সাধনা – ১০

দশ

সোনালি ক্লিনিকের ব্লাড ব্যাঙ্কের দায়িত্বে যে লোকটা রয়েছে, সে বসে আছে টেবিলের ওপর পা তুলে। আনোয়ার ও শাহেদকে ঢুকতে দেখেও নির্বিকারভাবে পা তুলে রাখল টেবিলের ওপর। ইতিমধ্যে শাহেদকে সব খুলে বলেছে আনোয়ার।

শাহেদের মাথা পরিষ্কার, অল্পতেই সব বুঝে গেছে।

ব্লাড ব্যাঙ্কের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল আনোয়ার, ‘আমরা একটু দরকারে এসেছি। আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য দরকার।’

কুৎসিতভাবে গলা চুলকাতে চুলকাতে বলল লোকটা, ‘কী দরকার? ব্লাড-ফ্লাড এখন হবে না। বিশ্রামে আছি।’

‘তেরোই মার্চ, সন্ধ্যা সাতটায় জাহাঙ্গীর নামে একজন আপনাদের এখান থেকে ব্লাড নিয়েছিল। তার সম্পর্কে তথ্য দরকার।’

‘আমরা এসব তথ্য সংরক্ষণ করি না। আগে বাড়েন। যত্তসব!’

নিজের রিভলভারটা টেবিলে রাখল শাহেদ চৌধুরী। লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগে ঠাস করে চড় মেরে বসল।

যে রোগের যে ওষুধ।

আরেকবার হাত উঁচু করল শাহেদ, ‘হারামজাদা, পা নামিয়ে কথা বল!’

বিদ্যুতের গতিতে উঠে দাঁড়াল লোকটা। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘স্যর, মাফ করে দেন। আপনাদের চিনতে পারিনি।’

‘আমাদের নষ্ট করার মত সময় নেই,’ আনোয়ার বলল, ‘আমাদের জাহাঙ্গীর সম্পর্কে তথ্য দরকার। গত এক মাসে এই লোক কতবার ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিয়েছে?

দ্রুত রেজিস্টার খাতা বের করল লোকটা। ১৩ মার্চ পাতাটা দেখে বলল, ‘স্যর, জাহাঙ্গীর তো রোগীর নাম। ঢাকা মেডিকেলের ব্লাড ক্যান্সারের রোগী। জাহাঙ্গীরের জন্য রক্ত নিয়েছে তার আত্মীয় ইদ্রিস।’

‘ওহ্,’ বলল আনোয়ার, ‘আমার ভুল হয়েছে তা হলে। আচ্ছা, ইদ্রিস গত এক মাসে ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে কতবার রক্ত নিয়েছে, জানাতে পারবেন?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই পারব। যারা এখানে নিয়মিত ব্লাড ডোনেট করে এবং যারা নিয়মিত রক্ত নেয়, তাদের একটা লিস্ট আমাদের কাছে আছে। দেখি সেখানে ইদ্রিসের নাম আছে কি না।’

পাতার পর পাতা উল্টাতে থাকল লোকটা। পনেরো মিনিট পর বলল, ‘হ্যাঁ, ইদ্রিস এখান থেকে নিয়মিত রক্ত নেয়। তার আত্মীয়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে রক্ত লাগে।’

‘ইদ্রিস সম্পর্কে আমাদের সবকিছু জানান,’ বলল আনোয়ার, ‘তার মোবাইল নাম্বার, ঠিকানা-সব।’

মাথা নিচু করে বলল লোকটা, ‘স্যর, অভয় দিলে একটা কথা বলি?’

‘হ্যাঁ, বলেন।’

‘আসলে ইদ্রিস আমাদের এখানেই পার্ট-টাইম কাজ করে। আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম এই ইদ্রিসই সেই ইদ্রিস কি না। তাই আর একবার চেক করে নিচ্ছিলাম।’

শাহেদ বলল, ‘ইদ্রিস আজ এসেছে?’

‘হ্যাঁ, এসেছে। একজন ব্লাড ডোনেট করতে এসেছে, তাকে সাহায্য করছে।’

‘আমাদেরকে সেখানে নিয়ে চলুন।

‘চলুন, স্যর।’

.

কাজ শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে এল ইদ্রিস। আর তখনই তাকে চেপে ধরল শাহেদ। ‘নড়ার চেষ্টা করবি না। একদম মাথায় গুলি করে দেব।’

তোতলাতে শুরু করল ইদ্রিস, ‘স্-স্যর, আ-আমি কী করেছি?’

‘চুপচাপ আমাদের সঙ্গে চল্।’

একটা মাইক্রোবাসে ইদ্রিসকে তুলে নেয়া হলো।

টেনে ইদ্রিসের গেঞ্জিটা খুলে ফেলে যা ভেবেছিল, ঠিক তা-ই দেখল আনোয়ার।

ইদ্রিসের শরীরেও সেই একই উল্কি আঁকা।

ইদ্রিসকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে শুরু করল আনোয়ার আর শাহেদ। প্রথমে মুখ না খুললেও পরে মুখ খুলতে বাধ্য হলো ইদ্রিস। ঘোলাটে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে উঠল আনোয়ার ও শাহেদের কাছে। ইদ্রিসকে নিয়ে থানার দিকে রওয়ানা হলো শাহেদ ও আনোয়ার। আরও অনেক কিছু জানার আছে তাদের। ইদ্রিসের সাহায্য দরকার।

এগারো

দুই দিন পর…

বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন রফিক সাদি। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। নিজেকে এত অসহায় আগে কখনও লাগেনি। তাঁর মেয়ে ঝমঝম কুঠিতে বউ হয়ে গেছে, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? একটু আগে নুযহাত ফোন করেছিল। নেটওয়ার্কের জন্য কথা ভাল শোনা যাচ্ছিল না। শুধু রফিক সাদি এটুকুই বুঝলেন, নুযহাত বলছে-ভাল আছে সে। নুযহাতের এ কথা তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। তিনি কিছু খেতে পারছেন না, মাথায় কেন জানি অসহ্য ব্যথা।

ঠিক এসময় রফিক সাদিকে জানানো হলো, তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন আনোয়ার নামে একজন।

মনে-মনে এই ছেলেটিকেই খুঁজছিলেন তিনি। দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন।

ড্রয়িং রুমে রফিক সাদিকে দেখে হাসল আনোয়ার।

ছেলেটার হাসিটা খুব সুন্দর, ভাবলেন রফিক সাদি। ওই হাসি মনের ভিতর কেমন যেন একটু প্রশান্তি এনে দিল।

আনোয়ার বলল, ‘কেমন আছেন?’

সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে রফিক সাদি বললেন, ‘আমার মেয়ে ঝমঝম কুঠিতে চলে গেছে। এই চিঠিটা রেখে গেছে।’

আনোয়ার একটু চমকে উঠল।

চিঠিটা পড়ে ঢিপঢিপ করতে থাকল বুকের ভিতরটা, কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করল না। মুখ স্বাভাবিক রেখে আনোয়ার বলল, ‘আমি জানি, সবকিছু মিলিয়ে আপনার মনে অনেক প্রশ্ন জমে গেছে। আপনার সব প্রশ্নের জবাব দিতেই এসেছি।’

‘চলো, চা খেতে-খেতে কথা বলি।’

চা এল মাত্র তিন মিনিট পর।

চায়ে চুমুক দিয়ে আনোয়ার বলল, ‘বিষয়টা একটু জটিল। কোথা থেকে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না। যা হোক, সোলেমান গাজির বাবা ইব্রাহিম গাজিকে দিয়েই শুরু করি। ইব্রাহিম গাজি একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষ ছিলেন। পিশাচ সাধনার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। মধ্যবয়সে এক তান্ত্রিকের কথা অনুসারে পিশাচ সাধনা শুরু করেন। এই সাধনার একটাই লক্ষ্য, পিশাচকে কাজে লাগিয়ে অভাবনীয় শক্তি অর্জন করা। ইব্রাহিম গাজি পিশাচকে নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। সেসময় তিনি দূর-দূরান্ত থেকে মেয়েদেরকে ধরে আনতেন। শারীরিক নির্যাতনের পর, পিশাচের উদ্দেশে বলি দিতেন তাদেরকে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি ইব্রাহিম গাজি। তখন তিনি অন্য পথ বেছে নিলেন। নিজের ছেলের মধ্যে পিশাচকে প্রবেশ করাতে চাইলেন। যৌবনে ছেলে সোলেমান গাজির মধ্যেও সাধনার বিষয়টা ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু সোলেমান গাজিকেও পছন্দ করেনি পিশাচ। একসময় ইব্রাহিম গাজি মারা গেলেন। প্রবল উৎসাহে সাধনা চালিয়ে যেতে লাগলেন সোলেমান গাজি। আরও কয়েকজনকে খুঁজে বের করলেন, যারা সবাই এ অন্ধকার পথের বাসিন্দা। তাদেরকে জায়গা দিলেন এলেমদারি বনে। সোলেমান গাজির স্ত্রীও এক পিশাচ সাধক। তাই দু’জনে জমল ভাল। সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁদের সন্তানের জন্মের সাথে- সাথে তাকে পিশাচের উদ্দেশে বলি দেবেন। এত বড় উপহার পেয়ে পিশাচ নিশ্চয় তাঁদের কারও মধ্যে প্রবেশ করবে। জয়ের জন্মের কিছুদিন আগেই হঠাৎ সোলেমান গাজির স্বপ্নে দেখা দিল পিশাচ। সে জানাল, তাঁদের অনাগত সন্তানকে বলি দেয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সন্তানের বয়স যখন একুশ হবে, তখন পিশাচ তার মধ্যে প্রবেশ করবে। সোলেমান গাজির এতদিনের সাধনা যেন ঠিকানা খুঁজে পেল। পিশাচটা আরও জানাল, সে যখন জয়ের মধ্যে প্রবেশ করবে, তখন থেকে নিয়মিত তার রক্ত ও বলি চাই। এর বিনিময়ে সোলেমান গাজিকে পিশাচটা দেবে অভাবনীয় ক্ষমতা ও সম্পদ। তবে চূড়ান্ত সম্পদ আর ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তাঁকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। জয়ের বয়স যখন একুশ, তখন ওর শরীরে প্রবেশ করল পিশাচটা। পিশাচ একবার কারও শরীরে প্রবেশ করলে সেই শরীরটা তার হয়ে যায়। তাই জয়ই পিশাচ, পিশাচই জয়। এরপর থেকে সোলেমান গাজিকে আরও বেশি সচেতন থাকতে হলো। কারণ, পিশাচকে কোনওভাবেই রাগিয়ে দেয়া চলবে না। সে রাগলে, অনর্থক জীবনহানি হবে। একে নিয়ন্ত্রণ করা কোনও সহজ বিষয় নয়। এর প্রধান খাদ্য রক্ত। আর নারীকে উৎসর্গ করলে মিলবে এর সন্তুষ্টি। সোলেমান গাজি নিয়মিত বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত আনা শুরু করলেন। ক্লিনিকের অসৎ কর্মচারীরা এ কাজে সাহায্য করত। প্রতি সাত দিন অন্তর পিশাচের তিন ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হত। দু’ব্যাগ সে পান করত, আর এক ব্যাগ দিয়ে গোসল করানো হত তাকে। আর সাতচল্লিশ, ছাপান্ন বা পঁয়ষট্টি দিন অন্তর কোনও যুবতী মেয়েকে তার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হত। এক সংখ্যাটা পিশাচের জন্য শুভ। কারণ, একের সাথে শনির একটা যোগাযোগ রয়েছে। সাতচল্লিশ সংখ্যাটির দুই অঙ্ক যোগ করলে যোগফল পাওয়া যায় এগারো, অর্থাৎ দুটো এক। ছাপান্ন এবং পঁয়ষট্টির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার, যোগফল এগারো।’

একটু থেমে আনোয়ার আবার বলল, ‘নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যদি কোনও যুবতী মেয়েকে পিশাচের জন্য উৎসর্গ না করা হয়, তবে সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রীর পরিণতি হবে ভয়াবহ। কারণ, তাঁদের আহ্বানেই পিশাচটা এসেছে। সোলেমান গাজি চতুর মানুষ, হিসাবে ভুল করেননি। অনুসারীদের এবং জয়কে এই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। এরা বিভিন্ন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তারপর ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঝমঝম কুঠিতে নিয়ে এসেছে। ঝমঝম কুঠিতে আনার পর এক পর্যায়ে মেয়েগুলোর মাথা কেটে ফেলা হত। তার আগে শরীরে আঁকা হত উল্কি, আর নিয়মিত খাওয়ানো হত ভাঙের শরবত। এরপর সময়মত পিশাচের উদ্দেশে উৎসর্গ করত। উৎসর্গ প্রক্রিয়াটা বেশ অদ্ভুত। প্রথমে খোলা মাঠের মধ্যে মেয়েটাকে হাঁটু গেড়ে বসানো হত। তার ঠিক সামনে থাকত জয়, যার মধ্যে রয়েছে পিশাচটা। এরপর গলায় ইলেকট্রিক তার পেঁচিয়ে, শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলা হত মেয়েটাকে। কয়েকজন তাকে চেপে ধরত, আর একজন একটা ছোট পাত্রে তার মুখের লালা সংগ্রহ করত। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর সেই লালা জয় বা পিশাচকে দেয়া হত। আনন্দ নিয়ে এই লালা পান করত পিশাচ। এতে আরও বাড়ত তার শক্তি। এরপর মেয়েটির মৃতদেহ জয়ের পায়ের কাছে রেখে গলায় সজোরে ছুরি চালানো হত। রক্তে ভিজে যেত জয়ের পা। এতে সন্তুষ্টি বাড়ত পিশাচের। এলেমদারি জঙ্গলের কিছু জায়গায় মোগল যুগের কিছু দামি রত্ন রয়েছে। পিশাচের মাধ্যমে সেগুলো কোথায় জানতে পেরেছেন সোলেমান গাজি। ফলে দু’হাতে আসতে লাগল টাকা। সে টাকার ভাগ তিনি এলেমদারির অন্যান্য লোকদেরও দিয়েছেন।’

ঠাণ্ডা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আবারও বলল আনোয়ার, ‘পিশাচের মাধ্যমে সোলেমান গাজি জানতে পেরেছেন, যদি জয়ের কোনও সন্তান পৃথিবীতে আসে, তবে সে হবে প্রবল ক্ষমতাশালী। সে জয়ের সন্তান হবে না, হবে পিশাচের সন্তান। ইচ্ছা হলে সেই সন্তান সব ধ্বংস করে দিতে পারবে, আবার সব গড়তেও পারবে, পৃথিবীকে আনতে পারবে হাতের মুঠোয়। সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাঁরা নুযহাতকে বেছে নেন।’

চুপ করে শুনছেন রফিক সাদি। তাঁর দিকে চেয়ে আনোয়ার বলল, ‘আমরা ঝমঝম কুঠিতে প্রতিটা মানুষের গায়ে যে উল্কি দেখেছি, সেটা কার অবয়ব, এখন বুঝতে পারছেন?’

রফিক সাদি কাঁপা গলায় বললেন, ‘জয়ের?’

আনোয়ার একটু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ওটা জয়ের অবয়ব।’

‘কিন্তু জয়কে আমার অফিসে দেখলাম স্বাভাবিক আর এলেমদারিতে দেখলাম অপ্রকৃতিস্থ। কারণটা কী?’

‘পিশাচটা যখন ঘুমিয়ে থাকে বা বিশ্রাম নেয়, তখন আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতই আচরণ করে জয়। কিন্তু যখন পিশাচটা সক্রিয় থাকে, তখন জয় প্রতিবন্ধীর মত আচরণ করতে থাকে।’

‘তা হলে এলেমদারির সব লোকই পিশাচের উপাসক?’

‘হ্যাঁ। এরা এলেমদারি বনে বাস করলেও কর্মসূত্রে পুরো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে আছে। এদের কেউ ক্লিনিকে কাজ করে, কেউ অফিসে করে, কেউ দোকানের কর্মচারী। পাশাপাশি এরা শিকারের খোঁজ রাখে। বিভিন্ন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে, তারপর এলেমদারি বনে নিয়ে যায়। সবসময় যে তারা সফল হয়, তা নয়, তবে চেষ্টা চলতে থাকে। আপনি ফারহানা নামে যে মেয়েটাকে ঝমঝম কুঠিতে দেখেছিলেন, তার নীরব নামে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। নীরবই তাকে এলেমদারি বনে নিয়ে যায়। আর বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, জয়ই কখনও নীরব, কখনও আসিফ, কখনও রফিক হয়ে নানা মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।’

‘ফারহানা মেয়েটার কী অবস্থা এখন?’ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন রফিক সাদি।

‘আগামীকাল তাকে পিশাচের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হবে। এটা হবে সোলেমান গাজির আটত্রিশতম শিকার। আটত্রিশতম উৎসর্গ সোলেমান গাজির পিশাচ সাধনাকে পরিপূর্ণতা দেবে। কালকের পরেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতা আর সম্পদ পেয়ে যাবেন তিনি। জয়ের সন্তানকে নিয়ে তিনি পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করতে চান।’

রফিক সাদি ভাঙা গলায় বললেন, ‘আমার মেয়ে তো জয়ের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে, তা হলে ওটা কি পিশাচের সন্তান?’

‘হ্যাঁ, ওটা পিশাচ এবং নুযহাতের সন্তান।’

‘এখন আমরা কী করব?’

‘সোলেমান গাজিকে সফল হতে দেয়া যাবে না। কালকে রাতে যদি আটত্রিশতম উৎসর্গ করতে পারেন, তা হলে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন তিনি। তাঁকে ধরার মত সব প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। আমি প্রস্তুত, পুলিশও প্রস্তুত।’

‘তোমার পরিকল্পনা কী?’

‘কালকে পিশাচটাকে রাগিয়ে দিলে সে সর্বনাশ করবে জয়, সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রীর। এতদিনের সাধনা একদিনেই শেষ হয়ে যেতে পারে। পিশাচ প্ৰথমে এই তিনজনের প্রাণ নেবে। তারপর চিরদিনের মত চলে যাবে। আর আগে থেকেই পুলিশ এলেমদারি বনের বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত থাকবে, সময়মত সবাইকে গ্রেফতার করবে তারা।’

‘আমার মেয়েটা কি মারা যাবে, বাবা?’ প্রায় কেঁদে ফেললেন রফিক সাদি।

‘আপনি শান্ত হোন। চিন্তা করবেন না। আশা করি, নুযহাত আর ফারহানাকে আমরা বাঁচাতে পারব। আর নুযহাতকে তো ওঁরা কোনওভাবেই মারবেন না। কারণ, নুযহাতের গর্ভে জয়ের সন্তান। জয় নুযহাতকে নানাভাবে সম্মোহিত করেছে। ওর হাতে যে তাবিজ আছে, সেগুলো যেভাবে হোক সরাতে হবে। তাবিজের মাধ্যমেই জয় নুযহাতকে নানা নির্দেশনা পাঠাত।’

নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে রফিক সাদি বললেন, ‘তুমি এত কিছু কীভাবে জানলে?’

‘পিশাচ সাধনা বিষয়ে আমার আগে থেকেই ধারণা রয়েছে। প্রচুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল। আর সোলেমান গাজির কাছের সহযোগী ইদ্রিসকে আমরা ধরতে পেরেছি। তার মাধ্যমে আমরা প্রচুর তথ্য পেয়েছি। সোলেমান গাজি যে সাঁইত্রিশজন মেয়েকে হত্যা করেছে, তাদের পরিচয়ও জানতে পেরেছি। বাড়ির পিছনের কবরস্থানে কবর দেয়া হয়েছিল তাদেরকে। আপনাকে এই ধরনের অন্য একটা ঘটনা বলি। উনিশ শ’ সাতানব্বুই সালে ইন্দোনেশিয়ায় পুলিশ আহমাদ সুবাদজি নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। সেই লোকও পিশাচ সাধক ছিল। বিভিন্ন নারীকে ধরে ইলেকট্রিক তার পেঁচিয়ে হত্যা করত। এরপর পান করত তাদের লালা। এরপর বাড়ির সামনেই কবর দিত লাশগুলোর। তবে আসলেই পিশাচ তার ওপর ভর করেছিল কি না, সে ব্যাপারে অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়ার আদালত লোকটাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আসলে সোলেমান গাজির মত এমন ভয়ঙ্কর লোক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।’

‘আমি আর এসব কিছু শুনতে চাই না, আমার মেয়েকে তুমি বাঁচাও।’

‘আপনাকে এবং ড্রাইভার মহসিনকে কালকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। মহসিন এলেমদারি বনের বাইরে থাকবে। আপনি আর আমি ভেতরে যাব। আপনি সুযোগ বুঝে ফারহানা আর নুযহাতকে নিয়ে পালাবেন। এরপর সোজা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন।’

‘আর তুমি?’

‘প্রথমে নিজে, এরপর আমার বন্ধু শাহেদকে নিয়ে বাকিটা সামলাব। চিন্তার কিছু নেই।’

‘কিন্তু আমরা ওদের ওখানে যাব কীভাবে? মানে উৎসর্গের সময় ওরা আমাদেরকে দেখলে কিছু বলবে না?’

‘আমরা ওদের একজন হয়েই যাব। প্রতি উৎসর্গের সময় এলেমদারির বাসিন্দারা কালো জোব্বার মত পোশাক পরে, নাক-মুখ ঢাকা থাকে কালো কাপড়ে। এ ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করছে ইদ্রিস। তার কাছ থেকে এমন দুটো পোশাক জোগাড় করেছি। ওই দুটো পরেই কালকে আমরা এলেমদারি বনে যাব। প্রস্তুত থাকবেন। দুপুরের দিকে রওনা দেব আমরা।’

‘অবশ্যই প্রস্তুত থাকব,’ বললেন রফিক সাদি

‘ব্যাগে আপনার জন্য পোশাক নিয়ে এসেছি। একটু ঢিলাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দর্জির দোকান থেকে আজই ঠিক করিয়ে নেবেন।’

‘ঠিক আছে।’

আনোয়ার উঠে দাঁড়াল। তারও দরকার ব্যাপক প্রস্তুতি।

বারো

কালো জোব্বা পরেছে আনোয়ার আর রফিক সাদি। মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে। শাহেদের দিকে তাকিয়ে আনোয়ার বলল, ‘রফিক সাহেব আর আমি বনে ঢুকছি। এখন রাত এগারোটা। ওদের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে বারোটার পর। ইদ্রিসের মাধ্যমে যে শর্টকাট পথের কথা জানতে পেরেছি, ওই পথেই যাব। এরপর ঝমঝম কুঠির কাছে গিয়ে দূর থেকে লক্ষ রাখব ওদের ওপর। সুযোগ বুঝে মিশে যাব ওদের দলের সাথে।’

‘একবারে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ওখানে অভিযান চালালে ভাল হত না?’ বলল শাহেদ।

‘পিশাচের মোকাবেলা করার নিয়ম পুলিশ জানবে না। মিস্টার সাদি আর আমার লাইসেন্স করা অস্ত্র সাথে রাখছি। তোর ফোর্সের লোকজন এলেমদারি বনের নানান জায়গায় রাখ। গুলির শব্দ পেলেই অ্যাকশনে যাবি, তার আগে নয়।’

‘ঠিক আছে। তোর ওপর আমার ভরসা আছে। জানি, অনর্থক ঝুঁকি নিবি না।’

‘চিন্তা করিস না।’

দেরি না করে রফিক সাদি ও আনোয়ার ঢুকে পড়লেন এলেমদারি বনে। বনের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিল শাহেদ চৌধুরীর ফোর্স। বনের বাইরে হাইওয়েতে গাড়িতে অপেক্ষা করছে মহসিন।

.

অন্ধকারে ছোট একটা টর্চ জ্বেলে নতুন এক পথ ধরে ঝমঝম কুঠির দিকে যাচ্ছেন রফিক সাদি ও আনোয়ার। ঝমঝম কুঠিতে সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে, তাই আশপাশটা বেশ আলোকিত। ঘন গাছপালা এড়িয়ে এগোতে হচ্ছে, কাজটা যথেষ্ট কঠিন। রাতের পোকামাকড় হুট করে বেয়ে উঠছে তাঁদের শরীরে। ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল এক কাঁটাযুক্ত গাছ, তবুও দাঁতে দাঁত চেপে তা সহ্য করল আনোয়ার, বুঝতে দিল না রফিক সাদিকে।

আনোয়ার পুরোপুরি নির্লিপ্ত হলেও বেশ ভয় লাগছে রফিক সাদির। কেন জানি মনে হচ্ছে, মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফেরা হবে না।

.

ঝমঝম কুঠি থেকে খানিক দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ার ও রফিক সাদি। আশপাশে টের পাওয়া যাচ্ছে বেশ চাঞ্চল্য। হঠাৎ ওরা দেখল, দল বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে কালো কাপড় পরা একদল মানুষ। বিড়বিড় করে মন্ত্রের মত কিছু বলছে।

চাপা গলায় বলল আনোয়ার, ‘দেরি না করে ওদের পিছনে জুটে যাব আমরাও। কোনও কথা বলবেন না। কোনও কিছু করার দরকার নেই। তবে আমি ইঙ্গিত করলে প্রথম সুযোগেই ফারহানা আর নুযহাতকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন। বুঝতে পেরেছেন?

মাথা নাড়লেন রফিক সাদি।

দলের পিছনে হাঁটতে লাগল দু’জন।

পিছনে পড়ল ঝমঝম কুঠি। কবরস্থানকে পাশ কাটিয়ে ওরা গিয়ে দাঁড়াল মাঠে। আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন সোলেমান গাজি। জ্বলছে বিশাল আগুন। সবার হাতে-হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে ভাঙের শরবত। ছোট মঞ্চে দাঁড়িয়ে সোলেমান গাজি। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জয়, পাশে নুযহাত। ওর চোখ বন্ধ। কোথায় আছে বোধহয় জানে না, জানতেও চায় না। হাঁটু গেড়ে বসে আছে ফারহানা, থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। অপেক্ষা করছে মৃত্যুর জন্য। ভাল করেই জানে, উৎসর্গ করা হবে তাকে।

কয়েক ব্যাগ রক্ত হাতে অপেক্ষা করছে একজন, ইঙ্গিত পেলেই ঢেলে দেবে পিশাচের মুখে।

এসব রক্ত মেটাবে পিশাচের পিপাসা। সে আরও পান করবে আটত্রিশতম মেয়ের লালা। এরপর বেচারীর তাজা রক্তে ভিজিয়ে নেবে পা। এতদিনের সাধনা সার্থক হবে সোলেমান গাজির। কিন্তু কোনওভাবেই পিশাচকে রাগিয়ে দিলে চলবে না, সেক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে সোলেমান গাজির জীবনে 1

ছোট মঞ্চের ওপর সংস্কৃত ভাষার মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন সোলেমান গাজি। তা শুনে যেন সজাগ হলো জয়। মুখে ফুটল ভয়ঙ্কর হাসি। বুঝে গেছে, একটু পরেই খাবার হিসাবে আসছে মেয়েদের লালা, ভিজবে রক্তে পা।

গম্ভীর কণ্ঠে বলল জয়নাল, ‘আহ্! মানুষের রক্ত! পিশাচ শ্রেষ্ঠ, মানুষ নির্বোধ।’

চারদিক ভরে উঠেছে ধূপের গন্ধে। অপার্থিব এক পরিবেশ। মন্ত্রের তালে- তালে দুলছে কালো কাপড় পরা মানুষ। বারবার স্পর্শ করছে শরীরের উল্কি তারাও ক্ষমতা ও সম্পদ চায়। জয়ের পুরো শরীরে কিছু ঘটছে, মুখ থেকে বেরোচ্ছে হিংস্র জন্তুর মত শব্দ।

হঠাৎ সোলেমান গাজি ইঙ্গিত করলেন পিশাচের মুখে রক্ত ঢালতে।

দ্রুত এগিয়ে গেল আনোয়ার, চোখের নিমিষে লোকটির হাত থেকে কেড়ে নিল রক্তের ব্যাগদুটো।

ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকল লোকটি।

সবার চোখের সামনেই রক্তের ব্যাগগুলো ফুটো করে বহুদূরে ছুঁড়ে দিল আনোয়ার। যেন আগুন বেরোতে থাকল পিশাচটার চোখ থেকে। লোহার মত শক্ত হয়ে উঠল মুখের মাংসপেশি। রেগে উঠেছে হঠাৎ করেই!

চেঁচিয়ে উঠলেন সোলেমান গাজি, ‘কী হচ্ছে এখানে? অ্যাই, ওই নির্বোধটাকে কেউ ধর! আজ ওর রক্তেই তাঁর পিপাসা মিটবে।’

পকেট থেকে রিভলভারটা বের করল আনোয়ার, ধমকে উঠল, ‘খবরদার! কেউ কাছে আসবে না! একদম শেষ করে দেব!’

একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, কিন্তু এগোবার সাহস নেই কারও।

হঠাৎ চোখ মেলে তাকাল নুযহাত, উঠে দাঁড়িয়েছে ফারহানাও। পিপাসায় ছটফট করছে জয়। রফিক সাদির দিকে ইঙ্গিত করল আনোয়ার, পরক্ষণে আকাশে গুলি করল।

নুযহাত ও ফারহানার পিছনে এসে থেমেছেন রফিক সাদি। মাথাটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা বলে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি কেউ। ছুরি দিয়ে কেটে দিলেন নুযহাতের হাতের তাবিজ। খুব কাছে গিয়ে কী যেন বললেন তিনি নুযহাত ও ফারহানাকে।

ঘোরটা কেটে গেছে নুযহাতের। একই অবস্থা ফারহানার। পিছাতে শুরু করেছে ওরা তিনজন।

সবার নজর আনোয়ারের ওপর। কারও খেয়াল নেই নুযহাত এবং ফারহানার দিকে। সুযোগ বুঝে ওরা সরে যেতে শুরু করেছে।

গুলির শব্দ পৌঁছে গেছে শাহেদ চৌধুরীর কানে, কিছুক্ষণের ভিতর এখানে চলে আসবে পুলিশ। চিৎকার করে বলল আনোয়ার, ‘বাঁচতে হলে সবাই পালাও! পুলিশ আসছে!’

দূরে শোনা গেল পুলিশের বাঁশির শব্দ।

পিশাচ সাধক হলে কী হবে, লোকগুলো এক-একটা কাপুরুষ। সবাই নানান দিকে দৌড় দিল, ভাবছে পালিয়ে যেতে পারবে জঙ্গলে।

এই সুযোগে মহাসড়কের দিকে ছুটলেন রফিক সাদি, নুযহাত ও ফারহানা। মাত্র এক মিনিট পেরোবার আগেই মাঠে থাকলেন শুধু সোলেমান গাজি, তাঁর স্ত্রী, জয়ের শরীরধারী পিশাচ ও আনোয়ার।

মন্ত্রপাঠ চালিয়ে পিশাচকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন সোলেমান গাজি। মঞ্চে উঠে রিভলভারের বাঁট দিয়ে সোলেমান গাজির মাথায় জোর এক গুঁতো বসিয়ে দিল আনোয়ার। মন্ত্রপাঠ থেমে গেল সোলেমান গাজির।

সংস্কৃত ভাষার কিছু দরকারি মন্ত্র আনোয়ারের মুখস্থ। পকেট থেকে বের করে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দিল বেলি ফুলের মালা। এই ফুল পছন্দ নয় পিশাচের। জোরে-জোরে মন্ত্রপাঠ শুরু করল আনোয়ার।

এতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে থরথর করে কাঁপতে লাগল জয়ের শরীর। দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে চিৎকার করে উঠল পিশাচ। সহ্য করতে পারছে না, তার চাই রক্ত। এদিকে আনোয়ারের মন্ত্র সৃষ্টি করছে তার শরীরে যন্ত্রণা।

সোলেমান গাজির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পিশাচ। বড়-বড় নখ গেঁথে গেল সোলেমান গাজির পেটের মধ্যে।

ভয়ানক ব্যথা পেয়ে বিকট এক আর্তনাদ ছাড়লেন সোলেমান গাজি। ধড়াস্ করে পড়লেন মঞ্চের মেঝেতে। এদিকে তাঁর স্ত্রী বেগতিক বুঝে ছুট দিলেন বেসামাল হরিণীর গতি তুলে। খেয়ালই নেই, পিশাচটা ক্ষতবিক্ষত করছে তাঁর স্বামীর দেহ।

পিশাচকে ডেকে এনে সন্তুষ্ট করতে পারেননি সোলেমান গাজি, তাই আজ নিস্তার নেই তাঁর। জোরালো আওয়াজ তুলে লোকটার ঘাড়টা ভেঙে দিল পিশাচ। বড়-বড় নখ দিয়ে টেনে বের করতে লাগল হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও পাকস্থলি। পিপাসা মিটিয়ে নিতে হবে শত্রুর রক্তে। কিন্তু চোঁ-চোঁ করে কয়েক লিটার রক্ত চুষে নিয়েই তার চোখ পড়ল আনোয়ারের ওপর। মন্ত্রপাঠ শেষ করেছে ওই শত্রু, স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে চলে যেতে হবে পিশাচকে।

কিন্তু আনোয়ারকে খতম না করে যাওয়ার ইচ্ছা নেই পিশাচটার। ভয়ঙ্কর রাগ তার। তাড়ানোর জন্য মন্ত্র পড়ছে নির্বোধ মানুষ! ওই লোক কি জানে না, আসলে সে কী করতে পারে!

শত্রুর দিকে এগোতে শুরু করল পিশাচ, কিন্তু এক পা-ও পিছিয়ে গেল না আনোয়ার। পালানোর চেষ্টাও করল না। পিশাচের চোখে চোখ রেখে এগোতে লাগল। বলল, ‘চলে যাও! চলে যাও! তোমাকে উপাসনার কেউ নেই, মানুষ নিজেই ক্ষমতাশালী, তার দরকার নেই পিশাচের ক্ষমতা!’

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল পিশাচ। আশ্চর্য, এই মানুষটা তাকে ভয় পাচ্ছে না, উল্টো তারই কেমন ভয়-ভয় লাগছে!

আনোয়ার চিৎকার করে আবারও পড়তে শুরু করেছে সংস্কৃত মন্ত্ৰ।

গুরুগম্ভীর ওই মন্ত্র শুনতে শুরু করে হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াল পিশাচটা। টের পেল, আর এগোতে পারছে না সে।

অদৃশ্য কোনও শুভ শক্তিতে যেন বলীয়ান আনোয়ার। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলল: ‘তুমি আর এগোবে না! একটু এগোলেই ধ্বংস তোমার সুনিশ্চিত! হাঁটু গেড়ে বসো! পরাজয় স্বীকার করো মানুষের কাছে!’

এদিকে কুচকুচে কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। হঠাৎ করেই চারপাশে শুরু হলো দমকা, ঝোড়ো বাতাস। মেঘে নীলচে আলো এঁকে-বেঁকে ঝলসে উঠল, পরক্ষণে কড়-কড়াৎ আওয়াজে কাছেই নামল বাজ। বাতাসের ঝটকা লেগে আনোয়ারের মনে হলো, যেন সামান্য পাতার মত উড়ে যাবে সে। কেউ যেন ক্রমাগত হামলা করতে চাইছে, কিন্তু কোথায় যেন বাধা। ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে সরে গিয়ে যেন আসতে চাইছে আনোয়ারের ক্ষতি করতে!

দৃঢ় কণ্ঠে বলল আনোয়ার, ‘হাঁটু গেড়ে বসো! পরাজয় স্বীকার করো! মানুষই শ্রেষ্ঠ!’ আনোয়ার কথাটা মাত্র বলেছে, এমন সময় হঠাৎ কী যেন একেবারে বিদ্যুতের গতিতে লাগল পিশাচের বুকে। বিকট হাহাকার করে উঠল পিশাচটা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মঞ্চে।

সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে আনোয়ারের। চোখ বন্ধ করে আবারও বলল, ‘নতি স্বীকার করো! হাঁটু গেড়ে বসো! তোমার উপাসনার জন্য কেউ নেই, কেউ নেই…চলে যাও…চলে যাও…’

কত সময় পেরিয়ে গেছে আনোয়ার জানে না। হঠাৎ চোখ মেলে দেখল, হাঁটু গেড়ে বসে আছে জয়। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।

আনোয়ার জানে, নির্বোধ এই প্রাণীটাকে আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন উপাসনা করলেও আসবে না ওই ভয়ঙ্কর পিশাচ।

পুলিশ ফোর্স নিয়ে চলে এসেছে শাহেদ চৌধুরী।

আনোয়ার জয়কে স্পর্শ করতেই লুটিয়ে পড়ল তার দেহ।

চলে গেছে পিশাচটা, কিন্তু যাওয়ার আগে নিয়ে গেছে জয়ের প্রাণটা। হঠাৎ এলেমদারি বনে শোনা গেল পোকামাকড়ের স্বাভাবিক শব্দ। বনের ঘোলাটে অন্ধকারটা কেটে গেছে।

শাহেদ চৌধুরীর দলের পুলিশ-সদস্যরা গ্রেফতার করেছে সোলেমান গাজির বেশিরভাগ সঙ্গীদেরকে। কিন্তু পালিয়ে গেছেন সোলেমান গাজির স্ত্রী।

কিছুক্ষণ পর নুযহাত ও ফারহানাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা দিলেন রফিক সাদি।

তেরো

দুই মাস পর…

রফিক সাদির ফোন পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গেল আনোয়ার। প্রসব বেদনা উঠেছে নুযহাতের। ঝমঝম কুঠি থেকে ফিরেই বাচ্চাটা নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন রফিক সাদি। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, এখন বাচ্চা নষ্ট করতে চাইলে মায়ের ক্ষতি হবে, মারাও যেতে পারে রোগিণী। আনোয়ারের হাত ধরে বললেন রফিক সাদি, ‘এখন কী হবে? এই সন্তান জন্ম নিলে বহু মানুষের ক্ষতি করবে। ও তো পিশাচের সন্তান।’

মুখে হাত বুলাতে-বুলাতে বলল আনোয়ার, ‘শুধু পিশাচের সন্তান নয়, নুযহাতেরও সন্তান।’

‘মানে?’

‘এই বাচ্চাটার মধ্যে মানুষ সত্তা বা পিশাচ সত্তা দুটোই থাকবে।’

‘কী বলতে চাও তুমি?’

‘যদি বাচ্চাটাকে খুব ভাল পরিবেশ দেয়া যায়, হয়তো কখনও তার পিশাচ সত্তা বেরোবে না। কিন্তু ….

‘কিন্তু কী?’

‘তার যে অভাবনীয় ক্ষমতা রয়েছে, তা চিরকাল গোপনও রাখা যাবে না। একসময় সে জানবে সবই। যেমন ধরুন, যখন সে রাগ করবে, তখন হয়তো দূর থেকেই কাউকে শাস্তি দিতে পারবে, কাউকে দূর থেকে সম্মোহিত করতে পারবে। এসব আবিষ্কার করার পরে নিয়মিত এগুলোর চর্চা করবে। আর চর্চার ফলে তার ক্ষমতাও বাড়তে থাকবে।’

‘আমি এত ঝামেলা চাই না। জন্মের পরেই একে মেরে ফেলতে হবে।’

‘কিন্তু একটু চেষ্টা করলে হয় না? প্রবল চেষ্টা করলে হয়তো কোনও দিনও তার পিশাচ সত্তাটা জেগে উঠবে না।’

‘আমি কোনও চেষ্টা করতে চাই না। ধরে নিলাম বাচ্চাটা মানুষের মতই বেড়ে উঠল। কিন্তু কী পরিচয়ে তাকে আমি মানুষ করব?’

আনোয়ার চুপ করে রইল।

রফিক সাদি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি আমার মেয়েকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাব। ঝমঝম কুঠি থেকে ফেরত আসার পরেই নুযহাত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, তাই তাকে সুস্থ করতে হবে। এই আবর্জনাকে কোনও অবস্থাতেই গ্রহণ করব না।’

‘তা হলে কী করতে চান?’

‘আমার অনুরোধ, তুমি একে মেরে ফেলবে।’

‘আমি? মেরে ফেলব! কী বলছেন এসব!’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।

‘হ্যাঁ, বাবা, প্লিজ, এতে না বোলো না। তুমি আমার মেয়ের জন্য এত কিছু করেছ, এই শেষ উপকারটুকু করো। হাতজোড় করে তোমার কাছে অনুরোধ করছি,’ ধরা গলায় বললেন রফিক সাদি।

দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল আনোয়ার।

যথাসময়ে স্বাভাবিক ডেলিভারির মাধ্যমে নুযহাতের ফুটফুটে ছেলে হলো। দেখতে কী সুন্দর, চোখ ফেরানো যায় না। টানা-টানা চোখ, গোলাপি ঠোঁট আর ধবধবে সাদা গায়ের রং।

রফিক সাদি এক মুহূর্ত দেরি না করে বাচ্চাটাকে আনোয়ারের কোলে তুলে দিলেন। বললেন, ‘কাল সকালেই নুযহাতকে এখান থেকে নিয়ে যাব। ভিসা- পাসপোর্ট রেডি। দশ দিন পর কানাডা চলে যাচ্ছি আমরা। ওখানে আমার বড় ভাই থাকেন। নুযহাতকে আর দেশে ফিরতে দেব না, কিন্তু হয়তো একসময় ফিরব আমি। তুমি এই আবর্জনাটাকে আজ রাতেই শেষ করে দাও। এটা নুযহাতের নয়, পিশাচের সন্তান।’

আনোয়ারের পকেটে দশ লাখ টাকার চেক গুঁজে দিলেন রফিক সাদি, তারপর বললেন, ‘প্লিজ, রাখো এটা, কোনও প্রতিদান হিসেবে নেবে না। তুমি যা করেছ, তার প্রতিদান শুধু জীবন দিয়েই দেয়া যায়। এই টাকা এক কৃতজ্ঞ বাবার উপহার। নুযহাত যেমন আমার সন্তান, তেমনি তুমিও আমার সন্তান।

আর মানা করল না আনোয়ার।

বাচ্চাটাকে ভালভাবে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে চুপিচুপি ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এল আনোয়ার। ওখানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, তাই ভয়েরও কারণ নেই। বাচ্চাটার জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা, এখনই চারদিকে তাকাচ্ছে। আনোয়ারের শরীরের সঙ্গে লেগে আছে সে। মনে হচ্ছে আনোয়ারই তার সবচেয়ে আপন। এত ছোট বাচ্চা এর আগে কোলে নেয়নি ও। বাচ্চাদের শরীরে এত সুন্দর ঘ্রাণ থাকে, তা ও আগে জানত না। আনোয়ার ভাবছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে কী করবে। কোনও নদী বা খালে ফেলে দেবে? নাকি রাস্তায় ফেলে রাখবে?

কিন্তু মনের অন্য এক অংশ আনোয়ারকে কঠোর সুরে বলল, এটা মানুষের বাচ্চা, মানুষ হয়ে মানুষকে হত্যা করলে নরকেও স্থান হবে না হত্যাকারীর। সত্যি যদি এই বাচ্চা একসময় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তখন দেখা যাবে। কোনও ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোনও বাচ্চাকে কখনোই হত্যা করা যায় না।

বাচ্চাটাকে হত্যা করতে পারল না আনোয়ার, রাতে রাখল এক এতিমখানার বারান্দায়। কে জানে, হয়তো ওখানেই মারা যাবে বাচ্চাটা, কিংবা হয়তো তাকে কোলে তুলে নেবে কেউ।

মনে-মনে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করল আনোয়ার: ‘হে, পরম করুণাময়, এই বাচ্চা যেন চিরকাল মানুষ হিসাবেই বেড়ে ওঠে। তুমি তাকে করুণা করো। তার খারাপ সত্তাটা যেন কখনও জেগে না ওঠে।’

কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে ওর, চোখে চলে এল জল। আরেকবার বাচ্চাটাকে দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগল নিজ বাড়ির উদ্দেশে।

চোদ্দ

ছয় বছর পর…

রাতটা একটু অন্যরকম। অনেক আলোতেও সবকিছু কেমন আবছা, দূরের পৃথিবীকে মনে হচ্ছে অপার্থিব জগতের দৃশ্য। চোখটা কেন জানি বিশ্রাম চাইছে, কিছু দেখতেও যেন কষ্ট।

রাস্তায় জ্বলছে টিমটিমে আলো। কিছু সময় পর পর তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দুই-একটা গাড়ি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। আজ তার বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। ভাল লাগছে একা-একা হাঁটতে। আবার কেন জানি হচ্ছে অজানা এক আশংকা। পথ আগলে দাঁড়িয়েছে কয়েকটা কুকুর। চাপা স্বরে চিৎকার করছে তারা। হাতের নড়াচড়া এবং মুখের শব্দেও পালিয়ে গেল না। লক্ষ্যে অবিচল, সামনে এগোতে দেবে না মানুষটাকে। কিন্তু ভয় পেল না সে। দেখাই যাক কী করতে চায় কুকুরগুলো। বোঝা যাচ্ছে ইচ্ছা নেই কামড়ানোর। একটা কুকুর মুখ দিয়ে ঠেলতে লাগল তাকে। সামনে এগোতে লাগল আরও দুটো। এমন একটা ভাব, যেন কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে। কুকুরগুলোর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দিল সে। বড় রাস্তা বাদ দিয়ে ছোট এক গলিতে ঢুকল কুকুরগুলো। ওদের পিছে যেতে লাগল মানুষটাও।

একটা গলি পেরিয়ে ছোট রাস্তা পাওয়া গেল। এখানে দেখা যাচ্ছে ক’জন মানুষ। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে গল্প করছে কেউ। যানবাহনের ভিড়ও এখানে একটু বেশি। হঠাৎ আনোয়ার নামের সেই মানুষটা লক্ষ করল, রাস্তার পাশে ভিক্ষা করছে এক মহিলা। তার সামনে শুয়ে আছে একজন মানুষ। একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে তাকে। সেদিকে এগিয়ে গেল কুকুরগুলো। তাই করল আনোয়ারও। ওকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল মহিলা, ‘ভাই গো! আমার বাচ্চাড়া মইরা গেছে। দাফন-কাফনের টাকা নাই। কিছু সাহায্য করেন।’

মনটাই খারাপ হয়ে গেল আনোয়ারের। প্রথমে ভেবেছিল, ঘুমিয়ে আছে কেউ, এখন বোঝা যাচ্ছে, মারা গেছে। শরীরে কোনও নড়াচড়া নেই, নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের কোনও চিহ্নও নেই। আনোয়ার পকেট থেকে এক শ’ টাকার একটা নোট মহিলার দিকে এগিয়ে দিল। কান্না থামিয়ে টাকাটা হাতে নিল মহিলা। কৃতজ্ঞতার ছায়া পড়ল মুখে। বলল, ‘আল্লাহ আপনার ভাল করুন।’

আনোয়ার ভাবল, একটু কথা বলা যাক মহিলার সাথে।

‘আপনি থাকেন কোথায়?’

‘এই তো, একটু সামনের বস্তিতে।’

‘আপনার স্বামী কোথায়?’

‘উনি বাসাতে।’

‘কী করেন আপনার স্বামী?’

‘রমনা পার্কে চা-সিগারেট বিক্রি করে।’

‘আপনার ছেলে মারা গেছে কখন?’

মহিলা উত্তর দেয়ার আগেই সবাইকে চমকে দিয়ে চাদর সরিয়ে উঠে বসল ছেলেটা। তেমন অবাক হয়নি আনোয়ার। বুঝতে পেরেছে পুরোটাই এই মহিলার ভণ্ডামি। নিজের ছেলেকে মৃত সাজিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা। মহিলাকে কঠিন এক ধমক দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আনোয়ার, তখন দেখতে পেল ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মহিলার মুখ। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। মহিলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাচ্চা ছেলেটা। এখন লক্ষ করা যাচ্ছে তার বুকের ওঠা-নামা।

আনোয়ার বলল, ‘কী উঠে দাঁড়ালে কেন? নিজের বাচ্চাকে মৃত সাজিয়ে ব্যবসা? দাঁড়াও, তোমাকে পুলিশে দেব।’

বাচ্চা ছেলেটাও ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার মধ্যে তেমন কোনও ভাবান্তর নেই।

আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল মহিলা, ‘এ হতে পারে না! পারে না!’ বলতে-বলতে সজোরে দৌড় দিল সে। একজন মহিলা এত জোরে দৌড়াতে পারে জানা ছিল না আনোয়ারের।

আশপাশে আরও কিছু মানুষ এগিয়ে এসেছে। তারা আনোয়ারকে বলতে লাগল, ‘এই মহিলা গত কয়েক ঘণ্টা ধরে ছেলের লাশ নিয়ে এখানে বসে আছে। অনেকেই সাহায্য করেছে। আসলে সব প্রতারণা। মা-ছেলে মিলে ভাল ব্যবসা শুরু করছে।’

উৎসুক এক লোক বলল বাচ্চাটাকে পুলিশে দিতে। ছোটবেলা থেকেই ঠক- বাটপারি শিখেছে।

আরেকজন বলল, ‘না। পুলিশে দিলে কাজ হবে না। আমরাই দু’-এক ঘা বসিয়ে দিই।’

আরও কয়েকজন তাকে সমর্থন জানাল।

সবাইকে শান্ত করতে চাইল আনোয়ার। যাকে ঘিরে এত উত্তেজনা সে একেবারে নীরব। আনোয়ার বলল, ‘এই, ছেলে, তোমার বাড়ি কোথায়?’

ছেলেটা কিছু বলল না।

আরেকজন মুখ খুলল, ‘ওই, ঠিকঠাক বল, তোর বাড়ি কোথায়?’

ছেলেটা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘জানি না।’

নানা প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করা হলেও একই উত্তর দিল সে: জানি না।

রাত হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পর ভিড় হালকা হবে, ভেবেছিল আনোয়ার। কিন্তু উৎসাহ হারিয়ে বিদায় নিল না বেশিরভাগ মানুষ। নানান মন্তব্য করছে।

আনোয়ার ভেবেছিল, বাড়ি ফিরবে। তারপর মনে হলো, কে জানে, বাচ্চাটা হয়তো তার বাসা চেনে না। একে দেখে পথশিশু বলেও মনে হচ্ছে না। যেন কোনও সচ্ছল পরিবারের সন্তান। যদিও কাদামাটি মেখে আছে শরীরে, পরনে ছেঁড়া প্যান্ট ছাড়া কিছুই নেই, তবুও চেহারার মধ্যে কেমন এক আভিজাত্যের ভাব।

‘আপনারা ভিড় করবেন না, আমি ওকে থানায় নিচ্ছি, ভিড় করা লোকগুলোকে বলল আনোয়ার। ওর দাপটের ভঙ্গি দেখে সবাই ধরে নিল, ও নিজেই আসলে পুলিশের বড় অফিসার।

কয়েকজন চামচার মত সায় দিল ওর কথায়।

কেউ আপত্তি করছে না দেখে ছেলেটার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে ওই জায়গা থেকে সরে এল আনোয়ার। অনেকটা দূরে এসে বলল, ‘তুমি এখন কী করবে?’

‘আপনার সাথে যাব।’ স্পষ্ট এবং শুদ্ধ উচ্চারণ ছেলেটির।

‘আমার সাথে যাবে?!’

‘হ্যাঁ।’

‘যে মহিলাকে দেখলাম, সে কি তোমার মা?’

ছেলেটা উত্তর দিল না। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল দূরে।

‘আমার সাথে কোথায় যাবে তুমি?’ আবার জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।

‘আপনার বাসায় যাব।’

‘এটা সম্ভব নয়। তুমি ঠিকানা বলো, বা তোমার মা-বাবার কারও মোবাইল নাম্বার থাকলে বলো। আমি তোমাকে পৌছে দেব।’

ছেলেটা কাঁদতে লাগল।

আনোয়ারের মনে হলো কোনও কোনও বাচ্চার কান্নার মধ্যেও আছে সৌন্দর্য।

বেশ কিছুক্ষণ বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর জিজ্ঞেস করল আনোয়ার, ‘তুমি তো আমাকে চেন না, আমার সাথে গিয়ে কী করবে?’

‘আমি আপনার সাথে যাব,’ যেন একটাই কথা জানে ছেলেটা।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আজ রাতে আমার সাথে থেকো। কাল তোমার মা- বাবাকে খুঁজে বের করব।’

ছেলেটা চোখ মুছল।

আশপাশে তাকিয়ে কুকুরগুলোকে আর দেখতে পেল না আনোয়ার।