা, আমার বাসায় আসার কথা কাউকে বলার দরকার নেই।’

‘মানে?’

‘একটু ব্যক্তিগত ব্যাপারে তোর সাথে কথা বলব। তাই আমার বাসায় আসার ব্যাপারটা কাউকে বলিস না। দুলাভাইকেও না।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আসছি। তুই ঠিক আছিস তো, সুজ?’

‘হ্যাঁ। ঠিক আছি।’

মোবাইলের লাইন কেটে গেল। সুজানার খুব ঘুম আসছে। জাফরের শরীর থেকে হঠাৎ এক ধরনের গ্যাস বেরোচ্ছে। সেই গ্যাসের প্রভাবে কেমন শরীর এলিয়ে আসছে সুজানার। চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। সুজানা ঘুমিয়ে পড়ার পর ওর দেহটা কাঁধে তুলে নিল জাফর। বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল ওকে।

জাফর অপেক্ষা করছে শিকারের জন্য।

.

এক ঘণ্টার মাঝেই সুজানার বাসায় পৌছে গেল সুমি আর তার মেয়ে রিমি। একবার ডোরবেল বাজতেই দরজা খুলে দিল জাফর। ওকে দেখে সপ্রতিভ হাসি হেসে সুজানা বলল, ‘জাফর ভাই, কেমন আছেন? সুজানা হঠাৎ জরুরি তলব করল। তাই চলে এলাম।’

জাফর কিছু বলল না। শুধু নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করল। ‘কী, আপনি কিছু বলছেন না যে? সুজানার সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?’ জিজ্ঞেস করল সুমি।

জাফর এবারও জবাব দিল না। ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলো সুমি। বরফের মত শীতল চোখ। যেন তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে কপালের রগ। গা থেকে আসছে কেমন একটা বাজে গন্ধ।

সুমিকে তার পিছন-পিছন আসতে ইঙ্গিত করল জাফর।

সুমি এগিয়ে গেল।

রিমি অবশ্য মায়ের দিকে লক্ষ করছে না, মন দিয়ে টিভিতে কার্টুন দেখছে।

সুমিকে পাশের রুমে নিয়ে গেল জাফর। পিছনে বন্ধ করল ঘরের দরজাটা।

একটু চমকে উঠে বলল সুমি, ‘দরজা বন্ধ করছেন কেন, জাফর ভাই?’

হাসল জাফর। সে হাসি ভয়ঙ্কর।

সুমি কিছু বোঝার আগে ওর বুক চিরে হাতটা ঢুকিয়ে দিল জাফর। এক ঝটকায় বের করে আনল হৃৎপিণ্ডটা।

সুমি এক সেকেণ্ড চেয়ে রইল জাফরের দিকে, তারপর ঢলে পড়ে গেল মেঝেতে। রক্ত ভর্তি হৃৎপিণ্ড কামড়ে খেতে শুরু করেছে জাফর। আহ্, কী স্বাদ! আনন্দে বুজে এল তার চোখ। খাওয়া শেষ করে সুমির পোশাক ছিঁড়ে ফেলল জাফর। দেহের নরম অংশগুলো খেতে শুরু করেছে। এক ঘণ্টার মধ্যে সুমির শরীরের অর্ধেকটা খেয়ে ফেলল জাফর। হাড়গুলো অবশ্য খেল না। হাড় তার পছন্দ নয়। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। এমন সময় রুমের দরজা ধাক্কাতে লাগল রিমি।

‘মামণি, মামণি? কোথায় তুমি?’

বেড়ে গেল জাফরের চোখের উজ্জ্বলতা। আরও একটা শিকার। ছোট বাচ্চার দেহ। অনেক বেশি মজার। রুমের দরজাটা খুলে দিল জাফর। ওর শরীরে রক্ত দেখে চিৎকার করে উঠল রিমি। কিন্তু ওর মাথাটা সর্বশক্তি দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিল জাফর। চার বছরের বাচ্চা এত প্রচণ্ড আঘাত সহ্য করতে পারল না। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মাথাটা। কিন্তু তখনও কয়েক সেকেণ্ড নানাদিকে তাকাল রিমির চোখ। মাকে খুঁজছিল বেচারি।

এখন কিছুক্ষণ ঘুমাবে জাফর। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার টানা ঘুম। আগেই সুজানাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে সে। তার ঘুম ভাঙতে কমপক্ষে সাত ঘণ্টা লাগবে।

তাই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে গেল জাফর।

তিন

সাত ঘণ্টা পর…

ঘোরটা আস্তে-আস্তে কেটে যেতে থাকল সুজানার। কেমন যেন দুর্বল লাগছে শরীর, ঘুরছে মাথাটাও। চারদিকে যেন উড়ছে ধোঁয়া। চোখ মেলে তাকাল সে। দেখল জাফরের ভয়ঙ্কর মুখ। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমাট রক্ত।

ঠিক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙেছে জাফরের। ঘুম ভাঙার পর থেকে সুজানার ঘুমন্ত শরীরের পাশে বসে আছে। তার বারবার মনে হয়েছে, সুজানাকে মেরে ফেলবে, নাকি বাঁচিয়ে রাখবে। শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্তই নিয়েছে। কারণ সুজানা তাকে আরও শিকার ধরতে সাহায্য করতে পারবে। জাফরের শরীর নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না ফ্যাফ্যাস। নিজে শিকার ধরতে গেলে যে- কোনও আঘাতে ক্ষতি হতে পারে জাফরের শরীরের। আর তার মানেই সন্তানের ক্ষতি। সেটা সে হতে দেবে না।

জাফরকে দেখে লাফিয়ে উঠে বসল সুজানা। ওড়নাটা ভাল করে জড়িয়ে নিল গায়ে। জাফরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী-কী-কী…চাই?’

‘তরল খাবার খাব। পুষ্টিকর তরল। চাই। অনেক চাই।’

‘কী পুষ্টিকর তরল?’

‘রাত হয়েছে। পুষ্টিকর তরল চাই। রাতে পুষ্টিকর তরল খাব।’

‘পানি চাও?’

‘নাহ্!’ রেগে উত্তর দিল জাফর।

‘তা হলে দুধ?’

‘হ্যাঁ, দুধ। দুধ চাই। চারপেয়ে জন্তুর।’

ফ্রিজ থেকে দুধের পাতিল বের করল সুজানা। এক লিটার দুধ আছে সেখানে। পিছন-পিছন এসেছে জাফরও। সুজানার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল পাতিলটা। ঢক-ঢক করে পুরোটা দুধ খেয়ে ফেলল। এক লিটার দুধ খেতে তার লাগল চার মিনিট। ডিমের ভিতর থাকা তার সন্তানের চাই প্রচুর পুষ্টি। তাদের দিতে হবে উপযুক্ত খাবার, নইলে দুর্বল রয়ে যাবে।

একটা ঢেকুর তুলল জাফর। হঠাৎ বিশ্রী গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। সুজানা ভাবছে, সুমি কি এসেছিল? জাফরের সারা শরীরে এই রক্ত কার? সুমির নয়তো? ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল ওর সারা শরীরে। জাফর যে রুমে সুমি-রিমিকে মেরেছে, সেই রুমে ঢুকল সুজানা। আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল ভয়ে। সুমি আর রিমির শরীরের অংশবিশেষ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কোথাও হাড়, কোথাও ফুসফুস, কোথাও কিছু মাংস। ওগুলো ঘিরে ধরেছে রাজ্যের পিঁপড়া।

জাফরের আর ওই বাকি খাবারের প্রতি আগ্রহ নেই। কাল সকালে চাই তার নতুন খাবার। আর প্রতি রাতে চাই পুষ্টিকর তরল: দুধ।

সুজানার চিৎকার শুনে দৌড়ে এসেছে জাফর, চেপে ধরল সুজানার গলা। হিসহিসে গলায় বলল, ‘মেরে ফেলব! একদম মেরে ফেলব!’

মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেল সুজানা। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে থাকল তার শরীর। সুজানাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল জাফর।

সোফায় গিয়ে বসে পড়ল সুজানা। আর শক্তি নেই দাঁড়াবার। বারবার সুজানার মনে হতে থাকল, এটা কি কোনও দুঃস্বপ্ন? ঘুম ভেঙে সে কি দেখবে তার পাশে ঘুমিয়ে আছে জাফর?

কিন্তু সুজানা বুঝতে পারছে, এটা আসলে মোটেও দুঃস্বপ্ন নয়। তার থেকেও অনেক বেশি কিছু। সে-রাতটা না ঘুমিয়ে কাটাল জাফররূপী ফ্যাফ্যাস আর সুজানা।

সুজানা বুঝল, যে-কোনও জিনিস খুব দ্রুত শিখতে পারে প্রাণীটা। ও জানতে চাইল, ‘কী চাও তুমি?’

‘আমি আমার সন্তানের জন্ম দিতে চাই।’

‘জাফরকে ছেড়ে দাও।’

‘না। না। এই শরীর এখন আমার। আমার সন্তানরা এখানেই জন্ম নেবে। এই শরীরের কোনও ক্ষতি হতে দেব না।’

‘তা হলে আমাকে ছেড়ে দাও। আমিও আমার সন্তানকে বাঁচাতে চাই। আমাকে মেরে ফেলো না।’

হেসে উঠল জাফর। বলল, ‘আমার বাচ্চা জন্ম নেয়ার পর তোমাকে ছাড়ব। এই কয়েকদিন আমার খাবার চাই। শিকার চাই। তুমি শিকার এনে আমাকে দেবে। তোমাকে আমি মারব না।’

‘আমি পারব না। আমি আর কাউকে আনতে পারব না।’

‘তা হলে তুমি আর তোমার সন্তান আমার খাবার আর পিপাসা মেটাবে।’

‘না-না! এমন কোরো না, আমার সন্তানকে বাঁচতে দাও।’

‘আমার সন্তানকে বাঁচতে দিলে আমিও তোমার সন্তানকে বাঁচতে দেব।’

‘তুমি কে?’

‘ফ্যাফ্যাস।’

‘তুমি কোথা থেকে এসেছ?’

‘অন্ধকার জগৎ থেকে।’

‘কে তোমাকে পাঠিয়েছে?’

‘অন্ধকারের দেবতা।’

‘তোমার সন্তানদের কেন এই পৃথিবীতে রাখতে চাও?’

‘আমার সন্তানরা পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। চোদ্দ দিন পর পৃথিবীটা হবে ফ্যাফ্যাসের।’

আঁতকে উঠল সুজানা। কী বলছে ফ্যাফ্যাস। এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটা ধীরে-ধীরে ধ্বংস করে দেবে পৃথিবীকে? এখন কী করবে ও?

চার

সারাটা রাত এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটার সাথে থেকে বুকের ভিতরে কেমন যেন হাঁসফাঁস করতে থাকল সুজানার। মনে হলো, মৃত্যু তার খুব কাছে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা ঘরেই আছে, কিন্তু সেই প্রিয় মানুষটার মাধ্যমে আজ বিপদের মুখে গোটা পৃথিবী। নিজ রুমে শুয়ে আছে সুজানা। মোবাইল নেটওঅর্ক এখনও কাজ করছে না। সুজানার রুমে বসে আছে জাফরও। একা রাখবে না সে সুজানাকে, কারণ সুজানা যে-কোনও সময় চাতুরির আশ্রয় নিতে পারে। জাফর সেটা হতে দেবে না।

সকাল দশটায় বেজে উঠল বাড়ির ডোরবেল। এতক্ষণ ঝিমুনির মধ্যে ছিল জাফর। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সুজানাকে বলল, ‘দেখো, কে এসেছে? কিন্তু কোনও ভুল করলে…’

সুজানা ভয়ে-ভয়ে মাথা নাড়ল। সদর দরজা খুলে দেখল দুধওয়ালা ছেলেটা এসেছে।

সুজানা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইয়ে, মানে, করিম, আজ দুই লিটার দুধ দিতে পারবে?’

‘জী, আপা, পারব।’

‘আচ্ছা, দাও তা হলে।’

‘আজ কোনও অনুষ্ঠান নাকি, আপা? বিশেষ কিছু রান্না করবেন?’

কিছু না বলে ঢোক গিলল সুজানা। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে জাফররূপী ফ্যাফ্যাস। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সুজানার দিকে।

সুজানা কোনও চালাকি করলে মেরে ফেলবে।

সুজানার বারবার মনে হচ্ছে, করিমকে কোনও ইঙ্গিত দেবে কি না। একবার যদি কাউকে বিষয়টা বলা যেত, তো ফ্যাফ্যাস এত সহজে পার পেত না। করিমকে ঘরে ঢোকানোও বিপজ্জনক হবে। হয়তো আরও একটা প্রাণ নেবে ফ্যাফ্যাস।

করিম হঠাৎ মুখ বিকৃত করে বলল, ‘আপা, আপনার ঘরের ভিতর থেকে কেমন পচা গন্ধ আসছে।’

রক্তশূন্য হয়ে গেল সুজানার চোখ-মুখ। পচতে শুরু করেছে সুমি আর রিমির দেহের অবশিষ্ট।

করিমকে বিদায় করতে চোখ গরম করে সুজানাকে ইঙ্গিত করল জাফর।

সুজানা বলল, ‘মনে হয় কোথাও ইঁদুর মরে পড়ে আছে।’

‘কী বলেন, আপা, আপনাদের বাসায় ইঁদুর! গন্ধটা কেমন যেন অন্যরকম ইঁদুর মরা গন্ধ নয়। কেমন যেন…’

কথা শেষ না করে মাথা চুলকাতে থাকল করিম

করিমকে ‘তুমি এবার এসো,’ বলে বিদায় করে দিল সুজানা। ফ্রিজে রেখে দিল দুই লিটার দুধ।

করিম চলে যেতেই পুরো ঘর ফিনাইল দিয়ে মোছার চেষ্টা করল সুজানা। তাতে এতটুকু কমল না ঘরের গন্ধ। দুপুরের দিকে অল্প কিছু শুকনো খাবার খেয়ে নিল সুজানা। এই অসীম বিপদেও না খেয়ে থাকতে পারে না মানুষ। মৃত্যু খুব কাছে থাকলেও তাকে খেতে হবে। তার নিজের সন্তানের জন্যও তাকে খেতে হচ্ছে। সুজানাকে খেতে দেখে ফ্যাফ্যাসেরও খিদে লাগল বোধহয়। সে সুজানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খিদে! আবার শিকার চাই!’

‘না, না, আমি এসব পারব না,’ ভাঙা গলায় বলল সুজানা।

প্রচণ্ড জোরে সুজানাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল জাফর।

আছড়ে পড়ে কয়েক মুহূর্ত চোখে-মুখে অন্ধকার দেখল সুজানা। জাফর হিংস্র গলায় আবার বলল, ‘আমার কথা না শুনলে তোকে এবং তোর সন্তানকে মেরে ফেলব আমি। আমার খিদে লেগেছে। শিকার চাই। ফোন কর।’

মোবাইলে নাম্বারগুলো দেখতে থাকল সুজানা। তার মধ্যে ভয়ের এবং বিষাদের অনুভূতি মিলেমিশে একাকার। বারবার চোখের পানি মুছতে হচ্ছে তাকে। দুই-তিনজন বান্ধবীকে ফোন দিল সুজানা। কিন্তু তারা সবাই ব্যস্ত, তাই সুজানার বাসায় আসতে রাজি হলো না। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে ফোন দিল জামিল ভাইকে। জামিল ভাইয়ের সব সময়ই সুজানার প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল। কিন্তু সুজানা সেই দুর্বলতা একদম পাত্তা দেয়নি বলে ব্যাপারটা বেশি দূর এগোয়নি। সুজানার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর জামিল কমিয়ে দেয় সুজানার সাথে যোগাযোগ। কারণ সুজানার জীবনে সে উপদ্রব হতে চায়নি।

সুজানার ফোন পেয়ে সত্যিই খুব অবাক হলো জামিল। ‘সুজানা? কেমন আছ?’

‘ভাল আছি, জামিল ভাই। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভালই আছি।’

‘আপনার সাথে একটু দরকার ছিল। আমার বাসায় একটু আসতে পারবেন?’

‘এখন? এই দুপুরে?’

‘হ্যাঁ। আপনি তো হাউস বিল্ডিং-এ থাকেন। তিন নম্বর সেক্টর পর্যন্ত আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না। নাকি অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত?’

‘না, মানে, ব্যস্ত না। তোমার বাসায় তো আগে কখনও যাইনি।’

‘বাসা চেনেন তো?’

‘হ্যাঁ। বাসা চিনি। খুব ভালভাবেই চিনি। আচ্ছা, তোমাদের গেটে কি দারোয়ান আছে?’

‘না। কোনও দারোয়ান নেই। আপনি দ্রুত চলে আসুন।’

‘আচ্ছা। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।’

সুজানার কোনও অনুরোধ ফেলা জামিলের পক্ষে সম্ভব নয়। সে আসলে জরুরি একটা কাজে বেরোচ্ছিল, কিন্তু এখন তার সবচেয়ে জরুরি কাজ সুজানার সাথে দেখা করা।

.

বেজে উঠল ডোরবেল।

দরজা খুলে দিল সুজানা, জামিলের সঙ্গে দু’চার কথা বলবার পর ড্রয়িং রুমে বসাল মানুষটাকে।

সুজানা অস্বস্তির হাসি হাসছে। ও যে প্রেগন্যান্ট, তা জানত না জামিল। এসব নিয়ে কথা বলবে ভাবছে, এমন সময় হঠাৎ পচা একটা গন্ধ নাকে এল ওর। ঘরের ভিতরটা লাগছে বেশ ধোঁয়া-ধোঁয়া। চাপা গলায় আওয়াজ করছে কেউ যেন। কেন জানি বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল জামিলের। কেউ যেন তাকে বলছে, তুমি চলে যাও। এখান থেকে চলে যাও। নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া খারাপ অনুভূতিটা পাত্তা দিল না সে। সুজানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী কারণে ডাকলে আমাকে, সুজানা?’

আশপাশে তাকাল সুজানা। দেখতে পেল না জাফরকে। দ্রুত ফিসফিস করে বলে উঠল সুজানা, ‘জামিল ভাই, আমার খুব বিপদ। জাফরের উপরে ভর করেছে এক ভয়ঙ্কর প্রাণী। ও সবাইকে মেরে…’

কথা শেষ করতে পারল না সুজানা।

এসে পড়েছে জাফর। ওকে দেখে উঠে দাঁড়াল জামিল।

‘ভাল আছেন, জাফর ভাই? আমাকে চিনেছেন? আমি জামিল। আপনাদের বিয়ের দিনে পরিচয় হয়েছিল।’

জাফর নাক দিয়ে শব্দ করছে। খুব কাছে এসে শুঁকে দেখল জামিলকে। এর শরীরটা খুব বেশি পছন্দ হয়নি তার। তবু এটা দিয়েই এখন ভরাবে পেট। হঠাৎ জামিলের গলা চেপে ধরল জাফর।

ছটফট করতে শুরু করেছে জামিল। একটু অক্সিজেনের জন্য আঁকুপাঁকু করছে। দুই হাতে হামলা ঠেকাতে চাইল। কিন্তু ভাবলেশহীনভাবে জামিলের দিকে তাকিয়ে রইল জাফর। এতটুকু আলগা হলো না বজ্রমুষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গেল জামিল। দূরে চোখ বন্ধ করে সোফাতে বসে থাকল সুজানা। কিছু দেখতে চাইছে না। কিছুই না।

জামিলের চুল ধরে টেনে পাশের ঘরটায় নিয়ে গেল জাফর। এই ঘরেই মেরেছিল সে সুমি আর রিমিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে খণ্ড-বিখণ্ড করল জামিলের লাশটা। পুরো বুক, পেট লম্বালম্বিভাবে চিরে ফেলে খেতে শুরু করল। চোখ দুটো তুলে মুখে দিল প্রথমে। এরপর ঊরুর মাংস, পেটের ভিতরের চর্বি খেল। ঘরে রক্তের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

বাইরে বেসিনে বিকট শব্দে বমি করতে থাকল সুজানা।

1

খাওয়ার মাঝপথে উঠে এল জাফর। সুজানাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিল তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবার খাওয়া শুরু করল। খাওয়ার আনন্দে যেন অবশ হয়ে আসছে তার পুরো শরীর।

পাঁচ

ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে সুজানার। চোখ মেলে গতকালের মত আজও দেখতে পেল জাফরকে। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। জাফর তার দিকে তাকিয়ে ক্রূর হাসি হাসল। বলল, ‘তুমি কী খেতে চাও?’

‘কী?’

‘মানুষের রক্ত, মাংস, চোখ, চর্বি?’

‘না! না! না!’ শরীরের ভিতরটা গুলিয়ে উঠেছে সুজানার।

‘আমি তোমার জন্য রেখেছি। খাও। অনেক পুষ্টি। পুষ্টি প্রয়োজন তোমার সন্তানের।’ হেসে উঠল জাফর।

সুজানার সাথে মজা করছে সে।

সুজানা অবাক হয়ে লক্ষ করল, এই প্রথম তার মধ্যে তীব্র ভয়ের অনুভূতিটা কাজ করছে না। সে জাফরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার সাথে মজা করবে না।’

কঠিন হয়ে গেল জাফরের চোখ-মুখ। সে বলল, ‘রাত হয়ে গেছে। আমার এখন পুষ্টিকর তরল, দুধ প্রয়োজন। দুধ নিয়ে এসো আমার জন্য।’

‘দুধ কি গরম করে আনব?’

‘আনো।’

জাফর ড্রয়িং রুমে গা এলিয়ে বসে আছে। রান্নাঘরে ঢুকে দুধ গরম করছে সুজানা। তার পুরো শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়। কারণ পঁচিশটা ঘুমের ওষুধ দিয়েছে সে দুধের মধ্যে। ওই ক’টা ওষুধই ছিল তার কাছে। রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ায় তাকে প্রতি রাতে একটা করে ওষুধ খেতে বলেছিল ডাক্তার। সেই ওষুধগুলোই কাজে লাগাতে চাইছে। কিন্তু তার পরিকল্পনা কি কাজে আসবে? জাফর কি ঘুমিয়ে পড়বে?

নিজেকে খুব স্বাভাবিক রেখে পাতিল ভর্তি দুধ জাফরের সামনে রাখল সুজানা। জাফর একটু অন্য দৃষ্টিতে তাকাল সুজানার দিকে। তারপর তাকাল পাতিলের দুধের দিকে। ধক ধক করছে সুজানার বুক। মনে হচ্ছে, বুকের ভিতরের শব্দটা বাইরে থেকে শোনা যাবে। কোনও কিছু কি আন্দাজ করছে জাফর? আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের হয়ে এল সুজানার। দুধ খাওয়া শুরু করেছে জাফর। সুজানা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সাত মিনিটের মধ্যে দেড় লিটার দুধ শেষ করল জাফর। বাকিটুকু আর খেতে চাইল না।

সুজানার দৃষ্টি এখনও জাফরের উপর নিবদ্ধ। দেখে মনে হচ্ছে পড়ছে না তার চোখের পলক।

হঠাৎ বলল জাফর, ‘ঝিমঝিম। ঝিমঝিম।’

সুজানা গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, ‘কী ঝিমঝিম?’ চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার গলায় উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠেছে।

‘মাথা ঝিমঝিম। খারাপ। খারাপ লাগে আমার।’ দশ মিনিট ধরে কেমন যেন এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াল জাফর। এরপর দড়াম করে পড়ে গেল মেঝেতে।

দ্রুত রান্নাঘর থেকে চাপাতিটা নিয়ে এল সুজানা। গত বছর কুরবানির ঈদে কিনেছিল ওটা।

জাফরের চোখ বন্ধ। কেমন যেন থেমে আছে নিঃশ্বাস।

দেরি করল না সুজানা। সবটুকু রাগ, সবটুকু ক্রোধ জাফরের শরীরে ঢালতে শুরু করল। প্রথমে চাপাতি দিয়ে কেটে দিল জাফরের গলাটা। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল সুজানার গা। জাফরের হাত ও পায়ের রগগুলো কেটে দিল। তারপর এলোপাথাড়ি কোপ দিতে শুরু করল শরীরে। সুজানার পুরো শরীরে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। ভয় নেই, আতঙ্ক নেই, আছে শুধু ক্রোধ।

ঠিক এই সময় চোখ খুলে গেল জাফরের। ঘুমের ওষুধের প্রভাব মাত্র পনেরো মিনিট কাজ করেছে ফ্যাফ্যাসের উপর। কিন্তু এই পনেরো মিনিটেই অনেক বড় সর্বনাশ করে দিয়েছে সুজানা ফ্যাফ্যাসের। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জাফরের পুরো শরীর। ওঠার চেষ্টা করেও পড়ে গেল সে। ফ্যাফ্যাসের পোষক দেহটা মারা যাচ্ছে। তীব্র এক আর্তনাদ করে উঠল ফ্যাফ্যাস। সেই আর্তনাদের শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। জাফরের শরীর থেকে বেরিয়ে পড়ল ফ্যাফ্যাস। কিছুক্ষণ কাঁপতে থাকল জাফরের দেহটা, তারপর হয়ে গেল পুরোপুরি নিশ্চল। ফ্যাফ্যাস বুঝতে পেরেছে, তার আয়ু শেষের দিকে।

ফ্যাফ্যাসের আসল চেহারা দেখতে পেল সুজানা। ভয়ঙ্কর এই চেহারা দেখে যেন নড়ে উঠল সুজানার পেটের সন্তানও। সুজানার মনে হলো, তার সন্তান পেটের মধ্য থেকে বলছে, ‘মা, আমাকে বাঁচাও!’

নীচে পড়ে থাকা চাপাতিটা তুলে নিল ফ্যাফ্যাসটা। ভয়ঙ্করভাবে কোপ দিল সুজানার বুকে। সুজানার রক্ত আর জাফরের রক্ত এক হয়ে মিশে গেল।

তীব্র গলায় বলল ফ্যাফ্যাস, ‘তুই আমার সন্তানকে বাঁচতে দিলি না! আমিও তোর সন্তানকে বাঁচতে দেব না!’

অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে সুজানা। দিন-রাতের পার্থক্য ভুলে গেল সে। একটা বাচ্চার কোমল মুখ ফুটে উঠল তার চোখে। সুজানার মনে হলো, এটাই রোমি। আহা রে! কী সুন্দর ঝুঁটি করেছে মেয়েটা! চোখগুলো কেমন মায়া- মায়া! বড্ড আদর করতে ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে!

ফ্যাফ্যাস এবং সুজানার দেহ পড়ে রইল মেঝেতে। এখনও মারা যায়নি তারা। সুজানার দেহ যেমন আস্তে-আস্তে অবশ হয়ে আসছে, ঠিক তেমনি ফ্যাফ্যাসের শরীরও শীতল হয়ে আসছে।

সুজানা চোখ মেলে তাকাল। বলল, ‘হে, আল্লাহ্! আমি মারা গেলেও আমার সন্তান যেন বেঁচে থাকে। তুমি আমার সন্তানকে বাঁচিয়ে দাও।

এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তেও সুজানার কেন জানি মনে হচ্ছে, কেউ তার ঘরে আসবে। তাকে হাসপাতালে নেবে, আর বেঁচে যাবে তার সন্তান।

সুজানার মত ফ্যাফ্যাসও কাতর স্বরে ভিন ভাষায় বলল, ‘হে, অন্ধকারের দেবতা! আমার সন্তানকে রক্ষা করো! তাকে এই পৃথিবীতে স্থান দাও!’

ফ্যাফ্যাস এবং সুজানা কারও প্রার্থনাই মঞ্জুর হলো না।

ফ্যাফ্যাস, এবং সুজানা একই সময়ে চিরতরে চোখ বুজল। এক শত বিশ বছরের জন্য পৃথিবীকে রক্ষা করেছে সুজানা। আবারও এক শ’ বিশ বছর পর অন্ধকার জগৎ থেকে পেটে ডিম নিয়ে পৃথিবীতে আসবে একটা ফ্যাফ্যাস। সে তার সন্তানদের জন্য খুঁজবে পোষক দেহ। হয়তো তখন পৃথিবীতে হবে ফ্যাফ্যাসের রাজত্ব। কিংবা সুজানার মত কেউ বুক আগলে রক্ষা করবে পৃথিবীকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *