ভুতুড়ে সাঁকোর রহস্য – ১০

দশ

‘জিমি আর রুবি মিলে যে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে কস্মিনকালেও ভাবিনি,’ বললেন এমিলি, কিচেন টেবিলে সবাই বসেছে ওরা হালকা নাস্তা পর্ব সারতে।

‘কী মানুষ!’ বলে উঠলেন মিসেস ম্যাকলিন। সবার জন্য দুধ ঢালছেন।

মনিকা এসময় প্লেটভর্তি কুকি নিয়ে এল। থালাটা রাখল টেবিলে। জানা গেল, বাইরে শোরগোল শুনে বড়আম্মার ঘুম ভাঙায় ও।

‘খাইছে, একটা প্রশ্নের কিন্তু এখনও জবাব মেলেনি,’ বলল মুসা। ‘গ্রাহামও না, রুবিও না, তাহলে কে আমাদেরকে ভয় দেখাতে চাইল?’

‘আমি,’ মিহিস্বরে জানাল মনিকা।

চোখের পলকে সবার নজর চলে গেল ওর ওপর।

‘তুমি আমাদেরকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছ?’ মুসা সচকিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

‘সে রাতে আমরা তোমাকেই ধাওয়া দিই, তাই না?’ রবিনও জিজ্ঞেস করল প্রায় একইসঙ্গে।

মাথা ঝাঁকিয়ে, চেয়ারে বসে পড়ল মনিকা।

‘আমি…আমি সত্যিই দুঃখিত।’

‘এসবের মানে কী?! আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!’ এমিলি বিমূঢ় দৃষ্টিতে চাইলেন মনিকার দিকে।

দু’হাতে মাথা ঢাকল মনিকা।

‘ভেবেছিলাম ভূতের উপদ্রবের কথা জানলে বাবা-মা আমাকে হয়তো এখান থেকে নিয়ে যাবে, বলল, ফোঁত-ফোঁত করে কাঁদছে। রবিন নিঃশব্দে ওর দিকে কটা টিস্যু এগিয়ে দিল।

‘কিন্তু কীভাবে…’ ভ্রূজোড়া কুঁচকে গেছে ডনের।

মনিকা মাথা তুলে ওর দিকে চাইল।

‘শব্দটা করলাম?’

মাথা ঝাঁকাল ডন।

‘ঠিক পাথরের ওপর দিয়ে ঝরনার ছুটে চলার মত শব্দটা।’

‘দাঁড়াও!’ নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ‘তুমি বনে গিয়ে ঝরনার শব্দ রেকর্ড করেছ, তাই না? সেজন্যেই পানির ধারে তোমার হেডব্যাওটা খুঁজে পাই আমরা।’

বড়আম্মার উদ্দেশে বোকাটে দৃষ্টিতে চাইল মনিকা।

‘আপনার টেপ রেকর্ডারটা নেয়া আমার উচিত হয়নি, বড়আম্মা।’ গলা কেঁপে গেল ওর। ‘আমাকে মাফ করবেন।’ এমিলি এতটাই থমকেছেন ভাষা খুঁজে পেলেন না।

‘তুমি মাঝরাতে বাইরে গিয়েছিলে, তাই না?’ কথার সুতো ধরল কিশোর, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জরিপ করছে মনিকাকে। ‘তারপর টেপটা চালু কর।’

মনিকা অস্বীকার করল না।

‘তোমরা এখানে আসার আগেই প্ল্যানটা করি আমি।’ চাইতে পারছে না ছেলেদের দিকে। ‘তখন তো জানতাম না তোমরা এত ভাল!’

‘খাইছে, আমরা শুরু থেকেই তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিলাম,’ শান্তস্বরে বলল মুসা।

‘হয়তো বিশ্বাস করবে না,’ বিমর্ষচিত্তে বলল মনিকা। ‘কিন্তু আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর ভয় দেখাব না তোমাদেরকে।’

এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন এমিলি। এবার মুখ খুললেন।

‘আমি জানি, মনি, তোমার মন খারাপ, কিন্তু কেন তা জানতাম না।’ বিরতি নিয়ে বড় করে শ্বাস ফেললেন। এখনও জানি না।’

কোলের ওপর হাতজোড়া মোচড়াল মনিকা।

‘আপনার সাথে থাকতে আমার ভাল লাগে, বড়আম্মা, কিন্তু…বাবা-মাকে খুব মিস করি।’ মুখের চেহারায় কষ্টের মেঘ জমেছে মেয়েটির। ‘পুরো গরমকালটা আমি তাদেরকে কাছে পাই না।’

‘ওঁদেরকে তোমার মনের কথা জানিয়েছ?’ রবিন প্রশ্ন করল। চোখ নামাল মনিকা, মাথা নাড়ল।

‘জানানো উচিত।’ মনিকার বাহুতে আলতো করে হাত রাখলেন এমিলি। ‘ওরা তো কারও মন পড়তে পারে না, তাই না? তুমি না বললে ওরা বুঝবে কীভাবে? সকালে উঠেই ওদেরকে ফোন কোরো, কেমন?’

‘আচ্ছা,’ বলে বড়আম্মার দিকে চেয়ে মধুর হাসল মনিকা।

‘সব বাবা-মা-ই সন্তানকে ভালবাসে, কোমল স্বরে বললেন মিসেস ম্যাকলিন। ‘তারাও তোমাকে ভালবাসে। তুমি তাদের হৃদয়েই আছ সারাক্ষণ।

আচমকাই হাঁ হয়ে গেল মুসা এবং আরেকটু হলেই দুধ চলকে পড়ত মুখ থেকে। অদ্ভুত এক চিন্তা খেলে গেছে ওর মাথায়। ‘খাইছে, আবার ওখানে যেতে হবে!’ চেঁচিয়ে উঠল। ‘কোথায়?’ কিশোরের প্রশ্ন।

‘সাঁকোটার কাছে!’ ঝট করে উঠে দাঁড়াল মুসা। ফ্ল্যাশলাইটটা রীতিমত ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে পা বাড়াল দরজার দিকে।

যারপরনাই হতভম্ব, অন্যরা পিছু নিল ওর। সবাইকে নিয়ে সেতুর মাঝ বরাবর পৌছে, ফ্ল্যাশলাইটের আলো সামনে-পেছনে বোলাল মুসা। রশ্মিটা অবশেষে স্থির হলো হৃদয় আকৃতির পাথরটার ওপর।

‘কী ব্যাপার বলো তো?’ কৌতূহলী কিশোর জিজ্ঞেস করল।

তখুনি জবাব দিল না মুসা। তর্জনী বোলাল হৃদয়ের ভেতরে ‘মেগ’ লেখা নামটির ওপরে।

‘কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বলল ডন।

‘মিসেস ম্যাকলিন যেই বললেন মনি ওর বাবা-মার হৃদয়ে আছে, তখুনি ধাঁ করে মনে পড়ে গেল।’ জ্বলজ্বল করছে মুসার চোখজোড়া। ‘হৃদয়ের ভেতরের নামটা দেখো।

ঘাড়ের পেছনটা চুলকাল কিশোর।

‘দেখলাম তো। তাতে?’

‘মেগের ধাঁধাটার প্রথম দু’লাইনে কী আছে?’ বলল মুসা।

সবাই একসঙ্গে আবৃত্তি করল, ‘শেষটা যখন শুরু, আর শুরু যখন শেষ।’

হঠাৎই বুঝে ফেলল কিশোর। শ্বাস চাপল উত্তেজনায়।

‘অক্ষরগুলো উল্টে দিলে-’

‘মেগ হয়ে যায় জেম।’ বলে উঠল রবিন। চোখ ছানাবড়া ওর।

MEG উল্টালে GEM মানে মূল্যবান রত্ন।

‘হায়, খোদা!’ বলে উঠলেন এমিলি। ‘মেগের ব্রুচটা দামি সব রত্ন দিয়ে তৈরি।’

‘আমরা বোধহয় শেষ সূত্রটা পেয়ে গেছি,’ বলল কিশোর।

‘তোমরা একটু অপেক্ষা করো,’ বললেন এমিলি, হাঁটা ধরলেন বাড়ির দিকে। খানিক পরে, ফিরলেন এক স্ক্রুড্রাইভার হাতে। ‘হাতের কাছে এটাই পেলাম। মনে হয় এতেই কাজ হবে।’

পরমুহূর্তে, কাজে লেগে পড়ল কিশোর। সহজেই মুড়মুড় করে খসে পড়ল আস্তর। শেষমেশ পাথরটা আলগা হতেই, দু’পাশে হাত দিয়ে সর্বশক্তিতে ওটা টেনে তুলতে লাগল ও। ধীরে-ধীরে উঠে এল পাথরটা, নিচে হাঁ করে রয়েছে এক গর্ত।

মুসা খোলা মুখটার ওপরে আলো ফেলতেই, উত্তেজনায় ছটফটাতে লাগল ডন।

‘কিছু দেখা যাচ্ছে, মুসাভাই?’ জানতে চাইল ও।

‘নাহ্-খাইছে, দাঁড়াও!’

মুসা গহ্বরের ভেতর থেকে বড়সড় এক জরাজীর্ণ চামড়ার থলে বের করতেই শ্বাস চাপল সবাই। মুহূর্তখানেক নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইল ওরা, দৃষ্টি স্থির থলেটার ওপরে। এবার ওটা এমিলির দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা।

থলের রশি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল কাপড়ের একটা টুকরো। ওটার ভাঁজ খুলতেই তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিল এক গাদা অলঙ্কার। সবার আগে নজর কাড়ল ঝলমলে, সুপ্রাচীন ব্রুচটা। আরও রয়েছে হীরের কণ্ঠহার, সোনার দামি-দামি গয়না, আর রঙবেরঙের নানান মূল্যবান রত্নপাথর। ছোটখাট এক ঐশ্বর্য বলা যায়। জিমির ধারণাই ঠিক। মেগ ব্রুচটার সঙ্গে আরও অনেক অলঙ্কারও রেখেছিলেন।

‘ওহ!’ চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল এমিলির মুখে।

ছেলেরা খুশিতে চিৎকার ছাড়ল। ওদের সঙ্গে যোগ দিল মনিকাও।

‘এরকম দুর্দান্ত সব গয়না আগে কখনও দেখিনি আমি! সবিস্ময়ে বলে উঠলেন মিসেস ম্যাকলিন।

‘সেজন্যেই মেগ এগুলোকে কোন সুরক্ষিত জায়গায় নিরাপদে রাখতে চেয়েছিলেন,’ বলল কিশোর।

সায় জানালেন এমিলি।

‘কিন্তু এটা চাননি এগুলো চিরদিন লুকানো অবস্থায় থাকুক। তাই তো বংশধরদের জন্যে সূত্রগুলো রেখে গেছেন।’

কিন্তু ডন কেন জানি ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না।

‘আচ্ছা, চ্যাটারিং বোনসের ব্যাপারটা আসলে কী?’ বিস্ময়মাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করল। ‘ওটা কি সত্যিই সাঁকোটায় হানা দেয়? এটা কি আসলেই ভুতুড়ে সাঁকো?’

এমিলি ওকে জড়িয়ে ধরলেন এক হাতে।

‘কিছু প্রশ্নের উত্তর কখনওই মেলে না, ডন,’ বললেন। ‘সেগুলো চিরকাল অজানা রহস্যই থেকে যায়।’

‘এমিলি, জানেন তো, রহস্যই কিন্তু আমাদের-’ একান-ওকান হাসি ডনের মুখে।

‘বিশেষত্ব!’ কোরাসে বলল চারজনে।

***