প্রাগৈতিহাসিক – ১৫

পনেরো

টেনে নবটা থেকে ওর হাত সরালাম।

‘তুমি কি পাগল হলে?’ জবাব চাইলাম।

চোখের পাতাজোড়া সরু হলো ওর।

‘আমি হইনি, কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি হয়েছ। এখান থেকে পালাতে চাও না তুমি?’

‘অবশ্যই চাই। কিন্তু আমি চাই অক্ষত অবস্থায় পালাতে। টাইম ট্র্যাভেল সম্পর্কে তোমার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, জিনা। কম তো টাইম ট্র্যাভেল করিনি। এটা খুবই বিপজ্জনক একটা কাজ,’ বললাম ওকে।

আসনে হেলান দিয়ে বসে রুপোলী জাম্পসুটের ওপর বাহু ভাঁজ করল জিনা। চোখ ঘোরাল।

‘বেশ, কতখানি বিপজ্জনক বলো শুনি। টাইম ট্র্যাভেল তো আমিও কম করিনি! তোমার সাথেই কত জায়গায় গেছি!’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ঝুঁকিটা মারাত্মক। কতখানি তা আমরা নিজেরাও জানি না। অন্ধের মত ট্র্যাভেল করলে তো হবে না। কোথায় গিয়ে পড়ব কে জানে।’

‘তো?’

‘তো তুমি কি চাও আমরা টি-রেক্সের খপ্পরে পড়ি, কিংবা মহাসাগরের তলায় চালান হয়ে যাই? অথবা এরচেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটুক আমাদের ভাগ্যে?’

‘বুঝলাম, কিশোর,’ দীর্ঘশ্বাস পড়ল জিনার। ‘কিন্তু এমনও তো হতে পারে আমরা নিরাপদে রকি বিচে পৌঁছে গেলাম। কিংবা নিজেদের বিছানায়। কিংবা মেরি চাচীর কিচেনে, তিনি হয়তো তখন চকোলেট পাই বের করছেন আভ্ থেকে।’

অনিচ্ছায় মাথা ঝাঁকালাম। এখনই চকোলেট পাইয়ের মনমাতানো সুগন্ধ পাচ্ছি মনে হলো।

নেচে উঠল জিনার চোখের তারা।

‘এবার বলো, ঝুঁকিটা নেয়া উচিত নয়? আমার মনে হয় উচিত। চলো কপাল ঠুকে দেখি!’

নবটার দিকে হাত বাড়াল ও।

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দেখছি ওর কাজ-কর্ম। তবে এবার আর ওকে থামানোর চেষ্টা করলাম না।

বিনা চেষ্টায় ছাড়বে না ও জানি আমি।

নবটা যখন ঘোরাল আমি শ্বাস চাপলাম। ডায়ালগুলোর একটা তীরও নড়ল না। কিছুই ঘটল না।

হতাশা নিয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম দু’জনে।

‘ওটার পাশের নীল লিভারটা ট্রাই করো,’ বাতলে দিলাম।

এটার পেছনেই নয় লেগে থাকা যাক ফল না পাওয়া অবধি।

ওটাকে চেপে নিচে নামাল জিনা, ইঞ্চিখানেক। দু’জনেই অধীর অপেক্ষায়।

এবারও কিছু ঘটল না।

আরেক ইঞ্চি নাড়াল ওটাকে জিনা।

ডায়ালের তীরগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠল।

আমাদের চারপাশে চড়া গুঞ্জন শোনা গেল।

জিনা আমার দিকে চাইল। চোখ রসগোল্লা। মুখের চেহারায় নিখাদ আতঙ্ক।

‘নাআআআ!’ রীতিমত হাহাকার করে উঠল ও।

ওর চোখের দু’কোণের চামড়া কুঁচকে নেমে এসেছে গাল পর্যন্ত, চলে গেছে কানজোড়ার পাশ দিয়ে ঘাড় অবধি। ওর চামড়ায় ভাঁজ পড়তেই গালজোড়া আর কান দুটো ঝুলে পড়ল।

কপাল কুঞ্চিত হয়ে লোলচর্ম বুড়ির মত ভাঁজ ছড়িয়ে গেল মাথার খুলিতে। মাথার চুল শণের নুড়ির মতন ধবধবে সাদা হয়ে গোছায় গোছায় খসে পড়তে লাগল।

সাহায্যের জন্য করুণ আর্তি জানাল বেচারী জিনা। ওর তিনটে দাঁত কালো হয়ে টপাটপ খসে পড়ল মাঢ়ী থেকে। ফোকলা বুড়ি জিনা এক হাতে ক্যাচ লুফল দাঁতগুলোকে, ওর হাতটাকে এখন থাবার মতন দেখাচ্ছে।

এবার আমার আর্তনাদ করার পালা। দু’জনে মিলে তারস্বরে চিৎকার জুড়লাম। অনুভব করলাম আমার হাড়ের মাংস শুকিয়ে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাচ্ছে ধনুকের মত।

টের পেলাম ডান চোখটা ঝুলে নেমে এসেছে গালের কাছে। সব কিছু ঝাপসা দেখছি।

এক হাড়বুড়োর গোঙানির শব্দ পেলাম। দুঃখের কথা, বুড়োটা স্বয়ং আমি।

আমার অস্তিত্বের একাংশ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দ্রুতগতিতে বুড়িয়ে যাচ্ছি আমরা। সেই একই অংশ এ-ও জানে, শীঘ্রি যদি এই প্রক্রিয়া উল্টে দেয়া না যায় তবে আমরা মারা পড়ব এবং ক’মুহূর্তের মধ্যেই কঙ্কালে পরিণত হব।

কিন্তু আমার সত্তার বেশিরভাগ অংশই চাইছে শুকিয়ে মরে যেতে-মরে বাঁচতে!

শরীরের প্রতিটা হাড়ে টনটনে ব্যথা। মনে হচ্ছে হাড় মুড়মুড়ি ব্যারামে ধরেছে আমাকে। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চেঁচাতেও পারছি না, এতটাই দুর্বল।

যেটুকু শক্তি বাকি রয়েছে, তাই নিয়ে নীল লিভারটার ওপর হামলে পড়ে ওটাকে টেনে পিছিয়ে আনার জন্য প্রাণপণে যুঝতে লাগলাম।

‘টানো, কিশোর! টানো! ককিয়ে উঠল জিনা।

‘পারছি না!’ পাল্টা ককালাম। ‘পারছি না!’

ষোলো

আটকে গেছে লিভারটা।

নড়াতে পারছি না।

মুখ হাঁ করে মাঢ়ীজোড়ার ফাঁক দিয়ে কোনমতে জিনার উদ্দেশে বললাম, ‘তুমিও টানো!’

ওর আবে ভরা প্রাচীন মাথাটা কেঁপে উঠল, ঠোঁট চাপড়াল ও। ‘টানো আমার সাথে! কাতর মিনতি করলাম।

জিনা ওর কোঁচকানো, দাগে ভরা হাতজোড়া আমার হাতের ওপর রাখল।

‘টানো! টানো!’ শ্বাসের ফাঁকে কোনমতে বললাম।

অবশেষে লিভারটা আস্তে-আস্তে উঠতে লাগল। একেকবারে ইঞ্চির ভগ্নাংশ পরিমাণ।

ডায়ালের কাঁটাগুলোর কাঁপাকাঁপি থামল।

কানে তালা লাগানো শব্দ মরে গিয়ে মেশিনটা এখন ক্ষীণ গুনগুন শব্দ করছে।

চকিতে জিনার দিকে চাইলাম। ও ক্রমেই জোয়ান হচ্ছে দেখে পরম স্বস্তি পেলাম।

ওর কোঁচকানো চামড়া মসৃণ হয়ে গোলাপী বর্ণ ধরেছে, এবং দাঁতগুলো ফিরে গেছে জায়গা মত।

ওর পাকা চুল এখন স্বাভাবিক রঙ ফিরে পাচ্ছে।

জিনার হাতজোড়া গোলগাল আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

এসব যখন ঘটছে, তখন অনুভব করলাম, আমার শিরদাঁড়া ধীরে-ধীরে শক্ত আর সোজা হচ্ছে। হাড়ে এঁটে বসছে ঝুলঝুলে চামড়া। মুখের ভেতর দাঁতের অস্তিত্ব টের পেয়ে কী ভালই না লাগল!

এবার লিভার থেকে পড়ে গেল আমাদের হাত।

‘ওহ!’

‘কী অবস্থা, বাপ রে!’

মখমলের গদিতে গা এলিয়ে দিলাম, ভয়ানক পরিশ্রান্ত। ‘ওয়াও। অল্পের জন্যে রক্ষা।’ হাঁফাচ্ছে জিনা। ওহ, কিশোর, আমি কখনওই বুড়ো হতে চাই না।’

‘আমিও না,’ একমত হলাম। এবার ওর দিকে চেয়ে হেসে ফেললাম। ‘তোমাকে যা দেখাচ্ছিল না! কী যে কুৎসিত!’ খেপালাম ওকে।

‘আমাকে?’ রাগে চেঁচিয়ে উঠল জিনা।

‘তোমাকে একটা শুকনো কিশমিশের মত লাগছিল। কিশমিশ বুড়ি!’

‘কী? আমি কিশমিশ বুড়ি! আর তুমি? তুমি তো আস্ত একটা আখরোট বুড়ো হয়ে গেছিলে!’

‘আচ্ছা, বাবা, ঠিক আছে,’ বললাম। ‘আমাদের দু’জনকেই ভয়ানক বিশ্রী দেখাচ্ছিল। ওই নীল লিভারটা আরেকবার ছুঁয়ে দেখো, তোমার সবকটা আঙুল যদি ভেঙে না দিই আমি!’

‘আচ্ছা, বাবা, আচ্ছা, বলল জিনা। ‘বরং এই বড় হুইলটা ঘুরিয়ে দেখি।

ওকে থামাতে পারার আগেই, হাত তুলে আমাদের মাথার ওপরের ভারী চাকাটা ঘুরিয়ে দিল জিনা।

গুড়-গুড় আওয়াজ করে উঠল যন্ত্রটা।

পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম আমরা। কিছু একটা ঘটছে নিঃসন্দেহে।

যন্ত্রটা কাঁপতে শুরু করেছে। হলদে-সবুজ আলোটা ম্লান হয়ে গাঢ় লাল রক্তের রঙ ধরেছে।

‘আরি!’

‘কী হচ্ছে, কিশোর?’ চেঁচিয়ে উঠল জিনা।

লাল বাতিটা মিটমিট করছে এবং কম্পনটা রীতিমত ঝাঁকাচ্ছে আমাদেরকে। মেশিনটা থরথর করে কাঁপছে আর গুড়-গুড় শব্দ করছে।

‘মনে হয় কাজ হচ্ছে!’ মেশিনের গর্জন ছাপিয়ে চিৎকার করে বললাম।

‘সাবাস!’ খুশিতে চিৎকার ছেড়ে, বিজয়োল্লাসে বাতাসে মুঠো ছুঁড়ল জিনা।

সতেরো

কমুহূর্ত পরে মেশিনটা নীরব আর নিথর হয়ে গেল। বাতিগুলো এখন উজ্জ্বল সবুজ।

যন্ত্রটা কোথায় নিয়ে এসেছে আমাদেরকে? ভাবলাম।

হৃৎপিণ্ডটা আমার রীতিমত লাফাচ্ছে। হয়তো কাজ হয়েছে। আমরা হয়তো ফিরে এসেছি নিজেদের সময়ে।

হাত বাড়িয়ে দরজার ছিটকিনি খুললাম।

কিন্তু দরজা খোলার আর সুযোগ পেলাম না। তার আগেই কে যেন হাট করে খুলে দিল ওটা।

ক্যাপ্টেন টাইম।

ক্যাপসুলের বাইরে দাঁড়িয়ে সে, তার পরনে সাটিনের লম্বা কালো আলখিল্লা আর পায়ে মখমলের চপ্পল। ঘুম থেকে আসায় কালো চুল উষ্কখুষ্ক। অবশ্য তাকে দেখে এমুহূর্তে পূণ সজাগই মনে হচ্ছে।

এবং ভয়ানক রাগান্বিত।

কাঠের ভারী মুগুরটা দিয়ে নিজের হাতের তালুতে আঘাত করল।

থ্যাপ। থ্যাপ। থ্যাপ।

‘বেরিয়ে এসো তোমরা,’ দাঁতের ফাঁকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে।

ভয়ে কাহিল আমি আর জিনা চোখাচোখি করলাম। ও আমার হাত চেপে ধরল।

মহা ঝামেলায় পড়েছি বুঝতে পারছি দু’জনেই।

মাথা নত করে ক্যাপ্টেনের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। আহা, ভয়ের চোটে যদি সময়চক্র ভেদ করে নিজের সময়ে ফিরে যেতে পারতাম, কী ভালই না হত! কিংবা পরের শতাব্দীতে।

‘তোমাদের মধ্যে হুইলটা ঘুরিয়েছে কে?’ কৈফিয়ত চাইল ক্যাপ্টেন টাইম।

ক্ষণিকের ভয়ার্ত নীরবতার পর মুখ খুলল জিনা।

‘আমি, ক্যাপ্টেন, স্যর,’ মিহি গলায় জানাল।

লোকটা চাপা হাসল।

‘ধন্যবাদ, রাজকুমারী। ওই হুইলটা অ্যালার্ম অন করে। অ্যালার্মের শব্দে জেগে গেছি আমি। তারপর এখানে এসে তোমাদেরকে পেলাম। তোমাদের কিছু বলার আছে?’

‘সরি!’ দুর্বল কণ্ঠে বললাম।

‘এতে হবে না!’ ভয়ঙ্করভাবে গর্জে উঠল লোকটা।

আঁতকে আধ হাত লাফিয়ে উঠলাম।

‘আমি সন্তুষ্ট নই,’ বলল ক্যাপ্টেন টাইম। ‘মোটেই সন্তুষ্ট নই।’ এর মানে কী?

আবারও কল্পনায় ভেসে উঠল পানির ট্যাঙ্কের ওই মাছবালকটির ছবি। নিজেকে মনের পর্দায় ওর পাশে সাঁতরাতে দেখলাম। সর্বনাশ!

‘আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত!’ এবার জোর দিয়ে বললাম।

‘সত্যিই?’ ভ্রূ কুঁচকে চাইল লোকটা আমার দিকে। ‘বেশ, এবারের মত তোমাদেরকে মাফ করে দিচ্ছি।’

বুকের ওপর থেকে দশ মণী পাথর নেমে গেল যেন আমার!

মাছের ট্যাঙ্কে যেতে হচ্ছে না। আমরা সৌভাগ্যবান।

অন্তত এ যাত্রা।

‘এখন,’ আলখিল্লার পকেট থেকে সোনার ঘড়িটা বের করে ঘোষণা করল লোকটা, ‘সোজা ঘরে চলে যাও। খড়ের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়োগে।’

অগত্যা টাইম মেশিনের দিকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিঠ ফেরালাম আমরা।

‘শোনো,’ মঞ্চের পেছনের ছোট কামরাটার দিকে আমাদেরকে পেছনে নিয়ে চলার সময় বলল ক্যাপ্টেন টাইম, ‘আমি লোক খারাপ নই। আমি চাই না তোমরা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাক। বিশ্বাস করো, আমি তোমাদের বাড়ি ফেরত পাঠাতেই চাই। সত্যি বলছি।’

বিশ্বাস হলো না আমার।

কিন্তু না করে উপায়ই বা কী?

দীর্ঘ হলওয়ে ধরে ক্লান্ত শরীর টেনে চলেছি আমরা। গ্যাসের প্রদীপ দেয়ালের উঁচু দেয়ালগিরিগুলো থেকে ভুতুড়ে আলো বিলাচ্ছে, কারাগারের দিকে আমাদের চলার পথকে আলোকিত করেছে ওগুলো।

প্রতি কদমে মন দমে যাচ্ছে আরও।

‘তোমরা শো-তে ভাল পারফর্ম করে আমাকে যদি বেশি-বেশি টাকা এনে দিতে পার, কথার খেই ধরল লোকটা, ‘তাহলে আমি গবেষণা চালিয়ে যেতে পারব। কে জানে? একদিন হয়তো ঠিকই আবিষ্কার করে ফেলব কীভাবে তোমাদেরকে নিজেদের সময়ে ফেরত পাঠানো যায়।’

আমাদের ঘরের সামনে থমকে দাঁড়ালাম।

‘একদিন?’ পুনরাবৃত্তি করল জিনা।

লা-পরোয়া ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ক্যাপ্টেন।

‘হয়তো কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এখন ঢুকে পড়ো, আদেশ করে, দরজাটা দড়াম করে লাগাল আমাদের পেছনে।

‘একদিন,’ বিড়বিড় করে আওড়ে খড়ের বিছানায় ফের শোয়ার আয়োজন করল জিনা। ‘ততদিনে বাসার লোকেরা আমাদের খোঁজা বাদ দেবে। ওহ, কী ভয়ঙ্কর! এরচেয়ে মরে যাওয়াই ভাল!’

শিউরে উঠলাম ভীষণভাবে। ভোরের এ সময়টায় ভয়ানক হিমশীতল হয়ে উঠেছে কামরাটা।

ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া, ব্যথায় টনটন করতে থাকা হাড়গুলোর ওপরে কিছু খড় টেনে নেয়ার সময় ওর সঙ্গে সহমত হলাম আমি। সত্যিই কী দুর্দশাতেই না পড়া গেছে…

ঠিক যখন অশান্ত ঘুমে চোখ লেগে আসছে, টের পেলাম কে যেন খোঁচা দিল আমার কাঁধে।

চোখ মেলে এক ঝটকায় উঠে বসলাম। চারধারে চাইলাম। কেউ নেই। খড়ের বিছানায় শুধু ঘুমন্ত ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখলাম।

কিন্তু মুহূর্ত আগেই কেউ এখানে এসেছিল। জানি আমি। কারণ সে কিছু একটা ফেলে গেছে।

আমার মাথার খড়ের বালিশটার ওপরে পড়ে রয়েছে ওটা।

একটা মাছ।

মরা এক মাছ।

আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ওটার দিকে।

ওটা একটা বার্তা, বুঝতে কষ্ট হলো না। ক্যাপ্টেন টাইমের হুমকি বার্তা।

আমাকে সাবধান করে দিচ্ছে আমার দশা হবে ওই মাছটার মতন।

মৃত।

আঠারো

পরদিন সকালে জিনা আর আমি পালালাম।

‘জলদি, কিশোর!’

উঁচু জানালাটার তাকটা চেপে ধরে টেনে তুললাম নিজেকে। এবার হাত নামিয়ে জিনাকে টানতে লাগলাম।

পরনে রুপোলী সুট নিয়ে কিলবিল করে তাকটায় উঠে পড়ল জিনা।

কার্নিভাল বিল্ডিঙের বাইরে, এক অলিপথে ধুপধাপ লাফিয়ে পড়লাম দু’জনে।

বুক ভরে তাজা বাতাস টেনে সূর্যের আলোয় পিটপিট করে চাইলাম। মাঝ সকাল এখন। দুই শো-র মধ্যকার বিরতির সময়। সকালে নাস্তা খেতে যাওয়ার সময় জানালাটা চোখে পড়ে জিনার।

শেষ শো-র পর সটকে পড়ি আমরা। পরের শো-র আগে হাতে এখনও মিনিট পনেরো সময় আছে। আমরা নিখোঁজ, ওরা এটা বোঝার আগেই পালাতে হবে।

গলিটা ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল জিনা।

আমি পিছু ধাওয়া করে ওর পথরোধ করলাম।

‘দাঁড়াও। বলেছিলে তোমার কী একটা প্ল্যান আছে!’

বারকয়েক চোখের পাতা ফেলল ও।

‘অবশ্যই আছে, কিশোর। আমার সবসময়ই প্ল্যান থাকে। প্ল্যানটা হচ্ছে দ্য বিস্টকে খুঁজে বের করা।’

‘এই তোমার প্ল্যান?’ প্রশ্ন করলাম।

‘তেমন সুবিধের নয়, তাই না?’ স্বীকার করল ও। ‘তবে গতবছর তো আমরা ওটা খুঁজে পেয়েছিলাম।’

হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালাম। গত গ্রীষ্মে, গোটা ফায়ারলাইট পার্ক তন্নতন্ন করে চষে বেড়ানোর পর শেষমেশ দ্য বিস্টের খোঁজ পাই আমরা।

পুরানো রোলার কোস্টারটা প্রাণে বাঁচায় আমাদেরকে, যথাসময়ে সরিয়ে আনে।

ওটা হয়তো এবারও রক্ষা করতে পারবে আমাদেরকে।

‘তোমার মনে হয় জানা নেই ওটা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলাম।

জবাবে বাদবাকি পার্কের ওপর পাহাড়ের মতন দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় ফেরিস হুইলটার দিকে তর্জনী দেখাল ও।

‘ফেরিস হুইল?’ বলে উঠলাম। ওটা আমাদেরকে বর্তমান সময়ে ফেরত নিয়ে যাবে? কীভাবে?’

চোখ উল্টাল জিনা।

কিশোর, আমরা ফেরিস হুইলটায় চড়ব।’

‘আর ফেরিস হুইলটা কী করবে?’ জবাব চাইলাম।

চোখ ঘোরাল ও।

‘ফেরিস হুইল থেকে পুরো পার্কটা দেখা যাবে। উঁচুতে ওঠার পর হয়তো দ্য বিস্ট চোখে পড়বে আমাদের। তোমার এরচেয়ে ভাল কোন প্ল্যান থাকলে বলো।’

মাথা নাড়লাম। পেট গুড়গুড় করে উঠল। এখন মনে হচ্ছে সকালের ওই জঘন্য নাস্তাটা করলেই হয়তো ভাল হত।

‘খালি পেটে চিন্তা-ভাবনা করা কঠিন,’ অভিযোগ করলাম।

মেরি চাচীর সুস্বাদু পট রোস্টের কথা ভাবলাম। চকোলেট পাই। বীফ বার্গার। আহা!

‘এসো,’ বললাম। জিনার হাত ধরে অলিপথ ধরে দৌড়ে চললাম বোর্ডওয়কের উদ্দেশে।

দিনের বেলায় ফায়ারলাইট পার্কে কখনও আসিনি আমরা। খাম্বার মাথায় দাঁড়ানো মশালগুলো এমুহূর্তে জ্বলছে না। ফ্যাকাসে নীল স্বচ্ছ আকাশ থেকে আলো বিলাচ্ছে সূর্য।

বিনোদন পার্কে বেড়াতে আসার জন্য চমৎকার এক দিন আজ। সেকেলে এক অর্গ্যানের বাজনার শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বোর্ডওয়ক ভর্তি মানুষ হেলেদুলে হেঁটে চলেছে।

প্রথমটায় আমরাও ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে চাইলাম। কিন্তু কাজটা সহজ হলো না।

মহিলাদের পরনে গোড়ালী অবধি নেমে আসা বাহারী পোশাক। পুরুষরা পরেছে সুট জ্যাকেট। ভুলেই গিয়েছিলাম, আগেকার আমলের মানুষজন পুরোদস্তুর সাজপোশাক পরে তবেই বিনোদন পার্কে বেড়াতে যেত।

সাধারণ অনাড়ম্বর পোশাক বলে কোন কিছু কি তখন ছিল না?

এক দল বাচ্চা আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। হাঁটু ছাড়ানো লম্বা, ব্যাগি শর্টস্ আর ব্যাগি শার্ট তাদের পরনে। স্নিকার্স নয়, পায়ে ওদের শোভা পাচ্ছে বাদামী রঙের ভারী কাঠের জুতো।

‘দেখো, দেখো!’ একজন চেঁচিয়ে উঠে আমাদের দিকে আঙুল দেখাল। ‘ভবিষ্যতের সেই উদ্ভট ছেলে-মেয়েগুলো!’

অন্যরা হেসে উঠল। জিনা আর আমি চলার গতি বাড়ালাম। জনতার ভিড় থেকে পালাতে পারলে কেউ হয়তো আর আমাদেরকে

আলাদা করে খেয়াল করবে না।

ছুট দিলাম আমরা, পেছনে ফেলে এলাম ছেলে-মেয়েগুলোকে। একটু পরে, ক্রিটার করাল সাইন লেখা এক দালানের পাশ কাটালাম।

খামারের মত লাগল ওটাকে- যেখানে শূকর, গরু আর হাঁস থাকে।

বেগুনী-সোনালী এক তাঁবুর পাশ দিয়ে ছোটার সময় গতি কমিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটলাম। প্রাচ্যের বাঁশির সুর ভেসে এল ওটা থেকে। তাঁবুর প্রবেশপথের ঠিক বাইরে পাগড়ী মাথায় দীর্ঘদেহী এক লোক দাঁড়িয়ে। ডোরাকাটা এক সাপ তাকে পেঁচিয়ে রেখেছে আপাদমস্তক।

‘ভেতরে এসো, দেখে যাও ক্লিওপেট্রাকে কোন্ বিষধর ছোট সাপে কেটেছিল।’

‘ধ্যাত্তেরি, এসো তো,’ বলে আমার বাহু ধরে টানল জিনা।

আমি আগে কখনও অমন সাপ দেখিনি। এবং এখনও দেখতে পাব না। ভেতরে ঢুকতে দু’ সেণ্ট লাগে, আমার কাছে তা নেই।

সারিবদ্ধ কার্নিভাল বুথ পেরোলাম দু’জনে। দিনের বেলাতেও ওদের লাল আর সাদা বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ছাদে লাগানো রঙবেরঙের পতাকা পতপত করে উড়ছে।

বিনব্যাগ টসের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে, বড়-বড়, নরম বল ছুঁড়ে পিরামিড আকৃতির ভারী কাঠের বোতল ফেলার খেলা। শুটিং গ্যালারিতে সিটিং ডাক অপেক্ষায় রয়েছে। পুরস্কারের ব্যবস্থাও আছে। সারকে সার স্টাফ করা জীব-জন্তু আর কিউপি পুতুল।

ছোট-ছোট বিনোদন পার্কগুলো সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে কীভাবে

বদলেছে ভাবলে অবাক হতে হয়।

কাঠের বড়সড় এক ঘূর্ণি বোর্ডে বাঁধা এক মহিলাকে লক্ষ্য করে ছোরা ছুঁড়ছে এক লোক।

‘ইস!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। একটা ছোরা মহিলার মুখটাকে এক চুলের জন্য ফস্কাল।

বেগুনী ট্যাঙ্ক শার্ট আর ডোরাকাটা ট্রাউজার্স পরা এক বামনকে দেখলাম। চোখা পেরেকের এক বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে। বুকের ওপর পেশীবহুল হাতজোড়া ভাঁজ করে রাখা। মনে হচ্ছে হাজারটা তীক্ষ্ণ পেরেক নয়, ফুলশয্যায় দিব্যি আরামে শুয়ে আছে সে।

পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি আমরা, লোকটা খপ করে চেপে ধরল জিনার গোড়ালী।

‘অ্যাই, মেয়ে,’ চেঁচিয়ে উঠল বামন। এক পেনি দিলে তোমাকে আমার বুকের ওপর দাঁড়াতে দেব।’

চোখে বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে চাইল জিনা।

‘আমার কাছে কানাকড়িও নেই,’ বলল।

দাঁত কেলিয়ে হাসল বামন বাহাদুর।

‘পয়সা লাগবে না। এমনিই দাঁড়াও। দেখবে একটুও ব্যথা পাব না আমি।’

‘না, ধন্যবাদ,’ কোনমতে আওড়ে, সরে পড়ল জিনা।

ছুটে চলেছি, বামনের বিদ্রূপের হা হা হাসি কানে বাজল আমাদের।

এবার এক ফুড স্ট্যাণ্ড চোখে পড়তেই নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। থেমে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলাম সাইনটার দিকে। খালি পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে।

কনি আইল্যাণ্ড ডগ্‌স্‌, সাইনটিতে লেখা। কোটিপতির ছেলে খায়।

কাউন্টারের পেছনে উঁকি দিলাম।

গ্রিলে এক সার হট ডগ ভাজা হচ্ছে। মনে পড়ল কী দুর্দান্ত স্বাদই না ছিল ওগুলোর। আর দাম ছিল মাত্র তিন সেণ্ট করে!

আমার ব্যুরোর নিচের ড্রয়ারটার কথা ভাবলাম। ম্যাসন জার ভর্তি পেনি রাখা ওটায়। দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

আহা, এখন যদি কিছু পেনি থাকত আমার পকেটে! একটা হট ডগের জন্য আমি এখন যে কোন কিছু করতে পারি।

বড়সড় এক বেতের স্ট্রলারে এক বাচ্চাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক মহিলা। তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে তিনটে হট ডগের অর্ডার দিলেন।

তাঁর দিকে আমাকে চেয়ে থাকতে দেখে দ্বিধা করলেন মুহূর্তখানেক।

‘চারটে,’ এবার গ্রিল ম্যানের উদ্দেশে হেঁকে বললেন।

‘আহা, বাছা!’ আমার উদ্দেশে ব্যথিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন। ‘ওই হতভাগা ক্যাপ্টেন টাইমটা তোমাদের কী কষ্টটাই না দেয়! কর্তৃপক্ষ কেন যে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না! নাও, বাছা।’

আমার হাতে একটা হট ডগ ধরিয়ে দিলেন তিনি।

আবেগে বুজে আসা গলায় ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম, কিন্তু তিনি হাত নেড়ে চলে যেতে বললেন।

‘ধন্যবাদ দিতে হবে না, বাছা। আমার স্বামী চলে আসার আগেই ভাগো। ভিখিরিদের দেখতে পারে না সে।’

দুঃখের হাসি হাসলাম।

প্রথমে আমি ছিলাম কার্নিভালের এক কিম্ভূত জীব আর এখন কিনা ভিক্ষুক।

দুনিয়া আমাকে ভালই খেল দেখাচ্ছে।

জিনার নাগাল ধরে ওকে গরমাগরম হট ডগটা দেখালাম। আধখানা ছিঁড়ে দিলাম ওকে

‘কিশোর! তোমার তুলনা নেই!’ বলে নিজের আধখানায় ফুঁ দিল জিনা।

ক’মুহূর্তের মধ্যেই ওটা গপাগপ চালান হয়ে গেল আমাদের পেটে। খাওয়া যখন সারলাম, আমরা তখন ফেরিস হুইলটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে।

সারসের মত গলা বাড়িয়ে, রঙচঙে আসনগুলোর দিকে চোখ তুলে চাইলাম, ঝিরিঝিরি বাতাসে মৃদু দোল খাচ্ছে ওগুলো। চাকাটা তারের দানবীয় পিনহুইলের মত ঘুরছে। ভারী মজার রাইড মনে হচ্ছে।

পরের রাইডটির জন্য লাইনে দাঁড়ালাম আমরা, মানুষজনের বাঁকা দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে।

তাদের চাউনিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আমরা এখানে অবাঞ্ছিত। আমরা কার্নিভালের ছেলে-মেয়ে। আমাদের আবার আনন্দ-ফুর্তি কীসের?

আমরা এখানে ফুর্তি করতে আসিনি! ওদেরকে বলতে ইচ্ছে হলো।

আমাদের মাথা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঘুরে গেল। নীল উর্দি পরা পাহারাদারদের ব্যাপারে সতর্ক আমরা। কিংবা তারচেয়েও বিপজ্জনক, কালো বৌলার হ্যাট পরা হতচ্ছাড়া ক্যাপ্টেন টাইমের লোকজনদের বিষয়ে।

ইতোমধ্যে নির্মম লোকটা বোধহয় জেনে গেছে আমরা পালিয়েছি। হয়তো আমাদের খোঁজে লোকও পাঠিয়ে দিয়েছে।

হুইল পরের রাইডের জন্য লোক তুলতে শুরু করলে দু’জনেই স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।

আমাকে কনুইয়ের আলতো গুঁতো দিল জিনা।

‘কিশোর,’ বলল ফিসফিস করে, ‘ওরা টিকিট চাইলে?’

‘চাইবে না। অ্যাডমিশন ফি সব রাইড কভার করে, ওকে মনে করালাম। হাঁফ ছাড়ল জিনা।

লাল সিটে বসে বাদামী স্ট্র্যাপের বস্ আঁটলাম। এবার সাঁই-সাঁই উঠে গেলাম ওপরে। বগিটা এদিক-ওদিক দুলছে, এবং ক্রমেই আরও ওপরে উঠছি আমরা।

পার্কের জমিনের ওপর থেকে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছি। শনশন বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল।

মাথাটা পেছনে ঝটকা দিয়ে সূর্যের তাপ মাখলাম মুখে। ঘরের ভেতর এত লম্বা সময় ছিলাম, মনে হচ্ছে ছাতা পড়ে গেছে বুঝি শরীরে! রুপোলী পোশাক পরা বিশাল কোন ফাঙ্গাস যেন আমি।

জিনাও ভারী আনন্দ পাচ্ছে। রুপোলী ক্যাপ খুলে বাতাসে উড়তে দিল চুলগুলোকে।

ফেরিস হুইল আমাদেরকে সবচেয়ে উঁচু শিখরে নিয়ে গেল, এবং আমরা ওখানে ঝুলে রইলাম, পার্কের অনেক ওপরে।

‘দারুণ না?’ বলে উঠল জিনা।

অনুভূতিটা সত্যিই তুলনাহীন।

আমাদের ঝুলন্ত পায়ের নিচে, চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বিনোদন পার্ক।

‘দেখো!’ জিনার উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠলাম, আঙুল দেখালাম। ‘ওই যে শুট-দ্য-শুট।’

‘দুর্দান্ত!’ পাল্টা চেঁচাল ও।

টিল্ট-আ-ওয়ার্ন-ও দেখলাম। এত উঁচু থেকেও রাইডারদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে, দূরাগত সাইরেনধ্বনির মত উঠছে নামছে সম্মিলিত শব্দটা। কাছেই, খেলনা লাটিমের মতন ঝাঁ-ঝাঁ রোদে বনবন করে ঘুরছে গোলাপী-নীল মেরি-গো-রাউণ্ড।

এখানে আসার পর, এই প্রথমবারের মত সামান্য আশা জাগল মনে। পার্ক থেকে বেরোবার নিশ্চয়ই কোন না কোন উপায় আছে, এবং সেটা খুঁজে পাওয়াও সম্ভব।

এবার চোখ পড়ল কার্নিভাল যেখানে হয় সেই বিরাট ওয়্যারহাউসটার ওপরে। ছাদে নীল ব্লেয়ার আর সাদা হ্যাট পরা ক্যাপ্টেন টাইমের বিশাল এক ছবি এঁকেছে কোন শিল্পী। বত্রিশ পাটী দাঁত বের করে দিলখোলা হাসি হাসছে লোকটা এবং তুলে ধরে দেখাচ্ছে ইয়াবড় এক পকেট ঘড়ি। কী ভালমানুষই না মনে হচ্ছে হতচ্ছাড়াকে!

তলার দিকে নকশা আঁকার মত নিপুণ হাতের লেখায় ক্যাপ্টেন টাইমের ভবিষ্যতের শিশু লেখা।

ক্যাপ্টেন টাইমের বড়-বড় কালো চোখজোড়া যেন চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকেই।

শিউরে উঠলাম আমি।

এমনি সময় আমার পাঁজরে জোরে আঙুলের খোঁচা দিল জিনা।

‘ওই যে, কিশোর!’ চিৎকার ছাড়ল। ‘দেখতে পেয়েছি! দ্য বিস্ট! আমরা এখন বাড়ি ফিরতে পারব!’

উনিশ

‘কোথায়?’ উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম।

তর্জনী তাক করল জিনা।

পার্কের কাঠের উঁচু বেড়ার ওপাশে গাছগাছালির এক ঘন কুঞ্জবন।

এত পরিচিত লাগল ওটাকে!

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।

কোন সন্দেহ নেই। বেড়ার উল্টোদিকে গাছপালার ভেতর থেকে যেন ফুঁড়ে বেরিয়েছে কাঠের কোন ধরনের এক ভারা।

মনে পড়ল গতবার আমরা এক কাঠের বেড়ার ফাঁক গলে দ্য বিস্ট-এর কাছে পৌঁছি।

এবং রোলার কোস্টারটা ঘন এক কুঞ্জবন ভেদ করে পাড়ি জমায়।

হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হলো আমার

‘হ্যাঁ!’ খুশিতে চিৎকার ছাড়লাম। ‘ওই তো!’

বগিটা চক্কর কেটে ফিরে আসতে আরম্ভ করেছে মাটির দিকে।

‘জলদি, কিশোর!’ গলা চড়িয়ে বলল জিনা। ‘রাস্তাটা মনে গেঁথে নাও।’

যতবারই ঘুরছি, একটা পথ খুঁজে বের করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বাম্পার কার, একটা পুকুর, বুনো জন্তু-জানোয়ার নিয়ে সবুজ-সাদা নকশাকাটা এক তাঁবু ফুটিয়ে তুললাম মনে।

অবশেষে আমরা শেষবারের মত নেমে এলাম মাটির কাছাকাছি, মাথা ঝিমঝিম করছে। আমার তো ফেরিস হুইল থেকে নামতে খারাপই লাগছে রীতিমত।

মাটিতে পা পড়তেই, ভিড় ভেদ করে ছুটলাম দু’জনে। বাম্পার কারগুলো পেরিয়ে।

পুকুরটার পাশ কাটালাম, ছোট ছেলে-মেয়েরা যেখানে নাবিকের চটকদার পোশাক পরে মডেল বোটের রেস লাগিয়েছে।

জীব-জন্তুর তাঁবু আর এক সার ফাঁকা খাঁচার মাঝখানের সরু অলিপথ ধরে দৌড়চ্ছি।

কাঠের উঁচু বেড়া বরাবর পাঁই পাঁই ছুটছি আমরা, ওপাশে যাওয়ার ফাঁক খুঁজছি

‘এই যে!’ চেঁচালাম জিনার উদ্দেশে।

বেড়ার নিচে কে যেন গভীর এক গর্ত খুঁড়েছে। হাঁটুর ওপর ধপ করে বসে পড়ে তলা দিয়ে শরীর গলিয়ে দিলাম।

বেরিয়ে এলাম ওপাশে। তারপর জিনাকে সাহায্য করতে উল্টো ঘুরলাম। কিন্তু তার আর দরকার হলো না।

জিনা রুপোলী বাণ মাছের মত কিলবিলিয়ে ওপাশে চলে এল। পরনের সুটের ধুলো ঝেড়ে, গাছপালা ভেদ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললাম আমরা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের সুবিশাল কাঠামোটার উদ্দেশে।

ওটা দ্য বিস্ট

হতেই হবে।

এছাড়া আর কী হতে পারে ওটা?

পরমুহূর্তে, জিনা হৃদয়ভাঙা চিৎকার ছাড়ল, ‘না!’ এবং হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। ‘না! না! না!’

ওটা দ্য বিস্ট নয়।

আমরা এক পুরানো, ভগ্নপ্রায় বার্নের দিকে চেয়ে রয়েছি।

ঘাসে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম জিনার পাশে। দীর্ঘক্ষণ বিষণ্ণ নীরবতার মাঝে চিত হয়ে শুয়ে রইলাম দু’জনে, নীল আকাশের দিকে চেয়ে।

কারও মুখে কথা নেই। কোন কিছু বলার আসলে প্রয়োজনই পড়ে না এরকম মুহূর্তে।

কী করতে হবে দু’জনেই জানি

উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে হবে কার্নিভালে, আমাদের বন্দিশালায়।

এছাড়া আর উপায়ই বা কী?