প্রাগৈতিহাসিক – ১০

দশ

চোখ বুজে ফেললাম। ভয় পাচ্ছি এই বুঝি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল কোস্টারটা।

অপেক্ষা করছি।

বগিটা আলগোছে থেমে গেল।

চোখ মেলতেই দেখি নিরেট অন্ধকার।

‘এ কী!’ চাপা, মিহি স্বর ফুটল আমার গলায়। ‘আমি কোথায়?’

একটা দরজা খুলল। চুইয়ে বেরোল আলো।

চোখ পিটপিটিয়ে আলোটার দিকে চাইলাম।

‘আরি!’ আবিষ্কার করলাম কোন ধরনের বুথ কিংবা ক্যাপসুলে বসে রয়েছি আমি। গোল, ফাঁপা এক গোলকের মত জিনিসটা, মজবুত বল্টু দিয়ে পুরু ধাতব সিমগুলো আঁটা।

দামি মখমলে মোড়া লালরঙা আসনটা শুকনো আর নরম ঠেকছে।

আমার সামনে এক কন্ট্রোল প্যানেল, ডায়াল, নব আর লিভার দেখলাম।

ডান দিকের দেয়াল থেকে সাবমেরিনের হুইলের মত কিছু একটা বেরিয়ে এসেছে, আমার মাথার আধ ফুট মত ওপরে।

আমি এ কোথায় এসে পড়লাম? রোলার কোস্টারের বগিটার কী হলো?

চিৎকার ছাড়তে যাব, খোলা পোর্টহোল দরজাটা দিয়ে সাদা দস্তানা পরা একটা হাত রীতিমত ছিটকে এল। আমার কলার চেপে ধরল ওটা।

‘আরি-কী হলো!’ চেঁচিয়ে উঠতেই ক্যাপসুল থেকে এক টানে আমাকে বের করে খোলা জায়গায় নিয়ে গেল হাতটা।

অনেক ওপর থেকে এক লোক কালো, শীতল চোখে আমাকে নিরীখ করছে। লোকটার দৃষ্টি দেখে মনে হলো গ্লাসের নিচে কোন পোকা-মাকড়কে ছটফটাতে দেখছে বুঝি।

বুকে সাহস নিয়ে পাল্টা চাইলাম তার দিকে। কিন্তু কাজটা কঠিন হলো, কেননা ভয়ানক ভড়কে গেছি আমি।

কালো চুল পেছনে আঁচড়েছে লোকটা। নাকের নিচের সরু গোঁফটা দেখে মনে হলো যেন চিকন কলম দিয়ে এঁকেছে। লোকটার পরনে ফ্লানেলের ধূসর ট্রাউজার আর মাড় দেয়া সাদা শার্টের ওপরে লাল পিন-স্ট্রাইপড্ ভেস্ট।

তাকে দেখে যথেষ্ট পরিপাটি আর সম্মানী লোক বলেই মনে হলো। তবে অদ্ভুত কিছু একটা যেন আছে তার মধ্যে।

আমি যেটা ঠিক ধরতে পারছি না।

‘তোমাকে দিয়ে হবে!’ চেঁচিয়ে উঠল সে।

হবে মানে? কী হবে? প্রশ্ন করার জন্য সবে মুখটা খুলেছিলাম।

‘খামোশ!’ আমি টু শব্দটি করার আগেই গর্জে উঠল লোকটা।

অমনি মুখ বন্ধ করে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম তার দিকে। লোকটার কালো চোখের মণিদুটো যেন ভস্ম করে দিচ্ছে আমাকে।

‘কাপড় খোলো!’ হুঙ্কার ছাড়ল।

‘কী?’ চেঁচিয়ে উঠলাম বিস্ময়ে।

বৃষ্টিতে ভিজে কাপড়চোপড় চুপচুপে আমার, কিন্তু তাই বলে খুলতে যাব নাকি! যেখানে লকার রুমে পর্যন্ত চেনা ছেলেদের সামনে কাপড় পাল্টাতেও অস্বস্তি লাগে আমার।

লোকটা আমাকে পাকড়ে ধরে জামাটা টেনে খোলার চেষ্টা করতে লাগল মাথার ওপর দিয়ে।

‘খুলছি, খুলছি!’ প্রতিবাদ করে, শরীর মুচড়ে সরে গেলাম তার কাছ থেকে। ওকে আর যা-ই হোক, কাপড় খুলতে দিচ্ছি না আমার।

ক্যাপসুলটার পেছনে এক লাফে গা ঢাকা দিলাম, ও যাতে দেখতে না পায়। এবার কাপড়চোপড়গুলো খুললাম একে-একে। ওগুলো ছুঁড়ে দিলাম বিটকেল স্বভাবের লোকটার উদ্দেশে।

ও আমার জামাকাপড় কুড়িয়ে নিয়ে এক ক্লজিটের দিকে এগোলে আতঙ্কে অবশ হয়ে এল আমার গা-হাত-পা। ভারী এক চাবির গোছায় টুংটাং শব্দ তুলে ক্লজিটের তালাটা খুলল লোকটা। শিউরে উঠলাম রীতিমত।

বিড়বিড় করে কী সব যেন আওড়াচ্ছে ব্যাটা।

‘নো প্রমাণ! নো প্রমাণ!’ শুনলাম কেবল।

আমার কাপড়গুলো ঠেসে ভরে দিল ক্লজিটের ভেতরে। তারপর চকচকে, রুপোলী পোশাকের এক স্তূপ নিয়ে ফিরল। এক ঝটকায় বাড়িয়ে দিল আমার উদ্দেশে।

‘পরে নাও!’ খেঁকিয়ে উঠল।

‘কিন্তু–’

‘কথা কম,’ আদেশ ঝাড়ল। ‘যা বলছি করো। গোড়াতেই কোন বেয়াড়াপনা চাই না। আমার শোয়ে কোন বিদ্রোহী প্রতিবাদীর ঠাঁই নেই।’

কীসের শো?

ঠাণ্ডা, কাঁপা-কাঁপা হাতে রুপোলী পোশাকটা পরে নিলাম।

ড্রেসটা ওয়ান পিস, রুপোলী সুতোয় বোনা। কলার থেকে নিয়ে ডান গোড়ালীর ভেতরদিক অবধি এক সার রুপোলী হুক নেমেছে। হাতজোড়া এতটাই কাঁপছে, হুকগুলো লাগাতে রীতিমত নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি।

অবশেষে সবকটা হুক লাগানো গেল। এবার চোখ নামিয়ে নিজের দিকে চাইলাম।

ভয়ানক অপ্রস্তুত বোধ করলাম।

আমি ঢিলেঢালা কাপড় পরতে ভালবাসি। এটা অনেকটা ওয়েটসুটের মতন আঁটোসাঁটো। এমন পোশাক আমি কখনওই পরি না-এমনকী হ্যালোইনেও না।

লোকটা ঘুরে-ঘুরে খুঁটিয়ে দেখল আমাকে। মনে হলো সন্তুষ্ট হয়েছে।

‘ভাল,’ ঝট করে মাথা ঝাঁকিয়ে আওড়াল বিড়বিড়িয়ে। ‘খুব ভাল। কোন চিহ্ন নেই। কোন প্রমাণ আর রইল না।’

প্রমাণ রইল না মানে?

‘কীসের প্রমাণ রইল না?’ ক্য-ক্য করে প্রশ্ন করলাম।

‘খামোশ!’ নিষ্ঠুর লোকটা কড়া ধমক মেরে সজোরে এক চড় কষাল আমার গালে।

ব্যথায় পানি এসে গেল চোখে, গালে হাত ডললাম।

লোকটা প্রায় মধুর হেসে তর্জনী নাচাল আমার উদ্দেশে।

‘ভাল ছেলে হয়ে থাকো এমন আর হবে না।’ কোমল, মসৃণ গলায় বলল আমাকে। অসহায়ের মত মাথা ঝাঁকালাম।

লোকটা এবার আমার বাহু চেপে ধরে ক্যাপসুলটা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

পিছু ফিরে চাইলাম টার দিকে। ওই ক্যাপসুলটা, ওটা যা-ই হোক, বাস্তব জীবনের সঙ্গে আমার একমাত্র যোগসূত্র। এই দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

বড়সড় এক ভবনে রয়েছি আমরা, এয়ারপোর্ট হ্যাঙ্গারের মত বিশাল। ভেতরটা ঠাণ্ডা আর প্রায়ান্ধকার। তবে লোকটা আমাকে লম্বা এক হল ধরে টেনে নিয়ে চললে দু’পাশে নিচু দেয়াল চোখে পড়ল।

দরজার পর দরজার পাশ কাটাচ্ছি, বেশিরভাগই বন্ধ। খোলা কামরাগুলো এতটাই আঁধার ভেতরে দৃষ্টি চলে না।

আমার অবশ্য দেখার সময়ও নেই। যতবারই দেখার জন্য একটু থামছি, লোকটা এমন জোরে টান দিচ্ছে যে মনে হচ্ছে বাহুটা বুঝি ছিঁড়েই যাবে।

নিচু দেয়ালগুলোর ওপাশ থেকে চাপা কণ্ঠস্বর কানে আসছে।

কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। একটা মেয়ে।

জিনা নয়।

ক’জন নারী-পুরুষ হল-এ দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছে। পুরুষদের পরনে স্ট্রাইপড্ শার্ট আর সামনে ভাঁজ নিয়ে ব্যাগি প্যান্ট। মহিলারা পরেছে গোড়ালী অবধি ঝুলের লম্বা, কালো পোশাক, বড় শোল্ডার প্যাড সহ। তাদের ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক।

এদের ফ্যাশন দেখেই বুঝে গেছি যা বোঝার। টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতে চলে গেছি। কিন্তু কোন আমলে?

আমি কোথায়? কী হচ্ছে এসব? আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মানুষগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা নীরব হয়ে গেল। অনুভব করলাম তাদের নজর আমার ওপর এবং আমাকে অনুসরণ করছে।

সাহায্যের জন্য আর্তচিৎকার করতে চাইলাম। কিন্তু এদের অভিব্যক্তি হিমশীতল, মোটেও বন্ধুভাবাপন্ন নয়।

আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে রয়েছে আমি যেন মঙ্গলগ্রহের জীব

আমরা যখন পানি ভরা অতিকায় এক কাঁচের ট্যাঙ্ক পেরচ্ছি, হলটা তখন আরও প্রশস্ত হলো। পানিতে গোলাপী আর কমলা সামুদ্রিক শৈবালের লতা ভাসছে।

বেগুনী রঙের ঢাউস এক সি ফ্যানের পেছন থেকে খলবলিয়ে বেরিয়ে এল ইয়াবড় এক মাছ।

মাছটাকে খুঁটিয়ে পরখ করলাম। পরমুহূর্তে, হৃৎপিণ্ড বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো আমার।

মাছটার মুখখানা মানুষের! আট-নয় বছরের এক বাচ্চা ছেলের মুখ।

বাচ্চাটার গোটা দেহ চকচকে সবুজ আঁশে ভরা। পা আর পায়ের পাতার জায়গায় দীর্ঘ মাছের লেজ ওর।

আমার ছোট্ট মাছটাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?’ লোকটা প্রশ্ন করল আমাকে।

আতঙ্কমাখা চোখে ওটাকে দেখছি, লোকটা টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল আমাকে।

নিজের তীক্ষ্ণ ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর কানে এল আমার। ‘এটা কোন্ জায়গা?’

কথার উত্তরে স্রেফ হ্যাঁচকা টান খেলাম বাহুতে।

ট্যাঙ্কটার দিকে চকিতে পিছু ফিরে শেষবারের মত চাইলাম। মাছবালকটি কাঁচের কাছে সাঁতরে উঠে মুখটা চেপে ধরেছে নিজের। আমার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ ওর, আয়ত, কালো চোখজোড়ায় তীব্র ভীতি।

ওর মুখ দিয়ে গলগল করে বুদ্বুদ বেরোল।

পানি আর কাঁচ ভেদ করে কিছু একটা বলছে ও, প্রাণপণে চেষ্টা করছে আমি যেন বুঝি।

‘পালাও!’ ও বলছে। ‘পালাও!’

এগারো

লোকটা আরও শক্ত করে পাকড়াল আমাকে। পালাবার পথ নেই।

কোথায় চলেছি আমি? কী হবে আমার?

শেষমেশ ওই ছেলেটার মত আমারও কি ঠাঁই হবে মাছের ট্যাঙ্কে?

একটু পরে, লোকটা আমাকে এক অন্ধকার দোরগোড়া দিয়ে ঠেলে ভেতরে ঢোকাল। এক সার সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম।

‘ওঠো, আদেশ করল লোকটা। হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে।

এবার ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ালাম, হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছে।

জায়গাটা আঁধার আর গুমট। হাত বাড়ালাম। কাঁপা হাতে পর্দার মত কীসের যেন স্পর্শ পেলাম।

চারপাশে হাতড়াচ্ছি, পর্দার মাঝে ফাঁক খুঁজছি মরিয়া হয়ে। এবার আঁতকে উঠে আঁধারে আরও ক’জনের উপস্থিতি টের পেলাম। মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।

কুঁকড়ে নিজের জায়গায় ফিরে এসে জমে গেলাম, অপেক্ষা করছি কান পেতে।

নাক টানার শব্দ পেলাম। এবার চিৎকার ছাড়ল কে যেন। মানুষের কণ্ঠস্বর।

স্বস্তি পেলাম। যে-ই আর্তচিৎকার করুক না কেন, সে-ও আমার মতই ভীত-সন্ত্রস্ত।

‘ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ! জলদি আসুন!’ আঁধার চিরে গমগম করে উঠল ভারিক্কী এক কণ্ঠ। ‘নিজের চোখেই দেখুন ভবিষ্য-তের আশ্চর্য শিশুদে-এ-র! যা দেখবেন বিশ্বাস করতে পারবেন না। ওরা আপনাকে হতভম্ব করে দেবে, আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন। ওদেরকে প্রশ্ন করুন। যে কোন প্রশ্ন। ওদের মুখ থেকে নিকট আর সুদূর ভবিষ্যতের আজব বিস্ময়গুলোর কথা জেনে নিজের কানকে বিশ্বাস হবে না আপনার।’

পর্দাটা সরে যেতেই তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। মান্ধাতা আমলের পোশাক পরা জনতা বিস্ময়ের অস্ফুট ধ্বনি করে একে-অন্যকে ঠেলে-গুঁতিয়ে আরও ভালভাবে দেখার চেষ্টা করতে লাগল।

তারস্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে তারা, পুরু ধাতব বারের সারি ভেদ করে ওপরদিকে তর্জনী দেখাচ্ছে।

বিশাল এক খাঁচায় দাঁড়িয়ে আমি

আমার সঙ্গে খাঁচাটার ভেতরে আরও প্রায় জনা বারো ছেলে-মেয়ে।

কারও কারও পরনে আমার মত রুপোলী পোশাক। অন্যদের পরনে জাম্পসুট আর হেলমেট, নিম্নমানের সায়েন্স ফিকশন ছায়াছবিতে যেগুলোকে স্পেসসুট হিসেবে চালানো হয় আরকী। আমার বাঁ পাশের ছেলেটা ফোঁত-ফোঁত করে কাঁদছে আর বারবার নাক মুছছে রুপোলী হাতায়।

কিন্তু কেউ খেয়াল করছে না কিংবা পাত্তা দিচ্ছে না।

‘ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, ক্যাপ্টেন টাইম-এর ভবিষ্যতের শিশুদের ওপর নজর রাখুন। যে লোকটা আমাকে এখানে এনেছে সে খাঁচার একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দর্শকদের সঙ্গে।

নীল ব্লেয়ার আর চকচকে কালো ভাইজর সহ ক্যাপ্টেনের সাদা হ্যাট পরেছে সে। হঠাৎই কাঠের এক মুগুর দিয়ে খাঁচার বারে গদাম

করে আঘাত করল।

‘আপনারা নির্দ্বিধায় যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন, ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ। ভয় নেই, ওরা আপনাকে কামড়ে দেবে না।’

জনতা অস্পষ্ট বিড়বিড়ানির শব্দ করে অবিশ্বাসের চোখ তুলে চেয়ে রইল আমাদের উদ্দেশে।

‘ভবিষ্যতে তোমরা কীভাবে ঘুমাও?’ এক যুবতী মহিলা বলল। ‘সাধারণ বিছানায় নাকি অন্য কিছুতে?’

‘দাঁড়িয়ে,’ আমার উল্টোদিকের ছেলেটা একঘেয়ে কণ্ঠে, রোবটের মত উত্তর দিল। চোখ খুলে। ভবিষ্যতের শিশুরা কখনও স্বপ্ন দেখে না। দুঃস্বপ্নও না। ওটা এক নিখুঁত পৃথিবী। আমরা সৌভাগ্যবান ভবিষ্যতের শিশু।’

‘কী খাও তোমরা?’ কামরার পেছনদিক থেকে চেঁচিয়ে উঠল এক লোক।

‘আমরা কোন খাবার খাই না,’ একইরকম নিষ্প্রাণ গলায় জবাব দিল।

লিকলিকে এক ছেলে ভবিষ্যতের শিশুরা শুধু

ভিটামিন ট্যাবলেট খায়! আমরা খুবই স্বাস্থ্যবান। আমরা সৌভাগ্যবান ভবিষ্যতের শিশু।

না ঘুম। না কোন খাবার। এরা কোন ধরনের ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে? এ ভবিষ্যৎ তো আমার অচেনা-অজানা!

এদের সমস্যাটা কোথায়?

‘ভিটামিন ট্যাবলেট?’ এক দর্শকের চড়া গলার প্রশ্ন। ‘আমি বিশ্বাস করি না।’

‘ঠিক কাজই করেন!’ আমার পেছন থেকে এক মেয়ে-কণ্ঠ বলে উঠল।

জনতার শোরগোল বাড়ল।

‘ওর কথা শুনবেন না!’ বলে চলল মেয়েটি। ‘ভবিষ্যতের ছেলে-মেয়েরা আপনাদের মতই খায়-দায়, ঘুমোয়, স্বপ্ন দেখে। আমরা খাবার খাই। এমনকী জাঙ্ক ফুডও। প্রচুর পরিমাণে জাঙ্ক ফুড। আমরা বলি ফাস্ট ফুড। মাইক্রোওয়েভ বারিটো আর ফ্রোযেন গার্বেজ পিৎযা।’

হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎই লাফিয়ে উঠল আমার। আমি একজন মানুষকেই চিনি ফ্রোযেন গার্বেজ পিৎযা যে ভালবাসে।

‘জিনা!’ জনতার ক্রমেই বেড়ে চলা কোলাহল ছাপিয়ে চিৎকার ছাড়লাম। ‘জিনা-আমি এখানে!’

বারো

‘কিশোর!’

খাঁচার ভিড় ঠেলে পথ করে নিল জিনা। আমার হাত ধরে এমন জোরে চাপল, মনে হলো আমি আসল কিশোর কিনা যাচাই করছে।

ওর হাতে পাল্টা চাপ দিলাম আমিও। ওকে দেখে কী ভালই না লাগছে!

জিনার পরনেও অবিকল আমারটার মতই রুপোলী পোশাক। কুৎসিত এক রুপোলী বনেটে গোঁজা ওর লম্বা চুল। মাথায় এঁটে বসা বেদিং ক্যাপের মত লাগছে ওটাকে।

‘বিশ্বাস করতে পার, কিশোর?’ ফিসফিস করে বলল ও। ‘আমরা নাকি ভবিষ্যতের শিশু!’

এক মহিলা ছাতার ডগা দিয়ে বারে টোকা দিল।

‘এই মেয়েটার দাঁতে ওটা কী?’ প্রশ্ন করল।

‘ওটা ভবিষ্যতের রাজকুমারীর মর্যাদার প্রতীক,’ ব্যাখ্যা করল ক্যাপ্টেন টাইম।

‘মোটেই না, প্রতিবাদে ফেটে পড়ল জিনা। ‘এগুলো ব্রেস।’

‘নকল দাঁত?’ কেউ একজন জিজ্ঞেস করল।

‘না,’ জিনা শুধরে দিল তাকে। ‘দাঁত মজবুত করার জন্যে ব্রেস ব্যবহার করা হয়। অর্থোডন্টিস্ট দিয়েছেন। ভবিষ্যতের বাচ্চাদের সবার দাঁত সমান থাকে, আঁকাবাকা নয়, তারা চাক বা না চাক।’

লোকজন গুঞ্জনধ্বনি তুলল।

‘ওর কথা শুনবেন না!’ ক্যাপ্টেন টাইম বলে উঠল। ‘এই মেয়েটা ভবিষ্যতের এক রাজকন্যা। জন্মের সময়ই ওই আজব গোলাপী আর বেগুনী জিনিসটা ওর দাঁতে লাগিয়ে দেয়া হয়। এটা রাজবংশের বিশেষ চিহ্ন!’

‘লোকটা কী বলছে এসব?’ ফিসফিসিয়ে বললাম

ভ্রূ কোঁচকাল জিনা।

‘আসলে ও যখন আমাকে ক্যাপসুল থেকে টেনে বের করে ওকে তখন এটাই বলেছিলাম। ব্যাপারটা মনে ধরেছে ওর, ভাবছে ফ্রিক শো-র জন্যে সত্যিকারের এক রাজকন্যাকে বাগে পেয়েছে।’

‘ভবিষ্যতের রাজকন্যার জন্যে একবার হাততালি হয়ে যাক!’ গর্জাল ক্যাপ্টেন টাইম।

বিক্ষিপ্ত করতালি।

মনে হয় না লোকে বিশ্বাস করেছে ওর কথা।

আমরা কেউ ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি ওরা একথা বিশ্বাস করেছে মনে করি না। যদিও জিনা আর আমি আদতেই ভবিষ্যতের মানুষ।

‘ভবিষ্যতের বাচ্চাদের কি স্কুলে যেতে হয়?’ দর্শকের মধ্য থেকে এক ছেলে জানতে চাইল।

‘না।’ জিন্দালাশের দল থেকে আরেক সদস্য জবাব দিল। ‘ভবিষ্যতে ছোটদের স্কুলে যাওয়ার কোন দরকার হবে না। তারা ঘরে বসে ছবিওয়ালা রেডিয়ো দেখবে! ভবিষ্যতের বাচ্চারা খুব ভাগ্যবান।’

‘ভবিষ্যৎ জিন্দাবাদ!’ দর্শক-শ্রোতাদের ভেতর থেকে ছোটরা আনন্দে আটখানা হয়ে চিৎকার করে উঠল।

‘আহা, এমন হলে কী ভালই না হত!’ ফিসফিস করে জিনার উদ্দেশে বললাম।

শ্রাগ করল ও।

‘হ্যাঁ, এসবই ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্যাপ্টেনের নিজের ধ্যান-ধারণা।‘

শেষটাকে অনুসরণ করে আরেকটা প্রশ্ন এল।

‘তোমরা ঘোরাফেরা করো কীসে করে? ইলেকট্রিক গাড়িতে?’

‘না!’ রুপোলী পোশাক পরা এক মেয়ে উত্তর দিল। ‘ভবিষ্যতের বাচ্চারা জেট প্যাকে চেপে ঘুরে বেড়ায়! যখন খুশি, যেখানে খুশি উড়ে যাই আমরা।

‘ওহ, যথেষ্ট হয়েছে! বিড়বিড় করে বললাম। চাপাবাজির একটা সীমা থাকা দরকার!’

‘ওখানে কি ফ্লুর চিকিৎসা আছে?’ দর্শকদের মধ্য থেকে এক লোক জিজ্ঞেস করল।

‘ভবিষ্যতে,’ আরেকটা বাচ্চা জবাব দিল, ‘কারও কোন অসুখ- বিসুখ হয় না। সবাই রোগ প্রতিরোধী ট্যাবলেট খায়, ব্যস, কেউ আর অসুস্থ হয় না।’

‘হুম, ঠিক,’ শ্বাসের নিচে আওড়াল জিনা।

মনে হলো জনতাও আমাদের মতই এসব কথা বিশ্বাস করছে না এক বিন্দু।

গজগজ করতে লাগল তারা। ক’জন আমাদেরকে লক্ষ্য করে দুয়োধ্বনি দিচ্ছে।

আমার পায়ে কীসের যেন খোঁচা। চেয়ে দেখি এক লোক গরাদের ফাঁক গলিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে গুঁতোচ্ছে। লাখি হাঁকাবার চেষ্টা করলাম।

‘জানোয়ার!’ হুঙ্কার ছাড়ল লোকটা, মুঠো নাচাচ্ছে আমার উদ্দেশে। ‘কিম্ভূত জীব একটা।’

অন্যরাও এবার যোগ দিল তার সঙ্গে, যা-তা বলতে লাগল আমাদেরকে। হঠাৎই টের পেলাম কপালে কী যেন আঘাত করল।

হাত তুলে ডললাম জায়গাটা।

পায়ের কাছে মেঝেতে চোখ নামিয়ে চাইলাম। একটা মটরশুঁটি। কেউ একজন ওটা ছুঁড়েছে আমার দিকে!

দর্শকদের মধ্যে যারা ছোট তারা এখন মুঠো মুঠো মটরশুঁটি ছুঁড়ছে।

জিনা আর আমি মাথা নোয়ালাম।

‘ওকে, ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ! বাজখাই কণ্ঠে চিৎকার ছাড়ল ক্যাপ্টেন টাইম, ঘণ্টি বাজিয়ে পর্দাটা ফেলে দিল। ‘শো শেষ। পরের শো আরম্ভ হবে বিশ মিনিটের মধ্যে। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনুন। এক টিকিটে দুই শো।’

জিনা আমার হাত চেপে ধরল।

‘হায়, খোদা, বিশ মিনিট পর এই একই কাজ আবারও করতে হবে আমাদের?’ প্রশ্ন করলাম।

‘ভাবতে পার! দিনে আঠারোটা শো’ ও বলল আমাকে। ওর পিছু নিয়ে মঞ্চ থেকে চলে গেলাম পেছনদিকের এক কামরায়।

সবকটা ছেলেপিলে ওখানে জড় হয়ে নাকি কান্না কাঁদছে, নালিশ করছে ঘ্যান-ঘ্যান করে। এঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। স্রেফ গাদা-গাদা খড়ের আঁটি। মাটির মেঝেতে এখানে-সেখানে আলগা খড়কুটো ছড়িয়ে রয়েছে।

ছেলে-মেয়েরা খড়ের আঁটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

এদের বেশিরভাগই হাড্ডিসার। ফ্যাকাসে চেহারায় কোটরে বসা চোখ। ভবিষ্যতের শিশুদেরকে মোটেও সৌভাগ্যবান দেখাল না আমার চোখে। কিংবা স্বাস্থ্যবান।

জিনাকে হাত ধরে এক পাশে টেনে নিয়ে গেলাম। মনের মধ্যে রাজ্যের প্রশ্ন গিজগিজ করছে।

কিন্তু ও আমার ঠোঁটে একটা আঙুল রাখল।

‘এখানে নয়,’ সতর্ক করল, ‘চারদিকে ক্যাপ্টেনের চর।’

আমার হাত পাকড়ে আরেকটি রুমে নিয়ে গেল ও। এটা আকারে বড়সড় কোন ক্লজিটের সমান। তোবড়ানো এক কৌচ দেখলাম।

‘ক্যাপ্টেন আমাকে এ ঘরটা ব্যবহার করতে দিচ্ছে, জানিয়ে, ছাতাপড়া গন্ধওয়ালা কৌচটায় বসল। ‘আমি রাজকুমারী না?!’

‘যাক, তোমাকে তো অন্তত রাজকন্যার সম্মান দিচ্ছে। আর আমার সাথে তো যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে।’

মাথা ঝাঁকাল জিনা।

‘আপাতত ওর কথা মতই চলতে হবে, কিশোর। কথা শুনলে মারধর করবে না। বসো।’ ওর পাশে গদিতে চাপড় মারতেই ধুলো উড়ল।

ধপ করে জিনার পাশে বসলাম।

‘তো এটা কোন্ জায়গা?’ জবাব চাইলাম।

‘ফায়ারলাইট পার্কের এক কার্নিভাল এটা, ক্লান্তস্বরে জবাব দিল ও। ‘আমরা আবারও অতীতে ফিরে গেছি। কোন্ সালে তা অবশ্য জানি না। উনিশশো ত্রিশ-ট্রিশ হবে হয়তো।’

সংক্ষিপ্ত মাথা ঝাঁকুনি দিলাম।

‘সব ছেলে-মেয়েগুলো কি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে?’

‘জানি না। বেশিরভাগই এতটাই ক্লান্ত আর বিভ্রান্ত, ওরা নিজেরাও জানে বলে মনে হয় না। অনেকেই এসময়ের ঘর পালানো কিংবা এতিম। ক্যাপ্টেন টাইম অবশ্য চায় আমরা সবাই যেন বোকাটে উত্তরগুলো দিই।’

‘এই লোকটা আসলে কে?’

‘সে এই কার্নিভালটা চালায়,’ জানাল জিনা। ‘লোকটা ফায়ারলাইট পার্কের মালিকের ছেলে। তার বাবা তাকে এই কার্নিভালটা চালানোর অনুমতি দিয়েছে। কার্নিভাল থেকে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে গবেষণা করে লোকটা।’

‘কীসের গবেষণা?’ প্রশ্ন করলাম। ট্যাঙ্কের সেই মাছবালকটির কথা মনে পড়তেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার।

‘সব ধরনের গবেষণা, ব্যাখ্যা দিল জিনা। তবে টাইম ট্র্যাভেল নিয়েই বেশি কাজ করে।’

মাথা ঝাঁকালাম।

‘ওই ক্যাপসুলটা দেখেই বুঝেছি ওটা যে টাইম মেশিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিনা।

‘আমরা এখন কী করব, কিশোর? এখান থেকে ফিরব কীভাবে?’

পানির মত সোজা লাগল আমার কাছে উত্তরটা।

‘ক্যাপ্টেন টাইমকে বলব আমাদেরকে যেন ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দেয়!’ বাতলে দিলাম।

অধৈর্য ভঙ্গিতে মাথা ঝাড়া দিল ও।

‘আমি বলিনি মনে করেছ? এরমধ্যেই অন্তত দশ-বারোবার বলা হয়ে গেছে। ও শুনবে না, কিশোর। অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি। যতই অনুনয়-বিনয় করি, ততই আরও শক্ত হয় লোকটা, কড়া গলায় ‘না’ বলে। ও আমাদেরকে এখানে রেখে দিতে চায়। বন্দি করে।’

পাশের কামরার খড়ের আঁটিগুলোর কথা ভাবলাম।

‘চিড়িয়াখানার বুনো জানোয়ারের মত। তাহলে তো দেখছি আমাদেরকেই পালানোর পথ খুঁজে নিতে হবে। আমরা-’

‘এই যে, রাজকুমারী!’ এসময় ক্যাপ্টেন টাইম হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। ও, রাজকুমারী দেখি আমাদের নতুন টাইম ট্র্যাভেলারের সাথে দোস্তি পাতিয়েছে। তেলতেলে হাসি হেসে পেন্সিল-সরু গোঁফের ওপর সাদা দস্তানা পরা এক আঙুল বোলাল।

এ আমার বন্ধু, কিশোর পাশা। উনি খুব ভাল মানুষ, কিশোর, ওঁকে হ্যালো বলো।’ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল জিনা।

কালো চোখজোড়া জ্বলে উঠল লোকটার।

‘বন্ধু! বাহ, চমৎকার। আমি তারমানে দুই বন্ধুকে ট্র্যান্সপোর্ট করেছি! বাবাকে বলতে হচ্ছে। সে যদিও বিশ্বাস করবে না। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। সবাই ভাবে এসবই আমার মিথ্যে কারসাজি।

‘কিন্তু আমি পেরেছি, তাই না?’ জবাব চাইল। ‘আমি সময় চিরে মানুষকে ট্র্যান্সপোর্ট করতে পারি। আমি জিনিয়াস। জিনিয়াস।’ লোকটা আনন্দে আত্মহারা।

‘আপনি যেহেতু জিনিয়াস,’ প্রস্তাব রাখলাম বিনীত কণ্ঠে, ‘তাহলে আমাদের সময়ে আমাদেরকে ফিরিয়ে দিন না।’

‘কেন ফিরিয়ে দেব?’ রীতিমত কাঁই-কাঁই করে উঠল লোকটা।

‘কারণ,’ সাবধানে খুলে বললাম, ‘আমরা নিজেদের সময়ে এবং নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে চাই।’ এবার সাহস বাড়ল। ‘ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাদেরকে এখানে ধরে রাখলে লোকে তো আপনাকে কিডন্যাপার বলবে!’

‘আমাদের পাঠিয়ে দিন,’ আমার সঙ্গে দৃঢ় কণ্ঠে যোগ দিল জিনা। ‘ফিরিয়ে দিন, কথা দিচ্ছি আমরা থানায় কোন অভিযোগ জানাব না।’

করুণ হাসল লোকটা।

‘বিশ্বাস করো, রাজকুমারী। তোমাদেরকে আমি ফিরিয়ে দিতেই চাই।’

‘তাহলে দিন!’ একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম দু’জনে।

‘ছোট্ট একটা সমস্যা আছে যে,’ যোগ করল লোকটা, মাথা নাড়ল। ‘কীভাবে ফেরত পাঠায় জানি না তো আমি।’

তেরো

এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাটা বলে কী!

‘তারমানে বলতে চাইছেন আপনি মানুষকে অতীতে নিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারেন না?’ চিৎকার করে বললাম।

‘হ্যাঁ,’ ব্যথিতকণ্ঠে বলল লোকটা। ‘অতীতে পারি, ভবিষ্যতে পারি না। এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি, তবে এখনও ঠিক সফল হতে পারিনি।’

ট্রাউজারের পকেট থেকে এক সোনার ঘড়ি বের করল সে। কাঁচে আলতো টোকা দিল।

‘এখন বিশ্রামের সময়। দশ মিনিট পর পরের শো আরম্ভ হচ্ছে।’

‘আমরা যদি শো না করি?’ জবাব চাইলাম।

দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে উল্টো ঘুরল লোকটা।

‘করতে তোমাদের হবেই। না করে গতি নেই। আর তুমি, রাজকুমারী’ সাদা দস্তানা মোড়া লম্বা-লম্বা আঙুলগুলো দোলাল জিনার উদ্দেশে—’দর্শকদের প্রশ্নের পেট বানানো জবাব দিয়ো না দয়া করে। স্রেফ লিপি অনুসরণ করবে।’

জিনা রুপোলী ক্যাপটা এক টানে খুলে লম্বা চুল ঝাঁকাল।

‘না করলে?’ ভ্রূ উঁচিয়ে জবাব চাইল।

‘শোনো।’ ওর উদ্দেশে কাছিয়ে এসে ভীতিকর ফিসফিসে স্বরে বলল লোকটা, ‘তুমি রাজকুমারী হও আর না হও, আমার কথা মত চলবে। বোঝা গেছে, রাজকুমারী?’

‘জি, হুজুর!’ গোমড়ামুখে স্যালুট ঠুকল জিনা।

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল ক্যাপ্টেন টাইম।

‘শেষ যে ছেলেটা গোল পাকিয়েছিল তার কিন্তু জায়গা হয়েছে ঠাণ্ডা পানির বিশাল এক ট্যাঙ্কে, ছোঁড়ার গা ভর্তি এখন মাছের সবুজ আঁশ।’

তো আমার ধারণাই ঠিক! ক্যাপ্টেন টাইম ওই ছেলেটাকে মাছ বানিয়ে দিয়েছে!

লোকটা প্রতিভাবান হতে পারে, তবে আস্ত একটা পাষণ্ড, মনে-মনে বললাম।

আশা করি বুঝতে পেরেছ? প্রশ্ন করল ক্যাপ্টেন টাইম।

দু’জনেই আমরা একসঙ্গে তার দিকে চেয়ে ঘাড় কাত করলাম।

‘জি, হুজুর!’ চিৎকার করে বললাম।

ক্যাপ্টেন টাইম চলে যেতেই, দরজার কাছে দৌড়ে গিয়ে উঁকি দিলাম।

হলওয়ে ফাঁকা। হাতছানি দিলাম জিনাকে।

‘এসো!’

আতঙ্কে ছানাবড়া হয়ে গেল জিনার চোখ।

‘ও কী বলল শোননি? শো এখুনি শুরু হবে। রেডি হয়ে নাও। সবসময় ঘড়ি ধরে শো আরম্ভ করে ও।’

‘করুক, কে পরোয়া করে? তুমি কি এখানে সারাজীবন শিকড় গেড়ে বসে দিনে আঠারোটা করে শো করতে চাও নাকি? চলো ভাগি এখান থেকে,’ তাগাদা দিলাম ওকে।

জিনা ক্যাপের ভেতর পরিপাটী করে চুল গুঁজে ক্লান্তিভরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘বাদ দাও,’ কিশোর।

বিভ্রান্তির সঙ্গে মাথা নাড়লাম।

‘বাদ দেব? তুমি তারমানে পালাতে চাও না?’

‘তা নয়, কিশোর। কিন্তু এই উদ্ভট পোশাক পরে কদ্দূরই বা যেতে পারব আমরা বলো।’

আমাদের সাজপোশাকগুলো এক পলক দেখে নিলাম। রাংতায় মোড়ানো একজোড়া অদ্ভুতুড়ে মানব-মানবী মনে হচ্ছে আমাদেরকে।

জিনার কথায় যুক্তি আছে।

‘তাছাড়া,’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল ও, ‘এখান থেকে পালালেই তো আর নিজেদের সময়ে ফিরতে পারছি না আমরা।’

মাথা ঝাঁকিয়ে চিমটি কাটলাম নিচের ঠোঁটে।

‘টাইম মেশিনটা তো এই বিল্ডিঙেই-তাই না?’

‘আমাদের উচিত আগে ক্যাপ্টেন টাইমের আস্থা অর্জন করা, ওর কথা মত চলা। তারপর সুযোগ বুঝে-

‘এখান থেকে পালিয়ে নিজেদের আমলে ফেরার চেষ্টা করা,’ বাক্যটা শেষ করলাম ওর হয়ে।

অগত্যা জিনা আর আমি জড়সড় হয়ে কৌচটায় বসে রইলাম। ও ঝটপট আমাকে জানিয়ে দিল ভবিষ্যৎ নিয়ে দর্শকদের প্রশ্নের জবাবে কী বলতে হবে আমার।

আমরা কী খাই। কী পরি। কীভাবে ঘুমোই। কীভাবে যাতায়াত করি। ও এমনকী এ-ও দেখাল কীভাবে নাচি আমরা।

নাচটা এক্কেবারেই যাচ্ছেতাই।

কিন্তু মন দিয়ে সব শুনলাম, দেখলাম। প্রতিটা স্টেপ শিখলাম আর ভবিষ্যতের সুবোধ, ছোট্ট, সৌভাগ্যবান বাচ্চাদের জন্য লেখা ক্যাপ্টেন টাইমের লিপির প্রতিটি শব্দ মুখস্থ করে নিলাম।

অনেকটা ইউনিট টেস্টের জন্য নিজেকে তৈরি করার মতই হলো ব্যাপারটা।

শুধু পার্থক্য এটাই, এ পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে আমাদের। ফেইল করলে কী হবে দু’জনেই জানি।

পেছনে পড়ে থাকব আমরা।

অতীতে।

চিরকালের জন্য।

চোদ্দ

ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেগে আছি। কস্টিউমের পাতলা রুপোলী কাপড়ের ওপর দিয়ে গায়ে খোঁচা দিচ্ছে খড়কুটো।

গভীর শ্বাস টানলাম, ঘুমের ভান করছি, যতক্ষণ অবধি না নিশ্চিত হলাম ঘরভর্তি ছেলে-মেয়েরা সব ঘুমে বিভোর।

এবার এক গড়ান দিয়ে জিনাকে মৃদু-মৃদু ঠেলা মেরে জাগাতে চাইলাম।

ভয় পাচ্ছি, আচমকা ঘুম ভেঙে ও না আবার চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দেয়, বাড়ি মাথায় তোলে।

জিনা বন্দিশালার খড় বিছানো মেঝেতে শুয়ে রয়েছে, ওর কাঁধ ধরে আলতো করে ঝাঁকালাম। এক তিল নড়ল না ও। হয়তো স্বপ্ন দেখছে বাড়ি ফিরে গেছে।

এখন স্বপ্ন দেখার সময় নয়। আমরা নিজেরাই এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছি।

অবশেষে এক টুকরো খড় তুলে নিয়ে ওর নাকে সুড়সুড়ি দিলাম।

এবার কাজ হবে মনে হচ্ছে।

নাক কুঁচকে উঠে বসল জিনা, কটমট করে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে।

‘কিশোর—’

‘শশশ।’ ওর মুখ চেপে ধরলাম। অল্প আলোয় বিস্ফারিত, ভীতিমাখা চোখ মেলে আমার দিকে চেয়ে রইল ও।

আমাদের চারপাশে, ভবিষ্যতের শিশুরা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে ধীরে-ধীরে ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম।

অন্ধকার ঘরটার ভেতর দিয়ে পথ করে নিচ্ছি আমরা।

এর আগে, রাতের শেষ শো-র পরে, কালো বৌলার হ্যাট পরা দু’জন ষণ্ডামার্কা লোক দীর্ঘ হলওয়ে ধরে, আমাদেরকে পেছনে হাঁটিয়ে আরেকটা কামরায় নিয়ে গিয়েছিল। লম্বা-লম্বা পিকনিক টেবিলে বসিয়ে জঘন্য কী একটা খাবার যেন খেতে দিয়েছিল।

ঝোলের মধ্যে ধূসর চর্বির মত কীসব ভাসছিল। ওয়্যাক!

মনে হচ্ছিল এর তুলনায় আমাদের স্কুল ক্যাফেটেরিয়ার খাবার যেন অমৃত।

অবাক চোখে দেখি অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা গোগ্রাসে গিলছে সেই বিস্বাদ, অস্বাস্থ্যকর খাবার।

জিনা আর আমি ও খাবার মুখে দিইনি। সবার অলক্ষে টেবিলের নিচে মেঝেতে ফেলে দিয়েছি

এরপর, দুই ষাঁড় আমাদেরকে মঞ্চের পেছনের ঘরটিতে তাড়িয়ে নিয়ে যায় ভেড়ার পালের মতন। কথা না বলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়তে বলে।

আমাদের বেশিরভাগই সারাদিনের ক্লান্তির পর সঙ্গে-সঙ্গে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

এ পর্যন্ত সব ভালয় ভালয় চলেছে।

মঞ্চের পেছনের কামরাটার দরজা তালা মারা ছিল না। ক্যাপ্টেন টাইম হয়তো ভেবেছে আমাদের পালাবার সব পথ বন্ধ।

আচমকা জোরাল এক খোঁত শব্দে জমে কাঠপুতুল হয়ে গেলাম।

ডিউটিরত এক পাহারাদার পাহারা ফেলে ঘুমোচ্ছে। দেয়ালে ঠেকনো দেয়া ওর চেয়ারটার সামনের পায়া দুটো শূন্যে। চোখজোড়া ঢেকে রেখেছে বৌলার হ্যাট। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে আর জোরে জোরে নাক ডাকাচ্ছে।

পা টিপে টিপে ওর পাশ কাটালাম, এবার দীর্ঘ হল-টা পেরিয়ে, খাবার ঘরের পাশ দিয়ে, মাছের বিশাল ট্যাঙ্কটাও পেরোলাম।

বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ওটার ভেতরে উঁকি দিলাম আমরা। সিউইডের কমলা আর হলদেরঙা লম্বা পাতাগুলোর এদিক-ওদিক ভুতুড়ে নাচানাচি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।

মাছবালকের কী হলো?

ক্যাপ্টেন হয়তো রাতে ওকে ট্যাঙ্ক থেকে বের করে খাটে ঘুমোতে দেয়।

এক সার দরজার পাশ কাটিয়ে শেষমেশ বেশ বড়সড় এক কামরায় ঢুকলাম দু’জনে। তর্জনী দেখাল জিনা

দূরপ্রান্তে টাইম মেশিনটা দাঁড়িয়ে।

ওটার পোর্টহোল জানালাগুলো দিয়ে এক সবুজ-হলদে আলো চুইয়ে বেরোচ্ছে। ওটার উদ্দেশে দৌড়ে গেলাম আমরা। এসময় তীক্ষ্ণ এক গুঞ্জনধ্বনি শুনলাম।

ক্যাপ্টেন আমাদের জন্য সহজই করে দিয়েছে কাজটা। পাওয়ার অন করে রেখে গেছে।

জিনা আমার আগে ছুটে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে গোল দরজাটা খুলল।

‘এসো, কিশোর,’ চাপা ফিসফিসে কণ্ঠে ওর জরুরী তাগিদ। ‘পালাই চলো।’

দ্বিধা করলাম। ‘কোথায় পালাব? কীভাবে?’

কিন্তু জিনা পরোয়া করে মনে হলো না। ইতোমধ্যেই লাল সিটটিতে বসে পড়েছে ও। পাশের গদিটায় চাপড় দিল।

‘এখান থেকে দূরে। এমুহূর্তে সেটাই আসল কাজ।’

আমি অতখানি নিশ্চিত নই।

‘তাড়াতাড়ি, কিশোর!’

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। জিনার চোখজোড়া বিস্ফারিত আর চকচকে। এটা কি ওর কাছে নিছকই আরেকটা অভিযান? ও কি বুঝছে না ব্যাপারটা কতখানি গুরুতর?

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর পাশে উঠে বসলাম। খোলা রাখলাম দরজাটা। বদ্ধ জায়গা ভয়ানক অপছন্দ আমার।

‘ওকে, কিশোর,’ ব্যস্তকণ্ঠে বলল জিনা। ‘নবগুলো নাড়াচাড়া করে দেখি এসো।’

প্যানেলটার দিকে চেয়ে রইলাম অসহায় দৃষ্টিতে। একটা নব, ডায়াল কিংবা লিভারেও কোন লেবেল নেই।

কে জানে কী কাজ কোন্টার! জানে শুধু ক্যাপ্টেন। এবং সে এখন ঘুমিয়ে কাদা।

এখন কেবল বুনো আশাই ভরসা।

জিনা আমার ওপর দিয়ে ঝুঁকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

‘সময়চক্রের মাঝখানে আটকা পড়তে চাই না,’ বিড়বিড় করে বলল।

ভারী মজার কথা।

এবার সবচাইতে কাছের নবটার উদ্দেশে হাত বাড়াল।

‘এটাকে বাঁয়ে ঘুরিয়ে দেখি,’ নার্ভাস কণ্ঠে বকে চলেছে ও। ‘মেশিনটা হয়তো প্রোগ্রাম করা আছে। এটা হয়তো নিজেকে স্রেফ উল্টে দিয়ে আমাদেরকে ফিরিয়ে দেবে জায়গা মত।’

‘জিনা! সাবধান করলাম।

‘ক্ষতিটা কী শুনি?’ নিরীহ গলায় প্রশ্ন করল ও।