নিখোঁজ যাত্রী – ১

এক

গ্রীনফিল্ড পাবলিক লাইব্রেরির মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে ডন। বড়সড় এক পোস্টারে রং করছে।

‘কী অবস্থা, ডন?’ জানতে চাইল মুসা। নিজের এইমাত্র আঁকা পোস্টারটা ধরে রেখেছে। কালি শুকানোর জন্য মৃদু-মৃদু নাড়াচ্ছে ওটাকে।

‘কেমন হয়েছে তুমিই দেখে বলো, মুসাভাই,’ জবাব দিল ডন।

ও এক পাশে কাত হলো মুসা যাতে ভালভাবে দেখতে পায়। শব্দগুলো বড় আর গোটা-গোটা, পুরু সাদা কাগজে পরিষ্কার কালো হরফে লেখা:

আগামীকাল সন্ধ্যা ৭টায়
আপনারা সবাই আমন্ত্রিত
‘দ্য ইয়াং অ্যাডভেঞ্চারার্স’
সিরিজের লেখক
বিখ্যাত কিশোর সাহিত্যিক
উইলার্ড প্রাইস আসছেন
গ্রীনফিল্ড লাইব্রেরিতে

আসলে রবিন লিখেছে শব্দগুলো। আর ডন মি. প্রাইসের কিছু বইয়ের ছবি এঁকেছে পোস্টারে।

উইলার্ড প্রাইসের বইয়ের ভক্ত ওরা। তাঁর প্রতিটি কাহিনীর পটভূমি কোন দূরদেশ এবং ছোটরাই উপন্যাসগুলোর মূল চরিত্র-রোমাঞ্চকর সব পরিস্থিতিতে পড়ে তারা, তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে রহস্যের সমাধান করে।

‘খাইছে, দারুণ হয়েছে তো,’ প্রশংসা করে বলল মুসা। ‘বাইরের দিকে ছোট করে আঁকা বইয়ের কভারগুলো খুব সুন্দর লাগছে। মিস্টার প্রাইসেরও নির্ঘাত পছন্দ হবে।’

কিশোর, মুসা, রবিন আর ডন রবিনের জ্যাক নানার বাসায় বেড়াতে এসেছে গ্রীনফিল্ডে। তিনি রবিনের মার আপন চাচা।

‘এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিই তিনি এখানে আসছেন,’ বলল রবিন। আরেকটি পোস্টার রং করছে। ‘দেশজুড়ে তাঁর এত ভক্ত, তারপরও এই লাইব্রেরিতে আসছেন।’

‘হ্যাঁ, মুসার চিঠি পেয়ে তিনি যে এভাবে সাড়া দেবেন ভাবাই যায় না! এত নামকরা একজন লেখক!’ মুগ্ধ কণ্ঠে বলল কিশোর।

মুচকি হাসল মুসা।

‘উনি চাইলেই ‘না’ করে দিতে পারতেন।’

কিন্তু প্রাইস আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেননি বরং জবাবী চিঠিতে জানিয়েছেন এ লাইব্রেরিতে আসতে পারলে তিনি খুশি হবেন। তাঁর সর্বশেষ বই ‘স্বর্ণসন্ধান’ ব্রাজিলের গহীন অরণ্য নিয়ে লেখা উত্তেজনায় ভরপুর দুর্দান্ত এক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। মি. প্রাইস সারা দেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি আর বইয়ের দোকানে নিয়মিত ভিজিট করেন।

‘কাল রাতে এখানে অনেক মানুষ তাঁকে দেখতে আসবে, বলল রবিন। ‘মিসেস কোনর বলেছেন প্রায় শ’খানেক।’

‘বেশিও হতে পারে,’ বললেন মিসেস কোনর, কামরায় এইমাত্র ঢুকলেন তিনি। হেড লাইব্রেরিয়ান ভদ্রমহিলা ছেলেদেরকে ভালভাবেই চেনেন। ‘একটু আগেই এলিমেন্টারি স্কুলের মিসেস কিনের সাথে ফোনে কথা হলো। তিনি তাঁর ক্লাসের সবাইকে কাল এখানে আসতে বলেছেন।’

‘ওয়াও!’ বলে উঠল ডন।

মিসেস কোনর ঘুরে-ঘুরে সবার পোস্টার দেখলেন।

‘বাহ, চমৎকার হয়েছে তো,’ বললেন। এগুলো কোথায় লাগাবে?’

‘সবখানে,’ জানাল মুসা। যেখানে যেখানে লাগালে মানুষের চোখে পড়বে আরকী। সুপারমার্কেট, ব্যাঙ্ক…’

‘স্কুল,’ বলল রবিন।

‘গ্যাস স্টেশন,’ যোগ করল কিশোর।

‘ট্রেইন স্টেশন,’ বলল ডন।

ডন ট্রেইন স্টেশনের কথা বলতেই জরুরী একটা বিষয় মনে পড়ল রবিনের। হাতঘড়ি দেখে নিয়ে বলল, ‘ওখানে এখুনি যাই চলো। মিস্টার প্রাইস আর এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।’

‘হ্যাঁ, ঠিক,’ সায় জানাল মুসা। ‘উনি ট্রেইনে ওঠার একটু আগে এখানে ফোন করেছিলেন।’

মি. প্রাইস একদিন আগেই শহরে আসছেন জ্যাক নানা আর ছেলেদের সঙ্গে ডিনারে যোগ দিতে। এক বন্ধুর সঙ্গেও নাকি দেখা করবেন, তবে তাঁর নাম বলেননি।

‘গুড লাক!’ কামরা ছাড়ার আগে বলে গেলেন মিসেস কোনর।

ছেলেরা পোস্টারের কাজ সেরে, ওগুলো গুছিয়ে পরিপাটী করে বাঁধল। এবার স্টেশনের দিকে যাবে, আর শহরজুড়ে সাঁটাবে।

ওরা দরজার দিকে পা বাড়াতেই দেখল উইলার্ড প্রাইসের বইয়ের ডিসপ্লের পাশে কে একজন দাঁড়িয়ে। বয়স্ক লোক, উষ্কখুষ্ক চুল। চোখে ছোট, গোল চশমা, প্যান্টের ভেতরে শার্ট গোঁজেননি।

ছেলেরা গতরাতে বইগুলো চোখে পড়ার মত করে সাজিয়েছে।

আগন্তুককে দেখে অবশ্য মোটেই উৎসাহিত মনে হলো না। তার বদলে, এমনভাবে তিনি বইগুলো উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন প্রচ্ছদ যেন দেখা না যায়। এখন ব্যাক কভার দেখা যাচ্ছে কেবল। এবার তাক থেকে অন্য আরও কটা বই নিয়ে মি. প্রাইসের বইগুলোর সামনে সাজিয়ে রাখলেন। কাজটা করার সময়, কাছের বুকশেলফটার কোনা দিয়ে বারবার উঁকি দিচ্ছিলেন তিনি। ভাবখানা এমন যেন ভয় পাচ্ছেন মিসেস কোনরের চোখে ধরা না পড়েন!

সাজানো-গোছানো ডিসপ্লে তছনছ করার পর, নিঃশব্দে কেটে পড়লেন ভদ্রলোক।

‘এটা কী হলো?’ কিশোর বলল।

‘বুঝলাম না,’ জবাব দিল নথি। ‘আজব না?’

‘খাইছে, আমাদের আবার আগের মত করে সাজানো উচিত, ‘ বাতলে দিল মুসা।

‘হ্যাঁ,’ একমত হলো ডন।

ওরা শেলফটার কাছে গিয়ে সব কিছু আবার গোছগাছ করল। কাজটা শেষ হতেই রবিন বলল, ‘আমরা ফিরে এসে মিসেস কোনরকে ব্যাপারটা জানাব।’

‘এখন স্টেশনে যাই চলো। নইলে লেট হয়ে যেতে পারে।’ বলল কিশোর।

সদর দরজায় পৌঁছতেই অচেনা লোকটিকে আবার দেখল ছেলেরা। ফ্রন্ট ডেস্কে কথা বলছেন তিনি মিসেস কোনরের সঙ্গে। ওদের কানেও এল তাঁদের কথোপকথন।

‘আমাকে লাইব্রেরিতে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না কেন শুনি?’ গজগজ করে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন আগন্তুক। ‘আমার বইগুলো কোন্ দিক দিয়ে খারাপ?!’

‘আমি তো বলিনি আপনার বই খারাপ, মিস্টার ওয়েসলি হল,’ মিসেস কোনর শান্ত, নিচু স্বরে বোঝালেন। ছেলেদের মনে হলো ভদ্রলোকও গলা নামাবেন আশা করছেন তিনি।

‘আপনারা উইলার্ড প্রাইসকে সেই ক্লেয়ারমন্ট থেকে দাওয়াত দিয়ে আনছেন। জায়গাটা এখান থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে। অথচ আমার এখানে আসতে এক ঘণ্টাও লাগে না! আমার ভক্ত সংখ্যা কি তার চেয়ে কম?’ বলে চললেন ভদ্রলোক। শুধু গলা চড়িয়েই ক্ষান্ত হননি, সে সঙ্গে নানান অঙ্গভঙ্গিও করছেন। ‘সবার মুখে খালি উইলার্ড প্রাইস আর উইলার্ড প্রাইস,’ বুক ঠুকলেন তিনি। ‘কেন, আমি কম কীসে শুনি? আসলে কথায় বলে না, গাঁয়ের যোগী ভিখ পায় না!’

গভীর শ্বাস টানলেন মিসেস কোনর।

‘শুনুন, মিস্টার ওয়েসলি হল,’ শুরু করলেন তিনি, ‘আগামী মাসে আমাদের শিডিউল ফাঁকা আছে, রবিবার রাতে, তেইশে—’

‘থাক, তাতে লাভটা কী?’ রীতিমত খেঁকিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। ‘আমি তো তখন ব্যস্ত থাকব! চাইলেই আমাকে পাবেন নাকি? আমি এখন কাজের জন্যে এ শহরে আছি। কাল রাতে দেখুন কোনভাবে আমার বক্তৃতার ব্যবস্থা করা যায় কিনা।’

‘সরি, তা সম্ভব হবে না,’ উত্তর দিলেন মিসেস কোনর।

‘তা আমি আগেই বুঝেছি,’ বাতাসে হাতের থাবড়া মেরে ঘুরে দাঁড়ালেন ক্রুদ্ধ ভদ্রলোক। তারপর ছেলেদেরকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলেন সদর দরজা দিয়ে।