নিখোঁজ যাত্রী – ২

দুই

‘কী বেয়াড়া লোক রে, বাবা,’ বলল রবিন, ওরা তখন গ্রীনফিল্ড ট্রেইন স্টেশনের এক খাম্বায় শেষ পোস্টারটা টেপ দিয়ে লাগাচ্ছে।

‘তাতে কোন সন্দেহ নেই,’ সহমত হলো কিশোর।

আবারও হাতঘড়ি দেখে নিল নথি।

‘বাদ দাও, মিস্টার প্রাইসের ট্রেইন এখুনি এসে পড়বে। আমরা রেডি তো?’

‘আমি রেডি!’ জবাবে বলল ডন।

‘আমিও,’ বলল কিশোর।

‘খাইছে, আমিও তৈরি,’ জানাল মুসা। ‘একটু শুধু… নার্ভাস লাগছে।’ হেসে উঠল।

রবিন বলল, ‘ট্রেইনটা লেট না করলেই হয়। আমি চাইব না-’

ঠিক সে মুহূর্তে, দূর থেকে ট্রেইনের ক্ষীণ কু ঝিকঝিক শোনা গেল।

‘লেট করবে না, বলল কিশোর।

একটু পরে, ট্রেইনটা বাঁক ঘুরে উদয় হতেই ভালমত দেখার জন্য সামনে ঝুঁকল ছেলেরা। রবিন সটান সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝাড়ল।

‘হ্যাঁ, সবাই তৈরি হয়ে নাও…’

ট্রেইনটা পুরোপুরি থেমে দাঁড়ানোর পর, হড়কে খুলে গেল দরজা, এবং বাইরে বেরিয়ে এল কণ্ডাকটররা। সামনে সোনালী বোতাম নিয়ে জমকালো নীলরঙা উর্দি তাদের পরনে। এবার যাত্রীরা নামতে লাগল। অসংখ্য মানুষ। ছেলেরা গ্রীনফিল্ডের কয়েকজন বাসিন্দাকে চিনল। অন্যরা অপরিচিত।

ছেলেদের জানা নেই, কোন্ বগিতে মি. প্রাইস রয়েছেন, তাই সবকটা দরজায় কড়া নজর রেখেছে ওরা। মুসা ট্রেইন থেকে দুটো ছোট ছেলে-মেয়ে সহ এক পরিবারকে নামতে দেখল। বাচ্চা দুটি কাঁদছে। ছোট্ট ছেলেটা অবিরাম চোখ কচলাচ্ছে আর ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে। ছোট মেয়েটির গাল বেয়ে দরদর করে অশ্রু গড়াচ্ছে, ওর হাতে চামড়ার লম্বা এক ফিতে। ওদের বাবা লাল ব্ল্যাঙ্কেটে মোড়া বড়সড় এক বাক্স জাতীয় কিছু বইছেন।

‘কিশোর, ওদিকে দেখো,’ বলল মুসা।

‘মিস্টার প্রাইস?’ জবাবে বলল কিশোর।

‘না, বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটো। কাঁদছে ওরা।

এক কণ্ডাকটর এগিয়ে এসে কথা বলল পরিবারটির সঙ্গে। হাসিখুশি লোকটির লাল চুল বেরিয়ে রয়েছে ক্যাপের তলা থেকে। বাবা-মার সঙ্গে প্রথমে কথা বলল সে, তাঁদেরকে উদ্বিগ্ন দেখাল। এবার হাঁটু গেড়ে বসে বাচ্চা দুটোর মন ভাল করার চেষ্টা করল। জ্যাকেটের পকেট থেকে দুটো ললিপপ বের করল সে। বাচ্চাগুলো নিল, তবে তাতে ওদের কান্না থামল না।

‘ওদের কী হয়েছে?’ বলল ডন।

‘কে জানে,’ বলল মুসা। এত মানুষ আশপাশে কথা শোনা যাচ্ছে না।’

খানিক পরে, কণ্ডাকটর উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটার মাথায় হাত বোলাল। বাবা তাঁর মেয়েটির মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে কী যেন বললেন ওকে। এবার কণ্ডাকটর পরিবারটিকে পেছনে নিয়ে পা বাড়াল।

‘নিশ্চয়ই দুঃখের কোন ঘটনা ঘটেছে,’ বলল রবিন।

‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল কিশোর। ‘আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মিস্টার প্রাইস কোথায়?’ জনতার মাথার ওপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করল, তবে এখনও অতটা লম্বা হয়ে ওঠেনি ও।

‘তা-ই তো ভাবছি,’ বলল রবিন, চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল। ‘তাঁর কোন চিহ্নই তো নেই।’

ছেলেরা ট্রেইনের উদ্দেশে কাছিয়ে গেল, সবকটা দরজা যাতে ভালভাবে দেখতে পায়। এক মুহূর্ত পেরোল, এবার আরেক। ভিড় পাতলা হয়ে আসছে। যাত্রীরা পরিবার-পরিজন আর বন্ধুবান্ধবদের খুঁজে পেয়ে স্টেশন ত্যাগ করছে। চাকা লাগানো সুটকেসের শব্দও একসময় মরে এল। ছেলেরা এখন একা।

সবাই ট্রেইন থেকে নেমেছে-এবং উইলার্ড প্রাইসের ছায়ামাত্র নেই কোথাও।

রবিন বলল, ‘তাঁকে দেখনি তুমি শিয়োর?’

‘দেখিনি,’ জবাবে বলল কিশোর। ‘এবং আমি নিশ্চিত আর সবাইকেই দেখেছি।’

‘খাইছে, আমিও,’ বলল মুসা।

‘উনি হয়তো বোঝেননি এটা তাঁর স্টপ, তাই হয়তো নামতে ভুলে গেছেন,’ বাতলে দিল ডন।

‘না,’ জোর গলায় বলল নথি। ‘কাল পর্যন্ত গ্রীনফিল্ডই এই ট্রেইনের শেষ স্টপ, তারপর আবার এটা উত্তরে রওনা দেবে। আর কোন স্টপ নেই। কাজেই তিনি ভুলে গেলেও এখানেই তাঁকে নামতে হবে।’

কিশোর পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে ভাঁজ খুলল। মি. প্রাইসের আগমনের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য টুকে রেখেছিল ও।

‘এই যে…শনিবার সকাল সাড়ে দশটায়, ষোলো নম্বর ট্রেইনে তাঁর আসার কথা।’ এমাথা-ওমাথা হেঁটে সবকটা বগি নিরীখ করল ওরা। ওই তো, ইঞ্জিনের এক পাশে ‘১৬’ লেখা সাদা কালিতে। ‘এটাই সেটা, কোন ভুল নেই এতে,’ বলল কিশোর।

‘খাইছে, তাহলে তিনি গেলেন কোথায়?’ মুসা ওর ভাবনা প্রকাশ করল।

এসময় লালচুলো কণ্ডাকটরকে এক গাদা টিকিট গুনতে- গুনতে প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে যেতে দেখল ওরা।

‘উনি হয়তো জানতে পারেন, বলল কিশোর, দুলকি চালে দৌড়ে লোকটার কাছে গেল। ‘একটু শুনবেন, প্লিজ?’

লোকটা ঘুরে দাঁড়াতেই ছেলেরা এই প্রথমবারের মত লক্ষ করল তার উর্দি পুরো ভিজে জবজবে।

‘এ কী!’ বলে ফেলল হতভম্ব ডন।

কণ্ডাকটর মুচকি হাসল।

‘ও, এই ব্যাপার? উত্তরে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যে নামতেই এ দশা করে ছেড়েছে আমার।’

‘তারমানে ভাল ঝড়-বৃষ্টিই হয়েছে,’ বলল মুসা।

‘হ্যাঁ, এ বছর এমন ঝড়-তুফান আর দেখিনি। বাদ দাও, তোমাদের জন্যে আমি কী করতে পারি, বাছারা?’

পেছনের পকেট থেকে প্রাইসের বইয়ের একটা কপি বের করল কিশোর। এটা ওর তুলে ধরে দেখানোর কথা ছিল, লেখক ভদ্রলোক যেন ট্রেইন ছেড়ে নেমে সহজেই ওদেরকে চিনতে পারেন।

‘এরকম চেহারার কাউকে কি দেখেছেন ট্রিপের সময়?’ বইটা উল্টে পেছনের প্রচ্ছদ দেখাল ও। প্রাইসের হাসিমুখের ছবি ছাপা ওখানে। সুদর্শন, বয়স্ক ভদ্রলোক তিনি, মাথায় ঢেউ খেলানো বাদামী চুল আর চঞ্চল চোখজোড়ায় দুষ্টুমির ঝিলিক তাঁর।

‘আজ সকালে ওঁর এখানে আসার কথা,’ বলল নথি। ‘আমরা অপেক্ষায় ছিলাম।’

‘ভদ্রলোক গ্রীনফিল্ড লাইব্রেরি ভিজিট করছেন,’ বলল মুসা।

‘উনি খুব ভাল লেখেন!’ জুগিয়ে দিল ডন।

হেসে উঠল কণ্ডাকটর।

‘তোমার বয়সী একটা ছেলে আছে আমার, কাজেই কথাটা মনে গেঁথে নিলাম।’ কিশোরের হাত থেকে বইটা নিয়ে ছবিটা খুঁটিয়ে দেখল।

‘না, দেখিনি। এরকম চেহারার কেউ আমার বগিতে ছিলেন না। তোমরা অন্যান্য কণ্ডাকটরদের সাথে কথা বলে দেখতে পারো।’ স্টেশনের উদ্দেশে তর্জনী দেখাল।

‘অনেক ধন্যবাদ,’ তাকে বলল কিশোর। ‘এসো সবাই।’

ছেলেরা ছোট্ট স্টেশন হাউসটায় ঢুকল, অনেক পুরানো, ছিমছাম আর সুন্দর ওটা। অ্যান্টিক স্টোরের মত শুকনো, ধুলোটে গন্ধ পাওয়া যায় এখানে এলে। ওরা আগেও কয়েকবার এসেছে।

অন্য দুই কণ্ডাকটরকে বসে থাকতে দেখল ছেলেরা। কাগজ- কলম নিয়ে ব্যস্ত তারা। বৃষ্টিতে সপসপে হয়ে গেছে তাদের উর্দিও।

‘সে কী ভয়ঙ্কর ঝড়!’ একজন বলল। ‘জানালা দিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।’

‘আমার কুকুর এমন ঝড়-বৃষ্টি দেখলে নির্ঘাত লেজ গুটিয়ে সিটের তলায় লুকোত,’ বলল অপরজন।

‘মাফ করবেন,’ বলল রবিন। প্রাইসের কথা খুলে বলল। কিশোর বইটা দিলে দু’জনেই একে-একে দীর্ঘক্ষণ ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখল।

‘জমজমাট কাহিনী মনে হচ্ছে, এক কণ্ডাকটর পেছনের প্রচ্ছদটা পড়ে বলল। খুঁটিয়ে ছবিটা দেখে মাথা নাড়ল। ‘নাহ, এই চেহারার কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’

‘আমিও না,’ অন্যজনও জানাল।

‘ঠিক আছে,’ বলল নথি। ‘ধন্যবাদ।’

বাইরে বেরিয়ে এল ওরা, দরজাটা পেছনে লাগিয়ে।

‘কিন্তু উনি ট্রেইনে চড়েছিলেন,’ বলল রবিন। নইলে আজ সকালে লাইব্রেরিতে ফোন করতেন না।’

‘হ্যাঁ,’ কিশোর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল। ‘স্টেশন থেকে কল করে বলেছিলেন তখুনি উঠছেন ট্রেইনে। উনি আমাদেরকে জানাতে চেয়েছিলেন ট্রেইন সময়মতই ছাড়ছে, আমরা যাতে এখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে পারি।’

‘তাহলে কী হলো তাঁর?’ ডনের প্রশ্ন। ‘কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন তিনি?’

গম্ভীর শ্বাস টেনে ধীরে-ধীরে ছাড়ল কিশোর।

‘আমাদেরকে সেটাই জানতে হবে।’

‘ট্রেইনটায় তল্লাশী চালিয়ে কাজ শুরু করা উচিত,’ প্রস্তাব করল মুসা। ‘মুকুটমণি-রহস্য’ বইতে মিস্টার প্রাইস কী লিখেছেন মনে করে দেখো, প্রফেসর যখন উধাও হয়ে যান! ছোট ছেলে-মেয়ে দুটো প্রথমে সেখানে যায়, প্রফেসরকে শেষবার যেখানে দেখা গেছে। মানে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে আরকী।’

‘ঠিক বলেছ, মুসা, বলল কিশোর। ‘আইডিয়াটা ভাল। চলো আমরা ট্রেইনটায় আগে খুঁজি।’