সাধনা – ১৫

পনেরো

বড় রাস্তায় এসে রিকশা নিল আনোয়ার। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বাবা কী করেন?’

কিছুই বলল না ছেলেটা। তাকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছে আনোয়ার, মহা আনন্দে আইসক্রিম খাচ্ছে সে।

‘তোমার বাসা কোন্ এলাকায়?’ আবার প্রশ্ন করল আনোয়ার।

এবারও জবাব দিল না ছেলেটা। চোখে কোনও দুশ্চিন্তা বা উত্তেজনার ছাপ নেই।

বাসায় পৌছে গেল আনোয়ার। পথিমধ্যে নতুন জামা ও প্যান্ট কিনে দিয়েছে ছেলেটাকে। এখন তাকে কোনওভাবেই পথশিশু বলে মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে কোনও ধনী পরিবারের সন্তান।

‘তোমার নামটা বলবে?’ বলল আনোয়ার।

ছেলেটা স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার নাম রাইয়ান।’

‘রাইয়ান শব্দের মানে জানো?’

‘বেহেশতের একটা দরজার নাম রাইয়ান।’

‘ও।’ বিস্মিত হয়েছে আনোয়ার। বস্তির ছেলের নাম এত আধুনিক হবে? কথাবার্তাও শুদ্ধ, স্বাভাবিক। কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে।

রাইয়ানকে আরও কিছু প্রশ্ন করল আনোয়ার। কিন্তু জবাব দিল না ছেলেটা। পরিবারের অন্যরা তিনতলায় থাকলেও, ছাদের চিলেকোঠার রুমে থাকতে পছন্দ করে আনোয়ার। রাইয়ানকে বলা সত্ত্বেও সে তিনতলায় ঘুমাতে রাজি হলো না। সে চায় আনোয়ারের সাথে ঘুমাতে।

বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়ার কিছুক্ষণের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ল রাইয়ান। কিন্তু চোখে ঘুম নেই আনোয়ারের। মনে অনেক প্রশ্ন। কাগজ-কলম নিয়ে লেখার তেমন অভ্যাস নেই ওর, তাই মনে-মনেই সাজাতে থাকল কিছু প্রশ্ন-উত্তর।

প্রথম প্রশ্নঃ ছেলেটার বয়স ছয় বা সাতের বেশি হবে না। কিন্তু তার কথাবার্তার ভঙ্গি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মত। কেন?

উত্তর: হয়তো ছেলেটা নিয়মিত স্কুলে যায়। মা-বাবা গরিব হলেও কার্পণ্য করেনি ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে।

কিন্তু এই উত্তর পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য মনে হলো না ওর।

দ্বিতীয় প্রশ্ন: একটা বাচ্চা ছেলে যে পথে-পথে বড় হয়েছে, সে তার বাসার ঠিকানা জানে না, এটা কীভাবে সম্ভব? যদি ধরেই নিই, সে আসলে বাসার ঠিকানা জানে না, তবে সে নিশ্চয়ই মা-বাবার নাম বলবে বা অন্তত এলাকার নাম বলবে। এসব বলছে না কেন?

উত্তর: ছেলেটা সবই জানে। কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে।

তৃতীয় প্রশ্নঃ ছেলেটা ওর সাথে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল কেন? রাস্তায় আরও অনেক মানুষ ছিল। কিন্তু ছেলেটা তার সাথেই কেন যেতে চাইল? আর কেনই বা সে পালিয়ে গেল না?

উত্তর: কোনও উত্তর জানা নেই।

চতুর্থ প্রশ্ন: কুকুর বিষয়ক রহস্যটা কি? ওগুলো একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত যেতে বাধ্য করেছে ওকে। তারপর সেগুলোকে আর দেখা যায়নি।

উত্তর: ওগুলো সাধারণ কুকুরই ছিল। আনোয়ারকে কোথাও নিয়ে যায়নি। পুরো বিষয়টা হয়তো মনের ভুল।

পঞ্চম প্রশ্ন: আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, কিডন্যাপ করা হয়েছে বাচ্চাটাকে? উত্তর: না। এটা সঠিক নয়। সেরকম হলে ছেলেটা তার মা-বাবার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকত।

ষষ্ঠ প্রশ্নঃ ও যখন ছেলেটাকে ঘুমানো অবস্থায় দেখতে পায়, তখন তার শ্বাস- প্রশ্বাসের কোনও লক্ষণ ছিল না। এটা কীভাবে সম্ভব?

উত্তর: ছেলেটার দেহ সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। তাই শ্বাস- প্রশ্বাসের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। আবার এমনও হতে পারে, ছেলেটাকে কোনও ঘুমের ওষুধ বা অন্য কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। অনেক ওষুধ আছে, যার প্রভাবে ধীর হয়ে যায় মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি 1

সপ্তম প্রশ্ন: মহিলাটা বাচ্চা ফেলে পালাল কেন?

উত্তর: এর সহজ উত্তর হচ্ছে, সে প্রতারক। সত্যিকারের মা কখনও শত বিপদেও সন্তানকে ফেলে পালিয়ে যায় না।

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়েই রাইয়ানের দিকে তাকাল আনোয়ার। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। ঘুমের ভিতরে হঠাৎ কিছু একটা বলে ফেলল।

কথাটা শুনে চমকে উঠল আনোয়ার।

রাইয়ান বিড়বিড় করে বলছে: ‘Revenge! I want revenge!’

এ কথার মানে কী?

সারারাত ঘুম হলো না আনোয়ারের, পায়চারি করতে লাগল ছাদে।

ষোলো

সকালে নাস্তা করে তিনতলায় বসে কার্টুন দেখতে লাগল রাইয়ান। এই মুহূর্তে চাকর-বাকর ছাড়া অন্য কেউ নেই আনোয়ারদের বাসায়। এই মুহূর্তে ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুরে আছে তার বাবা। আর অনেক আগেই মাকে হারিয়েছে সে।

রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল আনোয়ার, ‘চলো, তোমার মা-বাবাকে খুঁজতে বের হব।’

‘আমি যাব না।’

‘মানে? তুমি তোমার মা-বাবার কাছে যেতে চাও না?’

‘না।’

‘কেন?’

কিছু না বলে কঠোর চোখে দেখল রাইয়ান। এত ছোট বাচ্চা এভাবে তাকাতে পারে, চিন্তাতেও ছিল না আনোয়ারের। কেন জানি চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলো। রাইয়ান তার বাসায় থাকায় বিশেষ কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। তবে তার মা-বাবাকে খুঁজে বের করতে হবে।

কেন ছেলেটা তার মা-বাবার কাছে যেতে চায় না?

তারা কি কোনও অত্যাচার করে?

কী জানি!

আগে খুঁজে বের করতে হবে রাইয়ানকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া ওই মহিলাকে। কিন্তু দুই কোটি মানুষের মস্ত ঢাকা শহরে কোথায় খুঁজে পাবে তাকে?

অবশ্য চেহারা ভালভাবেই মনে আছে। ক্যাপটা মাথায় চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল আনোয়ার। বাড়ির বাবুর্চিকে বলে দিয়েছে, ঠিকমত দেখে রাখতে বাচ্চাটিকে।

রাইয়ানকে ফেলে যাওয়া ওই মহিলা বা মা-র সাথে নিজের কথোপকথন মনে করল আনোয়ার। মহিলা বলেছিল, তারা থাকে কাছের কোনও বস্তিতে। গত রাতে রাইয়ানকে পেয়েছে বনানীর সরু এক রাস্তায়। সেক্ষেত্রে খোঁজ নেয়া যেতে পারে বনানী বস্তিতে। কিন্তু তার আগে বনানীর সেই রাস্তায় আরও একবার যাওয়া দরকার। হয়তো ওই মহিলা সম্পর্কে জরুরি কোনও তথ্য দিতে পারবে ওখানকার মানুষ।

অনেক খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করল আনোয়ার, কিন্তু নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারল না কেউ। অগত্যা সে ঠিক করল, ঢুঁ দেবে বনানী বস্তিতে। ওখানে খোঁজ নেয়ার কাজটাও সহজ হলো না। পদে-পদে বিভিন্ন আপত্তিকর কথা শুনতে হলো আনোয়ারকে। সবাই স্পষ্টভাবে বলল, রাইয়ানের মা নামে কেউ এখানে থাকে না। কেউ কেউ উচ্চারণই করতে পারল না রাইয়ানের নাম, বলল রায়হান। রাইয়ানের মা-র চেহারার বর্ণনাও দিল আনোয়ার, কিন্তু কাজ হলো না তাতেও। অনেকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল তার দিকে! একজন তো বলেই বসল, ‘মেয়েছেলে দিয়া আপনার কাম কী?’

এসব কথায় দমল না আনোয়ার। খুঁজে বের করতেই হবে রাইয়ানের মা- বাবাকে।

ঢাকার আরও কয়েকটি বস্তিতে খোঁজ নিল আনোয়ার, কিন্তু ফলাফল শূন্য। ক্লান্ত হয়ে রাতে বাসায় ফিরল ও।

আনোয়ারকে দেখে দৌড়ে এল বাড়ির কেয়ারটেকার, বাবুর্চি ও কাজের মেয়ে।

‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।

মাথা নিচু করে বলল বাবুর্চি, ‘আপনি যে বাচ্চাটাকে রেখে গিয়েছিলেন, তাকে খুঁজে পাচ্ছি না!

‘কতক্ষণ ধরে খুঁজে পাচ্ছ না?’ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল আনোয়ার। ‘ঘণ্টা দেড়েক হয়েছে।’

‘বাসার সব জায়গায় দেখেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘মেইনগেট বন্ধ ছিল?’

‘হ্যাঁ, ছিল।’

‘ছাদে যায়নি তো?’

‘ছাদ তো আপনি তালা দিয়ে গেছেন। যাওয়ার উপায় নেই।’

রাগে মুখে থুতু জমল আনোয়ারের। ইচ্ছা হলো সবগুলোর মুখে চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে দমন করতে হলো ইচ্ছেটাকে। উধাও হয়ে যেতে পারে না একটা বাচ্চা। আনোয়ার ভাবল, আগামীকাল সকাল পর্যন্ত আশপাশে খুঁজে দেখবে, তারপর জানাবে পুলিসে। এতে বাড়তি কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, কিন্তু উপায় নেই।

বাইরে রাইয়ানকে খুঁজতে যাওয়ার আগে ছাদ ঘুরে দেখতে চাইল আনোয়ার। অবাক হয়ে লক্ষ করল, ছাদের দরজা খোলা, ওদিকে অন্ধকার। কেন জানি, মনে হলো অন্ধকারটা অন্য রাতের চেয়ে একটু বেশি গাঢ়! আস্তে-আস্তে এগিয়ে গেল আনোয়ার। কাঁপা গলায় বলল, ‘রাইয়ান।’

জবাব দিল না কেউ।

আবার বলল আনোয়ার, ‘রাইয়ান।’

অস্ফুট স্বরে কেউ বলল, ‘উঁ?’

‘রাইয়ান, তুমি কোথায়?’

‘তোমার ঘরে।’

আনোয়ার দেখল ছাদের চিলেকোঠার ঘরের দরজা খোলা, তালা নেই। অন্ধকার দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ও, ‘তুমি এখানে কী করছ? ঢুকলে কীভাবে?’

জোরে হাসল রাইয়ান।

শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল আনোয়ারের। রুমের বাতি জ্বালতে গিয়ে দেখল, নষ্ট হয়ে গেছে বাতি।

‘রাইয়ান, তুমি কোথায়? আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’

‘চোখ থাকতেও দেখতে পাচ্ছ না?’

‘না। খুব অন্ধকার।’

‘হা-হা-হা!’ হাসিটা যেন ছড়িয়ে পড়ল বহুদূরে।

‘হাসছ কেন?’

‘অন্ধকার ভয় লাগে তোমার?’

‘তুমি এসব কী বলছ?’

‘এবার বাতি জ্বালো। বাতি জ্বলবে।’

আবার সুইচ টিপল আনোয়ার। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল ঘরের বাতি। কিন্তু ঘরে নেই রাইয়ান!

তা হলে এতক্ষণ কার সাথে কথা বলল? দৌড়ে বেরিয়ে এসে আনোয়ার দেখল, ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ান।

‘রাইয়ান,’ নরম সুরে ডাকল আনোয়ার।

পেছন ফিরে তাকাল রাইয়ান

‘তুমি…এ-এখানে কী করছ?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।

‘বাসায় ভাল লাগছিল না, তাই ছাদে এসেছি।’

‘কিন্তু ছাদে তো তালা দেয়া ছিল।’

‘আমি কোনও তালা দেখতে পাইনি।’

রাইয়ানের কথা শুনে সচকিত হলো আনোয়ার। বয়স্ক মানুষের মত কথা বলছে বাচ্চাটি। যেন কোনও শিশুর মধ্যে ঢুকে গেছে কোনও বয়স্ক মানুষ!

নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল আনোয়ার, ‘চলো, নিচে যাই।’

আপত্তি করল না রাইয়ান, হাঁটতে লাগল ধীর পায়ে।

আবারও বলল আনোয়ার, ‘তুমি নিচে যাও, আমি আসছি।’

নিচে চলে গেল রাইয়ান। নিজের রুমটা ভালভাবে দেখল আনোয়ার। নাহ্, কোনও অস্বাভাবিক কিছু নেই। এবার টর্চ হাতে ঘুরে দেখতে লাগল ছাদটা। হঠাৎ‍ কয়েকটা ধাতব জিনিস দেখল ও। সেগুলো তুলে নিল হাতে। নিজের অজান্তেই বলল, ‘ওহ, মাই গড!’

এ কথা বলার কারণ, ওর সামনে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে ছিল তালার দুটো টুকরো!

সতেরো

ধীরে-ধীরে চোখ মেলে দেখল আনোয়ার। আজ তিনতলায় ঘুমিয়েছে সে। বাসার গেস্টরুমে ছিল রাইয়ান। কাল সারারাত নানা দুঃস্বপ্ন দেখেছে আনোয়ার। সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তালা খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার কারণও বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কেউ যেন প্রবল আক্রোশে ভেঙেছে তালা। রাইয়ানের মধ্যে কি কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে? নাকি একটু বেশি-বেশি চিন্তা করছে আনোয়ার?

ঘড়িতে নয়টা ছুইছুই। রাইয়ান এখনও ঘুমাচ্ছে। উঠে পড়ল আনোয়ার আজ আবারও খুঁজতে বের হবে রাইয়ানের মা-বাবাকে। বাসার সবাইকে বলেছে, রাইয়ানের দিকে নজর রাখতে। আর আজকে কোনও তালা দেয়া হয়নি ছাদে। ফ্রেশ হয়ে রাইয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল আনোয়ার। এক ডাকেই জেগে গেল রাইয়ান, যেন আনোয়ারের জন্যই অপেক্ষা করছিল।

খাওয়ার টেবিলে বলল আনোয়ার, ‘রাইয়ান?’

‘হ্যাঁ।’

‘ঠিকঠাক বলো তো, তুমি কে? তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?’

‘আমি জানি না।’

‘তুমি না বললে আমি পুলিসের কাছে যাব। তারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।’

কোনও ভাবান্তর হলো না রাইয়ানের মধ্যে। নীরস গলায় বলল, ‘আমি না চাইলে কেউ আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।’

‘মানে?’

‘এই বাসায় আমি কিছুদিন থাকব। আমাকে জ্বালাতন করবে না।’

‘তুমি আসলে কে?’

‘তুমি আসলে কে?’ একই ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন করল রাইয়ান।

‘আমি? আমি আনোয়ার।’

‘তুমি আনোয়ার, আর আমি জানোয়ার। হা-হা!’

‘আমি তোমার সব খবরাখবর বের করব।’

‘খুবই ভাল। বের করো। আমিও সব জানতে চাই।’

খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ল আনোয়ার। ঠিক করেছে, খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে রাইয়ানের বাবাকে রমনা পার্কে। সত্যিই যদি এই ছেলের নাম রাইয়ান হয়, তার বাবার নামও ‘র’ অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যেমন রায়হান, রমজান, রহমত, রহমান। একটা পরিকল্পনা করেছে আনোয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে প্রচুর সার্ভের কাজ করেছে ও। এখন সেই সার্ভের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছে। একটা যেন-তেন প্রশ্নাবলী তৈরি করে অনানুষ্ঠানিক সেক্টরের ওপর করা যেতে পারে ভুয়া সার্ভে। অনানুষ্ঠানিক সেক্টরের উত্তরদাতা হিসাবে নিতে হবে রমনা পার্কের চা-সিগারেট বিক্রেতাদেরকে। হয়তো এর মাধ্যমেই রাইয়ানের বাবাকে খুঁজে বের করা যাবে। প্রশ্নাবলীতে মূল বিষয় যেটি থাকবে, তা হলো নাম, ঠিকানা, ছেলে কয়জন, তাদের নাম, মোবাইল নাম্বার, আয়-ব্যয় ইত্যাদি। খুব সহজ সাধারণ তথ্য। প্রতিটি মানুষকে কিছু টাকাও দিতে হবে। কারণ এমনিতে সময় নষ্ট করে সঠিক তথ্য দিতে চাইবে না কেউ।

রমনা পার্কে গিয়ে প্রথমেই এক চা বিক্রেতার সাথে খাতির করে ফেলল আনোয়ার। তার কাছ থেকে দুই কাপ চা তো নিলই, এ ছাড়া বকশিস হিসাবে দিল পঞ্চাশ টাকা। চা বিক্রেতার নাম ইলিয়াস। সে এত টাকা বকশিস পেয়ে খুশিতে হয়ে গেল আত্মহারা। আনোয়ার বলল, ‘ইলিয়াস, রমনা পার্কে কতজন চা-সিগারেট বিক্রি করে?’

‘তা, স্যর, সাত-আটজন তো হবেই।’

‘সবার নাম জানো?’

‘হ্যাঁ, জানি।’

এদের সবাইকে কখন পেতে পারি?’

‘কেন, স্যার? কী দরকার?’

‘আমি একটা সার্ভে মানে জরিপ করব। এই সবার নাম, ঠিকানা, আয়-ব্যয় নিয়ে একটু তথ্য নেব আর কী। তুমি কি সবাইকে এক জায়গায় হাজির করতে পারবে?’

‘এইডা তো, স্যর, একটু কঠিন। তবে আশা করি, আপনি বারোটার দিকে সবাইকেই পাবেন। এই সময়ে কাস্টমার থাকে না, সবাই বসে-বসে ঝিমায়।’

‘আমি সবাইকে এক শ’ টাকা করে দেব। তুমি আজ বারোটায় সবাইকে এক জায়গায় হাজির করতে পারবে?’

‘হ্যাঁ, পারুম।’

‘ঠিক আছে, এখন বাজে সাড়ে দশটা। আমি পার্কে এই বেঞ্চেই বসে থাকব। তুমি সবাইকে এখানে নিয়ে আসবে।’

‘ঠিক আছে, স্যর।’

‘দেখি আরেক কাপ চা দাও।’

আনোয়ারের চোখে চশমা, হাতে কাগজ-পত্র ও কলম। কেউ যেন সন্দেহ না করে। যদি রাইয়ানের বাবা একবার তার আসল উদ্দেশ্য টের পায়, তবে নিশ্চিত পালিয়ে যাবে।

আঠারো

দুপুর বারোটায় অবাক না হয়ে পারল না আনোয়ার, আসলেই এলেম আছে ইলিয়াসের। সে সঠিক সময়েই আনোয়ারের সামনে হাজির করল সবাইকে। কেউ-কেউ অবশ্য প্রচণ্ড বিরক্ত, সার্ভের বিষয়টি তারা ভালভাবে বোঝেনি। কিন্তু কিছু কথা বললেই এক শ’ টাকা পাবে ভেবে এসেছে।

সবার দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল আনোয়ার, ‘সবাই এসেছে? কেউ কি বাকি আছে?’

ইলিয়াস বলল, ‘না, স্যর। কেউ বাকি নাই।’

সবাইকে বিষয়টা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিল আনোয়ার। সে কিছু প্রশ্ন করবে, তার ঠিকঠাক জবাব দিতে হবে। এরপর সবাই চলে যেতে পারবে পকেটে এক শ’ টাকা পুরে।

সবাই প্রশ্ন শুনে খুব আগ্রহী হয়ে উঠল। সহজ স্বাভাবিক প্রশ্ন। নাম, ঠিকানা, ছেলে-মেয়ে, এ বিষয়ে প্রশ্ন। মোট সাতজনের সাথে কথা বলতে আনোয়ারের লাগল পঞ্চাশ মিনিট। দেখল সাতজনের চারজনই কিশোর। এখনও বিয়ে করেনি। তাই চারজনকে মনে-মনে বাতিল করে দিল আনোয়ার। বাকি তিনজন বিবাহিত। তারা হচ্ছে ইলিয়াস, কাদের এবং রইস। এই তিনজনের একজন রাইয়ানের বাবা হতে পারে। কিন্তু আনোয়ার হতাশ হয়ে লক্ষ করল, এদের কারও সন্তানের নামই রাইয়ান নয়। আবার এমনও হতে পারে, মিথ্যা বলেছে রাইয়ান। তার আসল নাম হয়তো রাইয়ান নয়। ইলিয়াস, কাদের এবং রইসকে বসিয়ে বাকিদের বিদায় করে দিল আনোয়ার। টাকা পেয়ে মহা খুশি ইলিয়াস। এই ব্যাপারে খুব উৎসাহী সে।

‘আপনাদের স্ত্রীদের সাথেও অল্প একটু কথা বলতে হবে, সে জন্যও অবশ্য টাকা দেব,’ বলল আনোয়ার।

রইস বিরক্ত হয়ে বলল, ‘মেয়েছেলের সাথে আবার কথা কী?’

‘তেমন কিছু না। তাদের কাজ, আয়-ব্যয় সম্পর্কে একটু তথ্য নেব।’

‘আমাদের কাছ থেকেই নেন।’

‘নাহ্। যার তথ্য তার কাছ থেকেই নিতে হবে।’

ইলিয়াস উৎসাহের সাথে বলল, ‘ঠিক আছে, স্যর, আজকেই চলেন।’

তিনজনের বাসাই পার্কের কাছাকাছি, জানতে পারল আনোয়ার। বলল, ‘চলো, আজকেই কাজটা সেরে ফেলি। এ জন্য আপনাদের আরও দু’ শ’ টাকা দেব।’

টাকার কথা শুনে চকচক করতে থাকে তিনজনেরই চোখ। কোনও কাজ না করেই একদিনে তিন শ’ টাকা উপার্জন বিশাল ব্যাপার। এবার উৎসাহ দেখাল সবাই।

প্রথমে সবাইকে নিয়ে ইলিয়াসের বাসায় গেল আনোয়ার। বাসায়ই ছিল ইলিয়াসের বউ। এক কিশোরী মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখল আনোয়ার। এ রাইয়ানের মা নয়। সেখানে বেশি সময় ব্যয় করল না ও।

এরপর কাদেরের বাড়িতে গেল আনোয়ার। কাদেরের বউকে দেখেও আশাভঙ্গ হলো। সে দুই-এক কথা জিজ্ঞেস করে সরে পড়ল। কাদেরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু উত্তেজনা অনুভব করছে আনোয়ার। এখন বাকি আছে একমাত্র রইস। তবে কি রইসই রাইয়ানের বাবা? ছেলে হারানোর কোনও শোক অবশ্য তার চোখে-মুখে নেই। কাদের ও ইলিয়াসকে টাকা বুঝিয়ে বিদায় করে দিল আনোয়ার।

রইসের বাসা বেশ খানিকটা দূরে। দশ-পনেরো মিনিট হাঁটতে হবে।

‘স্যর, আসলে আমার বাসা নাই, ফুটপাতেই সংসার, বলল রইস। ‘তাই নাকি!’

‘হ্যাঁ। আগে বাসা ছিল বনানীর বস্তিতে। কিন্তু একটা সমস্যায় পড়ে বদলাতে হলো বাসা। এত জলদি নতুন কোথাও বাসা পাই না। তাই কয়েক দিন ধরে ফুটপাতেই আছি।’

‘খুব কষ্ট হচ্ছে তা হলে।’

‘আর কষ্ট। এই কষ্টতেই জীবনডা শেষ হয়ে যাবে।’

রইস রাস্তার পাশে বেশ ভাল সংসার পেতেছে। সেখানে খেলাধুলা করছে ছোট দুটো ছেলে-মেয়ে।

রইস একটা পিঁড়ে বের করে আনোয়ারকে বসতে দিয়ে বলল, ‘ওদের মা পানি আনতে গেছে। একটু বসেন।’

আনোয়ার বসল। মিনিট পাঁচেক পর রইসের স্ত্রী সুফিয়া পানি নিয়ে এল। সে আনোয়ারকে তখনও ভালভাবে খেয়াল করেনি। হঠাৎ তার দিকে তাকাল আনোয়ার। হ্যাঁ, সেইদিনের সেই মহিলা, রাইয়ানের মা!

আনোয়ারকে চিনতে পেরে যেন আকাশ থেকে পড়ল রাইয়ানের মা। অতি দ্রুত রইসকে কানে-কানে কী যেন বলল। শুনে রইসের চোয়াল ঝুলে পড়ল। আমতা-আমতা করতে লাগল সে। দু’জনে এসে জড়িয়ে ধরল আনোয়ারের পা বলল, ‘স্যর, আমাদের মাফ করে দেন!’

‘তোমাদের তো পুলিসে দেব ঠিক করেছি।’

‘না-না, স্যর। এই কথা কইবেন না। আপনার ভয়ে বাসা বদলাইছি। মেরাজের বাপ আপনারে চিনলে বাড়িতে আনত না,’ বলল মহিলা।

‘ঠিক আছে, পুলিসে দেব না। তবে একটা শর্ত আছে।

‘কী শর্ত?’

‘আমাকে সব কথা সত্যি বলতে হবে। কিছুই গোপন করবে না।’

দু’জনের ভয় ও কান্না একটু কমল।

আবারও আনোয়ার বলল, ‘কী? বলবে তো? নইলে…’

‘না-না, স্যর, বলব। কিন্তু আমাদের পুলিসে দিয়েন না। জীবনে একটা অন্যায় করেই ধরা খাইছি,’ কাতর গলায় বলল রইস।

আনোয়ারের সরাসরি প্রশ্ন: ‘রাইয়ান কি তোমাদের ছেলে?’

‘রাইয়ান কে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রইস।

‘তোমরা যে ছেলেকে মৃত সাজিয়ে ভিক্ষা করছিলে, তার কথা বলছি।’

‘ওই পোলার নাম তো আমি জানি না। আর…’

‘আর?’

‘ওই পোলাকে আমরা লাশ সাজাইনি। ও মারা গেসিল।’

‘মানে?!’ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল আনোয়ার।

‘স্যর, আপনারে সব বলতাছি। কিন্তু আপনি আমাদের পুলিসে দিয়েন না।’

‘আচ্ছা, কথা দিলাম, পুলিসে দেব না। তোমাদের কোনও ক্ষতিও করব না।’

উনিশ

রইস পুরো ঘটনাটা বলল আনোয়ারকে। তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হচ্ছে: রইস রমনা পার্কে কাজ করার সময় এক ধুরন্ধর লোকের সাথে তার পরিচয় হয়। নাম তার লোকমান। সে রইসকে বুদ্ধি দেয় কবর থেকে লাশ চুরি করার। প্রথমে বিষয়টা রইসের একদম পছন্দ হয়নি। কিন্তু লোকমান নানাভাবে বোঝাতে থাকল। একটা টাটকা লাশ চুরি করে আনলে বিশাল লাভ। অনেক দামে লাশটা বিক্রি করা যাবে। লোভের কাছে পরাজিত হয়েছিল রইস। কিন্তু কথা তুলল, ‘লাশটা কার কাছে বিক্রি করব?’

‘আমার কাছে আনলে, আমিই কিনে নেব,’ বলল লোকমান।

‘কত দেবেন?’

‘পাঁচ হাজার টাকা।’

রইস চিন্তা করে দেখল পাঁচ হাজার তার জন্য অনেক টাকা। একবার লাশটা চুরি করতে পারলেই …

এরপর কবরস্থানে কড়া নজর রাখছিল রইস। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে ছয়- সাতজনের দাফন হয় কবরস্থানে। সে উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুযোগ ধরা দিচ্ছিল না। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। রইস দেখল কয়েকজন মানুষ এসেছে লাশ দাফন করতে। সে সুযোগ পেয়ে মিশে গেল লোকগুলোর সাথে। এক ছোট বাচ্চাকে দাফন করতে এসেছে সবাই। ভাল করে কবরটা দেখে রাখল রইস। এই কবরস্থানের আশপাশে তেমন কোন জনবসতি নেই। তার উপর আজ বৃষ্টি। কেউ এদিকে আসবে বলে মনে হয় না। সন্ধ্যার দিকে লাশটা চুরি করার মতলব তার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী চুপিচুপি সন্ধ্যায় কবরস্থানে ঢুকল রইস এবং তার স্ত্রী। গতকাল রাতে কবরস্থানের ঝোপঝাড়ের মধ্যে কোদাল আর শাবল রেখে গিয়েছিল তারা। সারাদিনের বৃষ্টি আরও সহজ করে দিয়েছিল তাদের কাজকে। কোথাও দেখা যাচ্ছিল না কবরস্থানের পাহারাদারকে। এই লোকটা সন্ধ্যার দিকে নেশা করার জন্য বেরিয়ে পড়ে। তাই তাকে নিয়ে চিন্তা নেই। কাজে নেমে পড়ে রইস। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই কারও আসারও সম্ভাবনা নেই। এই লাশটা তাকে চুরি করতেই হবে। তারা সঙ্গে করে এনেছে বড় একটা বস্তা। ওটার মধ্যেই লাশটাকে ভরে ফেলল। বস্তা কাঁধে চাপিয়ে ধীরে-ধীরে হাঁটতে থাকল রইস। কবরস্থানের পশ্চিম কোণে মস্ত বড় জারুল গাছ। সেই গাছের নিচে লোকমানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল তারা। লোকটা আগেই বলে রেখেছিল, সন্ধ্যা সাতটার দিকে এসে নিয়ে যাবে লাশটা।

একঘণ্টা পার হয়ে গেছে, বৃষ্টিও থেমেছে বেশ আগে, কিন্তু দেখা নেই লোকমানের! এত কষ্টের পর ফল না মেলায় কেমন জেদ চেপে গিয়েছিল রইসের। এই লাশ নিয়ে এখন সে কী করবে? তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিল, লোকমানের বাসায় যাবে সে, আর রাস্তার পাশে লাশ নিয়ে বসে থাকবে সুফিয়া। এর মাধ্যমে লাশ দাফনের কথা বলে মানুষের কাছ থেকেও পাওয়া যাবে কিছু টাকা। আর এর মধ্যে লোকমানকে খুঁজে বের করবে রইস। ছোট বাচ্চাটার লাশ থেকে কাফনের কাপড় খুলে ফেলে সুফিয়া। নিজের ছেলের ছেঁড়া প্যান্টটা পরিয়ে দেয়। তারপর একসময় বনানীর ওই রাস্তায় আনোয়ারের সাথে দেখা হয়েছিল সুফিয়ার।