টিক-টিক-টিক
এক
কলেজ কমপাউণ্ডে জারুল গাছটার নীচে বসে আছে ইলিয়াস। কেমন অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। ইলিয়াসের খুব কাছের বন্ধু রুদ্র। ইলিয়াসের মন খারাপ দেখলে তার নিজের মনটাও উদাস হয়ে যায়।
‘মনটা খারাপ কেন, ইলিয়াস?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘কয়েকদিন ধরে বাসায় একা আছি। তাই ভাল লাগছে না,’ রুদ্রর দিকে না তাকিয়েই বলল ইলিয়াস।
‘একা কেন? তোরা না যৌথ পরিবার? আর সবাই কোথায়?’ বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রুদ্র।
‘সবাই গ্রামে গেছে।’
‘তুই গেলি না কেন?’
‘সামনে টেস্ট পরীক্ষা। এ অবস্থায় কীভাবে যাব?’ ইলিয়াসের গলায় সামান্য ক্ষোভের প্রকাশ।
‘খাওয়া-দাওয়া কীভাবে করছিস?’
‘বুয়া আছে। সে সকালে এসে রান্না করে দিয়ে যায়।’
‘হঠাৎ পুরো পরিবার গ্রামে গেল?’
‘গ্রামে জমি-জমা নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে।’
‘তোদের বাসা তো কল্যাণপুরে, না?’
‘নাহ, এখন মালিবাগে থাকি। আমাদের এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে ভাল লাগে না,’ ইলিয়াসের গলায় রহস্যের সুর।
‘তোরা পারিসও। প্রায় ষোলোজন মানুষ পরিবারে। এত মালপত্র নিয়ে বাসা বদলানো কি চাট্টিখানি কথা!’ একটু বিরতি দিয়ে রুদ্র বলল, ‘গত বছর কল্যাণপুরে তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, মনে আছে। গিয়ে তো বসলিই না।’
‘হ্যাঁ, একটা জরুরি নোট আনতে গিয়েছিলাম।’
‘আজকে আমাদের বাসায় চল না। বাসায় কেউ নেই। রাতে ইচ্ছামত আড্ডা দেয়া যাবে,’ করুণ গলায় বলল ইলিয়াস।
রুদ্র একটু ইতস্তত করতে লাগল। রাতে বাসার বাইরে থাকাটা মা-বাবা ঠিক পছন্দ করেন না।
রুদ্র মাথা চুলকে বলল, ‘ইয়ে, দোস্ত, আসলে…’
ইলিয়াস হাত জোড় করে বলল, ‘প্লিজ। না বলিস না। আমার মনটা ভাল নেই।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আজ রাতে তোর সাথে থাকব। তবে বাসায় মিথ্যা বলতে হবে।’
‘কী বলবি বাসায়?’
‘বলব, গ্রুপ স্টাডি করার জন্য কলেজ হোস্টেলে থাকব।’
‘হুম, সেটাই ভাল। আমার বাসায় থাকবি, এটা বলার দরকার নেই। না হলে তোর মা-বাবা ভেবে বসবেন ইলিয়াসের সাথে মিশে তাঁদের ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে।
ইলিয়াসের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যাক, আজ খুব ভাল একটা আড্ডা হবে।
দুই
মালিবাগের একটা ঘুপচির ভিতর ইলিয়াসদের বাসা। ইলিয়াস না থাকলে রুদ্র চিনে এই বাসায় আসতে পারত বলে মনে হয় না। দোতলা একটা পুরানো বাড়ি। বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। ইলিয়াসরা কম ভাড়ায় পুরো বাড়িটাই ভাড়া নিয়েছে
রুদ্র চিন্তিত গলায় বলল, ‘দোস্ত, তোদের এই বাসায় তো ভূতের সিনেমার শুটিং করা যাবে। আমার তো বিকেল বেলাতেই কেমন গা ছমছম করছে।’
ইলিয়াস হেসে বলল, ‘আজ রাতে দুই বন্ধু মিলে ভূতের গল্প করব। ভাল মজা হবে।’
‘না, না। আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। অন্য গল্প হবে,’ ইলিয়াস হেসে বলল।
বাড়ির ভিতর ঢুকতেই রুদ্র মৃদু স্বরে চিৎকার করে উঠল।
‘কী হয়েছে?’ চিন্তিত গলায় বলল ইলিয়াস।
‘গায়ে দুইটা টিকটিকি বসেছিল।’
‘হা! হা! টিকটিকি দেখে এত ভয় পেলি!’ বিদ্রূপের হাসি হাসল ইলিয়াস।
‘এত বড় টিকটিকি আমি জীবনেও দেখিনি।’
‘আমাদের বাসার টিকটিকিগুলো অনেক বড় সাইজের।’
‘তোদের কল্যাণপুরের বাসায়ও অনেক টিকটিকি দেখেছিলাম। তোরা টিকটিকি পুষিস নাকি?’ এবার রুদ্রর মুখে হাসি ফুটল।
‘আরে, টিকটিকি সব বাসায়ই আছে। খুঁজে দেখ, তোদের বাসায়ও টিকটিকি আছে।’
ওরা দু’জনে দোতলায় চলে গেল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি ওদের। ইলিয়াস ফ্রিজ থেকে নানা ধরনের খাবার বের করল। গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করল ওরা। খাওয়া শেষে ইলিয়াস একটা হলুদ জুস খেতে দিল রুদ্রকে। রুদ্র গন্ধ শুঁকে বলল, ‘এটা কীসের জুস?’
‘আরে, খেয়েই দেখ না, বিষ তো আর না!’
রুদ্র জুসে চুমুক দিল। কেমন অদ্ভুত টক-মিষ্টি স্বাদ। তবে খেতে অসাধারণ। রুদ্র বলল, ‘কী দিয়ে বানানো হয়েছে এটা?’
‘আমি ঠিক জানি না। আমার দাদির গোপন রেসিপি। আমাদের বাসায় কেউ বেড়াতে এলে দাদি অতিথিকে এই জুস খেতে দেন।’
‘ওহ। দারুণ খেতে।‘
গল্প তেমন জমে উঠছে না। রুদ্রর মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। গত দু’রাত ঠিকমত ঘুম হয়নি। এটা একটা কারণ হতে পারে।
কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই রুদ্র বারবার চমকে উঠছে। কেন জানি মনে হচ্ছে পুরো ঘর ভর্তি অসংখ্য মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোন রূমেই কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই। ইলিয়াস বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছে। বোঝা যাচ্ছে রুদ্রকে পেয়ে সে খুব খুশি হয়েছে। কিন্তু রুদ্রর কিছু মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ ঘরের মধ্যে দড়াম করে কিছু একটা পড়ল।
রুদ্র চমকে উঠে বলল, ‘কীসের শব্দ হলো?’
ইলিয়াস বলল, ‘কই, আমি তো কোন শব্দ শুনতে পাইনি।’
‘না, না। আমি স্পষ্ট শুনেছি।’
‘আরে, বাদ দে। বিড়াল-টিড়াল হতে পারে।’
রুদ্রর কিছু ভাল লাগছে না। কেন জানি বাসায় চলে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এখন ইলিয়াসকে একা রেখে যাওয়াটা খারাপ দেখাবে। ইলিয়াস হয়তো বুঝতে পেরেছে রুদ্রর কিছু একটা ভাল লাগছে না। তাই সে বলল, ‘আচ্ছা। তোকে আমাদের ছবির অ্যালবাম দেখাই।’
রুদ্রর ছবি দেখতে তেমন ইচ্ছা করছিল না। তবু সে ইলিয়াসের সঙ্গে ছবি দেখতে লাগল। বেশিরভাগই ইলিয়াসদের পারিবারিক ছবি। হঠাৎ ভিতরের রুমে টেলিফোন বেজে উঠল। ইলিয়াসের তেমন ভাবান্তর হলো না। বেশ কয়েকটা রিং হওয়ার পর রুদ্র বলল, ‘টেলিফোন বাজছে তো!’
ইলিয়াস আনমনে বলে বসল, ‘বাজুক। অন্য কেউ ধরবে।’
‘অন্য কেউ ধরবে মানে? বাসায় তো আর কেউ নেই।’
ইলিয়াস যেন একটু থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘হ্যাঁ। তাই তো। মনে ছিল না। আচ্ছা, তুই ছবি দেখ। আমি আসছি।’
রুদ্রর কেমন যেন মনের ভিতর একটা খটকা লাগছে। কোন কারণ ছাড়াই বুকের মধ্যে কাঁপুনি দিচ্ছে।
হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল রুদ্রর। নিলয়ের ছবি। ওদের সঙ্গে পড়ত নিলয়। হঠাৎ করেই দুই মাস আগে ছেলেটা নিখোঁজ হয়। পুলিস অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু নিলয়ের কোন খোঁজ বের করতে পারেনি। রুদ্র এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিলয়ের ছবিটা অ্যালবাম থেকে বের করল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইলিয়াসদের বাসায় তোলা হয়েছে ছবিটা। ছবির পিছনে কলম দিয়ে তারিখ লেখা রয়েছে, ২০ জুলাই। রুদ্রর মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। ২১ জুলাই তারিখ থেকে নিলয়ের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ওর মা-বাবা কলেজে এসে অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন। তারিখটা রুদ্রর স্পষ্ট মনে আছে। কারণ, ২১ জুলাই ওর মা-বাবার বিবাহবার্ষিকী। রুদ্র নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। তার মানে নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন নিলয় ইলিয়াসের বাসায় ছিল?
নীচতলায় অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। পাশের ঘরেও কেউ যেন বিচিত্র স্বরে কথা বলছে। রুদ্রর আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না।
এমন সময় ইলিয়াস ঘরে এসে ঢুকল। রুদ্র নিলয়ের ছবিটা বালিশের নীচে লুকিয়ে ফেলল।
রুদ্র স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ইলিয়াস, বাসা থেকে ফোন এসেছিল। আব্বার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়েছে। আমাকে যেতে হবে।’
ইলিয়াস চিন্তিত গলায় বলল, ‘তাই নাকি! ঠিক আছে, তুই চলে যা।’
রুদ্র উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মাথাটা ঘুরে উঠল। পেটের মধ্যেও কেমন যেন পাক দিচ্ছে। ইলিয়াসের চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। সে মুখে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘তুই নিলয়ের ছবিটা দেখে ফেলেছিস, না?’
রুদ্র ভয়ে ভয়ে ইলিয়াসের দিকে তাকাল।
ইলিয়াস ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আসগরেরও একটা ছবি আছে। দেখিসনি?’
রুদ্রর শরীর কেমন অবশ হয়ে গেল। আসগরও ওদের সঙ্গে পড়ত। পাঁচ-ছয় মাস আগে সে-ও নিখোঁজ হয়।
ইলিয়াস বলল, ‘চল, তোকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
রুদ্র হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
ইলিয়াস জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, ‘দাদি কী সব জুস যে বানায়, সবার শুধু মাথা ঘোরে। দাদি, ভাল জুস বানাতে পারো না?’
হঠাৎ এক বৃদ্ধা মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেল রুদ্র। জড়ানো কণ্ঠস্বর, শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ‘ঠিক আছে। এখন থেকে ভাল করে জুস বানাব। ভয়ঙ্করভাবে হেসে উঠলেন বৃদ্ধা। ইলিয়াস হাসিতে যোগ দিল। রুদ্র আরও বেশ কয়েকজনের হাসির শব্দ শুনতে পেল। সে জেগে থাকার অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে এল।
তিন
কেউ একজন অনেক দূর থেকে রুদ্রকে ডাকছে। ও চোখ মেলে তাকাল। আলোতে পরিপূর্ণ একটা ঘর। রুদ্রর পুরো শরীর নগ্ন। হাত-পা শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা। মুখে টেপ লাগানো। ওর সামনে উদ্বিগ্ন মুখে ইলিয়াস বসে আছে।
ইলিয়াস বলল, ‘দাদির জুসের প্রভাব চার-পাঁচ ঘণ্টা থাকে। এরপর ঘুম ভেঙে যায়। এখন কেমন লাগছে?’
রুদ্র নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু দড়িগুলো এতটুকু আলগা হলো না।
ইলিয়াস উপরের দিকে হাত তুলে জোরে বলল, ‘অনেক খিদে আমাদের। ক্ষুধার্তদেরকে তাদের কাজ করতে দে। নড়াচড়া করিস না।’
রুদ্র দেখতে পেল পনেরো-ষোলোটা টিকটিকি দেয়াল বেয়ে তার শরীরে বসেছে। ধীরে-ধীরে ওগুলোর আকার বহুগুণে বেড়ে গেল। রুদ্র ইলিয়াসকে আর দেখতে পেল না। সে-ও বড়সড় একটা টিকটিকি হয়ে গেছে। রুদ্র ছোট একটা বাচ্চার কণ্ঠ শুনতে পেল। ‘বাবা, চোখটা আমি খাই?’
‘খাও। আরাম করে খাও, বাবা।
বাচ্চা টিকটিকিটা আরাম করে রুদ্রর চোখ খেতে লাগল। চোখ হারানোর পরেও রুদ্র ভাসা-ভাসা অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে। সে দেখতে পেল টিকটিকিগুলো তার সমস্ত শরীর খুবলে খুবলে খাচ্ছে। তার কেন জানি মনে হতে লাগল এটা একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। একটু পরেই সে ঘুম থেকে জেগে উঠবে। দেখবে সে তার ঘরের খাটে শুয়ে আছে। সকালের রোদ তার পায়ে এসে পড়েছে।
রুদ্রর এই ভাবনায় ছেদ পড়ল। একটা টিকটিকি জোরে ডেকে উঠল, ‘টিক-টিক-টিক।’