আবার উ সেন – ২.৯

নয়

ব্যাপারটা ঘটেছে সেদিন সকালেই, হেলিকপ্টারে চড়ে পিটারসন ফিল্ডে আসার সময়।

আগের রাতে পার্টিতে বেশি মদ্যপান করায় অস্বস্তিবোধ করছিল জেনারেল, চোখ বুজে ছিল সে, ইচ্ছে ছিল একটু ঝিমিয়ে বা ঘুমিয়ে তাজা করে নেবে শরীরটা। কিন্তু পেশীতে ঢিল পড়তেই জেনারেলের মাথার ভেতরটা কেমন যেন হালকা হয়ে গেল, তারপরই শুরু হলো মানসিক কিছু পরিবর্তন।

প্রথমে তার মনে হলো ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু হবে, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক। মনে হলো ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে, অতীতের কিছু ছবি চলে এল মানসপটে।

ছবিগুলো যেন পিছন দিকে ছুটল, বিপুলবেগে, মাঝে মধ্যে স্লো-মোশনে বিস্তারিত উন্মোচিত হলো, কিন্তু সেগুলোর অর্থ ঠিকমত ধরতে পারল না সে। কিছু কিছু স্মৃতি অক্ষতই থাকল, যেমন সাম্প্রতিক প্রমোশনের ঘটনা, ভিয়েতনাম যুদ্ধের আংশিক অভিজ্ঞতা, তার আগের কিছু দৃশ্য-ছবির রীলটা যেন তাকে শিশুকালে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মধ্যবর্তী দৃশ্যগুলো ভারী উদ্ভট। একটা মেয়ে, সুন্দরী মেয়ে, তার চুলের গন্ধ ওর খুব চেনা, কাছে এল কয়েকটা পিল নিয়ে। অন্তত তার মনে হলো মেয়েটাকে চেনে সে, চিনল চুলের গন্ধ থেকে। বান্না। টারা। রিটা। রানা। মাসুদ রানা। এম.আর.নাইন।

তারপর জেনারেল চোখ মেলে উপলব্ধি করল সে মোটেও জেনারেল পিলার নয়। তখনও তার মাথার ভেতরটা হালকা লাগছে, আসল সত্য ও বাস্তবতা ধীরে ধীরে আসন গাড়তে শুরু করল তার মধ্যে, যেন খোলা দরজা দিয়ে পরম স্বস্তি দায়ক সুবাতাস বয়ে গেল মনের আঙিনায়।

ঠিক এই উদ্দেশ্যেই ওর কাছে এসে পিলগুলো দিয়ে গেছে সে। নিজেকে ফিরে পাবার সময় কিভাবে তাকে ড্রাগ দেয়া হয়েছে, কিভাবে সম্মোহিত করা হয়েছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি রানা নতুন একটা ব্যক্তিত্ব দান করা হয়েছিল তাকে, সেটা প্রত্যাখ্যান করে নিজের পরিচয় ফিরে পেয়েছে সে, শুধু সতর্ক থাকল কিভাবে দান করা ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য সুবর্ণ সুযোগ না আসা পর্যন্ত ধরে রাখা যায়।

এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ!

ক্ষিপ্রবেগে ঘুরে গিয়ে রানা যখন কর্নেলের পিস্তল ধরছে, দেখল ডুপেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নিজের অস্ত্রের দিকে, চিৎকার করে বলছে, ‘জেনারেলের কথা শুনবেন না! পাগল হয়ে গেছে! ওর কথা শুনবেন না!’

হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করল ডুপ্রে, ইতিমধ্যে কর্নেলের বড়সড় কোল্ট পয়েন্ট ফরটি-ফাইভ সহ হাতটা লম্বা করে দিয়েছে রানা, চেম্বারের ভেতর পরপর দুটো বিস্ফোরণ চারদিক থেকে প্রতিধ্বনি তুলল।

মেঝে থেকে ওপরে উঠে গেল ডুপ্রের পা। এক সেকেন্ডের জন্যে শূন্যে ঝুলে থাকল তার শরীর, বুক থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল লাল রক্ত, দড়াম করে ধাক্কা খেলো দেয়ালের সাথে। পরমুহূর্তে ঘুরল রানা, ল্যাচাসিকে খুঁজছে।

কঙ্কালটাকে কোথাও দেখা গেল না।

ভাবে ও ভঙ্গিতে যতটা পারা যায় কর্তত্ব ফুটিয়ে রানা নির্দেশ দিল কমপিউটর টেপ আর প্রিন্টআউটগুলো এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরিয়ে দেয়া হোক। ‘কর্নেল, আপনার লোকদের অ্যাকশনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলুন। জলদি! জলদি! আমার সাথে যে ট্রুপস এসেছে তারা সহজে হার মানার লোক নয়। প্রতিরক্ষার জন্যে তৈরি হোন।

এক সেকেন্ড ইতস্তত করল কর্নেল। কমান্ড পোস্টে মৃত্যু আর বারুদের গন্ধ। কর্নেলের দু’জন অফিসার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করেছে বটে, কিন্তু কি করবে সে-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এখানে পা রাখার সাথে সাথে মলিয়ের ঝানের বিপজ্জনক আইসক্রীমের ক্রিয়া টের পেয়ে গেছে রানা। ঝানের লোকেরা আর একটু হলে ঠিকই টেপগুলো হাতিয়ে নিচ্ছিল। এখন শুধু দেখতে হবে দ্বিতীয় চেষ্টায় তারা যেন ওগুলো জোর করে নিয়ে যেতে না পারে।

আবার কর্তৃত্বের সুরে নির্দেশ দিল রানা, এবার জানতে চাইল ল্যাচাসি সম্পর্কে।

‘সে চলে…আপনাকে গুলি করতে দেখে…ছুটে পালাল…,’ নোরাডের একজন অফিসার তোতলাতে শুরু করল।

‘কর্নেল, আপনার প্রতিরক্ষা। সবচেয়ে কাছের বেসকে জানান। আপনার সাহায্য দরকার হবে,’ চাবুকের বাড়ির মত তীক্ষ্ণ শব্দ করল রানার কণ্ঠস্বর।

যেন ওর কথার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার জন্যেই, ভোঁতা বিস্ফোরণের আওয়াজের সাথে কেঁপে উঠল গোটা চেম্বার। আওয়াজটা এল মেইন এন্ট্রান্সের দিক থেকে।

দোর-গোড়ায় একজন মেরিন এসে দাঁড়াল। ‘এন্ট্রান্স ব্লকে অ্যান্টি-ট্যাংক রকেট ছোঁড়া হয়েছে, স্যার,’ চিৎকার করে কর্নেলকে জানাল সে, এরইমধ্যে লাফ দিয়ে টেলিফোনের সামনে পৌঁচেছে কর্নেল।

আবার বিস্ফোরণ। পাহাড়ের ভেতর গোটা কমপ্লেক্স কেঁপে উঠল এবার। দৃষ্টি প্রসারিত করে মেরিনের দিকে তাকাল রানা। ‘আমার সাথে যে অফিসার এসেছিল, কোথায় সে?’

‘স্যার?’

‘হাড্ডিসার লোকটা, কঙ্কালের মত দেখতে…’

‘এখানে গুলির আওয়াজ হলো, লোকটা আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে ছুটল, স্যার। বলল সাহায্য আনার জন্যে যাচ্ছে…’

আরেকটা রকেট বিস্ফোরণের সাথে আবার কেঁপে উঠল চেম্বার।

বুঝতেই পারছ কি ধরনের সাহায্য পাঠাচ্ছে সে,’ বলল রানা। ‘যেখানে যত লোক পাও সবাইকে জড়ো করো। কর্নেল বাইরে থেকে সাহায্য পাবার চেষ্টা করছেন। তোমাদের এই বেস আক্রান্ত হয়েছে। এটা কোন মহড়া নয়। ইট’স দা রিয়েল থিং। দিস বেস ইজ আন্ডার অ্যাটাক।’

একটু দেরিতে হলেও, এতক্ষণে বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারল সবাই। কর্নেলের দিকে ফিরল রানা। ‘ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে ওরা,’ বলল ও। ‘অ্যান্টি-ট্যাংক রকেটের সাহায্যে ভেঙেচুরে পথ করে নেবে…’

শব্দ শুনে মনে হচ্ছে এম/সেভেনটি-টু।’ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কর্নেলের চেহারা। ‘বুঝলাম না কি ঘটল। আমরা তো প্রায় আরেকটু হলে দিয়েই ফেলেছিলাম…’

‘চিন্তা করবেন না, কর্নেল, ওতে আপনার কোন দোষ হয়নি। এখনকার সমস্যা হলো যে-কোন উপায়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে ওরা, দরকার হলে নখ দিয়ে খুঁড়ে। কঙ্কালটা সত্যি যদি বাইরে বেরিয়ে গিয়ে থাকে, আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে দলটা। ডিফেন্সের কি ব্যবস্থা নেয়া যায় আমাকে জানাবেন?’

অফিসারদের দ্রুত কয়েকটা নির্দেশ দিল কর্নেল। কিন্তু রানার কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত ইতস্তত করল তারা। ঝানের ড্রাগস সমস্যা সৃষ্টি করছে বুঝতে পেরে কর্নেলের নির্দেশ রানাকে পুনরাবৃত্তি করতে হলো।

‘বাইরে আমাদের যে গার্ড ছিল তারা ওদের সাথে লড়ছে,’ বলল কর্নেল, ঢোক গিলল। ‘বেশ ভালই করছে ওরা, আমার ধারণা। রিইনফোর্সমেন্টও আসছে, কিন্তু আমরা সমস্যায় পড়েছি এখানে-পাহাড়ের ভেতর। প্রথম দরজাগুলো উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে ওরা, সম্ভবত রিসেপশন এরিয়ায় চলে আসছে। আমার ধারণা দরজার কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা…

দরজাগুলো পড়ে গেলে, সরু এন্ট্রান্স ধরে ছুটে আসবে। ঠেকাবার উপায় কি?’

‘কিছু গ্রেনেড, সাইড আর্মস আর একজোড়া এ-আর এইটীন।’

‘আনান ওগুলো, জলদি!’ এ-আর এইটীন, যতটুকু জানা আছে রানার, কমার্শিয়াল আর্মালিট উইপন-এর সর্বশেষ সংস্করণ। পুরোপুরি অটোমেটিক, প্রতি মিনিটে ফায়ার রেট আটশো রাউন্ড, প্রতিটি ম্যাগাজিনে থাকে বিশটা করে। কর্নেলের পিছু নিয়ে আর্মস লকারের সামনে চলে এল ও, মেইন অপারেশনস্ গ্যালারির দরজা থেকে কাছাকাছি দেয়ালে।

অস্ত্রটা হাতে চলে আসতে স্বস্তি বোধ করল রানা, কর্নেলের হাত থেকে ম্যাগাজিনগুলো প্রায় ছিনিয়ে নিল ও। একটা বাদে সবগুলো চালান করে দিল ইউনিফর্ম জ্যাকেটের পকেটে, তারপর লোড করল অস্ত্র।

লকারের দিকে পিছন ফিরল ওরা, আগের চেয়েও জোরাল শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল রিসেপশন এরিয়ায়, হোঁচট খেতে খেতে প্রবেশ পথ থেকে মেইন কমপ্লেক্সে পিছিয়ে এল কয়েকজন সৈনিক। তাদের মধ্যে রানা যার সাথে কথা বলেছিল সেই মেরিন লোকটাও রয়েছে।

‘দরজা ভেঙে রিসেপশনে ঢুকে পড়েছে ওরা।’ লোকটা হাঁপাচ্ছে, রানা দেখল কাঁধ খামচে ধরা আঙুলগুলোর ফাঁক গলে তাজা রক্ত গড়াচ্ছে।

দোরগোড়ায় পৌঁছে স্তম্ভিত হয়ে গেল রানা। বৃত্তাকার রিসেপশন এরিয়ায় একবার চোখ বুলিয়েই বমি পেল ওর। সুসজ্জিত প্রতিটি ডেস্ক চুরমার হয়ে গেছে, আর কোথায় না পড়ে আছে লাশ। কেউ কেউ এখনও মারা যায়নি, তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তারা। ওর নাক বরাবর সামনে মেইন এন্ট্রান্স, সেখান থেকে রিসেপশনের ভেতর ধোঁয়া ঢুকছে।

শত্রুরা সশরীরে এখনও রিসেপশনে এসে পৌছায়নি, ভাবল রানা। তবে আসবে, সরু প্যাসেজ ধরে একজন একজন করে আসতে হবে তাদের। দেয়ালের গায়ে কাঁধ ঠেকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল ও, অস্ত্রটা ধরে আছে কোমরের কাছে। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, কর্নেলও ওর ভঙ্গিটা অনুকরণ করছে। একজন অফিসার, ওদের সাথে ফ্লাইং ড্রাগন কমান্ড পোস্টে ছিল সে, এই মুহূর্তে ওদের পায়ের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে, গলা আর মুখের অর্ধেকটাই নেই।

ঝান! দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করল রানা।

হঠাৎ ধোঁয়ার ভেতর সচল মূর্তি দেখা গেল। হার্মিসের লোকেরা ঢুকছে রিসেপশন এরিয়ায়

রানা আর কর্নেল, দু’জন একসাথে ফায়ার ওপেন করল, ধোঁয়ার ভেতর অস্পষ্ট গর্তের দিকে ছুটে গেল বুলেটের তৈরি একজোড়া রেখা। গর্তটা হাঁ করে আছে, খানিক আগে ওটাই ছিল একজোড়া স্লাইডিং স্টীল ডোর।

এ যেন পাতিলের ভেতর মাছ মারছি, জেনারেল!’ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল কর্নেল। অনেকটা সেরকমই, ভাবল রানা। হার্মিসের শয়তানগুলো ডাকাতের মত হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে সরু প্যাসেজ ধরে ছুটে এল, গর্তের মুখ থেকে রিসেপশনে ঢুকতে না ঢুকতে ধরাশায়ী হলো অঝোর ধারায় বুলেট বর্ষণে। ধোঁয়ার জন্যে সামনে কি আছে দেখতে পাচ্ছে না ওরা, ভেতরে ঢুকছে প্রতিবারে একজন। ঝাঁক ঝাঁক বুলেটের ধাক্কায় কেউ সবেগে পিছিয়ে যাচ্ছে, কেউ দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে। তারপর হঠাৎ করে নেমে এল আধিভৌতিক নিস্তব্ধতা।

অবশেষে ধোঁয়ার মেঘ হালকা হতে শুরু করল, এবং সেই সাথে সামনে কি ভয়াবহ রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে উপলব্ধি করে ভুরু কুঁচকে উঠল রানার।

অস্ত্রটা রিলোড করল ও, আবার দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। বাইরে থেকে আবার একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে এল। তারপর একটা ব্যাকুল চিৎকার।

‘কর্নেল? কর্নেল? স্যার? এখানে নোরাডের কোন অফিসার আছেন, ফর গডস সেক?’

‘হ্যাঁ,’ পাল্টা চিৎকার করল কর্নেল। ‘নাম আর র‍্যাঙ্ক বলো। কি ব্যাপার?’

‘বাইরে ওরা খতম হয়ে গেছে, স্যার। মেইন এন্ট্রান্সে আমাদের ফোর্স দ্বিতীয় এ.পি.সি.টাকে অচল করে দিয়েছে। রাস্তার ধারে আমি কথা বলছি সার্জেন্ট কাটলার, স্যার।’

রানার দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকাল কর্নেল। ‘ঠিক আছে, জেনারেল। কাটলারকে আমি চিনি।’

রানা সিদ্ধান্ত নিল আপাতত ওর কোর-স্টার জেনারেল থাকাই সব দিক থেকে ভাল। তাতে অন্তত বেয়াড়া প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচা যাবে। ওর প্রধান উদ্বেগ, এখন যেহেতু অপারেশন বুলডগ ব্যর্থ হয়েছে, রিটা হ্যামিলটনকে নিয়ে। তার অবস্থা কি জানার পর মলিয়ের ঝানকে খুঁজে বের করবে ও।

বাইরের অবস্থা ভেতরের চেয়ে কোন অংশে ভাল নয়। নিহতদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মেডিকেল টীমের লোকজন, আহতদের চিকিৎসা চলছে। প্রথম এ.পি.সি.-র আগুন এখনও নেভেনি। কাঁটাতারের বেড়ার এক জায়গায় বিরাট একটা ফাঁক দেখা গেল।

নিচের রাস্তা থেকে, দৃষ্টিসীমার বাইরে, মাঝে মধ্যে অটোমেটিক রাইফেলের আওয়াজ ভেসে আসছে।

‘ওদিকের খবর কি?’ গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কর্নেল, তাকিয়ে আছে তিনজনের একটা দলের দিকে, ফিল্ড কমিউনিকেশন রেডিওর ওপর হুমড়ি খেয়ে রয়েছে তারা।

জবাব দিল একজন সার্জেন্ট। গার্ডদের সাহায্য করার জন্যে আরও লোক রওনা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় এ.পি.সি.টাকে উল্টে দেয়া হয়েছে রাস্তার ধারে, শত্রুদের দু’একজন যারা বেঁচে আছে তাদের পালানোর পথ বন্ধ।

‘এখনও আমাদের মাথায় ঢুকছে না কেন আমরা টেপগুলো ওদের হাতে তুলে দিচ্ছিলাম,’ নিজের মনেই বিড়বিড় করছে কর্নেল। ‘এমন হবার তো কথা নয়। গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে আমার কাছে…’

‘সব পরিষ্কার হয়ে যাবে-একটু সময় দিন। আপনার কোন দোষ হয়নি, কর্নেল। ওরা এমনকি আমাকেও ফাঁদে ফেলেছিল…’

রেডিও থেকে মুখ তুলে কর্নেলকে ডাকল সার্জেন্ট, জানাল এক মাইল দূরে একটা প্রাইভেট হেলিকপ্টার রয়েছে। ‘এক ভদ্রমহিলা, স্যার। ল্যান্ড করার অনুমতি চাইছেন। জিজ্ঞেস করছেন আমাদের সাথে মি. রানা নামে কেউ আছেন কিনা।’

‘নামতে দাও ওকে,’ নির্দেশ দিল রানা, এখনও জেনারেলের ভূমিকায়। ‘গোটা ব্যাপারটা কি নিয়ে আমি জানি। এখানে নিয়ে এসো ওকে।

বলা যায় না, হেলিকপ্টারে করে হয়তো স্বয়ং মলিয়ের ঝানই আসছে, পিস্তল ধরে রেখেছে রিটা বা বেলাডোনার মাথায়। তবু কপ্টারটাকে নামতে দেয়াই ভাল। যদি ঝান এসে থাকে, তাকে আর খুঁজে বের করতে হবে না। ঝুঁকি থাকলেও, ঝানের সাথে এই মুহূর্তে দেখা করার ঝোঁক দমন করতে পারল না রানা। মনে পড়ল, আসার পথে কনভয়টাকে অনুসরণ করছিল একটা হেলিকপ্টার।

‘তাই করব, স্যার?’ রেডিও অপারেটর জিজ্ঞেস করল কর্নেলকে।

‘জেনারেল যদি বলেন তো করো। হ্যাঁ।’

ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সার্জেন্টের সামনে দাঁড়াল রানা। ‘তুমি আইসক্রীম পছন্দ করো না, ঠিক, সার্জেন্ট?’ জিজ্ঞেস না করে পারল না ও, কারণ এইমাত্র অচেনা ফোর-স্টার জেনারেলের নির্দেশ বৈধ কিনা জানার জন্যে ইমিডিয়েট বস্, পরিচিত কর্নেলের শরণাপন্ন হতে দেখেছে একজন সার্জেন্টকে।

হ্যান্ড মাইকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মাথা নাড়ল কমিউনিকেশন কর্মী ‘ঘৃণা করি, স্যার, বমি পায়। জিনিসটা এমনকি দেখতেও ইচ্ছে করে না। হেলিকপ্টারের সাথে যোগাযোগ করার সময় অবাক চোখে জেনারেলকে একবার দেখল সে।

তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা করে কর্নেলকে বোঝাল রানা, এখুনি তাকে বিদায় নিতে হবে। ‘কোন সমস্যা হলে হোয়াইট হাউসের সাথে যোগাযোগ করবেন। বলবেন মাসুদ রানা নামে একজনের সাথে দেখা হয়েছিল আপনার। ওরা একটা ব্যাখ্যা দেবে, আশা করি।’

অনেকটা যেন ঘোরের মধ্যে তাকিয়ে থেকে সাদা ধাতব ফড়িংটাকে কমপাউন্ডে নামতে দেখল কর্নেল। ল্যান্ড করার আগের মুহূর্তে নিখুঁতভাবে একপাশে সরে গেল, জ্বলন্ত এ.পি.সি-কে এড়াবার জন্যে। চেইন মাউন্টেইনের সিকিউরিটি ভেদ করে ভেতরে ঢোকার যে ব্যর্থ চেষ্টা মলিয়ের ঝান করেছিল ওটা তার শেষ স্মৃতি!

হেলিকপ্টারটা পুরানো বেল ফরটি-সেভেনের আধুনিক সংস্করণ, টুইন- সিটার। বেলুন আকৃতির ককপিটে মাত্র একজনকেই বসে থাকতে দেখল রানা। সে যে ঝান নয় তা পরিষ্কার বোঝা গেল। একহারা গড়ন পাইলটের, গায়ে সাদা ওভারঅল আর মাথায় হেলমেট, ছেলে নাকি মেয়ে বোঝার উপায় নেই।

কপ্টারের দরজা খুলে ফেলেছে, ঝুলে পড়েছে নিচের দিকে, এই সময় পৌঁছুল রানা।

‘ওহ্ রানা। থ্যাঙ্ক গড। ওহ্ থ্যাঙ্ক গড, ইউ আর সেফ!’

রানার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল বান্না বেলাডোনা, ঘন ঘন গাল ঘষল ওর বুকে, যেন সাত রাজার ধন ফিরে পেয়েছে। লাল চোখ জোড়া ভিজে উঠল, ফোঁপাচ্ছে।

রানা ক্লান্ত, রিটার নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন, ল্যাচাসি পালিয়েছে কিনা জানার জন্যে ব্যাকুল, আরেক চিন্তা: না জানি কোথায় লুকিয়েছে মলিয়ের ঝান, কিন্তু এত সব সত্ত্বেও ওর মনে হলো বানা বেলাডোনাকে আর কখনও কাছছাড়া করা চলবে না।