আঁধারে বসতি
আমি একটা অন্ধকার জায়গায় শুয়ে আছি। যতবার চোখ মেলে তাকাই, কিছু দেখতে পাই না। প্রচণ্ড একটা ভয়ের অনুভূতি আমায় জাপটে ধরে। জায়গাটা আশ্চর্যরকম নীরব। আমি খুকখুক করে কেশে উঠলাম। মনে হলো কাশির শব্দ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আমি কি মারা গেছি? নাকি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি? আমি সম্ভবত কোনও মাঠে শুয়ে আছি। আস্তে-আস্তে উঠে বসলাম। আমাকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। আমি কীভাবে এখানে এলাম? আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে, বন্ধু মাহমুদ আমাকে খারাপ কিছু খাইয়ে দিয়েছে? হয়তো আমি নেশার ঘোরে আছি। মাহমুদের আবার উল্টাপাল্টা জিনিস খাওয়ার অভ্যাস আছে।
আমি মারা যাইনি, এটা বেশ বুঝতে পারছি। হাত-পা ইচ্ছামত নাড়াতে পারছি। একটা মশা ভয়াবহ কামড় দিল। ব্যথা পেলাম। চারপাশে কেমন একটা কটু গন্ধ পাচ্ছি। মারা গেলে বা স্বপ্ন দেখলে এসব অনুভূতি কাজ করার কথা না। কিন্তু জায়গাটা এত অন্ধকার কেন? আমি চিৎকার করে বললাম, ‘কেউ আছেন?’
কেউ জবাব দিল না। মনের ভিতর ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাচ্ছে। এত ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ একটা আশঙ্কা আমায় পেয়ে বসল। আমি হয়তো অন্ধ হয়ে গেছি। তাই কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু হুট করে অন্ধ হলাম কী করে? না, হিসাব মিলছে না। খিদেও পেয়েছে বেশ। চোখের সামনে নান আর মুরগির গ্রিলের ছবি ভাসছে। প্রায় প্রতি রাতেই আমি নান আর মুরগির গ্রিল খেয়ে থাকি। সঙ্গে কড়া লিকারের এক কাপ চা।
না, এভাবে বসে থাকা সম্ভব না। আমি আবার বললাম, ‘কেউ আছেন?’
গম্ভীর গলায় কেউ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আছি।’
‘কে আপনি?’
‘আমি কেউ না।’
‘আমি কোথায় আছি?’
‘নিজেই বুঝতে পারবে।’
‘আমি কি বেঁচে আছি?’
‘না।’
‘তবে মারা গেছি?!!’
‘না। মারা যাওনি।’
‘মানে?!!’
‘শান্ত হও। সব বুঝতে পারবে।’
‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’
‘হতে পারে এটা এক ধরনের স্বপ্ন। আবার না-ও হতে পারে।’
‘আমার ভয় করছে। প্রচণ্ড ভয়।’
‘ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আরও অনেক কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
‘আপনি কি আমার হাতটা একটু ধরবেন?’
‘না।’
‘এত অন্ধকার কেন?’
‘একটু পরে অন্ধকার কমে যাবে।’
‘তাই?!’
‘হ্যাঁ। তুমি সবকিছু আবছা দেখতে পাবে।’
‘এই অন্ধকার পুরোপুরি দূর হবে কখন?’
‘এই অন্ধকার পুরোপুরি দূর হবে না।’
‘আমাকে বাঁচান।’
‘হা-হা-হা।’
‘ভয় লাগছে…আমার ভয় লাগছে।’
‘মাটিতে শুয়ে পড়ো।’
‘কেন?’
‘যা বলছি করো।’
আমি শুয়ে পড়লাম।
লোকটা আবার বলল, ‘একটু পরে অন্ধকার কমে যাবে। তুমি সবকিছু আবছা দেখতে পাবে। তখন মাটি থেকে উঠে পড়বে। এরপর হাঁটতে শুরু করবে।’
‘হেঁটে কোন্দিকে যাব?’
‘সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে।’
‘আপনি আমার সাথে থাকবেন?’
‘না।’
‘প্লিজ, আমাকে সাহায্য করুন।’
কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘সাহায্য করুন। আমাকে সাহায্য করুন। বাঁচাও, আমাকে কেউ বাঁচাও!’
কেউ সাড়া দিল না। আমি কাঁদতে লাগলাম। সর্বশেষ কবে কেঁদেছি মনে নেই। আর আজ ভয়ে-আতঙ্কে যেভাবে কাঁদছি, তার সঙ্গে অতীতের কোনও কান্নার মিল নেই।
ভয়! ভয়! ভয় আমাকে ক্রমাগত গ্রাস করছে। আমি বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি: ‘হে, মহান প্রতিপালক! সাহায্য করো। আমাকে রক্ষা করো।’
কিছুক্ষণ পর চারদিকে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। আস্তে-আস্তে চারদিক একটু পরিষ্কার হচ্ছে। আমি একটু আশ্বস্ত হলাম। আমি একটা ছোট খোলা জায়গায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে অসংখ্য গাছপালা। তা হলে আমি কি কোনও বনের মধ্যে আছি? আমি উঠে পড়লাম। ভেবেছিলাম যেদিকে আলোর রেখা দেখব সেদিকে এগোব। কিন্তু চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে আমি কোনও আলোর রেখা দেখতে পেলাম না। সোজা এগোতে শুরু করলাম। চারদিকে ঘন জঙ্গল। কিন্তু জঙ্গলটা ভয়ঙ্কর নীরব। কোনও পশুপাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি না। এমনকী ঝিঁঝিও ডাকছে না। কিছুক্ষণ একটানা হাঁটার পর আমি আবার একটা ফাঁকা জায়গা পেলাম। পা খালি হওয়াতে আমার হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। বিশ্রাম নেয়ার জন্য ফাঁকা জায়গাটায় বসলাম। হঠাৎ মনে হলো, একটু দূরে কেউ একজন বসে আছে। আমি এগিয়ে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’
‘আমি।’
‘আমি কে?’
‘আমার কোনও নাম নেই।’
‘কী করছেন এখানে?
‘বৃদ্ধ হয়েছি তো, পরিশ্রম সহ্য হয় না, তাই বিশ্রাম নিচ্ছি।’
‘এটা কোন্ জায়গা?’
‘এটা তোমার জন্য একটা নতুন জগৎ।’
‘আমি বুঝতে পারছি না।’
‘পৃথিবীর কোনও-কোনও মানুষকে এ জগতে আসতে হয়।’
‘কী বলছেন এসব!!’
হ্যাঁ। তবে সবাই এ জগৎ থেকে ফিরে যেতে পারে না। তাদের চিরদিনের জন্য এ জগতে থাকতে হয়!’
‘আপনিও কি আটকে পড়া একজন?’
‘না।’
‘তবে আপনি কে?’
‘আমি এ জগতের পাহারাদার!’
‘পাহারাদার?!!’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘তোমার বোঝার প্রয়োজন নেই।’
‘আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আপনি একটু কাছে এলে আমার ভয়টা একটু কমত।’
‘না, আমি কাছে আসব না।’
‘ঠিক আছে, আমিই কাছে আসছি।’
বড় আলখাল্লায় লোকটির পুরো শরীর ঢাকা। আমি তাঁর হাত-পা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু মুখ দেখতে পাচ্ছি না। আমাকে আসতে দেখে তিনি একটু দূরে সরে গেলেন। বললেন, ‘না, না, কাছে এসো না।’
আমি কথা না শুনে দৌড়ে এসে লোকটির হাত ধরলাম। হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। তখন একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটল। লোকটির হাত খুলে গেল। হাতটা আমার হাতে ঝুলছে। আমি ঝটকা মেরে হাতটা ফেলে দেয়ার চেষ্টা করলাম।
পাহারাদার বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার হাতটা তোমাকে দিয়ে দিলাম।’ বৃদ্ধ হাসতে লাগলেন।
হাতটা আমার গলা চেপে ধরল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমার। কোনওমতে বললাম, ‘বাঁচাও…
একটু পর হাতটা আমার গলা ছেড়ে দিল। বৃদ্ধ বললেন, ‘বেশি কৌতূহল ভাল নয়। বুঝলে?’
আমার শরীর কাঁপুনি দিচ্ছে। দৌড় দিতে চাইলাম। কিন্তু হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে। চিৎকার করে বললাম, ‘ভূত-ভূত…আ-আপনি ভূত।’ বৃদ্ধ বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘না, আমি ভূত নই। আমি পাহারাদার।’
‘আ-আপনার হাত…হা-হাত…’
‘চুপ করো। শুধু হাত কেন, আমার শরীরের সব অংশই টান দিলে খুলে আসে।’
‘অ্যা!!!’
‘হুঁ। এই দেখো।’ বৃদ্ধ তাঁর অন্য হাত দিয়ে পা দুটি খুলে ফেললেন। আমার পেটের ভিতর কিছু যেন পাক দিয়ে উঠল। বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘দাঁড়াও, এবার মাথাটা খুলি।’
‘না…না…না। থামুন, থামুন।’ আমি দৌড় দিলাম।
বৃদ্ধের হাত-পা আলাদা-আলাদাভাবে আমাকে ধরতে এগিয়ে আসতে লাগল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দৌড়াচ্ছি। কখনও পড়ে যাচ্ছি, ব্যথা পাচ্ছি। তবু থামছি না। একটা ভয়ঙ্কর হাসি শুনতে পেলাম। কেউ জোরে বলে উঠল, ‘বোকা, তুমি খুব বোকা।’
মনে হলো বৃদ্ধের গলা। কিন্তু আশপাশে কোথাও তাঁকে দেখতে পেলাম না। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। মনে হচ্ছে পানি খেতে না পারলে আর এক মুহূর্তও বাঁচব না। এমন সময় কেউ বলল, ‘অ্যাই।’
‘কে?’
‘আমি। এই তো এদিকে।’
আমি একটা ছোট বাচ্চা মেয়ের অবয়ব দেখতে পেলাম। তবে মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটি আস্তে-আস্তে বলল, ‘পানি খাবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই নাও।’ মেয়েটি আমার দিকে একটা পানির পাত্র এগিয়ে দিল।
আমি ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখানে কী করছ?’
‘আমি আমার মাকে খুঁজছি।’
‘তোমার মা কোথায়?’
‘হারিয়ে গেছে।’
‘তুমি পানি পেলে কোথায়?’
‘সামনে অনেক পানি।’
‘সামনে কোথায়?’
‘ওই তো সামনে।’
‘তুমি এখানে এলে কীভাবে?’
‘আমি সবসময় এখানেই আছি।’
‘তুমি এখানকার সবকিছু চেনো?’
‘হ্যাঁ। চিনি।’
‘আমি এখান থেকে বেরোতে চাই। কোনদিকে যাব?’
‘নদীর দিকে যেতে হবে।’
‘নদীটা কোথায়?’
‘বলব না।’
‘তোমার মা-ও কি এখানে থাকতেন?’
‘হ্যাঁ। হঠাৎ করেই হারিয়ে গেছে।’
‘নদীটা কোথায় বললে, আমি তোমার মাকে খুঁজে দেব।’
‘মিথ্যা! তুমি মিথ্যা বলছ! তুমি জানো না আমার মা কোথায়।’
‘জানি। আমি জানি।’
‘জানো না। তুমি মিথ্যা বলছ,’ মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। ‘তোমার শাস্তি পেতে হবে। মিথ্যাবাদীকে শাস্তি পেতে হয়।’
এমন সময় কিছু একটা আমার মুখে আঘাত করল। প্রচণ্ড আঘাত। দুটো দাঁত ছিটকে বেরিয়ে এল। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। আমি পড়ে গেলাম।
মেয়েটি আবার চিৎকার করে বলল, ‘আমি মিথ্যা ঘৃণা করি। ঘৃণা… ঘৃণা!’
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। ক্ষুধা, তৃষ্ণাও আগের থেকে বহুগুণ বেড়ে গেছে। কতক্ষণ পেরিয়েছে জানি না। দু’ঘণ্টা? পাঁচ ঘণ্টা? নাকি অনন্ত সময়? আমি আবার উঠলাম। হাঁটতে শুরু করলাম। মুখের ব্যথা ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। এমন সময় একটা মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ভয়ে- ভয়ে বললাম, ‘কে?’
একটু সামনেই এক তরুণী মেয়েকে দেখতে পেলাম। এখানে যাদের সাথে আমার দেখা হয়েছে, কারও মুখই আমি দেখতে পাইনি। তবে আবছা আলোতে এই মেয়েটির মুখ দেখতে পাচ্ছি। অন্ধকারটা বেশ চোখে সয়ে গেছে। মেয়েটি আমাকে দেখে চমকে উঠল। বলল, ‘কে? কে আপনি?’
‘আমি? আমি নিয়াজ। আপনি কে?’
‘আমি রূপা। আপনি কীভাবে এলেন এখানে?’
‘আমি জানি না।’
‘আমিও বুঝতে পারছি না, কীভাবে এখানে এলাম।’
‘কতক্ষণ হলো আছেন এখানে?’
‘জানি না। সময় আন্দাজ করতে পারছি না। হয়তো একদিন, দু’দিন কিংবা আরও বেশি।’
‘এতদিন!! কোনও খাবার কি পেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, এখানে মাটিতে অনেক ধরনের ফল পড়ে আছে, সেগুলো খেয়েছি। সামনে একটা ডোবা আছে, সেখান থেকে পানি খেয়েছি।’ বলতে-বলতে রূপা কেঁদে উঠল। ‘আমি বাঁচতে চাই। ঘরে ফিরে যেতে চাই।’
আমি রূপার হাত ধরলাম। রূপার কান্না স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল।
আমি বললাম, ‘আপনার কি অতীতের সবকিছু মনে আছে? কোথায় থাকতেন আপনি?’
‘হ্যাঁ। সবকিছু মনে আছে। আমি উত্তরাতে থাকি।
‘আমারও সবকিছু মনে আছে। পরিবারের কথা, বন্ধুদের কথা।’
‘কী হবে এখন আমাদের?’
‘আমাদের নদী খুঁজে বের করতে হবে।’
‘তারপর?’
‘হয়তো নদী পেরোতে হবে আমাদের।’
‘আপনাকে কে বলেছে?’
‘আমি জেনেছি।’
‘আপনি মানুষ তো?’
এত বিপদের মধ্যেও আমি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, রূপা, আমি মানুষ।
‘প্লিজ, আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না।’
‘না, যাব না। আমার নিজেরই খুব ভয় লাগছে! আপনাকে দেখে একটু হলেও মনে সাহস ফিরে পেয়েছি।’
‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে এটা মৃত্যুর পরের কোনও জগৎ?’
‘আমি ঠিক জানি না, রূপা। তবে সম্ভবত আমরা মারা যাইনি।’
‘তা হলে এটা কোন জায়গা?’
‘আমি ঠিক জানি না। হতে পারে এটা অন্ধকার জগৎ।’
‘অন্ধকার জগৎ?’ রূপার কণ্ঠে আতঙ্ক।
‘হ্যাঁ। তবে যে করেই হোক আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে।’
‘পারব আমরা?’
‘নিশ্চয়ই পারব।’ রূপাকে দেখে আমার মনোবল বহুগুণ বেড়ে গেছে। নারী যে প্রেরণাদায়ী তা এখানে এসেও টের পাচ্ছি।
আমরা এগোতে লাগলাম। রূপা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। বিচিত্র কোনও শব্দ শুনলেই আমাকে জড়িয়ে ধরছে। মনে হচ্ছে আমি যেন তার কত আপন। আমরা হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতেই লাগলাম। চেষ্টা করছি সোজা হাঁটতে। কিন্তু দিক ঠিক রাখা খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় মনে হলো কিছু একটা আমাদের অনুসরণ করছে। ভয়ে আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। চেঁচিয়ে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’
হঠাৎ একটা জন্তু আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জন্তুটাকে একবার কুকুর, একবার বাঘের মত লাগছে। জন্তুটা আমাকে ধারাল নখ দিয়ে আঁচড় দিতে লাগল। যেন আমার উপর ভয়ঙ্কর আক্রোশ রয়েছে। কামড় দিয়ে আমার শরীরটা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল জন্তুটা। রূপা কোথা থেকে একটা কাঠ জোগাড় করে জন্তুটাকে আঘাত করল। পালিয়ে গেল ওটা। আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। মনে হচ্ছে মারা যাব। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে চলেছি। রূপা কাঁদছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। ওর একটা হাত আমার মুখের উপর দিয়ে রেখেছে। বলল, ‘খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?’
এমন সময় কেউ একজন আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। এই লোকের মুখও দেখা যাচ্ছে না। তিনি কিছু পাতা আমার গায়ের উপর ফেললেন। রূপাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘পাতা থেকে রস বের করে ওর গায়ে লাগিয়ে দাও। ক্ষতগুলো ঠিক হয়ে যাবে।’
রূপা ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘কে আপনি?’
‘যা বলছি, আগে তাই করো।’
রূপা পাতাগুলো পিষে যতটুকু সম্ভব রস বের করল। এরপর আমার শরীরের ক্ষতস্থানগুলোতে লাগিয়ে দিল। একটু পরেই টের পেলাম ব্যথা কমে গেছে। উঠে বসলাম। বললাম, ‘আপনাকে ধন্যবাদ।’
‘তুমি অনেক বড় অন্যায় করেছ। এজন্য জন্তুটা তোমাকে আক্রমণ করেছে।’
‘কী অন্যায়?’
‘অন্যায়টা তুমি ভাল করেই জানো। দু’দিন আগে কি ঘটেছিল তোমার মনে নেই?’
আমি চমকে উঠলাম। মনে আছে। স্পষ্ট মনে আছে।
কাঁপা গলায় বললাম, ‘আপনি কে?’
‘আমি পথনির্দেশক বৃদ্ধ। আমি মানুষকে এখান থেকে বেরোনোর পথ বলে দিই।’
‘সত্যি! বলুন, কীভাবে আমরা বেরোব?’
‘বলব। নিশ্চয়ই বলব।’
‘আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি?’
‘এখানে সময় বলে কিছু নেই।’
‘মানুষ এই জগতে আসে কীভাবে?’
‘ঘুমের ঘোরে, কোমায় থেকে, জ্ঞান হারিয়ে এ জগতে চলে আসতে পারে। আমরা যদি দুটো জগৎ ধরি-বাস্তব জগৎ এবং অন্ধকার জগৎ, তা হলে একজন মানুষকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফিরে যেতে হয়। নতুবা সে চিরদিনের জন্য এ জগতে আটকা পড়ে যায়।’
‘আপনিই তো বললেন এখানে সময় বলে কিছু নেই। তা হলে কোন্ নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলছেন?’
অন্ধকার জগতে সময় বলে কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব জগতে তো আছে, আমি বাস্তব জগতের সময়ের কথা বলছি।’
‘বাস্তব জগতের কোন্ সময়ের মধ্যে আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে?’
তোমার হাতে এখনও যথেষ্ট সময় থাকলেও মেয়েটির খুব বেশি সময় নেই। মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে এখান থেকে বেরোতে হবে।’
রূপা ভয়ঙ্কর চমকে উঠল
আমি বললাম, ‘কেউ কি এই অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফেরত গেছে?’
‘হ্যাঁ, কতজনই তো ফিরে যায়।’
‘আচ্ছা। কেউ বাস্তব জগতে গিয়ে কি আবার অন্ধকার জগতে ফিরে আসতে পারে?
‘যে মানুষ একবার অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে যায়, সে মনেপ্রাণে চাইলে আবার অন্ধকার জগতে ফিরে আসতে পারে। তখন তাকে আবার পথ খুঁজে বেরিয়ে যেতে হবে।’
‘এবার আপনি আমাদের বেরোনোর পথ বলে দিন।’
‘তোমরা সোজা. আর একটু হাঁটলেই একটা ফাঁকা জায়গা পাবে। সেখান থেকে ডান দিকে যেতে থাকবে। এরপর একটা ছোট খাল পাবে। খালে পানি খুব কম। খাল পেরিয়ে আবার সোজা এগোতে থাকবে। দেখবে নদীর ঘাটে পৌঁছে গেছ। সেখানে এক মাঝিকে পাবে। তাকে রাজি করিয়ে তোমাদের ওপারে যেতে হবে। ওপারে যাওয়ার পর টানা হেঁটে যেতে হবে সোজা। খুব বেশিক্ষণ নয়। দুই-তিন ঘণ্টা। কিন্তু মানুষ হাঁটতে পারে না। ওই পথ জুড়ে হাজার-হাজার কাঁটা রয়েছে। অনেকেই ওই পথে কিছুটা গিয়েই বসে পড়ে। দেরি করে ফেলে। কেউ উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে। কেউ ভুল পথে চলে যায়। কেউ ব্যথায়, যন্ত্রণায় ঘোরের মধ্যে চলে যায়। এদিকে সময় শেষ হয়ে যায়। চিরতরে আটকা পড়ে যায় সে।’
বৃদ্ধ পথনির্দেশক একটু থামলেন। আবার বললেন, ‘তোমরা যদি ঠিক পথে এগোতে থাকো তবে একসময় তীব্র আলোর রেখা দেখতে পাবে। সেই আলোর দিকে কিছুক্ষণ এগোলেই তোমরা বাস্তব জগতে চলে যাবে।’
‘ধন্যবাদ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাহায্য করার জন্য। আমরা এখনই এগোতে চাই।’
‘হ্যাঁ, যাও।’
আমরা এগোতে লাগলাম। ওই পথনির্দেশক বৃদ্ধ সাহায্য না করলে হয়তো গোলকধাঁধায় আটকা পড়তাম। হয়তো এক জায়গাতেই ঘোরাঘুরি করতাম। রূপা এখন আমার আরও কাছে। এত কাছে যে ওর নিঃশ্বাসের উষ্ণতা শরীরে অনুভব করছি। বাস্তব জগতে এমন হত কি না জানি না। তবে এখানে খুব সহজেই কথাটা বলে ফেললাম রূপাকে
‘রূপা, আমরা যদি ফিরে যেতে পারি, তবে…’
‘তবে কী?’
‘তুমি-আমি চিরকাল পাশাপাশি থাকব।’
‘হ্যাঁ, তুমি-আমি…. চিরকাল…একসাথে।’
ভালবাসায় আমার হৃদয়টা আর্দ্র হলো। মনে হলো সব ভয়কে জয় করা সময়ের ব্যাপার। আমরা নদীর ঘাটে পৌঁছলাম। নদীতে তীব্র স্রোত। নদীর দিকে তাকাতেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। পাগলের মত মাঝিকে খুঁজতে লাগলাম। এমন সময় রূপা আমাকে বলল, ‘ওই যে, একটা নৌকা।’
অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তবে নৌকা বলেই মনে হচ্ছে। আমরা নৌকায় ওঠার চেষ্টা করতেই নৌকার মাঝি বলল, ‘কে তোমরা? কী চাও?’
‘আমরা ওপারে যেতে চাই। আমাদের পার করে দিন।’
‘এখন পার করতে পারব না।’
‘দয়া করুন। আমাদের পার করে দিন।’
অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর মাঝি রাজি হলো। আমরা দু’জন নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকা চলতে শুরু করল। তীব্র স্রোতে দুলতে শুরু করল।
রূপা বলল, ‘নৌকা ডুবে যাচ্ছে… ডুবে যাচ্ছে। আমরা মারা যাব।’
মাঝি জবাব দিল, ‘না। নৌকা ডুববে না। আর এ জগতে কেউ মারা যায় না। তোমরা এখন চোখ বন্ধ করো। আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।’
‘কেন?’
‘এত কৌতূহল ভাল নয়। যা বলছি করো।’
আমরা চোখ বন্ধ করলাম। তখনই নৌকাটা আরও বিচিত্রভাবে দুলতে লাগল। চারদিকে নানান শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বিচিত্র ভাষায় কিছু বলছে। মাঝির কণ্ঠও শুনতে পেলাম: ‘যা-যা, দূর হয়ে যা।’
কেউ বলল: ‘পার করে দে। আমাদের পার করে দে।’
‘যা-যা…নৌকায় উঠবি না। যা, দূর হ।’
‘পার করে দে…’ প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনতে পেলাম। সে আর্তনাদ আকাশ- বাতাস ভেদ করে চলে গেল।
রূপা ফিসফিস করে বলল, ‘আমরা কি ফিরতে পারব? এখান থেকে মুক্তি পাব?’
‘নিশ্চয়ই মুক্তি পাব, রূপা, নিশ্চয়ই।’
যতবার রূপাকে আশ্বাস দিলাম ততবারই বুকের ভিতরটা ওলটপালট হয়ে গেল আমার। কিছুক্ষণ পর মাঝি বলল, ‘চোখ খোলো।’
আমরা চোখ মেলে তাকালাম। মনে হলো নদীর এপারে পৌঁছে গেছি। মাঝি বলল, ‘যাও, নেমে পড়ো।’
আমি বললাম, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘তোমার ধন্যবাদ আমার প্রয়োজন নেই। তুমি পাপী, অন্যায়কারী। যাও, চলে যাও।‘
লোকটির কথা আমার মনে আঘাত করল। সে-ও আমার অন্যায়ের কথা জানে!
আমি আর রূপা এগোতে লাগলাম। একটু এগোতেই পায়ে কাঁটা ফুটতে শুরু করল। যন্ত্রণায় আঁতকে উঠলাম আমরা। দাঁতে দাঁত চেপে এগোতে লাগলাম। পা দিয়ে রক্ত ঝরছে অনবরত। রূপা বলে উঠল, ‘পারব না। আমি পারব না।’
‘পারতে হবে, রূপা। আমাদের পারতে হবে।’
আবার আমরা এগোনোর চেষ্টা করলাম। বারবার পড়ে যাচ্ছে রূপা। ওর শরীরের নানান জায়গায় কাঁটা ফুটে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে রূপা পড়ে গিয়ে বলে উঠল, ‘আমি আর এগোতে পারব না। কিছুতেই না।’ যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগল একটানা।
‘চলো, রূপা। আমাকে ধরো। চেষ্টা করো।’
‘না, না, তুমি যাও। তুমি চলে যাও। আমি যাব না।’
‘রূপা, ওঠো….’
রূপা জবাব দিল না। হয়তো ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ রূপাকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম। এরপর একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। রূপাকে ফেলেই আমি এগোব। দ্রুত এগোনোর জন্য আমি দৌড়াতে লাগলাম। ব্যথায় আমার পা অসাড় হয়ে গেল। তবু থামলাম না। পড়ে গেলাম বারবার। কিন্তু পরক্ষণেই আবার এগোতে লাগলাম। কতক্ষণ পেরিয়েছে জানি না। হঠাৎ তীব্র আলোর রেখা দেখতে পেলাম আমি। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আলোর দিকে আরও দ্রুত দৌড়াতে লাগলাম। নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হলো। মনে হচ্ছে বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া। পেটের ভিতরের সবকিছু মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবু আমি এগিয়ে চললাম। সবকিছু হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আবার তীব্র অন্ধকারে ডুবে গেলাম। তীব্র…তীব্র অন্ধকার।
.
মোবাইলটা বাজছে। আমি চোখ মেলে তাকালাম। শরীরের কোথাও ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না। মুখের মধ্যে দাঁতগুলো ঠিকমত আছে। হাত-পায়েও কোনও ক্ষত নেই।
আমি ফোন ধরলাম। মায়ের ফোন। মা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘কী রে, কী অবস্থা তোর? গতকাল থেকে তোকে ফোন করছি। ফোন ধরিস না কেন?’
আমার মনে পড়ে গেল। মা-বাবা নড়াইলে গেছেন। আমি বাসায় একা। মোবাইলের দিকে ভাল করে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। মোবাইলে তারিখ দেখাচ্ছে ৮ এপ্রিল। রাত নয়টা। আমি গতকাল রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়েছি। তার মানে আমার জীবন থেকে তেইশ ঘণ্টা হারিয়ে গেছে। আচ্ছা, রূপা কী করছে এখন? আমি আসলে খুব স্বার্থপর। মেয়েটাকে একা-একা ওই অন্ধকার জগতে রেখে এসেছি। সে হয়তো চিরতরে আটকা পড়ে গেছে ওখানে। খুব কষ্ট হতে লাগল আমার। ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
আমি গ্যারাজ থেকে আমাদের গাড়িটা বের করলাম। যদিও বের করতে একটু ভয়-ভয় করছে। কারণ, কয়েকদিন আগেই এই গাড়িতে আমার একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি সেটা মনে করতে চাই না। সব দুঃস্বপ্ন আমি ভুলে যেতে চাই।
একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রিয় নান আর মুরগির গ্রিল খেয়ে নিলাম। রাতে বাসায় ফিরে আর ঘুমানোর সাহস করলাম না। পরদিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে তুমুল আড্ডায় মেতে উঠলাম। যা দেখছি তা-ই ভাল লাগছে। তবে মনের ভিতর কোথায় যেন একটা ভয়। অস্বস্তি দানা বাঁধছে। রাতেও আমার ঘুমাতে খুব ভয় লাগছিল। যদি আবার ওই জগতে ফিরে যাই? কিন্তু একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। স্বপ্নে রূপা আর আমি নৌকায় করে কোথায় যেন যাচ্ছি। আমার কোলে একটা ছোট বাচ্চা। রূপা বলল, ‘অ্যাই, নদীতে খুব স্রোত। বাবুকে সাবধানে রেখো।’
‘আচ্ছা।’
রূপা আবার বলল, ‘না, না। তুমি ওকে ফেলে দেবে। ওকে আমার কাছে দাও।’
রূপা আমার দিকে এগিয়ে এল। প্রচণ্ড স্রোতে নৌকাটা দুলছে। হঠাৎ তাল সামলাতে না পেরে নদীর মধ্যে পড়ে গেল রূপা। কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর ডুবে গেল।
আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ের অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। একটু পরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আনমনে পত্রিকাটা হাতে নিলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব সংবাদ পড়তে লাগলাম। হঠাৎ শেষ পৃষ্ঠায় ছোট একটা নিউজে আমার চোখ আটকে গেল।
নিউজটার শিরোনাম: ‘৭২ ঘণ্টা কোমায় থেকে মৃত্যুবরণ করলেন রূপা।’ ভিতরে লেখা: ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত রূপা মৃত্যুবরণ করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় চিকিৎসকরা তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করেন। উল্লেখ্য, গত ৫ এপ্রিল উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় মারাত্মকভাবে আহত হন মেধাবী এ ছাত্রী। এ ব্যাপারে থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়েছে।’
আমার হাত থেকে পত্রিকাটি পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল আমার সেই অন্যায়টির কথা। গত ৫ এপ্রিল আমি এলোপাথাড়ি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে এসে আমার গাড়ি একটা মেয়েকে ধাক্কা দেয়। আমি প্রাণভয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দ্রুত সরে পড়ি। ওই মেয়েটিই যে রূপা ছিল তা এখন বুঝতে পারছি।
রূপার প্রতি আমি দু’বার অন্যায় করেছি। একবার এই জগতে। একবার ওই অন্ধকার জগতে। এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে।
.
অনেক রাত। আমি মনেপ্রাণে সেই অন্ধকার জগতে প্রবেশ করতে চাইছি। একাগ্রচিত্তে ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করছি আমি। পথনির্দেশক বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘যারা অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফিরে যায়, তারা আবার চেষ্টা করলে অন্ধকার জগতে ফিরে আসতে পারে।
আমি সেই চেষ্টাই করছি। আমি ওই জগতেই স্থায়ীভাবে থাকতে চাই। এ-ও জানি, বাহাত্তর ঘণ্টা পেরোলেই বাস্তব জগতে মৃত্যু ঘটবে আমার। ভাবতে-ভাবতে চোখে এল রাজ্যের ঘুম।
আমি চোখ মেলে তাকালাম। আবার সেই তীব্র অন্ধকার। আমি তা হলে আবার সেই জগতে ফিরে এসেছি। তীব্র অন্ধকারেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। রূপাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি ওর সঙ্গে চিরকাল থাকতে এ জগতে এসেছি। বলে উঠলাম, ‘রূপা…কোথায় তুমি?’
কেউ জবাব দিল না।
আমি আকুল হয়ে ডাকতেই লাগলাম, ‘রূপা…রূপা…’