আবার উ সেন – ১.৬

ছয়

কেনসিংটন সেফ হাউসে দু’জনেই ওরা কিছু সঙ্কেত শিখেছে, ঠিক এ-ধরনের পরিস্থিতিতে কাজে লাগবে। যে লোকটা কথা বলল সেই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে মোটা আর লম্বা, তার দিকে চোখ রেখে মাথার মাঝখানটা চুলকাল রানা, খুক করে কাশল একবার। এসব সঙ্কেতের অর্থ করল রিটা— ‘এই মোটা লোকটাই লীডার, ওর কথামত চলো, তবে আমি কি করি লক্ষ রাখবে।’

কোন ঝামেলা নয়, বুঝেছেন তো, স্যার?’ লোকটা রানার চেয়ে ইঞ্চি কয়েক লম্বা হবে, পেশীবহুল শরীর, ওয়েট-লিফটারদের মত ব্যারেল আকৃতির বুক। বাকি দু’জনও কম যায় না, এক একটা অসুর। পেশাদার গুণ্ডা, ভাবল রানা, পেশাদার এবং অভিজ্ঞ।

গরিলাটাই রানার কাছ থেকে কামরার চাবি নিল। শান্তভাবে দরজার তালা খুলল সে, সতর্কতার সাথে একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দু’জনকে কামরার ভেতর ঢোকাল। পিছন থেকে পিঠে কয়েকটা ধাক্কা খেলো রানা, ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল ও, চেয়ারের হাতলের সাথে ওর হাতজোড়া চেপে ধরা হলো, কঠিন চাপ পড়ল কাঁধে। একই ব্যবহার রিটার সাথেও করা হলো।

এতক্ষণে চতুর্থ লোকটাকে দেখতে পেল রানা, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে নিচের রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। ওরা ভেতরে ঢোকার আগে থেকেই লোকটা ছিল কামরায়। দেখার সাথে সাথে তাকে চিনতে পারল রানা। একহারা গড়ন, শরীরে মেদ বলে কিছু নেই, পেশী ফোলা না হলেও ইস্পাতের মত শক্ত। গোঁফ জোড়া দর্শনীয়, সাধারণত সামরিক অফিসারদের মুখে এ-ধরনের দেখা যায়। গাঢ় মেরুন রঙের ডিনার জ্যাকেট পরে আছে। হোটেলে প্রথমবার ঢোকার সময় রানার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল লোকটা, সোনালি বর্ডার দেয়া একটা ভিজিটিং কার্ড গুঁজে দিয়েছিল ওর হাতে, নিজের পরিচয় দিয়েছিল জিনোস মিলিয়ট বলে। তাড়াহুড়ো করে বলেছিল, সাংবাদিকদের সাথে এয়ারপোর্টেও ছিল সে, কিন্তু প্রফেসরের সাথে প্রিন্ট সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে চায়। কোন ক্যাসিনো বা অন্য কোথাও মদ্যপানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে রানা, ধরে নিয়েছিল লোকটা সাংবাদিকই হবে, ওর সাক্ষাৎকার নিতে উৎসাহী।

এখন রানার মনে পড়ল, লোকটা কিন্তু কোন পত্রিকার নাম করেনি। কার্ডটাও ভাল করে দেখা হয়নি ওর পকেটে রেখে দেয়ার পর ওটার কথা ভুলে গিয়েছিল। এক রাত বিশ্রাম নিয়ে তারপর কারও সাথে কথা বলার কথা ভাববে ও, এ-ধরনের একটা উত্তর দিয়ে লোকটাকে এড়িয়ে গিয়েছিল।

‘তাহলে, প্রফেসর,’ বলল লম্বা-চওড়া লোকটা, কামরার মাঝখানে পজিশন নিয়ে রানার ভি-পি-সেভেনটি বার বার শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফছে সে, যেন নুড়ি পাথর নিয়ে খেলা করছে একটা গরিলা। ‘সাথে একটা আগ্নেয়াস্ত্রও রাখেন আপনি! কিভাবে এটা ব্যবহার করতে হয়, জানা আছে তো?’

গাল ফুলিয়ে মুখ থেকে বিস্ময়সূচক একটা ধ্বনি উগরে দিল রানা, প্রফেসরের ভূমিকায় নিখুঁত উৎরে গেল, ধ্বনিটার অর্থ হতে পারে ভয়ানক রেগে গেছেন তিনি। ‘অবশ্যই ওটা আমি ব্যবহার করতে জানি,’ জোর গলায় বলল সে। অপমানে কাঁপছেন যেন প্রফেসর। ‘আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, যুদ্ধের সময়…’

‘কোন্ যুদ্ধ হতে পারে সেটা, ফ্রেন্ড?’ রানার পিছন থেকে আরেক গুণ্ডা প্রশ্ন করল, রানার কাঁধ ধরে আছে সে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ?’

‘জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীতে আমি একজন অফিসার ছিলাম!’ গর্বের সাথে বলল রানা। ‘লেবাননে আমি যে অ্যাকশন দেখেছি, তোমরা…’

‘লেবানন থেকে শান্তিবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে অনেক বছর আগে, দোস্ত,’ লম্বা-চওড়া গরিলা বাধা দিল রানাকে, হাতের ভি-পি-সেভেনটির ওজন অনুভব করল সে, রানার মুখের একেবারে সামনে। ‘এখানে এটা অত্যন্ত মারাত্মক একটা অস্ত্র, একেবারে অত্যাধুনিক। জানতে পারি, কেন এটা আপনি সাথে রেখেছেন?

‘প্রোটেকশন!’ প্রফেসরসুলভ ঝাঁঝ আর অধৈর্যের সাথে বলল রানা।

হ্যাঁ, আমিও তাই ধরে নিয়েছি। কিন্তু কার, কিসের বিরুদ্ধে প্রোটেকশন?’

‘চোর। গুণ্ডা। আপনাদের মত মাস্তান। যারা আমাদের জিনিস চুরি করতে চায়…’

‘হেনরি ডুপ্রে, আর কবে তুমি ভদ্র আচরণ শিখবে বলো তো?’ সংযত, ঠাণ্ডা গলায় করা হলো প্রশ্নটা, জানালার কাছ থেকে। ‘আমরা আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি, প্রফেসর লুগানিসকে অপমান করার জন্যে নয়। মনে নেই?’

আপনাদের জিনিস চুরি করব? কি বলছেন! যেন আকাশ থেকে পড়ল গরিলা অর্থাৎ হেনরি ডুপ্রে, হঠাৎ করে বিনয়ের অবতার বনে গেল সে, চেহারায় ভদ্রতার মুখোশ। ‘আমরা জানি আপনারা কিছু পিকচার রেখেছেন, কিন্তু সেগুলো…না-না, চুরি করতে যাব কেন…ছি-ছি!’

‘পিকচার?’

‘হ্যাঁ, পিকচারই তো বলে, নাকি…’

‘প্রিন্টস, ডুপ্রে,’ জানালার সামনে দাঁড়ানো লোকটা এবার আরও যেন ভারী আর কর্তৃত্বের সুরে বলল কথাটা।

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, প্রিন্টস। থ্যাঙ্কস, মি. মিলিয়ট।’ রানার দিকে তাকাল হেনরি ডুপ্রে। ‘হো-কি-যেন এক লোকের কিছু প্রিন্টস রেখেছেন আপনি।’

‘হোগার্থ, ডুপ্রে,’ রাস্তা থেকে চোখ না তুলে বলল জিলোস মিলিয়ট।

‘হ্যাঁ, কিছু হোগার্থ প্রিন্টের মালিক আমি,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল রানা। ‘মালিক হওয়া আর কাছে রাখা দুটো একই ব্যাপার নয়।

‘আমরা জানতে পেরেছি, ওগুলো আপনি এখানে রেখেছেন,’ কৃত্রিম ধৈর্যের সাথে বলল হেনরি ডুপ্রে। ‘হোটেলের সেফে।’

জিলোস মিলিয়ট এতক্ষণে জানালার দিকে পিছন ফিরল, সরাসরি তাকাল রানার দিকে। রানা এতক্ষণে টের পেয়েছে, চারজনের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বিপজ্জনক। চেহারায় শান্ত এবং সংযত ভাব থাকলেও কর্তৃত্বের সাথে হিংস্র একটা ভাব লুকাতে পারেনি। ‘আসুন, ব্যাপারটাকে সহজ করা যাক। আপনাদের দুজনের কাউকেই আমরা দুঃখ বা ব্যথা দিতে চাইছি না। আমরা শুধু চাইছি আপনারা পরিস্থিতিটা বুঝুন। আমরা এখানে মি: মলিয়ের ঝানের প্রতিনিধিত্ব করছি, যিনি ওই হোগার্থ প্রিন্টগুলো দেখতে চান। বলতে পারেন এটা তাঁর একটা আমন্ত্রণ। কিন্তু সাড়া পাবার জন্যে কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে প্রস্তুত নন তিনি 1 আপনি তাঁর কার্ড পেয়েছেন-লবিতে যেটা আপনাকে দিয়েছিলাম। আমার ধারণা, তিনি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিতে চান…’

জিভ আর টাকা সহযোগে টকাস্ করে একটা বিচ্ছিরি আওয়াজ করল হেনরি ডুপ্রে। ‘এমন একটা প্রস্তাব, আপনি প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না, প্রফেসর…’

জিলোস মিলিয়ট কৌতুকে অংশগ্রহণ করল না। ‘আহ্, ডুপ্রে, চুপ করো! প্রস্তাবটা সরাসরি, প্রফেসর। আপনি শুধু ফ্রন্ট ডেস্ককে ফোনে বলবেন প্রিন্টগুলো যেন ওপরে পাঠিয়ে দেয়, তাহলেই আমরা রওনা হয়ে যেতে পারি।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘তা সম্ভব নয়,’ মৃদু হেসে বলল ও। ‘মোট দুটো চাবি-একটা আমার কাছে, অপরটা ওদের হাতে। ব্যাংকের মত। প্রিন্টগুলো একটা সেফটি ডিপোজিট বক্সে আছে,’ মিথ্যে বলল ও। ‘শুধু ডিউটি অফিসার আর আমি ছাড়া কেউ ওগুলোয় হাত দিতে পারবে না। এমনকি আমার স্ত্রীও পারবেন না…’

পরম স্বস্তির সাথে নিজেকে ধন্যবাদ দিল রানা, ভাগ্যিস শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টেছিল। প্রিন্টগুলো নিয়ে নিচতলায় নামার সময় বুদ্ধিটা আসে মাথায়। হোটেলের সেফে রাখার চেয়ে স্যাব-এর গোপন কমপার্টমেন্টে রাখা অনেক বেশি নিরাপদ, এবং সুবিধেও অনেক, যদি হঠাৎ করে কেটে পড়তে হয়।

‘মি. মিলিয়ট যেমন বললেন,’ চাঁছাছোলা, অমার্জিত সুরে বলল হেনরি ডুপে, ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়েছে, ‘কাউকে আমরা ব্যথা দিতে চাই না। কিন্তু আপনি যদি অসহযোগিতা করেন, জন আর টনি-,’ রানার কাঁধ আর কব্জি ধরে থাকা লোক দু’জনকে ইঙ্গিতে দেখাল সে, ‘-আপনার প্রিয় সঙ্গিনীর ওপর জুলুম করবে।’

জানালার কাছ থেকে সরে এল জিলোস মিলিয়ট। হেনরি ডুপ্রেকে চক্কর দিয়ে একবার হাঁটল সে। ডুপ্রে এখনও ভি-পি-সেভেনটি নিয়ে খেলা করছে। রানার ঠিক সামনে থামল মিলিয়ট। ‘প্রফেসর গ্রেগ লুগানিস। আমার পরামর্শ, আপনি আর ডুপ্রে নিচতলা থেকে একবার ঘুরে আসুন। আপনারা প্রিন্টগুলো নিয়ে ফিরে আসবেন। তারপর আমরা সবাই কেনেডি এয়ারপোর্টে চলে যাব। বিশেষ করে আপনার জন্যে মি. মলিয়ের ঝান তাঁর প্রাইভেট জেট পাঠিয়েছেন। তিনি আশা করেছিলেন আজ রাতের ডিনারে আপনি তাঁকে সঙ্গ দেবেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাঁর সাথে ডিনার খাওয়ার সৌভাগ্য আজ রাতে আপনাদের হবে না। তবে রাতটা আপনারা র‍্যাঞ্চে বিশ্রাম নিতে পারবেন।’ কামরার চারদিকে তাচ্ছিল্যের সাথে তাকাল সে। ‘কথা দিচ্ছি এই নোংরা জায়গার চেয়ে অনেক বেশি আরামে থাকবেন আপনারা। এবার বলুন, আমার পরামর্শ কেমন লাগল আপনার?’

‘দেখুন, মিলিয়ট,’ রাগে কাঁপতে শুরু করল প্রফেসর লুগানিস। ‘আপনারা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন! আপনাকে আমি আগেই জানিয়েছি, আজ আমরা কারও সাথে কোন কথা বলব না। আপনি সত্যি যদি ভদ্রলোকের প্রতিনিধি হন—কি যেন নাম বললেন তাঁর—মলিয়ের?’

শালা ন্যাকামো করছে,’ খেঁকিয়ে উঠল ডুপ্রে। ‘বোঝা গেল; সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। সাবধান, পণ্ডিতমশাই, বোকার মত কিছু করে বোসো না!’ দীর্ঘ পদক্ষেপে রিটা হ্যামিলটনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, ক্ষিপ্র একটা হাত নেড়ে তার কাপড় গলা থেকে কোমর পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলল, সেই সাথে পৃথিবীর সবাই জানল রিটা হ্যামিলটন কাপড়ের নিচে ব্রা পরে না।

‘সুন্দর,’ রুদ্ধশ্বাসে বলল জন, রানার ঘাড় আগের মতই ধরে আছে সে, রিটার দিকে তাকিয়ে আছে কাঁধের ওপর দিয়ে। ‘ভারি সুন্দর!’

‘থামো!’ নির্দেশ দিল মিলিয়ট। ‘এখুনি এতটা বাড়াবাড়ি করার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। দুঃখিত, প্রফেসর লুগানিস। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন, যাতে নেতিবাচক উত্তর পেতে না হয় তার ব্যবস্থা মি. মলিয়ের ঝান ঠিকই করে রাখেন। আর দেরি করার কোন মানে হয় কি? আপনার জিনিস-পত্র আমি সব গুছিয়ে নিই, সেই ফাঁকে ডুপ্রেকে সাথে নিয়ে নিচ থেকে ঘুরে আসুন। কেনেডিতে যত তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে পারব ততই ভাল…’

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘ঠিক আছে,’ শান্তভাবে বলল ও, একটু অন্যমনস্ক, কারণ সে-ও রিটা হ্যামিলটনের আংশিক উন্মুক্ত বুক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। ‘কিন্তু আমার স্ত্রী কাপড় বদলাবেন। প্রিন্টগুলো বেরিয়ে যাবার সময় নিলেই হবে…’

‘প্রিন্টগুলো আমরা এখুনি নেব,’ রায় ঘোষণার সুরে জানাল মিলিয়ট, তর্কের কোন অরুকাশ রাখল না। ‘প্রফেসরের অস্ত্রটা ওভাবে লোফালুফি কোরো না তো, ডুপ্রে। ক্লজিটে রেখে দাও ওটা, তোমার নিজের একটা আছে।

কোট থেকে ছোট একটা রিভলভার বের করল ডুপ্রে। সে যে নিরস্ত্র নয় এটা রানাকে দেখাবার পর অস্ত্রটা আবার রেখে দিল পকেটে। তারপর ভি-পি- সেভেনটিটা রাখল বেডসাইড টেবিলে।

মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত দিল মিলিয়ট, অপর দু’জন রানার কাঁধ আর কব্জি ছেড়ে দিল। হাতজোড়া আস্তে আস্তে নাড়ল রানা, যথাসম্ভব দ্রুত রক্ত চলাচল ফিরিয়ে আনতে চাইছে। একই সাথে খুক করে কাশল একবার, তারপর অস্তিত্বহীন একটা সুতো দু’আঙুলে ধরে কোটের আস্তিন থেকে ফেলে দিল। রিটাকে তৈরি হতে বলার সঙ্কেত। মিলিয়টের দিকে ফিরে জানাল ব্রীফকেসটা দরকার ওর।

‘আমার চাবি আছে ওতে।’ ইস্পাত আর ক্যানভাসের তৈরি কলাপসিবল র‍্যাকের দিকে ইঙ্গিত করল ও, ব্রীফকেসটা ওখানে।

এগিয়ে গিয়ে র‍্যাক থেকে ব্রীফকেসটা তুলল মিলিয়ট, ওজন অনুভব করল, ঝাঁকি দিল বার দুয়েক, সন্তুষ্ট হয়ে রানার হাতে ধরিয়ে দিল সেটা। ‘শুধু চাবি বের করুন, তারপর ডুপ্রের সাথে নেমে যান।

ব্রীফকেসটার বৈশিষ্ট্য হলো স্প্রিং বসানো একজোড়া সরু চোরাকুঠুরি। ঘর দুটো ডানদিকে, ভেতরের লাইনিং সেলাই করার পর সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে। খোলার বোতাম রয়েছে হাতলের সাথে, দুই প্রান্তে-হাতলের গায়ের সাথে এমনভাবে মিশে আছে যে খালি চোখে ধরা পড়বে না। বোতামে চাপ দিলে ছুরির হাতল ব্রীফকেসের তলা থেকে রানার হাতে বেরিয়ে আসবে, সাথে সাথে নয়, পাঁচ সেকেন্ড পর

ব্রীফকেসটা কোলের ওপর নেয়ার সময় পরিস্থিতি নিয়ে দ্রুত চিন্তা করল রানা। কোন সন্দেহ নেই জটিল সঙ্কটে পড়েছে ওরা। হোটেলের সেফটি ডিপোজিট বক্সে প্রিন্টগুলো নেই জানার পর গুণ্ডারা মরিয়া হয়ে উঠবে, অথচ স্যাব-এর রহস্য ফাঁস করতে রাজি নয় রানা। ঠাণ্ডা মাথায় হেনরি ডুপ্রেকে কাবু করার কথা ভাবল ও-নিচে নামার সময় বা গাড়ির কাছে পৌঁছুবার আগে এক- আধটা সুযোগ পাওয়া যাবেই। ছোট একটা বন্ধ জায়গায় চারজনকে সামলানোর চেয়ে খোলা জায়গায় একজনকে সামলানো অনেক সহজ। কিন্তু তারপর, রিটার কি হবে? ও যদি চিৎকার করে লোকও জড়ো করে, এমন কোন নিশ্চয়তা আছে কি গুণ্ডারা রিটার ক্ষতি করবে না? বিপদ দেখে তারা যদি প্রথমে রিটাকে মেরে ফেলে? না, এ-ধরনের ঝুঁকি নেয়া চলে না। বিকল্প উপায় এখানে এই মুহূর্তে চারজনের দিকে টেবিল উল্টে দেয়া, কিন্তু তাতেও সুফল আশা করা যায় না। রিটার ক্ষিপ্রতার ওপর ভরসা করা কি ঠিক হবে? চট করে একবার তার দিকে তাকাল রানা, পলকের জন্যে দু’জোড়া চোখ এক হতে টের পেল ও, রিটা তৈরি হয়ে আছে।

ওর সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছে মিলিয়ট, প্রথমে তার ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল। ব্রীফকেসের হাতলের ডান প্রান্তে চাপ দিল ও, কোন শব্দ হলো না। ব্রীফকেসের তলায় হাত রাখল, অপর হাত দিয়ে হাতলের ছোট্ট বোতামে চাপ দিল। পরমুহূর্তে ডান হাতে বেরিয়ে এল প্রথম ছুরির হাতল। আর মাত্র চার সেকেন্ড পর দ্বিতীয় ছুরিটা বেরুবে, কথাটা মনে রেখে নড়ে উঠল ও। মিলিয়টকে কাবু করা সম্ভব হলে, তারপরই সামলাতে হবে হেনরি ডুপ্রেকে, বাকি দু’জনকে পরাস্ত করতে হলে বিস্ময় আর তার সাথে ভাগ্যের সহায়তা পেতে হবে ওকে। গোটা ব্যাপারটা তিনটে জিনিসের ওপর নির্ভর করছে লক্ষ্য ভেদে শুর নিজের নৈপুণ্য, রিটার প্রস্তুতি, আর কত দ্রুত তৎপর হতে পারে গুণ্ডারা।

থ্রোয়িং, নাইফ এমন সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে, এমনকি একজন এক্সপার্টও তার ইচ্ছে মত অস্ত্রটাকে ব্যবহার করতে হিমশিম খেয়ে যায়। অকস্মাৎ যদি খুব দ্রুতও ছোঁড়া হয়, ছোঁড়ার ধরনটা নিখুঁত হলে, পৌঁছুবার মুহূর্তে ছুরির ফলা থাকবে টার্গেটের দিকে তাক করা অবস্থায়।

একান্ত যদি এড়ানো না যায় তাহলে আলাদা কথা, তা না হলে কাউকে মারাত্মকভাবে জখম করতে চায় না রানা। ও যা চাইছে তা করতে হলে লক্ষ্য তো অব্যর্থ হতেই হবে, সেই সাথে ধারাল ফলার আগে টার্গেটে পৌছুতে হবে হাতলের গোড়া। চেয়ারেই বসে থাকল ও, বলা যায় একটুও নড়ল না, শুধু শরীরের পাশ থেকে তীব্র ঝাঁকি খেলো ডান কব্জি। সম্ভাব্য সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রথম ছুরিটা ছুঁড়ে দিয়েই ব্রীফকেসের তলায় ফিরে এল আবার হাত, দ্বিতীয় ছুরিটা ডেলিভারী নিতে হবে।

প্রথম ছুরি বাতাসে শিস কেটে ছুটে গেল। মিলিয়টের দু’চোখের মাঝখানে ঠকাস করে বাড়ি খেলো হাতলের গোড়া। কি থেকে কি হলো বুঝল না সে, পিছন দিকে নিঃশব্দে ঝাঁকি খেলো মাথাটা। ছুরিটা মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে, সেটাকে অনুসরণ করল মিলিয়টের শরীর। রানা আর রিটা একই সাথে নড়ে উঠল।

দাঁড়াবার সময় পায়ের ধাক্কায় জনের দিকে চেয়ার ফেলে দিল রিটা. মিলিয়ট পড়ে যাচ্ছে দেখে অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল জন। হাঁটুতে চেয়ারের ধাক্কা খেলো সে, ইতিমধ্যে তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রিটা, পায়ের দ্বিতীয় ধাক্কায় চেয়ারটাকে জনের গায়ের ওপর চেপে ধরল সে। রানা শুধু চেয়ার আর জনের পতনের শব্দ পেল, ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ছুরিটা হাতে চলে এসেছে, শরীরটাও ঘুরিয়ে নিয়েছে ড্রপের দিকে

যতটা রানা আশা করেছিল তারচেয়ে দ্রুত বেগে সরে গেল ডুপ্রে, রানার ছুঁড়ে দেয়া দ্বিতীয় ছুরিটা ভাগ্যের জোরে তার ডান কানের পাশে লাগল।

যেন স্থির হয়ে যাওয়া সময়ের সাথে নিশ্চল মূর্তি হয়ে গেল ডুপ্রে, রিভলভার ভরা পকেটের দিকে হাতটা মাত্র অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছে। কানের পাশ থেকে অদৃষ্ট, ভঙ্গিতে পড়তে শুরু করা ছুরিটা, কান ছিড়ে প্রায় দু টুকরো করে। তার হাঁ করা মুখ থেকে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল, কেউ যেন তার গলা টিপে ধরেছে। কয়েকবার হোঁচট খেলো সে, কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে রিটা আর জনের ওপর পড়ে গেল-মেঝের ওপর ধস্তাধস্তি করছে ওরা।

রানার পিছনে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল টনি, হঠাৎ সে তৎপর হয়ে উঠল হাতের ব্রীফকেস ফেলে দিয়ে দু’পায়ের গোড়ালির ওপর দেহের সমস্ত ভার চাপিয়ে চেয়ার থেকে লাফ দিল রানা বেডসাইড টেবিলে পড়ে থাকা ভি-পি- সেভেনটি লক্ষ্য করে।

কারাতে যোদ্ধার মত উন্মত্ত, তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল রানার গলা থেকে, ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বের করে দিয়ে তিন কদম দূরত্ব আধসেকেন্ডেরও কম সময়ে পেরিয়ে এল। মুঠোর ভেতর চলে এসেছে পিস্তলের বাঁট, ট্রিগারের রিঙে আঙুল ঢুকছে, চরকির মত আধপাক ঘুরে গেল শরীরটা, দু’হাত সামনের দিকে বাড়ানো, বিপদ হয়ে প্রথম যে দেখা দেবে তাকেই গুলি করার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি।

টনির ডানহাত পকেটে মাত্র ঢুকেছে, রানা চিৎকার করে বলল, ‘হোল্ড ইট! স্টপ! বেঁচে থাকার সুবুদ্ধি হলো টনির। স্থির হয়ে গেল সে ডান হাতটা এক সেকেন্ডের জন্যে কাঁপল, তারপর রানার সাথে চোখাচোখি হতে-মেনে নিল নির্দেশ। পকেট থেকে হাত বের করে মাথার ওপর তুলল সে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ছেড়ে দেয়া স্প্রিঙের মত খাড়া হলো রিটা, দু’হাত এক করে জনের ঘাড়ে আঘাত করল। কোঁক করে উঠে নেতিয়ে পড়ল জন। ধীর পায়ে টনির সামনে হেঁটে এল রানা, মৃদু হাসছে, হাত বাড়িয়ে তার জ্যাকেটের পকেট থেকে বের করে নিল আগ্নেয়াস্ত্রটা, তারপর তার কানের পিছনে তীক্ষ্ণ একটা খোঁচ দিল দুই আঙুলে। বন্ধুদের সাথে অজ্ঞানতার অন্ধকারে যোগ দিল টনি, সেই সাথে গুণ্ডাদের অশুভ তৎপরতার আপাতত ইতি ঘটল।

‘কাপড় বদলাও, রিটা:’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা, তারপর মত পাল্টে, ‘না, আগে এদের ব্যবস্থা করি এসো।

দু’জন মিলে প্রথমে ওরা সবাইকে নিরস্ত্র করল। ভাব দেখে মনে হলো তার বুক যে প্রায় সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে এ-ব্যাপারে মোটেও সচেতন নয় রিটা। ব্রীফকেসের বিশেষ একটা কুঠরি হাতড়ে সীল করা ছোট একটা প্লাস্টিকের বাক্স বের করল রানা, খোলার পর দেখা গেল ভেতরে ক্লোরোফর্ম ভেজানো প্যাড রয়েছে। মেঝেতে পড়ে থাকা চারজনের নাকের সামনে প্যাড ধরা হলো। ‘খুব একটা কাজের জিনিস না হলেও, ট্যাবলেট গেলানোর চেয়ে কাজটা সহজ;’ বলল রানা। ‘এ-ধরনের ইমার্জেন্সির জন্যেই সাথে রাখা। পুরানো, পরীক্ষিত পদ্ধতি-প্রায়ই সেরা প্রমাণিত হয়। অন্তত আধঘণ্টার জন্যে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি আমরা।’

চারজনের হাত আর পা বাঁধা হলো তাদেরই বেল্ট, টাই আর রুমাল দিয়ে। তখনই লক্ষ্য করল রিটা রানার ছুরি ডুপ্রের কানের কি অবস্থা করেছে। কানের ওপরের আধ ইঞ্চি দু’ফাঁক হয়ে গেছে, তারপর লতির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা গভীর ক্ষত। ব্রীফকেসটা যেন আলাউদ্দীনের চেরাগ, ভেতর থেকে নীল রঙের একটা শিশি বের করে ক্ষতটায় ওষুধ লাগাল রানা বাথরুমের কাবার্ড থেকে পাওয়া স্টিকিং প্লাস্টার দিয়ে ব্যান্ডেজ করল রিটা।

অবশেষে রিটা খেয়াল করল সে অর্ধনগ্ন, যদিও কোন রকম লজ্জা না পেয়ে শুধু আঁটসাঁট সাদা ব্রিফস্ ছাড়া বাকি সবকিছু খুলে ফেলল সে, পা দিয়ে গলিয়ে কোমরে তুলল একজোড়া জিনস। গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে, এই ফাঁকে ওদের জিনিস- পত্র সুটকেস আর ব্যাগে ভরতে শুরু করল রানা। হঠাৎ করেই সোনালি কিনারা বিশিষ্ট ভিজিটিং কার্ডটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। হোটেলের লবিতে ওকে দিয়েছিল জিলোস মিলিয়ট। কার্ডটা বের করে পরীক্ষা করল ও।

কার্ডের মাথার দিকে প্রতীক চিহ্নের মত ছাপা রয়েছে একটা সন্ন্যাসীর মূর্তি। তার পাশে দুটো খুদে ইংরেজী অক্ষর-এস.এম.। নিচের প্রথম লাইনে ক্যাপিটাল লেটারে ছাপা হয়েছে নামটা মলিয়ের ঝান। নামের নিচে, ছোট ছোট ক্যাপিটাল লেটারে লেখা: অনট্রাপ্র্যানার-অ্যামারিলো, টেক্সাস।

কার্ডের পিছনে টানা হাতে একটা মেসেজ লেখা রয়েছে:

‘প্রফেসর এবং মিসেস লুগানিস,

‘দিন কয়েক আমার অতিথি হয়ে আমাকে সম্মানিত করুন। হোগার্থগুলো সাথে করে আনবেন। আপনার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। আমার সিকিউরিটি ম্যানেজার, জিলোস মিলিয়টকে সব বলা আছে, সে আপনাদেরকে কেনেডিতে নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা করবে। ওখানে আমার জেট আছে।-মলিয়ের ঝান।’

মেসেজের পর বিশেষ দ্রষ্টব্যও আছে-ওরা যেন তাড়াতাড়ি অতিথি হতে রাজি হয়, তা না হলে ডিনার হারাবে। সবশেষে একটা টেলিফোন নম্বর দেয়া হয়েছে, যদি কোন সমস্যা দেখা দেয়।

কার্ডটা রিটার হাতে ধরিয়ে দিল রানা। ‘চলো তাহলে, অ্যামারিলোতেই যাওয়া যাক। গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভাল, ওরা আশা করছে না। দেখে নাও, তোমার সব জিনিস নেয়া হয়েছে তো?’

রিটার চেহারায় সন্দেহ এবং উদ্বেগ দেখতে পেল রানা। ‘তোমার আগে তোমার দুর্নাম পৌঁছে যাবে, রানা।’

‘বুড়ো লুগানিস ছুরি ছুঁড়তে পারে, দু’একটা কারাতে মার জানে-সে-কথা বলছ?’ লীফকেসের গোপন কুঠরিতে ছুরি ভরছে রানা।

‘হ্যাঁ।’

এক মুহূর্ত ভাবল রানা। ‘ঝান আমাদের পিছনে লেগেছে। এখন সে জানবে আমরা মোমের তৈরি পুতুল নই। তার কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখার আগ্রহ বোধ করছি। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।’

চারজনের দিকে তাকাল রিটা। ‘ওদের কি হবে? পুলিসকে জানাবে?’

‘এখুনি কোন রকম হৈ-চৈ বাধানো ঠিক হবে না।

‘হোটেলের বিল?’

হাসল রানা। পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করে দেখাল রিটাকে। এর মধ্যে চাবি আর কিছু টাকা আছে, লন্ড্রিরূমে রেখে যাব-আগেই দেখেছি, ওটা খোলা রাখে ওরা। ভাগ্যটা ভালই বলতে হবে, আমাদের দরজায় পুরানো আমলের তালা রয়েছে-চাবি ছাড়া ভেতর থেকে খোলা যাবে না। ফোন করে ডেস্ককে জানাবে না, স্বাভাবিক কারণেই। কাজেই ঘর থেকে বেরুতে যথেষ্ট সময় লাগবে ওদের।’

‘ওদের পকেটে চাবি পেয়েছ…?’

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘ডুপ্রের পকেটে। রূমসার্ভিসকে ঘুষ দিয়ে হাতিয়েছিল, বোঝা যায়। চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামব আমরা।’