আবার উ সেন – ১.২

দুই

খানিক আগের ঘটনা।

ফ্লাইট বি টুয়েলভের স্টারবোর্ড সাইড, প্যাসেজের ধারে একটা সীট, একজিকিউটিভ ক্লাস। খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে, একদিকে একটু কাত হয়ে বসে আছে মাসুদ রানা, দেখে মনে হবে উদ্বেগ বা উত্তেজনার লেশমাত্র নেই ওর মধ্যে। আধবোজা চোখ আর শিথিল পেশীর আড়ালে টপ গিয়ারে রয়েছে ওর মাথা, শরীর নিয়ে রয়েছে বিপজ্জনক একটা ভঙ্গি, পেঁচানো স্প্রিঙের মত, ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি।

কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখলে মায়াভরা কালো চোখেও ধরা পড়বে উদ্বেগ। সিঙ্গাপুর থেকে প্লেনে ওঠার পরপরই বিপদের গন্ধ পেয়েছে রানা, তারপর বাহরাইন থেকে প্লেন ‘টেক-অফ করার পর সন্দেহ প্রবল হয়েছে। সতর্কতা বিফলে যায়নি, আজ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

বাহরাইন থেকেই বিপুল পরিমাণে সোনা তোলা হয়েছে প্লেনে।

বোয়িঙে রানার সাথে ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-টেরোরিজম অর্গানাইজেশনের চারজন আন্ডারকাভার এজেন্টও রয়েছে। শার্ক আর কোবরা কমাত থেকে বাছাই করা এজেন্ট ওরা, সাধারণ আরোহীদের সাথে ফার্স্ট, একজিকিউটিভ আর ট্যুরিস্ট ক্লাসে বসে আছে।

রানার ক্লান্তি আর উত্তেজনা শুধু এই বিমান যাত্রার ফল নয়, সিঙ্গাপুর থেকে লন্ডনের দীর্ঘ যাত্রায় এবার নিয়ে পরপর তিনবার থাকছে ও। সন্ত্রাসবিরোধী সতর্কতার অংশ হিসেবে কয়েক হপ্তা হলো এই ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করছে। শুধু সিঙ্গাপুর টু লন্ডন রুটে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে এরকম আরও অনেক রুটে সন্ত্রাস আর হাইজ্যাক বিরোধী সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। সম্প্রতি প্ৰায় পনেরোটা দেশে বিমান হাইজ্যাক হওয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ অনুরোধে ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-টেরোরিজম অর্গানাইজেশন এই সতর্ক প্রহরার আয়োজন করেছে।

অথচ আশ্চর্য, আজ পর্যন্ত কোন টেরোরিস্ট গ্রুপ এই সব হাইজ্যাকিং ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করেনি। এদিকে মাঝারি আর বড় মাপের এয়ারলাইন্স কোম্পানীগুলো ব্যাপক হারে প্যাসেঞ্জার হারাতে শুরু করেছে। প্রচার মাধ্যম আর সরকারগুলো যতই অভয়বাণী শোনাক, সাধারণ বিমান আরোহীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।

অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে হাইজ্যাকাররা ছিল চরম নিষ্ঠুর। আরোহী আর ক্রুরা পাইকারীহারে মারা গেছে। হাইজ্যাক করা কোন কোন প্লেনকে বিপজ্জনক আর দুর্গম পাহাড়ী এলাকার কোন গোপন এয়ারফিল্ডে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাটাই ধরা যাক—ওটা ছিল সেভেন-ফোর-সেভেন জাম্বো, ক্যাপটেনকে হাইজ্যাকাররা সুইস আল্পস-এ নিয়ে যেতে বলে জাহাজ। সমুদ্রপিঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে সমতল একটা জায়গা তৈরি করা হয়েছিল আগেই, কিন্তু জায়গাটা দুই উপত্যকার মাঝখানে ঢাকা ছিল। ল্যান্ড করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ক্যাপটেন, বিধ্বস্ত হয় প্লেনটা। আরোহী বা হাইজ্যাকার, কারও লাশই চেনার উপায় ছিল না।

কোন কোন ক্ষেত্রে নিরাপদেই নেমেছে প্লেন। লুঠ করা সোনা, টাকা, অলঙ্কার ইত্যাদি নিয়ে ছোট একটা প্লেনে উঠে গেছে হাইজ্যাকাররা, যাবার সময় হাইজ্যাক করা প্লেনটা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে মুহূর্তের দ্বিধা বা হস্তক্ষেপ বয়ে নিয়ে এসেছে অকস্মাৎ মৃত্যু-ক্রুদের, আরোহীদের, এমনকি শিশুদেরও।

এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং হাইজ্যাক হওয়ার ঘটনাটা। বোয়িঙে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অলঙ্কার আর অ্যান্টিকস তোলা হয় আবুধাবী থেকে, সবই সহজে বহনযোগ্য। হাইজ্যাকাররা সে-সব হাতিয়ে নিয়ে প্লেনটাকে নিচে নামাতে বলে, তারপর প্যারাসুট নিয়ে বেরিয়ে যায় প্লেন থেকে। এ-যাত্রায় প্রাণ বেঁচে যাওয়ায় আরোহীরা যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বোমা ফাটিয়ে আকাশ থেকে গায়েব করে দেয়া হয় বোয়িংটাকে।

ছয় হপ্তা হলো হাইজ্যাকিং বিরোধী সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। গত দুটো ফ্লাইটে রানার অংশগ্রহণ ছিল ঘটনাবিহীন। কিন্তু এবার ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, কিছু একটা ঘটবেই ঘটবে।

সিঙ্গাপুর থেকে প্লেনে ওঠার পর আরোহীদের মধ্যে চারজন লোককে দেখে সন্দেহ হয় ওর। চারজনই শক্ত-সমর্থ, কারও বয়সই ত্রিশের বেশি নয়। প্রত্যেকে দামী সুট পরে আছে, সাথে একটা করে ব্রীফকেস, যেন ব্যবসায়ী। চারজনই তারা একজিকিউটিভ ক্লাসে বসেছে, দু’জন সেন্ট্রাল সেকশনের পোর্ট সাইডে, রানার বাঁ দিকে। বাকি দু’জন সামনের দিকে, রানার কাছ থেকে পাঁচ সারি দূরে। চেহারায় ট্রেনিং পাওয়া সৈনিকের ভাব থাকলেও চারজনই তারা চুপচাপ এবং শান্ত।

তারপর, বাহরাইনে যাত্রাবিরতির সময় প্লেনে উঠে এল মূর্তিমান বিপদ। প্ৰায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সোনা, কারেন্সি আর ডায়মণ্ড তোলা হলো প্লেনে, ওগুলোর পিছু পিছু আরও উঠল তিনজন যুবক আর একটা মেয়ে। মেয়েটা সুন্দরী, চুল কালো, কিন্তু চেহারা এমন থমথমে, যেন শক্ত পাথর। তার পুরুষ সঙ্গীরা মেদহীন, স্মার্ট, হাবভাব দেখে মনে হয় ট্রেনিং পাওয়া গেরিলা।

উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াবার ছলে সীট ছেড়ে একবার উঠেছিল রানা, নবাগত আরোহীরা কে কোথায় বসেছে দেখে এসেছে। সন্দেহজনক ব্যবসায়ীদের মত এই চারজনও জোড়ায় জোড়ায় বসেছে, তবে সবাই রানার পিছনে, ট্যুরিস্ট ক্লাসে।

শার্ক আর কোবরা কমান্ডোদের মত রানাও সশস্ত্র। ওর সাথে নতুন একজোড়া থ্রোয়িং নাইফ রয়েছে। একটা ওর প্রিয় পজিশনে, বাম বাহুর ভেতর দিকে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো। আরেকটা পিঠে, শিরদাঁড়ার পাশে। আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাত এবং নির্ভরযোগ্য একটা রিভলভারও রয়েছে ওর সাথে, যেটা উড়ন্ত অবস্থায় প্লেনের ভেতর ব্যবহার করা যাবে নির্ভয়ে।

রিভলভারটা ছোট, পয়েন্ট থ্রী-এইট বোর, কার্ট্রিজে চার্জের পরিমাণ খুবই সামান্য। ফ্র্যাগমেনটেশন বুলেট-মারাত্মক শুধুমাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে, কারণ ওটার গতি দ্রুত কমে যায়, আর বুলেট ফেটে যাওয়ায় এয়ারফ্রেম বা প্লেনের ধাতব আবরণ ভেদ করতে পারে না।

কমান্ডোরাও সবাই রানার মত সশস্ত্র, তাদের ট্রেনিঙেও কোন খুঁত নেই, তবু প্লেনে রিভলভার থাকায় খুশি নয় রানা, যতই না কেন বলা হোক নিরাপদ। প্লেনের গা বা জানালার খুব কাছাকাছি থেকে গুলি করা হলে, বুলেটটা যদি সরাসরি ঢোকে, মারাত্মক ডিপ্রেশারাইজেশন সমস্যা দেখা দেবে। নিজেকে নিয়ে ওর তেমন কোন ভাবনা নেই, যাই ঘটুক ছুরি দিয়েই সামলাতে পারবে। তবে টার্গেট কাছাকাছি চলে এলে আলাদা কথা, তখন অবশ্যই রিভলভারটা ব্যবহার করবে ও। কাছাকাছি বলতে এক্ষেত্রে ওর হিসেবে দু’ফুট।

দৈত্যাকার সেভেন-ফোর-সেভেন মৃদু ঝাঁকি খেলো, সেই সাথে এঞ্জিনের আওয়াজে ক্ষীণ পরিবর্তন লক্ষ করল রানা, ওরা নিচে নামতে শুরু করেছে এ তারই লক্ষণ। সম্ভবত এই মাত্র বেলজিয়ান উপকূল ছাড়িয়ে এসেছে বোয়িং, আন্দাজ করল ও, চোখ জোড়া কেবিনের চারদিকে ঘুরছে, সতর্কতার সাথে আপেক্ষায় আছে।

নিরেট দর্শন স্বর্ণকেশী স্টুয়ার্ডেস রানার কয়েক সারি সামনে ব্যবসায়ী দু’জনকে সফট্-ড্রিঙ্কের ক্যান দিল। মেয়েটাকে প্যাসেজ ধরে আসা-যাওয়া করতে বেশ অনেকবার দেখেছে রানা। তার মুখের দিকে চোখ পড়তেই পলকের মধ্যে বুঝে নিল রানা কোথাও কোন ঘাপলা আছে। মুখে ধরে রাখা স্থির হাসি অদৃশ্য হয়েছে, আরোহী দু’জনের দিকে খুব বেশি ঝুঁকে রয়েছে সে, ফিসফিস করে কি যেন বলছে তাদেরকে।

চট করে একবার বাঁ দিকে তাকাল রানা, সুটেডবুটেড ব্যবসায়ীদের দ্বিতীয় জোড়া যেখানে বসে আছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে স্টুয়ার্ডেসের দিকে তাকিয়েছিল ও সেই ফাঁকে অদৃশ্য হয়েছে লোক দু’জন।

মাথা ঘুরিয়ে তাদের একজনকে দেখতে পেল রানা। হাতের জিনিসটাকে মনে হলো বিয়ানের ক্যান, ওর পিছনের প্যাসেজে ছোট গ্যালির কাছে, একজিকিউটিভ ক্লাসের পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। ইতিমধ্যে সামনের গ্যালিতে অদৃশ্য হয়ে গেছে স্টুয়ার্ডেস।

রানা নড়তে যাবে, চোখের পলকে সব কিছু একসাথে ঘটতে শুরু করল।

ওর পিছনের লোকটা বিয়ার ক্যানের রিঙ ধরে টান দিল, তারপর প্যাসেজের ওপর গড়িয়ে দিল ক্যানটা। ঘন ধোঁয়া বেরিয়ে এল ওটা থেকে, মুহূর্তের মধ্যে ভরে উঠল কেবিন।

ইতিমধ্যে সামনের লোক দুজনও সীট ছেড়েছে, দেখা গেল স্টুয়ার্ডেসও আবার ফিরে এসেছে প্যাসেজে। এবার কি যেন একটা রয়েছে মেয়েটার হাতে। আরও দূর প্রান্তে চার নম্বর ব্যবসায়ীকে দেখা গেল, সামনের দিকে ছুটতে শুরু করে সে-ও একটা স্মোক ক্যান ছুঁড়ে দিল প্যাসেজে।

দাঁড়িয়ে ঘুরতে যাচ্ছে রানা। সবচেয়ে কাছের লোকটা, ওর পিছনের প্যাসেজে, এক সেকেন্ডের জন্যে ইতস্তত করল। ভোজবাজীর মত রানার হাতে বেরিয়ে এল ছুরিটা। ছুরি ধরা হাতটা কাঁধের কাছে কখন উঠল, কখন ছুঁড়ে দিল, কি আঘাত করল, এ-সব কিছুই টের পেল না লোকটা। ছুরিটা তার হার্টের ঠিক নিচে ঢোকার সময় অকস্মাৎ ব্যথা আর বিস্ময়ের ধাক্কা অনুভব করল শুধু।

গোটা কেবিনে ধোঁয়া আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চিৎকার করে আরোহীদের শান্ত থাকতে বলল রানা, কেউ যেন সীট ছেড়ে না ওঠে। ট্যুরিস্ট ক্লাস আর সামনের পেন্ট হাউস স্যুইট থেকে কমান্ডোদেরও গলা পেল রানা। হঠাৎ শোনা গেল পরপর দুটো বিস্ফোরণের আওয়াজ, এয়ারগার্ড রিভলভারের বলে চেনা গেল ওগুলোকে। পরমুহূর্তে আরও জোরাল বিস্ফোরণ ঘটল, ভারী কোন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে!

দম আটকে রেখে ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে একজিকিউটিভ ক্লাস গ্যালির দিকে ছুটল রানা। ওখান থেকে পোর্ট সাইডে যাওয়া যাবে, তারপর ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যাবে পেন্ট হাউস আর ফ্লাইট ডেকে। এখনও অন্তত তিনজন হাইজ্যাকার বেঁচে আছে, চারজনও হতে পারে।

গ্যালিতে ঢুকেই বুঝল, আর মাত্র তিনজন। ইনগ্রাম সাবমেশিনগানটা এখনও আঁকড়ে ধরে আছে স্টুয়ার্ডেস, ধোঁয়ার ভেতর চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে সে, কাছ থেকে ছোঁড়া এয়ারগার্ড রিভলভারের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে তার বুক, বিস্ফারিত নীল চোখে বিস্ময় আর আতঙ্ক।

ছুরি ধরা হাতটা শরীরের পাশে, এখনও দম আটকে রেখেছে রানা, আতঙ্কিত আরোহীদের চেঁচামেচি আর কাশির আওয়াজ কানে তুলে লাশটা টপকাল। এত হৈচৈ সত্ত্বেও কমান্ডোদের একজনের গর্জন পরিষ্কার ভেসে এল নিচে, ‘রেড ওয়ান। রেড ওয়ান!’ এটা একটা সঙ্কেত, মানে হলো মূল আক্রমণটা করা হয়েছে ফ্লাইট ডেকে বা তার আশপাশে।

ঘোরানো সিঁড়ির গোড়ায় আরেকজনকে টপকাল রানা। কমান্ডোদের একজন, জ্ঞান নেই, এদিকের কাঁধ অর্ধেক উড়ে গেছে।

ছোট সিঁড়ি. বাঁক ঘুরতেই আরেক ব্যবসায়ীকে দেখতে পেল রানা, কয়েক ধাপ সামনে ওর দিকে পিছন ফিরে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে, হাতের ইনগ্রামটা তুলছে সে। ঝাঁকি খেলো রানার শরীর, বাতাসে শিস কেটে ছুটে গেল ছুরিটা। ফলাটা এতই ধারাল, লোকটার ঘাড়ে প্রায় সবটুকু গেঁথে গেল, ঠিক যেন মস্ত একটা হাইপডারমিক সিরিঞ্জ। কাটা ক্যারটিড শিরা থেকে ঝর্নার একটা ধারার মত সবেগে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। লোকটা এমনকি চিৎকার পর্যন্ত করল না। বিড়ালের মত নিঃশব্দে সামনের ধাপ ক’টা টপকে তার ঠিক পিছনে চলে এল রানা, লোকটার পতন শুরু হবার আগেই ধরে ফেলল তাকে, নিজেকে আড়ালে রেখে উঁকি দিয়ে তাকাল প্লেনের ওপরের অংশে।

ফ্লাইট ডেকের দরজা খোলা। দোরগোড়ার কাছে ব্যবসায়ীদের আরেকজনকে দেখা গেল, হাতে সাবমেশিনগান, নির্দেশ দিচ্ছে ক্রুদের। দরজার বাইরে, তার দিকে পিছন ফিরে রয়েছে সঙ্গীটি, এর হাতেও একটা ইনগ্রাম। সে যে তৈরি হয়ে আছে বোঝাবার জন্যে অস্ত্রটা একদিক থেকে আরেক দিকে অর্ধবৃত্ত আকারে ঘোরাচ্ছে ঘন ঘন। ইনগ্রাম সাবমেশিন গান সম্পর্কে জানা আছে রানার, মিনিটে বারোশো বুলেট ছোঁড়ে।

কমান্ডোদের একজনকে দেখতে পেল রানা, পরস্পরের সাথে সঙ্কেত বিনিময় করল ওরা। দু’জনেই জানে এরপর কি করতে হবে। সুযোগ না থাকায় এতক্ষণ নিজের সীটে গোবেচারার ভঙ্গিতে বসে ছিল কমান্ডো যুবক, কমান্ডারের নির্দেশ পেয়ে তৈরি হলো সে।

লাশটাকে ধাপের একপাশে সরিয়ে দিল রানা, লাশের ঘাড় থেকে এরই মধ্যে ছুরিটা ফিরে এসেছে ডান হাতে। বড় করে শ্বাস টেনে মাথা ঝাঁকাল ও। লাফ দিয়ে সীট ছাড়ল কমান্ডো, এয়ারগার্ড রিভলভার আগেই গর্জে উঠেছে তার হাতে।

হাইজ্যাকারদের গার্ড রানার নড়াচড়া টের পেয়ে সিঁড়ির দিকে ইনগ্রাম ঘোরাল। কিন্তু ট্রিগার টানার সুযোগ পেল না, তার আগেই এয়ারগার্ড রিভলভারের দুটো বুলেট খেলো সে গ্লায়। ডেক থেকে পা উঠল না তার, শরীরটা ঘুরলও না, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সটান সামনের দিকে আছাড় খেলো। ডেকে পড়ার আগেই মারা গেছে।

ফ্লাইট ডেকের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো হইজ্যাকার দ্রুত ঘুরল। এক ঝলক আলোর মত ছুটে গেল ছুরিটা, ঘ্যাঁচ করে বিঁধল তার বুকে। হাত থেকে পড়ে গেল ইনগ্রাম। তার পাশে রানা আর কমান্ডো একসাথে পৌছুল। লোকটার হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল, পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে পড়তে না দিয়ে ধরে রাখা হলো-পকেটগুলো দ্রুত সার্চ করছে রানা, গ্রেনেড বা অন্য কোন অস্ত্র থাকতে পারে।

লোকটাকে ছেড়ে দিতেই ডেকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে, বুকে গাঁথা ছুরির হাতলটা দু’হাতে ধরে বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করছে। বিস্ফারিত চোখের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে মণি জোড়া, রক্তাক্ত ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসছে ঘড় ঘড় আওয়াজ।

‘অল ওভার!’ চিৎকার করে বলল রানা, ক্যাপটেন সহ সবাই যাতে শুনতে পায়। যদিও পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত নয় ও। বিপদ কি সত্যিই কেটে গেছে?

‘নিচেটা চেক করে দেখি,’ কমান্ডোকে বলল ও, আহত হাইজ্যাকারের ওপর ঝুঁকে রয়েছে সে।

নিচের কেবিনে ধোঁয়া এখন আর নেই বললেই চলে, সামনে একজন কালো চুল স্টুয়ার্ডেসকে দেখতে পেয়ে হাসল রানা। ‘তুমি ওদেরকে শান্ত করো, ‘ তাকে বলল ও। বিপদ কেটে গেছে।’ মেয়েটার বাহু চাপড়ে দিল ও, তারপর তাকে একজিকিউটিভ ক্লাসের সামনের গ্যালিতে যেতে নিষেধ করল।

ওখানে নিজে গেল রানা। আরোহীদের অনেকেই সীট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে প্যাসেজে, ভিড় ঠেলে এগোতে হলো। এক বুড়ি রানাকে ধরে ঝুলে পড়ল, ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আরেকজন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কাউকে অভয় দিয়ে কাজ হলো, আবার কেউ ধমক খেয়ে চুপ করল। স্টুয়ার্ডেসের লাশে একটা কোট চাপা দিল ও। যে-কোন লাশ, তা সে যারই হোক, চোখে বড় অসুন্দর লাগে।

বাকি দু’জন কমান্ডো, যুক্তিসঙ্গতভাবেই, প্লেনের পিছন দিকে রয়েছে। হাইজ্যাকারদের যদি ব্যাক-আপ টীম থাকে, তাদের সামলাবার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি ওরা। হাঁটতে হাঁটতে আপনমনে হাসল রানা। নিষ্ঠুর চেহারার তিনজন যুবক আর তাদের সঙ্গিনী মেয়েটা, যারা বাহরাইন থেকে প্লেনে ওঠার সময় ওর মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিল, এই মুহূর্তে অন্যান্য সাধারণ আরোহীদের চেয়েও বেশি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

দ্বিতীয়বার যখন ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠছে রানা, ইন্টারফোন সিস্টেম থেকে পার্সারের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আরোহীদের জানাল খানিক পরই লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামতে যাচ্ছে প্লেন। তারপর অনির্ধারিত অপ্রীতিকর ঘটনার’ জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করল সে।

পেন্টহাউস স্যুইটে রানা ঢুকতেই কমান্ডো যুবক ম্লান মুখে মাথা নাড়ল। হাইজ্যাকার লোকটা, রানার দ্বিতীয় ছুরির শিকার, দুটো খালি সীটের ওপর পড়ে আছে, শরীরটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। ‘কোন লাভ হলো না,’ রানাকে বলল কমান্ডো; ‘মাত্র কয়েক মিনিট বেঁচে ছিল।

রানা জানতে চাইল লোকটার জ্ঞান ফিরেছিল কিনা। ‘একেবারে শেষ মুহূর্তে। কথা বলার চেষ্টা করছিল।’

‘আচ্ছা!’

‘মাথামুণ্ডু কিছুই অবশ্য আমি বুঝতে পারিনি।’

কথাগুলো কি ছিল মনে করার জন্যে তাগাদা দিল রানা।

‘বলল…মানে, কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল আর কি। দু’একটা শব্দ… কিন্তু ভারী অস্পষ্ট, কমান্ডার। মনে হলো যেন…সৎ মং। দম বন্ধ হবার আগে থরথর করে কাঁপছিল লোকটা, কাশির সাথে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু শেষ শব্দ দুটো, কোন সন্দেহ নেই, ওরকমই শোনাল –সও মং।

চুপ হয়ে গেছে রানা। ল্যান্ড করতে যাচ্ছে প্লেন, কাছাকাছি একটা সীটে বসে পড়ল ও।

আরও খানিক পর প্লেনের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করল, তখনও রানা মাথা নিচু করে হাইজ্যাকারের শেষ শব্দ দুটো নিয়ে ভাবছে। না, তা কি করে হয়! এত বছর পর সও মং কোত্থেকে আসবে!

উ সেন! ছদ্মনাম সও মং। রানার পরম শত্রু ছিল লোকটা। প্যারিসে রানা যাকে নিজের হাতে খুন করেছে।

এক মুহূর্তের মধ্যে চোখ বুজল রানা। দীর্ঘ যাত্রা আর খণ্ডযুদ্ধ ক্লান্ত করে তুলেছে ওকে। কোন সন্দেহ নেই উ সেন মারা গেছে। কাজেই সও মঙের আবির্ভাবও আর সম্ভব নয়। কিন্তু কে বলতে পারে? সও মং তো উ সেনের আসল নাম ছিল না, ছদ্মনামটা কেউ যদি ধার করে উ সেনের উত্তরাধিকারী হিসেবে উদয় হয়ে থাকে আশ্চর্য হবার কি আছে! কিন্তু কে হতে পারে? উ সেনের কোন শিষ্য? তার কোন ছেলে? কিন্তু না, ওর জানামতে উ সেন কখনও বিয়ে করেনি। কিংবা হয়তো করেছিল, কাউকে জানতে দেয়নি। ছেলে না-ও হতে পারে, ইউনিয়ন কর্সের কোন নেতা হবার সম্ভাবনাই বেশি। ইউনিয়ন কর্সের ইতিহাসে উ সেনের মত দুর্ধর্ষ নেতা দ্বিতীয়টি নেই। ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকা জুড়ে সন্ত্রাস আর আতঙ্ক ছড়ানোর ব্যাপারে তার মত সাফল্যও আর কেউ অর্জন করেনি-তবে কি তারই ছদ্মনাম গ্রহণ করে খোদ ইউনিয়ন কর্স-ই নতুন কোন কূট-পরিকল্পনা করেছে?

সও মং, নতুন আরেক অপদেবতা?

সেভেন-ফোর-সেভেনের এঞ্জিন থামল। বেল বাজিয়ে আরোহীদের জানিয়ে দেয়া হলো, এখন তারা নেমে যেতে পারে।

হ্যাঁ, মনে মনে স্বীকার করল রানা, সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না।