প্রাগৈতিহাসিক – ৫

পাঁচ

ট্র্যাশ ক্যানটার পেছনে হাঁটু গেড়ে বসলাম, ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে জবুথুবু হয়ে। মাথার ওপরে নিচু হয়ে ঝুলে থাকা কুয়াশা মিহি বৃষ্টি ঝরাচ্ছে।

হায় রে কপাল! ভিজতেই হবে।

আমার মেরুন-সাদা স্ট্রাইপের সকার জার্সির ভেজা কলারটা তুলে দিলাম।

পরে, গত বছরের সে রাতটির কথা অনেক ভেবেছি। টাইম ট্র্যাভেল করেছিলাম আমরা নিঃসন্দেহে।

দ্য বিস্ট কি স্বয়ং আমাদেরকে অতীতে নিয়ে গিয়েছিল? নাকি পি. ডি. সুইচ টিপে পেছনে পাঠায় জিনা আর আমাকে?

গত সামারে দ্য বিস্ট-এ যখন রাইড নিচ্ছি, কোনভাবে তখন ষাট বছর আগের ফায়ারলাইট পার্কে চলে যাই আমরা। কীভাবে কিংবা কেন তা জানি না। তবে অদ্ভুত ব্যাপারটা সত্যিই ঘটেছিল।

এখন বৃষ্টিতে জড়সড়, একটা চিন্তা ঘাই মারল আমার মাথায়। কপাল থেকে ক’গাছি ভেজা চুল সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

গতবার কোস্টারটা আমাদের দু’জনকেই অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

এবার, যে কোন কারণেই হোক, জিনাকে একাই টেনে নিয়ে গেছে।

কল্পনায় বেচারীর ছবি ফুটে উঠল, ভিন্ন কোন সময়ে একাকী আটকা পড়েছে ও-চোখজোড়া অশ্রুসজল।

ও এমনকী বিপদেও পড়ে থাকতে পারে।

ওকে আমার সাহায্য করতে হবে। কিন্তু কাজটা একা করব কীভাবে! কারও সহযোগিতা দরকার।

দ্য বিস্ট-এর কাছে আমার ফিরতে হবে।

পি. ডি. হয়তো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

প্রাচীন ভূতটা হয়তো অতীতের ফাঁদ থেকে জিনাকে উদ্ধারে কোনওভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলাম, গার্ডদের ফিরতি টহলের সময় যে ঘাপটি মারব সে কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।

ওরা পাশ কাটানোর ক’মুহূর্ত আগে মাটিতে সটান শুয়ে পড়লাম আমি।

যাক, অল্পের জন্য রক্ষা।

ওদের একজন পথ থেকে নেমে গেল।

ওয়েস্ট বাস্কেটটা বরাবর আসছে।

সোজা আমার উদ্দেশে।

তার ফ্ল্যাশলাইটের আলো সরাসরি এসে পড়ল আমার মুখের ওপর।

‘দেখে যাও, কী পেয়েছি!’ সঙ্গীর উদ্দেশে চেঁচাল ও।

ছয়

পাহারাদার ঝাঁপাল আমার উদ্দেশে।

দৌড় দেয়া উচিত, কিন্তু আমার স্নিকার্স যেন গেঁথে গেছে মাটিতে।

তাছাড়া, ডান পায়ে কোন সাড় নেই। ওটাকে আলুর বস্তার মত হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে আমার।

হয়তো মগজটাও অবশ হয়ে গেছে, লোকটাকে বলার মত ভাল কোন কাহিনীও ফাঁদা হয়ে ওঠেনি।

কথা বলতে পারব কিনা এমনকী তা-ও জানি না। জিভটা যেন অসাড়!

ঝুঁকল পাহারাদার। আমার ওপর তার দীর্ঘ ছায়া পড়ল। চোখ বুজে ফেললাম, ভাবছি এই বুঝি কাঁধজোড়া চেপে ধরে এক টানে দাঁড় করিয়ে দেবে আমাকে।

কিন্তু অমন কিছু ঘটল না।

চোখ মেললাম, একটা-একটা করে। নিরাপত্তারক্ষী সটান সিধে হয়েছে আবারও।

চোখ নামিয়ে চেয়ে রয়েছে ওর হাতের দিকে

‘কী পেয়েছি দেখো,’ এবার বন্ধুর উদ্দেশে হেঁকে বলল। ‘খাঁটি রুপোর ডলার।’

স্বস্তিতে মূর্ছা যাওয়ার জোগাড় হলো আমার, লোকটা যখন সঙ্গীকে ওটা দেখাতে দৌড়ে গেল।

‘কী বুঝলে! এটা উনিশশো আটাশের!’ চেঁচিয়ে উঠল উত্তেজিত কণ্ঠে। এগুলো যে এখনও পাওয়া যায় জানতাম না।’

‘তুমি তো ঠিকই বড়লোক হয়ে গেলে হে!’ চাপা হাসল ওর বন্ধু, এবার দু’জনে হেলেদুলে হাঁটা দিল।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বেগটা বেড়েছে এখন। আমার শার্ট-প্যান্ট ভিজে সপসপে, স্নিকারের তলা দুটো কাদায় মাখামাখি।

গার্ডরা শ্রবণসীমার বাইরে না যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম। এবার ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ালাম, মাটিতে পায়ের পাতা ঠুকলাম সাড় ফেরাতে।

তারপর সোজা দ্য বিস্ট বরাবর হাঁটা দিলাম।

পার্কে কেমন যেন এক গা ছমছমে পরিবেশ। ফিনফিনে বৃষ্টির চাদরের ওপাশে ঢাকা পড়েছে দালানকোঠা আর রাইডগুলো।

বাড়িগুলোর পেছনে যে ঘাসে মোড়া অলিপথটা রয়েছে ওটা ধরে পা চালাচ্ছি। আর কোন পাহারাদারের খপ্পরে পড়তে চাই না। ভেজা ঘাস মাড়িয়ে চলেছি, স্নিকারজোড়া প্যাচ-প্যাচ শব্দ করছে।

দৌড়তে বেগ পাচ্ছি রীতিমত। যন্ত্রণার ছোট-ছোট নিঃশ্বাস পড়ছে। আবারও সেই অনুভূতিটা টের পাচ্ছি, ভারী এক পাথর যেন চেপে বসেছে আমার ওপরে।

জিনার জন্য ভয়ানক দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কেন জানি মনে হচ্ছে আমাকে ওর দরকার।

ওর কাছে যেভাবে হোক পৌঁছতে হবে। ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা ঘটার আগেই সাহায্য করতে হবে ওকে।

আমার নিজের অবস্থাও বেগতিক। সারা শরীর ভিজে জবজব করছে, ঠাণ্ডায় কাঁপছি দস্তুরমত।

হঠাৎই একটা শব্দ পেলাম।

থমকে দাঁড়িয়ে শ্বাস চাপলাম, কান পেতেছি।

বৃষ্টির শব্দ শুনছি, দালানগুলোর ছাদে আর ছোট গাছগুলোর পাতায় মিহি বালির মতন ঝরছে বৃষ্টির পানি।

কিন্তু অন্য একটা শব্দও কানে এসেছে আমার।

কাঠের ট্র্যাকে চাকার ভুতুড়ে খটাখট আওয়াজ।

এ শব্দটা চিনতে কখনও ভুল হবে না আমার।

এটা কোস্টারের চাকার ঘরঘরানি, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে কাঠের ট্র্যাকের ওপর দিয়ে শূন্য বগিগুলোর গড়িয়ে চলার ফাঁকা আওয়াজ।

দ্য বিস্ট!

এক দৌড়ে র‍্যাম্পে উঠে প্ল্যাটফর্মে হড়কে থেমে পড়লাম।

এবার দেখলাম লোকটাকে। কন্ট্রোল লিভারে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, মাথাটা নোয়ানো।

লম্বা হাতা কালো সোয়েটারের ওপর সেই বিশাল, সেকেলে ওভারলটা পরা।

প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে আচমকা ভেজা দমকা হাওয়া বয়ে গেলে কেঁপে উঠলাম। লোকটার মাথার সাদা ধবধবে চুল আলগা, রুপোলী হুডের মতন উড়ে উঠল বাতাসের ঝাপ্টায়।

ধড়াস ধড়াস করছে আমার হৃৎপিণ্ড। গলা খাঁকরালাম। কন্ট্রোল থেকে চোখ তুলল না সে।

আমাকে মনে হয় এখনও দেখেনি। দেখুক তা চাই কিনা এমনকী নিজেও জানি না।

এখনও কেটে পড়ার সুযোগ আছে।

ঘাড়ের পেছনের চুল সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেছে টের পাচ্ছি। কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়লাম না।

আমি এখানে এসেছি পি. ডি.-কে খুঁজতে, কারণ আমার মন বলছে একমাত্র সে-ই আমাকে সাহায্য করতে পারে।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি সেধে তার কাছে যেতে চাই।

ইস, জিনা এখানে থাকলে কী ভালই না হত! তাহলে ওকে নিয়ে চটজলদি বিদেয় হতে পারতাম এখান থেকে।

গা শিরশির করছে আমার। সর্বাঙ্গ ভেজা। ক্লান্তি বোধ করছি। গলা শুকনো ঠেকছে।

কিন্তু কী আর করা, ঢোক গিলে, মুখ খুললাম ভূতটার সঙ্গে কথা বলার জন্য।

সাত

‘হ-হাই,’ ক্ষীণস্বরে ককিয়ে উঠলাম।

কন্ট্রোল প্যানেল থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে চাইল পি. ডি.। তার ফ্যাকাসে মুখে কালো চোখের মণিজোড়া কোটরে বসা। ঠোঁট দুটো দৃঢ় আর কঠোর দেখাল।

প্ল্যাটফর্মের ছাদে বৃষ্টিপাতের শব্দ ছাপিয়ে, আমাদের মাথার ওপরে কোথাও থেকে কোস্টারের বগিগুলোর খটাখট আওয়াজ কানে এল।

তবুও মুখে কথা নেই ওর।

আমি এবছর দু’পাশে ছোট আর পেছনে লম্বা চুল রেখেছি। এবং মাথায় সোয়া তিন ইঞ্চি লম্বা হয়েছি।

ও কি আমাকে চিনতে পারছে না?

কপালের ওপর থেকে ভেজা চুল সরিয়ে তুতলে বললাম, ‘আ-আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’

‘অবশ্যই পারছি, কিশোর,’ ওর কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল বড় কোন হাঁড়ি থেকে গলগল করে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে এলে যেমন হয়, কুয়াশা তেমনিভাবে তার গলার আওয়াজে নড়ে উঠে প্ল্যাটফর্মটাকে আড়াআড়ি পেরিয়ে গেল ঘুরপাক খেয়ে।

‘বাঁচলাম!’ স্বস্তির হাসি হেসে ক’কদম এগিয়ে গেলাম তার উদ্দেশে।

বাতাসের আর্দ্রতায় পুঁতির মতন দানা ছড়িয়ে পড়েছে ওর সাদা দাড়ি-গোঁফে। মনে হচ্ছে খুদে খুদে কয়েকশো হীরে বুঝি চমকাচ্ছে আঁধারে।

কথা বলতে শুরু করল ও, ধোঁয়াটে কুয়াশায় নিচু, গুড়-গুড় শব্দ বেরোল ওর গলা দিয়ে।

‘ফায়ারলাইট পার্কের সে রাতটার কথা কখনও ভুলব না আমি। তুমি আর তোমার বান্ধবী জিনার সাথে চমৎকার সময় কাটিয়েছিলাম।’ ঠোঁটজোড়া মুড়ে গিয়ে হাসি ফুটল এবার। ‘সে রাতের উষ্ণ স্মৃতি ভোলার নয়।’

পেটে হাত বোলাল ও।

‘আমি মনে হয় আধ ডজন হট ডগ সাঁটিয়েছিলাম। তোমার তো অনেক টাকা!’ মাথাটা পেছনে ঝাড়া মেরে হা-হা করে হেসে উঠল ও প্ল্যাটফর্মের ছাদে বাড়ি খেয়ে ছড়িয়ে পড়ল যেন শব্দটা। ‘বড়লোক মানুষ!’

বড়লোক? আমি?

আসলে হয়েছে কি, আধুনিক সময়ের টাকার মূল্যমান তো সেকালে অনেক। অতীতে চলে গিয়েছিলাম না? ওখানে একেকটা হট ডগ মাত্র তিন সেন্টে কিনেছিলাম। ভাবা যায়!

পি. ডি. বলে চলল, এত টাকা কোন ছোট ছেলের কাছে দেখিনি। বেশিরভাগ ছেলেপিলেই তো আমার মত হদ্দ গরীব। ওটা ছিল ফায়ারলাইট পার্কে কাটানো আমার সেরা রাত।’

এবার মুখের চেহারায় মেঘ জমল ওর।

‘অবশ্য শেষ রাতও বটে,’ ব্যথাভরা কণ্ঠে বলল।

স্রেফ মাথা ঝাঁকালাম, কোন কথা বললাম না।

কী বলব? আপনি মারা গিয়েছিলেন বলে আমি খুবই দুঃখিত? ‘তোমাকে দেখে অনেক খুশি হলাম, কিশোর। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?’ জানতে চাইল।

এবার গড়গড় করে সব বলে ফেললাম। কীভাবে রাইড শেষে চোখ মেলতেই দেখি জিনা নেই।

‘তাই এখানে এসেছি,’ ব্যাখ্যা করলাম। ‘আপনার সাহায্য চাইতে।’

নীরবে লম্বা দাড়ি টানল পি. ডি.। শেষমেশ কথা যখন বলল, ভৌতিক ফিসফিসে স্বর ফুটল ওর গলায়।

‘এখনও বুঝতে পারছি না, কিশোর। আমি সাহায্য করতে পারব ভাবছ কেন তুমি?’

‘আপনিই আমার একমাত্র আশা, পি. ডি.,’ মিনতি করলাম। ‘একমাত্র আপনিই পারেন-’

এসময় দু’জন নিরাপত্তাকর্মী কুয়াশা ফুঁড়ে আমার পেছনে উদয় হলে থেমে গেলাম।

‘এখানে কী করছ তুমি?’ ওদের একজন জবাব চাইল।

‘পি. ডি.-র সাথে কথা বলছি,’ ব্যাখ্যা করলাম, কন্ট্রোল বুথের উদ্দেশে হাত দেখালাম।

প্ল্যাটফর্মে পাক খাওয়া কুয়াশার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল দুই পাহারাদার।

‘কার সাথে?’ লোকটা জিজ্ঞেস করল।

কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ক’মুহূর্ত আগে পি. ডি. যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে এখন কেবলই কুয়াশার ঘূর্ণিপাক।

প্রেতাত্মাটা স্রেফ উধাও।

কিন্তু জলজ্যান্ত পাহারাদার দু’জন তো এখানে রয়েছে।

এবং আমাকে বাগে পেয়েছে ওরা।

ফাঁদে পড়েছি আমি।

আট

দু’জন আমার দু’পাশে, পাহারাদারেরা র‍্যাম্প ধরে হাঁটিয়ে, দ্য বিস্ট-এর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল আমাকে।

কাঁধের ওপর দিয়ে অসহায়ের মত এক পলক চাইলাম।

‘বাছা, পার্ক বন্ধ হয়ে গেছে জান না তুমি?’ একজন প্রশ্ন করল।

‘এটা অনুপ্রবেশ,’ বলল আরেকজন। ‘আইন ভাঙছ তুমি।’

‘তোমার গার্ডিয়ানদের ফোন করা হবে,’ বলল প্রথমজন। ‘তাঁরা মোটেই খুশি হবেন না।’

আমাকে প্রায় বয়ে নিয়ে চলল দু’জনে পার্ক ভেদ করে, নীরব রাইডগুলো আর সবকটা অন্ধকার বুথের পাশ দিয়ে।

ওরা সুযোগ দিলেও মনে হয় না নিজের পায়ে হাঁটতে পারতাম। পাজোড়ায় অবশ আর প্রাণহীন অনুভূতি।

বুকের কাছে মাথা নুয়ে পড়েছে আমার।

জিনা এখন সত্যিকারের বিপদে।

ওরা আমাকে পার্ক থেকে বের করে দিলে ওকে আমি উদ্ধার করব কীভাবে?

এবং চাচা-চাচী আমাকে নিতে এলে তাদেরকেই বা কী বলব? আর জিনার বাসার লোকেদের?

মহাবিপদে পড়েছি আমি। এমনকী জিনার সাহায্যও পাব না এখন।

জিনা সবসময়ই দুর্দান্ত সব ব্যাখ্যা হাজির করে আমাদেরকে ঝামেলামুক্ত করতে। বড়দেরকে চমৎকার সামলায় ও। আমার চাচা-চাচী তো ওকে খুব ভালবাসে। জিনা বেড়াতে এলে আমার ওপর তারা সে কটা দিন খেপে না বললেই চলে।

কিন্তু এখন চরম খেপা খেপবে, কোন সন্দেহ নেই। দেখলাম বৃষ্টির পানি জমা গর্তগুলো ম্লান আলোয় ঝকমক করছে, আমাকে যখন ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রিট দিয়ে হাঁটিয়ে মেইন গেটের উদ্দেশে নিয়ে চলল ওরা।

আমাকে নিয়ে যাবে ওদের শীতল, উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত সিকিউরিটি অফিসে। ফোন করবে আমার বাসায়। তারপর শুরু হবে নানা ধরনের জেরা।

চোখ ফেটে পানি আসছে আমার। আর হয়তো কখনও জিনাকে দেখতে পাব না।

বৃষ্টির গতি আরও বেড়েছে। মাটির কাছে যেন জমাট বেঁধেছে কুয়াশা, আমাদের পায়ের পাতা ঘিরে ঘুরছে, বুদ্বুদ ছড়াচ্ছে।

এবার ফোয়ারার মতন আমাদের সামনে ছিটকে উঠল ওটা, আমাদের মাথা ছাপিয়ে উঁচু হয়ে উঠছে ক্রমেই।

একটু পরে, কুয়াশার কুণ্ডলী ধীরে-ধীরে একটা মুখের আদল নিতেই সভয়ে শ্বাস চাপলাম। একজোড়া কোটরাগত বড়-বড় চোখ আর ঝলসানো লম্বা দাড়ির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছি। মুখখানায় কিলবিল করছে অগুনতি পোকা, মাংস খুবলে খাচ্ছে।

নাকে ভক করে পচা মাংসের দুর্গন্ধ এসে লাগল। ওটার চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো, ছুরির মত বিধল আমাকে। এবার কুৎসিত পোকা-মাকড়গুলো চোখের কোটর বেয়ে পিলপিল করে চুইয়ে পড়ে, আমাদের পায়ের কাছে পেভমেন্ট বিছিয়ে ফেলল।

পরমুহূর্তে, ভয়ালদর্শন মড়ার খুলিটা মুখ হাঁ করে রক্ত হিম করা বিকট গর্জন ছাড়ল।

নয়

আতঙ্কিত গার্ডরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল।

আমি কোন কিছু ভাবলাম না। স্রেফ ঝেড়ে দৌড় দিলাম।

পরক্ষণে, ঘন, ঘূর্ণি-কুয়াশার মধ্যে এক ছুটে ঢুকে পড়লাম। এবার ঝোপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে লুকোলাম।

পেভমেন্টে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। অন্যরা ধেয়ে এসেছে সাহায্য করতে। একাধিক দরজা ককিয়ে খুলল আর সশব্দে বন্ধ হলো। স্যাঁতসেঁতে বিষণ্ণ অন্ধকার চিরে দিল ফ্ল্যাশলাইটের আলো।

পাহারাদারদের বিড়বিড়ানি স্পষ্ট কানে এল আমার।

‘বললাম না, ভয়ঙ্কর এক দানব ওটা।’

‘বিশাল কোন জিন্দালাশ বা অমন কোন কিছু! দেখলে বুঝতেন, কী প্রকাণ্ড আর বীভৎস!’

‘তোমরা পাগল হয়ে গেছ! নির্ঘাত চোখের ভুল!’

‘না! সত্যি বলছি।’

‘হুম, তোমরা দু’জন অতিরিক্ত হরর মুভি দেখো।’

‘আমি জানি কী দেখেছি!’

‘কী দেখেছ?’

‘জানি না! তবে আমার দুঃস্বপ্নে বারবার হানা দেবে ওটা!’

‘অ্যাই, ছেলেটা কই?’

‘ছেলেটা? এখানেই তো ছিল।’

‘নিশ্চয়ই পালিয়েছে।’

আরও পদশব্দ! আরও হাঁচড়পাঁচড় আর চেঁচামেচি। বৃষ্টি কেটে ফ্ল্যাশলাইটের আভা।

ঝোপের ভেতর সিঁটিয়ে বসে রয়েছি, আশা করছি ওরা যেন আমাকে খুঁজে না পায়।

ঝুঁকলাম ভিজে একসা একটা জুতোর ফিতে বাঁধতে-এমনিসময় কাঁধে কে যেন টোকা দিল।

হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার দশা।

ওহ, না!

ঝট করে ঘুরে চাইতেই দেখি পি. ডি.। ছেলেমানুষের মত দাঁত কেলিয়ে হাসছে। কী খুশি!

‘কেমন দেখালাম বলো?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে এক পাশে ঢলে পড়লাম প্রায়।

‘ওটা আপনি ছিলেন? ওহ, আরেকটু হলে ভয়ে মরেই যেতাম!’

‘ধন্যবাদ।’ আমুদে গলায় জানাল। ‘তারমানে আমি এখনও ফুরিয়ে যাইনি। কত বছর হলো মানুষকে ভয় দেখাই না! ভারী মজা লাগে কিন্তু!’

আমার পাশে উদয় হলো ও এবং আমাকে টেনে তুলতে এক হাত নামাল। বাপ রে, কী শক্তি ওর গায়ে! মনে হলো উড়াল দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালাম বুঝি।

‘এসো,’ বলল ও। ‘হাতে সময় কম।’

‘তারমানে কি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন? আশা নিয়ে জানতে চাইলাম।

‘চেষ্টা করব,’ জবাবে বলল সে। ‘ইদানীং এখানে বেশ কিছু অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটেছে।’

‘অদ্ভুতুড়ে?’ প্রতিধ্বনি করলাম।

মাথা ঝাঁকাল ও, হাত বোলাল দীর্ঘ সাদা দাড়িতে।

‘অতীতের জিনিসপত্র কীভাবে যেন চলে এসেছে বর্তমানে।’

‘কী ধরনের জিনিস?’ শুধালাম।

‘এক মহিলার ছাতা। কিছু খুচরো পয়সা। পুরনো দিনের টুকিটাকি জিনিস…’ কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল ওর। ‘চলো দ্য বিস্ট-এর কাছে যাই। ওটাই আমাদের একমাত্র আশা-ভরসা।’

বৃষ্টির মধ্য দিয়ে ওর ভুতুড়ে অবয়বটিকে অনুসরণ করলাম। পথ চলতে হিমশিম খাচ্ছি রীতিমত। পানির গর্ত আর গার্ডদের বারবার ফাঁকি দিয়ে চলেছি। চারদিকেই যেন ছড়াছড়ি দুটোরই।

পি. ডি.-র লম্বা-লম্বা কদমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বেগ পেতে হচ্ছে। আমার ভেজা চুপচুপে স্পিকার্স কাদায় পিছলে যাচ্ছে একটু পরপরই, তবুও টলমল পায়ে অনুসরণ করে চললাম ওকে।

মাঝেমধ্যেই যেন বৃষ্টি আর কুয়াশার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অশরীরী পি. ডি.-র ছায়াশরীর। কয়েকবারই হারিয়ে ফেললাম ওকে।

কিন্তু এটা অন্তত জানি কোথায় যাচ্ছি। আমরা ফিরছি দ্য বিস্ট-এর কাছে।

শেষমেশ টলতে টলতে র‍্যাম্প ধরে হেঁটে প্ল্যাটফর্মটায় পৌঁছলাম।

পি. ডি. আগেই হাজির হয়ে গিয়ে কন্ট্রোলে দাঁড়িয়ে। বগিগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে খটখটিয়ে লোডিং স্টেশনে নিয়ে আসছে।

‘জলদি,’ তাড়া দিল ও, ‘ওরা ধরে ফেলার আগেই কোস্টারে ওঠো।’

চকচকে ভেজা আসনগুলোর ওপর দৃষ্টি পড়ল আমার। কোথায় বসব?

আমার মন পড়ে জবাবটা দিয়ে দিল পি. ডি.

‘জিনার সিটে বসো,’ নির্দেশ দিল। ‘ও যেখান থেকে অদৃশ্য হয়েছে পারলে ঠিক সেখানটায় বসো।‘

মাথা ঝাঁকিয়ে কোস্টারের সামনের দিকে ছুটে গেলাম। জিনার আসনে বসে সেফটি বারটা সশব্দে নামালাম।

দ্য বিস্ট ঘুরতে আরম্ভ করল।

গা ছমছম করছে, বৃষ্টির মধ্যে একাকী বসে রয়েছি ফাঁকা, ভুতুড়ে কোস্টারে। মসৃণ, অন্ধকার ট্র্যাক ধরে খটাখট শব্দ তুলে উঠে যাচ্ছে ওটা।

আমার মনে একটা ভাবনা খেলে গেল: এরকম ঝুম বৃষ্টির মধ্যে পার্কওয়ালারা দ্য বিস্ট বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু ও নিয়ে ভাবার সময় পেরিয়ে গেছে।

তাছাড়া ভেবে হবেই বা কী? এখন তো জিনাকে উদ্ধার করাটাই আসল কাজ।

বুক ধড়ফড় করছে। ঠাণ্ডা, পিচ্ছিল বারটা এত জোরে আঁকড়ে ধরেছি, হাতজোড়া টাটাচ্ছে। বৃষ্টিমুখর আঁধারে ক্রমেই উঠে যাচ্ছি আমি।

কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। চারদিকে শুধুই আঁধারের চরকিপাক। আচমকা বগিটা সামনের দিকে আছড়ে পড়ে গতি তুলল। দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে, সগর্জনে উঠে চলেছে ট্র্যাক ধরে।

সে মুহূর্তটির জন্য নিজেকে তৈরি করলাম, প্রথম পাহাড়টার চূড়ায় ওঠার পর আবার যখন পতন হবে নিচে।

এবার ভাবলাম, চূড়ায় তো এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা! কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটা এল না তো এলই না। এবং এল না বলে প্রতিমুহূর্তেই ভয় জেঁকে বসতে লাগল আমার মনে।

মিসাইলের মত দ্রুত আর উঁচু হয়ে আঁধারে অন্ধের মতন ছুটে চলেছে কোস্টার।

বাতাস শিস কেটে চলে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে। কাঁধজোড়া আড়ষ্ট, টনটন করছে। কান দুটোও দপ দপ করছে ব্যথায়।

এবার বিকট আর্তনাদ ছাড়লাম, ট্র্যাক থেকে যেই খসে পড়ল চাকাগুলো-এবং বগিটা সাঁ করে রকেটের মত উড়ে গেল আকাশে।