নিখোঁজ যাত্রী – ৯

নয়

ছেলেরা প্রথমটায় ভেবেছিল মি. হল হয়তো তাঁর বাড়িতে বিনা অনুমতিতে ঢুকে সূত্র খোঁজায় খেপে ব্যোম হয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি কামরায় পা রাখলেন হাসি মুখে।

‘লরার কাছে শুনলাম তোমরা এখানে সূত্র খুঁজছ, তাই ভাবলাম একটু ঢু মারি আরকী।

এগিয়ে এসে ওদের সঙ্গে করমর্দন করলেন, এবার ঝুঁকলেন বার্তাটা পড়ার উদ্দেশ্যে।

‘অখাদ্য? জঘন্য?’ বিড়বিড় করে আওড়ালেন। ওর বুকের পাটা আছে বলতে হবে…. এবার ছেলেদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বুকের ওপর বাহুজোড়া ভাঁজ করলেন।

‘তো আমরা আমাদের বন্ধুটিকে হারিয়েছি, তাই না?’

ছেলেরা বিখ্যাত লেখকটির সামনে কেমন থ মেরে গেছে।

‘জি, স্যর। আসলে-’ শেষমেশ মুখ খুলল কিশোর।

‘স্যর?’ হেসে উঠলেন মি. হল। ‘আমাকে স্যর বোলো না, বাছা। নিজেকে বুড়ো মনে হয়! ‘ওয়েস’ বলে ডেকো।’

কিশোর অন্যদের দিকে চেয়ে শ্রাগ করল।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ওয়েস।’ কিশোর মি. হলকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলল। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তিনি, মাঝেমধ্যে মাথা ঝাঁকালেন আর চিবুকে হাত বুলোলেন।

কিশোরের কথা শেষ হলে বললেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, তোমাদের ডিটেকটিভ স্কিল আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রায়ই গোয়েন্দাগিরি কর বুঝি তোমরা?’

চাপা হাসল রবিন।

‘সে আর বলতে!’

‘তোমাদের অভিজ্ঞতাই তার প্রমাণ দিচ্ছে।’

‘খাইছে, কিন্তু আমরা তো এখনও জানি না মিস্টার প্রাইস কোথায়,’ মনে করাল মুসা। ‘আর সময়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত!’

মুচকি হাসলেন মি. ওয়েসলি হল।

‘লাইব্রেরিতে তোমরা আমাকে নয়, উইলকে চাও, তাই না?’

ছেলেরা সঙ্গে-সঙ্গে ‘না, না’ করে উঠলেও, মি. হল এসব ভালই বোঝেন। তিনি তো আর কচি খোকাটি নন।

‘কোন সমস্যা নেই, ছুঁচোটার বইগুলো আমার বইয়ের চাইতে সবসময়ই খানিকটা বেশি চলে। তবে একদিন পাঠকের রুচি পাল্টাবে নিশ্চয়ই,’ বললেন তিনি।

‘আমাদের এখন,’ বলল রবিন, ওঁকে খুঁজে বের করতে হবে।’

‘আর টমিকে ফিরিয়ে দিতে হবে ওর পরিবারের কাছে,’ বলল মুসা।

মাথা ঝাঁকালেন মি. হল।

‘হ্যাঁ,’ বললেন। ‘বেশ, চলো তবে গ্যারাজে, গাড়ি বের করি!’ অ্যালার্টন আর গ্রীনফিল্ডের মধ্যকার প্রধান সড়কটি তিন লেনের হাইওয়ে, ওটা দিয়ে গাড়ি আর ট্রাক অবিরাম ছুটে চলেছে সাঁ সাঁ করে। মি. হল আজদাহা যে গাড়িটা চালাচ্ছেন সেটি পুরানো লন মোয়ারের মত কেবলই গোঙাচ্ছে। সিটে স্ট্র্যাপে বাঁধা ছেলেরা ঝাঁকুনি খেতে-খেতে চলার পথে মি. প্রাইসের খোঁজে ইতিউতি চাইছে।

‘অন্য গাড়িটা অবসর সময়ে বানাচ্ছিলাম,’ ওয়েসলি হল গলা চড়িয়ে বললেন ওদেরকে, রাস্তার কোলাহল ছাপিয়ে। ‘এটা আমার একটা শখ, পুরনো গাড়ি মেরামত করা। গাড়ি বিক্রির টাকা আমি চ্যারিটিতে দিয়ে দিই।’

‘খাইছে, খুব ভাল!’ বলে উঠল মুসা।

মাথা ঝাঁকালেন ওয়েসলি হল।

‘আমার শখও মিটল আর অভাবী মানুষজনের কিছু উপকারও হলো। সবারই লাভ।’

‘মিস্টার প্রাইস গাড়িটা চালাতে পারবেন তো?’ রবিন প্রশ্ন করল।

‘তোমাদেরকে টেকনিকাল কথা বলে বিরক্ত করব না, তবে না, খানিকদূর গিয়েই ইঞ্জিন গরম হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে গাড়িটা। ওটা চালিয়ে গ্রীনফিল্ড অবধি যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। ওকে রাস্তাতেই কোথাও দেখা যাবে বিগড়ানো গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’

আরেকবার হাতঘড়ি দেখে নিল রবিন। প্রায় চারটে। আর মাত্র ক’ঘণ্টা বাকি।

এক ঘণ্টা গেল হাইওয়ের এমাথা-ওমাথায় মি. প্রাইসের সন্ধানে। ছেলেরা মিসেস কোনরকে ফোনে জিজ্ঞেস করল ভদ্রলোক কোনভাবে লাইব্রেরিতে পৌছে গেছেন কিনা ইতোমধ্যে। পৌছননি।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ছেলেদের আশা উবে যেতে লাগল।

‘তিনি এ রাস্তার কোথাওই নেই,’ বলল মুসা। ‘এর মধ্যেই দু’বার আপ-ডাউন করেছি আমরা। তিনি রাস্তায় থাকলে চোখে পড়তই!’

কিশোর জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রয়েছে, মুখে রা নেই। এবার ঝট করে ঘাড় ফেরাল, চোখজোড়া বিস্ফারিত।

‘এক মিনিট!’

‘ওঁকে দেখলে, কিশোরভাই?’ ডনের প্রশ্ন।

‘না, ভাবছিলাম…মিস্টার প্রাইস সম্ভবত ক’ঘণ্টা আগে বেরিয়েছেন। হাউসকিপার বলছিলেন তিনি বাসায় ফিরে ভদ্রলোককে পাননি।’

‘তো?’ রবিন জবাব চাইল। বুঝতে পারছে না কিশোর কী বলতে চাইছে। অন্যদেরও একই দশা।

‘তো মিস্টার প্রাইস এ রাস্তায় চলবেন কেন? তাঁর তো তাড়াহুড়োর দরকার নেই। হাতে অফুরন্ত সময়!’

হাসি ছড়াল রবিনের মুখে।

‘ঠিকই তো…’

‘এতে তাঁর বইয়ের একটা জরুরী বিষয় মনে পড়ে গেল আমার,’ বলে চলেছে কিশোর, ‘তাঁর গল্পে চরিত্রগুলো পারতপক্ষে মেইন রোড ব্যবহার করে না, তাই না? তার বদলে পেছনের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে চলতে ভালবাসে।’

মাথা ঝাঁকালেন ওয়েসলি হল।

‘ঠিক বলেছ। আমারও একটা কথা মনে পড়ল-প্রথমবার উইল যখন গ্রীনফিল্ডে যায়। গ্রীনফিল্ডের আশপাশে ওর কিছু কলেজ ফ্রেণ্ড থাকে। তাই ট্রেইনে না গিয়ে সেবার গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিল ও। পরদিন আমাকে ফোন করে পেছনের সেই চমৎকার রাস্তাটার কথা জানায়। বলে হাইওয়ের চেয়ে অনেক সুন্দর ওটা। পাহাড় আর গাছপালার ছড়াছড়ি-ওর যেমনটা পছন্দ। শান্ত-সমাহিত আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।’

‘উনি নিশ্চয়ই ওখানেই আছেন,’ বলল রবিন। ‘চলুন, যাই!’