নিখোঁজ যাত্রী – ৩

তিন

মূল ট্র্যাক থেকে সরিয়ে এক রেইল ইয়ার্ডে ঢোকানো হয়েছে ট্রেইনটাকে। ওখানে আরও কয়েক ডজন ট্রেইন রয়েছে।

‘খাইছে, এটা তো ট্রেইনের পার্কিং লট!’ বলে উঠল মুসা। ‘আমরা কোনটা খুঁজছি?’ প্রশ্ন ডনের। ‘ট্রেইনের তো ছড়াছড়ি!’

‘ষোলো নম্বরটা, ওদেরকে মনে করাল কিশোর, এবং শীঘ্রি ওটা খুঁজে পেল ওরা।

মপ আর বালতি নিয়ে এক বগির গা ধুচ্ছিল দশাসই চেহারার এক লোক।

‘এই যে, ছেলেরা,’ বলে উঠল সে। ‘তোমরা ভুল স্টপে নেমে পড়নি তো?’

কিশোর বলল, ‘না, আমরা গ্রীনফিল্ডে নানার বাসায় বেড়াতে এসেছি। ট্রেইনটা কি একবার চট করে ঘুরে দেখতে পারি?’

লোকটা মপটা মাটিতে নামিয়ে ওতে ভর দিল।

‘তোমরা কি কিছু হারিয়েছ?’ ওভারলের পেছনের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল।

‘হ্যাঁ,’ বলল ডন। ‘আস্ত একজন মানুষকে!’

পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল কিশোর। কথা শেষ হলে বলল, ‘আমরা তাই সূত্রের খোঁজে ট্রেইনটা সার্চ করতে চাই। সেজন্যেই অনুমতি নেয়া উচিত মনে করলাম।’

‘আমার কোন আপত্তি নেই,’ জানাল লোকটা। ‘আমার কাজ এটা পরিষ্কার করা।’

‘একাজে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি, প্রস্তাব করল মুসা।

‘ট্রেইনের ভেতরটা যেহেতু পরীক্ষা করছিই আমরা,’ বলল রবিন।

‘তবে তো ভালই হয়। আমার নাম রব।’ ছেলেদের সবার সঙ্গে হাত মেলাল সে, ওরা একে-একে নিজেদের পরিচয় দিল। ‘এই নাও।’ সামনে ঝুঁকে চারটে প্লাস্টিকের ব্যাগ তুলল। ‘সবার একটা করে।’

‘ধন্যবাদ, রব, বলল কিশোর।

চারটি যাত্রীবাহী বগির প্রথমটায় পা রাখল ওরা। জনমানবহীন ট্রেইনটার ভেতরে কেমন গা ছমছমে পরিবেশ, যদিও তেরছাভাবে রোদ চুইয়ে ঢুকেছে। ওপ্রান্তের দরজাটা দিয়ে পরের বগিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এবং তার পরেরটাও।

‘খাইছে, কেমন ভয়-ভয় করে, তাই না?’ বলল মুসা।

‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল কিশোর। ‘আমরা তো ট্রেইন ভর্তি মানুষ দেখতেই অভ্যস্ত। যাকগে, তল্লাশীটা সেরে ফেলি। রবিন আর আমি ওপরদিকটা দেখব। তুমি আর ডন নিচেরটা। একেকবারে একটা করে সিট।’

ছেলেরা ধীরে আর সাবধানে কাজটা করছে। প্রথম বগি দুটোতে ওরা পরিত্যক্ত খবরের কাগজ, সোডা ক্যান, কলম আর ক্যাণ্ডির মোড়ক খুঁজে পেল। তিন নম্বর বগির পেছনদিকে পৌঁছনোর পর সূত্র ভাবা যায় এমন একটা কিছু পাওয়া গেল-মিশর-রহস্য বইয়ের একটা কপি। এটা উইলার্ড প্রাইসের পঞ্চম উপন্যাস, মিশরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ নিয়ে লেখা।

‘ওয়াও, এটা দেখো!’ একেবারে শেষ আসনটার তলায় ওটা খুঁজে পেয়ে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল ডন। রবিনের হাতে দিতেই ও বইটা নিরীখ করল।

‘উনি কি নিজেই নিজের বই পড়বেন?’ ভাবনাটা প্রকাশ করল নথি।

‘ভদ্রলোক হয়তো লাইব্রেরিতে এটা নিয়ে কথা বলবেন ভেবেছিলেন,’ বলল মুসা। ‘তাই হয়তো উল্টেপাল্টে দেখছিলেন। ‘

প্রচ্ছদ ওল্টাতেই বেরিয়ে পড়ল প্রথম পাতাটা। ওপরদিকে তাড়াহুড়ো করে লেখা: মিসেস টিনা টার্নার।

‘টিনা টার্নার?’ বলল কিশোর। ‘নামটা কেমন পরিচিত লাগছে না?’

‘উনি জ্যাক নানার দু’ব্লক পরে থাকেন,’ জানাল মুসা। ‘ওই যে, হ্যালোইনে একবার অনেক ক্যাণ্ডি দিয়েছিলেন আমাদের।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ!’ বলে উঠল ডন।

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

‘তোমার তো মনে থাকবেই,’ মজা করে ডনকে বলল। ‘চকোলেটের পোকা।’

একান-ওকান হাসল ডন।

‘বড়রাও শুনেছি মিস্টার প্রাইসের বই পড়ে, বলল কিশোর। ‘তাই হয়তো ভদ্রমহিলা এটা পড়ছিলেন।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।

‘তারমানে এটা গুরুত্বপূর্ণ কোন সূত্র নয়, তাই না?’

‘হ্যাঁ,’ কিশোর বলল ওকে। তবে আমরা এটা মিসেস টার্নারকে ফিরিয়ে দেব।’

‘আচ্ছা, আমরা সময় করে যাব তাঁর বাসায়। রবিন বইটা গুঁজল ওর জিন্সের পেছন পকেটে। ‘চলো পরের বগিটার যাই।’

চতুর্থ বগির দরজা খুলল ওরা, এটাই শেষ বগি। শেডগুলো টেনে দেয়া, ফলে অন্যগুলোর চেয়ে অন্ধকার এটি। এবং বাতাসে অস্বাভাবিক এক গন্ধ।

‘খাইছে, গন্ধটা কীসের?’ প্রশ্ন করল মুসা। ‘ওষুধের মত…’

শুঁকল রবিন।

‘হুম…কেমন চেনা-চেনা লাগছে।’

‘তাই?’ শুধাল মুসা।

‘হ্যাঁ,’ আবারও নাক টানল নথি। ‘ধ্যাত, মনে পড়ছে না! তবে আমি শিয়োর এ গন্ধ আগেও পেয়েছি।’

কিশোর বলল, ‘আমিও একই কথা ভাবছিলাম, রবিন। এসো, বগিটায় তল্লাশী চালিয়ে দেখি গন্ধটা কোত্থেকে আসছে।’

মুসা কটা শেড হড়কে তুলে দিতেই আলো এসে পড়ল বগির ভেতরে। আর ছেলেদের চোখে লাগল অস্বাভাবিক ব্যাপারটা।

‘আরে, এখানে তো কোন ময়লা-টয়লা নেই,’ বলল ডন ‘মনে হচ্ছে কেউ এরমধ্যেই বগিটা সাফসুতরো করেছে।’

‘রব করতে পারে,’ বলল মুসা, ‘সে হয়তো আগেই এখানে এসেছিল।’

‘জিজ্ঞেস করব তো,’ বলল রবিন।

প্রথম সিটটার ওপর কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। ঝুঁকে তুলে নিল ওটা।

কেউ পরিষ্কার করে থাকলেও এটা তার চোখ এড়িয়ে গেছে, বলে চকচকে রুপোলী এক মোড়ক তুলে ধরল ও। ‘গ্র্যানোলা বারের র‍্যাপার।’ ট্র্যাশ ব্যাগে রেখে দিল ওটা

একটা-একটা করে বাদবাকি আসনগুলো পরখ করল ছেলেরা, কিন্তু আবিষ্কার করল বগিটা নিখুঁতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিচিত্র সেই ঘ্রাণটা আরেকটু জোরাল হলো, ওরা যেই পেছনদিকে গেল।

‘এখানে আর কিছু নেই,’ বলল রবিন। ‘চলো, যাওয়া যাক।’

ছেলেরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই রবের সঙ্গে দেখা হলো আবার। আরেকটি ট্রেইন ধোয়া-মোছার কাজ করছে এখন সে। ছেলেরা ওদের ট্র্যাশ ব্যাগগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখল। প্রতিটাই প্রায় আধাআধি ভরা এবং শক্ত করে গিট দেয়া।

‘অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে,’ বলল রব। ‘কোন ক্লু পেলে?’ রবিন পকেট থেকে বইটা বের করে তুলে ধরল।

‘আমরা মিস্টার প্রাইসের লেখা একটা বই খুঁজে পেয়েছি। তবে মনে হচ্ছে এটা আমাদের পরিচিত এক ভদ্রমহিলার। তাঁর নাম দেখলাম ভেতরে।’

‘এটাকে তো তেমন জোরাল কোন সূত্র বলে মনে হচ্ছে না, মন্তব্য করল রব।

‘হ্যাঁ, আমাদেরও তা-ই ধারণা,’ বলল কিশোর। ‘আর চতুর্থ বগিটায় কুড়ানোর মত কিছু পাওয়াও যায়নি।’

‘তার কারণ সফরের সময় ওটা বন্ধ ছিল,’ রব জানাল।

‘বন্ধ?’ রবিন শুধাল।

‘যাত্রী কম ছিল। এসব ক্ষেত্রে কণ্ডাকটররা কিছু-কিছু বগি বন্ধ করে দেয়। ফলে যাত্রীদের দেখাশোনার কাজটা সহজ হয় তাদের জন্যে। আমার জন্যেও ভাল, পরে কম বগি সাফ করতে হয়।’

‘চার নম্বর বগিটায় অদ্ভুত এক গন্ধ পেয়েছি, বলল কিশোর। ব্যাখ্যা দিল ঘ্রাণটার। ‘অমন গন্ধ থাকার কি কোন কারণ আছে?’

মাথা নাড়ার আগে এক মুহূর্ত ভাবল রব।

‘না। তবে দেখব আমি ব্যাপারটা।’

কিশোর অন্যদেরকে দেখে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আসি, রব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

হ্যাঁ, আপনার অনুমতি ছাড়া তো আমরা ট্রেইনটা সার্চ করতে পারতাম না,’ বলল রবিন।

‘ওটা কোন ব্যাপার নয়,’ বলে সবার হাত আবারও ঝাঁকিয়ে দিল রব। ‘কোন দরকার হলে আমাকে জানিয়ো।’

লাইব্রেরিতে হেঁটে ফেরার পথে রবিন বলল, ‘দেখেশুনে যা মনে হলো, মিস্টার প্রাইস সম্ভবত ট্রেইনে ছিলেন না।’

‘কিন্তু আমরা জানি ছিলেন,’ বলল মুসা। ‘উনি ট্রেইনে ওঠার আগে লাইব্রেরিতে ফোন করে জানিয়েছিলেন না?’

‘তাহলে গেলেন কোথায়?’ ডন বলল ভাবুক কণ্ঠে।

কারও কাছে এর জবাব নেই।