ভুতুড়ে সাঁকোর রহস্য – ৯

নয়

ওরা বেরিয়ে এসেছে বাইরে, কিশোর মুখ খুলতে যাবে, এসময় ওর বাহু আঁকড়ে ধরল ডন।

‘কী ওটা?’

ডনের তর্জনী অনুসরণ করে চাইল ওরা। সাঁকোর ওপরে মিটমিট করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল একটা আলো। ইতিকর্তব্য ঠিক করার সময় নেই ছেলেদের। চোখের নিমেষে, টিক করে ফ্ল্যাশলাইটটা নিভিয়ে কাছের ঝোপঝাড়গুলো লক্ষ্য করে ধেয়ে গেল কিশোর।

লম্বা-লম্বা ঘাসের আড়ালে লুকোল ছেলেরা, সেতুর মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটির দিকে দৃষ্টি ওদের।

কথোপকথনের চাপা শব্দ কানে আসছে, কিন্তু এত দূর থেকে বুঝতে পারছে না কেউই।

ডন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘মনে হয় ওখানে রুবি আর গ্রাহাম আছে! গোপন জায়গাটা খুঁজছে ওরা।’

মন্তব্য করার সুযোগ পেল না মুসা কিংবা রবিন, একটা শব্দ শুনল-মনে হচ্ছে সাঁকোটাকে শাবল জাতীয় কিছু দিয়ে খোঁচাচ্ছে কেউ!

‘খাইছে!’ মুসার চোখ বিস্ফারিত।

ডন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল ঝোপের ওপর দিয়ে উঁকি মারতে, কিন্তু রবিন সময়মত টেনে ধরল ওকে।

‘বসো, বসো!’

‘কিন্তু…ব্রিজটা তো ভেঙে ফেলছে!’ চিৎকার করে উঠল ডন, প্রায় গর্জনের মতন শোনাল ওটা। ‘আমরা কিছুই করব না?’

কিশোর বলল, ‘কী ঘটছে ওখানে জানি না, কিন্তু এখন দেখতেই হচ্ছে।’

‘কাছিয়ে যাই চলো,’ প্রস্তাব করল রবিন। ‘হয়তো শুনতে পাব ওদের কথাবার্তা

সাবধানে গুড়ি মেরে এগোল চারজনে। এবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আরেক দঙ্গল ঝোপের আড়াল নিল।

‘আরও জলদি করতে পারেন না?’ বলল একজন। রুবি!

‘ধৈর্য ধরো!’ গজগজ করে বলল এক পুরুষকণ্ঠ। পাথরগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে রাখা আস্তরে আঘাত করছে। ‘সাধ্যমত করছি। এর বেশি পারব না।’

‘আস্তরটা পুরনো আর ভাঙাচোরা,’ বলল রুবি। ‘সহজেই তো পাথরটা খসাতে পারার কথা।’

ছেলেরা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে চাইল।

‘তোমার অনুমানের ওপর ভরসা রেখেই কাজটা করছি,’ বলল পুরুষটি। ‘সবকিছু নির্ভর করছে এর ওপরে।’

‘বললামই তো, ওই ফলকটাই শেষ সূত্র,’ বলল রুবি। ওই পাথরটার ঠিক নিচেই সেই গুপ্তস্থানটা পাবেন।’

চকিতে কিশোরের দিকে চাইল রবিন। এটা আগে ওদের মাথায় আসেনি, কিন্তু নিঃসন্দেহে এর পেছনে যুক্তি আছে। সূত্রগুলো কি জন’স ব্লাণ্ডারের প্রতিই ইঙ্গিত করেনি? এক পাথরে বল্টু মেরে লাগানো তামার ফলকটায় কি ওনামটাই লেখা নয়?

হঠাৎ করেই, পাথরে গুঁতো মারার আওয়াজটা থেমে গেল।

‘পাথরটা মনে হয় এবার উঠে আসবে,’ বলল লোকটা। ‘যীশুর নাম নাও।’

‘চোর!’ হুঙ্কার ছাড়ল ডন। বিদ্যুৎবেগে ঝোপের ওপাশ থেকে ছিটকে বেরোল ও। ওকে থামায় কার সাধ্য।

এখন কাজে নামার পালা। এক পাশ দিয়ে ঊর্ধ্বগতিতে দৌড়ে সাঁকোতে উঠে পড়ল কিশোর আর ডন। এবং অন্যপাশ দিয়ে মুসা আর রবিন। রুবি বোঁ করে আচমকা ঘুরে দাঁড়াতেই ওর হাত থেকে খসে পড়ল ফ্ল্যাশলাইটটা। গড়িয়ে গেল সেতুর ওপর দিয়ে।

‘কে ওখানে?’ গর্জাল মেয়েটা, কিশোরের ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ধাঁধিয়ে গেছে চোখ।

‘তিন গোয়েন্দা আর ডন,’ জবাবটা দিল রবিন।

‘আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল!’ বলল রুবি। ‘তোমরা এখানে কী করছ? দূর হও!’ হাত নেড়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করল।

কিশোর ওর চোখে-চোখে চাইল।

‘আমরা কোথাও যাচ্ছি না।’ এবার কাছেই দাঁড়ানো লোকটার ওপর আলো ফেলল।

ছেলেরা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না! ওটা গ্রাহাম ব্রাউন নয়। জিমি কোনস!

‘খাইছে, আপনি তো পটলাক ডিনারের সেই লোক,’ মুসা থ বনে গেছে।

কিন্তু জিমি কোনর্স ছেলেদেরকে পাত্তাই দিল না। তার বদলে, পাথর সরানো অন্ধকার গর্তটার ভেতরে হাত ভরে দিল।

‘নেই!’ ঘুরে দাঁড়াল, খালি হাতে। ‘কিচ্ছু নেই!’

হাঁ হয়ে গেল রুবি।

‘তা কী করে হয়?’

‘তুমিই বলো!’ খেঁকিয়ে উঠল জিমি। ‘তুমি না সবজান্তা!’

‘সব দোষ আপনার!’ রুবি এখন তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। যেমন আপনি তেমনি আপনার উদ্ভট সব আইডিয়া! আস্ত পাগল একটা!’

ঠিক এমনিসময়, খিড়কি দরজার ওপরে যে নগ্ন বাতিটা রয়েছে সেটি জ্বলে উঠল। আঙরাখা কোমরে জড়াতে জড়াতে ধেয়ে বেরিয়ে এলেন এমিলি আর মিসেস ম্যাকলিন। আধো হেঁটে আর আধো দৌড়ে সাঁকোটার কাছে এসে হাজির হলেন দু’জনে।

‘এত গোলমাল কীসের… হায়, খোদা…’ এমিলি থেমে গিয়ে হাঁ করে থাকা গর্তটার দিকে চাইলেন।

‘এখানে হচ্ছেটা কী?’ জবাব দাবি করলেন মিসেস ম্যাকলিন।

‘ওরা মেগের ব্রুচটা চুরি করতে চাইছিল!’ অভিযোগের সুরে বলল ডন। এমিলি প্রথমে রুবি, তারপর জিমির দিকে চেয়ে আবার দৃষ্টি ফেরালেন।

‘আপনারা একজন আরেকজনকে চেনেন?

জিমি আমতা-আমতা করে বলল, ‘উম…আসলে…আমি…’ সহসা থেমে গেল ও। কাঁধজোড়া নুয়ে পড়ল এবং সেতুতে হেলান দিল লোকটা, পরাজয়ের ছাপ চোখে-মুখে। ‘রুবি আমার খালাতো বোন।’ এমিলির দিকে চাইতে পারছে না লজ্জায়।

‘কী…?’ এমিলি এতটাই চমকেছেন মুখে কথা জোগাল না।

মুহূর্তের জন্য, এমিলি আর তাঁর সহকারী স্রেফ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি ধরে রাখলেন। এবার চরকির মতন ঘুরে দাঁড়িয়ে জিমির মুখোমুখি হলো রুবি।

‘পুরোটাই ওঁর আইডিয়া, তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠে, অভিযোগের আঙুল তাক করল জিমির উদ্দেশে।

শাণিত দৃষ্টিতে জিমি কোনসকে মাপলেন এমিলি।

‘এ ব্যাপারে আপনার কী বলার আছে, জিমি?’

বারকয়েক মুখ খুললেও জিমির খাবি খাওয়ার দশা হলো, রা ফুটল না। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ও ঠিকই বলেছে। আমি আপনার পারিবারিক ব্রুচটা চুরি করতে চেয়েছিলাম।

হাঁ করে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন এমিলি।

‘সত্যি কথা বলতে কি, বাই চান্স পুরনো এক চিঠি হাতে পড়ে আমার,’ স্বীকার করল জিমি। ‘আপনার বাসায় কাজ করার সময়। আমার ধারণা মেঝের তক্তার ফাঁক গলে অনেক আগেই খসে পড়েছিল ওটা।’

‘আচ্ছা?’ একটা ভ্রূ উঠে গেল এমিলির।

‘ওটা মেগ ইটনের দাদীর লেখা চিঠি,’ মুহূর্তের দ্বিধার পর, বলে চলল জিমি। ‘চিঠিটায় আভাস পাই মেগ পারিবারিক ঐতিহ্যটা, অর্থাৎ দামি পাথরে তৈরি ব্রুচটা লুকিয়ে রাখার জন্যে নিরাপদ জায়গা খুঁজছেন।’

‘আর তাই আপনি জানতেন এটা পুরনো রহস্য,’ বলে মাথা ঝাঁকাল রবিন।

ম্লান হাসল জিমি।

‘তখনই ধরা খাই আমি, তাই না? এবার কথার খেই ধরল। ‘যাকগে, চিঠিটা পড়ার পর বুঝে যাই আমার সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। আর শুধু ব্রুচটা কেন, সাথে অন্যান্য আরও গয়নাও রেখে থাকতে পারেন মেগ। যে করে হোক হাতাতে হবে ওগুলো। সমস্যা দাঁড়ায় একটাই—’ কথা থামাল লোকটা।

‘কাজটা একা সারা সম্ভব ছিল না আপনার পক্ষে, তাই তো?’ কিশোর জুগিয়ে দিল।

‘হ্যাঁ,’ অকপটে স্বীকার করল জিমি।

রবিন জানে এরপর কী আসছে।

‘গবেষণা সহকারী চেয়ে খবরের কাগজে এমিলির দেয়া বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে আপনার, ঠিক না?’

জিমি অস্বীকার করল না।

‘তখন মাথায় আসে,’ বলল লোকটা, ‘রুবি কলেজে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছে। ওকে এখানে ঢুকিয়ে দেয়া গেলে, ভেতরের একজন লোক থাকল আমার হাতে। ভেবেছিলাম নিখুঁত একটা ছক কষতে পেরেছি।

‘আমি খুব দুঃখ পেয়েছি, জিমি।’ এমিলিকে ব্যথিত দেখাল। ‘আপনার কাছ থেকে অন্তত এটা আশা করিনি।’

‘আমি কখনওই আপনার ক্ষতি করতে চাইনি, এমিলি। ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জিমি। ‘কিন্তু কী করব বলুন? আমি নিরুপায় হয়ে গিয়েছিলাম। হাতে টাকা নেই, অথচ ঋণের বোঝা শুধু বেড়েই চলেছে। ক্রচটা বেচে কিছু নগদ টাকা পাব ভেবেছিলাম। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমার। ব্যবসা লাটে উঠবে যে কোন সময়।’

‘তাই বলে চুরি করতে হবে? কঠোর কণ্ঠে বললেন মিসেস ম্যাকলিন।

‘জানি কাজটা অন্যায়, কিন্তু ক্ষতি কী? শ্রাগ করে পরিবেশটা হালকা করতে চাইল জিমি। ‘হাজার হলেও মানুষের ধারণা ব্রুচটা রেখে গেছে। ভেবেছিলাম আমি ওটা-’

‘সত্যি-সত্যি চুরি করলে কেউ বুঝবে না,’ শেষ করল মুসা।

মাথা ঝাঁকাল জিমি।

‘শেষে ধরা পড়লাম আমি, কিন্তু চোরে মনে হয় বহু আগেই ব্ৰুচটা হাতসাফাই করেছে-সম্ভবত মেগ ওটা লুকোতে পারার আগেই।’

বিমর্ষচিত্তে মাথা ঝাঁকালেন এমিলি। খুব কষ্ট পেয়েছেন মনে। ‘আপনি একজন চটপটে, কর্মঠ যুবক, জিমি, শান্তকণ্ঠে বললেন। ‘চুরি করবেন কেন? এটা তো কোন সমাধান নয়।’

জিমি আর কী উত্তর দেবে, স্রেফ হাঁটা ধরল। বাহুজোড়া মরা সাপের মত ঝুলছে দু’পাশে।

এবার সহকারীর দিকে ফিরলেন এমিলি।

‘তুমিও চোরের দলে? ভেবেছিলাম তোমাকে বিশ্বাস করা যায়। ক্রুদ্ধ নয়, আহত শোনাল তাঁর কথাগুলো। ‘তুমি আমাকে বারবার বোঝাতে চেয়েছ বহু আগেই ব্রুচটা খোয়া গেছে। অথচ পুরোটা সময়ই তুমি ছিলে ওটা চুরির মতলবে।

সবার ওপর চোখ বোলাল রুবি। প্রত্যেকের দৃষ্টি স্থির ওর ওপর।

‘আমি সত্যিই লজ্জিত,’ বলে ঢোক গিলল। ‘প্রথমে আমি জিমিভাইয়ের সাথে হাত মিলাইনি।’

‘কিন্তু পরে মত পাল্টান?’ রবিন বলল।

‘টাকাটা আমারও দরকার ছিল। তাছাড়া গবেষণার কাজটার প্রতিও আগ্রহী ছিলাম। ভেবেছিলাম ব্রুচটা খুঁজে পেলে ভালই হবে। জিমিভাই টাকাটা ভাগাভাগি করতেন আমার সাথে।’

‘খাইছে, সেজন্যেই তখন আমাদের কাছ থেকে তথ্য পেতে আপনার এত চেষ্টা, তাই না?’ বলল মুসা।

মাথা ওপর-নিচ করল রুবি।

‘ভেবেছিলাম তোমরা হয়তো কোন সূত্র পেয়েছ।’

‘স্টোন পুলের ছবিটার ব্যাপারটা কী?’ কিশোর জবাব

‘আপনি নিয়েছেন ওটা?’

আবারও মাথা ঝাঁকাল রুবি।

‘হল-এ দাঁড়িয়ে ছিলাম, এসময় ছবিটা নিয়ে তোমাদেরকে কথা বলতে শুনি। তোমরা যে এত ঝানু গোয়েন্দা, সব সূত্র মিলিয়ে ফেলবে ভাবতেও পারিনি। আমি তোমাদেরকে ছোট করে দেখেছিলাম,’ বলে ওদের সবার ওপর চোখ বুলিয়ে আনল। ‘ভয় পাচ্ছিলাম তোমরাই না আগে গুপ্তস্থানটা খুঁজে পাও!’

‘আপনার জানা ছিল না,’ বলল রবিন। ‘এমিলি ইতিমধ্যেই ছবিটার অনেকগুলো কপি করিয়ে রেখেছেন।

বিস্মিত দেখাল রুবিকে।

‘তাই? তারমানে আমাদের পরিকল্পনাটা- ‘নিখুঁত ছিল না,’ বলে উঠল মুসা।

‘ওহ, ফোনে কথা বলছিলাম তোমরা শুনে ফেলেছ,’ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুবি।

‘আপনাদের প্ল্যান আরেকটু হলেই প্রায় সফল হয়ে গিয়েছিল,’ বলল ডন।

‘হ্যাঁ,’ বলল রুবি। ‘তোমরা আসার আগ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। তোমরা নাছোড়বান্দা, তাই না? সব গুবলেট করে দিলে!’

‘হ্যাঁ,’ বলল কিশোর। ‘রহস্যের সবকটা সূত্র না জোড়া অবধি হাল ছাড়ি না আমরা।’

রবিনের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিল।

‘কিন্তু রহস্যটার একটা অংশ এখনও বুঝছি না আমি,’ বলল ও। ‘সাঁকোর তলা দিয়ে চ্যাটারিং বোসের বয়ে চলার শব্দটা করলেন কীভাবে আপনারা?’

রুবি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল রবিনের দিকে।

‘মানে? তোমার কথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।’

এমিলির আর ধৈর্যে কুলাল না।

‘তোমার কাজের আমার আর দরকার নেই, রুবি,’ বললেন। ‘প্লিজ, ব্যাগ গুছিয়ে ভালয় ভালয় বিদেয় হও।’

‘আপনার বিশ্বাসভঙ্গ করেছি, সেজন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন, এমিলি,’ মৃদুস্বরে বলল রুবি। এবার মাথা নিচু করে হাঁটা দিল।