সাধনা – ২০

বিশ

কবরস্থানের গার্ডের কাছ থেকে রাইয়ান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারল আনোয়ার। লাশ চুরি হয়েছে তা ইতিমধ্যে রাইয়ানের পরিবারকে জানিয়েছে গার্ড, কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ করেনি।

এই মুহূর্তে রাইয়ানের বাবা মুবিন চৌধুরীর সামনে বসে আছে আনোয়ার। বেশ ক’দিন দেখা করতে চেয়েছে, কিন্তু সুযোগ মেলেনি। শেষপর্যন্ত আজ রাজি হয়েছেন মুবিন চৌধুরী, যদিও আনোয়ারের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ সংশয়ে আছেন তিনি

মুবিন চৌধুরী আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বললেন, ‘আমার কাছে কী দরকার?’

শান্ত গলায় বলল আনোয়ার, ‘আসলে আপনার ছেলে রাইয়ান সম্পর্কে একটু আলাপ করতে এসেছি।’

মুবিন চৌধুরী বললেন, ‘রাইয়ান! রাইয়ানকে নিয়ে কী কথা?’

‘রাইয়ান কবে মারা গিয়েছিল, কীভাবে মারা গিয়েছিল, এই বিষয়টা আমি জানতে চাই।’

‘আমি এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে চাই না।’ চোখ আরেক দিকে সরিয়ে নিয়ে বললেন মুবিন চৌধুরী। ‘আপনি আসলে কে, বলুন তো?’

‘রাইয়ানের লাশ চুরি হয়েছে, জানেন তো?’

ভয়ের ছায়া পড়ল মুবিন চৌধুরীর চেহারায়। তিনি ভীত গলায় বললেন, ‘আপনি কি গোয়েন্দা বিভাগের কেউ?’

মাথা নেড়ে বলল আনোয়ার, ‘আমি গোয়েন্দা নই।’ একটু বিরতি দিয়ে বলল, ‘আসলে রহস্যময় এবং ব্যাখ্যাতীত বিষয়গুলো সম্পর্কে এক ধরনের আগ্রহ আছে আমার। নিতান্ত কৌতূহল থেকেই এসব বিষয়ের পিছনে ঘুরে বেড়াই।’

‘এর সাথে রাইয়ানের কী সম্পর্ক?’

‘আমার মনে হচ্ছে, রাইয়ানের মধ্যে এক ধরনের রহস্য ছিল, যেটা আপনি জানেন।’

‘এমন কিছু আমার জানা নেই। আর নিজের পারিবারিক বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলব না।’ কড়া গলায় বললেন মুবিন চৌধুরী, ‘আপনি এখন আসুন।’

অনেকভাবে বোঝাতে চেষ্টা করল আনোয়ার, কিন্তু মুবিন চৌধুরী অনড়। পারিবারিক বিষয়ে তিনি কোনও কথা বলবেন না।

শেষ চেষ্টা করল আনোয়ার। ‘আপনি কি জানেন, আপনার ছেলে রাইয়ান বেঁচে আছে?’

ভয়ানকভাবে চমকে উঠলেন মুবিন চৌধুরী। মুহূর্তেই ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল মুখমণ্ডল। এক দৃষ্টিতে আনোয়ারের দিকে চেয়ে রইলেন। বললেন, ‘কী বললেন? রাইয়ান বেঁচে আছে?!’

‘হ্যাঁ, সবই বলব,’ জবাবে বলল আনোয়ার। ‘তবে তার আগে আমার কৌতূহল মেটাবেন আপনি। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর চাই।’

মুবিন চৌধুরীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাঁকে গ্রাস করেছে এক রাশ অস্বস্তি। চোখেমুখে বিষণ্ণতার ছায়াও পড়ল। নিচু গলায় ডাকলেন স্ত্রী মরিয়মকে। এমন ভাবে, যেন স্ত্রী না এলেই খুশি হতেন। সবকিছু ছাপিয়ে ক্লান্তির ছাপই ফুটে উঠেছে মরিয়ম বেগমের চেহারায়। অসম্ভব রূপবতী মহিলার চোখের নিচে কালি, চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো। কিছু দিন আগে ছেলে হারিয়েছেন, চেহারায় এমন দুঃখ এবং ক্লান্তির ছাপ পড়াই স্বাভাবিক। মরিয়ম বেগম আনোয়ারের সামনে এসে বসলেন, ঠিক মুখোমুখি। মুবিন চৌধুরী মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা সন্দেহ করেছিলাম, ঠিক তা-ই। উনি রাইয়ানের খোঁজ নিয়ে এসেছেন।’

মরিয়ম বেগমের চেহারা এক মুহূর্তে যেন বদলে গেল। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আনোয়ারের দিকে। বললেন, ‘মৃত মানুষের কোনও খোঁজ থাকে না।

‘আপনাদের ছেলে রাইয়ান বেঁচে আছে,’ বলল আনোয়ার।

হিংস্র গলায় বললেন মরিয়ম বেগম, ‘মৃত রাইয়ান আমাদের ছেলে, জীবিত রাইয়ান নয়।’

কথাটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারল না আনোয়ার। মুবিন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল সবকিছু খুলে বলতে।

বলতে শুরু করলেন মুবিন চৌধুরী, ‘আসলে রাইয়ান আমাদের নিজেদের সন্তান নয়। তিন মাস বয়সে আমরা ওকে এক এতিমখানা থেকে দত্তক এনেছিলাম। আমাদের আগের দুটি সন্তান ছিল। তবু আরও একটা সন্তানকে বুকে টেনে নেয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই রাইয়ানকে দত্তক নিই। রাইয়ানের সাথে অন্য বাচ্চাদের অনেক পার্থক্য ছিল। সে কখনও কাঁদত না। খিদে পেলেও না, ব্যথা পেলেও না। অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করত। মাত্র এক বছর বয়সে দৌড়াতে পারত, আর দুই বছর বয়সে কথা বলতে শুরু করল। ছোট বাচ্চাদের মত আধো- আধো কথা না। কঠিন-কঠিন বাক্য বলত, আচার ও ভঙ্গিও ছিল বড়দের মত। প্রথম চার বছর কোনও সমস্যা ছাড়াই পার করেছিলাম আমরা। তবে ওর মধ্যে ছিল কিছু অস্বাভাবিকতা। ওর বয়স যখন তিন বছর, তখন বড় অস্বাভাবিক ঘটনাটি লক্ষ করলাম।’

‘কী ঘটনা?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।

‘তিন বছর বয়সে আমরা লক্ষ করলাম, রক্ত জিনিসটার প্রতি রাইয়ানের আগ্রহটা চোখে পড়ার মত। নিজের শরীরের কোথাও কেটে গেলে, সে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে বড় করে ফেলত ক্ষতটাকে। তার নাকি ভাল লাগে রক্ত দেখতে। যেসব সিনেমায় ভায়োলেন্স বা রক্তারক্তি বেশি, সেগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখত সে। আমরা ভাবতাম, ছোট মানুষ, হয়তো এসব দৃশ্য দেখে ভয় পাবে, কিন্তু ঘটত তার উল্টো। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই মুরগি কিনে এনে জবাই করা হতো। আমি নিজ হাতেই মুরগি জবাই করতাম। রাইয়ান খুব আগ্রহ ভরে দৃশ্যটা দেখত এবং অনেক সময় নিজেই ছুরি হাতে জবাই করতে চাইত মুরগি। চেঁচিয়ে বলত, ‘আমাকে দাও! আমাকে দাও!’ এরপর রাইয়ানের বয়স যখন চার, তখন থেকেই মূলত সূত্রপাত হলো ভয়ঙ্কর সব ঘটনার।’ কথা থামিয়ে মুবিন চৌধুরী ঢক ঢক করে খেয়ে নিলেন এক গ্লাস পানি। বোঝা যাচ্ছে, বিষয়গুলো বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না তিনি।

আবারও বলতে শুরু করলেন মুবিন চৌধুরী: ‘চার বছর বয়সে রাইয়ান ধারাল এক ছুরি নিয়ে আমাদের বাসার বেড়ালটার মাথা কেটে ফেলেছিল। শুধু মাথা কেটেই ক্ষান্ত হয়নি, সে বিড়ালের পুরো দেহটাও খণ্ড-বিখণ্ড করেছিল। ছোট বাচ্চারা যেমন কোনও কাজ করে সবাইকে আগ্রহ নিয়ে দেখাতে থাকে, তেমনি রাইয়ানও সেদিন আগ্রহ করে সবাইকে দেখাতে থাকে বিড়ালের খণ্ড-বিখণ্ড দেহ। তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। এই দৃশ্য দেখার জন্য আমি এবং আমার স্ত্রী, কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। রাইয়ানের আচরণে হতবাক আমার অন্য দুই ছেলে-মেয়েও। চার বছর হওয়ার পর থেকেই প্রতিটা দিন যেন বদলে যেতে লাগল, রাইয়ান। বাসার অন্ধকার কোণগুলোতে লুকিয়ে থাকত। আর রক্ত সম্পর্কিত অস্বাভাবিকতা বাড়ছিল দিন-দিন। মাঝে-মাঝে আনমনে বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলত। এর মধ্যে আমার স্ত্রী একটা স্বপ্ন দেখল। ভয়ঙ্কর দর্শন এক প্রাণী মানুষের গলায় বলছে, ‘আমার ছেলেকে তোরা কেড়ে নিতে চেয়েছিলি, কিন্তু পারবি না।’ স্বপ্ন নিয়ে বিচলিত হওয়া ঠিক নয়, কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিতে আমরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। রাইয়ানের মধ্য থেকে পুরোপুরি হারিয়ে গেল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটা। সে হাসতে ভুলে গেল, খেলাধুলো করত না, ঠিকমত কথা বলতেও চাইত না। খাওয়া-দাওয়াও তেমন করত না। এই অবস্থায় আমরা ভাবলাম, কোনও মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ওকে। কিন্তু রাইয়ান কীভাবে যেন টের পেয়ে গেল বিষয়টা, কোনওভাবেই রাজি হলো না ডাক্তারের কাছে যেতে। এভাবেই পার হলো খারাপ একটা বছর। এরপর রাইয়ানের বয়স যখন পাঁচ হলো, তখন…’ চুপ হয়ে গেলেন মুবিন চৌধুরী।

আনোয়ার বলল, ‘তখন কী?’

‘তখন হুট করেই মারা গেল সে।’

বিস্মিত হয়ে বলল আনোয়ার, ‘মারা গেল?!’

কপালের ঘাম মুছে মুবিন চৌধুরী বললেন, ‘হ্যাঁ, মারা গেল। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের কথা বলছি। একদিন সকালে রাইয়ান ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে কেমন যেন সন্দেহ হয় আমাদের। অনেক ডেকেও কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। পরবর্তী সময়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকি আমরা। দেখলাম বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছে রাইয়ানের শরীরটা। ঠাণ্ডা হয়ে আছে সারাশরীর। প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই চেহারায়। দ্রুত গিয়ে একজন ডাক্তার নিয়ে এলাম। ডাক্তার পাল্স, বিপি, চোখ দেখে বলল, ‘আপনাদের সন্তান আর বেঁচে নেই।’

‘এমন মৃত্যু আমাদের কারও কাম্য ছিল না। ভয়ঙ্করভাবে ভেঙে পড়লাম। কষ্টে যেন ফেটে যাচ্ছিল বুকটা। কী কোমল একটা মুখ, আর কোনও দিন ডাকবে না বাবা বলে। যত অস্বাভাবিকতাই থাকুক, সে তো আমাদের সন্তান। ডাক্তার চলে যাবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দাফনের প্রস্তুতি শুরু করলাম আমরা। রাইয়ানকে গোসল করানো হলো, কাফনের কাপড় পরানো হলো। আমরা যখন কবরস্থানের দিকে রওয়ানা দেব, তখন হঠাৎ উঠে বসল রাইয়ান। পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল ভয়ের পরিবেশ। কেউ-কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারছিল না ওকে। মুহূর্তেই খালি হয়ে গেল পুরো বাড়ি। আমার দুঃখের অনুভূতিও কেমন যেন রূপান্তরিত হলো ভয়ে। ডাক্তার যাকে মৃত ঘোষণা করল, সে কীভাবে বেঁচে উঠল? এ ঘটনার পর আমরা আর ভালভাবে গ্রহণ করতে পারিনি রাইয়ানকে।

‘রাইয়ান বেঁচে ওঠার পর ওর মধ্যে আসতে শুরু করল নানা পরিবর্তন 1 রেগে উঠত অল্পতেই। কারণে অকারণে আমার অন্য দুই ছেলে-মেয়েকে আঘাত করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে আমার বড় ছেলেটা, আর মেয়েটা কলেজে, ফার্স্ট ইয়ারে। বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও রাইয়ানের শক্তির কাছে হার মানতে হতো ওদের। প্রায়ই ঘরের অন্ধকার কোণে পদ্মাসনে বসতে দেখতাম রাইয়ানকে। মনে হতো যেন ধ্যান করছে। শত ডাকাডাকিতেও সাড়া দিত না। এভাবে পার হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

‘আমাদেরও নানাভাবে কষ্ট দিতে থাকল রাইয়ান। তার কোনও কথাতে আপত্তি করলেই ভয়ঙ্করভাবে রেগে যেত। এমন কী আঘাত করতেও ছাড়ত না। ওর শক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম আমরা। আর ওর ইচ্ছার কাছে ছিলাম বন্দি। ওর সন্তুষ্টির জন্য প্রায়ই বাজার থেকে কিনে আনতে হতো জ্যান্ত মুরগি। ওগুলো সে নিজ হাতে জবাই করত। রক্ত মেখে নিত নিজের গায়ে। এসব কুৎসিত দৃশ্য আমাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু কী রকম এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম আমাদেরও মধ্যেও। রাইয়ান না চাইলে ঘর থেকেও বের হতে পারতাম না আমরা। অদৃশ্য কিছু যেন আঘাত করত আমাদেরকে। আস্তে-আস্তে আমরা বুঝতে পারলাম, অশুভ কোনও বিষয় আছে রাইয়ানের মধ্যে। কিন্তু এই অশুভ বিষয়টা কী আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। মনে হচ্ছিল রাইয়ানকে দূরে সরিয়ে দেয়াই মঙ্গলজনক।

‘কিছুদিন আগে দ্বিতীয়বারের মত মারা গেল রাইয়ান। ওকে পরীক্ষা করে দেখল ডাক্তার, পুরো শরীর ঠাণ্ডা, হৃৎস্পন্দন নেই, পাও পাওয়া যাচ্ছে না। এবার আগের মত দেরি করিনি। বেশি লোক জানাজানিও হয়নি। মৃত্যুর তিন ঘণ্টার মধ্যেই দাফন করা হলো রাইয়ানকে। ওকে কবরে শুইয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু কবর দেয়ার পরদিন আমরা খবর পেলাম, চুরি হয়ে গেছে রাইয়ানের লাশ। আর আজকে আপনার কাছে শুনলাম, বেঁচে আছে ও।’

‘হ্যাঁ। রাইয়ান বেঁচে আছে। আমার কাছেই আছে।’

হাতজোড় করে বললেন মুবিন চৌধুরী, ‘আপনার কাছে অনুরোধ, আমাদের কাছে আনবেন না রাইয়ানকে।’

মন দিয়ে সব শুনেছে আনোয়ার। রুমের পেইন্টিংগুলো দেখতে দেখতে বলল, ‘রাইয়ান সম্পর্কে অজানা বিষয় জানতেই এসেছিলাম। আগেই বলেছি, এসব বিষয়ে আমার আছে প্রবল আগ্রহ। আপনাদের এসব তথ্য অনেক কাজে লাগবে আমার। আপনারা কি বলবেন কোন্ এতিমখানা থেকে এনেছিলেন রাইয়ানকে?’

নাম মনে করার চেষ্টা করলেন মুবিন চৌধুরী। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। শ্যামলীর ভেতর দিকে এক এতিমখানা আছে, উত্তরখান এতিমখানা। সেখান থেকে এনেছিলাম।’

বিড়বিড় করে বলল আনোয়ার, ‘আমিও ছয় বছর আগে বাচ্চাটাকে রেখে এসেছিলাম ওই এতিমখানায়।’

‘কী বললেন?’

‘না, কিছুই না।’ আবার বলল আনোয়ার, ‘আপনি কি রাইয়ানের ধ্যানের বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলবেন?’

‘হ্যাঁ। ওকে প্রায়ই দেখতাম ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে থাকতে। মাঝে-মাঝে বিচিত্র ভাষায় কী সব বলত।’

‘ধ্যানের বিষয়টা কত বছর বয়সে প্রথম লক্ষ করেছিলেন?’

একটু ভেবে মুবিন চৌধুরী বললেন, ‘সম্ভবত চার বছর বয়সেই প্রথম এই ধ্যানের বিষয়টি লক্ষ করি।’

‘আরেকটা প্রশ্ন, একটা সত্যি জবাব চাই।’

‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আপনারা কি কখনও রাইয়ানের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন বা মারধর করেছিলেন?’

‘সন্তানকে মা-বাবা যে ছোটখাট শাসন করে, সেসব করতাম। আর…’

‘আর কী?’

‘রাইয়ানের চতুর্থ জন্মদিনের সময় ঘটেছিল একটা ঘটনা। হাই ব্লাডপ্রেশারের রোগী আমার স্ত্রী, সেসময়ে শারীরিক অবস্থা ভাল ছিল না তার। তাই, সেবার আমরা রাইয়ানের জন্মদিনে কোনও অনুষ্ঠান করব না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু রাইয়ান মানতে চাইছিল না বিষয়টা। একদম প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মত আমাদেরকে চার্জ করতে লাগল। আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে ওর সম্পর্ক একদম মধুর ছিল না। তখন সবাই মিলে অনেক কটু কথা বলে ফেলেছিলাম ওকে।’

‘সম্ভবত ওই সময়েই রাইয়ান জানতে পারে, দত্তক আনা হয়েছিল তাকে। ঠিক না?’

আনোয়ারের বিচক্ষণ অনুমানে অবাক না হয়ে পারলেন না মুবিন চৌধুরী। বললেন, ‘জী, ঠিক। রাগ করে সেদিন কথাটা বলে ফেলেছিল আমার মেয়ে সভ্য। ‘তুই আমাদের আপন ভাই না, এ জন্যই মায়ের কষ্টের কোনও মূল্য নেই তোর কাছে।’’ মুবিন চৌধুরী অপরাধীর গলায় বললেন, ‘তবে বিশ্বাস করুন, আমরা কখনও ওকে আলাদা করে দেখিনি। আমার অন্য দুটি ছেলে-মেয়ে হয়তো একটু অবহেলা করেছে, কিন্তু আমরা তাদের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি।’

‘আজ অনেকগুলো হিসাব মিলে গেল,’ দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল আনোয়ার।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি উঠি।’

মূর্তির মত বসে রইলেন মুবিন চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী, একবারও দেখলেন না আনোয়ারের দিকে।

আনোয়ার লক্ষ করল, চোখে পানি মরিয়ম বেগমের। হয়তো এই ভয়ঙ্কর সন্তানটিকে এখনও খুব ভালবাসেন তিনি।

একুশ

ডা. রাশেদের চেম্বারে ঢুকল আনোয়ার। এই মানুষটার সাথে খুব সখ্য রয়েছে তার। ডাক্তার হিসাবে রাশেদ যেমন প্রথম শ্রেণীর, মানুষ হিসাবেও। ঢাবির ছাত্র হলেও রাশেদের সাথে ঢাকা মেডিকেলে প্রচুর আড্ডা দিয়েছে আনোয়ার। ওর চেয়ে রাশেদ বয়সে একটু বড় হলেও সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মত।

আনোয়ারকে দেখে উৎফুল্ল গলায় বলল রাশেদ, ‘কী, আনোয়ার, সরাসরি আমার চেম্বারে? কোনও বিশেষ দরকার?’

হেসে বলল আনোয়ার, ‘রাশেদ ভাই, একটা বিষয়ে কথা বলার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আপনি যেমন আন্তরিকভাবে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন, অন্য জায়গায় এটা সম্ভব নয়, তাই জ্বালাতে এলাম।’

‘আরে, জ্বালানো বলছ কেন?’ চশমা খুলতে খুলতে বলল ডা. রাশেদ, ‘খুব খুশি হয়েছি। অনেকদিন দেয়া হয় না আড্ডা। তবে তোমাকে আধঘণ্টা বসতে হবে। আরও দু’জন রোগী দেখা বাকি।’

‘কোনও সমস্যা নেই, রাশেদ ভাই। আমি বাইরে বসছি।’

‘ঠিক আছে।’

চল্লিশ মিনিট পর ডাক পড়ল আনোয়ারের।

অনেকক্ষণ রোমন্থন চলল পুরনো স্মৃতির। এরপর হালকা স্ন্যাকস খেল দু’জন। ডা. রাশেদ হাত-পা ছড়িয়ে চেয়ারে বসল। এরপর বলল, ‘এবার বলো কী জানতে চাও?’

‘রাশেদ ভাই, মৃত মানুষ কি কখনও জীবিত হতে পারে? এমন কোনও বিষয় কি মেডিকেল সায়েন্সে আছে?’

গম্ভীর হয়ে গেল ডা. রাশেদ। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘না। মৃত মানুষ কখনও জীবিত হতে পারে না।’

‘তা হলে যে প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি মৃত্যুর এত ঘণ্টা পর বেঁচে উঠলেন রোগী, আবার সেদিন পড়লাম পোস্টমর্টেমের সময় রোগী নড়ে উঠল। এসব বিষয়ে কী বলবেন?’

‘তোমাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। ‘কী ব্যাখ্যা?

‘এরা আসলে মারা যায়নি, মানে এদের মৃতদের কাতারে ফেলা যায় না। এ ধরনের ঘটনাকে বলে স্থগিত মৃত্যু বা আপাত মৃত্যু। অনেকে এটাকে বলে পুনর্জীবিত স্থগিত মৃত্যু। প্রথমেই আসি পত্রপত্রিকায় আমরা যেসব খবর পড়ি, সে বিষয়ে। আসলে ডাক্তাররা প্রাথমিকভাবে বিপি, পাস্‌ চেক করেই ধরে নেয় মারা গেছে রোগী। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কিছু রোগী তখনও মারা যায়নি। হয়তো খুব স্তিমিত গতিতে কাজ করছে তার হার্ট। এক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার জন্য করতে হয় ইসিজি। ওটা করলেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে, রোগী মারা যায়নি; তবে এসব ক্ষেত্রে রোগীর বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।’

‘কেউ ইচ্ছাকৃত এ কাজ করতে পারে?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।

‘মানে?’

‘মানে, কেউ ইচ্ছাকৃত মৃত্যুবরণ করে আবারও জীবিত হতে পারে?’

‘বিষয়টা হাস্যকর শোনালেও উত্তরটা হচ্ছে: হ্যাঁ, পারে। অনেক মুনি, ঋষি, সাধুরা সাধনার মাধ্যমে নিজ শারীরবৃত্তীয় কাজকে বন্ধ করে দিতে পারে সাময়িকভাবে। এতে আপাতদৃষ্টিতে তারা মৃত মানুষের মত হয়ে যায়, আবার নির্দিষ্ট সময় পর সচল হয়ে ওঠে তাদের শরীর। ডা. রাশেদ মুখে হাত বোলাতে- বোলাতে বলল, ‘অনেকটা সাপ বা ব্যাঙের শীতযাপনের সাথে তুলনা করা যায় এর। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ এক ধরনের ক্ষমতা।’

‘কীভাবে অর্জন করা যায় এই ক্ষমতা?’

‘ধ্যান ও বিভিন্ন যোগ সাধনার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। তবে প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু বিষয়েরও প্রয়োজন হয়। সবাই এ কাজ করতে পারলে তো পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন পড়ে যেত। এত সহজ নয় বিষয়টা।’

‘আপনি খুব সহজ করে বুঝিয়ে বলেন, রাশেদ ভাই। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম।’

‘তুমি কি এখনও ভূত, প্রেত, রহস্য নিয়ে পড়ে আছ?’ কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করল ডা. রাশেদ।

উত্তর না দিয়ে হাসল আনোয়ার। আবার বলল ডা. রাশেদ, ‘তুমিই অবশ্য ভাল আছ। সারাদেশে ঘুরে বেড়াও, অ্যাডভেঞ্চার করো। কতই না আনন্দ। আর আমাদের নিজেদের জন্য সময় বলতে কিছু নেই।’

‘এবার আপনাকে নিয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাব।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ। আগে হাতে একটা কাজ আছে, ওটা শেষ করে নিই, তারপর বিস্তারিত বলব আপনাকে।’

উঠে দাঁড়াল আনোয়ার।

ডা. রাশেদ বলল, ‘এত তাড়া কীসের? ডিনার করে যাও।’

‘না, ভাইয়া, একটু কাজ আছে। পরে আবার আসব।’

বাইশ

ঘড়িতে রাত দশটা বেজে বিশ মিনিট। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরেছে আনোয়ার। ভাল লাগছে না শরীরটা। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রাইয়ানের দিকে দৃষ্টি গেল। এক মনে টিভি দেখছে ছেলেটা।

আনোয়ারকে দেখে রাইয়ান বলল, ‘কী, আমার ব্যাপারে সব খোঁজ পেলে?’

জবাব দিল না আনোয়ার।

‘তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে কেন?’ টিভির দিকে তাকিয়েই বলল রাইয়ান।

অবাক হয়ে নিজের ডান হাতের দিকে তাকাল আনোয়ার। সেখান থেকে এক নাগাড়ে ঝরছে রক্ত। ক্রমেই বাড়ছে ব্যথা। ক্ষতটা দেখে মনে হচ্ছে, ওর হাতের কয়েক জায়গায় ধারাল ছুরি দিয়ে পৌঁচ দিয়েছে কেউ। অথচ এতক্ষণ ক্ষতটা লক্ষই করেনি আনোয়ার। হাসছে রাইয়ান। আনোয়ারের মনে হচ্ছে, সে পরিচিত এই হাসির সাথে। এমন বিশ্রীভাবে হাসতে পারে না কোনও বাচ্চা ছেলে। আচ্ছা, ওর হাতের ক্ষতের সাথে কোনও যোগসূত্র নেই তো রাইয়ানের? হাতে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে ছাদে চলে গেল আনোয়ার। আজ রাতে নিজের ঘরে ছাদের চিলেকোঠায় থাকার ইচ্ছা ওর। কী যেন মনে করে তালা মেরে রাখল ছাদের দরজাটা।

রাতে হঠাৎ ভেঙে গেল আনোয়ারের ঘুম। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। পিপাসা পেয়েছে খুব। পানি ও আলোর পিপাসা এলোমেলো করে দিচ্ছে মনোজগৎকে। বিছানায় উঠে বসল। তখনই শুনতে পেল একটা মেয়ের কান্নার শব্দ।

আনোয়ার বলল, ‘কে…কে?’

থেমে গেল মেয়েটার কান্না। একটু পর আবারও শুরু হলো ফুঁপিয়ে উঠে কান্না।

কাঁপা গলায় বলল আনোয়ার, ‘কে কাঁদে? কে?’

‘আমি,’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দিল কোনও নারী কণ্ঠ।

‘আমি কে?’

‘আমি খেয়া।’

‘খেয়া?’ চিনতে পারল আনোয়ার। দোতলার ভাড়াটিয়া সোবহান সাহেবের ছোট মেয়ে।

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি এখানে কীভাবে এলে?’

‘আমি জানি না।’

‘তাড়াতাড়ি বাসায় যাও।’

‘আমি উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছি না।’

‘খেয়া, কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে, বলো তো!’

আবার কাঁদতে লাগল খেয়া।

‘আস্তে, খেয়া, আস্তে,’ বলল আনোয়ার। ‘শব্দ কোরো না।’

খেয়ার কান্নার শব্দ একটু কমে এল, তবে পুরোপুরি মিলিয়ে গেল না। উঠে বসে বাতি জ্বালল আনোয়ার। কই, কেউ তো নেই! চিলেকোঠার দরজা খুলে এল ছাদে। নাহ্, ছাদেও কেউ নেই। ছাদের দরজাও তালাবদ্ধ। এখনও কাঁপছে ওর বুকটা। এসব কী দেখছে ও? ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমে ঢুকল আনোয়ার। এরপর যে দৃশ্যটি দেখল, তাতে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ওর হৃৎস্পন্দন। ওর ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছে খেয়া। আত্মহত্যা করেছে। বেরিয়ে আছে জিভ। চোখ খোলা, বীভৎস এক দৃশ্য। বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না আনোয়ার, পড়ে গেল মাথা ঘুরে। ঠিক তখনই জোরে হেসে উঠল কে যেন! হাসিটা চিনতে পারল আনোয়ার। হাসছে রাইয়ান্! রাইয়ান ওর সাথে মজা করছে বুঝতে পারল আনোয়ার। এটা এক ধরনের খেলা।

পিশাচের হাসি হেসে বলল রাইয়ান, ‘আমাকে তুই চিনতে পেরেছিস? আমাকে জন্মের সাথে-সাথে এতিমখানায় ফেলে এসেছিলি তুই। আমার বাবার সাথে অনেক হিসেব-নিকেশ আছে তোর। আর আমার প্রিয় নানাজান মেরে ফেলতে বলেছিল আমাকে।’ কথাগুলো শুনতে-শুনতে চোখ বন্ধ হয়ে এল আনোয়ারের।

তেইশ

পরদিন সকালে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল আনোয়ার। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে দেখল, নুযহাতের বাবা রফিক সাদি ফোন দিয়েছেন ওকে। তিনি কানাডা চলে যাওয়ার পরেও প্রায় প্রতি মাসেই ফোন করতেন। তবে গত কয়েক মাস ধরে কোনও যোগাযোগ নেই।

আনোয়ারকে উৎফুল্ল গলায় রফিক সাদি বললেন, ‘আমরা গত পরশুদিন এসেছি দেশে। আমার সাথে নুযহাতও এসেছে।’

ভিতরের উত্তেজনা বুঝতে দিল না আনোয়ার, স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘খুবই ভাল।’

‘তোমার সাথে দেখা হয়েছিল ছয় বছর আগে। এরপর আর দেশে আসা হয়নি, দেখাও হয়নি। নুযহাতকে বিয়ে দিয়েছি। নুযহাত খুব সুখে আছে। বাপ- মেয়ে দশদিনের জন্য চলে এলাম দেশের টানে।’

‘খুব ভাল করেছেন।’

‘অবশ্যই বাসায় আসবে। আমরা খুব খুশি হব তুমি কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গে থাকলে। কারণ, তুমি আমাদের অনেক আপন একজন। তোমার ঋণের কথা কখনও ভোলা সম্ভব নয়।

ফোনে নুযহাতও কথা বলল, ‘আনোয়ার ভাই, আপনাকে কয়েকটা দিন আমাদের বাসায় থাকতেই হবে। কোনও না শুনব না।’

আনোয়ার রাজি না হয়ে পারল না। ঠিক করল রাইয়ানকেও নিয়ে যাবে ওই বাসায়। কেন যেন ওর মন বলছে, ওই বাসাতেই রাইয়ান বিষয়ে লুকিয়ে আছে কোনও সমাধান।

সেই পুরানো স্মৃতি মনে পড়ল আনোয়ারের। নুযহাতের কথা, রফিক সাদির কথা, ঝমঝম কুঠির কথা, জয়নালের কথা, পিশাচের কথা।

দুপুরের দিকে খেয়ার সাথে দেখা হলো ওর। বুঝল, গতকাল যা দেখেছে, সবই ভ্রান্তি, চোখের ভুল। রাইয়ান একবারও জিজ্ঞেস করল না কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সব জানে।

রাইয়ানকে নিয়ে রফিক সাদির বাসায় যখন পৌছাল আনোয়ার, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রফিক সাদি বুকে জড়িয়ে ধরলেন আনোয়ারকে। কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময়ে পার হলো। রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে সরু চোখে বললেন রফিক সাদি,

‘এই ছেলেটি কে?’

তাঁর কানের কাছে মুখ এনে বলল আনোয়ার, ‘আপনাকে সব বলব। এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।’ কথা ঘুরিয়ে উঁচু গলায় বলল আনোয়ার, ‘আপনি বলেছেন, তাই আপনার বাসায় কয়েকদিন থাকতে এলাম। কোন্ রুমে থাকব আমরা?’

.

আনোয়ার এবং রাইয়ানকে দুটো আলাদা রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন রফিক সাদি। তাঁকে আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে বলল আনোয়ার, ‘এই ছেলেটি কে, আপনি জানেন?’

‘কে, বলো তো! ওর দিকে তাকিয়েই বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠেছে।’

‘উত্তরটা শুনতে আপনার ভাল লাগবে না।’

‘তবু বলো। আমি শুনতে চাই।’

রফিক সাদিকে বলল আনোয়ার, ‘এই ছেলেটি আপনার নাতি।’

‘আমার নাতি? কী বলছ এসব?!’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার কোনও নাতি নেই,’ মাথা দোলাতে-দোলাতে বললেন রফিক সাদি। কাজ করছে না মাথা। এতদিন পর দেশে এসে এ কী শুনছেন?

আবারও বলল আনোয়ার, ‘আপনি অস্বীকার করলেও সত্য সত্যই। এই ছেলেটি নুযহাতের সন্তান।’

‘না-না! নুযহাতের কোনও সন্তান নেই!

‘আপনি জোর দিয়ে বললেই তো সত্য কখনও মিথ্যা হবে না। নুযহাতের সাথে ছেলেটার চেহারার মিল নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন?’

‘এ নুযহাতের নয়, পিশাচের সন্তান,’ প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে বললেন রফিক সাদি, ‘তোমাকে বলেছিলাম বাচ্চাটিকে মেরে ফেলতে! তুমি ওই পিশাচটাকে মেরে ফেলোনি কেন?’

আনোয়ার বলল, ‘আমি পারিনি মারতে। মানুষ হয়ে হত্যা করা যায় না অন্য মানুষকে।’

‘বাহ! ভালই করেছ! আমার দেশে আসাই ভুল হয়েছে। এই আবর্জনা বেঁচে আছে জানলে কখনও ফিরতাম না।’

‘একটা এতিমখানায় রেখে এসেছিলাম রাইয়ানকে। কয়েক মাস পর ওখান থেকে একটি পরিবার ওকে দত্তক নেয়।’

‘তা হলে এতদিন পর তুমি কীভাবে একে খুঁজে বের করলে? সেই পরিবারের পরিচয়েই তো এর বড় হওয়ার কথা।’

‘রাইয়ানকে ঘিরে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সমস্যার পিছনে ছুটতে গিয়েই জেনে ফেলেছি ওর আসল পরিচয়।’

‘কী সমস্যা?’

‘আপনাকে পরে সব বলব।’

‘এই বাচ্চা যেখানেই যাবে, সৃষ্টি করবে সমস্যা। তুমি একবার আমাদের বাঁচিয়েছ। কিন্তু এবার তোমার ভুলেই আমরা মারা পড়ব।’

‘আমি কোনও ভুল করিনি। সেই মুহূর্তে ওটিই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। আগেই বলেছি এই বাচ্চাটির মধ্যে আছে মানব-সত্তা এবং পিশাচ-সত্তা-দুইই। চার বছর বয়স পর্যন্ত একে নিয়ে খুব সমস্যা হয়নি। হ্যাঁ, হয়তো ছিল কিছু অস্বাভাবিকতা। কিন্তু সেসব বড় কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু চার বছর বয়সে প্রথম জানল, সে অন্য কারও সন্তান। সেই দুর্বল মুহূর্তে জেগে উঠল তার পিশাচ-সত্তা। তার সাথে যোগাযোগ শুরু করল পিশাচ। তাকে বোঝাতে লাগল, চাইলে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রাণী হতে পারে সে। প্রায়ই ধ্যানমগ্ন হয়ে তার পিশাচ বাবার সাথে যোগাযোগ করত রাইয়ান। নানা ধরনের শক্তির চর্চাও হতো সেই মুহূর্তে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল মারা গিয়েও পুনরায় বেঁচে ওঠার বিষয়টি। তার শারীরবৃত্তীয় কাজগুলো বন্ধ করে দিতে পারে রাইয়ান, আবার সচলও করতে পারে ধীরে- ধীরে। মুনি-ঋষিদের মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক গল্প। শরীরকে এমন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইয়োগা, ধ্যান, মেডিটেশন করতেন ঋষিরা। রাইয়ানও তার পিশাচ বাবার বশ্যতা স্বীকার করে ধ্যানের মাধ্যমে আত্মস্থ করেছিল এই বিষয়টি। আসলে আমরা তাড়িয়ে দিয়েছিলাম পিশাচকে। তাকে একবার তাড়ালে পুনরায় ফিরতে অনেক সমস্যা হয় তার। তাই কাজে লাগাচ্ছে সে রাইয়ানকে। ধীরে-ধীরে ওর মাধ্যমে ফিরে আসতে চায় সে।’

অন্যদিকে তাকিয়ে বলল আনোয়ার, ‘দেরি হয়ে গেছে। এখন আর সবকিছু আমাদের হাতে নেই। চাইলেও বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না আমি। এমন কী রাইয়ান না চাইলে এ বাসা থেকে বের হতে পারবেন না আপনিও।’ কথা শেষ করে নিজের ঘরে চলে এল আনোয়ার।

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রফিক সাদি। ধপাস করে সোফায় শুয়ে পড়লেন।

আনোয়ার বের হওয়া মাত্রই রফিক সাদির রুমে ঢুকল রাইয়ান, যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল দাঁড়িয়ে। কিছু বলার চেষ্টা করলেন রফিক সাদি। কিন্তু মুখ দিয়ে বের হলো না কোনও শব্দ। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল রাইয়ান। বাঘ যেমন শিকারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ওর দৃষ্টিও অনেকটা সেরকম। রফিক সাদির মনে হলো, রাইয়ানের চোখ দুটো জ্বলছে এবং গলা দিয়ে বের হচ্ছে ফোঁস-ফোঁস আওয়াজ। ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন রফিক সাদি। হঠাৎ লক্ষ করলেন, অসাড় হয়ে আসছে তাঁর হাত-পা। ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। মনে হচ্ছে, যেন প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কেউ। দুষ্টু হাসি রাইয়ানের মুখে।

দ্রুত ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকলেন রফিক সাদি। ছেলেটার ওই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়। রফিক সাদির মনে হলো, তিনি ছাড়াও আরও কেউ আছে বাথরুমে। কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই ঘুরে উঠল মাথাটা, পড়ে গেলেন তিনি বাথরুমের মেঝেতে। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন কোমরে, হাতে এবং পায়ে। চোখের সামনে দেখতে পেলেন রাইয়ানকে। একদিকে কাত হয়ে আছে তার মাথা, মুখ দিয়ে ঝরছে লালা। বহুদিন আগে তিনি ঝমঝম কুঠিতে দেখেছিলেন জয়নালের মধ্যে এমন ভঙ্গি। শাওয়ারটা ছেড়ে দিল কেউ। রফিক সাদির মনে হচ্ছে আর বাঁচবেন না তিনি।

চব্বিশ

রাইয়ানের ঘরে ঢুকল আনোয়ার। মেঝেতে বসে আছে রাইয়ান, মাথায় কালো একটা কাপড় বাঁধা। টকটকে লাল চোখ। একদিকে কাত হয়ে আছে মাথাটা। মুখ দিয়ে ঝরছে লালা। ডাকল আনোয়ার, ‘রাইয়ান।’

মাথাটা সোজা করে তাকাল রাইয়ান। চুষে নিল মুখের লালাটুকু। হিসহিসে গলায় বলল, ‘বল, কী বলবি?’

‘আমাকে তুই করে বলছ?’

‘তোর খুব আঁতে ঘা লেগেছে নাকি, জানোয়ার?’

‘তুমি কী চাও?’

‘আমি সবকিছু চাই এবং আমার বাবা আমাকে সবকিছু দেবেন।’

কে তোমার বাবা?’

‘মনে হচ্ছে তুই এখনও ফিডার খাস, কিছু বুঝতে পারছিস না?’

‘রফিক সাদিকে কেন বাথরুমে ফেলে দিলে? কেন আমাদের এই বাড়ি থেকে বের হতে দিচ্ছ না?’

‘আমি প্রতিশোধ নেব। খুব ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ।’ চোখে-মুখে ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল রাইয়ানের। ‘তোরা আমার এবং আমার বাবার সাথে যে অন্যায় করেছিস, তার বদলা আমাকে নিতেই হবে। রফিক সাদি, তোর বন্ধু শাহেদ চৌধুরী, নুযহাত এবং জানোয়ার, মানে তুই কাউকে ছাড়ব না।’

‘তুমি ভুল করছ, রাইয়ান। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম, হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম।’ দৃঢ় কণ্ঠে আনোয়ার বলল, ‘তোমার বিরুদ্ধে কিছু করিনি। এমন কী তোমার মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে আছে জেনেও তোমাকে হত্যা করা হয়নি।’

‘হ্যাঁ, জানি। তুই আমাকে সুযোগ পেয়েও মেরে ফেলিসনি। এজন্য তোকে সবার শেষে মারব। আগে বাকিগুলোকে শেষ করব।’

‘শেষ করবে?’

‘হ্যাঁ। সবটুকু কষ্ট দিয়ে শেষ করব। তিলে-তিলে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করব।’

দাঁত বের করে হাসল রাইয়ান। অস্বাভাবিক লম্বা এবং সূচাল দাঁত দেখলে বুকটা আঁতকে উঠবে যে কারও।

‘আমার বাবা প্রায়ই স্বপ্নে আসেন। নানা দিকনির্দেশনা দেন। বাবার সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি মৃত্যুকে। আমি দুইবার মরে, বেঁচে উঠেছি। এখন আমি এবং আমার বাবা না চাইলে কেউ মারতে পারবে না আমাকে।’ হাত উঁচু করে চিৎকার করে বলল রাইয়ান, ‘আমি নিষ্ঠুরতা দেখাতে চাই, মানুষকে কষ্ট দিতে চাই, সত্যিকারের পিশাচ হতে চাই। আমার বাবার মত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে চাই। আমি আর আমার বাবা শাসন করব পুরো পৃথিবী। আমার বাবা স্বপ্নে এবং ধ্যানে বারবার দেখা দেন। তিনি প্রতিনিয়ত পথ দেখাচ্ছেন আমাকে। গত দুই বছর ধরে ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছি আমি আমার।’

শীতল গলায় বলল আনোয়ার, ‘তোমার বাবা একটা নির্বোধ, ভীতু।’

‘কী বললি?’ বিকৃত হয়ে গেল রাইয়ানের মুখটা।

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। তোমার বাবা মানুষের সামনে আসতে ভয় পায়, তার ক্ষমতা এখন শূন্যের কোঠায়। তাই তোমাকে কাজে লাগিয়ে আবার ক্ষমতাশালী হতে চায় সে।’

‘মিথ্যা! মিথ্যা বলছিস তুই! আমার বাবাকে তুই চিনি না!’ লাল হয়ে গেছে রাইয়ানের মুখ। দেখে মনে হলো পুড়ে গেছে মুখের খানিকটা অংশ। লাফ দিয়ে উঠেই আনোয়ারকে সজোরে চড় বসাল রাইয়ান। তাল সামলাতে না পেরে সামনের টেবিলে গিয়ে পড়ল আনোয়ার। মেঝেতে পড়ে গেল ফুলদানিটা। কয়েক মুহূর্ত চোখে-মুখে অন্ধকার দেখল আনোয়ার। রক্তের লোনা স্বাদ পেল মুখের ভেতর। মুখে বরফ ঘষছে আনোয়ার। বেশ ফুলে উঠেছে মুখটা। এদিকে শয্যাশায়ী রফিক সাদিও। তার বন্ধু ডিবি পুলিস অফিসার শাহেদকে ফোন দিল আনোয়ার। আগেরবার অনেক সাহায্য করেছিল শাহেদ, এবারও প্রয়োজন তার সাহায্য।

ফোনটা ধরল না শাহেদ, ধরল ওর মা। তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘গতকাল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শাহেদের। শরীরের চারটা হাড় ভেঙেছে। মাথায় ও পেয়েছে গুরুতর আঘাত।’

শ্বাসটা আটকে রেখে বলল আনোয়ার, ‘কীভাবে হলো অ্যাক্সিডেন্ট?’

‘আমরা কিছুই জানি না। গতকাল শাহেদকে গুলশান দুইয়ের গোল চত্বরের সামনে পড়ে থাকতে দেখে পুলিস। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।’

আণ্টিকে সান্ত্বনা দিয়ে ফোন রেখে বিড়বিড় করে বলল আনোয়ার, ‘রাইয়ান!’ এরপর যোগাযোগ করতে চাইল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু ডেড হয়ে গেছে ল্যাণ্ড ফোন। কাজ করল না মোবাইল ফোনও।