আবার উ সেন – ২.১১

এগারো

বান্না বেলাডোনার হাতে রানার অটোমেটিক, সরাসরি ঝানের মাথার দিকে তাক করে ধরে আছে সে। দুর্বোধ্য আওয়াজ করছে ঝান, কাতর অনুনয়ের সাথে থামতে বলছে বেলাডোনাকে। অবশেষে কাবু হয়ে পড়েছে ভাল্লুক, অসহায়।

মনে হলো রানার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন নয় বেলাডোনা। আর রানাও সামনের দৃশ্য দেখে পাথর হয়ে গেছে।

‘প্রথম থেকেই আমি জানতাম, ঝান-এ-সবে তোমার মন নেই,’ ভঙ্গুর হাসি এইমুহূর্তে অবশ্যই মধুকণ্ঠ থেকে বেরুচ্ছে না, চাপা থাকছে না ফরাসী উচ্চারণ।

‘না, ঝান। বুঝতে না পারলে তোমাকে হয়তো মারতাম না। কিন্তু পেছনে ভুল করে এসেছ, ছাপগুলো মুছে আসোনি। বাংলাদেশী যুবক, রানা, সব ফাঁস করে দিয়েছে। আমরা তাকে ড্রাগ দিলাম, তার ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম নতুন ব্যক্তিত্ব, সব ঠিকভাবেই শুরু হলো। কিন্তু সব তুমি ভেস্তে দিলে। আমার বিছানায় ছিলে তুমি, তাই না? আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চুপিসারে নেমে যাও তুমি। হ্যাঁ, সরাসরি আমার বিছানা থেকে রানার কাছে যাও তুমি। তা না হলে আমার চুলের গন্ধ রানা পাবে কিভাবে?

‘রানার কাছে গিয়ে তার মুখে পিল ভরে দাও তুমি-প্রতিষেধক। কি চেয়েছিলে, ঝান? ভেবেছিলে তোমার নোংরা ভালবাসার শিকার বানাবে রানাকে? ল্যাচাসির সাথে তোমার যে সম্পর্ক, ভেবেছিলে রানার সাথেও তুমি…নাকি দলবদলের ষড়যন্ত্র, ঝান? কিংবা, এটাই হয়তো আসল কারণ, আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে তুমি। আচ্ছা, আমি যে তোমাকে বিয়ে করব না, টের পেয়ে গিয়েছিলে, তাই না?’ খিল খিল করে হেসে উঠল বার্ননা বেলাডোনা, আবার হঠাৎ হাসি থামল। ‘বিয়ে আমি কাউকেই করতে পারি না, ঝান। তোমাকে নয়, ল্যাচাসিকে নয়, কাউকে নয়। অথচ তোমরা আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছ। এর একটা বিহিত আমাকে করতেই হত। অপরাধ করে সিদ্ধান্ত নিতে তুমি আমাকে সাহায্য করেছ, তা ঠিক।’

বেলাডোনা ট্রিগারে টান দিতেই লাফ দিল রানা, কিন্তু ঝানের মাথাটা রক্তভরা বেলুনের মত বিস্ফোরিত হলো। হলুদ মগজ ছড়িয়ে পড়ল বেলাডোনার নগ্ন শরীরে।

‘মাইগড! ইউ বীচ!’ মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো, কথাগুলো উচ্চারণ করেনি ও। তবে ঝট্ করে ঘুরে গেছে বেলাডোনা, তার হাতের কোল্ট রানার বুকের দিকে তাক করা।

এই বেলাডোনাকে রানা চেনে না। উজ্জ্বল আলোয় তার চেহারায় বয়সের ছাপ দেখতে পেল ও। মাথার চুল এলোমেলো, কালো আগুনের মত চোখ জোড়া থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ঘৃণা। তার এই চোখ দুটোই এক লহমায় সমস্ত রহস্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করল রানাকে। গাঢ় সবুজ রঙের চশমা পরে থাকত ‘আদি সও মঙ অর্থাৎ উ সেন, কারণ প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে তার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই তার চোখ দেখার সুযোগ রানার হয়নি। কিন্তু চোখ নষ্ট হবার আগের ফটো দেখেছে ও। এ সেই চোখ। দু’টুকরো কালো আগুন।

হাসল বান্না বেলাডোনা। বাঁকা হলো শুধু একদিকের ঠোঁটের কোণ। অত্যন্ত পরিচিত ভঙ্গি। চোখ বুজলে পরম শত্রু উ সেনের ঠোঁটে এখনও এই হাসি দেখতে পাবে রানা। একই হাসি!

‘হ্যালো, মাসুদ রানা। অবশেষে। এই জঘন্য দৃশ্যটা তোমাকে দেখতে হলো বলে আমি দুঃখিত। বিশ্বাস করো, ওকে ক্ষমা করার কথা সিরিয়ালি ভাবছিলাম আমি, কিন্তু তুমি প্রতিষেধক পিলের কথা বলার পর আমার চোখ খুলে গেল। বুঝলাম, বেঈমানকে বাঁচিয়ে রাখা চলে না।’ রানা কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাত তুলে থামিয়ে দিল সে। ‘সত্যি দুঃখজনক। ওর নিজের ক্ষেত্রে দারুণ প্রতিভা ছিল, মানতেই হবে। অন্তত ওর মত গড-গিফটেড কেমিস্ট আমার অর্গানাইজেশনে অবশ্যই ঠাঁই করে নিতে পারে। কিন্তু ঝানের বেলায় সমস্যা ছিল, ওর অ্যামবিশন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আসল কাজে মন ছিল না ওর। আমাকে বিয়ে করবে, ভাবো একবার:

রানার দিকে এক পা এগোল বেলাডোনা, তারপর কি মনে করে আবার পিছিয়ে গেল।

‘যা ঘটেছে সব মনে রেখে, এবং স্বীকার করি তোমার দুঃসাহস আর বীর্য মুগ্ধ করার মত, তবু বলতে হয় আমাদের পরিচয় হয়নি। আমার নাম বানা উ সেন।’ অপার আনন্দে হেসে উঠল সে। ‘বলতে পারি, তোমার নাম মাসুদ রানা। এবং এখন আমি আমার পুরস্কার দাবি করতে পারি।

‘তার মেয়ে?’ রানার গলা কোন রকমে শোনা গেল।

‘আমার পুরস্কার,’ বলে চলেছে বান্‌না সও মং। ‘তোমার মাথার জন্যে আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। কেউ পারল না, আমি নিজে পারলাম। অবাক হচ্ছ? অবাক হচ্ছ এ-কথা ভেবে যে তোমাকে আর আমেরিকানদের কিভাবে আমি বোকা বানালাম? আমি জানতাম, রানা- জানতাম সি.আই এ তোমার সাহায্য চাইবে। জানতাম তাদের ডাকে তুমি সাড়াও দেবে। মেজর মাসুদ রানা, এম.আর.নাইন, বি.সি.আই. এজেন্ট, হার্মিসের ব্যাপারে একজন এক্সপার্ট। হ্যাঁ, রানা, দূর থেকে নাকে দড়ি দিয়ে তোমাকে আমি ঘুরিয়েছি। ফাঁদ পাতলাম, তুমি ধরা দিলে।

‘সেই ঘোষিত পুরস্কার এখন দাবি করি আমি। তুমি আমার বাবাকে মেরেছ। এমনকি তখনও আমি ছোট্টটি, বাবা আমাকে তোমার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিল।

‘আর তোমার মা?’ সময় পাবার চাল দিল রানা।

বান্না সও মঙের গলার পিছন থেকে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বেরিয়ে এল, আহত পশুর মত, যেন বমি করতে যাচ্ছে। আমি অবৈধ সন্তান, যদিও জানি কে সে। ফরাসী দেহপসারিণী, বাবার সাথে তার তিন কি চারবার মাত্র দেখা হয়েছিল। আমার সাথে তার দেখা হয়েছে, তবে জ্ঞাতসারে নয়। ভাল আমি আমার বাপকে বাসতাম, মি. মাসুদ রানা। আজ আমি যা জানি, সব আমার বাবার কাছ থেকে শেখা। উইল করে বাবা তার হার্মিসের সম্পদ আর দায়িত্বও আমাকে দিয়ে গেছেন। ব্যস, এইটুকুই তোমাকে জানাবার ছিল আমার। ঝান বিদায় নিয়েছে। এবার তোমার পালা।

‘ভুল তোমারও হয়, সও মং, তাড়াতাড়ি বলল রানা। ‘মারাত্মক একটা ভুলের কথা এখুনি তোমাকে আমি জানাতে পারি।’

‘ভুল আমার?’ সকৌতুকে রানাকে লক্ষ করছে নতুন সও মং। ‘কি ভুল? নাকি অযথা সময় নষ্ট করাতে চাইছ?’

ঝান নয়, বান্‌না, তুমি। প্রতিষেধক পিল তুমিই আমাকে দিয়েছ। কৃতিত্বটা অবশ্যই আমার।

‘আমি?’ হেসে উঠল বান্না উ সেন। ‘তোমার কৃতিত্ব?’

‘মনে আছে, সম্মোহন সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছিলে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘বিদ্যাটা আমি জানি বলাতে তুমি জেদ ধরলে তোমাকেও শেখাতে হবে?’

‘হ্যাঁ, তো কি?’

‘তোমাকে আমি শেখালাম, মনে পড়ে? মাত্র পনেরো মিনিটের চেষ্টাতেই সম্মোহিত হয়ে পড়লে তুমি। তারপর কি হলো শুনবে? তুমি যে সও মং হতে পারো, এ-সন্দেহ প্রথম থেকেই ছিল আমার মনে। সাবধানের মার নেই, তাই তোমাকে কিছু সাজেশন দিয়ে রাখি আমি-আমাকে ড্রাগ দেয়া হলে তুমি আমাকে প্রতিষেধক দেবে। আর প্রয়োজনের সময় ঠিক তাই দিয়েছ, নিজের অজান্তে। আমাকে ড্রাগ দেয়া হয়েছে, এই খবর পাবার পর আবার তুমি সম্মোহিত হয়ে পড়ো, বুঝলে?’

কয়েক মুহূর্ত নড়ল না বানা উ সেন। ম্লান দেখাল তাকে। তারপর নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে। ‘বেশ, মানলাম, তুমিও আমাকে খেলাতে পেরেছ। কিন্তু এখন? এখন, মাসুদ রানা? কে কাকে খেলাবে? এই যে, তোমাকে আমি গুলি করছি। পারবে ঠেকাতে? পারবে তুমি আমার হাত থেকে বাঁচতে?

‘তিনটে গুলি করব, রানা। শেষ গুলিটা তোমার মাথার খুলি ফাটিয়ে দেবে, বের করে নিয়ে যাবে খানিকটা মগজ। ওটাই আসল, বাকি দুটোর কথা বাদ দাও, ওগুলো শুধু হাড় গুঁড়ো করবে।’

হাতের কোল্টটা রানার দিকে তুলল বান্না। আগেই লাফ দিয়েছে রানা,

ঠিক যখন মাল্ থেকে বেরুতে যাচ্ছে বুলেটটা। প্ল্যান করা ছিল, টেবিলের কোণ লক্ষ্য করে লাফ দিয়েছে ও। একটা আড়াল পেতে যাচ্ছে টেবিলের তলায়, এই সময় ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল পিয়েরে ল্যাচাসির ধুলো-মাখা ভঙ্গুর কাঠামো, গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে সে।

‘আমাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে, সও মং! পালাবার পথ নেই, চারদিকে পুলিস-চারদিকে!’

গুলি করল বান্না, রানা দেখল ওর মাথার এক ফুট ওপরে টেবিলের কোণ উড়ে গেল। শরীরটা মোচড় দিয়ে খপ্ করে একটা চেয়ারের পায়া ধরে ফেলল ও। ওকে লক্ষা করে এরইমধ্যে লাফ দিয়েছে ল্যাচাসি, চেয়ারটা টেবিলের নিচ থেকে হ্যাঁচকা টানে বের করে আনল রানা। বান্নার পরবর্তী গুলি আর রানার মাঝখানে পৌছুল ল্যাচাসি।

বুলেটটা গর্ত করল ল্যাচাসির বাম বুকে, লাটিমের মত কয়েক পাক ঘুরিয়ে দেয়ালে নিয়ে ফেলল তাকে। মনে হলো পেরেক দিয়ে গেঁথে রাখা হয়েছে শরীরটা, তারপরই খসে পড়ল মেঝেতে, দেয়ালে রেখে এল লাল লাল ছোপ।

হাঁপানোর আওয়াজ পেল রানা, বিড়বিড় করে অভিশাপ দিচ্ছে সও মং। ঠিক সেই মুহূর্তে, সে যখন ভারসাম্য ফিরে পেতে চেষ্টা করছে, গায়ের সবটুকু শক্তি এক করে চেয়ারটা ছুঁড়ে মারল রানা।

সময় যেন স্থির হয়ে গেল, শূন্যে ঝুলে থাকল চেয়ার, আত্মরক্ষার তাগিদে সেটাকে এড়িয়ে যাবার ভঙ্গিতে বাননা সও মংও যেন স্থির হয়ে আছে। বাঁচার তাগিদ, সও মং পরিবারের প্রতি তীব্র ঘৃণা, আর রানার নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা আসুরিক পেশী, এই তিনটে শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে চেয়ারটা।

চেয়ারের নিরেট তলাটা সরাসরি বুকে আঘাত করল। চারটে পায়া নিখুঁতভাবে তার দুই হাতে দেবে গেল, সংঘর্ষের জোরাল ধাক্কা ছিটকে নিয়ে ফেলল তাকে জানালার গায়ে।

কাঁচ ভাঙার শব্দে রী রী করে উঠল গা। তারপরই শোনা গেল তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। জানালা ভেঙে শক্ত মাটিতে গিয়ে পড়েছে বান্‌না সও মং, ঠিক যেখান থেকে জায়গাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে ঝোপ-ঝাড় আর জলাভূমির দিকে।

বান্না থামছে না, দীর্ঘ হচ্ছে আর্তনাদ, বিরতিহীন। আর দাঁড়িয়ে আছে রানা, যেন একটা পাথুরে মূর্তি, ভয়াবহ না জানি কি দেখতে হয় ভেবে হতবিহ্বল।

যে-ই মাটিতে পড়েছে বান্‌না অমনি একটা ধাতব খাঁচা ঝপ্ করে নেমে এসেছে অন্ধকার ওপর থেকে। তার দিয়ে ঘন করে বোনা হয়েছে খাঁচার পাশগুলো। প্রায় সাথে সাথেই, আশপাশের এলাকা জ্যাস্ত হয়ে উঠল। খাঁচাটার একটা ছাদ দেখল রানা, তিন দিকে তারের জাল। রাকি একটা দিক ঝোপ-ঝাড় অর্থাৎ জলাভূমির দিকে খোলা।

খাঁচাটা নেমে এল, সেই সাথে কামরার ভেতর ম্লান হয়ে এল আলো। কিন্তু তবু বুকে হেঁটে এগিয়ে আসা সরীসৃপগুলোকে দেখতে পাবার মত যথেষ্ট আলো রয়েছে। একটা, তারপর আরেকটা, দুটোকে দেখতে পেল রানা। কিন্তু জোরাল আভাস পেল, আরও আছে। দুটোই বিশাল, মোটা, ভয়ঙ্কর পাইথন; লম্বায় একেকটা ত্রিশ-চল্লিশ ফুটের কম নয়।

সাপ দুটো দেহ বেয়ে উঠতে শুরু করল, পরিষ্কার শুনতে পেল রানা পাটখড়ির মত মট মট শব্দ করে চেয়ারটা ভাঙছে। পা ছুঁড়ছে বান্না, চিৎকার করছে। কিন্তু এগুলো সাপ, শুনবে কেন! একটু পরই তার চিৎকার থেমে গেল। এক সেকেন্ড আগেই টের পেয়েছে রানা, কামরার ভেতর লোকজন ঢুকছে। অন্তত, একজনকে পরিষ্কার চিনতে পেরেছে ও। নুমা-র ডিরেক্টর, অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন।

হন হন করে এগিয়ে জানালার সামনে পৌঁছুলেন অ্যাডমিরাল। একটা হাত তুলে লক্ষ্যস্থির করলেন। তৃতীয় বিস্ফোরণের পর ঘাড় ফিরিয়ে রানার দিকে তাকালেন। ‘হ্যালো, মাইবয়!’

দুটো গুলি করে পাইথন জোড়াকে মেরেছেন জর্জ হ্যামিলটন। শেষ গুলিটা করেছেন বান্নাকে, তখনও যদি বেঁচে থাকে, এই ভেবে।

.

‘এসো, রানা।’ রিটার গলা, রানার পাশ থেকে। সে-ই ওর হাত ধরে কামরা থেকে বের করে নিয়ে এল। এক মিনিটের ছুটি নিয়ে রানা চলে গেল পোশাক পরে আসতে।

কয়েক মিনিট পর, বাড়িটার হলঘরে, রানার পাশে বসে শান্তভাবে গল্পটা শোনাল রিটা হ্যামিলটন। ঠিক কি ঘটেছিল মনো-রেলে।

‘সাথে পিস্তল ছিল সত্যি, তুমি বলেও গিয়েছিলে ট্রেনে কেউ উঠতে চেষ্টা করলে গুলি করে মারব আমি, কিন্তু বারো-তেরোজন লোককে মারা কি সম্ভব? সম্ভবত আমরা র‍্যাঞ্চ ছাড়ার আগে থেকেই ট্রেনে অপেক্ষা করছিল ওরা। দেখলাম এত লোকের সাথে লড়তে যাওয়া স্রেফ পাগলামি, তাই লেজ তুলে পালালাম। হেসে ফেলল রিটা। ‘কি, আমাকে তুমি ভীতু বলবে?’

নিঃশব্দে মাথা নাড়ল রানা। ‘ঠিক কাজটি করেছ।’

‘দুঃখিত, রানা-তোমাকে কোন সঙ্কেত দিতে পারিনি। একবার ভেবেছিলাম তোমার কাছে যাই, কিন্তু চারদিকে ওদেরকে দেখে সাহস পেলাম না। শুনে ফেলার ভয়ে চিৎকারও দিতে পারলাম না। অন্ধকার, কিছু দেখতেও পাচ্ছিলাম না। সম্ভবত ফেরার সময় কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে আমাকে তুমি পাশ কাটিয়েছ। শেষ পর্যন্ত তোমার সাথে নয়, ধাক্কা খেলাম একটা লাশের সাথে।’

‘কিভাবে…?’ শুরু করল রানা।

‘হেঁটে। গেট পেরিয়ে মরুভূমিতে বেরিয়ে এলাম। তবে অ্যামারিলোতে পৌঁছুতে অনেক দেরি করে ফেলি, লুকিয়ে থাকা ছাড়া তখন আর করার কিছু ছিল না। সারাটা রাত গরু-খোঁজা করে খুঁজল ওরা আমাকে। অনেক কষ্টে, অতি সাবধানে পৌঁছলাম শহরে, ফোনের কাছে

‘তারপর খবর আসতে লাগল চেইন পাহাড় থেকে। ইতিমধ্যে বাবা পৌঁছে গেছেন, সাথে আরও লোকজন। অনেক খোঁজ-খবর নেয়ার পর বানা বেলাডোনার হেলিকপ্টার সম্পর্কে জানা গেল, কোন দিকে গেছে ওটা। এভাবেই তোমার খোঁজ বের করা হলো। তোমাকে তো আমি আগেই বলেছিলাম, ও মেয়ে ভাল নয়।’

চুপ করে থাকল রানা। নিজেও আন্দাজ করেছিল, বান্না ভাল মেয়ে নয়! কিন্তু তবু সব রহস্য উন্মোচিত হবার পরও, গোটা ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে।

হলঘরে এলেন জর্জ হ্যামিলটন। ‘অনেক দিন পর আবার দেখা হলো, মাই বয়,’ বলে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি, নিঃশব্দে একটু হাসলেন। তুমি জানো না, একটা মিরাকল ঘটে গেছে।’

‘মিরাকল?’ অবাক হলো রানা।

‘তুমি আমার স্নেহের পাত্র, স্বভাবতই আমি আশা করব আমার পরিবারের সবাই তোমাকে বন্ধু হিসেবে নেবে,’ বলে চলেছেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে একদিন আবিষ্কার করলাম, আমার পরিবারে তোমার এক শত্রু আছে।’

‘ড্যাডি, তুমি বাড়িয়ে বলছ…,’ তীব্র প্রতিবাদ জানাল রিটা। ‘ব্যাপারটা ঠিক সেরকম ছিল না। মাসুদ রানা বলতে তুমি অজ্ঞান, এমন ভাব দেখাতে যেন ওর কোন খুঁত নেই, যেন সব দিক থেকে সেরা…আর আমি শুধু শান্তভাবে বলতে চেষ্টা করতাম, এ-ধরনের নিখুঁত চরিত্র শুধু উপন্যাসের পাতায় পাওয়া যায় বাস্তবে দেখা মেলা ভার…’

‘কিন্তু মিরাকলের কথা কি যেন বলছিলেন?’ বিব্রত বোধ করছে রানা।

‘তোমার ব্যাপারে ওকে সাংঘাতিক উদ্বিগ্ন হতে দেখেছি, কোন শত্রুর জা সাধারণত কাউকে এরকম হতে দেখা যায় না, তখনই বুঝলাম, ব্যাপারটা উ গেছে। শত্রু বন্ধু হয়ে গেল, মিরাকল নয়?’

রানার পাশ থেকে উঠে এসে বাবার কাঁধে থুতনি রেখে দাঁড়াল রিটা হ্যামিলটন, বলল, ‘কিছুই উল্টে যায়নি। আমার বাবার আদরের ভাগ শুধু আমি পাব, আর কাউকে দেব না।’

ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ মেয়ের আবদারের কাছে হার মানলেন অ্যাডমিরাল। ‘তাই হবে, কাউকে দেব না। কিন্তু সম্ভব হলে তুই নিজের কাছ থেকে সামান্য এক-আধটু দিস, কেমন?’ হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তিনি, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘এখন যা, দেখ, দু’কাপ কফি খাওয়ানো যায় কিনা। এই ফাঁকে রানার সাথে জরুরী কয়েকটা কথা সেরে নিই।’

রিটা হলঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অ্যাডমিরাল বললেন, ‘সও মং আর হার্মিস সম্পর্কে খবর নিতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার জানতে পেরেছি, রানা।’

চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল রানা।

‘হার্মিসের ভিত খুব শক্ত,’ বলে চলেছেন অ্যাডমিরাল। ‘আমেরিকার সবখানে ওদের সংগঠন ছড়িয়ে আছে। গোপনে অনেক আমলা, পুলিস অফিসার, এমনকি সামরিক অফিসারও হার্মিসের সদস্য। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে আভাস পেয়েছি, কিছু কিছু মহল থেকে বলা হচ্ছে সও মঙের কোন ক্ষতি হলে চরম প্রতিশোধ নেবে তারা। কাজেই তোমার সাবধান হওয়া দরকার বলে মনে করছি, রানা।’

‘ধন্যবাদ, অ্যাডমিরাল, বলল রানা। ‘সাবধানেই থাকব আমি।

হার্মিস সম্পর্কে জানা আছে ওর। প্রথম সারির নেতা বলতে শুধু ল্যাচাসি আর ঝানই ছিল না, আরও অনেক থাকার কথা। সও মঙের অকালমৃত্যুর প্রতিশোধ তাদের পক্ষে নিতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, সাবধানেই থাকতে হবে তাকে। খুব সাবধান!

***