হত্যা
এক
রুখসানাকে মেরে ফেলার পর দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর যখন রুখসানার শরীরটা বিছানায় এলিয়ে পড়ল তখন ঘড়িতে রাত ৮টা বাজে। আর এখন ১০টা। দুই ঘণ্টা একটা লাশকে নিয়ে এক ঘরে থাকাটা বেশ কঠিন একটা বিষয়। তবে ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর অধিকারী শওকতের জন্য বিষয়টা তেমন কঠিন নয়। খুনের মত এত বড় বিষয়ও তাকে উত্তেজিত করতে পারেনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট টানছে।
রুখসানাকে মেরে ফেলতে শওকতকে তেমন কোনও বেগ পেতে হয়নি। ঘুমের ওষুধ, ছুরি, পিস্তল-এ ধরনের কোনও উপকরণেরই প্রয়োজন পড়েনি। আজ অফিস থেকে ফিরেই রুখসানা খানিকটা সময় মাথা নিচু করে বসে ছিল। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছিল। শওকত বুঝতে পেরেছিল কোনও কিছু নিয়ে ঝামেলায় আছে।
রুখসানা বাইরের পোশাক বদলে কড়া গলায় বলে, ‘আমি কিছুক্ষণ ঘুমাব। আমাকে বিরক্ত করবে না।’
কথাটা শুনে খুশি হয় শওকত। বলে, ‘এক গ্লাস শরবত করে দিই? তারপর ঘুমাও।’
‘না। এখন কিছু খাব না। আমাকে প্লিজ বিরক্ত করবে না।’
মুখে একটা দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে শওকত বলে, ‘আচ্ছা। ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও।’ ঘুমাও কথাটার উপর অত্যাবশ্যক জোর দেয় সে।
রুখসানা ঘুমিয়ে পড়া মাত্রই শওকত আর দেরি করেনি। একটা বালিশ তার মুখের উপর চেপে ধরেছে। ‘বেচারি। বেশ কিছুক্ষণ বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমার শক্তির সাথে পেরে ওঠেনি,’ মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে নিজেকে বলল শওকত। নিজের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে তার।
শওকত অবাক হয়ে লক্ষ করল, মারা যাওয়ার পরেও রুখসানার শরীর অনেক গরম। সে শেষবারের মত গভীর মমতায় তার প্রিয় স্ত্রীকে আলিঙ্গন করল তার কপালে চুমু খেল। এরপর তাদের বড় ডিপ ফ্রিজটার মধ্যে রুখসানার লাশট ঢুকিয়ে দিল। অন্য আট-দশটা রাতের মত আজও সে শান্তিতে ঘুমাবে। যদি হঠা দেখে রুখসানা ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবু খুব বেশি বিচলিত হবে না। ধরে নেবে এসব হ্যালুসিনেশন। ভূতকে ভয় পেলে চলে না। রুখসানার লাশটা কাটাছেঁড়া করার বা কোনও জায়গায় ফেলে দেয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। লাশটা ফ্রিজেই থাকবে। আগামীকাল সকালেই বেনাপোল বর্ডার দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার ইচ্ছা তার। কারণ পালিয়ে থাকার জন্য ভারত বেশ উৎকৃষ্ট জায়গা।
প্রিয় বন্ধু আনিসকেও কিছুক্ষণ আগে মেরে ফেলেছে শওকত। তাকে অবশ্য রুখসানার মত সহজে মারতে পারেনি। রিভলভারের দুটো গুলি খরচ করতে হয়েছে। আজ ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনিসকে আশুলিয়া নিয়ে যায় শওকত। এরপর একটা জনশূন্য জায়গায় সুযোগ বুঝে…। সে খুব ভাল করেই টের পেয়েছিল আনিসের সঙ্গে রুখসানার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সম্পর্কের উষ্ণতা যে বাড়ছিল সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছিল। যে-কোনও সময় হয়তো রুখসানা তাকে ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এদিকে শওকত অনেক আগেই সব সম্পত্তি স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছে। তাই পাশার দানে হার এড়ানোর জন্য দু’জনকেই হত্যা করতে হলো।
বিছানায় শুয়েই শওকতের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। মনে হলো খাটের নীচে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। প্রথমে সে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মনের ভিতর তীব্র খচখচানি তাকে অস্থির করে ফেলল। অস্থিরতার কাছে পরাজিত হয়ে লাইট জ্বালল শওকত। এরপর খাটের নীচে উঁকি দিল। প্রচণ্ড চিৎকারে চারদিক যেন কেঁপে উঠল। খাটের নীচে আনিস শুয়ে আছে। আনিস শওকতের দিকে এক নজর তাকাল। তারপর নিজের মনে গাইতে লাগল, ‘Where have all the flowers gone?’
দুই
পুরানো দুঃস্বপ্নটা দেখে ঘুম ভাঙল শওকতের। তার হৃৎস্পন্দন হচ্ছে তড়িৎ গতিতে। সঙ্গে যোগ হলো নিঃশ্বাসে কষ্ট। মুখের ভিতরে শুকনো, খটখটে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই এক গ্লাস পানি পান না করলে সে মারা যাবে। শরীরটাও কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। নিজেকে মনে হচ্ছে প্যারালাইসিস রোগী। শওকত বাম হাতটা নাড়ানোর চেষ্টা করল। হ্যাঁ, বাম হাত নাড়াতে পারছে। কিন্তু বাম চোখে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না। তার পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে রুখসানা। ও ডাকার চেষ্টা করল, ‘রু-রুখ…’
রুখসানা ঘুমের ভিতরেই অস্ফুট স্বরে ‘উ’ বলল। সুন্দর মায়াবী একটা মুখ, রুখসানার। বিড়ালের মত আদুরে মুখমণ্ডল, ধনুকের মত শরীরের অবয়ব আর কমলার কোয়ার মত কোমল ঠোঁট। আর তার গাঢ় নিঃশ্বাসেও আছে কাছে আসার আহ্বান। স্বল্প পোশাকে তার শরীরের সৌন্দর্য যেন বহুগুণে বেড়ে গেছে। অনাবৃত পা শওকতের শরীরের উপর তুলে দিয়েছে রুখসানা। হালকা আকর্ষণীয় পা-টা শওকতের কাছে এখন ভয়ানক ভারী মনে হচ্ছে।
শওকত আবার বলল, ‘রুখ। অ্যাই, রুখ।
রুখসানা চোখ মেলে তাকাল। আস্তে করে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘ভয় করছে, রুখ। সেই স্বপ্নটা আবার দেখেছি। শরীর খারাপ লাগছে।’
‘কী যে পাগলের মত ভয় পাও। স্বপ্ন তো স্বপ্নই,’ সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল সে।
‘আনিস, আনিস আবার এসেছিল।’
‘পানি খাবে?’
‘হ্যাঁ, পানি খাব। পানি।
রুখসানা পানির গ্লাস এগিয়ে দিল।
শওকত এক চুমুক পানি খেয়ে মুখ বিকৃত করল। কাঁপা গলায় বলল, ‘পানি তিতা লাগছে। বমি আসছে।’
রুখসানা কিছুটা বিরক্ত হলো। বেশ কিছুদিন ধরে শওকত এরকম ঝামেলা করছে। লাইট জ্বালল রুখসানা। আলোতেও শরীরের স্বল্প কাপড় নিয়ে বিব্রত হলো না সে।
‘তোমাকে নিয়ে কী যে করি!’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল রুখসানা। ‘এত কীসের ভয় তোমার?’
‘স্বপ্নে আমি অনেক সাহসী একজন মানুষ। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙতেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। আজ ঘুমের মাঝে আমি আবার তোমাকে এবং আনিসকে মেরে ফেলেছি।’
‘ওহ। ভাল করেছ। কে জানে হয়তো তোমার হাতেই আমাদের মৃত্যু আছে। হা-হা,’ খিলখিল করে হেসে উঠল রুখসানা।
‘আনিস ভাল আছে তো?’
‘গতকালই না আমাদের বাসায় এল আনিস ভাই।’
‘তবু চিন্তা হচ্ছে। ওর খারাপ কিছু হয়নি তো? স্বপ্নে যা-ই দেখি না কেন, আমি আমার বন্ধুকে অনেক ভালবাসি।’
‘আনিস ভাই মরে গেছে।’ মুখটা বিকৃত করে রুখসানার জবাব।
‘রুখ, দেখো, আমার বুড়ো আঙুলটা কাঁপছে…’
‘শান্ত হও তো।’
‘বিছানার নীচে কেউ আছে কি না একটু দেখবে?’
‘দেখো তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করছ!’
‘স্বপ্নে আনিস খাটের নীচে শুয়ে ছিল। আর একটু পরপর শিস বাজানোর চেষ্টা করছিল। আর একটু পর গাওয়ার চেষ্টা করছিল: Where have all the flowers gone. এরপর…’
‘ওহ, বাদ দাও তো এসব। অসহ্য লাগছে,’ বিরক্তিটা পুরোপুরি প্রকাশ করে বলল রুখসানা। ‘তুমি কি আমাকে আর আনিস ভাইকে সন্দেহ করো?’
‘না, না। কখনওই না। আমি জানি তুমি আমাকে কখনওই কষ্ট দিতে পারো না। তবু কেন যে এসব স্বপ্ন দেখি!’
‘তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ। তোমার চিকিৎসা প্রয়োজন।’
‘তুমি, প্লিজ খাটের নীচটা একটু দেখবে?’
‘ওহ। প্রতিদিন এক ঝামেলা আর ভাল লাগে না। আচ্ছা দেখছি।’
উবু হয়ে খাটের নীচে উঁকি দিল রুখসানা। এরপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। একটা আনন্দের ভাব যেন এক নিমিষে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী যেন স্থির হয়ে গেছে। সত্যিই আনিস খাটের নীচে বসে আছে। চেহারায় জবুথুবু ভাবটা নেই। বরং বড্ড প্রফুল্ল মনে হচ্ছে তাকে। আনিস রুখসানার দিকে না তাকিয়ে গাইতে শুরু করল, ‘How many roads must a man walk down?’
শওকতের চোখ-মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, ‘রু-রুখ… রুখসানা খেয়াল করল আবারও শওকতের বুড়ো আঙুলটা কাঁপতে শুরু করেছে। রুখসানা উঠে দাঁড়াল। ওয়ারড্রোব খুলল। শওকতের রিভলভারটা খুঁজছে সে। না, নেই। কোথাও নেই সেটা।
আনিস খাটের নীচ থেকে বলল, ‘রু-রুখ।‘
শওকত খাটের উপর থেকে বলল, ‘রু-রুখ।‘
প্রথমজনের কণ্ঠের মধ্যে সন্তুষ্টির ভাব থাকলেও দ্বিতীয়জনের কণ্ঠে ছিল ভয়। রুখসানা পাগলের মত রিভলভারটা খুঁজতে লাগল। হ্যাঁ, রিভলভারটা অবশেষে পাওয়া গেছে। ওটা হাতে নিয়ে পিছনের দিকে ফিরল সে। খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এল আনিস।
শওকত পাগলের মত কাঁপছে। সে বলল, ‘রুখ, আনিস আমাকে মেরে ফেলবে! আমাকে বাঁচাও!’
আনিস বলল, ‘ওহ, বন্ধু। শান্ত হও। এত অস্থির হলে চলে?’
রুখসানা প্রথমে আনিসের দিকে রিভলভারটা তাক করল। এরপর নাটকীয়ভাবে হাতের অবস্থান পরিবর্তন করল। ‘একদম নড়বে না, সোনা। যে স্বপ্নটা তুমি এতদিন দেখে এসেছ সেটা আজ আমরা সত্যি করব,’ শওকতের দিকে তাকিয়ে ঝনঝনে গলায় বলল রুখসানা।
আনিস রুখসানাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘সত্যি করব, তবে একটু অন্যভাবে। আজ তোমাকে মরতে হবে, বন্ধু।’
আনিস সর্বশক্তি দিয়ে শওকতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুখের উপর বালিশ চেপে রাখল। রুখসানাও ওর সঙ্গে যোগ দিল।
আধ ঘণ্টা পরে বাসার বড় ডিপ ফ্রিজে জায়গা করে নিল শওকতের মৃতদেহ। সে রাতেই আনিসকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে রুখসানা। কাল দেশের বাইরে পালিয়ে যাবে তারা। শওকতের টাকা-পয়সা মোটামুটি সবই ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। নিজের গয়নাগুলোও বিক্রি করেছে রুখসানা। তাই এখন পালিয়ে যেতে পারলেই মুক্তি।
ভোরের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আনিসের। প্রচণ্ড ভয় করছে তার। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। আকুল গলায় সে বলল, ‘রুখ। অ্যাই, রুখ। রুখসানা চোখ মেলে তাকাল। আস্তে করে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘ভয় করছে, রুখ। সেই স্বপ্নটা আবার দেখেছি। শরীর খারাপ লাগছে। ‘কী যে পাগলের মত ভয় পাও। স্বপ্ন তো স্বপ্নই,’ সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল সে।
ঠিক তখন ওরা টের পেল খাটের নীচে কিছু একটা খুটখুট আওয়াজ করছে। ফ্যাসফেঁসে গলায় কেউ যেন গান গাওয়ারও চেষ্টা করছে।