দরজার ওপাশে
এক
সেলিম চাচাদের বাসায় দিপু খুব একটা যেতে চায় না। এর পিছনে মূল কারণটা একটু জটিল। সহজ করে বলা যায়, সেলিম চাচার মেয়ে নিরুপমার প্রতি ওর প্রচণ্ড দুর্বলতা রয়েছে। প্রেমে পড়লে মানুষের আচার-আচরণ চোরের মত হয়ে যায়। ওর অবস্থাও সেরকম। শুধু মনে হয়, বারবার সেলিম চাচাদের বাসায় গেলে সবাই আসল ঘটনা বুঝে ফেলবে। তবে ওদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠলে আশা করা যায় দুই পরিবারের কেউই কোনও আপত্তি করবে না। কিন্তু দিপুর মূল দুশ্চিন্তাটা নিরুপমাকে নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই নিরুপমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। এখন প্রিয় বন্ধুকে কি নিরুপমা ভালবাসতে পারবে?
স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ে নিরুপমার প্রতি বিশেষ কোনও দুর্বলতা অনুভব করেনি। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠল, তখন কীভাবে যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সেদিনটার কথা খুব মনে পড়ে, যেদিন নিরুপমাকে প্রথম শাড়ি পরতে দেখেছিল, নীল রঙের জামদানি শাড়ি। একটা নীল রঙের টিপও ছিল কপালে। ব্যস, এটুকুই, আর কোনও সাজসজ্জা ছিল না। তাতেই মনে হচ্ছিল দিপুর সামনে একটা নীল পরী বসে আছে, যার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়। সেদিন প্রথমবারের মত নিরুপমার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিল ও। ওর চোখের দিকেও তাকাতে পারছিল না, মনে হচ্ছিল হুট করেই ও অনেক বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
অনার্স শেষ করেই একটা ব্যাংকে চাকরি শুরু করেছে দিপু। এত দ্রুত চাকরি শুরুর কারণ হচ্ছে, নিরুপমাকে মনের সব কথা খুব দ্রুত খুলে বলতে চায়। তারপর আপন করে পেতে চায়।
সেলিম চাচা দিপুর আপন চাচা নন। দিপুর বাবার মামাতো ভাই। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি গভীর। দিপুর জীবনের একটা বড় অংশ সেলিম চাচা আর নিগার চাচীর ভালবাসায় পরিপূর্ণ হয়েছে। চাচা সারাজীবন প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরি করেছেন, কিন্তু জীবনে কখনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তাই ঢাকা শহরে নিজের বাড়ি করা হয়নি। এখনও তাঁকে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে হয়। সাভারে অবশ্য তিন কাঠা জমি কিনেছেন, তবে কবে বাড়ি বানানোর সুযোগ হবে, এখনও জানেন না।
দুই
সেলিম চাচারা নতুন বাসায় উঠেছেন। আগের বাসাটার সবকিছু ভাল ছিল, কিন্তু পানি ঠিকমত পাওয়া যেত না। অগত্যা নতুন বাসা খুঁজতে হলো। নতুন বাসাটা পাঁচতলা, তিনতলায় থাকবেন সেলিম চাচা। নতুন বাসাটা আগের বাসার থেকে অনেক সুন্দর। সম্প্রতি বাড়িতে নতুন রং করা হয়েছে এবং সব রুমে নতুন টাইলস দেয়া হয়েছে। তিনতলাটা দীর্ঘদিন ফাঁকা পড়ে ছিল। তাই বাড়িওয়ালা সবকিছু নতুন করে সংস্কার করেছেন। দিপু, ওর আব্বু, আম্মু চাচাদের বাড়ি বদলের সময় যথাসাধ্য সাহায্য করল। দিপুর নজর অবশ্য নিরুপমার দিকেই বেশি ছিল। কে জানে নিরুপমা হয়তো ওর দুর্বলতা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। আজকাল প্রায়ই ফোনে কথা হয় ওদের। ফেসবুকে মেসেজও আদান- প্রদান হয় অনেক। দিপু মাঝে-মাঝে ইঙ্গিতে ওর ভাল লাগার কথা বোঝানোর চেষ্টা করে। নিরুপমা বুঝতে পারে কি না, কে জানে।
নতুন বাসায় সবকিছু দ্রুত গুছিয়ে নিলেন নিগার চাচী। তাঁর কর্মদক্ষতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। একাই একশো। দিপুর আম্মুও অবশ্য যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন।
সকালে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে দিপু, সেই মুহূর্তে সেলিম চাচার ফোন। এত সকালে ওনার ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হলো ও। সেলিম চাচা বললেন, ‘দিপু, আজ অফিস শেষ করে আমাদের বাসায় একটু আসতে পারবে?’
দিপু বলল, ‘হ্যাঁ, চাচা। অবশ্যই আসতে পারব।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। চলে এসো।’
‘চাচা, কোনও সমস্যা?’
‘তেমন কিছু না। সামনাসামনি বলব।’ বলেই ফোনটা রেখে দিলেন। দিপু চিন্তায় পড়ল। সারাদিন অফিসে অস্বস্তিতে কাটাল। অফিস শেষ করে এক মুহূর্ত দেরি না করে সেলিম চাচাদের বাসার দিকে রওনা দিল
আজ সেলিম চাচাকে অনেক গম্ভীর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। দিপুর মনের ভিতর ভয়ের অনুভূতি দানা বাঁধছে। সে কি কোনও ভুল করেছে? দিপু প্রায় পনেরো মিনিট বসে আছে, এর মধ্যে সেলিম চাচা ওর সঙ্গে একটা কথাও বলেননি। তাঁর সামনে চায়ের কাপ, কিন্তু একবার চুমুকও দেননি। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে আনমনে কিছু ভাবছেন।
অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই সেলিম চাচা বললেন, ‘দিপু।’
‘জী, চাচা।’ হঠাৎ শব্দ শুনে কিছুটা চমকে উঠল দিপু।
‘তোমার সাথে কি নিরুপমার নিয়মিত কথা হয়?’
প্রশ্নটা দিপুর কাছে পরিষ্কার নয়। তাই আমতা-আমতা করল। বলল, ‘জী…মানে…’
কেন জানি গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। পানি খাওয়া দরকার। নিরুপমার সঙ্গে কথা বলা নিয়ে কি কোনও ঝামেলা হয়েছে? নিরুপমা কি ওর কোনও আচরণে রাগ করেছে? মাথার ভিতর রাজ্যের সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
চাচা আবার বললেন, ‘আমার যতদূর মনে হয়, নিরুপমা আর তুমি খুব ভাল বন্ধু। তাই তোমাকে ডেকেছি। আর তুমি তো এ বাড়িরই ছেলে।’
কথাটা শুনে দিপুর ভয়ের ভাবটা কিছুটা কাটল। ‘এ বাড়ির ছেলে’ কথাটা মধুর মত শোনাল।
সেলিম চাচা আবার বললেন, ‘নিরুপমাকে নিয়ে একটু ঝামেলায় পড়েছি। তোমার সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই।’
‘কী সমস্যা, চাচা?’
‘নিরুপমা যে রুমে থাকে, সেই রুমে একটা অ্যাটাচড বাথরুম রয়েছে। সেটাতে বিশাল বড় একটা তালা ছিল। বাড়িওয়ালা প্রথম দিনেই বলেছিলেন, ‘এই বাথরুমে কোনওক্রমেই ঢোকা যাবে না।’ নিরুপমা হেসে বলেছিল, ‘কেন, চাচা? ভূত আছে নাকি?’ বাড়িওয়ালা কথাটা ভালভাবে নেননি। রাগতস্বরে বলেছিলেন, ‘মা, এ নিয়ে আর কোনও কথা বলতে চাই না। খবরদার, এই বাথরুমে কাউকে ঢুকতে দেবে না।’ আমার মেয়েটা একটু জেদি ধরনের, জানো তো। ওর মধ্যে জেদ চেপে গেল। বাড়িওয়ালা চলে যাওয়ার পর সে চেঁচিয়ে বলল, ‘এইসব কুসংস্কারের জন্য দেশ এখনও পিছিয়ে আছে। আরে, ওয়াশরুম নিয়ে এত ভয়ের কী আছে? আমি এই তালা ভাঙব। নিজের রুমে ওয়াশরুম থাকতে অন্য রুমে যেতে পারব না।’ আমি বললাম, ‘মা, বাড়িওয়ালা যখন নিষেধ করেছেন, তখন থাক না। আরও দুইটা বাথরুম আছে তো।’ নিরুপমা বলল, ‘না, বাবা। আমি এই ওয়াশরুমই ইউজ করব।’ ও তালাটা ভেঙে ফেলল। ঝকঝকে-তকতকে একটা বাথরুম। দেখে মনেই হয় না যে দীর্ঘদিন কেউ এটা ব্যবহার করেনি। পরিষ্কার করার প্রয়োজন ছিল না, তবু বাথরুমটা আবার পরিষ্কার করল নিরুপমা। নতুন লাইটও লাগাল। কয়েকদিন পেরিয়ে গেল। আমি বিষয়টা এত বেশি গুরুত্ব দিইনি। গত পরশু রাতে নিরুপমা বাথরুমে যাওয়ার পর ভয়াবহ কিছু কাণ্ড ঘটেছে।’
দিপু আঁতকে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে, চাচা?’
‘কী ঘটেছিল নিরুপমা আমাদের সব বলেছে। তবে আমি চাই তুমি আবার ওর মুখ থেকে সব শোনো। পারলে আমার মেয়েটাকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো, বাবা। যাও, নিরুপমা রুমেই আছে।’
নিরুপমা তার রুমে শুয়ে ছিল। দিপু দরজায় নক করল। অনুমতি চাইল, ‘আসব?’
নিরুপমা বলল, ‘এসো, দিপু।’
দিপু ওর বিছানার পাশের চেয়ারে বসল। হাসিমুখে বলল, ‘কেমন আছ? অসুস্থ নাকি?’
‘হ্যাঁ। আমি অসুস্থ।’ নিরুপমার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। জবুথুবু হয়ে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে শীত লাগছে তার।
দিপু কৌতুকের সুরে বলল, ‘চাচা বললেন, তুমি নাকি বাথরুমে গিয়ে ভয় পেয়েছ?’
‘তুমি মজা পাচ্ছ?’ আহত গলায় নিরুপমার প্রশ্ন।
দিপু যেন সংবিৎ ফিরে পেল। মাথাটা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বলল, ‘না। না। আমি মজা করে কিছু বলিনি। আসলে পরিস্থিতিটা হালকা করার জন্য এমন সুরে কথা বলছিলাম। সরি।’
নিরুপমা চোখ বন্ধ করল। মনে হলো, তাকিয়ে থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে। দিপুর নজর গেল বাথরুমটার দিকে। সেটার দরজায় একটা নতুন তালা ঝুলছে।
দিপু নিচু গলায় বলল, ‘আমাকে সবকিছু বলবে, প্লিজ?’
নিরুপমা চাদরটা ভালভাবে শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘বলব। তোমাকে যে সব বলতেই হবে।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘সেদিন ওয়াশরুমে ঢোকার পর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, অনুভব করছিলাম কিছু একটা ঠিক নেই। বেসিনের আয়নার দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল। অজানা ভয় তখন আমাকে জেঁকে ধরেছিল, মনে হচ্ছিল আয়নার দিকে তাকিয়ে অন্য কারও মুখ দেখতে পাব। নাহ, তেমন কিছু ঘটেনি। আয়নার মধ্যে আমার মুখই দেখেছিলাম। এরপর শাওয়ার চালু করেছিলাম। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছিলাম। তাই ঠাণ্ডা পানিতে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছিল। কিছু সময় পার হওয়ার পর, আমার অস্বস্তিটা বাড়ল। মনে হলো, কেউ আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে পিছনে তাকালাম, কিন্তু পিছনে কেউ ছিল না। শাওয়ারের দিকে নজর গেল আমার। পানির বেগ ঠিকই ছিল। কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’
‘পানি অসম্ভব ময়লা ছিল। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পানির সাথে সাদা-সাদা ছোট টুকরো চলে এসেছে, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সাদা টুকরোগুলো হাতে নিয়ে বুঝলাম, ওগুলো…’ নিরুপমা চোখ ঢেকে ফেলল।
‘ওগুলো কী ছিল?’
‘আমি বলতে পারব না। ওহ…আমি বলতে পারব না।’
‘প্লিজ, নিরুপমা, বলো।’
‘ওগুলো…ওগুলো…মাংসের টুকরো ছিল।’
‘ওহ, মাই গড। কী বলছ এসব?’
‘হ্যাঁ। আমার পুরো শরীর যেন ঘিনঘিন করে উঠল। মনে হলো পালিয়ে আসি সেখান থেকে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ পানির রং বদলে গেল। পানি ক্রমেই লাল হয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম ওগুলো পানি নয়, রক্ত। এতক্ষণ কি তা হলে রক্ত আর মাংস দিয়ে গোসল করেছি? শাওয়ার বন্ধ করলাম আমি। কিন্তু কোনও লাভ হলো না। আগের মতই চলতে লাগল। এমন সময় মনে হলো কমোডের মধ্য থেকে কেউ শব্দ করছে। প্রথমে মৃদুস্বরে, এরপর শব্দের গতি ক্রমেই তীব্র হলো। আমি ধীরে-ধীরে কমোডের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কাঁপা হাতে কমোডের ঢাকনা তুলেছিলাম। এরপর নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ভয়ে আর্তচিৎকার দিয়েছিলাম।’ হু-হু করে কেঁদে উঠল নিরুপমা।
‘নিরুপমা, কেঁদো না। শক্ত হও। সবকিছু বলো আমাকে। কমোডের ঢাকনা উঠিয়ে কী দেখতে পেয়েছিলে?’
‘আমি দেখলাম কমোডের মধ্যে একটা কাটা হাত। কিন্তু হাতে একটাও আঙুল নেই। আমি আর দেরি করিনি। দৌড়ে দরজার কাছে চলে গিয়েছি। প্রবল শক্তিতে দরজা খোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আতঙ্কের সাথে লক্ষ করলাম, দরজা খুলতে পারছি না। মনে হচ্ছিল দ্রজা জ্যাম হয়ে গেছে। এমন সময় একটা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। তখন বিকালের আলো ভেন্টিলেটার দিয়ে পুরো ওয়াশরুমে ঢুকছিল। হঠাৎ আলোর পথে যেন এক রাশ অন্ধকার বাধা হয়ে এল। পুরো ওয়াশরুম ক্রমেই অন্ধকার হতে লাগল। পরিবেশটাও আশ্চর্য নীরব হয়ে উঠেছিল। শাওয়ারও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গোঙানির শব্দটা আবার শুনতে পেয়েছিলাম। আমি কাঁপতে-কাঁপতে বললাম, ‘কে-কে?’ কেউ একজন মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল। আমি শব্দের উৎস খোঁজার জন্য এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছিল, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। হঠাৎ ওয়াশরুমের উপরের দিকে নজর গেল আমার। উপরের দৃশ্য দেখে আমি যেন পাথরের মত জমে গিয়েছিলাম।’
‘কী ছিল সেখানে?’ প্রশ্ন করল দিপু।
একজন, মানে একটা মেয়ে সেখানে ঝুলছিল। অনেকটা বাদুড়ের মত। তার একটা হাত নেই। বুঝতে পারলাম এই মেয়েটাই এতক্ষণ শব্দ করছিল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে-যেতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। মেয়েটি দেয়াল থেকে নীচে নেমে এল। এমন বিশ্রী চেহারার মানুষ আমি আগে কখনও দেখিনি। চোখের মণি সাদা রঙের, মাথায় একটাও চুল নেই, আর কালো জিভটা ক্রমাগত নড়াচড়া করছিল। আমি এক-এক পা করে পিছনে সরে যাচ্ছিলাম, মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ভয়ে আমি কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিলাম। তার চোখের দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল আমাকে যে-কোনও সময় মেরে ফেলবে। হঠাৎ মেয়েটা আমাকে জাপটে ধরল। আমি নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে এক চুলও সরেনি। আমার পিঠে সে তার ধারাল দাঁত দিয়ে কামড় বসিয়ে দিল। মুহূর্তেই পুরো পৃথিবী আমার সামনে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। অঝোরে রক্ত ঝরছিল বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। আমি চিৎকার করে বলছিলাম, ‘ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও।’ আমার কথায় যেন ম্যাজিকের মত কাজ হয়েছিল। মেয়েটা আমাকে ছেড়ে দিল। এরপর কানের কাছে মুখ এনে কিছু কথা বলল। তারপর মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ওয়াশরুমে আবার আলো ফিরে এল। আমি দরজা আবার খোলার চেষ্টা করলাম। এবার দরজা খুলল। আমি বাইরে এসে বাবাকে ডাকলাম। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। সম্ভবত আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার দূরসম্পর্কের খালাতো বোন ডাক্তার। সে এসে আমার পিঠের ক্ষতে ড্রেসিং করে দিয়েছিল। এরপর বাবা ওয়াশরুমে একটা বড় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন।’
দিপু বলল, ‘সেই মেয়েটা তোমাকে কানে-কানে কী বলেছিল?’
‘না। না। আমি আর কিছু বলব না।’
নিরুপমা আর কিছু বলতে চাইল না। দিপু বুঝতে পারল এসব চিন্তা করতে কষ্ট হচ্ছে ওর। নিরুপমা আদুরে গলায় বলল, ‘তুমি আমার কাছে একটু আসবে?’ দিপু চেয়ার নিয়ে নিরুপমার বিছানার কাছে চলে গেল। নিরুপমা দিপুর হাতটা শক্ত করে ধরল। দিপুর পুরো শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। নিরুপমা আগে কখনও ওর হাত ধরেনি। নিরুপমা বিড়বিড় করে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো?’
‘হ্যাঁ। বলো।’ দিপুর গলাটা কেমন যেন কেঁপে উঠল
কেন জানি আজই বলতে ইচ্ছা করছে। হয়তো এটা বলার উপযুক্ত সময় নয়। তবু আমি আজ বলব। দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে লালন করা কথাটা আজ বলব।’
‘বলো, কোনও সমস্যা নেই।’ দিপুর গলার কাছে কিছু একটা যেন আটকে গেছে।
‘আমি তোমাকে ভালবাসি। অনেক ভালবাসি
দিপুর মনে হলো সে ভুল শুনছে। যে কথাটা সে বহুদিন ধরে বলার চেষ্টা করছিল, সেটা নিরুপমা এত সহজে বলে দিল! দিপু স্বপ্ন দেখছে না তো? নিরুপমা এখনও ওর হাত শক্ত করে ধরে আছে। ধীরে-ধীরে বিছানায় উঠে বসল। এরপর বলল, ‘তুমি কি আমার পাশে থাকবে, দিপু?’
এত আবেগ, ভালবাসার জবাবে ওর কী বলা উচিত জানে না, এক শব্দে বলল, ‘থাকব।’
‘আমাকে ভালবাসো তো?’ অনুনয়ের সঙ্গে বলল নিরুপমা।
‘হ্যাঁ। ভালবাসি। ভালবাসি। ভালবাসি।’ আহা! কথাটা বলতে কতই না ভাল লাগছে দিপুর। মনে হচ্ছে ক্রমাগত ভালবাসি-ভালবাসি বলতেই থাকে।
এরপর হুট করেই নিরুপমা দিপুকে জড়িয়ে ধরল। হু-হু করে কেঁদে ফেলল। ‘আমাকে ফেলে যেয়ো না, দিপু। আমার সব বিপদে পাশে থেকো।’ দিপুও সুযোগটা হাতছাড়া করল না। নিরুপমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। মনে হচ্ছিল সে এই পৃথিবীতে নেই। কেন জানি মনে হচ্ছে এটা কোনও স্বপ্নদৃশ্য।
তিন
নিরুপমা ফোন করে ওদের বাসায় যেতে বলল দিপুকে। আজ অন্য পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সব বাদ দিয়ে সেলিম চাচাদের বাসার দিকে রওনা দিল দিপু।
নিরুপমাকে আজ খুব খুশি-খুশি লাগছে। দিপুকে সরাসরি নিজের বেডরুমে নিয়ে গেল। সেলিম চাচা আর নিগার চাচী বিষয়টা নিয়ে কিছু মনে করবেন কি না, এই ভয় হচ্ছিল ওর। কিন্তু নিরুপমার মধ্যে কোনও ভ্রুক্ষেপ লক্ষ করল না। নিরুপমা ওখানেই থেমে থাকল না। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দিপু লাফিয়ে উঠে বলল, ‘দরজা বন্ধ করছ কেন?’
‘হা-হা। ভয় পাচ্ছ কেন, বোকা ছেলে? একটু আরাম করে গল্প করতে চাই তোমার সাথে, এর বেশি কিছু না।’
‘চাচা-চাচী যদি কিছু মনে করেন?’
‘বাবা-মা কিছুই মনে করবেন না, আমি তাঁদের সব খুলে বলেছি।’
‘বলো কী? কী সর্বনাশ!’
‘সর্বনাশের কিছু নেই। আমি তাঁদের বলেছি দ্রুত আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। তাঁরাও সম্ভবত মনে-মনে এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। তোমার বাবা- মা’র সাথে প্রাথমিক কথাও নাকি হয়ে গেছে।’
‘আম্মা-আব্বা তো আমাকে কিছু বলেননি!’ বিস্মিত গলায় বলল দিপু।
‘হয়তো কথা আর একটু এগোলে বলবেন।’
‘তুমি এত দ্রুত কীভাবে সব ম্যানেজ করলে?’
‘হা-হা। আমার কাছে জাদু আছে,’ রহস্যমাখা গলায় নিরুপমা বলল।
আজ দিপু নিজেই নিরুপমাকে আলিঙ্গন করল। নিরুপমা দিপুর গালে একটা চুমু এঁকে দিল। ওরা অনেক গল্প করল। ভবিষ্যৎ স্বপ্নের গল্প, ভালবাসার গল্প, গল্প যেন শেষই হয় না। নিরুপমা হঠাৎ লাজুক গলায় বলল, ‘তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে ইচ্ছা করছে।’
‘কী?’
‘সেদিন মেয়েটা পিঠের যে জায়গাটায় কামড় দিয়েছিল, সেই জায়গাটা।’ দিপুর শরীরের ভিতর দিয়ে আলোড়ন বয়ে গেল। এত সৌভাগ্য কি ওর হবে? দিপু মাথা নাড়ল। ‘হ্যাঁ। আমি দেখতে চাই।’
‘নাও। জামার পিছন দিকের বোতাম দুটো খোলো,’ নিরুপমা মাথা নিচু করে বলল।
দিপু লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল। এগোনোর সাহস পাচ্ছিল না। নিরুপমা হেসে বলল, ‘থাক। এত লজ্জা পেতে হবে না। এই বিষয়টা আমাদের বাসর রাতের জন্য তোলা রইল।’
চার
সবকিছু ভালই চলছিল। দ্রুত একটা ঘরোয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে নিরুপমা আর দিপুর বিয়ে হবে। কিন্তু দুঃস্বপ্নের মত আবার বাথরুমের সেই ঘটনাগুলো সামনে চলে এল। এখনও সেই ঘটনার রেশ নিরুপমাকে টানতে হচ্ছে। আজ সেলিম চাচাদের বাসায় ও আসার পর থেকেই নিরুপমা আকুল হয়ে কাঁদছে। দিপুর অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে, কী যে বিপদে পড়েছে মেয়েটা। সেলিম চাচা নিরুপমার ঘরের ওয়াশরুমে একটা বড় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাথরুমের সেই মেয়েটা প্রায়ই নিরুপমার স্বপ্নে দেখা দিচ্ছে। বারবার বলছে যে খুব তাড়াতাড়ি নিরুপমার জীবন শেষ করে দেবে। খুব কষ্ট দিয়ে মারবে নিরুপমাকে। তার অনেক দিনের খিদে। নিরুপমাকে দিয়ে তার খিদে মেটাবে।
সেলিম চাচা বাড়ি বদলের চিন্তা করছেন, কিন্তু নিরুপমা বলেছে বাড়ি বদলে কোনও কাজ হবে না। বরং বাড়ি বদলানোর চেষ্টা করলে মেয়েটা তখনই তাকে মেরে ফেলবে।
দিপুর মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ক্রোধের ভাব জেগে উঠল। নিরুপমাকে রক্ষা করতেই হবে। আগে এই বাসার বাথরুমের ইতিহাসটা জানা দরকার। দিপু সেলিম চাচার সঙ্গে কথা বলে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে গেল।
সেলিম চাচাদের বাড়িওয়ালা নবির শেখ বয়স্ক মানুষ। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। কথাবার্তা বলেন স্পষ্ট গলায়। তিনি দিপুকে দেখে কথা বলার তেমন কোনও আগ্রহ দেখালেন না। কেমন যেন সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। উঁচু গলায় বললেন, ‘আমি তো বাড়ি ভাড়া দেয়ার সময়েই বলেছিলাম ওই বাথরুমে কেউ ঢুকবেন না। আমার কথা শুনেছেন?’
দিপু চুপ করে রইল।
নবির শেখ আবার বললেন, ‘নিরুপমা মেয়েটা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সাহস খুব দরকারী একটা জিনিস। তবে মুরব্বীদের উপদেশ মেনে চলাও সমান দরকারী। ছোট ভুলের বড় শাস্তি পাবে মেয়েটা।’
দিপু জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এই বাথরুমের রহস্যটা কী?’
নবির শেখ উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। দিপু তাগাদা দিয়ে বলল, ‘আমাদের সবকিছু জানা প্রয়োজন। এর সাথে নিরুপমার জীবন-মরণ জড়িত।’
নবির শেখ দিপুর দিকে একটু ঝুঁকে বললেন, ‘আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে ওই বাথরুমে এলিনা নামে একটা মেয়ে মারা গিয়েছিল।’
‘কীভাবে মারা গিয়েছিল?’
‘তার স্বামী তাকে মেরে ফেলেছিল। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, সে মেয়েটার একটা হাতও কেটে ফেলেছিল। আর পুরো শরীরটা খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে বিকৃত করেছিল। পরে অবশ্য এলিনার স্বামীরও ফাঁসি হয়েছিল। তখন আমার বাবা বেঁচে ছিলেন। তিনি ওই বাথরুমটা তালাবদ্ধ করে রাখেন। তিনি দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন, এই বাথরুমটা ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। এখানে এলিনার আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই কাউকে বাড়ি ভাড়া দেয়ার আগে বাবা বলতেন, কোনওক্রমেই বাথরুমটা খোলা যাবে না। কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ খুব বেশি। তাই অনেক ভাড়াটিয়া আমাদের নিষেধ শোনেনি, তার ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। এ পর্যন্ত পাঁচজন ওই বাথরুমে মারা গেছে। প্রতিবারই থানা-পুলিশ হয়েছে। কিন্তু কাকে ধরবে পুলিশ, মৃত মানুষকে তো আর গ্রেফতার করা যায় না।’
‘যারা মারা গিয়েছিল তাদের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল কিছু জানা গিয়েছিল?’
‘প্রত্যেকেরই শরীরের খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে। কেউ যেন তাদের খুবলে খুবলে খেয়েছে। কিছু হাড়, কিছু মাংস আর রক্ত এদিক-সেদিক পড়ে ছিল। এমন বীভৎস দৃশ্য-কী আর বলব, আমার মত শক্ত মনের মানুষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই গত সাত বছর আমি তিনতলাটা ভাড়া দিইনি। এবার একটু আর্থিক টানাটানির জন্য সেলিম সাহেবের কাছে বাসাটা ভাড়া দিয়েছিলাম। তাঁদের কঠিনভাবে নিষেধ করেছিলাম, কোনওক্রমেই যেন বাথরুমের দরজাটা খোলা না হয়। কিন্তু নিরুপমা মেয়েটা আমার কথা শোনেনি।’
নবির শেখ চিন্তিত গলায় আরও বললেন, ‘বিষয়টা খুবই রহস্যজনক। আজ পর্যন্ত কোনও মানুষ এলিনার কাছ থেকে জীবিত ফিরতে পারেনি। নিরুপমাই প্রথম যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।’
‘হ্যাঁ। নিরুপমা ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেছে, কিন্তু এখন এলিনা নামের মেয়েটা বলছে, নিরুপমাকে সে মেরে ফেলবে। এখন আমরা কী করতে পারি?’
‘বাসা ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আর কোনও হুজুর ডেকে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, নবির শেখ জবাব দিলেন।
‘কিন্তু এলিনা স্বপ্নে বলেছে, বাসা ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেই মুহূর্তে নিরুপমাকে মেরে ফেলবে।’
‘এখন পর্যন্ত নিরুপমা বেঁচে আছে এটাই আশ্চর্যের।’ চশমাটা খুলে ফেললেন নবির শেখ।
‘আচ্ছা, যে পাঁচজন মারা গিয়েছিল তাদের কতজন নারী আর কতজন পুরুষ?’ দিপু জিজ্ঞেস করল।
নবির শেখের মুখটা আরও একটু গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘তাদের পাঁচজনই পুরুষ ছিল। পুরুষদের কৌতূহল মনে হয় একটু বেশিই থাকে।’
‘আচ্ছা, আপনি কখনও ওই বাথরুমে ঢুকেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। প্রতিটা মৃত্যুর পর পুলিশের সাথে আমিও ঢুকেছিলাম। মৃতদেহগুলো বাথরুমেই পড়ে ছিল। তবে আমার চোখে বাথরুমের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েনি।’
‘আপনি বাথরুমটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেননি কেন?’
‘এটা ভুলই হয়েছিল। আসলে সাত বছর বাড়িটা ভাড়া দেয়া হয়নি, তাই ভেবেছিলাম ওই অশুভ জিনিসটার সম্মুখীন হয়তো আর হতে হবে না। কিন্তু…এবার বাথরুমটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেব।’
পাঁচ
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কি বিয়ের কথা চিন্তা করা যায়? কিন্তু দুই পরিবার ওদের বিয়ে ঠিক করল। দিপুর আম্মা-আব্বাও পুরো বিষয়টা জানতে পেরেছেন। তাঁরা মনে করছেন বিয়ের পর নিরুপমা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি মিলবে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর নিরুপমা এলিনাকে আর স্বপ্নেও দেখেনি।
দিপু এখন প্রায় প্রতিদিনই নিরুপমাদের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দিপুকে দেখে নিরুপমা কেন জানি আগের মত খুশি হয় না। তার চোখের নীচে কালি পড়েছে, ব্রণে ভরে গেছে মুখ। আর মাথার চুলগুলো জট পাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে নিজের শরীরের প্রতি কোনও যত্ন নিচ্ছে না। দিপু নিরুপমার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘এ কী অবস্থা তোমার?’
একদিন নিরুপমা কাতর গলায় বলল, ‘আমাকে তুমি মাফ করে দিয়ো।’,’অ্যাই, বোকা মেয়ে, মাফ চাইছ কেন? তুমি কী অপরাধ করেছ?’
নিরুপমা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল, ‘মাফ চাইতে ইচ্ছা হলো, তাই মাফ চাইলাম।’
দিপু বুঝতে পারল নিরুপমার মন থেকে ভয়টা এখনও দূর হয়নি। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি তো কয়েকদিন পরেই সবসময় তোমার সাথে-সাথে থাকব, দেখি কে তোমার ক্ষতি করে।’
‘হুম।’ বোঝা যাচ্ছে দিপুর কথায় নিরুপমা তেমন ভরসা করতে পারেনি।
দিপু কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু বিয়ের রাতে তোমার পিঠের সেই ক্ষতটা দেখব, মনে আছে তো?’
নিরুপমা এবার হাসল। দিপু দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, ‘আর ওইদিন…’
‘ওইদিন কী?’
‘হা-হা। আরও অনেক কিছু করব।’
কেন জানি নিরুপমা আবার কাঁদতে লাগল। বেচারী বড্ড চিন্তায় আছে। দিপু এই মেয়েটাকে কিছুতেই আর কষ্ট পেতে দেবে না, কিছুতেই না।
ছয়
একটা ছোট ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিরুপমা আর দিপুর বিয়ে হলো। অল্প কিছু কাছের মানুষকে দাওয়াত দেয়া হলো। পরবর্তীতে দুই পরিবারের যৌথ উদ্যোগে একটা বড় অনুষ্ঠান করা হবে। বিয়ের রাত। দিপু নিরুপমাদের বাসায়ই থাকবে। পরদিন দুপুরের দিকে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
বাসর রাতে দিপু আর নিরুপমা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশ দেরি হয়েছে, দু’জনেই প্রচণ্ড ক্লান্ত। খুব ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু বাসর রাতে সম্ভবত বোকারাই শুধু ঘুমায়। তাই জেগে রইল ওরা। বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিরুপমা ক্রমাগত কেঁদেছে। এখন অবশ্য শান্তমুখে বসে আছে। তবে চেহারায় কেমন যেন তীব্র বেদনার ছাপও দেখা যাচ্ছে। বিয়ের সময়ে সব মেয়েরই মনে হয় এমন হয়।
দিপু বিছানায় বসতেই নিরুপমা বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিয়ো, দিপু।
‘তোমার কী হয়েছে বলো তো। এত মাফ চাইছ কেন? তুমি মারা যাবে নাকি? যেভাবে মাফ চাইছ।’ দিপু জোরে হেসে উঠল।
‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট। তুমি বুঝবে না,’ হতাশামাখা কণ্ঠ নিরুপমার।
দিপু নিরুপমাকে শক্ত করে ধরে রইল। আজ সারারাত ওকে দিপু ভালবাসবে, ওর সবটুকু কষ্ট নিজের করে নেবে। ও বলল, ‘পিঠের সেই ক্ষতটা দেখতে চাই। আজ আমি লজ্জা পাব না। ঠিক আছে?’
এমন সময় বাথরুমের দরজায় মৃদু শব্দ হলো। দিপু চমকে উঠে লাইট জ্বালল। আশ্চর্য ব্যাপার, বাথরুমের দরজায় তালা নেই। শুধু একটা ছিটকিনি দেয়া। দিপু নিরুপমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আবার এই বাথরুমের তালা খুলেছ?’
মাথা নিচু করে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘খবরদার তুমি আর বাথরুমে ঢুকবে না কখনও।’
‘ঠিক আছে,’ নিরুপমা বলল। ‘তুমি একটু আমার সাথে এসো।’
‘কোথায়?’
নিরুপমা উঠে দাঁড়াল। বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দিপু পিছু- পিছু গেল। নিরুপমা বাথরুমের ছিটকিনিটা খুলে ফেলল। দিপু আঁতকে উঠে বলল, ‘এ কী করছ? বাথরুমে ঢুকছ কেন?’ সে দৌড়ে গিয়ে নিরুপমার হাত চেপে ধরল।
ততক্ষণে দরজাটা পুরো খুলে ফেলেছে। ভিতরটা তীব্র অন্ধকার।
‘এদিকে এসো, দিপু!’ নিরুপমার কণ্ঠে আহ্বান।
‘নিরুপমা, তুমি কী করছ?’
‘আমার কাছে এসো।’ নিরুপমার গলায় কাতরতা।
দিপু নিরুপমার আরও কাছে গেল।
নিরুপমা বলল, ‘বাথরুমের ভিতরটা একটু দেখো!’
‘কী দেখব?’
‘তোমার দেখা প্রয়োজন।’
দিপুর সবকিছু এলোমেলো লাগছে। এসব কী করছে নিরুপমা?
দিপু বাথরুমের দরজা দিয়ে খানিকটা ভিতরে ঢুকল। সেই মুহূর্তে নিরুপমা দিপুকে সজোরে ধাক্কা দিল। দিপু তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে গেল। নিরুপমা বাইরে থেকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। অন্ধকার, ভয়ঙ্কর অন্ধকারে দিপু ক্রমশ তলিয়ে যেতে লাগল।
দিপু উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মত দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। ‘নিরুপমা, নি- নিরুপমা। দরজা-দরজা খোলো।’
নিরুপমার কথা শুনতে পাচ্ছে দিপু। কাঁদতে-কাঁদতে নিরুপমা বলছে, ‘আমাকে মাফ করে দিয়ো, দিপু। আমি তোমার কোনও কথা শুনতে পাচ্ছি না। বাথরুমের ভিতরের শব্দ বাইরে থেকে শোনা যায় না।’
একটু থেমে আবার বলল, ‘এলিনা সেদিন আমাকে কী বলেছিল তোমাকে বলা হয়নি। এলিনা সেদিন আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আর বলেছিল, সে কোনও পুরুষকে দিয়ে তার খিদে মেটাতে চায়। আমাকে ত্রিশ দিন সময় দিয়েছিল। এর মধ্যে আমার ভালবাসার মানুষটিকে ওকে দিতে হবে। নয়তো আমাকে বাঁচতে দেবে না। বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে শেষ করবে। তার সব আক্রোশ পুরুষদের প্রতি। সাত বছর ধরে অপেক্ষায় আছে এলিনা। আমি ওর কথায় রাজি হয়েছিলাম। এরপর বাথরুম থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। তবু নিজেকে বাঁচানোর জন্য কাজটা করতে হয়েছে আমাকে। আমি বাবাকে দ্রুত বিয়ের আয়োজন করতে বলি। অবশ্য তাঁকেও এই বিষয়টা খুলে বলা হয়নি। এদিকে এলিনা প্রায়ই আমার স্বপ্নে আসে। আমাকে সবকিছু বারবার মনে করিয়ে দেয়। এই কারণেই আমি আগেভাগে বারবার তোমার কাছে মাফ চেয়েছি। একটু পর তোমার খণ্ডিত লাশটা বাথরুমে খুঁজে পাওয়া যাবে। সবাই ভাববে তুমি বাথরুমে ঢুকেছিলে, তাই এই বিপত্তি ঘটেছে। এখানে আমার দোষের কথা কারও মাথায়ও আসবে না।’
দিপু আর কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। সম্ভবত নিরুপমার আর কিছু বলার নেই। দিপু চিৎকার করছে, ‘বাঁচাও। কেউ আমাকে বাঁচাও।’
বাথরুমের মধ্যে একটা পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। কেউ পা টেনে-টেনে হাঁটছে। বুঝতে পারল এলিনা তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাঁপা গলায় বলল দিপু, ‘আ-আ-আমাকে মেরো না।’
এলিনার গরম নিঃশ্বাস দিপুর শরীরে লাগছে।
ভাঙা গলায় এলিনা বলল, ‘খিদে লেগেছে। কতদিন পুরুষের মাংস খাইনি। অ-অ-অনেক দিন-ন-ন্।’
এলিনা দিপুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। দিপু হাল ছেড়ে দিল। দিপু জানে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে ভয়ঙ্কর বোধহয় আর কিছু নেই।
দিপু নিরুপমার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। নিরুপমা বলছে, ‘বাবা, ও, বাবা, দিপু বাথরুমে ঢুকেছে, বাবা, আমি অনেক নিষেধ করেছিলাম, তবু ঢুকেছে।’
সেলিম চাচা বলছেন, ‘এ কী বলছিস? চিন্তা করিস না, মা। আমি দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করছি।’
পুরো বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। দরজা ভাঙার আয়োজন চলছে। এলিনা দিপুর বুকের উপর উঠে বসেছে। দিপু জানে, সেলিম চাচা বাথরুমের দরজা ভাঙার আগেই মেয়েটা তার খিদে মিটিয়ে ফেলবে।