অন্যায় যখন প্রতিপক্ষ

অন্যায় যখন প্রতিপক্ষ

এক

মাঝে-মাঝে পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তগুলো মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবু সামাজিক জীব হিসাবে একজন মানুষকে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। রনির একমাত্র ছোট বোন হীরা। রনির আব্বা আব্দুর রশিদ হুট করেই হীরার বিয়ে ঠিক করেছেন। বিয়ের বিষয়ে রনির মতামত জানারও প্রয়োজন বোধ করেননি। সব ঠিকঠাক করে আব্দুর রশিদ সেদিন ফোন করে রনিকে বললেন, ‘রনি, হীরার জন্য ভাল একটা পাত্র পেয়েছি। ফুলমণি গ্রামের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান।’ একটু থেমে বললেন, ‘ছেলে ইণ্টার পর্যন্ত পড়েছে। গঞ্জে নিজের চারটা দোকান আছে, বাবার জায়গা-জমিও আছে বিস্তর। দুই-দুইটা পাকা দালান আছে তাদের। গ্রামেও খুব নাম-ডাক, সিদ্দিকুরের পরিবারকে সবাই এক নামে চেনে।’

রনি বলল, ‘হীরার এমন কী বয়স হয়েছে? বিয়ে নিয়ে এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন?’

‘গত বছর যে মেয়ে ইন্টার পাশ করেছে, তার বিয়ে নিয়ে মা-বাবা চিন্তা করবে না?’ বিস্মিত গলায় আব্দুর রশিদ বললেন।

‘হীরার তো আরও পড়াশুনা করার ইচ্ছা। আমি চাই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক,’ পাল্টা জবাব দিল রনি।

আব্দুর রশিদ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘মেয়েমানুষ অনেক পড়াশুনা করেছে। আর দরকার নেই। আমার মেয়ে শহরে গিয়ে মডার্ন মেয়ে হয়ে ঘুরবে, এটা আমি মেনে নিতে পারব না।’

‘আব্বা, ছেলেও তো তেমন ভাল না। পড়াশুনা তেমন করেনি, শুধু টাকা- পয়সা দেখেই রাজি হলেন?’

আব্দুর রশিদ রেগে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, ‘তোমার মতামত চাওয়ার জন্য আমি ফোন করিনি। আমার মেয়ের জন্য কোনটা ভাল, মন্দ, আমি বুঝব। তোমার এত মাথা ঘামাতে হবে না।’

‘ঠিক আছে, আব্বা।’

‘আগামী মাসের দুই তারিখে হীরার গায়ে হলুদ। তিন তারিখ বিয়ে। তুমি অবশ্যই আগে-ভাগে চলে আসবে।’

‘বড় ভাই হিসেবে আমার মতামতের যখন কোনও গুরুত্ব নেই, তখন আমি না আসলে কি কোনও ক্ষতি হবে?’

‘লাভ-ক্ষতির হিসাব আমাকে বোঝাবে না। আসবে কি আসবে না তোমার বিবেচনা।’

আব্দুর রশিদ ফোন রেখে দিলেন। পুরো বিষয়টা এখনও ঠিকমত মনের ভিতর সাজাতে পারেনি রনি। ঠিক সেই মুহূর্তে হীরা ফোন করল।

রনি ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে হীরার কান্নার শব্দ শুনতে পেল।

রনি চমকে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে, হীরা?’

‘আব্বা আমার বিয়ে ঠিক করেছে, শুনেছ?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি।’

‘আমি এখন বিয়ে করব না, ভাইয়া।’

রনি কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার মতামতের কোনও গুরুত্ব পরিবারে নেই। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল, ‘কাঁদিস না। কেঁদে কোনও লাভ নেই।’

‘ভাইয়া, ভাইয়া, আমাকে বাঁচাও। আমি আরও পড়ালেখা করব।’

‘ধুর, বোকা। বিয়ে নিয়ে এত ভয় পাওয়ার কী আছে?’

‘আমি পড়ালেখা করতে চাই।’

দেখবি তোর বরই তোকে পড়ালেখা করাবে।’

‘না, করাবে না। লোকটা আমার চেয়ে বারো-তেরো বছরের বড়। তার বাবা বলেছে, আমার বউ না, একটা কাজের মেয়ে দরকার। ঘরের সবকিছু বাড়ির বউকেই সামলাতে হবে।’

‘এরপরেও আব্বা এই বিয়েতে রাজি হলেন?’

‘হ্যাঁ। আব্বারও মেয়েদের নিয়ে একই ধারণা। এ ছাড়া তিনি আমাকে একটা শিক্ষা দিতে চান। ‘

‘মানে? কী শিক্ষা?’

‘তুমি তো আনিস ভাইয়ার ব্যাপারটা জানতে। আব্বা আনিস ভাইয়ার ব্যাপারটা জানার পর তড়িঘড়ি করে বিয়ে ঠিক করেছেন।’

রনির মনে পড়ল। আনিস তাদের গ্রামেরই ছেলে। ওর চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। এখন ঢাকা কলেজে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। অনেক আগে থেকেই আনিস হীরাকে পছন্দ করে। হীরারও তার প্রতি আগ্রহ আছে। আনিস বলেছে একটা চাকরি জোগাড় করে হীরার বাসায় প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু আব্দুর রশিদ এই বিষয়টা জানতে পেরে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। তাঁর মেয়ের নিজ পছন্দে বিয়ে হবে, এটা তিনি চিন্তাও করতে পারেন না। ছেলে রাজপুত্র হলেও সেই বিয়ে তিনি মানবেন না।

ভাবলেশহীন গলায় রনি বলল, ‘আব্বার বিষয়ে কী আর বলব! তুই একটা ছেলেকে পছন্দ করিস তাতেই আব্বা এমন করছে। আর যদি প্রেম করতি, তা হলে মনে হয় মেরেই ফেলত।’

হীরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, ‘ভাইয়া, আমি এখন কী করব?’

‘সাহস থাকলে পালিয়ে যা।’

‘সাহস নেই। আর পালিয়ে কোথায় যাব?’

‘আনিস কী বলে?’

‘তিনি তো খুব আঘাত পেয়েছেন। তাঁর বাবাকে দিয়ে আব্বার সাথে কথা রলানোর চেষ্টা করেছিলেন। আব্বা তাঁর সাথে ঠিকমত কথা তো বলেনইনি, উল্টো খুব অপমান করেছেন।’

‘আচ্ছা, দেখি আমি কী করতে পারি।’

‘তুমি দ্রুত বাসায় চলে এসো, ভাইয়া।’

‘আচ্ছা, আসব।’

‘আমার মন বলছে তুমি এলে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।’

দুই

দেরি করতে ইচ্ছে হলো না রনির। হীরার ফোন পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করল। বোনের এই সমস্যায় হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। রনি গ্রামে যাওয়ার পর আব্বার হাসিমুখ দেখতে পেল। রনিকে দেখে তিনি বললেন, ‘ভাল সময়ে এসেছ। কাল সিদ্দিকদের বাসায় যাওয়ার কথা আছে। তোমাকে নিয়ে যাব।’

সিদ্দিকের সঙ্গে হীরার বিয়ে হতে যাচ্ছে।

রনি বলল, ‘আব্বা, আমি যাব না।’

মুহূর্তেই আব্দুর রশিদের মুখ কালো হয়ে গেল। বললেন, ‘কেন যাবে না?’

‘আব্বা, ছেলের বয়স তো অনেক বেশি। আমার চেয়েও চার-পাঁচ বছরের বড়।’

‘বয়সে বড় ছেলেই সংসার করার জন্য ভাল। এরা আবেগে চলে না। বুঝে- শুনে সিদ্ধান্ত নেয়।

‘কিন্তু হীরার তো এই বিয়েতে মত নেই।

‘হীরার যদি মত না থাকে সেটা আমার সামনে এসে বলতে বলো। দেখি কত সাহস!’ আব্দুর রশিদের হাত মুষ্টিবদ্ধ। তিনি যখন খুব বেশি রেগে যান, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখেন। রনির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার সাথে এই বিষয়ে আমি আর কোনও কথা বলতে চাই না। কাল তুমি আমার সাথে সিদ্দিকদের বাসায় যাবে, এটাই শেষ কথা। আর আমার সাথে কখনওই এমন উঁচু স্বরে কথা বলবে না।’

রনির ভিতরটা কেঁপে উঠল। আব্বার কথার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তার কখনওই ছিল না। কিন্তু আদরের বোনটার এই সমস্যা রনিকে কেমন যেন বদলে দিয়েছে। আব্বা যখন বলছেন তখন কাল সিদ্দিকুরদের বাসায় যাবে রনি। ছেলে কেমন এটাও তার জানা দরকার, আব্বার কথার উপর কোনও ভরসা নেই।

.

হীরার হবু বরের পুরো নাম সিদ্দিকুর রহমান। তার বাবার ভালই টাকা-পয়সা আছে বোঝা যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশাল দুটো দোতলা বাড়ি। এই গ্রামে এমন আর একটাও বাড়ি আছে কি না সন্দেহ। রনিদের যে ঘরটাতে বসতে দেয়া হয়েছে তার সাজসজ্জা চোখে পড়ার মত। ঘরের মেঝেতে কার্পেট, দেয়ালে কিছু মহামানবের ছবি, শৌখিন সোফা আর ৩১ ইঞ্চি বিশাল এলইডি টিভি। দেখে কেউ বুঝতে পারবে না এটা গ্রামের কোনও বাড়ি। আব্দুর রশিদের মুখে বিজয়ীর হাসি। সম্ভবত তিনি ছেলেকে বোঝাতে চাইছেন, দেখো, কত বড় ঘরে হীরার বিয়ে ঠিক করেছি।

পাত্রপক্ষ যত্নের চূড়ান্ত করলেন। সিদ্দিকুর রহমান রনির চেয়ে বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভাইয়া ডাকছে। রনি এতে কিছুটা বিব্রত বোধ করছে। সিদ্দিকুর রহমান মাথা নিচু করে বললেন, ‘আমার বউয়ের বড় ভাই মানে আমার বড় ভাই। এখানে বয়স কোনও বিষয় না। আমি বড় ভাইকে অবশ্যই সম্মান করব।’

সিদ্দিকুরের বাবাও বেশ কিছু কথা বললেন। বেশ অপরাধী মুখ করে বললেন, ‘এর আগের দিন আপনাদের একটা অন্যায় কথা বলেছিলাম।’

আব্দুর রশিদ বললেন, ‘কী কথা?’

‘বলেছিলাম, আমাদের একটা কাজের লোকের মত বউ দরকার। আমি অশোভন কথা বলেছিলাম। ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আমি খারাপ অর্থে কথাটা বলিনি। বুঝাতে চেয়েছি আমার ঘরের সব দায়িত্ব বউমার উপরেই থাকবে।’

আব্দুর রশিদ মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি কি এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ করেছি, বেয়াই সাব?’

‘নাহ, আপনি কোনও অভিযোগ করেননি। তবে সিদ্দিকের মা সেদিন কথাটা শুনে খুব রাগ করেছিল। পরে আমারও মনে হয়েছে ভুল বলেছি।’

‘মেয়েদের বিয়ের পর অবশ্যই সংসারের কাজকর্ম করতে হবে। এটা তো চিরন্তন সত্য। আমার মেয়েও আলহামদুলিল্লাহ লক্ষ্মী। সে সব সামলে নিতে পারবে।’

‘আর আমাদের কোনও দাবি-দাওয়া নেই। এমনকী মেয়েকে গয়না না দিলেও সমস্যা নেই। আমরাই সব দিয়ে মেয়ে সাজিয়ে আনব।’

‘এ তো আপনাদের মহত্ত্ব। তবে আমার একটা মাত্র মেয়ে। আমি সাধ্যমত মেয়েকে সবকিছুই দেব।’

‘ঠিক আছে। মেয়ের বাবার মনে আমরা কষ্ট দিতে চাই না। আর দেনমোহর আপনি যা ঠিক করবেন তাই। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’

আব্দুর রশিদ ছেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘এরা কত বড় বাড়ির মানুষ বুঝতে পেরেছ? পারলে এদের একবার সালাম করে দোয়া নিয়ো, জীবনে কাজে লাগবে।’

কথাবার্তা চলছে। হঠাৎ রনি বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করল। সিদ্দিকুর নীচে গিয়েছে। সিদ্দিকুরের বাবা বাথরুমের কথা শুনে বললেন, ‘ভিতরে গিয়ে ডানদিকের মাথায় বাথরুম। নতুন টাইলস লাগিয়েছি। যাও।’

.

রনি ডানদিকে হাঁটতে লাগল। মনে হচ্ছে দোতলাতে তেমন কেউ থাকে না। বড়- বড় অনেকগুলো রুম। কিন্তু বেশিরভাগই তালাবদ্ধ। ঠিক বাথরুমের পাশের রুমটার সামনে গিয়ে রনি থমকে দাঁড়াল। রুমের দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। কিন্তু মনে হচ্ছে ভিতর থেকে কারও কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেমন যেন কৌতূহল হতে লাগল রনির। রুমের জানালাটা আলতো করে ধাক্কা দিল খুলে গেল সেটা। ভিতরটায় ঈষৎ অন্ধকার। বোঝা যাচ্ছে অনেক বড় একটা রুম। ভিতরে কোনও আসবাবপত্র নেই এবং মনে হচ্ছে রুমের মধ্যে কয়েকজন হাঁটাহাঁটি করছে।

হঠাৎ রনিকে চমকে দিয়ে একটা মেয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে লাল রঙের শাড়ি। বড় আঁচল দিয়ে মুখটা ঢাকা। রনির মনের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই।

মেয়েটা বলল, ‘বোনের বিয়ে দিতে এসেছেন?’

‘জি।’

‘মিষ্টি এনেছেন তো?’

‘জি, এনেছি। আপনি কে?’

মেয়েটা হেসে উঠল। রনির মনে হচ্ছে আঁচলের ওপাশে একটা কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘হাসছেন কেন?’

‘বিয়ে বাড়ি তো হাসিরই জায়গা।’

‘আপনি কে বললেন না তো।’

‘বলব না।’

‘ঘরের দরজায় তালা দেয়া কেন?’

‘আমি পাগল তো তাই আটকে রেখেছে।’ আবার হাসি

‘ওহ।’ রনি জানালা থেকে একটু দূরে সরে গেল। এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। মেয়েটা সিদ্দিকুর রহমানের কোনও আত্মীয়। সম্ভবত মানসিক ভারসাম্যহীন তাই ঘরে আটকে রাখা হয়েছে।

রনি বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল। মেয়েটা আবার ডেকে বলল, ‘যাবেন না। আপনার সাথে আরও কথা আছে।’

রনি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার তেমন কোনও আগ্রহ বোধ করছে না। পাগল মানুষ কখন কী করে, ঠিক নেই। মেয়েটা গলা নামিয়ে বলল, ‘সিদ্দিকের সাথে আপনার বোনের বিয়ে দেবেন না।’

‘কী বলছেন এসব? কেন?’

‘সিদ্দিকের সাথে বিয়ে না দিয়ে বোনকে পুড়িয়ে মেরে ফেলুন।’

মেয়েটা আসলেই পাগল, বোঝা যাচ্ছে। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

‘আপনি কে?’ পুরানো প্রশ্নটা আবার করল রনি।

‘আমি আমেনা।’

‘ওহ।’

‘আমি সিদ্দিকের প্রথম বউ।’ আমেনার গলায় নিস্পৃহ ভাব।

‘অ্যা! সিদ্দিকুরের আগের বউ আছে? এটা তো জানতাম না। আপনি কি সত্যি বলছেন?’ নিজের বিস্ময়টা লুকাতে পারল না রনি।

‘হা-হা। আরও অনেক কিছুই আপনারা জানেন না।’

ঠিক সেই মুহূর্তে আরও একটা মেয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল। এর পরনেও লাল রঙের শাড়ি। আগের মেয়েটার মত সে-ও আঁচল সামনের দিকে টেনে রেখেছে।

এই মেয়েটা নিজ থেকেই বলল, ‘আমি জমিলা। সিদ্দিকের দ্বিতীয় বউ।’

রনির মাথা ঘুরে উঠল। কী দেখছে এসব। সিদ্দিকের আগের বউ আছে। দু’জনেই পাগল? এটা কীভাবে হয়? নাকি এই মেয়ে দুটো মিথ্যা বলছে?

কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বরের মধ্যে এক ধরনের বেদনার ছাপ রয়েছে, গভীর বেদনা নিয়ে মিথ্যা বলাটা কঠিন।

আমেনা বলল, ‘আমি সিদ্দিকের সাথে দুই বছর সংসার করেছিলাম। সিদ্দিকের মা-বাবা আর সিদ্দিক দিনরাত আমার উপর নির্যাতন করত। এরপর একদিন…’

‘একদিন কী?’

‘সিদ্দিক আর তার বাবা আমার সারা শরীরে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। তারপর আমাকে এই রুমে ফেলে রাখে।’

রনি আঁতকে উঠল। ‘অ্যাসিড!!!’

‘হ্যাঁ। এদের গোপন কয়েকটা কারখানা আছে। সেখানে অ্যাসিড মজুত করে রাখা আছে। কাউকে শায়েস্তা করার দরকার হলেই এরা অ্যাসিডকে কাজে লাগায়।’

আমেনাকে থামিয়ে দিয়ে জমিলা বলল, ‘আমার দুই বছর সংসার করার সৌভাগ্য হয়নি। আমাকে গোপনে বিয়ে করে এনেছিল সিদ্দিক। বিয়ের তিন দিনের মাথায় বদমাশটা আমার শরীরে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। আমাকেও এই রুমে ফেলে রেখেছিল। এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছিল যে, গ্রামের লোকজনও সিদ্দিকের দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানে না।’

‘আপনারা কী পাগলের মত কথা বলছেন? আপনারা বলছেন সারা শরীরে অ্যাসিড মেরে এখানে ফেলে রেখেছিল। তা হলে চিকিৎসা ছাড়া আপনারা বেঁচে আছেন কীভাবে?’

দু’জনেই ভয়ঙ্করভাবে হেসে উঠল। রনির হাতে-পায়ে শীতল ভাব ছড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। জানালার সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে রনি। তবে অদ্ভুত কোনও আকর্ষণ তাকে সেখানে আটকে রেখেছে। কিছু একটা রনি দেখতে চায় না, কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে দেখতেই হবে।

ঘটনাটা ঘটল খুব দ্রুত। আমেনা এবং জমিলা এক ঝটকায় মুখের উপর থেকে আঁচল সরিয়ে নিল। রনির মুখ দিয়ে মৃদু আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল। রনি পিছনের দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়াল। বুঝতে পারছে তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে, ঘামে ভিজে গেছে শরীরের অনেকটা অংশ। এ ভয়ঙ্কর দৃশ্য রনি দেখতে চায় না। সে চোখ বন্ধ করল। মনে হলো, চোখ খুললেই দেখবে সামনের সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু তা হলো না। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা রনিকে বারবার দেখতে হলো।

রনি দেখল আমেনা এবং জমিলার মুখ, গলা, হাত ঝলসে গেছে। মুখমণ্ডলে চোখের কোনও অস্তিত্ব নেই, নাক এবং ঠোঁট যেন একসঙ্গে মিশে গেছে, কোথাও- কোথাও মাংস খসে পড়েছে, মাথায় চুল নেই একটাও।

জমিলা হেসে বলল, ‘বিশ্বাস হয়েছে আমাদের কথা? শরীরের সব জায়গায়ই এই অবস্থা। সব আপনাকে দেখাতে পারব না।’

রনি শক্ত করে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে যে কোনও সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

জমিলা বলল, ‘নিজের বোনের যদি এমন অবস্থা দেখতে চান, তবে অবশ্যই সিদ্দিকের সাথে বিয়ে দেবেন। তখন এই ঘরে আমরা তিনজন থাকব। মাঝে- মাঝে আমাদের তিনজনকে দেখে যাবেন।’

আমেনা গলা নামিয়ে বলল, ‘আমাদের কাছেও অ্যাসিড আছে। একদিন আমরাও সিদ্দিক আর ওর মা-বাবার উপর অ্যাসিড ঢেলে দেব।’

রনি আর দাঁড়াতে পারল না। বাথরুম সেরে দৌড়ে বসার রুমে ফিরে গেল। আব্দুর রশিদ রনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে? এভাবে ঘেমেছ কেন?’

রনি ঠিকভাবে বসতে পারছে না। তার মুখের মধ্যে শুকনো খটখটে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কথা বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে।

‘চলো, আজ তা হলে উঠি,’ আব্দুর রশিদ রনির দিকে তাকিয়ে বললেন। রনি নিশ্চুপ। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।

সিদ্দিকুর রহমান আব্দুর রশিদের পা ছুঁয়ে সালাম করল। আব্দুর রশিদ চাপা গলায় বললেন, ‘দেখেছ কেমন ভদ্র ছেলে! মাশা’আল্লাহ।’

রনি দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।

ফুলমণি গ্রাম থেকে রনিদের গ্রাম আশামণির দূরত্ব খুব বেশি নয়। ভ্যানে বা রিকশায় করে সবাই যাতায়াত করে। রনি আব্বাকে ভ্যানে তুলে দিয়ে বলল, ‘আব্বা, আপনি বাড়ি চলে যান। আমি একটু পর আসছি।’

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘এই গ্রামে আমার একটা বন্ধু আছে। তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’

‘আচ্ছা, যা। রাতে তুই বাসায় ফিরলে বিস্তারিত কথা বলব।’

তিন

অনেকদিন সেলিমদের বাসায় যায়নি রনি। পুরানো বন্ধুর সঙ্গে বহু বছর পর দেখা হলেও কোনও সমস্যা হয় না, আন্তরিকতায় এতটুকু খাদ থাকে না। সেলিম রনিকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরল। ওর মা-বাবার মুখেও হাসি ফুটল। রনি অনেকবার বলার চেষ্টা করল, ‘একটু পরেই চলে যাব।’ সেলিম কঠিন গলায় উত্তর দিল, ‘আজ যেতে পারবি না। পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে। আর আব্বা মোরগ জবাই করবে। আজ রাতে তোকে ছাড়ছি না, আজ একসাথে খাওয়া-দাওয়া করব আর সারারাত পুকুর পাড়ে বসে গল্প করব।’

রনি রাজি হলো, মানে হতেই হলো। এরকম অকৃত্রিম ভালবাসাকে অগ্রাহ্য করা খুব কঠিন।

রাতের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন দেখে রনি হতবাক হয়ে গেল। বড় রুই মাছ, দেশি কই, চিংড়ি, মোরগের মাংস, শিম ভর্তা, মসুরের ডাল, আচার এবং দই। এত অল্প সময়ে এত আয়োজন! শহরে কোনও আত্মীয়ের বাসায় এই ভালবাসার এক ভাগও কল্পনা করা যায় না। ‘আহা! গ্রামে যদি ফিরে আসতে পারতাম। পুরনো কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।’ রনির মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল কথাগুলো।

প্রিয় পুকুর ঘাটে অনেকদিন পরে বসেছে রনি আর সেলিম। হাতে পাতার বিড়ি। পাতার বিড়ি খাওয়ার মাধ্যমে তাদের পুরানো আনন্দ যেন আবার ফিরে এসেছে। সুন্দর বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। আর আকাশে চাঁদও রয়েছে। এত সুন্দর পরিবেশ যে তাদের মনে হচ্ছে অনন্তকাল এখানে বসে থাকে। নতুন- পুরানো নানা গল্প চলল দুই বন্ধুর। রনির কথা কতটা মনে পড়ে সেটাও জানিয়ে দিল সেলিম। কথায়-কথায় হীরার বিয়ের প্রসঙ্গটা তুলল রনি। প্রথমে বেশ আগ্রহ দেখালেও সিদ্দিকুর রহমানের কথা শুনে সেলিমের উৎসাহটা মিইয়ে গেল।

রনির দিকে না তাকিয়ে শুধু বলল, ‘তা হলে তোর বোনের সাথেই সিদ্দিক ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে?’

‘তুই বিয়ের বিষয়ে আগেই জেনেছিলি?’

‘হ্যাঁ, শুনেছিলাম সিদ্দিক ভাই বিয়ে করতে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা যে আমাদের হীরা তা জানতাম না।’

‘হুম।’ আড়চোখে সেলিমের দিকে তাকিয়ে রনি বলল, ‘সিদ্দিকুর রহমান লোক কেমন?’

সেলিম রনির দিকে একনজর তাকাল। তারপরেই চোখ নামিয়ে নিল। মিনমিন করে বলল, ‘হ্যাঁ, ভালই তো।’

রনি সেলিমের কাঁধ ধরে বলল, ‘দেখ, সেলিম, এটা আমার বোনের জীবনের প্রশ্ন। তুই সিদ্দিকুর সম্পর্কে খারাপ, ভাল যা-ই জানিস, আমাকে বল। কিছু লুকাবি না।’

‘মানুষটা ভাল না রে,’ সরাসরি বলে বসল সেলিম। ‘যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তাই কিছু বলতে চাইছিলাম না।’

সেলিমের কথায় মনের মধ্যে ধাক্কা লাগলেও স্বাভাবিক গলায় রনি বলল, ‘বিয়ে শুধু ঠিক হয়েছে, হয়ে তো যায়নি। আমাকে সব খুলে বল।’

‘খুলে বলার খুব বেশি কিছু নেই। সিদ্দিকুর রহমানের বাবা খিজির রহমান গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ। বহু মানুষের জমা-জমি দখল করে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছে। সিদ্দিকুর রহমানও বাবার ধারা অব্যাহত রেখেছে। গ্রামের মানুষ এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ।’

‘হুম।’

‘আর একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে সিদ্দিকুরের চরিত্রও তেমন ভাল না। গ্রামের বহু মেয়ের দিকে সে নজর দিয়েছে। তার জন্য অনেক মেয়েকে গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। তুই কি জানিস সিদ্দিকুরের আগের একটা বিয়ে আছে?’

‘বলিস কী!’

‘হ্যাঁ, আমেনা নামে এই গ্রামের একটা অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছিল। একদিন জানতে পারলাম রান্নাঘরে আগুন লেগে আমেনা মারা গেছে। গ্রামের সবাই ছুটে গেলাম সিদ্দিকুরদের বাড়িতে। দেখলাম গোলপাতার রান্নাঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাউকে লাশও দেখতে দেয়া হয়নি। তড়িঘড়ি করে বাড়ির পিছনের কবরস্থানে আমেনাকে কবর দেয়া হয়। আমেনার মৃত্যু নিয়ে লোকজনের মধ্যে নানান কানাঘুষা আছে।’

‘কী কানাঘুষা?’

এটা বলা ঠিক হবে না রে। মানুষ তো আজগুবি কথা বলতে পছন্দ করে। এগুলো বিশ্বাস না করাই ভাল।’

‘আমাকে বল, সেলিম। আমি অবুঝ মানুষ নই, কিছু শুনেই আমি হুট করে বিশ্বাস করে ফেলি না।’

নিচু গলায় সেলিম বলল, ‘অনেকে বলে সিদ্দিক এবং তার বাবা-মা মিলে আমেনাকে মেরে ফেলেছে।

‘ওহ, আল্লাহ!’

‘হ্যাঁ, তাদের ভাষ্য মতে আমেনাকে অ্যাসিডে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এরপর রান্নাঘরে আগুন লাগার নাটক সাজানো হয়েছে।’

রনি কী বলবে বুঝতে না পেরে সেলিমের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

সেলিম আবার বলল, ‘সিদ্দিক এবং তার বাবা শত্রুদের অ্যাসিডে ঝলসে দেয়। অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে তারা এত ক্ষমতাশালী যে কেউ পুলিশের কাছে যেতে সাহস পায়নি। অনেক গুণ্ডা পোষে সিদ্দিকুর রহমান, পুলিশের সাথেও বেশ দহরম মহরম। বুঝতেই পারছিস।’

‘আচ্ছা, সিদ্দিকুর কি জমিলা নামে কোনও মেয়েকে বিয়ে করেছিল?’

সেলিম শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। তার কথায় জড়তা চলে এল। ‘তু- তুই তু-তুই জ-জমিলার কথা কীভাবে জানলি?’

‘সত্যি কি না বল?’

‘জমিলাকে আমি কোনওদিন দেখিনি। গ্রামের কিছু মানুষ জমিলার কথাও বলত একসময়। সিদ্দিকুর নাকি দূরের এক গ্রাম থেকে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে এনেছিল। বিয়ের তিন দিনের মাথায় সে নিখোঁজ হয়েছিল। তবে জমিলাকে গ্রামের কোনও মানুষ চোখে দেখেনি। হতে পারে এটা একটা গুজব।’

‘আমি এখন কী করব, রে?’

‘আমিও তাই ভাবছি। হীরাকে সিদ্দিকুরের বউ হিসাবে দেখব ভাবতেই পারছি না।’

‘আব্বা এই পরিবার সম্পর্কে ঠিকমত খোঁজখবর না নিয়ে কীভাবে বিয়ে ঠিক করলেন?’

‘চাচাজান হয়তো খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে সিদ্দিকুরদের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলার সাহস কারও নেই।’

‘চল, শুয়ে পড়ি। ভাল লাগছে না।’

‘তোর মনটা খারাপ করে দিলাম!’

‘মনটা এমনিতেই খারাপ। তোর কথায় বরং আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। তুই যে আমাদের কত বড় উপকার করলি…’ সেলিমের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল রনি।

সেলিম এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘একটা অনুরোধ, আমি যে তোকে এসব বলেছি, কাউকে বলবি না।’

সেলিমের ভয়টা দেখে রনি বুঝতে পারল সিদ্দিকুর রহমান কতটা নিষ্ঠুর চরিত্রের।

চার

জীবনে প্রথমবারের মত আব্বার সঙ্গে কথা বলতে রনি কোনও ভয় পাচ্ছে না। বেশ স্পষ্ট স্বরেই বলল, ‘আব্বা, সিদ্দিকুর লোকটা ভাল না।’

২৩৮

আব্দুর রশিদ কঠিন চোখে রনির দিকে তাকালেন। ‘কী বললে?’

‘আপনি জানেন, সিদ্দিকুরের আগে বিয়ে আছে?’

‘হ্যাঁ, জানি।’

রনির মাথায় যেন বাজ পড়ল। ‘আপনি জানেন?!!’ উত্তেজনায় চেয়ার থেকে

দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘এত লাফাচ্ছ কেন? জানি তো আগে একবার বিয়ে করেছিল। বউটা আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল।’

‘আব্বা, সিদ্দিকুর আর তার বাবা-মা মিলে ওই বউটাকে মেরেছিল।’

‘একদম চুপ। বাজে কথা বলবে না।’

‘শুধু তাই নয়। আরও একটা মেয়েকে বিয়ে করে সিদ্দিকুর মেরে ফেলেছিল। গ্রামের অনেক মানুষের উপরে নির্যাতনের ইতিহাসও আছে ওদের। সিদ্দিকুরের চরিত্রও তেমন সুবিধার না।’

‘বাহ! এতদিন গ্রামে থেকে আমি কিছু জানতে পারিনি, আর তুমি দেখি এক রাতের মধ্যে সব কিছু জেনে গেছ!’

রনি আব্বার বিদ্রূপটা গায়ে না মেখে বলল, ‘কোনওভাবেই সিদ্দিকুরের সাথে হীরার বিয়ে দেবেন না, আব্বা।’

‘তুমি যা-যা বললে সব গ্রামের মানুষের রটনা। মানী লোক সম্পর্কে গ্রামের মানুষ খারাপ কথা ছড়াতে পছন্দ করে।’

‘আমি কোনওভাবেই এই বিয়ে হতে দেব না।’

আব্দুর রশিদ শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরলেন। তিনি রাগে অস্থির হয়ে আছেন বোঝা যাচ্ছে। বললেন, ‘সিদ্দিকুর একটা বিয়ে করেছিল। তার বউটা রান্নাঘরের আগুনে মারা গিয়েছিল। এটুকুই সত্যি। আর কিছুই সত্যি নয়। আর তুমি বিয়ে বন্ধ করার কে? এখনও আমার হাতে জোর আছে, মনে রাখবে। বেয়াদবকে সোজা করার উপায় আমার জানা আছে। আমার সামনে থেকে যাও।’

রনি উঠে দাঁড়াল।

‘তোমার শাস্তির ব্যবস্থা আমি অবশ্যই করব। আমি দুষ্ট গরু পুষতে চাই না।’

রনি মনে-মনে বলল, ‘আপনার গোয়ালে আমি আগুন দেব, আব্বা। আপনার গোয়াল শুধু শূন্যই থাকবে না, ধ্বংসও হয়ে যাবে। আপনার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি, আর না।’

পুরানো একটা দুঃখের স্মৃতি মনে পড়ে গেল রনির। রনির বয়স যখন আঠারো, তখন আব্বা তার বিয়ে দিয়েছিলেন। একরকম বাধ্যই করেছিলেন বিয়ে করতে। আব্দুর রশিদের যুক্তি ছিল অল্প বয়সে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিলে তাদের জীবন সুখের হবে। কিন্তু রনির জীবন সুখের হয়নি। রনির বারো বছর বয়সী বউ শাহানা আব্দুর রশিদের পরিবারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। তবে রনির কেন যেন মনে হয়, শাহানা তাকে একটু-একটু পছন্দ করত। বাসর রাতে সে অনেক গল্প করেছিল। তার জীবনের গল্প। তাদের বাসার গাভীটার একটা নতুন বাছুর হয়েছিল, বাছুরটা তার গলা শুনলেই দৌড়ে আসত। তার বান্ধবী সীমা নাকি মাছের মত সাঁতার কাটে, কোনও ছেলেও তাকে হারাতে পারবে না। রিয়াজ- শাবনূরের নতুন সিনেমাটা দেখে নাকি চোখে পানি এসে যায়। রনির সে-রাতে মনে হয়েছিল, আল্লাহ শুধু তার জন্য এই বিশেষ মেয়েটিকে তৈরি করেছেন। শাহানার মধ্যে রনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।

কিন্তু সুখ রনির ভাগ্যে ছিল না। বিয়ের পরদিন থেকে আব্দুর রশিদের কড়া শাসনের মধ্যে পড়ে গেল শাহানা। রনির আম্মা এমনিতে আব্দুর রশিদের কাছে কোনও কাজে পাত্তা পান না। তবে আব্দুর রশিদ যখন কারও প্রতি অন্যায় করেন, তখন রনির আম্মা তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যান। সে অর্থে তিনিও একজন নিষ্ঠুর মানুষ।

রনির আব্বা, আম্মা দু’জনে মিলে শাহানার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছিলেন কিশোরী মেয়েটা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করত। কাজের পুরস্কার হিসাবে ছিল শ্বশুরের ধমক আর শাশুড়ির টিপ্পনী। তার খাওয়া-দাওয়ার দিকেও কারও নজর ছিল না। তার পোশাক-আশাক ছিল চাকরানির মত। অবাক ব্যাপার হচ্ছে শাহানা কখনও রনির কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করলেও অবশ্য রনির কিছু করার ছিল না।

শাহানার পরিবারের সদস্যরা এই নির্যাতনের বিষয়ে সবই জেনেছিল। তারা ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। ফলে, দুই মাসের মধ্যেই তালাক সম্পন্ন হয়েছিল। রনি শুনেছে শাহানার আবার বিয়ে হয়েছে। একটা বাচ্চাও নাকি আছে। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে, এখনও রনি আনমনে সেই কিশোরী মেয়েটার কথা ভাবে। গোলগাল মুখ, মিষ্টি চেহারা, চোখে-মুখে কৌতূহল ভরা যে মেয়েটাকে দেখে রনি মুগ্ধ হয়েছিল।

তালাক হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর পর, আব্দুর রশিদ আবার রনির বিয়ের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু রনি কোনওক্রমেই রাজি হয়নি। রনির নিজের জীবনে যে খারাপ বিষয়টা ঘটে গেছে, তা সে কোনওক্রমেই হীরার জীবনে ঘটতে দেবে না, কিছুতেই না।

পাঁচ

আনিস ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে। হীরাই সংবাদটা রনিকে দিয়েছে। রনি দেরি না করে আনিসদের বাসায় গেল। আনিসদের বাসা কাছাকাছি। রনিকে দেখে আনিস কিছুটা ভড়কে গেল। কোনওকিছু নিয়ে শঙ্কায় ভুগছিল হয়তো। রনি তার সব শঙ্কা, দূর করে বলল, ‘তোমার আর হীরার বিষয়টি আমি জানি।’

আনিসের মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল।

রনি বলল, ‘এখন কী করবে ভাবছ?’

‘ভাইয়া, আমার তো তেমন কিছু করার নেই। চাচা না চাইলে তো কেউই কিছু করতে পারবে না।’

‘কোনওকিছুতে জয়ী হতে চাইলে জেদ থাকা প্রয়োজন। আব্বা যতটা না রাগী, তার চেয়ে বেশি জেদি। তাঁর এই জেদের জন্যই জীবনে সব বিষয়ে তিনি সফল। আমার মনে হয় তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মাথা তুলে দাঁড়ালে তিনি হতভম্ব হয়ে যাবেন।’

‘ভাইয়া, আমাকে কী করতে বলছেন?’

‘আগে নিজের মনকে প্রশ্ন করো, হীরাকে তুমি বিয়ে করতে চাও কি না?’

‘ভাইয়া, অবশ্যই চাই। হীরা আমার জীবনে না এলে হয়তো সবই হারিয়ে ফেলব।’

‘তা হলে নিজেই ভেবে বলো, তোমার কী করা উচিত।’

‘আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। কিন্তু হীরা কি চাচার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে?’

‘হীরা আর তুমি ঢাকায় চলে যাও। এরপর সেখানে বিয়ে সেরে নাও। যদিও আমি চেয়েছিলাম হীরার বিয়েটা আরও কয়েক বছর পর হোক। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে তোমাদের বিয়ে করে নেয়াই ভাল। বিয়ের পর আমার বাসাতেই তোমরা থাকবে। তুমি চাকরির চেষ্টা করবে আর হীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে।’

আনিস আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ল। ‘ভাইয়া, আপনি…’ আনিসের চোখে পানি দেখতে পেল রনি। পুরুষমানুষের চোখে পানি অনেক বড় ব্যাপার। রনির মনে হচ্ছে, এই ছেলেটার কাছে তার বোন সুখেই থাকবে।

রনি বলল, ‘আনিস, মন নরম করলে চলবে না। অনেক বড় মানসিক শক্তি দরকার তোমাদের।’

‘ভাইয়া, আমি শক্তই আছি। আমার অনেক স্বপ্ন। সংসারের কথা চিন্তা করে আমি ছোটখাট সঞ্চয় করেছি। সে সঞ্চয় এখন তিন লাখ টাকা হয়েছে।’

‘খুবই ভাল। এত টাকা কীভাবে জমালে?’

‘আমি প্রচুর টিউশনি করি। টিউশনির টাকাই একটু-একটু করে জমিয়েছি।’

‘খুব ভাল। ওই টাকাটা এখন খরচ কোরো না। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই টাকায় হাত দেবে না।’

‘জি, ভাইয়া।’

‘দু’দিনের মধ্যে তোমরা ঢাকা যাবে। আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। বাসার চাবিটাও মনে করে নিয়ে নিয়ো।’

‘আপনি আমাদের সাথে যাবেন না?’

‘নাহ, এখনই যাব না। আমি এদিকটা সামলাব। দেখব আব্বা কী করেন। ওনাকেও তো সামলাতে হবে।’

‘আচ্ছা, ভাইয়া।’

‘আমি হীরাকে সব বলব আজকে। তুমি তৈরি থেকো।’

.

পরিস্থিতি মানুষকে সাহসী করে দেয়। রনি ভেবেছিল হীরা আব্বার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে ভয় পাবে, কিন্তু তাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে সহজেই রাজি হয়ে গেল। আব্বার প্রতি তার ক্ষোভও দীর্ঘদিনের।

রনি বলল, ‘কিছু জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখিস। আর এই চার হাজার টাকা রাখ। সোজা আমার বাসায় যাবি। একটা বেডরুম খালি পড়ে আছে, তোদের থাকতে কোনও সমস্যা হবে না।’

হীরার মুখটা শুকনো। মুখের সেই চিরাচরিত হাসিটা যেন নিভে গেছে।

রনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় লাগছে?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া, লাগছে। যদি আব্বা জানতে পারেন, তা হলে…’

‘আমি নিজে তোদের ঢাকার বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসব। রাত এগারোটার বাসে যাবি। এই সময় কেউ জেগে থাকবে না।’

.

সহজে হয়ে গেল সবকিছু। রাত এগারোটার বাসে হীরা আর আনিসকে উঠিয়ে দিয়েছে রনি। হীরা খুব কাঁদছিল। বেচারী খুব ভয় পাচ্ছিল। যদিও বড় ভাই ওর পাশে আছে, তবু এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ নয়। যতই আশ্বস্ত করা হোক না কেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া একটা মেয়ের জন্য অনিশ্চিত যাত্রার মত। রনি আনিসকে অনেকবার বলেছে যেন হীরাকে দেখেশুনে রাখে। এই মেয়েটা শহরের পরিবেশ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না।

ছয়

রাতে বাসায় ফিরতে-ফিরতে প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল রনির। সারারাত ঘুমাতে পারেনি। শুধু এপাশ-ওপাশ করেছে। শেষ রাতের দিকে নিজের অজান্তেই চোখটা একটু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার।

রনির ঘুম ভাঙল আব্বার চেঁচামেচি শুনে। আব্দুর রশিদ রনির ঘরের দরজায় সজোরে লাথি দিচ্ছিলেন। রনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। আব্বা কি তবে সব জেনে গেছেন?

আব্দুর রশিদ চিৎকার করছেন, ‘দরজা খোল, হারামজাদা।’

রনি শান্তমুখে দরজা খুলে দিল।

আব্দুর রশিদের মুখ ক্রোধে লাল হয়ে আছে। তাঁর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। হাতে একটা ধারাল দা চকচক করছে। রনির ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু ও অবাক হয়ে লক্ষ করল তার ভয় করছে না। আব্দুর রশিদ দা উঁচু করে বললেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, বল, হীরা কোথায়?’

‘ঢাকায় গেছে, আব্বা।’

‘ওর নাগরের সাথে গেছে? তুই ওদের পাঠিয়েছিস, না?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওই হারামজাদী চিঠি লিখে গেছে। কী সুন্দর সেই চিঠির ভাষা।’ দাঁতে-দাঁত চেপে আব্দুর রশিদ বললেন, ‘আজ তোকে টুকরো-টুকরো করে কুকুরকে খাওয়াব।’

‘আপনার সাহস থাকলে আমাকে কোপ দেন।

‘কী বললি?’

‘বলেছি আপনার সাহস নেই আমাকে কোপ দেয়ার। আছে শুধু হম্বিতম্বি।’ আব্দুর রশিদ অবাক দৃষ্টিতে রনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে তিনি নিজের ছেলেকে চিনতে পারছেন না।

রনি সোজাসুজি আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সিদ্দিকুর একটা খুনি। সে তার আগের দুই বউকে খুন করেছে। গ্রামের মানুষকে বহু বছর ধরে তারা নির্যাতন করে আসছে। এমন একটা পরিবারে আমি আমার বোনকে বিয়ে দিতে পারব না। আপনি বাবা হিসাবে ব্যর্থ হতে পারেন, আমি ভাই হিসাবে ব্যর্থ হতে পারব না।’

আব্দুর রশিদ যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। রনি তাঁর চোখে অন্য দৃষ্টি দেখতে পেল। তিনি হারতে চান না। এবার বোঝা যাচ্ছে তিনি সত্যিই রনিকে কোপ দেবেন। আব্দুর রশিদ চিৎকার করতে-করতে রনির দিকে এগিয়ে আসছেন। ও অপেক্ষা করছে। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাওয়ার অপেক্ষা। ঠিক সেই মুহূর্তে রনির আম্মা এবং পাশের বাড়ির ইব্রাহিম কাকা ঘরে ঢুকলেন। আব্দুর রশিদকে চেপে ধরলেন তাঁরা। তিনি তখন পশুর মত শব্দ করছেন, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। বলছেন, ‘ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও। এই শুয়োরকে মেরে আমি একটা পুণ্য করতে চাই।’

আম্মা চিৎকার করে বললেন, ‘রনি, তুই চলে যা। তোর আল্লাহর দোহাই লাগে তুই চলে যা।’

আম্মা আর ইব্রাহিম কাকা শক্ত করে ধরে রেখেছেন আব্দুর রশিদকে। তিনি ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন। রনি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। না, আব্বার ভয়ে নয়। এমন ক্রমাগত চিৎকার করলে আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়বেন, তখন নিজেকে বড্ড দায়ী মনে হবে।

রনিদের বাসায় প্রচুর মানুষ জড় হয়েছে। সবাই মজা দেখতে এসেছে। আব্দুর রশিদ চিৎকার করে বললেন, ‘আজ থেকে আমার কোনও ছেলে-মেয়ে নেই। আমি দুই কুত্তাকেই ত্যাজ্য করলাম।’

রনি মনে-মনে বলল, ‘আপনার এই দোজখে আর ফিরতে চাই না।’

পরিশিষ্ট

হীরা আর আনিসের বিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে রনি। হীরা তার বাসায়ই আছে। ঢাকার একটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। প্রস্তুতি ভাল না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি।

আনিস মাস্টার্স পাস করেছে। আগের মত মেসেই থাকছে। ঠিক করেছে একটা ভাল চাকরি পেয়েই হীরাকে বিয়ে করবে। আব্বা-আম্মা রনি এবং হীরার কোনও খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেননি। এমনকী একবার ফোনও করেননি। তবে গতকাল সেলিম রনিকে ফোন করেছিল। সে এমন একটা খবর দিল যে রনি হতবাক হয়ে পড়ল। তার ভাষাতেই বলা যাক:

‘তুই হীরাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছিস আগেই জেনেছিলাম। এসব ব্যাপার নিয়ে দুই গ্রামে নানা কথাবার্তা চলছিল। তবে বেশিরভাগ মানুষই বলেছে, ‘যাক, ভালই হলো। মেয়েটা সিদ্দিকুরের হাত থেকে বেঁচে গেল।’ কেউ-কেউ অবশ্য পুরো ঘটনায় মজাও লুটছে। সিদ্দিকুর আর তার বাবা তোদের বাসায় এসে অনেক চেঁচামেচি করেছিল। তারা এর শেষ দেখে নেবে এ-ও বলেছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। গভীর রাতে কেউ সিদ্দিকুর এবং তার মা-বাবার উপর অ্যাসিড ঢেলে দিয়ে গিয়েছিল। সিদ্দিকুরের মা-বাবাকে বাঁচানো যায়নি। সিদ্দিকুর কোনওমতে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার চোখ, কান, শ্বাসনালীসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিদ্দিকুর আর কোনওদিন চোখে দেখবে না, কানেও শুনবে না। এমনকী এখনও সে ঠিকমত কথাও বলতে পারে না। হাসপাতালেই আছে এই সাত দিন। বারবার কী যেন বলার চেষ্টা করে। তার ভাঙা-ভাঙা কথা শুনে মনে হয় লাল শাড়ি পরা দুটো মেয়ে তাদের উপর অ্যাসিড ঢেলেছে। সেই মেয়েদের শরীরে নাকি অসুরের মত শক্তি। অনেক সময় নিয়ে তারা অ্যাসিড ঢেলেছে। গ্রামের মানুষ এ ঘটনায় খুবই খুশি। সবাই মেয়ে দুটোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।’

রনি বিড়বিড় করে বলল, ‘ধন্যবাদ, আমেনা এবং জমিলা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *