আবার উ সেন – ২.৬

ছয়

রানা ভেবেছিল টানেল থেকে বেরিয়ে দেখতে পাবে গাঢ় নীল মখমলের মত রাতের আকাশে হীরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে তারাগুলো। কিন্তু টানেলের মুখ থেকে তাপদগ্ধ বাতাসে উঠে এল ও, আকাশ জুড়ে যুদ্ধ বেধে গেছে। একদিকে অন্ধকার আকাশ চিরে এঁকেবেঁকে ছুটে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, দূরে কোথাও বাজ পড়ছে ঘন ঘন, আরেকদিকে গম্ভীর একটানা ডাক ছাড়ছে মেঘ। প্রকৃতি যেন ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠার মহড়া দিচ্ছে।

বড় করে শ্বাস টানল রানা, বুক ভরলেও গরম বাতাসে তুপ্তি হলো না। রাস্তার কিনারায় কয়েক সেকেন্ড অনড় দাঁড়িয়ে থাকল ও, তারপর লিভার ধরে টান দিল, পাথরের ঢাকনিটা ফিরিয়ে আনল টানেলের মুখে।

মনে মনে একটা হিসাব করল রানা, কনফারেন্স সেন্টারে প্রায় নয় ঘণ্টার মত ছিল, স্টেজের তলায় বিশেষ নড়াচড়া করার সুযোগ হয়নি, মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছে, নাক দিয়ে টানতে হয়েছে বহুলোকের নিঃশ্বাস ঘাম আর গায়ের গন্ধ মেশানো ভাপসা বাতাস। অসম্ভব নোংরা লাগছে নিজেকে। গোসল করা দরকার, দরকার কাপড় পাল্টানো।

কনফারেন্স শেষ হতে প্রায় সন্ধে হয়ে যায়, তারপরও হলঘর খালি হওয়ার অপেক্ষায় কিছুক্ষণ স্টেজের তলায় পড়ে থাকতে হয়েছে ওকে। প্রথম সুযোগেই বেরিয়ে এসেছে ও, অপারেশন বুলডগের বিস্তারিত প্ল্যান মাথায় নিয়ে। লোকেশন, পরিবহন ব্যবস্থা, অস্ত্রশস্ত্র, মিলিত হওয়ার নির্দিষ্ট জায়গা, বিকল্প উপায় ইত্যাদি সবই জানে ও। দুঃসাহসিক পরিকল্পনা, কোন সন্দেহ নেই। এক পাগল ছাড়া আর কেউ ভাবতেও পারে না নোরাড হেডকোয়ার্টারে ঢুকে ক্লাসিফায়েড কমপিউটর টেপ নিয়ে বেরিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু না, হার্মিসের নেতা সও মং পাগল নয়। সম্ভাব্য সমস্ত বাধা-বিঘ্ন বিবেচনার মধ্যে রেখে প্ল্যান করা হয়েছে, বিফল হবার কোন আশঙ্কাই রাখা হয়নি। রানা বিশ্বাস করে, ওরা পারবে। ওদের পক্ষে সম্ভব।

শুধু একটা তথ্য জানা নেই রানার। চার তারকা বিশিষ্ট জেনারেলের ভূমিকা কে পালন করবে। সব দিক থেকে যোগ্য এবং উপযুক্ত হতে হবে তাকে, আসলে ইউ.এস.এয়ার/স্পেস ডিফেন্স-এর ইন্সপেক্টর-জেনারেলের ভূমিকায় অভিনয় করা সহজ কথা নয়।

মিশনের গুরুত্ব রানার ঘাড়ে যেন ভূতের মত সওয়ার হয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া তথা বিশ্বের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ফ্লাইং ড্রাগন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। ফ্লাইং ড্রাগন একাই যে-কোন পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি মোকাবিলা করতে পারে। পৃথিবীর অনেক ওপরে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে গুগুলো, সবগুলো মহাদেশের ছত্রছায়া হিসেবে, যে-কোন সঙ্কটময় জরুরী অবস্থায় ওগুলো ব্যবহার সম্ভব এবং ব্যবহার হতে পারে। প্রতিটি ন্যাটো শক্তিকে বিষয়টা গোপনে জানিয়ে রাখা রয়েছে, জানিয়ে রাখা হয়েছে অন্যান্য ফ্লাইং ড্রাগনের অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা সম্পর্কে-যে-কোন মুহূর্তে কক্ষপথে স্থাপন করা যাবে, ওগুলোর চেইজ ট্র্যাক কন্ট্রোল এবং মনিটর করা হবে চেইন পাহাড়ের অপারেশন রূম থেকে অপারেশনাল কন্ট্রোল সেন্টার স্থানান্তরের প্ল্যান করা হয়েছে, জানে রানা। কিন্তু যতদিন না পার্টিকল্ বীম উইপন ব্যবহার করার উপযোগী হচ্ছে ততদিন কলোরাডোর চেইন পাহাড়ের অপারেশন রূমের গুরুত্ব এতটুকু কমবে না। সাধারণ কামানের জায়গা যখন মিসাইল দখল করে নেয়, মধ্যবর্তী সময়ে সঙ্কটের মধ্যে ছিল পৃথিবী। এখন পারমাণবিক মারণাস্ত্রের জায়গা দখল করে নেবে পার্টিকল্ বীম সিস্টেম, পৃথিবীর মানুষ আবার একবার সঙ্কটময় মধ্যবর্তী সময় পেরোচ্ছে।

রাস্তার ধারে জঙ্গলের কিনারায় গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে রানা, স্যাব বা রিটার সন্ধানে, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, একটা প্রশ্ন অস্থির করে তুলল ওকে। ল্যাচাসি বলল নারকোটিক মেশানো আইসক্রীম নোরাড হেডকোয়ার্টারে সাপ্লাই দেয়া হয়েছে, পৌঁছে যাবে কাল দুপুরের দিকে। তারমানে কি র‍্যাঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে আইসক্রীম, পথে কোথাও রয়েছে? নাকি শুধু ট্রাকে তোলা হয়েছে, এখনও রওনা হয়নি?

প্রায় মাঝরাত হতে চলল, রিটার দেখা নেই। জঙ্গলের কিনারায় বেরিয়ে এসে ছটফ; করতে লাগল রানা। তারপর, বারোটা দশ মিনিটে, স্যাবের আওয়াজ পেল ও। বনভূমি ঘেরা ঢালের দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে সাইডলাইট।

রিটার চেহারায় উদ্বেগ আর উত্তেজনা, রানার মত সে-ও গাঢ় রঙের জিনস আর একটা সোয়েটার পরে আছে। লাফ দিয়ে স্যাবে উঠে পড়ল রানা, সেই সাথে দেখল গিয়ার লিভারের পাশে রিভলভারটা রয়েছে, নাগালের মধ্যে।

‘ওরা আমাদের খুঁজছে, রানা!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রিটা। ‘কোথাও বাদ রাখছে না! গাড়ি আমিই চালাই?’

মাথা ঝাঁকিয়ে মনো-রেল ডিপোর দিকে যেতে বলল রানা।

‘খামোকা বলছ,’ দম নিয়ে বলল রিটা। ‘ওদিকে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের জন্যে সব রাস্তাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, রানা! রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে, আর স্টেশনে গার্ড….

অটোমেটিক পিস্তলটা হোলস্টার থেকে বের করে হাতে নিল রানা। ‘সেক্ষেত্রে যুদ্ধ করে এগোব। রোড-ব্লক দেখলে গাড়ি ঘুরিয়ে নেবে, প্রতিটি রাস্তায় ব্যারিকেড খাড়া করা সম্ভব নয়। মনো-রেলে উঠতে হলে যদি গুলি করতে হয় করব।’

‘তোমার মনে আছে, ওদিকের স্টেশনে ও…?’

হ্যাঁ, যমজরা পাহারায় আছে। ভুলিনি। দরকার হলে ওদেরকেও পাঠিয়ে দেব পরপারে। যেভাবে হোক এই র‍্যাঞ্চ থেকে বেরুতে হবে আমাদের, বুঝলে। আমার কাছে যে খবর নাছে, পার্ল হারবার ওয়ার্নিঙের পর এত গরম খবর আর সৃষ্টি হয়নি। এবার ওরা গুরুত্ব দেবে, এ আমি বাজি ধরে বলতে পারি। শোনো, তোমারও সব কথা জানা দরকার, রিটা। বলা যায় না, দেখা যাবে দুজনের মধ্যে হয়তো একজন মাত্র বেরিয়ে যেতে পেরেছি।

রানার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ হবার পর সব আবার পুনরাবৃত্তি করতে হলো টরিটাকে, তারপর সে যোগ করল, ‘তবু এসো একসাথে বেরুবার চেষ্টা করা যাক। এখানে আমাকে একা থাকতে হবে বা বাইরে বেরিয়ে সব দিক সামলাতে হবে, ভাবতেই পারছি না।’

মেইন রোডগুলো থেকে দূরে থাকল রিটা, শুধু সাইড রোডগুলো ব্যবহার করছে, মাঝে মধ্যে রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ছে ঘাসের ওপর, পেরিয়ে আসছে ছোট ছোট মাঠ। খানিক পরই দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এল টারা, বাড়িটার চারপাশে কয়েক ডজন ফ্লাডলাইট জ্বলছে। ইতিমধ্যে আরও কাছে সরে এসেছে ঝড়, মাথার ওপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন।

শেষ পর্যন্ত এই ঝড়ই ওদেরকে সাহায্য করল। মরু এলাকার আবহাওয়া সাধারণত যেমন হয়, পরিবর্তনটা এল অকস্মাৎ। গরম বাতাস হঠাৎ শীতল হয়ে গেল, সেই সাথে শুরু হলো তুমুল বর্ষণ, চারদিকে শোঁ শোঁ গর্জন; আর এক নিমেষের মধ্যে ঝান র‍্যাঞ্চের মাথায় আকাশ হয়ে উঠল ঠিক যেন আগুনে তৈরি ছাতা।

গাছপালার পর্দার আড়ালে রয়েছে স্যাব, গাড়িটাকে সাবধানে সীমানায় দাঁড়ানো পাঁচিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে রিটা।

ওয়াইপার পুরোদমে কাজ করলেও উইন্ডস্ক্রীনের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি চলে না। ঝড় আর বজ্রপাত ভাগিয়ে দিয়েছে গার্ডদের, ধারণা করল রানা। মনো-রেল আধ মাইল দূরে থাকতে রিটাকে গাড়ি থামাতে বলল ও, প্রথম দফা বৃষ্টির প্রকোপ

কমার জন্যে অপেক্ষা করবে।

রিটা জানাল, যতদূর জানে সে, এদিকের স্টেশনেই আছে মনো-রেল। ‘সকালের দিকে মনো-রেলে করে কিছু গাড়ি এসেছে,’ বলল সে, ব্যাখ্যা করল টারায় হঠাৎ করে প্রচুর লোকজন চলে আসায় তার জন্যে পালানো খুব কঠিন হয়ে উঠেছিল।

‘কিভাবে এলে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘বুঝলাম সাহস করতে হবে। স্রেফ হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে এলাম। ঝান আমাকে দেখে ফেলল, জিজ্ঞেস করতে বললাম, তাজা বাতাস দরকার তাই বেরিয়েছি। সে চোখের আড়াল হতেই দৌড়াতে শুরু করি। জীবনেও বোধহয় এত জোরে ছুটিনি…না, ভুল হলো,-কলেজ টীমের গোলকীপার যেদিন প্রেম নিবেদন করল, সেদিন বোধহয় এরচেয়েও জোরে দৌড়েছিলাম।’

‘ধরতে পেরেছিল?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘অবশ্যই, রানা। একটু পর আমি ছোটার গতি কমিয়ে দিই। দেব না কেন! ছোকরা দেখতে ভারি সুন্দর ছিল। ভাল কথা, হিরোইনকে কেমন দেখলে?

‘হিরোইন?’ আকাশ থেকে পড়ার ভান করল রানা। ‘কার কথা বলছ? ‘বাননা বেলাডোনা। অস্বীকার কোরো না, আমি জানি তার সাথে দেখা হয়েছে তোমার।’

‘তা দেখা হয়েছে, অস্বীকার করব কেন, কিন্তু এই অ্যাসাইনমেন্টে হিরোইন যদি কেউ থাকে তো সে তুমি, বেলাডোনা কেন হতে যাবে?’

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল রিটা। যাক, অন্তত হিরোর মৌখিক স্বীকতি পাওয়া গেল। কাজের দ্বারা প্রমাণিত হতে কত যুগ লাগবে একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। তা, কি হলো তার সাথে?’ আড়চোখে তাকাল সে। ‘কি কি হলো?’

রানা গম্ভীর। ‘আমার ধারণা ছিল না তুমি এ-ধরনের আপত্তিকর প্রসঙ্গ তুলতে পারো। কি আবার হবে!’

‘কিছুই হয়নি?’ রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করলেও লাল হয়ে উঠল রিটার মুখ। ‘মিথ্যে বলবে না, তুমি ওকে পটাবার চেষ্টা করোনি?’

হেসে ফেলল রানা। ‘সম্ভবত উল্টোটা সত্যি।

‘কিন্তু আমি যদি বলি তা নয়, তুমিই ওকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছ?’ ঝাঁঝের সাথে, আত্মবিশ্বাসের সাথে অভিযোগ করছে রিটা। যদি বলি সোজা পথে সুবিধে হচ্ছে না দেখে সম্মোহনের আশ্রয় নিয়েছ তুমি? অস্বীকার করতে পারবে?’

হো হো করে হেসে উঠল রানা। তারপর হঠাৎ থেমে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘বেলাডোনা তোমাকে সম্মোহনের কথা বলল? বলল, আমার সাথে দেখা হয়েছে তার?’

‘তা কেন বলবে! সম্মোহন বিদ্যা সম্পর্কে আমি কিছু জানি কিনা জিজ্ঞেস করছিল। আমি বললাম জানি না। তখন বলল সম্মোহন সম্পর্কে ওর খুব আগ্রহ, কিছু কিছু নাকি তোমার কাছ থেকে শিখেওছে। কবে, কখন, তা কিছু বলেনি…আমি বুঝে নিয়েছি। অমন করে হাসলে কেন জানতে পারি?’

‘যা জানো তাই। সম্মোহন সম্পর্কে ভারি আগ্রহ দেখলাম বেলাডোনার, মনোযোগী ছাত্রী পেয়ে শেখানোর সুযোগটা ছাড়লাম না, এই আর কি!’

‘শুধু কি শেখানোর সুযোগ নিলে, নাকি অন্যান্য আরও কিছু সুযোগ…?’

‘আপত্তিকর প্রশ্ন।’

‘তা, সম্মোহিত হয়েছিল বেলাডোনা?’ ঘুরপথে কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করছে রিটা।

‘কি জানি, ভান করছিল কিনা পরীক্ষা করিনি।’

‘তারমানে হয়েছিল। তারপর?’

‘তারমানে? তারপর আবার কি?’

সরাসরি তাকাল রিটা রানার দিকে। ‘সুন্দরী, যুবতী একটা মেয়েকে সম্মোহিত করলে, অথচ বলছ তারপর কিছু ঘটেনি?

তোমার কি ধারণা, মেয়েদেরকে আমি প্রথমে অসহায় করে তুলি, তারপর সুযোগ নিই?’

সাথে সাথে কিছু বলল না রিটা। রানার মনে হলো, অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে সে। ও রাগ করেনি, অথচ হঠাৎ ক্ষমা প্রার্থনা করল রিটা, বলল, ‘দুঃখিত, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। ভুলে যাও, প্লীজ। আমি জানি, তুমি সেরকম মানুষ নও।

‘তুমি জানো?’ হেসে উঠল রানা।

‘হ্যাঁ।’ রিটা মুখ ঘুরিয়ে নিল, হঠাৎ উদাস আর বিষণ্ন হয়ে পড়েছে। ‘নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি।

‘প্রশংসার জন্যে ধন্যবাদ,’ সহাস্যে বলল রানা। তবে একটা কথা তোমাকে জানানো দরকার। আমি সাধুপুরুষ নই, কোন কালে ছিলামও না। বেলাডোনা কেন, সুন্দর এবং মার্জিত যে-কোন মেয়ে আমাকে চাইলে আমি প্রত্যাখ্যান করব সে আশা কম।’

এবার রিটার হেসে ওঠার পালা। তারমানে হতাশ হবার কোন কারণ নেই আমার!’

আলাপের এই পর্যায়ে বৃষ্টি কমে এল।

‘গাড়ি ছাড়ো,’ বলল রানা। ‘ড্রাইভ লাইক দা ডেভিল। গোলাগুলি হলে ভয় পেয়ো না, স্যাবে যতক্ষণ বসে আছি কেউ আমাদের ছুঁতে পারবে না। সরাসরি মনো-রেল ডিপো, রিটা।’

মনো-রেল কিভাবে চালাতে হয় জানো তুমি?’ গাড়ি ছেড়ে দিয়ে জানতে চাইল রিটা।

রানা বলল সব ব্যাপারেই প্রথমবার বলে একটা কথা আছে, চেষ্টা করে দেখবে।

কারও চোখে না পড়ে মনো-রেল ডিপোর দুশো গজের মধ্যে চলে এল ওরা। অন্তত রানার তাই ধারণা ছিল। ভুলটা ভাঙল হঠাৎ করে।

ওদের পিছনে গাড়িটাকে প্রথমে রানাই দেখতে পেল। অকস্মাৎ বৃষ্টির নিশ্ছিদ্র একটা পর্দা ঝপ্ করে নেমে এল গাড়ি দুটোর মাঝখানে, পিছনের গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর আরেকটা গাড়ি উদয় হলো ডান দিক থেকে, স্যাব যখন ডিপোর সামনে দিয়ে ছুটছে।

সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে রিটা, উইন্ডস্ক্রীন প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে নাক, চোখে দিশেহারা ভাব নিয়ে র‍্যাম্পটা খুঁজছে সে।

দু’জোড়া হেডলাইট, পিছনে আর ডান দিকে, বৃষ্টির মধ্যে বারবার দেখা দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরই শব্দ পেল রানা, বুলেটটা ওর পাশের আর্মারে আঘাত করেছে। পরপর আরও দুটো বুলেট ছুটে এল। ড্রাইভারের জানালায় মোটা, অভেদ্য কাঁচ, কাঁচে লেগে ছিটকে চলে গেল বুলেট।

এভাবে শেষ রক্ষা হত না, বাঁচিয়ে দিল আবহাওয়া। আগুন যেমন নেভার আগে দপ করে শেষ একবার জ্বলে ওঠে, বৃষ্টিটাও যেন ঠিক তেমনি থামার আগে হঠাৎ বিশাল জলপ্রপাতের মত নেমে এল।

‘ওই যে!’ চিৎকার করল রিট, উপলব্ধি করল র‍্যাম্পের পাশে রয়েছে ওরা, ওটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্যাব। উইন্ডস্ক্রীনে নাক ঠেকিয়ে, চেহারায় অসন্তোষ আর গাম্ভীর্য, গাড়ি পিছিয়ে আনল সে, ফার্স্ট গিয়ার দিল, তারপর সাবলীলভাবে র‍্যাম্পে তুলল স্যাবকে। ঘেরা র‍্যাম্প ধরে মনো-রেলে চড়ছে ওরা।

এই তুমুল বর্ষণের মধ্যে ড্রাইভার পথ চিনতে পারবে কিনা বলা কঠিন কিংবা তারা হয়তো বুঝতেই পারেনি কোন্ দিকে গেছে স্যাব। অন্ধকার টানেলে ঢুকে হেডলাইট জ্বেলেছে রিটা, ওদের পিছনে কাউকে দেখা গেল না।

সামনে হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বড়সড় স্লাইডিং ডোর, পরমুহূর্তে ট্র্যান্সপোর্টার ভ্যানের সাথে ধাক্কা খেলো গাড়ি, রিস্ট্রেইনিং রেইলের ঠিক সামনে স্থির হয়ে গেল।

স্যাব থেকে লাফ দিয়ে নামার সময় চিৎকার করল রানা, দরজা বন্ধ করতে বলছে রিটাকে, সেই সাথে মনে মনে প্রার্থনা করল ড্রাইভারের কেবিনে যেন তালা দেয়া না থাকে। ক্যাবে ঢোকার সময় দরজা বন্ধ করার ক্লিক শুনতে পেল। এখন শুধু কমনসেন্স ব্যবহারের পালা, আর কন্ট্রোল প্যানেল দেখে বুঝে নেয়া কোন্ লিভারের কি কাজ।

বৃষ্টি এখনও তুমুল, কেবিনের বড় বড় জানালায় ঝাপসা হয়ে আছে কাঁচ। লিভার আর ইন্সট্রুমেন্টের সমতল প্যানেলের সামনে মেঝের সাথে আটকানো ছোট একটা চেয়ার। পরম স্বস্তির সাথে রানা দেখল, প্রতিটির গায়ে নাম লেখা আছে। লাল একটা বোতামের নিচে একজোড়া সুইচ, লেখা রয়েছে-টারবাইন: অন/অফ। অন সুইচ চাপ দিয়ে বোতামটা টিপে দিল রানা, অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্টের দিকে চোখ ফেরাল। থ্রটলটা ধাতব বাহুর আকৃতি নিয়ে রয়েছে, ছাড়া ছাড়া ভাবে বসানো টার্মিনালের মধ্যবর্তী জায়গাটায় অর্ধবৃত্ত আকারে ঘোরানো যায় সেটা। ওর পায়ের কাছে রয়েছে ব্রেকিং মেকানিজম, থ্রটলের ডান দিকে একটা সেকেন্ডারি ডিভাইস সহ। স্পীড ইন্ডিকেটর, উইন্ডস্ক্রীন ওয়াইপার, লাইট আর এক সার বোতাম দেখতে পেল ও। বোতামগুলোর মাথায় লেখা রয়েছে-ডোরস: অটোমেটিক। ক্লোজ/ওপেন।

লাল বোতামে চাপ দেয়ার পর চাপা যান্ত্রিক গুঞ্জনের সাথে ঘুরতে শুরু করেছে টারবাইন। সবগুলো অটোমেটিক ডোর বাটন ক্লোজ সার্কিটে নামিয়ে দিল রানা, অন করল ওয়াইপার আর লাইট, ব্রেক রিলিজ করল, তারপর আলতোভাবে নাড়ল থ্রটল বাহু।

এমন আকস্মিক প্রতিক্রিয়া আশা করেনি ও। ঝাঁকি খেলো ট্রেন, সমস্ত ভার নিয়ে ডিপো থেকে রওনা হয়ে গেল হুট করে, যেন তেলের ওপর পিছলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রানার কনুইয়ের পাশে পৌঁছে গেছে রিটা, সামনের বড় জানালার দিকে ঝুঁকে চোখ কুঁচকে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছে সে। হেডলাইটের আলোয় বৃষ্টি আর ট্র্যাক বেশ পরিষ্কারই দেখা গেল।

একটু একটু করে পাওয়ার বাড়াল রানা, স্পীড গজ উঠে যেতে দেখল ঘণ্টায় সত্তর মাইলে। আশিতে ওঠার পর দেখা গেল ঝড় কেটে যাচ্ছে। যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, থামার সময়ও তেমনি হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ল বাতাসের গতিবেগ। বৃষ্টি এখন সামান্য ঝির ঝিরে, আলোর লম্বা বাহুর মধ্যে দীর্ঘ সিঙ্গল ট্র্যাক তীরচিহ্নের মত বেরিয়ে গেছে ট্রেনের নাক থেকে।

ট্রেনের দু’দিকে ইলেকট্রিফায়েড নিরাপত্তা বেষ্টনী, কাঁটাতারের বেড়া, স্বভাবতই রিটার মনে প্রশ্ন তুলল। ‘শেষ মাথায় পৌছে কি করব আমরা?’

‘আমাদের জন্যে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করবে ওরা। শটগান, ইলেকট্রিফায়েড বেড়া…চিন্তার কথা, তবে আগে পৌঁছে নিই, তারপর ভাবব।

আবার স্পীড বাড়াল রানা, সন্দেহ প্রকাশ করল শেষ মাথার স্টেশনের ভেতর দিয়ে যাবার সময় সম্ভাব্য বাধাগুলো ট্রেন সামলাতে পারবে কিনা। বোধহয় স্যানের ভেতর থাকলে ভাল হয়, খানিকটা প্রোটেকশন পাওয়া যেত।’

‘কিসের প্রোটেকশন, গোটা ট্রেনই যদি উল্টে যায়? বামপার ধরনের কিছু একটা যে থাকবে শেষ মাথায়, জানা কথা।

‘আর পাশেই ওরা দাঁড়িয়ে থাকবে,’ মন্তব্য করল রানা। ‘হাতে অস্ত্র নিয়ে।’

তীরবেগে ছুটে চলেছে মনো-রেল অথচ কোন ঝাঁকি, দোলা বা কাঁপন নেই। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় সামনে বহুদূর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল রানা। কমবেশি দশ মিনিট ছুটছে ওরা। নরম হাতে থ্রটলটা পিছিয়ে আনল ও, তারপর স্যাব থেকে রিভলভার আর নাইটফাইন্ডার নিয়ে আসার নির্দেশ দিল রিটাকে।

রিটা চলে যাবার পর ট্রেনের স্পীড আরও কমাল রানা, ক্ষীণ কাঁপুনির সাথে মন্থর হয়ে এল গতি।

‘একটু পরেই মেইন লাইটগুলো নিভিয়ে দেব,’ রিটা ফেরার পর বলল রানা। ‘বিপদ থেকে বাঁচার একটাই উপায় আছে। স্টেশন খানিকটা দূরে থাকতে ট্রেন থামাব, দেখব নাইটফাইন্ডার কি বলে। তারপর…দুর্গ তোমার দায়িত্বে থাকবে, আমি ট্র্যাক ধরে এগিয়ে দেখব ভেতরে ঢোকা যায় কিনা।’

বাইরে ঘন কালো অন্ধকার, হেডলাইটের প্রান্তসীমার সামনে। আরও দূরে দিগন্তরেখার কাছাকাছি মাঝে মধ্যেই ফণা বিস্তার করছে বিদ্যুৎ।

নাইটফাইন্ডারের স্ট্র্যাপ গলায় পরল রানা, ভি-পি-সেভেনটি নিয়ে ইন্সট্রুমেন্ট শেলফে রাখল, প্রতিমুহূর্তে পিছিয়ে আনছে থ্রটল। একটু পরেই আলো নিভিয়ে দিল ও।

সম্পূর্ণ অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ট্রেন। নাইটফাইন্ডারে চোখ রেখে দূরে তাকিয়ে আছে রানা, ওর একটা বাহু ধরে পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিটা। ট্র্যাক সামান্য একটু বেঁকে গেছে, আর দেরি না করে এখুনি হিসাব পাওয়া দরকার মরু স্টেশন থেকে কতটা দূরে রয়েছে ওরা। প্রায় এক মাইল, থ্রটল আরও একটু পিছিয়ে এনে ভাবল ও। এক মুহূর্ত পর শেষ সীমায় টেনে আনল ওটা, ধীরে ধীরে ব্রেক চাপল।

কেবিনের নিজস্ব স্লাইডিং দরজা রয়েছে, অটোমেটিক/ওপেন-এ সুইচ দেয়া থাকলে বাকিগুলোর সাথে সেটারও তালা খুলে যায়। ক্যাব থেকে নামার জন্যে নিশ্চয়ই লোহার ধাপ বা আঙটা আছে, নিচের দিকে অন্তত খানিকটা নামতে সাহায্য করবে ওকে। তারপর সম্ভবত লাফ দিয়ে দীর্ঘ পতনের ঝুঁকি নিতে হবে।

কি করতে চায় অল্প কথায় রিটাকে বোঝাল রানা। ‘অন্ধকারে এটাই আমার চোখ, নাইটফাইন্ডারে আঙুল বুলাল ও। দরজার তালা খোলার পর টারবাইনের সুইচ অফ করতে হবে, তোমাকে একা রেখে নেমে যাব আমি!’

‘রানা, বেড়াগুলো বিপজ্জনক, খুব সাবধানে থেকো,’ শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও রিটার গলা একটু কেঁপে গেল। ‘মনে রেখো, একা আমি ওদের সাথে

পারব না।

‘বাজে কথা বোলো না তো! নিজেকে তুমি অবশ্যই রক্ষা করতে পারবে, সে ট্রেনিং তুমি পেয়েছ। আর আমার কথা ভেবো না, আমি ভুলিনি শালার বেড়াগুলোই আমার আসল শত্রু।

চোখে নাইটফাইন্ডার তুলে ট্রেনের সামনে তাকাল রানা, অন্ধকারে কোথাও কিছু নড়ে কিনা দেখছে।

‘ধরে নিচ্ছি, ওরা অপেক্ষা করছে,’ শুরু করল রিটা।

‘যমজ ভাইরা ভাবছে, কি ব্যাপার, স্টেশনে পৌছুনোর আগেই ট্রেন থামছে কেন, আলো নিভিয়ে দেয়ারই বা কারণ কি। বলো তো, কি আশা করছি আমি?’

উত্তর দিতে এক সেকেন্ড দেরি করল রিটা, ‘তুমি আশা করছ ব্যাপারটা কি জানার জন্যে ট্র্যাক ধরে এগিয়ে আসবে ওরা??

‘ওরা, কিংবা অন্তত ওদের একজন। আর ঠিক তাই আমার দরকার। শোনো। ওদেরকে সামলানোর পর কারেন্টের সুইচ অফ করব আমি, গেট খুলব, তারপর ফিরে আসব তোমার কাছে। তোমার কাজ হবে খুন করা…

‘কি!’

‘খুন অর্থ খুনই বোঝাচ্ছি,’ বলল রানা। ‘আমি চলে যাবার সাথে সাথে তুমি ধরে নেবে অন্ধকার থেকে এগিয়ে আসবে একজন, লুকিয়ে ক্যাবে ওঠার চেষ্টা করবে। কোন রকম ঝুঁকি নেবে না তুমি। গুলি করবে সরাসরি খুন করার জন্যে। একমাত্র আমাকেই শুধু ট্রেনে ফিরতে দেবে। ঠিক আছে?’

রাজি হলো রিটা, ‘হ্যাঁ।’

অটোমেটিক ডোর বাটনে চাপ দিল রানা, টারবাইন অফ করল। যেমন আশা করেছিল, কেবিনের দরজা সহজেই খুলে গেল। উঁকি দিয়ে তাকাল ও, লোহার খুদে ধাপগুলো নিচের দিকে নেমে গেছে।

রিটার দিকে ঘুরল ও, জানত না ওর পিছনে দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছিল রিটা, সরাসরি তার আলিঙ্গনের মধ্যে আটকা পড়ল। বাধা দেয়ার কথা ভাববার সুযোগও হলো না, পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে উঁচু হলো রিটা, চুমু খেলো রানার ঠোঁটে।

‘বিদায়চুম্বন না হলেই হয়,’ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল রানা।

‘এত হালকাভাবে নিলে?’ আহত হয়েছে রিটা। ‘ছেলে যখন যুদ্ধে যায়, মা তাকে চুমো খায় না? সব চুমোর মধ্যেই কি সেক্স থাকে, রানা?’

‘দুঃখিত,’ বলে রিটার মাথার চুল একটু এলোমেলো করে দিল রানা। ‘গেলাম তাহলে। যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব

নাইটফাইন্ডার অ্যাডজাস্ট করল ও, সবটুকু উজ্জ্বলতা আর রেঞ্জ দরকার এখন। রিটার দিকে মুখ করে দরজার কিনারা থেকে স্যাঁৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল নিচের দিকে। দ্রুত নামছে।

শেষ ধাপে অর্থাৎ ট্রেনের তলায় পৌঁছে গলাটা ক্রেনের মত বাঁকা করল রানা, ট্র্যাকের দূরত্ব আন্দাজ পাবার চেষ্টা করছে! অন্তত পনেরো ফুট নিচে ওটা। বিশাল আকারের কংক্রিট পিলার যেগুলোর ওপর ভর করে রয়েছে ট্র্যাক, আর ইলেকট্রিফায়েড বেড়ার মাঝখানে দূরত্ব যথেষ্টই বলা চলে-বারো ফুট।

শেষ ধাপটা শক্ত করে ধরে নিচের দিকে শরীরটা ছেড়ে দিল রানা। শূন্যে ঝুলছে, দুলছে সামান্য। অন্ধকার নিচেটা ঝাপসা মত, তবু নির্দিষ্ট একটা পয়েন্টকে টার্গেট ধরে নিয়ে ঝুলন্ত শরীরটাকে পজিশনে নিয়ে এল, লাফ দিল চোখ খোলা রেখে। নিচের মাটি সমতল এবং শক্ত। পতনটা রানার নিখুঁত হলো, শুধু হাঁটু জোড়া ভাঁজ হলো, হোঁচট খেলো না বা শরীরটাকে গড়িয়ে দিতে হলো না। মাটিতে পা স্পর্শ করা মাত্র হাতে চলে এসেছে অটোমেটিক, পরমুহূর্তে মূর্তি হয়ে গেল ও, স্থির এবং চুপচাপ, গিলসের ভেতর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, কান খাড়া।

কালো রাত অস্বাভাবিক শান্ত আর নিস্তব্ধ। বৃষ্টির পর মরু বিশেষ একটা গন্ধ ছড়ায়, মিষ্টি মিষ্টি সোঁদা আর নির্মল, তার সাথে ঠাণ্ডা বাতাস-জুড়িয়ে গেল প্রাণ। সামনে কোন নড়াচড়া নেই। পিস্তলটা ঊরুর সাথে ঠেকিয়ে এগোতে শুরু করল রানা, ট্র্যাকের উঁচু কংক্রিট অবলম্বনগুলোর কাছাকাছি থাকল, খানিকটা স্বস্তির সাথে লক্ষ করল পিলারগুলোর গায়ে পা ফেলার খুদে ধাপ রয়েছে, প্রতি তিনটে পিলারের একটায়, সম্ভবত মেইন্টেন্যান্স-এর জন্যে।

মাঝে মধ্যে থামল রানা, শব্দ হয় কিনা শোনার আর একটানা কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকানোর জন্যে। হাঁটল বিড়ালের মত নিঃশব্দে, দশ মিনিটের মধ্যে সামনে পরিষ্কার দেখা গেল মরু ডিপো।

স্টেশনের আলো নিভিয়ে রেখেছে ওরা, উদ্দেশ্য ট্রেনের ড্রাইভারকে অসুবিধের মধ্যে ফেলা। এখন রানা সামনে নড়াচড়ার আভাস পাচ্ছে। দীর্ঘ একটা মূর্তি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে, যতটা সম্ভব পিলারের কাছাকাছি রয়েছে! লোকটার কাছে একটা শটগান রয়েছে, তৈরি অবস্থায়, পেশাদার ভঙ্গিতে শরীর থেকে দূরে, কাঁধের মাত্র কয়েক ইঞ্চি সামনে বাঁট, ব্যারেল নিচের দিকে নামানো।

পাশে সরে এল রানা, একটা পিলারের গায়ে সেঁটে গেল। একটু পরই প্রতিপক্ষের আওয়াজ শুনল ও, কোন সন্দেহ নেই লোকটা এক্সপার্ট, কারণ শব্দ আসছে শুধু নিয়ন্ত্রিত নিঃশ্বাস পতনের।

রানাকে দেখেনি, সম্ভবত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করে দিল তাকে। রানার পিলারের কাছ থেকে এক ফুট দূরে থাকতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, কান পাতল, পিছন ফিরছে। শটগানের ব্যারেলটা দেখতে পেল রানা।

নড়ে ওঠার আগে লোকটাকে পিলারের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দিল ও। যখন নড়ল, ভঙ্গি আর গতিটাকে শুধু কেউটের ছোবলের সাথেই তুলনা করা চলে, এ-ধরনের আঘাত আর মৃত্যু সমার্থক। ভারী অটোমেটিকটা শক্তভাবে ধরা ছিল রানার ডান হাতে। হাতটা পিছিয়ে আনল, তারপর সবটুকু শক্তিতে আঘাত করল এম.আর. নাইন। অন্ধকারের ভেতর থেকে আঘাতটা আসছে, কিভাবে যেন টের পেয়ে গেল প্রতিপক্ষ। টের পেল, কিন্তু সরে যাবার সুযোগ হলো না, তার আগেই কানের নিচে আঘাত করল ভি-পি-সেভেনটির ব্যারেল।

হিস্ শব্দে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে গেল বাতাস, পতন শুরুর সাথে সাথে গোঙানির আওয়াজও শোনা গেল। মাটিতে পড়ার আগেই লোকটার জ্যাকেট ধরে ফেলল রানা, কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। কাঁটাতারের ঘন বুনন থেকে চোখ ধাঁধানো নীল আলো বিচ্ছুরিত হলো, লোকটার অজ্ঞান শরীরকে ঘিরে। ইলেকট্রিফায়েড তার শরীরটাকে নিয়ে খেলল কিছুক্ষণ, বলা যায় প্রায় নাচিয়ে ছাড়ল।

মাংস-পোড়া গন্ধে বমি পেল রানার। কয়েক মুহূর্ত পর স্থির হয়ে গেল দেহটা, বেড়া থেকে খসে গিয়ে পড়ে থাকল মাটিতে। শটগানটা, একটা উইনচেস্টার পাম্প, রানার দু’পায়ের প্রায় মাঝখানে পড়ে আছে।

দৃশ্যটা দেখার সময় চোখে নাইটফাইন্ডার থাকলেও, বেড়ার বৈদ্যুতিক আগুন তার খানিকটা রেশ রেখে গেল রানার চোখে। বিস্ময়ের ধাক্কাটা কখন কাটিয়ে উঠেছে নিজেও বলতে পারবে না ও। ঘন ঘন চোখ পিট পিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার, করে নিল। তারপর এক হাঁটু ভাঁজ করে তুলল উইনচেস্টারটা, হোলস্টারে চালান করে দিল ভি-পি-সেভেনটি।

পাম্প অ্যাকশন উইনচেস্টার লোড করা রয়েছে। ওটা হাতে নিয়ে সিধে হচ্ছে রানা, পঞ্চাশ ফুট সামনের ট্র্যাক থেকে চিৎকার করল এক লোক।

ভাই? কি হলো, ভাই? ব্যাটা কাবু হয়েছে?’

অপর গার্ড, নিহত লোকটার যমজ ভাই, পিলার আর বেড়ার মধ্যবর্তী সরু পথটা ধরে এগিয়ে আসছে, থপ থপ আওয়াজ হচ্ছে পায়ের। আগুনের ঝলক আর আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এসেছে সে। উইনচেস্টারটা তুলল রানা, মাজু তাক করল এগিয়ে আসা লোকটার বুক বরাবর, বলল, ‘ওখানেই দাঁড়াও। অস্ত্রটা ফেলো। তোমার ভাই গেছে। থামো, তা না হলে তুমিও যাবে।

থামল লোকটা, তবে রানার আওয়াজ আকাজ করে উইনচেস্টার তোলার জন্যে। প্রথম গুলিটা আসার আগেই একটা পিলারের আড়ালে সরে এল রানা, পিলারের আরেক কোণ থেকে উঁকি দিল, আবার শটগান তুলল লোকটার দিকে।

লোকটা যেন খেপে উঠেছে। এলোপাতাড়ি গুলি করল সে, সেই সাথে ছোট ছোট লাফ দিয়ে এগিয়ে এল, বোধহয় আশা করছে ভাগ্যগুণে লক্ষ্যভেদ করবে। একটাই গুলি করল রানা, নিচের দিকে। মনে হলো হ্যাঁচকা টানে লোকটার পা টেনে নেয়া হলো পিছন দিকে, মুখ থুবড়ে পড়ল সে। বেশ কয়েক সেকেন্ড ফোঁপাল, তারপর আর কোন শব্দ নেই।

নিহত লোকটাকে সার্চ করল রানা। চাবি না পেয়ে সাবধানে সামনে এগোল ও, জানা নেই মরু ডিপোর নিরাপত্তা বিধানে ব্যাকআপ টীম হিসেবে ঝানের আরও লোক আশপাশে আছে কিনা।

দ্বিতীয় লোকটার জ্ঞান নেই, তবে বাঁচবে। একটা গুলিতে তার দুটো পা-ই জখম হয়েছে, রক্তও বেরুচ্ছে প্রচুর, তবে হাড় গুঁড়ো হয়নি বা কোন শিরা থেকে রক্ত ছিটকে বেরুচ্ছে না।

তাকেও খুঁটিয়ে সার্চ করল রানা। চাবি নেই। হতে পারে ট্রেন আসছে শুনে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল ওরা, ব্লকহাউসে চাবি রেখেই বেরিয়ে এসেছে। রানার মনে আছে, ছোট্ট ওই ব্লকহাউস থেকে ইলেকট্রিফায়েড বেড়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নাকি চাবি আর কারও কাছে আছে, রানা আর রিটাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে অপেক্ষা করছে তারা?

লাইনের শেষ মাথায় পৌছুতে প্রচুর সময় নিল রানা। চলার পথে রিলোড করল উইনচেস্টার। নিচু বিল্ডিংটা সারাক্ষণ ধরে রাখল চোখে।

চারদিক নিস্তব্ধ। প্ল্যাটফর্মে পৌঁছুল রানা। কোথাও কিছু নড়ছে না! মোটর র‍্যাম্পটা প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত বিস্তৃত, মনো-রেলের সাথে সংযোগ পাবার জন্যে তৈরি।

বিল্ডিঙের গা ঘেঁষে থাকল রানা, অন্ধকারের ভেতর, চারদিকে লক্ষ রাখছে। কোথাও কিছু নেই।

অবশেষে আড়াল থেকে বেরুল রানা, হন হন করে ব্লকহাউসের দিকে এগোল। আলো জ্বলছে ওদিকে। গোটা তল্লাট জনমানব শূন্য, বেড়ার ভেতর বা বাইরের মরুভূমিতে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই।

বড় ফিউজ বক্স আর মেইন সুইচবোর্ডের কাছে, টেবিলের ওপর রয়েছে চাবির গোছাটা। মাস্টার সুইচ অফ করল রানা, আগেই হাতে চলে এসেছে চাবি, ব্লকহাউস থেকে বেরিয়ে এসে বিদ্যুৎ আছে কিনা নিশ্চিত হবার জন্যে কাঁটাতারের গায়ে উইনচেস্টার ঠেকাল, তালা খুলল মেইন গেটের, কবাট জোড়া যতটা পারা যায় খুলল, যাতে সরাসরি ট্রেন থেকে নেমেই বেরিয়ে যেতে পারে স্যাব।

ভাগ্য সহায় হলে, অ্যামারিলোয় পৌঁছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে টেলিফোন করতে এক ঘণ্টার বেশি লাগবে না ওদের।

ফিরতি পথটুকু একছুটে পেরিয়ে এল রানা। আহত গার্ড এখনও বেহুঁশ, তবে সামান্য গোঙাতে শুরু করেছে। তার ভাই নিঃসাড় পড়ে আছে, মাংস আর কাপড় পোড়া গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে।

সামনে, ওর ওপর দিকে, অবশেষে ট্রেনটা দেখতে পেল রানা। লম্বা ট্রেনের একটা দিক প্ল্যাটফর্মের কিনারা থেকে যেন ঝুলছে। ট্র্যাক আর ট্র্যাকের পাশে কার্নিস অর্থাৎ প্ল্যাটফর্ম দাড়িয়ে রয়েছে পিলারের ওপর, পিলারের কিনারা আর রেলের মাঝখানে কার্নিসটা তিন কি চার ফুট চওড়া, নিরেট ইস্পাতের ওপর কংক্রিটের মোটা স্তর দিয়ে তৈরি। না থেমে, সবচেয়ে কাছের লোহার ধাপে পা রাখল রানা, তর তর করে উঠে পড়ল প্ল্যাটফর্মে।

ছুটল রানা কার্নিস ধরে, এক সময় সামনে উঁচু টাওয়ার হয়ে উঠল ট্রেনের সামনেটা। ট্র্যাক আর কার্নিস ঢেকে ফেলেছে ট্রেন, হাঁটু গেড়ে বসে নিচের দিকে উঁকি দিল ও, মনো-রেলের পাশটা দেখল। ক্যাবের দরজা এখনও খোলা, দরজা নিচ থেকে লোহার ধাপগুলো নেমে গেছে মাটির দিকে। ওই ধাপ বেয়েই নেমেছিল রানা।

কিন্তু ট্রেনের সামনে থেকে ধাপগুলোর নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। ট্রেনের নাকের বাঁ কিনারা ঘেঁষে বসল রানা, লম্বা করে দিল একটা হাত। না, সম্ভব নয়, নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে ধাপগুলো।

মাটি থেকে ট্রেনে ওঠা সম্ভব নয়, কারণ প্রথম ধাপটা পনেরো ফুট ওপরে। ট্রেনের সামনে থেকে ধাপ লক্ষ্য করে লাফ দিতে পারে রানা, কিন্তু যদি মুঠোর ভেতর একটাকে ধরে রাখতে না পারে তো তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করার মত ব্যাপার হবে সেটা।

রিটাও ওকে এই সমস্যায় কোন সাহায্য করতে পারবে না।

অগত্যা ভাল করে দেখেশুনে লাফই দিল রানা। প্রতিটি লোহার ধাপ ইংরেজী ডি অক্ষরের আকৃতি নিয়ে রয়েছে, একটা ধাপ ডান হাতের মুঠোয় চলে এল, আরেক হাতের তালু ঠেকল ধাপের গায়ে। দুটো হাত ধাক্কা খেলো পরস্পরের সাথে, ডান হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে গেল লোহার ধাপ।

পড়ে যাচ্ছে রানা, ডান হাত মাথার পিছনে বাতাসে খাবলা মারছে। বুকের সাথে ঘষা খেলো ধাপটা, বাঁ হাতের মুঠোর ভেতর শক্ত করে ধরল রানা সেটা। ঝুলে পড়ল শরীর, ঝাঁকি খেলো প্রচণ্ড, মনে হলো কাঁধ থেকে ছিঁড়ে যাবে বাম হাত। এক কি দু’সেকেন্ড দোলা খেলো ও, ইতিমধ্যে ডান হাত দিয়েও ধরে ফেলেছে ধাপটাকে। আরও এক সেকেন্ড সময় নিল দম ফিরে পেতে। তারপর উঠতে শুরু করল ক্যাবের দিকে।

দরজার খোলা মুখের কাছে মুখ তুলে ডাকল রানা, ‘সাবধান, গুলি কোরো না, আমি রানা। কোন বাধা নেই, চলো বেরিয়ে যাই।’ ক্যাবে উঠে পড়ল ও, একটু হাঁপাচ্ছে।

কেবিনে রিটা নেই। আবার তাকে ডাকতেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

লাফ দিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে চলে এল রানা, লাইটের সুইচ অন করল। গোটা ট্রেন উজ্জ্বল আলোয় হেসে উঠল, এবং ঠিক তখুনি কেবিনের দরজা অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধ হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে ম্যানুয়্যাল হাতলটা ঘোরাল রানা, কোন লাভ হলো না।

ঘুরে দাঁড়াল রানা, আবার একবার রিটার নাম ধরে ডাকল। ভেহিকল কমপার্টমেন্টের দিকে রওনা হবার আগে পিস্তলটা হাতে নিল ও। যেমন রাখা ছিল তেমনি রয়েছে স্যাব। অথচ রিটার কোন ছায়া পর্যন্ত নেই কোথাও। বোকার মত এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল রানা, আর ঠিক তখুনি কেবিনের অপর দরজাটা ভোজবাজির মত বন্ধ হয়ে গেল দড়াম করে।

‘রিটা?’ চিৎকার করল রানা। ‘কোথায় তুমি? ওরা কি তোমাকে…?’

‘ইয়েস, মি. রানা, দেহহীন একটা অদৃশ্য কণ্ঠস্বর জবাব দিল। ঠিক ধরেছেন, মি. মাসুদ রানা। আপনি যেমন, তেমনি মিসেস লুগানিসও আর পালাতে পারছেন না। ও-সব বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে বরং সুস্থির হবার চেষ্টা করুন। বেশ বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে আপনার বিশ্রাম দরকার, মি. রানা।’

গলাটা চিনতে পারল রানা, পিয়েরে ল্যাচাসির, সরু আর কর্কশ, বেরিয়ে এল লাউডস্পীকার সিস্টেম থাকে। আরেকটা বিস্ময় আবিষ্কার করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ওর।

বাতাসে কিসের যেন একটা গন্ধ। মিষ্টি, কিন্তু নাকে ঝাঁঝাল লাগল। তারপরই হালকা মেঘ দেখতে পেল রানা। মেঝের খুদে গ্রিল থেকে একটু একটু করে বেরুচ্ছে-গ্যাস। বুঝতে কিছুই বাকি থাকল না আর।

মনে হলো যেন পাশে দাঁড়িয়ে নিজের আচরণ লক্ষ করছে রানা। অদ্ভুত একটা নির্লিপ্ত ভাব বাসা বাঁধল মনে। নড়াচড়া করতে পারছে, কিন্তু গতি খুবই মন্থর। সিদ্ধান্ত নিতে প্রচুর সময় বেরিয়ে গেল। অক্সিজেন! হ্যাঁ, তাই তো, অক্সিজেন! অক্সিজেন আছে ওর কাছে।

গাড়িতে আছে। প্যাসেঞ্জার সীটের তলায়, একটা সিলিন্ডারে।

এগোবার চেষ্টা করল রানা, মনে হলো ওর চারপাশে সব কিছু দুলছে। বিড়বিড় করে চলেছে ও, অক্সিজেন, অক্সিজেন…,’ বারবার।

স্যাবের দরজার দিকে হাত বাড়াল রানা, হাতল ঘুরিয়ে খুলে ফেলল। শরীরটা টলছে। দরজার ভেতর মাথা গলাবার জন্যে ঝুঁকল সামনের দিকে, পড়ে গেল।

পতনটা যেন অন্তহীন, অনন্তকাল ধরে নেমে যাচ্ছে ও। ওর চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে দুনিয়া। চেতনা হারাবার আগে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখল না।