আবার উ সেন – ১.১১

এগারো

কেবিন দুটো হুবহু একই রকম দেখতে, শুধু নাম আলাদা-স্যান্ড ক্রীক আর ফেটারম্যান। স্মরণ করতে যদি ভুল না হয় রানার, আঠারোশো ষাট সালের ইন্ডিয়ান যুদ্ধে গা গুলিয়ে ওঠা হত্যাযজ্ঞের নাম এগুলো। স্যান্ড ক্রীকে, ওর মনে পড়ল, ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতার একটা দৃশ্য উন্মোচিত হয়; যার অবসান ঘটে বুড়ো, মহিলা আর শিশুদের পাইকারীভাবে খুন করার মধ্যে দিয়ে।

তবে কেবিনগুলোয় সও মং ফ্যাশন রক্ষা করা হয়েছে, গোটা র‍্যাঞ্চে যেমন তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ভেতরে প্রচুর জায়গা দেখে অবাক হলো না রানা। প্রতিটি কেবিনে একটা করে প্রশস্ত সিটিংরূম; টেলিভিশন, স্টেরিও আর ভি-টি- আর দিয়ে সাজানো। একটা করে বেডরূম, পাঁচতারা হোটেলেও এত সুন্দরভাবে সাজানো কামরা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। বাথরূমে রয়েছে শাওয়ার আর বাথটাব, বাথটাবে সাঁতার কাটা যাবে, পানিতে বুদ্বুদ আর আলোড়ন তোলার যান্ত্রিক ব্যবস্থা। পেইন্টিংগুলো বিশাল, প্রতিটি নামকরা শিল্পীদের আঁকা-স্যান্ড ক্রীক আর ফেটারম্যান যুদ্ধের জ্যান্ত দৃশ্য ফুটে আছে!

টেলিফোনও আছে, তবে একটু পরই জানা গেল প্রধান দালান ছাড়া আর কিছুর সাথে সংযুক্ত নয়। পরস্পরের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। আরেকটা ব্যাপার উদ্বিগ্ন করে তুলল রানাকে, দুটো কেবিনের কোনটাতেই তালা- চাবি বলে কিছু নেই। অতিথিদের জন্যে প্রাইভেসীর কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

টস করল ওরা। রানার কপালে ফেটারম্যান জুটল। রিটাকে তার লাগেজগুলো স্যান্ড ক্রীকে নেয়ার কাজে সাহায্য করল রানা।

‘সাড়ে চারটার আগে ওরা আমাদের নিতে আসছে না,’ রিটাকে বলল ও। ‘দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নাও, আশপাশটা দেখতে বেরুব।’

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, লাগেজ খোলার সময় ভাবল রানা, ঝান র‍্যাঞ্চের রহস্যগুলো সম্পর্কে জানা দরকার ওদের। কেবিনে তালা-চাবি না থাকলেও, সাথে অন্তত স্যাবটা আছে। তালা দেয়া গাড়িতে ওদের ইকুইপমেন্ট নিরাপদে থাকবে। সাধারণ একটা স্যাব থেকেই কিছু চুরি করা অত্যন্ত কঠিন আর ঝামেলার কাজ, আর রানার স্যাবে বুলেট প্রুফ কাচ ছাড়াও অতিরিক্ত বহু কিছু রয়েছে। স্পর্শকাতর সেনসর আছে, কেউ ভেতরে হাত গলাতে চাইলে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। অবশ্য এই মুহূর্তে গাড়ি নয়, নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে বেশি উদ্বিগ্ন রানা। জঙ্গলের মাঝখানে ছোট্ট ফাঁকা জায়গায় যেভাবে ওদেরকে কোণঠাসা করা হয়েছে, দুশ্চিন্তা না করে পারা যায় না।

কাপড় বদলে দশ মিনিটেই তৈরি হয়ে গেল রিটা। নতুন শার্ট আর জিনস পরেছে সে, শার্টের ওপর ওয়েস্টার্ন জ্যাকেট। কাপড় বদলেছে রানাও, স্প্রিঙফিল্ড থেকে কেনা ক্রীম কালারের লাইটওয়েট সুট পরেছে ও। দু’জনের পায়েই লেদার বুট। রানার হোলস্টার জায়গা বদল করে ডান নিতম্বের শেষপ্রান্তে চলে এসেছে, কোমরের বেল্টের সাথে আটকানো।

কেবিনে একা থাকার সময় ব্রীফকেস খুলেছিল রানা। রিটা আসতে তার হাতে ছোট রিভলভারটা ধরিয়ে দিল, অ্যামিউনিশন সহ।

‘হুঁ-হুঁ, কেউ লাগতে এলে দেব খুলি উড়িয়ে!’ কৌতুক করে বলল রিটা।

‘এসো, যারা দেখছে, যদি কেউ থাকে, তাদের বুঝিয়ে দিই আমরা আবেগে আক্রান্ত হয়েছি,’ রিটার মত রানাও ফিসফিস করল, তার কাঁধে হাত রেখে বেরিয়ে এল কেধিন থেকে। মেঠো পথের দিকে যাচ্ছে ওরা। গাছপালার ভেতর দিয়ে যাবার সময় রিটাকে পাঁজরের আরও কাছে টেনে নিল রানা।

যত টানল রানা, তারচেয়ে বেশি সরে এল রিটা। ‘কাউকে বোঝাবার জন্যে অভিনয় করতে হবে না, রানা-আমি এমনিতেই প্রচণ্ড আবেগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি।

রিটার চোখের দিকে তাকাল রানা। সারা শরীরে পুলক আর মনে লোভ জাগছে। এই মেয়ে একজন সাধুরও চরিত্রহনন করবে, সন্দেহ নেই।

‘এভাবে যদি ব্যাপারটা ভুলে থাকতে পারো তাহলেই তো আর কোন সমস্যা থাকে না, বিড়বিড় করে বলল রিটা, রানার সুট আর শার্টের ভেতর একটা হাত ঢোকাল সে।

‘আমি ভুলিনি,’ ঠাণ্ডা গলায় উত্তর করল রানা। ‘আমার বেলায় এটা অভিনয়ই।’

‘কিসের কথা বলছি বলো তো?’

‘তুমি সস্তা মেয়ে নও।’

ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিটা। ‘তুমি শুধু রাগী বা অহঙ্কারী নও, নিষ্ঠুরও!’ রানার বুক থেকে হাত সরিয়ে নিল সে। জঙ্গলের আরও গভীরে চলে এসেছে ওরা। ‘আমার আরও সন্দেহ হচ্ছে, তুমি সত্যি একটা পুরুষ মানুষ কিনা। নাকি চরিত্র না হারাবার পণ করেছ? যেমন কোন কোন মেয়ে অক্ষতযোনি থাকার পণ করে?’

রানা নিরুত্তর।

‘দেখব কোথায় থাকে তোমার চরিত্র!’ এত কথা বলেও মনের রাগ মিটছে না রিটার। ‘এই বলে রাখলাম, ঝানের বান্ধবী জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে তোমাকে।’

যুদ্ধ আর ঝগড়া একা একা হয় না, কাজেই আপাতত চুপ করে যেতে হলো রিটাকে। ইলেকট্রনিক বা জ্যান্ত কোন প্রহরী যদি থাকে, তাদের চোখে মনে হবে ওরা স্রেফ হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। তবে দু’জনেই ওরা সতর্ক, দৃষ্টিসীমার প্রতিটি ইঞ্চির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেল না।

‘হতে পারে রাডার বা অন্য কোন সিস্টেম ব্যবহার করছে ওরা-সরাসরি টারা থেকে নজর রাখছে,’ বলল রানা, ঢালের মাথায় উঠে এসেছে ওরা। বেরিয়ে এল জঙ্গলের কিনারায়।

ঢালের মাথা থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় র‍্যাঞ্চ। আট মাইল সামনে ছোট একটা শহর মত দেখা গেল, ইঁটের তৈরি ঘর-বাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ওটাই বোধহয় স্টাফ কোয়ার্টার। বাম দিকে ইংরেজি টি অক্ষরের আকৃতি নিয়ে রোদে জ্বলজ্বল করছে সাদা একটা বিল্ডিং। রানা লক্ষ করল, এই বড়সড় কাঠামোটা প্রতিরক্ষা সীমান্ত বরাবর উঁচু পাঁচিল ঘেঁষে রয়েছে, সবুজ গাছপালার চওড়া একটা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা।

‘যত্নচর্চিত বনভূমি,’ কমপ্লেক্সটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল রানা। ‘ওটা নিশ্চয় কনফারেন্স সেন্টার। একবার ঢু মারা দরকার।

‘জঙ্গলের ভেতর দিয়ে?’ রিটার ভুরু উঁচু হলো। ‘না জানি ভেতরে কি আছে! দেখছ? জঙ্গলের কিনারায়? খাদ মত কি যেন? আরও আছে…বিল্ডিংটার কাছে বেড়া…’

হিংস্র জানোয়ারের কথা ভাবল রানা, সাপও থাকতে পারে, এমনকি বিষাক্ত ফুল থাকাও অসম্ভব নয়। পয়জন গার্ডেন সম্পর্কে শুনেছে রানা, উ সেনের একটা শখ ছিল। কোন ভবনের কাছাকাছি যদি কৌতূহলী কাউকে ঘেঁষতে দেয়ার ইচ্ছে না থাকে, সামর্থ্য থাকলে কর্তৃপক্ষ একশো একটা বিভিন্ন উপায়ে বাধা দিতে পারে কিংবা ভেতরে ঢুকতে দিয়ে বেরুবার রাস্তা চিরকালের জন্যে বন্ধ করে দিতে পারে। রানার মনে পড়ল, মনো-রেলের মত দীর্ঘ একটা পথকেও ইলেকট্রিফায়েড কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে সও মং।

সামনের দৃশ্য নয়নাভিরাম, সন্দেহ নেই, কিন্তু নিজেকে অন্যমনস্ক হতে না দিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে রানা। যেভাবে হোক কনফারেন্স সেন্টারের ভেতর ঢুকতে হবে ওকে

শুধু কনফারেন্স সেন্টার নয়, ঝানের ল্যাবরেটরির কথাও মনে আছে ওর। ওদের নিচে র‍্যাঞ্চের মেইন হাইওয়ে, হাইওয়ের কাছাকাছি লম্বা আরেকটা বিল্ডিং ওটাকেই ল্যাবরেটরি বলে সন্দেহ করল রানা। টার্গেট হিসেবে সহজ বলেই মনে হলো। কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করল রিটা। হাত তুলে দেখাল সে, দ্বিতীয় আরেকটা বিল্ডিং রয়েছে, রানা যেটাকে ল্যাবরেটরি বলছে সেটার পিছনে, তৈরি করা হয়েছে অনেকটা অয়্যারহাউসের মত করে, আংশিক ঢাকা পড়ে আছে গাছপালায়। ওটার পিছন থেকে চওড়া একটা রাস্তা বেরিয়েছে, এঁকেবেঁকে পিছিয়ে গিয়ে মিলিত হয়েছে মেইন হাইওয়ের সাথে।

বহুদূরে, ধোঁয়াটে নীলচের ভেতর অস্পষ্ট, পশুচারণ ভূমি। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সচল কিছু কালো বিন্দু দেখা গৈল শুধু, ওগুলোই গরু-মহিষের পাল। আরও জানা গেল ঢালের মাথাটাই র‍্যাঞ্চের সবচেয়ে উঁচু জায়গা নয়! কনফারেন্স সেন্টারের বাঁ দিকে, ঝানের স্বপ্নপুরী ধীরে ধীরে উঁচু হতে শুরু করে একটা মালভূমিতে গিয়ে সমতল হয়েছে। এয়ারস্ট্রিপটা ওখানেই। দূর থেকে দেখে ওরা দু’জনেই একমত হলো, মালভূমিটার যে আকার তাতে খুব বড় ধরনের প্লেনও অনায়াসে ল্যান্ড করতে পারবে।

ঠিক যেন ওদের ধারণাকে সমর্থন করেই হঠাৎ শোনা গেল এঞ্জিনের আওয়াজ। ত্রিশ কি চল্লিশ মাইল দূর থেকে ভেসে এল শব্দটা। ওদের দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এল প্লেন, একটা বোয়িং সেভেন-ফোর-সেভেন।

‘ওরা যদি জাম্বো নামাতে পারে, বাকিগুলোর ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন থাকে না।’ রোদের ঝাঁঝে কুঁচকে সরু হয়ে গেছে রানার চোখ। ‘ওটা আমাদের আরেকটা টার্গেট, রিটা। তালিকাটা মনে রেখো-কনফারেন্স সেন্টার, ঝানের ল্যাবরেটরি, এয়ারফিল্ড…’

রানার হাত ধরে আছে রিটা, চাপ বাড়িয়ে বলল, ‘আর এদিকের মনো-রেল স্টেশন। কে জানে, ওই পথেই হয়তো পালাতে হবে আমাদের। ওদিকের স্টেশনে কি কি বাধা আছে আমরা জানি।’

‘যমজ ড্রাকুলা আর বেড়ার গায়ে অদৃশ্য আগুন,’ নিষ্ঠুর হাসিতে টান টান হয়ে উঠল রানার মুখ। ‘স্বপ্নপুরীর সবখানে সৌন্দর্য আর সুরুচির ছড়াছড়ি, প্রাচুর্যের সমারোহ, কিন্তু আসলে জায়গাটা উপচে পড়া ডাস্টবিনের মত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।’

হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নাক ঢাকল রিটা।

‘এখানে ছোট একটা আর্মি আছে তার, প্রাসাদে আছে আমোদ-ফুর্তির আয়োজন। রেস ট্র্যাকও আছে, যেখানেই হোক…’

‘গরু, মহিষ, ভেড়া, ঘোড়া এ-সবের কথা ভুলে যেয়ো না…,’ নাক থেকে হাত সরিয়ে বলল রিটা।

‘ঝানল্যান্ড, ডিজনিল্যান্ডের জবাব। কিন্তু জানো, রিটা, এত সব আনন্দ- কৌতুকের মধ্যে আমি হার্মিসের অস্তিত্ব অনুভব করছি? আমার পরম শত্রু উ সেন ঠিক এভাবেই বেঁচে থাকতে পছন্দ করত।’

‘সেন্টিমেন্টালি ইনভলভড় হওয়াটা কি ঠিক হবে, রানা?’ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রিটা, তার দৃষ্টিতে সতর্কতা।

বুঝতে পারছ না, রিটা, ওরা আমার বাঁচা-মরা নিয়ে খেলছে! সেন্টিমেন্টালি ইনভলভড় না হয়ে আমার উপায় নেই! ‘

সাথে ফিল্ড গ্লাস নেই বলে খেদ প্রকাশ করল রানা। কাগজ-পেন্সিলও নেই যে একটা ম্যাপ আঁকবে। খানিক পর রিটা জিজ্ঞেস করল রানার কি মনে হয়, এখান থেকে বেরুতে পারবে তো ওরা?

দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পরই শুধু সে চেষ্টা করব আমরা। সেগুলো কি তুমি জানো।

মাথা ঝাঁকাল রিটা, কাঠিন্য ফুটে উঠল কোমল চেহারায়। ‘হার্মিস কি করতে চাইছে জানা, এটা যদি তাদের ঘাঁটি হয়ে থাকে…’

‘এটা যে তাদের ঘাঁটি তাতে কোন সন্দেহ নেই।

‘আর কে আসল কালপ্রিট জানা…

‘হ্যাঁ,’ রানার চেহারা আগের মতই গম্ভীর। ‘তোমার কাকে সন্দেহ হয়? ঝান, নাকি পিয়েরে ল্যাচাসি…?’

‘কিংবা বান্‌না বেলাডোনাও হতে পারে, রানা।’

‘বেশ, কিংবা বান্না বেলাডোনাও, তর্কের খাতিরে মানলাম। তবে যদি বাজি ধরতে বলো, আমি বলব ঝান। তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্মাদের সমস্ত লক্ষণ আছে। বস্তা বস্তা ডলার খরচ করে কাভার তৈরি করছে, সম্পদ আর অমূল্য অ্যান্টিকস্ সংগ্রহের ব্যাপারটা তার একটা রোগের মত, সব সময় প্রতিটি জিনিস আরও বেশি করে চাইছে, যতই থাক মন ভরে না, আসরে মধ্যমণি হয়ে থাকার প্রবণতা। আমার ধারণা সে-ই, পিয়েরে ল্যাচাসি তার খোজা প্রহরীদের প্রধান।

‘লোকটা খোজা কিনা সে-ব্যাপারে জোর করে কিছু বোলো না তো,’ একটা ঢোক গিলে বলল রিটা। লাঞ্চের সময় তার পাশে বসেছিলাম আমি। হাড়সর্বস্ব হলে কি হবে, তার হাত নির্লজ্জের মত এদিক সেদিক বাড়তে চেষ্টা করে।’ শিউরে উঠল সে। ‘সেই থেকে ভয়ে সিঁটিয়ে আছি আমি দরজায় তালাও দিতে পারব না।’

ঢালের কিনারা থেকে রিটাকে নিয়ে সরে এল রানা, আরেকবার জঙ্গলটা পরীক্ষা করে দেখতে চায়। ‘কোন না কোন ধরনের মনিটরিং সিস্টেম না থেকেই পারে না,’ আরও আধ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর বিফল হয়ে বলল ও। ‘আমার মনে হয় রাতে বেরুনোই ভাল। পাহারায় যদি কেউ থাকে, অবশ্যই থাকবে, তাদের চোখে ধুলো দিতে হবে। হ্যালো!’ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল রানা, মাথা একদিকে একটু কাত করে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে।

একটু পর রিটাও শুনতে পেল শব্দটা, কোন এঞ্জিনের। ঢালের নিচে রাস্তা থেকে ভেসে আসছে।

রিটার একটা হাত ধরল রানা। ‘গ্রান্ড ট্যুর পার্টি আসছে। ভুলো না, এখন ওরা আমাদেরকে আলাদা করবে, কিন্তু টারায় ডিনারের পর দু’জন একসাথে থাকব আমরা। ঠিক আছে?’

‘যথা আজ্ঞা, জনাব।’ পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে উঁচু হলো রিটা, রানার গালে ঠোঁটের কোমল স্পর্শ দিল। আর তুমিও ভুলো না ড্রাগন লেডি সম্পর্কে কি বলেছি আমি।’

‘কোন কথা দিচ্ছি না,’ মুহূতের জন্যে গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে পড়ল রানার মুখ থেকে। ‘আমার বুড়ি নানী বলত প্রতিজ্ঞা হলো চিনে বাদামের খোসা, ভাঙার জন্যেই।’

‘ওহ্ রানা, তুমি না!’

জঙ্গল থেকে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঝানকে দেখা গেল, একটা মাস্টাঙ জি.টি-তে বসে আছে, হুইলের পিছনে দৈত্যের মত লাগছে তাকে। ধুলোর পাহাড় তুলে ধেয়ে এল গাড়িটা, ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল স্যাবের ঠিক পিছনে। সিরকা উনিশশো ছেষট্টি, বাহনটা চিনতে পারল রানা। সম্ভবত টু-এইট-নাইন ভি-এইট এঞ্জিন।

ঝানের পাশে বসে আছে বান্না বেলাডোনা, চোখমুখে এলোমেলো হয়ে আছে চুল, লালচে মুখ। মাস্টাঙ থেকে মার্জিত এবং সাবলীল ভঙ্গিতে নামল সে, নড়ে ওঠা থেকে শুরু করে নামা পর্যন্ত নৃত্যভঙ্গিমায় কোথাও বিরতি বা ছেদ পড়ল না।

‘সুন্দর গাড়ি!’ নিঃশব্দে হাসল রানা। ‘এটাকে পিছনে ফেলতে ভালই লাগবে আমার, অবশ্য গ্রাঁ প্রি-র আয়োজন যদি আদৌ করা হয়…’

‘আমি আপনাকে আরও জ্যান্ত জিনিস অফার করতে পারি, মি. রানা, ‘ ঘোষণা করল ঝান। ‘কি, আয়োজন করা হবে মানে? আয়োজন তো শেষ! কিসের বিরুদ্ধে জিততে হবে পরে দেখাব আপনাকে। মেহমানদের কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? কে কোন কেবিনে? নাকি একটাই দু’জনে শেয়ার করছেন?’ নিজের রসিকতায় হেসে উঠল, যদিও ইঙ্গিতটায় অশ্লীল কোন ভাব থাকল না।

রিটা ফেটারম্যানে, আমি স্যান্ড ক্রীকে,’ তাড়াতাড়ি বলল রানা, রিটা সত্যি কথা বলে ফেলার আগে ভুল তথ্য সরবরাহ করল। পিয়েরে ল্যাচাসি যদি দুঃসাহসী লম্পট হয়, রাতে হাতড়াবার জন্যে সে বরং রানার কাছেই আসুক।

‘তুমি রেডি তো, রানা?’ এক মুহূর্ত আগেও নাচছিল বান্‌না বেলাডোনার চোখ, রানার মুখের ওপর হঠাৎ তার দৃষ্টি স্থির আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল

‘তুমি কি স্যাবে চড়ার ঝুঁকি নেবে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রানা :

‘যে-কোন ঝুঁকি নেবে ও,’ বলল ঝান, হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে চেহারা। ‘আসুন, মিসেস লুগানিস। আমি আপনাকে দেখাব সত্যিকার ড্রাইভিং কাকে বলে, সেই সাথে ঝানল্যান্ডের চুম্বক অংশগুলো উপভোগ করবেন আপনি।’

স্যাবের তালা খুলল রানা, বেলাডোনাকে প্যাসেঞ্জার সীটে বসাল। ঝানের ঘোষণা অনুসারে, গ্রান্ড ট্যুর শেষ হতে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘণ্টা, তবে সময়টা সংক্ষেপ করে নেবে ওরা। সাড়ে সাতটায় ডিনার। প্রিন্ট আর আপনার সাথে আধ ঘণ্টা একা থাকতে চাই আমি, মি. রানা। ট্র্যাকে মিলিত হব আমরা, এই পৌনে সাতটার দিকে। বাননা আপনাকে পথ দেখাবে। লক্ষ্মী হয়ে থাকবেন, আর যদি লক্ষ্মী হয়ে থাকতে না পারেন…

স্যাবের এঞ্জিন গর্জে উঠল, ঝানের শেষ কথাগুলো শুনতে পেল না রানা। তারপর, হাত নেড়ে, দরজা বন্ধ করল ও। একটু কমল এঞ্জিনের আওয়াজ।

শরীরটা স্থির রেখে রানার দিকে শুধু মুখ ফেরাল বেলাডোনা। ওকে, রানা-চলো, মি. ঝানের গর্বের কারণটা দেখাই তোমাকে।

‘সেটা আমি এখান থেকেই ভাল দেখতে পাচ্ছি,’ মৃদু হাসির সাথে বলল রানা। কোন সন্দেহ নেই চোখ-ধাঁধানো রূপ রয়েছে মেয়েটার, লক্ষ মেয়ের মাঝখান থেকে আলাদাভাবে খুঁজে নেয়া যাবে। তার অবিশ্বাস্য কালো চোখের সাথে রোদপোড়া গায়ের রঙ যেন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

হাসি নয় যেন বীণার সাতটা তার ঝনঝন করে উঠল, তারপর ক্রমশ নেমে এল খাদে। ‘একদম বিশ্বাস কোরো না। র‍্যাঞ্চই তার একমাত্র গর্বের কারণ। আমি তার লোভের কারণ হতে পারি, তার বেশি কিছু না।’ চোখের কালো আগুন পলকের জন্যে জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘গাড়ি ছাড়ো, দেখাই তোমাকে।

রওনা হলো স্যাব, ছোট শহরটার দিকে যাবার রাস্তায় নেমে এল। র‍্যাঞ্চ স্টাফদের ছেলেমেয়েরা ছোট একটা পার্কে ছুটোছুটি করছে, বাড়িগুলোর সামনে পরিচ্ছন্ন লন। বড় একটা দোকানের সামনে আর ভেতরে নারী-পুরুষের ভিড়, উঠানে কাজ করছে মেয়েরা। এত বেশি স্বাভাবিক দৃশ্য, র‍্যাঞ্চের বাকি অংশের সাথে একেবারেই যেন বেমানান, কৃত্রিম বলে মনে হয়।

কারও কারও উদ্দেশে হাত নাড়ল বেলাডোনা। একটা প্যাট্রল কার দেখল রানা, পাশে লেখা রয়েছে ঝান সিকিউরিটি’

‘হাইওয়ে পুলিস?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘সার্টেনলি। মি. ঝান আইন-শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। তাঁর ধারণা এতে করে মানুষ ভুলে থাকবে যে তারা একটা বন্ধ জায়গায় বাস করছে। স্টাফরা বাইরে যাবার কোন সুযোগ প্রায় পায় না বললেই চলে, রানা-তুমি জানো।

রানা কোন মন্তব্য করল না, চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। স্টাফ কোয়ার্টার পিছনে ফেলে পশুচারণ ভূমির কিনারায় চলে এল স্যাব। তারপর বাঁক নিয়ে এয়ারপোর্ট রোড ধরল। রিটা আর রানার ধারণাই ঠিক, কাজ চালাবার জন্যে সাধারণ একটা ল্যান্ডিং স্ট্রিপ নয়, ব্যাপারটা পুরোদস্তুর অপারেশনাল এয়ারপোর্টই।

‘বিশ্বাস করবে, কি নাম রাখা হয়েছে?’ বেলাডোনার কণ্ঠে একটু যেন ব্যঙ্গের রেশ। ‘ঝান ইন্টারন্যাশনাল।’

‘বিশ্বাস করলাম। এরপর কোথায়?’

পথ-নির্দেশ দিল বেলাডোনা, খানিক পরই বনভূমির কিনারা ঘেঁষে ছুটল স্যাব। কনফারেন্স সেন্টারটাকে এই বনভূমিই চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। রানা জানে, তবু প্রশ্নটা করল-কনফারেন্স সেন্টারে অবাঞ্ছিত কাউকে যেতে না দেয়ার ইচ্ছে থেকে বন সৃষ্টি করা হয়েছে কিনা।

‘যেতে না দেয়ার ইচ্ছে, বেরুতে না দেয়ার ইচ্ছে, দুটোই বলতে পারো। কনফারেন্স উপলক্ষে অদ্ভুত সব লোক আসে এখানে, চেঁচামেচি করে তারা। মি. ঝান প্রাইভেসী পছন্দ করে। নিজেই টের পাবে। তোমার সাথে চুক্তি হবার পর, তার সবগুলো খেলনা দেখানো শেষ করে, তুমি জানতেও পারবে না কখন তোমাকে বের করে দিয়েছে।

স্যাবের গতি কমাল রানা, প্রতি মুহূর্তে ঘন সবুজ দুর্ভেদ্য জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছে। ‘ভয় পাবার মত ব্যাপার। জঙ্গলটাকে ঘিরে একটা খাদও রয়েছে দেখতে পাচ্ছি। ভেতরে বাঘ-টাগ নেই তো, কিংবা ড্রাগন?

‘অতটা ভয় পাবার কিছু নেই, তবে হাতে কুড়োল আর দক্ষতা না থাকলে বেশিদূর তুমি যেতেও পারবে না। আধ মাইলটাক ঘন ঝোপ পেরোতে হবে, কাঁটাঝোপ-রীতিমত বিপজ্জনক। তারপর আছে উঁচু বেড়া। আমরা অবশ্য ঢুকতে পারব।’

‘ঢোকার একটা ব্যবস্থা তো রাখতেই হয়েছে, তাই না? স্টাফরা নিশ্চয় তোমাদের লোক। নাকি তাদের আনা-নেয়ার কাজে কপ্টার ব্যবহার করা হয়?’

‘বলো মি. ঝানের লোক,’ রাগ নয়, যেন অনুরোধের সুরে ভুলটা ধরিয়ে দিল বেলাডোনা। ‘না, শুধু কনফারেন্স ডেলিগেটরা হেলিকপ্টারে করে আসে। কিন্তু এখানে…চলো দেখাই তোমাকে। গ্রীন বেল্ট আরও দু’মাইল অনুসরণ করো।’

‘এমন সুন্দর একটা ফরাসী মেয়ে এই স্বপ্নজগতে কি করছে?’ বলল রানা, প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করা।

কয়েক মুহূর্ত কথা বলল না বেলাডোনা। নিজেকে গাল দিল রানা, ধরে নিল সময়ের আগে চাল দেয়া হয়ে গেছে।

‘সে প্রশ্ন তো আমারও,’ বিড়বিড় করে বলল বেলাডোনা, চোখ নামাল। সারাক্ষণ সে কথাই তো ভাবি।’ আবার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল সে, তারপর বলল, ‘নাহ্, থাক-সে অনেক বড় গল্প। এমনি কারও কপাল পোড়ে না, কিছু মারাত্মক ভুলও তার থাকে। লোভ করলে কিছু খেসারত তো দিতেই হয়। গোল্ড-ডিগারদের সম্পর্কে জানো তো, সোনার সাথে তাদের কপালে যার যেমন প্রাপ্য সেটুকু মরুভূমিও জোটে?’

‘আমার তো ধারণা ছিল তাদের ভাগ্যে শুধু হীরে, মিল্ক কোট, লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, লাগজারি ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালেন্স ইত্যাদি…

‘হ্যাঁ, ওগুলোও তারা পায়। কিন্তু তাদের একটা মূল্য দিতে হয়। এখান থেকে—নাক বরাবর সোজা। স্পীড কমাও।’

ধনুকের মত বাঁকা হয়ে রাস্তাটা প্রায় উঁচু কাঁটাতারের বেড়া আর পাঁচিল পর্যন্ত চলে গেছে। অপর দিকে কি আছে জানা আছে রানার-শুকনো মাটি আর বালি, পোড়া ঘাস, সেই অ্যামারিলো পর্যন্ত বিস্তৃত মরুভূমি।

‘থামো এখানে।’

গাড়ি থামাল রানা, বেলাডোনার দেখাদেখি নামল।

হেঁটে রাস্তার কিনারায় চলে গেল বেলাডোনা, দুই হাঁটুর ওপর হাত রেখে ঝুঁকল নিচের দিকে, যেন ভয় পেয়েছে কেউ দেখে ফেলবে। ‘আসলে কাজটা আমি ভাল করছি না, ফাঁস করে দিচ্ছি ব্যাপারটা।’ তার হাসি, যখন মাথা তুলল সে, বর্শার মত বিদ্ধ করল রানার হৃৎপিণ্ডকে। এ তোমার পাগলামি, নিজেকে তিরস্কার করল রানা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বান্না বেলাডোনাকে তুমি চিনতেই না।

মেয়েটা সম্পর্কে সব কিছু জানার প্রচণ্ড কৌতূহল জাগল রানার মনে-তার অতীত, ছেলেবেলা, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব, পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তা আর আদর্শ। জানাটা যেন খুব জরুরী।

মাথার ভেতর থেকে সতর্ক সঙ্কেত পাওয়া গেল, চলতি মুহূর্তের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনল ওকে। বানা বেলাডোনা ঝুঁকে রয়েছে ছোট, গোল একটা ধাতব ঢাকনির দিকে, ডায়ামিটারে প্রায় এক ফুট হবে, দেখে মনে হলো আন্ডারডেনের ঢাকনি হতে পারে। ঢাকনির মাঝখানে একটা রিঙ রয়েছে, সেটা ধরে ঢাকনিটা সহজেই তুলে ফেলল বেলাডোনা, যেন একেবারেই হালকা

‘দেখছ?’ রানাকে আঙটা আকৃতির একটা হাতল দেখাল সে, সদ্য উন্মোচিত ফাঁকটায় কাত হয়ে রয়েছে। ‘এবার লক্ষ করো!’ হাতলটা ধরে টান দিতেই রাস্তার কিনার থেকে বড় একটা পাথর ধীরে ধীরে মাটির তলায় তলিয়ে যেতে শুরু করল, যেন একটা হাইড্রলিক লিফট ওটাকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পাথরটা চারকোনা, লম্বা চওড়ায় পাঁচ ফুটের মত। সারফেস থেকে এক ফুট নেমে যাবার পর দূর থেকে ভেসে আসা হাইড্রলিক গুঞ্জন পরিষ্কার কানে বাজল। এক পাশে সরে গেল পাথরটা, নিচে দেখা গেল চওড়া একটা চেম্বার। নিচে নামার জন্যে ঠিক সিঁড়ি নয়, লোহার ধাপ দেখা গেল কয়েকটা।

‘নামা উচিত হবে না,’ বলল বেলাডোনা। নার্ভাস দেখাল তাকে। ঘন ঘন এদিক ওদিক তাকাল কিছুক্ষণ। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘নিচের চেম্বার থেকে সিঁড়িতে পৌছানো যায়, তারপর টানেল। টানেল থেকে তুমি বেরিয়ে আসবে এক দারোয়ানের ক্লজিটে, একেবারে সেই মেইন বিল্ডিঙে।’ নিচের দিকে তাকাল সে। ‘ওখানে খোলা আর বন্ধ করার ডিভাইস আছে, আর একটা আছে শেষ মাথায়।’

‘আসলে কেন…?

‘মি. ঝানের অনেক জাদুর একটা বলতে পারো,’ বলে চলেছে বেলাডোনা, রানার অসমাপ্ত প্রশ্ন বোধহয় শুনতে পায়নি। ‘খুব কম লোকই এটার কথা জানে। কনফারেন্স সেন্টারে তার স্টাফরা কাজ করে, এই পথেই যাওয়া-আসা করে তারা-ডেলিগেটরা আসার আগের দিন যায়। খাবারদাবার নেয়া হয় হেলিকপ্টারে। এটা আসলে পালানোর জরুরী পথ, যদি কখনও বিপদ দেখা দেয়।’

‘কি ধরনের বিপদ?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

কি যেন বলতে গিয়েও বলল না বেলাডোনা, সামলে নিল নিজেকে। তারপর বলল, ‘তোমাকে তো বলেছি, কনফারেন্সে অদ্ভুত সব লোকজন আসে। মি. ঝান সিকিউরিটি সম্পর্কে সচেতন। ঝোঁকের মাথায় কি করে বসলাম, না? তোমাকে বোধহয় পথটা দেখানো উচিত হলো না। চলো, সরে যাই এখান থেকে।

আবার টান দিয়ে লিভারটা আগের পজিশনে নিয়ে এল বেলাডোনা। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল পাথরটা, তারপর উঠে এল আগের জায়গায়। এরপর হাতের ঢাকনিটা ছোট ফাঁকটায় বসিয়ে দিল সে, পা দিয়ে কিছু ধুলো চাপাল ঢাকনির ওপর।

গাড়িতে বসার পরও উত্তেজিত দেখাল বেলাডোনাকে। ‘এবার কোথায়?’ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল রানা, ভাব দেখাল গোপন পথটা মজার একটা ব্যাপার বলে মনে হয়েছে তার কাছে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।

রিস্ট ওয়াচে চোখ বুলাল বেলাডোনা। ঝানের সাথে দেখা হতে এখনও পৌনে এক ঘণ্টা বাকি রয়েছে। ‘কেবিনের রাস্তাটা ধরো,’ দ্রুত বলল সে। ‘কোথায় বাঁক নিতে হবে দেখিয়ে দেব।

গাছপালা ঢাকা ঢালের দিকে স্যাব তাক করল রানা। খানিক পর নির্দেশ দিল বেলাডোনা, ঢাল বেয়ে উঠে যাওয়া রাস্তা ধরতে নিষেধ করল। ঢালটাকে ঘিরে থাকা অপর রাস্তা দিয়ে বাঁ দিকে চলে এল ওরা, সামনে দ্বিতীয় আরেকটা রাস্তা ঢাল বেয়ে মাথার দিকে উঠে গেছে, গাড়ি বা ট্রাকের জন্যে যথেষ্ট চওড়া।

রাস্তাটা ধরে অর্ধেকের মত দূরত্ব পেরোবার পর জঙ্গলের গায়ে একটা ফাঁকের দিকে হাত তুলল বেলাডোনা। কয়েক মুহূর্ত পর ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গায় চলে এল, উঁচু গাছপালায় ঘেরা আর অন্ধকার।

‘তোমার কাছে সিগারেট হবে?’ রানা ইগনিশনের সুইচ অফ করার পর জিজ্ঞেস করল সে।

গানমেটাল কেসটা বের করল রানা, দু’জনের জন্যেই একটা করে সিগারেট ধরাল। লক্ষ করল, বেলাডোনার আঙুলগুলো কাঁপছে। সিগারেটে লম্বা টান দিল সে, প্রতিবার অনেকক্ষণ ধরে ধোঁয়া ছাড়ল। ‘শোনো, রানা। ঢিল ছোঁড়া হয়ে গেছে এখন আর কিছু করার নেই। মারাত্মক বোকামি করে ফেলেছি আমি। সত্যি দুঃখিত। জানি না কেন করেছি…কিন্তু, প্লীজ! মি. ঝান যেন কিছু না জানে!’

‘কি বলছ!’

‘উনি যদি জানেন আমি তোমাকে কনফারেন্স সেন্টারের গোপন পথ…আমার বিপদ হবে, রানা!’ নিজের প্রতি ক্ষোভে মাথা নাড়ল বেলাডোনা। ‘কি ভূত যে চাপল মাথায়! কেন যে দেখাতে গেলাম! তুমি তো জানো না, এ-সব ব্যাপারে উনি ভীষণ স্পর্শকাতর। আমার আসলে হুঁশ-জ্ঞান ছিল না…নতুন একজন মানুষ, যার ব্যবহার সুন্দর…প্রায় সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। বুঝতে পারছ কি বলছি?’ তার আঙুলগুলো নড়ে উঠে প্রতিবেশীর আঙুলগুলোকে খুঁজে নিল, দু’হাতের পাঁচটা করে দশটা আঙুল এক হলো, মৃদু চাপ অনুভব করল রানা।

‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি বলে মনে হয়।’ বেলাডোনার স্পর্শ ছোট্ট বৈদ্যুতিক ঝাঁকির মত লাগল রানার।

হঠাৎ করে হেসে উঠল বেলাডোনা। ‘ওহ্ ডিয়ার, আমি মোটেও বুদ্ধিমতী নই! আগে মনে পড়েনি! এই যে, মশাই, তুমি জানো কি, ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারতাম?’

‘ব্ল্যাকমেইল করতে পারতে?’ উদ্বিগ্ন রানা আকাশ থেকে পড়ল, ছ্যাৎ করে উঠল বুকের ভেতরটা।

দু’জনের একটা করে হাত এক হয়ে আছে, দুটোই ওপর দিকে তুলল বেলাডোনা, জোরে চাপ দিল রানার হাতে। ‘ভয় পেয়ো না। প্লীজ। তুমি ঝানকে বলবে না আমি তার কনফারেন্স সেন্টারের গোপনীয়তা ফাঁস করে দিয়েছি, আর আমি বলব না যে তুমি একটা…আরে-ধ্যেৎ, কি যেন বলে? ভুয়া ব্যবসায়ী? আত্মবিশ্বাসী প্রতারক? না, আরও কি যেন একটা স্ল্যাং নেম আছে, এদিকে খুব চল…’

‘আ ফ্লিম-ফ্যাম ম্যান?’ সাহায্য করল রানা।

‘দ্যাট’স গুড!’ আবার বীণানিন্দিত হাসি দিল বেলাডোনা। ‘চমৎকার বর্ণনা করেছ-ফ্লিম-ফ্যাম।’

‘বেলাডোনা, আমি ঠিক….

‘রানা,’ মুক্ত হাতের একটা আঙুল তুলে নাড়ল বেলাডোনা। ‘তুমি আমার মুঠোয় চলে এসেছ, মাই ডিয়ার! এবং ঈশ্বর জানেন, ভাল একজন মানুষ আমার হাতে থাকা দরকার।

‘এখনও আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি…

ঠোটে একটা আঙুল রেখে রানাকে চুপ করিয়ে দিল বেলাডোনা। ‘শোনো। ঝান অত্যন্ত ক্ষমতাবান লোক। বহু কিছু সম্পর্কে এক্সপার্ট সে। গাড়ি আর ঘোড়া সম্পর্কে জানে, আইসক্রীম সম্পর্কে তো জানেই। বলা যায় একমাত্র আইসক্রীম সম্পর্কেই সম্ভাব্য যা কিছু জানার আছে সব জানে সে। কিন্তু প্রিন্টস সম্পর্কে? ক্যাটালগ, বই এ-সবই আছে, কোন্‌টা পছন্দ করার মত বুঝতে পারে, কিন্তু এ- ব্যাপারে তাকে এক্সপার্ট বলা যাবে না। কিন্তু আমি…হ্যাঁ, আমাকে এক্সপার্ট বলা যাবে। প্যারিসে থাকতে আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলাম, বারো বছর বয়স থেকে। কিন্তু আমি আর্টসের ছাত্রীও ছিলাম। আর জানো কি, আমার প্রিয় বিষয় ছিল প্রিন্টস? তোমার কাছে এক সেট অপ্রকাশিত হোগার্থ আছে। ইউনিক, আমাকে বলেছে ঝান। সাত রাজার ধন।’

‘হ্যাঁ। এবং অথেনটিকেটেড। তবে ওগুলো বিক্রির জন্যে কিনা এখনও তা বলিনি আমি, বেলাডোনা।

চোখে বুদ্ধির ঝিলিক নিয়ে হাসল বেলাডোনা। ‘না, বলোনি। কিন্তু ভেবো না অতি পুরাতন কৌশলটা আমার জানা নেই, রানা। দেব দেব করছ কিন্তু দিচ্ছ না, কেমন? আগ্রহ আরও বাড়াতে চাইছ, ঠিক না? শোনো।’ রানার হাতটা নিজের কোলের ওপর নিয়ে এল সে, চেপে ধরল দুই ঊরু দিয়ে। আচরণটা এত স্বাভাবিক, যেন কি করছে সে-সম্পর্কে কোন খেয়াল নেই তার। কিন্তু রানার অবস্থা কাহিল, শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। ‘শোনো, রানা। তুমি ভাল করেই জানো যে নতুন, অপ্রকাশিত হোগার্থ প্রিন্ট বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। তুমি জানো, আমিও জানি। তোমার সাথে যেগুলো রয়েছে, অত্যন্ত ভাল হাতে তৈরি জাল প্রিন্টস্। এতই নিখুঁতভাবে জাল করা হয়েছে যে আমার কোন সন্দেহ নেই ভাবী বংশধরেরা ওগুলোকেই আসল বলে বিশ্বাস করবে। এগুলো আসল হোগার্থ হয়ে উঠবে। বাজারে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় আমার জানা আছে। জাল একটা শিল্পকর্ম, ঠিকমত ব্যবস্থা করা গেলে, সত্যি সত্যি আসল জিনিস হয়ে ওঠে t যেভাবেই হোক কিছু লোককে তুমি এরইমধ্যে বিশ্বাস করাতে পেরেছ ওগুলো আসল, বলছ অথেনটিকেশন আছে…জানি না সেটাও জাল কিনা…’

‘না।’ রানা জানে বেআইনী কিছু স্বীকার করা উচিত হবে না। তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কিভাবে যে ওগুলো নকল? মাত্র কয়েক সেকেন্ড চোখ বুলিয়েছ…’

কাছে সরে এল বেলাডোনা, রানার কাঁধে কাঁধ ঠেকাল, মাথা এতটাই ঝুঁকে আছে যে রানা তার চুলের গন্ধ পাচ্ছে। ‘আমি জানি ওগুলো জাল, কারণ যে লোক জাল করেছে তাকে আমি চিনি। সত্যি কথা বলতে কি, প্রিন্টগুলো আগেও আমি দেখেছি। লোকটা ইংরেজ, নাম-অনেকগুলো নাম তার-মিলার, মিলহাউস, কখনও বা মিলটন, তাই না?’

এরপর বেলাডোনা লোকটার চেহারার যে বর্ণনা দিল, শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ল রানা। ছোটখাট, রোগা-পাতলা এই লোকই তো কেনসিংটনের সেফ হাউসে প্রিন্টস সম্পর্কে রিটা আর ওকে জ্ঞান দান করেছিল!

সর্বনাশ, সব ভেস্তে গেছে! সি.আই.এ. চীফের আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। সেই সাথে আরেকটা কথা ভাবল রানা। সি.আই.এ. চীফ হয়তো জেনেশুনেই ছোটখাট লোকটাকে কাজে লাগিয়েছেন, তার সাহায্যে বা মাধ্যমে তিনি হয়তো হার্মিসের পিছনে লোক লাগাতে পারবেন, রানা যদি কোন যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়। ‘এবার আমাকে বলতে দাও,’ খুকু করে কেশে গলা পরিষ্কার করল রানা। ‘তুমি ঠিক বলছ কি ভুল বলছ জানি না, তবে আমার কাছে আনকোরা নতুন খবর বলে মনে হলো।’ বেলাডোনাকে ধোঁকায় ফেলার চেষ্টা।

মনে হলো বেলাডোনাও স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। ‘রানা। কাউকে আমি কিছু বলতে যাচ্ছি না। তুমি শুধু, প্লীজ, টানেলের ব্যাপারে মুখ খুলো না। তোমাকে ওটা আমার দেখানো উচিত হয়নি, এবং… ওহ্, রানা! মাঝে মধ্যে ঝানকে আমি যমের মত ভয় করি…।’ রানার হাত ছেড়ে দিল সে, মুখের দিকে মুখ তুলল। দু’জোড়া ঠোঁট এক হলো।

ঠোঁট দু’জোড়া এক হতে, মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো, দূর থেকে ভেসে আসা রিটার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে ও, ‘এই বলে রাখলাম, ঝানের বান্ধবী জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে তোমাকে।’

কিন্তু সতর্ক হওয়া তো দূরের কথা, মাসুদ রানা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে মোহময়ী বান্‌না বেলাডোনা যদি ওকে সত্যি কাঁচা চিবিয়ে খেতে চায় তো সানন্দে রাজি হবে সে। সুন্দরী নারীর সান্নিধ্য খুব কম পায়নি রানা, কিন্তু এত আবেগ নিয়ে কেউ ওকে চুমো খেয়েছে কিনা মনে করতে পারল না। আদরের কোমল, মৃদু স্পর্শ দিয়ে শুরু হলো; এক হলো দু’জোড়া ঠোঁট, তারপর সড়সড়, কিলবিল একটা অনুভূতি; দুটো মুখ একসাথে খুলে গেল। পরস্পরের জিভের ডগা এক হলো, তারপর পিছিয়ে এল, আবার এক হলো—দুটো প্রাণী পরস্পরকে যেন আবিষ্কার করছে। এক সময় দুটো মুখ আর দুটো থাকল না, একটা হয়ে উঠল, হারিয়ে ফেলল আলাদা পরিচয়।

নিজের অজ্ঞাতেই বেলাডোনার শরীরের দিকে হাত বাড়াল রানা, কিন্তু ওর কব্জি চেপে ধরল বেলাডোনা, দূরে সরিয়ে রাখল ওকে। রুদ্ধশ্বাসে আবার চুমো খেলো ওরা।

‘রানা,’ ফিসফিস করে বলল বেলাডোনা। ‘আমার ধারণা ছিল চুমো যে একটা আর্ট পুরুষরা তা ভুলে গেছে।’

‘না, অন্তত একজন ভোলেনি—এই মুহূর্তে টেক্সাস র‍্যাঞ্চের মাঝখানে একটা স্যাব গাড়িতে বাস করছে সে।’

রিস্টওয়াচে চোখ বুলাল বেলাডোনা। ‘আরে, সময় হয়ে এসেছে, দেখছ! রানার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল সে। ‘তোমাকে…একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’ উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে বাইরে তাকাল সে। তুমি আর মিসেস লুগানিস… রিটা…?’

‘বলো?’

‘তোমরা কি…মানে, তোমাদের মধ্যে কি…?’

‘আমার লাভার কিনা?’ প্রশ্নটা ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রানা।

‘হ্যাঁ…?’’

‘না। প্রশ্নই ওঠে না। রিটার স্বামী আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার সাথে ওকে একা ছেড়ে দিয়েছে দেখে বুঝতে পারছ না আমাকে কতটুকু বিশ্বাস করে সে? কিন্তু, বান্না, এর কোন মানে হয় না, স্রেফ পাগলামি। তুমি ঝানের বান্ধবী, তাই না? আমার কোন অধিকার নেই…ঝান জানতে পারলে…’

তোমাকে খুন করবে। ঠাণ্ডা এবং শান্ত বেলাডোনা। কিংবা তুমি ওকে খুন করবে। তবে এই ব্যাপারটা জানাজানি না হলেও সে হয়তো তোমাকে শেষ পর্যন্ত খুন করবে, রানা। আগেই ভেবে রেখেছিলাম, যাই ঘটুক না কেন, তোমাকে আমি সাবধান করে দেব। এখন সেই কাজটাই করছি, কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে-কারণ যে- কোন কিছুর বিনিময়ে তোমাকে এখানে চিরকালের জন্যে ধরে রাখতে পারলে আমার জীবন সার্থক হবে। কিন্তু তোমাকে রাখতে চাওয়া মানে খুন হতে বলা। তারচেয়ে আমি চাইব আমার জীবন থেকে সরে যাও সে-ও ভাল কিন্তু বেঁচে থাকো। ডার্লিং রানা, আমার পরামর্শ হালকাভাবে নিয়ো না, প্লীজ। যাও, রানা। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। ঝানের কাছ থেকে যতটুকু পারো নিয়ে আজ রাতেই পালাও তুমি, রানা। আজ রাতেই, প্রথম সুযোগেই। এই জায়গা শয়তানদের আস্তানা। তোমার যত ভালমানুষদের জন্যে নয়। তুমি ভাবতেও পারবে না কি অশুভ…,’ থেমে গেল বেলাডোনা, চেহারায় সতর্ক ভাব।

‘অশুভ?’

‘তোমাকে সে-কথা বলতে পারব না। আসলে, খুব একটা বেশি জানিও না, তবে যতটুকু জানি, মনে করলে গায়ে কাঁটা দেয়। ঝানকে তুমি চেনো না, রানা। দেখে মনে হয় ধনী, হাসিখুশি, উদার ভদ্রলোক। কিন্তু লোকটা একটা হিংস্র পশু, রানা। ধারাল নখ আর থাবা আছে। সেই থাবায় কতটুকু ক্ষমতা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তার ক্ষমতা র‍্যাঞ্চ ছাড়িয়ে আরও বহুদূর বিস্তৃত। টেক্সাস, আমেরিকা ছাড়িয়ে…’

‘তুমি কি বলতে চাইছ সে এক ধরনের ক্রিমিন্যাল?’

‘আরও জটিল, রানা, আরও জটিল!’ দ্রুত, ঘন ঘন মাথা নাড়ল বেলাডোনা। ‘সে আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না! আচ্ছা, আমি কি তোমার কাছে…মানে, আসতে পারি, আজ রাতে? না, আজ রাতে সম্ভব নয়। সুযোগ হবে না। কাল রাতে, রানা? অবশ্য আমার পরামর্শ যদি মানো তাহলে আজ রাতেই তুমি চলে যাবে। কিন্তু যদি না যাও, কাল রাতেও যদি থাকো, তোমার কাছে যেতে পারব আমি?’

‘প্লীজ!’ আনন্দ প্রকাশের জন্যে আর কোন শব্দ খুঁজে পেল না রানা। বেলাডোনাকে ওর মনে হলো কোন পাহাড়চূড়ার কিনারায় শুয়ে আছে, নিজের ভেতর নিজেকে আড়াল করে।

‘এবার আমাদের ফেরা দরকার। দেরি করলেও ঝান হাসবে, কিন্তু পরে নরকযন্ত্রণায় ভুগতে হবে আমাকে…’

‘কেন! তোমার ওপর সে জোর খাটায় কিভাবে?’ রাগে চোখ জ্বলে উঠল রানার। ‘সম্পর্কটা বন্ধুত্বের, তাই না? ইচ্ছে করলে তুমি তাকে এড়িয়ে যেতে পারো না?’

‘না, রানা, পারি না!’ বিষণ্ণ হেসে বলল বেলাডোনা। ‘সব কথা তোমাকে যদি খুলে বলতে পারতাম! শুধু এটুকু বলি, আমি খুব বিপদে আছি। ঈশ্বর জানেন, এই বিপদ থেকে কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে কিনা। বন্ধুত্ব, রানা? তুমি জানো, হারামজাদা বুড়োটা আমাকে বিয়ে করতে চায়? যদি বলি, সব মিথ্যে, ঝান আমাকে এখানে বন্দী করে রেখেছে? থাক, রানা, তোমার এ-সব শুনে কাজ নেই আমার বিপদ আমারই থাক, তোমাকে জড়াতে চাই না। এবার চলো…’

ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছোট্ট আয়নায় নিজের চেহারা দেখল বেলাডোনা, ঠোঁট মেরামত করল। ফেরার পথে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা, ‘তোমার কি ভূমিকা সেটা ব্যাখ্যা করতে পারো না? সংক্ষেপে?’

পথ-নির্দেশ দেয়ার ফাঁকে দ্রুত কথা বলে গেল বান্‌না বেলাডোনা। সি.আই.এ-র ফাইলে তার সম্পর্কে যতটুকু আছে সব মিলে যায়। তার ছেলেবেলা কেটেছে প্যারিসে, একটা এতিমখানায়। মা-বাবার পরিচয় জানা নেই। অজ্ঞাতপরিচয় এক লোক তার নামে এতিমখানায় টাকা পাঠাত। পড়াশোনার জন্যে আমেরিকায় চলে আসে আঠারো বছর বয়সে। কয়েক বছর পর এক ফরাসী উকিল তাকে চিঠি লিখে জানায়, তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় মারা গেছেন, বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি আর নগদ টাকা রেখে গেছেন তিনি, সমস্তটাই বান্‌না বেলাডোনার নামে উইল করা। উইলের শর্ত ছিল, হার্মিস নামে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে বেলাডোনাকে। প্রতিষ্ঠানটাকে গড়ে তোলার কাজে নির্দিষ্ট কিছু লোক তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেবে, তাদেরকে কিভাবে চেনা যাবে তারও সঙ্কেত দেয়া ছিল উইলে।

সম্পত্তি পাবার কিছুদিন পর ঝান তার সাথে দেখা করতে এল। সাথে আরও কয়েকজন লোক। তারা বলল, ওর নেতৃত্বে হার্মিসকে তারা বিরাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। বেলাডোনা রাজি হলো। নগদ টাকা ওদের হাতে তুলে দিল সে, সম্পত্তিও কিছু বিক্রি করা হলো। হার্মিসকে গড়ে তোলার কাজ ওরাই শুরু করল, মাঝে মধ্যে শুধু তার সাথে আলোচনা করত। কিন্তু তারপরই ওদের চেহারা বদলাতে শুরু করল। ইতিমধ্যে বেলাডোনা টের পেয়ে গেছে, লোকগুলোর উদ্দেশ্য ভাল নয়। হার্মিসের নামে তারা আসলে একটা ক্রাইম সিন্ডিকেট গড়ে তুলছে। প্রতিবাদ করল সে, কিন্তু তার কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ল সবাই। তারপর একে একে ঝান সহ তার সঙ্গী-সাথীরা বিয়ে করার প্রস্তাব দিল তাকে। বেলাডোনা সিদ্ধান্ত নিল, আইনের আশ্রয় নেবে সে। কিন্তু সুযোগ হলো না, তার আগেই কিডন্যাপ করা হলো। সেই থেকে এই ঝান র‍্যাঞ্চে বন্দী হয়ে আছে সে।

পালাবার কথা সব সময়ই চিন্তা করে বেলাডোনা। কিন্তু আবার এ-কথাও ভাবে, পালিয়ে লাভ কি? পুলিসের সাহায্য পাওয়া অত সহজ নয়, তাছাড়া আইনের সাহায্যে ঝানের মত লোকদের শায়েস্তা করা যায় না। মাঝখান থেকে প্রাণটা হারাতে হবে তাকে। পালিয়ে হয়তো যাওয়া সম্ভব, কিন্তু পালিয়ে থাকা অসম্ভব। ঝান ঠিকই তাকে খুঁজে বের করবে।

‘বিয়ের ব্যাপারে এখনও সে তোমাকে…?’

‘সে বলছে, দরকার হলে সারাজীবন ধৈর্য ধরবে। এই একটা ব্যাপারে সে জোর খাটাতে চায় না। তাকে নাকি আমার ভালবাসতে হবে। আমি নিজে থেকে বিয়েতে রাজি হলে তবেই সে বিয়ের আয়োজন করবে..’

‘আর কে…?’

‘বলো কে নয়? ল্যাচাসি একজন, আরেকজন…এ-সব জেনে কি লাভ তোমার, রানা? বাদ দাও। এই, ডান দিকে, ডান দিকে ঘোরো…!

‘আচ্ছা…,’ শুরু করল রানা।

‘আমাকে আর কথা বলিয়ো না, প্লীজ, রানা। ঝান টের পেয়ে যাবে আমি উত্তেজিত হয়ে আছি। সাবধান, সে যেন কোন আভাস’না পায়।

‘শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও,’ অনুরোধ করল রানা। ‘ঝান আর ল্যাচাসির মধ্যে কার ক্ষমতা বেশি? আরেকটা প্রশ্ন-সও মং নামটা আগে কখনও শুনেছ?’

‘সও মং মানে? এটা আবার কি নাম হলো?’

‘বার্মীজ নাম, শুনেছ?’

মাথা নাড়ল বেলাডোনা। ‘না। কেন বলো তো?’

‘শুনেছিলাম এই নামের একটা লোক নাকি থাকে এখানে, যারুগে। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল…’

‘ক্ষমতা কার বেশি বলা মুশকিল, রানা,’ খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল বেলাডোনা। ‘ওদের সম্পর্কটাও জটিল…দু’জনেই একটা সীমা পর্যন্ত হোমো বলে, সন্দেহ হয় আমার। মাঝে মধ্যে মনে হয় ল্যাচাসির পরামর্শ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ঝান, অথচ বেশিরভাগ সময় দেখি নেপথ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখে ল্যাচাসি। ওরা তো আর আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলে না, কাজেই ঠিক বলতে পারব না। প্লীজ, রানা, এবার আমাকে দম নিতে দাও!’

ছোট একটা রাস্তা ধরে এগোল স্যাব, টারাকে ঘিরে থাকা মসৃণ লনের কাছাকাছি পৌছে গেল ওরা। তারপর গাছপালার উঁচু আর চওড়া একটা বেষ্টনী ভেদ করল গাড়ি। বোঝা গেল ঢালের মাথা থেকে রানা আর রিটা রেসিং সার্কিটটাকে কেন দেখতে পায়নি।

গাছগুলো সব কিছু আড়াল করে রেখেছে। গোটা র‍্যাঞ্চ লে-আউটের এইটাই সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি কাঠামো বা রাস্তা সবুজ বনজঙ্গল দিয়ে ঘেরা। বৃত্তাকার বিশাল রেস ট্র্যাকটাও তাই। বেশ চওড়া ট্র্যাক, পাশাপাশি তিনচারটে গাড়ি দাঁড়াতে পারবে। বাড়ির কাছাকাছি বাঁকগুলো তেমন জটিল বা তীক্ষ্ণ নয়, কিন্তু দূর প্রান্তের দিকে যেতে মাঝামাঝি জায়গায় ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়া হয়েছে—কোণটা বিপজ্জনক, ব্যারিয়ার থাকায় এত সরু হয়ে আছে রাস্তা যে কোন রকমে শুধু একটা গাড়ির জায়গা হবে। প্রতিযোগীদের ভাষায় এ-ধরনের বাঁককে শিকেইন বলে। তারপরই ডান দিকে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক। পরবর্তী বাঁকটা, এবড়োখেবড়ো বৃত্তের শেষ প্রান্তে, দেখতে অনেকটা ইংরেজী ‘জেড’ অক্ষরের মত।

গোটা বৃত্তটা আট মাইল হবে। কোথায় কি সুবিধে-অসুবিধে, বিপদের মাত্রা ইত্যাদি দেখে রাখল রানা।

শেষ প্রান্তে উঁচু একটা কাঠের মাচা মত রয়েছে, অদূরে খাদ আর গর্ভ মাচার নিচে এইমাত্র পৌচাচ্ছে লাল মাস্টাঙ, ঝান আর রিটাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে তৈরি হয়ে রয়েছে কঙ্কালসার পিয়েরে ল্যাচাসি।

সার্কিটের পাশের রাস্তা ধরে এল স্যাব। কাছাকাছি আসার পর ঝান আর রিটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল ওরা, স্যাবের মতই রূপালি একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এই মুহূর্তে হুইলে বসে রয়েছে পিয়েরে ল্যাচাসি

‘খুব সাবধান, রানা,’ শান্ত গলায় বলল বেলাডোনা, ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। হুইলের পিছনে ল্যাচাসি বিপজ্জনক লোক। এক্সপার্ট তো বটেই, নিজের হাতের মত এই ট্র্যাকটা তার চেনা। সবচেয়ে খারাপ কি জানো, অ্যাক্সিডেন্টের পর ভয় বলে কোন অনুভূতি নেই ওরনা নিজের জন্যে, না আর কারও জন্যে।’

‘আমি নিজেও খুব খারাপ নই,’ ঝান আর ল্যাচাসির ওপর রাগটা ছোট ছোট বিস্ফোরণের আকারে গলার গভীর থেকে উঠে এল। ‘ওরা যদি এই রেসে ছল চাতুরীর আশ্রয় নেয়, পিয়েরে ল্যাচাসিকে দু’একটা সবক শেখাতে বাধ্য হব আমি, বিশেষ করে, আমার সাথে প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা যদি থাকে তার। আমি শুধু আমার সমতুল্য কারও সাথে…’ থেমে গেল রানা, দলটার কাছে চলে এসেছে ওরা, রূপালি গাড়িটাকে চেনা যাচ্ছে। ব্রেক করে গাড়ি থামাল ও, দরজা খুলল, স্যাবের সামনে দিয়ে ঘুরে চলে এল বেলাডোনাকে নামতে সাহায্য করার জন্যে। ওর পিছনে এসে দাঁড়াল মলিয়ের ঝান, মৃদু চাপড় মারল পিঠে, খল খল করে হাসছে।

‘কেমন এনজয় করলেন? চমৎকার না? এবার বুঝতে পেরেছেন তো ঝান র‍্যাঞ্চ নিয়ে কেন আমার এত গর্ব?

‘সত্যি, দারুণ একটা জায়গা।’ হাসিমুখে রিটার দিকে তাকাল রানা। ‘তাই না, রিটা? মন ভরিয়ে দেয় না?’

‘কাছেও টানে,’ জবাব দিল রিটা। তার গলার স্বরে কাঠিন্যের রেশ রানা শুধু একা টের পেল। ও একাই দেখল বান্‌না বেলাডোনার দিকে মাঝে মধ্যেই ছুরির মত ধারাল চোখে তাকাচ্ছে রিটা।

‘কাল,’ প্রায় হাঁক ছেড়ে বলল মলিয়ের ঝান, চোখের কোণ দিয়ে ঘনঘন বার কয়েক তাকাল পার্ক করা রূপালি গাড়িটার দিকে। ‘আপনার কি মনে হয়, আপনারা সমান যোগ্য, মি. রানা? কাল ল্যাচাসি আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। কাল সকালে হলেই ভাল, আমার ধারণা। কারও কিছু বলার আছে?’

পিয়েরে ল্যাচাসির দিকে তাকাল রানা, শেলবি-আমেরিকান জি-টি থ্রী- হানড্রেড-ফিফটিতে বসে আছে। ষাট দশকের শেষ দিকে হাই-পারফরম্যান্স কমপিটিশন কার হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ওটা। বডি আগের চেয়ে আরও হালকা করা হয়েছে, টু-হানডেড-এইটিনাইন ভি-এইট এঞ্জিন।

রানার দৃষ্টি লক্ষ করে মাথা নাড়ল ঝান। ‘চেহারা দেখে ওটার বিচার করবেন না, মি. রানা। বিশ বছরের পুরানো গাড়ি, কিন্তু গাড়ি বটে একখানা! এই ট্র্যাকে সব গাড়িকে ওটা দাবড়ে বেড়াবে, হোক না আপনারটা টারবো। আপনি রাজি তো, মি. রানা?’ রানার দিকে একটা হাত লম্বা করে দিল সে।

হাতটা ধরল রানা। ‘অবশ্যই। দারুণ মজা হবে।’

ঘাড় ফেরাল ঝান, হাঁক ছেড়ে ল্যাচাসিকে বলল, ‘কাল, পিয়েরে। রোদ তেতে ওঠার আগে, এই ধরো সকাল দশটার দিকে। এইট ল্যাপস, ঠিক আছে, মি. রানা?’

‘টেন ইফ ইউ লাইক।’ যদি দর্শনীয় ড্রাইভিং দেখারই শখ চেপে থাকে রানা ওদের হতাশ করবে না।

‘গুড। ছেলে-ছোকরাদের কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানাব। ভাল একটা রেস দেখার সুযোগ পেলে ধন্য হয়ে যাবে ওরা।’ তারপর, হঠাৎ করে গলার স্বর বদলে বান্না বেলাডোনার দিকে তাকাল ঝান। ‘চলো, তাহলে ফেরা যাক। রাতে আমার দু’একটা কাজ আছে, তাছাড়া ডিনারের আগে মি. রানার সাথেও কথা হওয়া দরকার। আমার ধারণা, ভদ্রমহিলারাও বোধহয় একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে চাইবেন।’

রানাকে মৃদু, মিষ্টি হাসি উপহার দিল বেলাডোনা। ‘আমাকে গাইড হিসেবে বেছে নেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, মি. রানা। সময়ের অভাবে ঝান র‍্যাঞ্চের আরও কিছু জাদু আপনাকে দেখানো হলো না, সেজন্যে আমি সত্যি দুঃখিত।’

‘মাই প্লেজার।’ রিটার জন্যে স্যাবের দরজা খুলে দিল রানা, রিটাও ধন্যবাদ জানাল মলিয়ের ঝানকে। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল রানা। বেলাডোনার কাঁধে হাত রাখল মলিয়ের ঝান, রানার যেন মনে হলো ব্যথা পেয়ে কেঁপে গেল বেলাডোনার শরীর।

‘গাইড হিসেবে আমাকে বেছে নেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, মি. রানা!’ বিকৃত গলায় ভেঙচাল রিটা। ‘মাই প্লেজার, বান্‌না, মাই প্লেজার! তুমি একটা কেঁচো, রানা।’

‘তার পরীক্ষা পরে নিয়ো,’ হাসিমুখে বলল রানা। ‘কিন্তু কি জেনেছি শোনো আগে। যাকে তুমি পছন্দ করছ না, সেই বান্‌না বেলাডোনাই সম্ভবত এখানে আমাদের একমাত্র বন্ধু। কনফারেন্স সেন্টারে ঢোকা এখন আর কোন সমস্যা নয়। একটা রাস্তা দেখে এসেছি, ওখানে পরে যাব। আজ রাতে আমরা ল্যাবরেটরি আর পিছনের বিল্ডিঙে যেতে চাই। ঝানের সঙ্গ কেমন লাগল তোমার?’

জবাব দিল না রিটা। রানার মুখ থেকে খবরগুলো শুনে এক, দুই, তিন, এভাবে গুনতে শুরু করেছে সে। …একশো….’ শেষ করল গোনা। যদি সত্যি কথা জানতে চাও, রানা, ওদের একজনকেও আমি বিশ্বাস করব না। আর ঝানের কথা যদি বলো, রাক্ষসী বেলাডোনাকে সে বিয়ে করতে চায় এটা জানা না থাকলে আমি ধরে নিতাম লোকটা সমকামী।’

‘প্রথম ঢিলেই পাখি পড়েছে,’ বলল রানা। টারার গাড়ি-পথে পৌঁছে গেল স্যাব। .

বসে আছে রানা, হাতে ভোদকা মার্টিনি, বারান্দায় মলিয়ের ঝানের মুখোমুখি হয়েছে ও। পিছনে, মাথার ওপর ঝুলে রয়েছে পিয়েরে ল্যাচাসি।

‘এ আপনি ঠিক বলছেন না, মি. রানা!’ আপাতত হাস্যরসিকের ভূমিকা থেকে সরে এসেছে মলিয়ের ঝান। প্রিন্টগুলো হয় বিক্রির জন্যে, নয়তো বিক্রির জন্যে নয়। হ্যাঁ বা না, একটা কিছু পরিষ্কার শুনতে চাই আমি। দু’জন কেউ কাউকে বাজিয়ে দেখতে ছাড়িনি, কিন্তু এখন আমি আপনাকে নির্দিষ্ট একটা প্রস্তাব দিতে চাই।’

ছোট্ট একটা চুমুক দিল রানা, সাইড টেবিলে আস্তে করে রাখল গ্লাসটা, তারপর আবার একটা সিগারেট ধরাল। ‘ঠিক আছে, মি. ঝান। আপনি যেমন ফলছেন, বাজিয়ে দেখা শেষ। কঠিন সব নির্দেশ দিয়ে পাঠানো হয়েছে আমাকে। বলছি তাহলে। হ্যাঁ, প্রিন্টগুলো বিক্রির জন্যেই।’

সশব্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ঝান।

‘…ওগুলো বিক্রি করা হবে নিলামে, নিলাম অনুষ্ঠিত হবে নিউ ইয়র্কে, আজ থেকে এক হপ্তার ভেতর।‘

‘নিলামে অংশগ্রহণ করার কোন ইচ্ছে আমার নেই…,’ শুরু করল ঝান, একটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল রানা।

‘সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত ওই নিলাম নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হবে, এক হপ্তার ভেতর, যদি না তার আগে নির্দিষ্ট একটা মূল্যের প্রস্তাব আমি পাই। পুরো সেটের একটা মূল্য আগেই স্থির করা হয়েছে, কিন্তু সেটা গোপন একটা তথ্য। ফাঁস করার অধিকার আমি রাখি না।’

‘বেশ…,’ ঢোক গিলল ঝান, ‘আমি আপনাকে অফার করছি…’

‘থামুন,’ তাকে থামিয়ে দিল রানা। ‘আপনাকে আমার সাবধান করে দেয়া দরকার। যিনি প্রথম অফার দেবেন, নিলামের বাইরে, তিনি শুধু একবারই অফার দিতে পারবেন। তারমানে হলো, মি. ঝান, আপনার এখনকার অফার যদি স্থির করা গোপন মূল্যের চেয়ে কম হয়, পরে আর আপনি নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অন্য ভাষায়, আপনাকে ভেবেচিন্তে সাবধানে অফার দিতে হবে।’

এই প্রথম, রানার মনে হলো, মলিয়েরের চেহারায় অশুভ একটা ভাব ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। ‘মি. রানা,’ বলল সে, ‘আপনাকে দুটো প্রশ্ন করতে পারি?

‘করতে পারেন। উত্তর দেয়ার হলে দেব।’

চেহারা দেখে মনে হলো, না-ঘাবড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছে ঝান। ‘ঠিক আছে। প্রথমটা সহজ। প্রতিটি মানুষেরই, আমার অভিজ্ঞতা বলে, একটা দাম আছে। আমি ধরে নিতে পারি আপনার ভেতরও অপরাধপ্রবণতা আছে?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘না, অন্তত এই ব্যাপারটায়, কেউ আমাকে ঘুষ দিতে পারবে না। আশপাশে মিসেস লুগানিস রয়েছেন। তাছাড়া, একটা লিগ্যাল অবলিগেশনে আমার হাত-পা বাঁধা। আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন?’

‘স্থির করা মূল্যটা কি সত্যিকার দামের ওপর ভিত্তি করে…?’

‘সত্যিকার দাম বলে কিছু নেই। প্রিন্টগুলো আসল। তবে, আপনাকে ভরসা দেয়ার জন্যে বলতে পারি, মিনিমাম আর ম্যাক্সিমাম-এর মাঝামাঝি একটা মূল্য স্থির করা হয়েছে। নিলামে সবচেয়ে কম কি দাম বা সবচেয়ে বেশি কি দাম উঠতে পারে সেটা আন্দাজ করে…কাজটা কমপিউটর করেছে, আর কমপিউটরের কাজ আমি ভাল বুঝি না।’

চারদিক থেকে ডাক ছাড়ছে ঝিঁ-ঝি পোকারা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে দূর আকাশে উঁকি দিচ্ছে আধখানা চাঁদ। নিস্তব্ধতার মাঝখানে মলিয়ের ঝানের কাশি শুনতে পেল রানা।

‘ঠিক আছে, মি. রানা। ঢিল ছোঁড়ার ঝুঁকি আমি নেব। এক মিলিয়ন ডলার।’

ঝানকে নিয়ে আসলে মজা করছিল রানা, কোন অঙ্কের কথা ভাবেনি। কথা বলার সময় মনে মনে হাসল ও। টার্গেটে পৌঁচেছেন, মি. ঝান। ওগুলো আপনার। এখন কি করতে বলেন আমাকে? প্রফেসরকে ফোন করব? হাত মেলাব

আমরা, কিংবা আর কিছু…?’

‘উফ, কি কষ্টটাই না দিয়েছেন আপনি আমাকে, মাই ফ্রেন্ড! না, এখুনি কাউকে, কিছু জানাবার দরকার নেই। ব্যাপারটা আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যাই আমরা। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি চেষ্টা করলে এক মিলিয়ন ডলার যোগাড় করতে পারবেন? আমি বলতে চাইছি, এখন, এই মুহূর্তে?’

‘কে, আমি নিজে?’

‘প্রশ্নটা আপনাকেই আমি করছি।’

‘এই মুহূর্তে পারব না। তবে এক আধদিন সময় পেলে, বোধহয় পারব। হ্যাঁ, সম্ভব। কেন?’

‘আপনি কি জুয়া খেলতে পছন্দ করেন?’

‘মাঝেমধ্যে করি বৈকি।’

‘বেশ। এবার শুনুন। জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগটা আপনাকে দিতে যাচ্ছি আমি। কাল আপনি ল্যাচাসির বিরুদ্ধে রেসে নামতে যাচ্ছেন। আপনার দ্রুতগামী টারবোর সাথে পুরানো একটা গাড়ির প্রতিযোগিতা। আমি আপনাকে প্রিন্টগুলোর জন্যে এক মিলিয়ন ডলার অফার করেছি। আপনি যদি ট্র্যাকে ল্যাচাসিকে হারাতে পারেন, প্রিন্ট বাবদ এক মিলিয়ন তো পাবেনই, কষ্ট করার জন্যে আপনাকে আমি আরও এক মিলিয়ন দেব।’

‘সে আপনার ভারি উদারতা…।’ ঝানকে হাত তুলতে দেখে চুপ করে গেল রানা।

‘বলতে দিন আমাকে, প্লীজ। এখনও শেষ করিনি। এক মিলিয়ন ডলার অফার করেছি আমি। কিন্তু যদি ল্যাচাসি আপনাকে হারিয়ে দেয়, আপনি এক পয়সাও পাবেন না। প্রিন্টগুলো আমার হয়ে যাবে, আমার হয়ে পেমেন্ট করবেন, আপনি।’

সূক্ষ্মভাবে করা হয়েছে পরিকল্পনাটা, কয়েকটা তথ্য জানা থাকায় ঝুঁকিটা নিচ্ছে ঝান-ল্যাচাসির দক্ষতা সম্পর্কে জানে সে, জানে সেলবি-আমেরিকান জি.টি-র ক্ষমতা, জানে ট্র্যাক সম্পর্কে, ট্র্যাকটা রানার অচেনা হলেও ল্যাচাসির চেনা। তবু, এটা একটা জুয়াই। যদিও, রানা জিতলেও, মলিয়ের ঝান বা পিয়েরে ল্যাচাসি যদি নতুন সও মং হয়, প্রিন্ট বাবদ কোন টাকা পাবে না ও। ঝান ওর সাথে খেলছে, ধরে নিয়েছে টোপটা গিলবে রানা, তারপর বিপজ্জনক বাঁকগুলো সামলাতে না পেরে মারা পড়বে।

আর যদি প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াতে চায় ও…?

মন ভোলানো হাসির সাথে ঝানের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল রানা : ‘রাজি,‘ বলল ও, জানে শব্দটা উচ্চারণ করে আসলে হয়তো নিজের মৃত্যু-পরোয়ানাই জারি করল।

***