আবার উ সেন – ১.৪

চার

বেকার স্ট্রীটে থামল গাড়িটা, মাঝরাত। আগেই চোখে পড়েছে তিনতলায় ওর নিজের কামরায় আলো জ্বলছে, ভুরু কুঁচকে ওঠার সাথে বেড়ে গেছে হার্টবিট। এঞ্জিন বন্ধ করে অনড় বসে থাকল রানা, তারপর শোল্ডার হোলস্টারে রাখা নতুন হেকলার অ্যান্ড কচ ভি-পি-সেভেনটি হ্যান্ড-গানটার স্পর্শ নিল।

লন্ডনে এলে বেকার স্ট্রীটের এই ফ্ল্যাটটায় থাকে রানা-গোপন কোন আস্তানা তো নয়ই, সেফ হাউসও নয়। দুই গোছা চাবি, রিফাতের কাছে থাকে, লন্ডনে এলে তার কাছ থেকে একটা চেয়ে নেয় রানা।

রিফাত জাহান রানা এজেন্সিতে চাকরি করে, শাখা প্রধান শাহিন কায়সারের নিচের পদটাই তার। অবশ্য একটা তথ্য অনেকেরই জানা নেই-বি.সি.আই. থেকে বাছাই করা অল্প কয়েকজনকে বদলি করে রানা এজেন্সির বিভিন্ন শাখায় পাঠানো হয়েছে, রিফাত জাহান তাদেরই একজন।

বি.সি.আই. অর্থাৎ বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ এজেন্টদের একজন রানা। আর বেশ কয়েক বছর হলো .বি.সি.আই. চীফ মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের নির্দেশে গড়ে তোলা হয়েছে রানা এজেন্সি। বি.সি.আই. সরকারী প্রতিষ্ঠান, তাই আন্তর্জাতিক অনেক সংকট-সমস্যায় নাক গলাতে অসুবিধে হয়, সেকথা ভেবেই মাসুদ রানাকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর করে এজেন্সিটাকে দাঁড় করানো হয়েছে। শুরু থেকেই ভাল কাজ দেখাচ্ছে রানা এজেন্সি, পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরে খোলা হয়েছে শাখা। রানা এজেন্সি গড়ে তোলার সময় বি.সি.আই-এর চাকরি ছেড়ে দেয় রানা, বলাই বাহুল্য, সেটা লোক দেখানো ব্যাপার ছিল।

বি.সি.আই. এবং রানা এজেন্সি ছাড়া অন্যান্য আরও কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত রানা, তার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি টেরোরিজম অর্গানাইজেশন অন্যতম।

সন্ত্রাসবাদ বিরোধী একটা আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার ধারণাটা প্রথম আসে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধির মাথায়। দীর্ঘ কয়েক মাস জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে ব্যাপক আলোচনার পর সবার সমর্থন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি টেরোরিজম অর্গানাইজেশন। গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে এটা একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর রাজনৈতিক মতাদর্শ বা উদ্দেশ্য যাই হোক, সেন্ট্রাল কমিটির নির্দেশে কমান্ডোরা তাদের কার্যকলাপ বানচাল করার জন্যে অপারেশন চালাবে।

এত রাতে রিফাত ওর কাছে আসবে না। তাহলে কে হতে পারে? পরিষ্কার মনে আছে রানার, ফ্ল্যাট থেকে বেরুদ্ধার আগে সব আলো নিভিয়েছিল ও।

চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে সতর্কতার সাথে গাড়ি থেকে নামল রানা। গার্ডরুমটাকে পাশ কাটাবার আগেই দেখতে পেল ওটার দরজায় তালা ঝুলছে। ইচ্ছে করেই এলিভেটরের দিকে গেল না, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল তিনতলায় ইতিমধ্যে কোটের পকেটে চলে এসছে ভি-পি-সেভেনটি।

করিডরের দিকে কোন জানালা নেই, ফ্ল্যাটটার দরজার পাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল রানা। শুধু একটা হাত লম্বা করে দিয়ে নক করল। ভেতর থেকে কেউ সাড়া তো দিলই না, অন্য কোন শব্দও হলো না। পকেট থেকে চাবি বের করে কী হোলে ঢোকাল ও, এখনও দেয়ালের সাথে সেঁটে রয়েছে শরীরটা।

ধীরে ধীরে চাবিটা ঘোরাল ও। ক্লিক একটা আওয়াজের সাথে খুলে গেল তালা। চাবিটা খুলে নিয়ে পকেটে ভরল, পকেট থেকে হাতে চলে এল ভি-পি- সেভেনটি। আবার হাত বাড়িয়ে দরজার হাতলটা ঘোরাল ও, তারপর অকস্মাৎ এক ধাক্কায় কবাট খুলে লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ল কামরার ভেতর, হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র, বাঁকা শিরদাঁড়া নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে।

সিটিংক্রমে কেউ নেই।

লিভিংরূমের দরজাটা খোলা। সাবধানে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল রানা। সোফার ওপর একটা নারীদেহ দেখে ছ্যাৎ করে উঠল বুকের ভেতরটা। দেহটা মোচড়ানো, লম্বা কালো চুল কার্পেটে ঝুলছে, একটা কনুইসহ হাতের নিচে চাপা পড়েছে মুখ আর কপাল। চেনা চেনা লাগল, কিন্তু চিনতে পারল না রানা। শাড়ি পরা যুবতী মেয়ে, রিফাত নাকি?

অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল রিফাত, নির্জন কোন রাস্তায় ওর পথরোধ করে দাঁড়ায় খুনীরা? নির্মমভাবে খুন করে লাশটা রেখে গেছে এখানে? ওকে ফাঁসাবার উদ্দেশ্যে? লক্ষ করেছে রানা, গত কয়েকদিন অনুসরণ করা হয়েছে ওকে-কোথায় থাকে দেখে গেছে শত্রুরা।

কিন্তু কল্পনাটা যে ভিত্তিহীন, দরজা বন্ধ করে লিভিংরুমে ঢোকার পর বুঝতে পারল রানা। রিফাত জাহানই, তবে নিয়মিত নিঃশ্বাস ফেলছে। যে-কোন কারণেই হোক, রানার সাথে দেখা করতে এসেছিল সে, এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমটা এসেছে হঠাৎ, নিজের অজান্তে, তাই শরীরের এই এলোমেলো ভঙ্গি।

রিফাতকে জাগাতে গিয়েও জাগাল না রানা। সারাটা দিন ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে বেচারি, তারপর কে জানে হয়তো সন্ধের পর থেকে এখানে ঠায় বসে অপেক্ষা করেছে ওর জন্যে, নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত-ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।

বাথরূম থেকে স্লিপিং গাউন পরে বেরিয়ে এল রানা, লিভিংরুম হয়ে ঢুকল কিচেনে। ও নিজে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, কিন্তু রিফাতের জন্যে কিছু তৈরি করা দরকার। কিচেনে রুটি, মাখন, ডিম, পনির, ফল ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে, একটা প্লেট সাজাতে খুব বেশি সময় লাগল না। তারপর কফি বানাতে বসল ও।

মাঝখানে একবার উঠে গিয়ে দেখে এসেছে রিফাতকে। সেই আগের ভঙ্গিতেই শুয়ে আছে সে। একবার ইচ্ছে হয়েছিল ভাঁজ করা একটা পা লম্বা করে দেয়, মুখ থেকে নামিয়ে হাতটা রাখে বুকের ওপর, কিন্তু সংকোচ বোধ করায় শুধু চুলগুলো সোফার ওপর তুলে দিয়ে ফিরে এসেছে রানা। কুমারী মেয়ে, তাও ঘুমন্ত শরীরে হাত দেয়া উচিত নয়-কে জানে, যদি চিৎকার দেয়!

সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর ক’টা দিন লন্ডনেই রয়েছে রানা, ই.এ.টি.ও-র হেডকোয়ার্টার থেকে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। বি.এ. ফ্লাইট টুয়েলভ হিথরোতে যেদিন নামল সেদিন থেকেই রিফাতের সাথে ওর ঘনিষ্ঠতার শুরু। তার আগে পর্যন্ত দু’জনের মধ্যে একটা দূরত্ব আর জড়তা ছিল। একসাথে হলে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলেনি বা ভাবেনি। সম্পর্কটা প্রায় আগের মতই আছে, তবে দূরত্ব আর জড়তা কমে এসেছে।

প্লেন থেকে নামার পরপরই অফিসে আসে রানা, তখনই জানতে পারে ঢাকা থেকে_বি.সি.আই. চীফ নতুন নির্দেশ দিয়েছেন, এখন থেকে রানা এজেন্সির সব এজেন্টকে হেকলার অ্যান্ড কচ ভি-পি-সেভেনটি ব্যবহার করতে হবে।

রানা প্রতিবাদ করলেও সেটা ছিল মনে মনে। প্রতিবাদ করার কারণ, এতদিন নিজের খুশি আর পছন্দ মত হ্যান্ডগান বেছে নেয়ার স্বাধীনতা ছিল ওর, সেটা একরকম কেড়ে নেয়া হলো। ওর প্রিয় অস্ত্র ওয়ালথার পি-পি-কে, যদিও সব সময় ওটা রানা ব্যবহার করে না। গত মাসে একটা অ্যাসাইনমেন্টে পুরানো মডেলের মাউজার ব্যবহার করে ও, সেজন্যে ওর প্রচুর সমালোচনা হয়েছে।

কিন্তু প্রতিবাদ করে যে কোন লাভ নেই রানা জানে। বুড়ো বসের কথা যদি আইন হয়, রিফাতের দায়িত্ব হলো সে আইন মানা হচ্ছে কিনা দেখা। মেয়েটার এই গুণটা সম্পর্কে আগে জানা ছিল না রানার। স্মল আর্মস সম্পর্কে সে যে শুধু একজন এক্সপার্ট তাই নয়, তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখারও আছে রানার। যাকে দেখলে ঢ্যাঙা সুপারী গাছের কথা মনে পড়ে যায়, তার প্রতি একটা সমীহের ভাব জন্ম নিয়েছে রানার মনে। কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখার পর শুধু সুন্দরী নয়, একইসাথে কঠিন আর কোমল মনে হয়েছে, মনে হয়েছে এই মেয়ের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেলে সার্থক মানুষের জীবন। কিন্তু না, কোন আভাস বা ইঙ্গিতে মনের কথা বুঝতে দেয়নি রানা। সম্পর্কটাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে টেনে আনতে চায়নি।

ভি-পি-সেভেনটি আকারে ওয়ালথারের চেয়ে বড় হলেও, রানাকে স্বীকার করতে হয়েছে গোপনে সাথে রাখার ব্যাপারে অস্ত্রটা কোন সমস্যা সৃষ্টি করেনি। হাতে নিয়েও আরাম, বাঁট লম্বা এবং ওজন এমনভাবে কমবেশি করা আছে যাতে ভারসাম্য ঠিকমত রক্ষা পায়। লক্ষ্যভেদে ভাল, গুরুতর জখম করার শক্তি ও রাখে-নাইন এম-এম, সাথে আঠারো রাউন্ডের ম্যাগাজিন, হালকা শোল্ডার স্টক ফিট করা অবস্থায় সেমি-অটোমেটিকে প্রতিবার তিনটে বিস্ফোরণ।

সন্দেহ নেই ভি-পি-সেভেনটি চমৎকার একটা ম্যান-স্টপার। হাইজ্যাকারদের সাম্প্রতিক দৌরাত্ম্যের কথা মনে রেখেই সম্ভবত এই অস্ত্রটা ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রিফাতের সহযোগিতায় এরই মধ্যে নতুন পিস্তলটার সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে রানার। পরপর তিনটে দিন একটা আন্ডারগ্রাউন্ড রেঞ্জে এক্সপার্ট রিফাতের সাথে প্র্যাকটিস করেছে রানা। ফাস্ট ড্র-তে রানা এখন সাবলীল

তিন দিন আন্ডারগ্রাউন্ড রেঞ্জে একসাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছে ওরা। রিফাত রানাকে, রানা রিফাতকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পেয়েছে। মনে যাই থাক, সংযমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে রানা-রিফাত যে একটা সুন্দরী মেয়ে ওর আচরণে সেটা বুঝতে দেয়নি। প্রয়োজনের চেয়ে কাছে এসেছে রিফাত, মাঝে মধ্যে অকারণে হেসেছে, দেখেও না দেখার ভান করেছে রানা। ও জানে, মেয়েদের অনেক রকম খেয়াল থাকে, পুরুষদের বাজিয়ে দেখার প্রবণতা থাকে, তারমানে এই নয় যে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। হৃদয়ঘটিত হোক বা শরীরঘটিত, নতুন কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে ওর নেই। তৃতীয় অর্থাৎ শেষদিন রেঞ্জ থেকে বেরুবার মুখে আভাসে রিফাত রানাকে জানিয়েছিল, সন্ধ্যায় তার কোন কাজ বা প্রোগ্রাম নেই, ইচ্ছে করলে তার সঙ্গ চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রানা সাড়া দেয়নি, কাজের অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে। চেহারা কালো হয়ে গেলেও, একটা কথাও বলেনি রিফাত।

নিজের জন্যে কাপে আর রিফাতের জন্যে ফ্লাস্কে কফি নিয়ে লিভিংরুমে ফিরে এল রানা। ঘুমের মধ্যে ভাল করে শুয়েছে রিফাত, ভাঁজ করা পা দুটো সোফার পিঠে ঠেকে আছে, তবে হাত দুটো এখনও চোখের ওপর।

সিঙ্গল একটা সোফায় বসে নিচু টেবিলের ওপর পা তুলে দিল রানা, ধীরে ধীরে চুমুক দিল কাপে। হাতঘড়ি দেখল একবার। সাড়ে বারোটা বাজে। মেয়েটার ঘুম ভাঙানো উচিত হবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছে না। তারপর চিন্তাটা অন্য খাতে বইতে শুরু করল। গত কয়েক দিনে হাইজ্যাকারদের সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, ধন্যবাদ দিতে হয় রানা এজেন্সির লন্ডন শাখার কমপিউটর সেকশনকে।

দেখা গেছে প্রতিটি হাইজ্যাকারের সাথে একজন জার্মান লোকের কোন না কোন সময় যোগাযোগ ছিল বা আছে। লোকটার নাম ফন এফেন। জানা গেছে স্টুয়ার্ডেস মেয়েটা নির্দিষ্ট ওই ফ্লাইটে থাকার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা তদ্বির করেছিল, যদিও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে তিন বছর ধরে রয়েছে সে। তার সাথেও ফন এফেনের একটা যোগাযোগ ছিল অতীতে।

রানাকে সবচেয়ে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে মৃত্যুর আগে টেরোরিস্ট লোকটার উচ্চারিত শব্দ দুটো। সও মং। ব্যাপারটা বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে আরেকটা তথ্য জানার পর-ফন এফেন জীবিত সও মং অর্থাৎ উ সেনের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল। শুধু তাই নয়, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হার্মিসের একজিকিউটিভ কমিটিরও প্রভাবশালী সদস্য ছিল সে।

হাতে আরও তথ্য চলে আসায় উদ্বেগ বেড়েছে রানার। উপর্যুপরি যে ক’টা হাইজ্যাক হয়েছে, সেগুলোর সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের মধ্যে থেকে ছয়জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দু’জন পরিচিত গুণ্ডা, জেফরি অ্যাডামসের সাক্ষাৎ শিষ্য, লস অ্যাঞ্জেলসে তাদের সাংঘাতিক দাপট। আরেকজনের সাথে যোগাযোগ আছে হার্ভেনোভেল আর হ্যারি ইয়ংব্লাডের, ভাড়াটে খুনী হিসেবে নিউ ইয়র্ক আন্ডারগ্রাউন্ডে তার অনেক ‘সুনাম’। আরেকজন কাজ করে হেনরি মার্লিনের সাথে সুইডেনে জন্ম তার, ফ্রি-ল্যান্স ইন্টেলিজেন্স এক্সপার্ট, যে বেশি পয়সা ঢালতে পারবে সে-ই তার প্রাইভেট এসপিওনাজ সার্ভিস পেতে পারে। ছয় নম্বর লোকটার সম্পর্ক রয়েছে প্যারিসের কুখ্যাত অপরাধী ক্লড অর্ভির সাথে, যার বিরুদ্ধে ফ্রেঞ্চ পুলিস গত বিশ বছর ধরে প্রমাণ সংগ্রহের ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।

আরও ভীতিকর তথ্য হলো জার্মান ফন এফেনের মত জেফরি অ্যাডামস, হার্ভে নোভেল, হ্যারি ইয়ংব্লাড, হেনরি মার্লিন এবং ক্লড অর্ভির সাথে জীবিত উ সেন এবং হার্মিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এরাই এখন হার্মিসের একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য হয়েছে। তারমানে, কোন সন্দেহ নেই, ইউনিয়ন কর্মকে আন্তর্জাতিক একটা চেহারা দেয়ার চেষ্টা চলছে। ইউনিয়ন কর্ম বলতে এখন শুধু ফরাসী একদল ‘অপরাধীদের সংগঠন বোঝায় না। উ সেনের স্বপ্ন ছিল গোটা দুনিয়ার তাবৎ ক্ষমতা নিজের মুঠোর মধ্যে আনবে সে, হার্মিসকে গড়ে তোলার পিছনে সেটাই ছিল তার প্রেরণা আর উদ্দেশ্য। উ সেন মারা গেছে, তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু হার্মিস টিকে আছে, সারা দুনিয়া থেকে কুখ্যাত আর শক্তিশালী অপরাধীদের নিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে একজিকিউটিভ কমিটি। বোঝাই যায়, বড় ধরনের কোন কুমতলব আছে ওদের। বড় ধরনের কিছু করতে হলে বিপুল টাকার দরকার, একের পর এক ডাকাতি ও হাইজ্যাক করে সেই টাকাই সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সও মং নাম ধারণ করে হার্মিসকে নেতৃত্ব দিচ্ছে কেউ একজন। এই পালের গোদাটাকে চিনতে পারলে সুবিধে হত।

একটা সিগারেট ধরাল রানা, কিন্তু চিন্তার রাজ্যে আর ফিরে যাওয়া হলো না। পাশ ফিরতে গিয়ে উঁ করে উঠল রিফাত।

হাতঘড়ি দেখাল রানা। দেড়টা বাজে। আর দেরি করা যায় না, জানা দরকার কেন এসেছে রিফাত। তাকে কিছু খেতে বলাও দরকার।

‘রিফাত,’ ডাকল ও।

দ্বিতীয় ডাকে চোখ থেকে হাত সরাল রিফাত, তারপর চোখ মেলল। ‘ওমা, ছি ছি, কি কাণ্ড বলুন তো, মাসুদ ভাই, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?’ সোফার ওপর উঠে বসে শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করছে। কখন এলেন আপনি? আমাকে ডাকেননি কেন? কটা বাজে বলুন তো?’ তারপর নিজেই হাতঘড়ি দেখে আঁতকে উঠল। ‘কি সর্বনাশ! সেই সন্ধে থেকে আমি…ছি-ছি!’ পরমুহূর্তে তার চেহারায় উদ্বেগ ফুটে উঠল। ‘দেড়টা…ইস্, এত রাতে একা আমি বাড়ি ফিরি কি করে!’

‘কেন এসেছিলে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘ও, হ্যাঁ,’ বলে ঢোক গিলল রিফাত, সোফার নিচে পা ঝুলিয়ে দিল। ‘আপনি অফিস থেকে চলে আসার পর ঢাকা থেকে বসের একটা মেসেজ এল, সেটা দিতে এসেছিলাম। এসে দেখি আপনি নেই, তাই…’

ঠিক আছে, ঠিক আছে-অপেক্ষা করতে করতে পৃথিবীতে তুমিই এই প্ৰথম ঘুমিয়ে পড়োনি। তা, মেসেজটা কি?’

সোফা থেকে হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিয়ে খুলল রিফাত, ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। হাতে নিয়ে রানা দেখল, কোড করা মেসেজ। কোড ভাঙতে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগল ওর। বি.সি.আই. হেডকোয়ার্টার থেকে মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান লিখেছেন, ‘তোমাকে ফাদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। নতুন ছদ্মবেশ নিয়ে এরা তোমার পুরানো শত্রু। আমরা অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি এদের নেতা কে। পারো তো পালের গোদাটাকে ধ্বংস করো, যাতে অন্তত আবার কিছু দিন সংগঠনটা মাথা তুলতে না পারে। এ-কাজে যেখান থেকে যত সাহায্য পাও সব তোমার দরকার হবে।’

সংগঠনের অর্থ করল রানা- হার্মিস। আর পালের গোদা হলো সও মং নামধারী লোকটা। পুরানো শত্রু-ইউনিয়ন কর্স বা উ সেনের ঘনিষ্ঠ সহচররা।

‘খারাপ কিছু, মাসুদ ভাই?’ রানাকে অন্যমনস্ক দেখে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রিফাত।

হ্যাঁ, বস্ আমাকে সতর্ক করে দিয়েছেন।’ কিন্তু কি ব্যাপারে তা বলল না রানা, রিফাতও জিজ্ঞেস করল না। সে জানে, প্রয়োজন মনে করলে মাসুদ ভাই নিজেই সব জানাবে।

বসের শেষ কথাটার অর্থ পরিষ্কার বুঝল না রানা। ঠিক কি বলতে চেয়েছেন? কথাটার সূত্র ধরে একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল। ক’দিন ধরেই নজর রাখা হচ্ছে ওর ওপর। একাধিক লোক, কিন্তু খুব কাছাকাছি আসে না। যেন দূর থেকে ওর গতিবিধি লক্ষ করা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই। লোকগুলোর পরিচয় সম্পর্কে কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি রানা। চেহারা দেখে কখনও মনে হয়েছে আফগান, কখনও ল্যাটিন আমেরিকান। কে.জি.বি. আর সি.আই.এ. সহ অনেক এসপিওনাজ এজেন্সিই প্রয়োজনে বিজাতীয় লোকদের কাজে লাগায়, এমনকি মাফিয়া আর ইউনিয়ন কর্স-ও এ-ধরনের ছলনার আশ্রয় নেয়। লোকগুলোর পরিচয় জানতে হলে নাগালের মধ্যে পেতে হবে এক-আধজনকে।

‘ঘুম ভাঙানোর জন্যে সত্যি দুঃখিত,’ রিফাতকে বলল রানা। ‘মেসেজটা কাল সকালে দেখলেও চলত। তুমি বরং কিছু খেয়ে নাও, তারপর…’

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রিফাত। ‘বাড়িতে রান্না করা আছে, মাসুদ ভাই। আমি বরং যাই…।’ জানি-জানি, যত বড় যুধিষ্ঠিরই তুমি হও, রাত দুপুরে একটা সুন্দরী মেয়েকে ঘরের ভেতর একা পেয়ে ছেড়ে দিতে মন চাইবে না। রিফাতের ভাবনাটাই সত্যি হলো।

রানা বলল, ‘এত রাতে ট্যাক্সি পাবে কি? অন্তত কাছে পিঠে পাবে বলে মনে হয় না, বেশ খানিকটা হাঁটতে হবে। পুলিসের সাথে দেখা হবে, সেটা ভয়ের কিছু না হলেও, ছিনতাইকারীদের সাথেও দেখা হবে…

‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন, মাসুদ ভাই,’ মৃদু হেসে বলল রিফাত, ‘আমি কারাতে জানি, আন-আর্মড কমব্যাটে ট্রেনিং নেয়া আছে।’

রানা গম্ভীর হলো। ‘ছিনতাইকারীদের কথা না হয় বাদ দাও। আমাদের শত্রু কি কম? ভেবেছ কেউ দেখেনি তুমি এখানে ঢুকেছ? জোর করে বলতে পারবে, সশস্ত্র একদল লোক বাইরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে না? রানা এজেন্সির অনেক গোপন ইনফরমেশন জানো তুমি, তুমি চাইলেও আমি তো তোমাকে এত রাতে একা যেতে দিতে পারি না।’

চেহারায় কৃত্রিম ভয় ফুটিয়ে তুলে রিফাত বলল, ‘তাহলে, মাসুদ ভাই!’

‘বললে আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি,’ প্রস্তাব দিল রানা।

‘না-ক্স, সেকি! আপনি কেন এত রাতে কষ্ট করতে যাবেন…!’

‘তাহলে এক কাজ করো,’ রিফাতের চোখে চোখ রেখে মৃদু কণ্ঠে বলল রানা, রাতটুকু এখানেই থেকে যাও।’

‘কিন্তু…সেটা কি…মানে…

‘তুমি বেডরূমে থাকো, আমি সিটিংক্রমে সোফার ওপর…!

‘না, তা কি করে হয়! আপনি কেন কষ্ট করবেন। বরং আমিই সিটিংক্রমে…’

‘তর্ক কোরো না, আমার ঘুম পেয়েছে,’ বলে সোফা ছাড়ল রানা, টেবিলে ঢাকা দেয়া খাবার প্লেটগুলো দেখিয়ে বলল, ‘যা পারো খেয়ে শুয়ে পড়ো!’ দরজার দিকে পা বাড়াল ও। আলো নেভাতে ভুলো না যেন আবার!’

‘কি! আলো নিভিয়ে শুতে হবে! কিন্তু আমার যে অভ্যেস …

‘আলো জ্বেলে শোয়া তোমার অভ্যেস? বেশ, জ্বেলেই শোও।’ দরজার কাছে পৌঁছে গেল রানা।

‘মাসুদ ভাই!’ পিছু ডাকল রিফাত। এত সহজে পরাজয় মানতে রাজি নয় সে। লোকমুখে মাসুদ ভাই সম্পর্কে দু’রকম কথা শুনতে শুনতে একটা জেদ চেপে গেছে তার। একদল বলে, লেডিকিলার, মেয়ে দেখলেই রানা পাগল হয়ে যায়। আরেক দলের বক্তব্য, রানা বর্তমান যুগের সাচ্চা ঋষি, স্বর্গের হুরীদের পক্ষেও তার ধ্যান ভঙ্গ করা সম্ভব নয়। মাত্রা ছাড়ানো মেয়েলি কৌতূহল পাগল করে তুলেছে রিফাতকে, মাসুদ ভাইকে পরীক্ষা করে দেখবে সে। জানে, এ-কাজে বিপদের ভয় আছে। ঝুঁকিটা জেনে শুনেই নিয়েছে সে। ইউরোপে বহু বছর ধরে আছে, বিয়ে না করলেও নিজেকে সে কুমারী বলে দাবি করে না। পাঁচ বছর আগে মাথা ভর্তি কালো চুল, আপনভোলা চেহারার সেই টগবগে তরুণটিকে ভালবাসা, সতীত্ব সবই দিয়েছিল রিফাত, রোড অ্যাক্সিডেন্টে তার অকালমৃত্যু না হলে আজ ওকে এই সন্ন্যাসিনীর জীবনযাপন করতে হত না। এই জীবন স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে সে। তরুণটি এখন শুধুমাত্র স্মৃতি, কিন্তু তার বিদায়ের পর আর কাউকে ভালবাসতে পারেনি রিফাত। মাসুদ ভাইয়ের প্রতি সে আকর্ষণ অনুভব করে বটে, কিন্তু জানে একেও ঠিক ভালবাসা বলে না। মানুষটাকে তার আশ্চর্য রহস্যময় মনে হয়, সেই রহস্য ভেদ করতে না পারলে তার যেন বেঁচে থাকায় শান্তি বা সার্থকতা নেই। আসলে মানুষটাকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কারণটা পরিষ্কার নয়। সত্যিই মাসুদ ভাই শ্রদ্ধার পাত্র কিনা আবিষ্কার করতে হবে তাকে। যদি কিছু হারাতে হয়…হারাবার তার আছেটা কি?

সুযোগের অপেক্ষায় ছিল রিফাত, ঢাকা থেকে বসের মেসেজটা সেই সুযোগ এনে দিয়েছে তাকে। নিজের ওপর আস্থা আছে তার, আছে গর্ব, জানে এই যৌবন আর সৌন্দর্য এড়িয়ে যাওয়া কোন পুরুষের পক্ষে অসম্ভব। ফাঁদ পাতার প্রয়োজনে অনেক দূর যাবে সে।

দরজার কাছ থেকে ঘুরল রানা। আবার কি হলো?’

মাথা নিচু করল রিফাত। ‘এক ঘরে একা আমি শুতে পারি না, আমার ভয় করে।

হো হো করে হেসে ফেলল রানা। ‘তাই নাকি? এত বড় হয়েছ, একা শুতে তোমার ভয় করে? কাকে কাকে নিয়ে শোও তুমি রোজ?’

‘আমার বোন আর আমি…

‘কিন্তু এখানে তো তোমার বোন নেই, বলো তো আমি তোমার সাথে শুতে পারি।

রানার কথা যেন শুনতে পায়নি রিফাত। ‘এক কাজ করলে হয় না, মাসুদ ভাই? আপনি আপনার বিছানাতেই, এই বেডরূমেই শোন, আমিও এখানে শুই-সোফায়?’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা,; বলল, ‘আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আলো জ্বালা থাকলে আমার যে ঘুম আসবে না?’

খুশি হয়ে উঠল রিফাত। ‘আপনি ঘরে থাকলে আলো জ্বালা না থাকলেও চলবে।’

হেসে ফেলে রানা বলল, ‘তারমানে আমাকে তোমার কোন ভয় নেই?’

ছোট্ট মেয়ের মত দ্রুত মাথা নেড়ে রিফাত বলল, ‘না। আমার ভয় ভূতকে, হাসবেন না!’

হাসতে হাসতে রিফাতের সামনে, আগের সোফায় ফিরে এসে বসল রানা। ‘খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। কাল সকালে অনেক কাজ আছে আমার। একটা সিগারেট ধরাল ও, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘ভূত কখনও দেখেছ? জ্যান্ত মানুষ ও কিন্তু ভূত হতে পারে।’

কথা না বলে খেতে শুরু করল রিফাত, রানার দিকে তাকাল না। মনে মনে ভাবছে, সেটাই তো দেখতে চাই, আপনি ভূত সাজেন কিনা।

অল্পই খেলো রিফাত, বাথরূমে গেল একবার, তারপর ফিরে এসে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল রানার বিছানায়। রানা আগেই সোফার ওপর লম্বা হয়েছে, চোখ বন্ধ।

‘ঘুমালেন নাকি, মাসুদ ভাই?’

‘না।’

‘আসুন, গল্প করা যাক।‘

‘না।‘

এক মিনিট পর রিফাত আবার কথা বলল, ‘আপনি বিয়ে করেননি কেন?’

‘করব না, তাই।’

‘প্রতিজ্ঞা? কেন?’

রানা উত্তরে বলল, ‘ঘুমাও।’

‘আসছে না।

‘তাহলে ঘুমাতে দাও।’

আবার চুপচাপ।

তারপর, ‘ও কিসের শব্দ?’

‘কই?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

ফিসফিস করে রিফাত বলল, ‘মনে হলো কে যেন আমার বিছানার পাশ ঘেঁষে হেঁটে গেল।’

‘এতক্ষণে দেয়াল ফুঁড়ে ঘরের বাইরে চলে গেছে-ঘুমাও।’

‘আবার!’ আঁতকে উঠল রিফাত।

‘আবার কি?’

‘পায়ের আওয়াজ!’

রানা কোন উত্তর দিল না।

‘মাসুদ ভাই।’

রানা চুপ করে থাকল।

‘মাগো!’ চিৎকার করে উঠল রিফাত। ‘বিছানায় কি যেন খস খস করছে!’

রানা তবু সাড়া দিল না।

বিছানার ওপর বসে পড়ল রিফাত। ‘আমি এখানে শোব না!’

রানা নিরুত্তর।

‘আমি আলো জ্বেলে শোব।’

ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ হলো সোফায়, মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠল রিফাত-আসছে নাকি মাসুদ ভাই? কিন্তু না, পাশ ফিরে শুলো রানা।

‘মাসুদ ভাই, আমার ভয় করছে! আপনি কি, কথা বলছেন না কেন?’ হঠাৎ গা ছম ছম করে উঠল রিফাতের। বিছানার পাশে সত্যি সত্যি পায়ের শব্দ। জানালা বন্ধ, ঘরের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। বিছানায় কেউ বসছে বুঝতে পেরে চিৎকার করার জন্যে হাঁ করল রিফাত, শক্ত একটা হাত পড়ল মুখের ওপর। ধস্তাধস্তি শুরু করবে রিফাত, শান্ত গলায় কথা বলে উঠল রানা।

‘আসলে চাও কি তুমি, রিফাত?’ রিফাতের মুখ থেকে হাত সরাল রানা। ‘মেসেজটা ছিল অজুহাত, আসলে এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলে তুমি। কিন্তু বুঝতে পারছ কি, কাজটা তুমি অন্যায় করেছ? আমি পুরুষ মানুষ, এবং অক্ষম নই, কাজেই এটাকে আমি আমার পুরুষত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ বলে ধরে নেব। সুন্দরী এক মেয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে নিবেদন করছে, গ্রহণ না করলে যৌবনের অসম্মান হবে, তোমাকেও অপমান করা হবে। আর যদি গ্রহণ করি, শুধু শরীরের আগুনটাই নিভবে, মনের তৃপ্তি আসবে না। কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি না।’

অন্ধকার ঘর, পুরুষ মানুষের কঠিন স্পর্শ, কোমল কণ্ঠস্বর, নিজের মনের অপ্রতিভ আর অসহায় অবস্থা রিফাতকে ভাবাবেগের প্রচণ্ড এক স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে, কান্না জড়ানো গলায় শুধু বলতে পারল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, মাসুদ ভাই!’

সকালে ওদের একই সময়ে একই বিছানায় ঘুম ভাঙল। রানা সম্পর্কে রিফাতের ধারণা বদলায়নি, শ্রদ্ধার পরিমাণ বরং আরও বেড়েছে। সেই সাথে দেহ-মনে বাসা বেঁধেছে অদ্ভুত একটা পুলক আর তৃপ্তি। শেষ রাতে ওদের মধ্যে যাই ঘটে থাকুক, কেউ সেজন্যে অনুতপ্ত নয়। দু’জনের মাঝখানে কোন কাঁটা নেই, আবার বাঁধনও নেই। পরস্পরকে নিয়ে ওরা স্বপ্ন দেখেনি, আবার কোন প্রত্যাশা অপূর্ণও থাকেনি। পরস্পরকে বুঝতে চেষ্টা করেছে ওরা, এবং একজন আরেকজনকে যতটুকুই চিনতে পেরে থাকুক, দু’জনেরই মনে হয়েছে অবাধ মেলামেশা আর বন্ধুত্বে কোন ক্ষতি নেই।

একসাথে ঘুম ভাঙলেও রানাকে বিছানা থেকে উঠতে দেয়নি রিফাত। আগে শাওয়ার সারল সে, তারপর ব্রেকফাস্ট তৈরি করল। ইতিমধ্যে শাওয়ার সেরে দাড়ি কামিয়ে কাপড় পরেছে রানা, টেবিলে বসে একসাথে নাস্তা করল দু’জনে। বিশেষ কোন কথা হলো না, তবে ঠোঁটে হাসি থাকল আর চেহারায় থাকল আনন্দ।

বিদায় নেয়ার সময় রানার সামনে দাঁড়াল রিফাত, ওর টাইয়ের নটটা ঠিক করে দিল।

‘ভূতের ভয় আর আছে?’ চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আবার কোন দিন যদি ঘরে ফিরে দেখো তোমার সোফায় ঘুমিয়ে আছি আমি, কি করবে?’ পাল্টা প্রশ্ন রিফাতের।

‘পালাব না,’ কথা দিল রানা। ‘জানব ঘুমাওনি তুমি, ঘুমের ভান করে আছ।’

‘রাগ হবে না?’

‘হবে,’ রিফাতের নাক টিপে দিয়ে বলল রানা। ‘আরও আগে আসোনি বলে।’

রিফাত চলে গেছে পাঁচ মিনিটও হয়নি, নক হলো দরজায়।

ভি-পি-সেভেনটি পরীক্ষা করা শেষ করেছে মাত্র রানা, সেটা কোটের পকেটে ফেলে দরজার দিকে এগোল ও। চট করে একবার চোখ বুলাল হাতঘড়ির ওপর। আটটা বাজতে এখনও সাত মিনিট বাকি। কে হতে পারে?

কোটের পকেটে একটা হাত রেখে দরজা খুলল ও।

প্রথম দর্শনে মনে হলো ভদ্রলোক পরচুলা পরে আছেন। কালো আর সাদা-ঠিক সাদা নয়, রূপালি। যেন একটা কালো চুলের পাশে একটা রূপালি, এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় হয়নি সারা মাথায় কোথাও। বয়স হলে, যখন চুল পাকবে, ঠিক এরকমটি যদি ওরও হয় খুশি হবে রানা। ঝাড়া ছয় ফুট লম্বা হবেন, নিখুঁতভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো। কড়া ভাঁজ করা অ্যাশ কালারের সুট। কোমরে বা কাঁধে হোলস্টার নেই, আন্দাজ করল রানা। এক রঙা টাই, নীল। একটু বিসদৃশ লাগল চোখে, স্টীলরিমের চশমাটা হাতে। বয়স হবে…আন্দাজ করা কঠিন, পঁয়তাল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে। চওড়া কাঠামো, তবে শরীরে অপ্রয়োজনীয় মেদ নেই। চোখ দুটো পরিষ্কার, চোখের নিচে কালি বা পুঁটুলি নেই। কোন কোন মেয়েকে দেখে যেমন বোঝা যায় না রানী নাকি মেথরানী, এই ভদ্রলোককে দেখেও আন্দাজ করা মুশকিল হাজী নাকি পাজি। ডেস্কের সাথে বাঁধা হেডক্লার্ক ও হতে পারেন, আবার ব্যবসায়ী হওয়াও বিচিত্র নয়। হাসছেন না, চেহারার ভাবটাই এমন, যেন হাসতে জানেন না। ‘বলুন,’ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা।

আপনার সাথে আমার একটু আলাপ ছিল,’ স্পষ্ট মার্কিন উচ্চারণ ‘আমি কে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘আপনি কে?’

‘আপনি মাসুদ রানা,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘আমি সি.আই.এ।’

‘সি.আই.এ-র সাথে আলাপ করতে উৎসাহী নই আমি,’ বলে দরজা বন্ধ করে দিতে গেল রানা।

ভদ্রলোক নড়লেন না, শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, ‘প্লীজ

‘আপনার কার্ড দেখি,’ বলল রানা।

ভদ্রলোক মোটেও অপ্রতিভ হলেন না। ‘পথে-ঘাটে আমি যদি মারা পড়ি, সি.আই.এ চায় না আমার পরিচয় জানাজানি হয়ে যাক।’

তবু রানা নরম হলো না, বলল, ‘ঠিক আছে, আলাপ থাকলে অফিসে আসুন। আবার দরজা বন্ধ করতে গেল ও।

‘অফিশিয়ালি নয়, আপনার সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে চেয়েছিলাম,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘আমি চাই না কেউ জানুক আমি আপনার কাছে এসেছি।’

‘আপনি চান না?’ হাসল রানা। ‘কিন্তু এরইমধ্যে অনেক লোক জানে। আমার ওপর নজর রাখার লোকের অভাব নেই, তারা আপনাকে এখানে ঢুকতে দেখেছে।

এই প্রথম ভদ্রলোকও হাসলেন। ‘না, মি. মাসুদ রানা, কেউ দেখেনি। কেন, আপনি লক্ষ করেননি, আমাদের লোকেরা ক’দিন ধরে আপনার আশপাশে রয়েছে?’ রানা লক্ষ করল হাসলে ভদ্রলোককে আশ্চর্য প্রাণবন্ত আর সরল দেখায়।

‘ও। গম্ভীর হলো রানা। ‘তাহলে আপনারাই।’

কিন্তু অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়, আর যারা আপনার ওপর নজর রাখে বা রাখতে পারে তাদের ভাগাবার জন্যে,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘আমি যখন বিল্ডিংটায় ঢুকেছি দু’মাইলের মধ্যে সি.আই.এ. ছাড়া আর কোন এসপিওনাজ এজেন্সির এজেন্ট ছিল না। একজন বাদে, কিন্তু মিস রিফাত জাহানও আমাকে ঢুকতে দেখেননি।

একটু গুরুত্ব দিতেই হলো রানাকে, জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? কি চান আপনারা? জানেন না, সি.আই.এ-র সাথে নিজেকে জড়াতে আগ্রহী নই আমি?’

‘জানি বলেই তো এত কাঠ খড় পুড়িয়ে আমার নিজেকে আসতে হলো,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘ভেতরে ডাকবেন না? আলাপটা বসেই করতাম?’

কিন্তু দরজা ছেড়ে নড়ল না রানা। ‘আপনার নাম?’ সি.আই.এ-র হাই অফিশিয়ালদের অনেককেই চেনে ও, নিদেনপক্ষে নাম জানা আছে।

‘কলিন ফর্বস।’

‘দুঃখিত,’ বলল রানা। ‘আলাপ করতে হলে আপনাকে অফিসে আসতে হবে।’ এই নামে সি.আই.এ.তে কোন উচ্চপদস্থ অফিসার নেই, এ-ব্যাপারে রানা প্রায় নিশ্চিত।

ভদ্রলোক তবু হতাশ হলেন না বা চটলেন না। বললেন, ‘এর আগে প্রতিবার সি.আই.এ. আপনার সাহায্য পাবার জন্যে যোগাযোগ করেছে। এবার কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম।’

‘অন্যরকম? কিরকম?’

‘এবার ব্যাপারটা পারস্পরিক। একটা কেসে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি, আপনি আমাদেরকে।‘

‘কেসটা কি?’

‘আপনার এই জিনিসটা আমি খারাপ চোখে দেখছি না, সব মানুষেরই উচিত নিজের জেদ বজায় রাখা। ধরে নিচ্ছি দরজায় দাঁড়িয়েই আপনি শুনতে চান?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেসটা মলিয়ের ঝান।’

ব্যাখ্যা চাইতে পারত রানা, কিন্তু সে-সবের মধ্যে গেল না। মলিয়ের ঝান সম্ভবত কোন লোকের নাম, কিন্তু এ-ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোন ইচ্ছে ওর নেই। দুঃখিত, এখনও আমি আগ্রহ বোধ করছি না।’

ভদ্রলোক হাসলেন না, বরং তাঁকে সিরিয়াস দেখাল। ‘কথা দিচ্ছি, করবেন।’ কয়েক সেকেন্ড ভাল করে ভদ্রলোককে লক্ষ করল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে? সি.আই.এ-র হয়ে কথা বলার অধিকার আপনার আছে?’

রানাকে প্রায় চমকে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি সি.আই.এ-র বর্তমান চীফ, ল্যাংলি থেকে আজ ভোরের ফ্লাইটে শুধু আপনার সাথে কথা বলার জন্যে এসেছি।’

.

মাত্র এক সেকেন্ডের জন্যে হতভম্ব হয়ে পড়ল রানা, তারপর সামলে নিল নিজেকে। সি.আই.এ. চীফ স্বয়ং ওর সাথে দেখা করতে এসেছেন, ভাবাই যায় না! ভদ্রলোককে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ও। ‘আসুন, ভেতরে এসে বসুন, প্লীজ।’ গত মাসে সি.আই.এ. চীফ বদলি হয়েছে জানত ও, কিন্তু সিনেটর কলিন ফর্বস নতুন চীফ হয়ে এসেছেন তা জানত না। ‘দুঃখিত, মি. ফর্বস।

‘ও কিছু না,’ ঘরে ঢুকে নিজের হাতে দরজা বন্ধ করলেন কলিন ফর্বস। ‘ইতিমধ্যে যতটুকু কানে এসেছে, ধারণা করা যায়, সি.আই.এ. সব সময় আপনার সাথে ঠিক ব্যবহারটি করেনি। আশা করি এখন থেকে যোগ্য লোকের সাথে ভাল ব্যবহার করার সুমতি আমাদের হবে।’

‘বসুন, প্লীজ,’ একটা সোফা দেখিয়ে বলল রানা। ‘কফি চলবে?’

‘নো, থ্যাঙ্কস্।’ সোফায় বসে কোট-পকেট থেকে টোবাকো পাউচ বের করলেন কলিন ফর্বস। ‘অনুমতি দিলে ধূমপান করতে পারি।’

মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে একটা সোফার হাতলে বসল রানা। অপেক্ষা করছে।

পাইপে তামাক ভরে রানার দিকে তাকালেন কলিন ফবস, ‘যদি আপত্তি না করেন, আপনার সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আপনার অনুমতির অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে।’

‘আমি কিন্তু কোন কথা দিইনি, মি. ফর্বস,’ বলল রানা। ‘এই মুহূর্তে বড় একটা কাজ রয়েছে আমার হাতে, আপনাদের জন্যে কিছু করতে পারব না। কি বলতে চান শুনতে রাজি হয়েছি শুধু আপনি নিজে এসেছেন বলে।’

‘জানি, ধন্যবাদ,’ আবার প্রাণবন্ত দেখাল কলিন ফবসকে, তবে ঠোঁটের হাসিতে এবার যেন একটু রহস্যের আভাস। ‘ডাকব ওকে?’ রানাকে মৃদু মাথা ঝাঁকাতে দেখে কোটের আস্তিন সরিয়ে কব্জি বের করলেন তিনি, দেখা গেল রিস্টওয়াচে অনেকগুলো খুদে বোতাম রয়েছে। একটা বোতামে একটু চাপ দিয়ে কোটের আস্তিন টেনে রিস্টওয়াচ ঢাকলেন। প্রায় সাথে সাথে নক হলো দরজায়।

‘কাম ইন,’ বলল রানা।

দরজা খুলে ভেতরে যেন আগুনের একটা স্তম্ভ ঢুকল। যথেষ্ট লম্বা, অ্যাথলেটিক, বিধাতা যেন ছুটি নিয়ে বিশেষ যত্নের সাথে এই মূর্তির প্রতিটি অঙ্গ নিজের হাতে তৈরি করেছেন। এবং কোন সন্দেহ নেই, সুষমা ভরা পাত্রটি তাঁর হাত থেকে মেয়েটার মুখে পড়ে গিয়েছিল।

‘দেখুন, চিনতে পারেন কিনা,’ কলিন ফর্বস বললেন। ‘আমার ঠিক জানা নেই রিটা হ্যামিলটনের সাথে আপনার আলাপ আছে কিনা।’

‘রিটা হ্যামিলটন,’ বিড়বিড় করল রানা, অপ্রতিভ এবং আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে নামটা পরিচিত লাগলেও, এই স্বর্গীয় অপ্সরাকে আগে কখনও দেখার সৌভাগ্য ওর হয়নি।

আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে মেয়েটাও। বড় বড় চোখে একটু বিস্ময়, খানিকটা বিব্ৰত ভাব। সাধারণ একটা ডেনিম স্কার্ট আর শার্ট পরে রয়েছে সে।

নিজেকে দ্রুত সামলে নিতে পারল রানা, সজাগ হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনের সাথে সামান্য হলেও মিল আছে চেহারায়, অন্তত ভুরু জোড়া যেখানে মিলেছে। ‘আলাপ হয়নি,’ বলল রানা। ‘তবে আন্দাজ করতে পারছি—উনি নুমা-র ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনের মেয়ে। হ্যালো, রিটা।’ বলে হাত বাড়িয়ে দিল রানা।

‘হ্যালো।’ রানার সাথে হ্যান্ডশেক করল রিটা। ‘বাবার মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি,’ কোন আবেগ নেই, বিবৃতির মত শোনাল। শতমুখে উনি আপনার প্রশংসা করেন!’ ভাবটা যেন, অন্যায় বা পক্ষপাতিত্ব করেন। রানা অনুরোধ করার আগেই কলিন ফর্বসের পাশের সোফায় বসে পড়ল রিটা ।

‘কেমন আছেন অ্যাডমিরাল?’ শ্রদ্ধার ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘ভাল,’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে বস্ কলিন ফর্বসের দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘আমার মনে হয়, এবার কাজের কথা শুরু করা যেতে পারে,’ বললেন কলিন ফর্বস। ‘শুরু করো, রিটা।’

‘বস চাইছেন আমি আমার ব্যক্তিগত ইতিহাস খানিকটা শোনাই আপনাকে,’ বলল রিটা হ্যামিলটন। কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা মাদকতা আছে, কানে ঢোকা মাত্র পুলকে শিরশির করে ওঠে গা; কিন্তু কেন কে জানে বলার ভঙ্গিতে ক্ষীণ ব্যঙ্গের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে রিটা হ্যামিলটন।

কিন্তু তার কি কোন প্রয়োজন আছে…?’ সি.আই.এ. চীফের দিকে তাকাল রানা।

‘প্লীজ, মি. রানা, একটু ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করি।’

রিটা হ্যামিলটনের ক্যারিয়ার শুরু হয় আঠারো বছর বয়সে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন সেক্রেটারি হিসেবে। এক বছরের মধ্যে সি.আই.এ. কাজ করার প্রস্তাব দেয় তাকে। ‘আমার বাবা নুমার ডিরেক্টর, সেটাই বোধহয় কারণ, ‘ বলল রিটা। তবে আমাকে সাবধান করে দেয়া হয়, বাবা যেন ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু জানতে না পারে।’ স্টেট ডিপার্টমেন্টে যেমন কাজ করছিল তেমনি করতে থাকে সে, শুধু ছুটির দিনগুলোয় আর বিশেষ কোন কোন সন্ধ্যায় ট্রেনিং কোর্সে অংশগ্রহণ করত।

‘আমাকে অ্যাকটিভ এজেন্ট হিসেবে চায়নি সি.আই.এ.। প্রথম থেকেই ঠিক হয়, আমাকে ট্রেনিং দেয়া হবে, নিয়মিত রিফ্রেশার কোর্স শেষ করব, কিন্তু স্টেট ডিপার্টমেন্টের চাকরি ছাড়ব না। তবে, প্রয়োজন দেখা দিলে ভবিষ্যতে আমাকে ডাকা হতে পারে।

‘এবং প্রয়োজন দেখা দেয়ায় ডাকা হয়েছে ওকে,’ বললেন কলিন ফর্বস, রানার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। ‘এত কথা বলার কারণ, মি. রানা, আপনাকে জানানো যে যাকে আমরা ‘ফেস’ বলি রিটা হ্যামিলটন তা নয়।’ অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন দূনিয়ার এসপিওনাজ সমাজ রিটা হ্যামিলটনকে চেনে না। ‘আপনার সাথে এই কেসটায় কাজ করার জন্যে সহকারিণী হিসেবে ঠিক এমন একটি মেয়েই দরকার, আমেরিকান স্পাই বলে যাকে কেউ চিনতে পারবে না…

বাধা দিল রানা, ‘মি. ফৰ্বস, আমি আগেই বলেছি…’

‘একটু পরই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে, মি. রানা,’ কলিন ফর্বস আশ্বাস দিলেন। ‘এই মুহূর্তে বড় একটা কাজে আপনি ব্যস্ত, আমি ভুলিনি। আমাদের কাজটা আপনার কাজের চেয়ে কোন অংশে ছোট নয়, এটুকু জানি বলেই বিশ্বাস আছে আপনি আমার অনুরোধ ফেলবেন না। আমার অনুরোধে যদি কাজ না হয়—,’ কোটের পকেট হাতড়ে অনেকগুলো কাগজ বের করলেন তিনি, একাধিক এনভেলাপও দেখা গেল সেগুলোর মধ্যে। তার মধ্যে একটায় প্রেসিডেন্সিয়াল সীল দেখতে পেল রানা। আশ্বস্ত হয়ে বাকি কাগজের সাথে সীল মারা এনভেলাপটাও আবার পকেটে রেখে দিলেন কলিন ফর্বস।

হাতঘড়ি দেখল রানা। ‘অনুরোধ করব তাড়াতাড়ি শেষ করবেন, মি. ফর্বস।’

‘ব্যাপারটা হলো মলিয়ের ঝান-কে নিয়ে,’ শুরু করলেন সি.আই.এ. চীফ। কোটের আরেক পকেট থেকে ছোট একটা ফোল্ডার বের করেছেন তিনি, হাতের চশমাটা নাকে এঁটে সেটার পাতা খুললেন।

তথ্যগুলো সাজিয়ে লেখা আছে, পড়ে শোনালেন রানাকে। উনিশশো ত্রিশ সালে নিউ ইয়র্কে জন্ম মলিয়ের ঝানের। ফরাসী বাবা আর জার্মান মায়ের একমাত্র সন্তান। মা-বাবা দু’জনেই ছিল মার্কিন নাগরিক। মলিয়ের ঝান তার প্রথম এক মিলিয়ন ডলার রোজগার করে মাত্র বিশ বছর বয়েসে, পরবর্তী তিন বছরে মালটি মিলিওনেয়ার বনে যায় সে। বয়স হবার পর থেকেই আমেরিকান নাৎসী পার্টির সদস্য হয়, পার্টিতে সৎ বিশ্বস্ত আর নিরেদিতপ্রাণ বলে যথেষ্ট খ্যাতি আছে। ব্যাপারটা গোপন রাখার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। ‘উনিশশো ষাট সালে সে তার সমস্ত ব্যবসায়িক স্বার্থ চড়া দামে বিক্রি করে দেয়, সেই থেকে মধ্যযুগের রাজাদের মত বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে সে। নিজের রাজ্য ছেড়ে বড় একটা বের হয় না…’

‘নিজের কি…?’ ভুরু কুঁচকে উঠল রানার।

কথার কথা, মি. রানা। রিটা ব্যাখ্যা করবে।’

‘আমারিলো, টেক্সাস থেকে আশি মাইল দূরে মলিয়ের ঝানের রয়েছে একশো পঞ্চাশ বর্গমাইল সম্পত্তি। একসময় জায়গাটা মরুভূমি ছিল। তার রাজ্য বলাটাই ঠিক। পানি তো নিয়ে গেছেই, বনভূমি তৈরি করে তার ভেতর বাড়ি বানিয়েছে, তারপর আক্ষরিক অর্থেই সীল করে দিয়েছে। কোন রাস্তাই ঝান র‍্যাঞ্চে পৌঁছায়নি। দু’ভাবে আপনি ওখানে যেতে পারেন—ছোট একটা এয়ারস্ট্রিপ, আর একটা প্রাইভেট মনো-রেল সিস্টেম আছে। শহরের পনেরো মাইল বাইরে পরিত্যক্ত একটা স্টেশন আছে-তারমানে আমারিলো-র কথা বলছি—মাঝে মধ্যে স্টেশনটা ব্যবহার করে মলিয়ের ঝান, তবে আপনার সাথে তার খুব যদি দহরম- মহরম থাকে তাহলেই শুধু মনো-রেলে চড়ার সুযোগ পাবেন। সে যদি অনুমতি দেয় নিজের গাড়ি নিয়েও যেতে পারেন, রেল সিস্টেমে গাড়ি বহন করার ব্যবস্থা আছে, আর র‍্যাঞ্চে আছে রাস্তা- কমপাউন্ডের ভেতর। ভেতরে বড় বড় বিল্ডিং দেখতে পাবেন, অটোমোবাইল রেস ট্র্যাক, ঘোড়া, লেক, সব আছে।’

নির্লিপ্ত চেহারা নিয়ে শুনে যাচ্ছে রানা, যেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। রিটা হ্যামিলটন এমনভাবে চুপ করে আছে যেন রানাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিচ্ছে।

কিন্তু রানা কোন প্রশ্ন করল না দেখে নিজেই উত্তর দেয়ার ভঙ্গিতে আবার শুরু করল, ‘না, ওখানে আমি যাইনি। তবে ছবিগুলো সবই দেখেছি-স্যাটেলাইট থেকে তোলা। আমাকে ব্রিফ করার সময় দেখানো হয়। এই মুহূর্তে ওগুলো আমার সাথেই আছে। একশো পঞ্চাশ বর্গমাইল এলাকা, পুরোটাই পাঁচিল আর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আর মলিয়ের ঝানের রয়েছে নিজস্ব সিকিউরিটি আউটফিট।’

আবার চুপ করে রানার দিকে তাকাল রিটা হ্যামিলটন, চোখের ভাষা দেখে বোঝা গেল সে যেন ভাবছে: লোকটা বোকা, নাকি অভদ্র? কৌতূহলবশতঃও তো মানুষ কিছু জিজ্ঞেস করে।

নিচু টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার তুলল রানা। প্যাকেটটা রিটার দিকে বাড়িয়ে ধরল, কিন্তু মাথা নাড়ল সে। কলিন ফর্বস রানার দেখাদেখি পাইপে তামাক ভরতে শুরু করেছেন। ‘রাজ্যই হোক আর র‍্যাঞ্চই হোক,’ বলল রানা, ‘তার অপরাধটা কি? টাকা বানানো ছাড়া?’

‘সেটাই সমস্যা,’ বলে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বসের দিকে তাকাল রিটা হ্যামিলটন।

‘বলো, সব ওঁকে বলো, রিটা,’ অনুমতি দিলেন কলিন ফর্বস। ‘সব কথাই জানা দরকার ওঁর।’

‘মাস কয়েক আগে পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটা অস্পষ্ট ছিল।’ পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে সোফায় হেলান দিল রিটা হ্যামিলটন। স্কার্টে টান পড়ায় বেরিয়ে পড়ল মসৃণ, ফর্সা হাঁটু। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সিলিঙের দিকে তাকালেন সি.আই.এ. চীফ ‘রাজনৈতিক অর্থে অনেক দিন থেকেই মলিয়ের ঝানকে সন্দেহের চোখে দেখা যাচ্ছে। পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিটি থেকে বরাবর দূরে থাকায় তাকে নিয়ে অবশ্য বিশেষ মাথা ঘামাতে হয়নি। কিন্তু সে যে পিছনের দরজা দিয়ে হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবার চেষ্টা চালিয়েছে তার প্রমাণ আছে। একাধিক রাজনৈতিক দলের সাথে গোপনে ভিড়তে চেয়েছে সে, কিন্তু কোন দলই তাকে সুযোগ দেয়নি।’

‘রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে আমার ধারণা আপনি দেখছি বদলে দিতে চাইছেন,’ বলল রানা। ‘এতদিন জেনে এসেছি ধড়িবাজ লোকদেরই আড্ডা…’

‘দলগুলো তার টাকা-যাকে চাঁদা বলা হয়-নিয়েছে, কিন্তু তাকে নেয়নি, ‘ ব্যাখ্যা করল রিটা হ্যামিলটন, এই প্রথম ক্ষীণ একটু হাসল সে। রানা লক্ষ করল, হাসলে জর্জ হ্যামিলটনের সাথে চেহারার আর একটু মিল পাওয়া যায়। ‘ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হবার সময় জানা গেছে, কেলেঙ্কারিটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য যে টাকা খরচ হয়েছিল তার একটা মোটা অংশ এসেছিল মলিয়ের ঝানের পকেট থেকে। আরও জানা গেছে, লোকটা আমাদের প্রশাসনেও ঢোকার চেষ্টা করেছে—স্টেট ডিপার্টমেন্টে।’

মোটেও আগ্রহ বোধ করছে না রানা। হাতঘড়ি দেখল ও। অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্বয়ং সি.আই.এ. চীফ উপস্থিত রয়েছেন, তা না হলে আরও আগেই ওদেরকে বিদায় করে দিত। ‘স্টেট ডিপার্টমেন্টে ঢুকতে চায় লোকটা?’ নিস্তব্ধতা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠায় জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কেন? তার ইচ্ছে মার্কিন সরকারকে মুঠোয় আনা?’

‘কষ্ট কল্পনা বলে মনে হলেও, ওয়াকিফহাল মহলের অনেকেরই তাই ধারণা। বর্তমান যুগে শুধু আমীর আর শেখরাই ধনকুবের মনে করলে ভুল হবে। টেক্সাসে এমন সব পরিবার আছে যারা আক্ষরিক অর্থেই রাজ-রাজড়াদের মত জীবনযাপন করে। তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, সব দেশেই দু’চারজন যেমন থাকে, যারা বিপজ্জনক ফ্যান্টাসীতে ভোগে। বিপজ্জনক ফ্যান্টাসীর সাথে যখন সীমাহীন বিত্ত-বৈভব যোগ হয় :-

রানার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন কলিন ফর্বস, যেন রিটা হ্যামিলটনের যুক্তি অকাট্য। ‘এবং ভুলে গেলে চলবে না যে মলিয়ের ঝানের ফ্যান্টাসী নাৎসী আইডিওলজি থেকে তৈরি।’

‘কিন্তু হোক নাৎসী আদর্শে বিশ্বাস,’ বলল রানা, ‘তাকে বিপজ্জনক বলা যায় কিভাবে সে যদি…’

‘সে যদি কিছু না করে, তাই না?’ রানার দিকে সরাসরি তাকাল রিটা হ্যামিলটন। ‘হ্যাঁ, আপনার সাথে একমত আমি। কিন্তু সে যে কিছু করছে তার আভাস পাচ্ছি আমরা। গত এক বছর ধরে র‍্যাঞ্চে অদ্ভুত একদল লোককে অভ্যর্থনা জানিয়ে আসছে ঝান। নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা জোরদার করেছে সে, স্টাফদের সংখ্যাও আগের চেয়ে অনেক বেশি।’

আবার হাতঘড়ি দেখে নিয়ে শিরদাঁড়া খাড়া করল রানা, কলিন ফর্বসের দিকে তাকাল। ‘মি. ফর্বস, এবার আমাকে মাফ করতে হবে। দুঃখিত, আপনাদের কথা সবটা শোনা হলো না। দয়া করে যদি…’

মনে নেই, আপনি আমাকে কফি অফার করেছিলেন?’ চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন কলিন ফর্বস। ‘অফারটা আমি গ্রহণ করেছি, মি. রানা।’

হেসে ফেলল রানা। সোফা ছাড়তে যাবে, মৃদু হেসে রিটা হ্যামিলটন বলল, ‘কাজটা মেয়েদের, আপনি শুধু আমাকে কিচেনটা দেখিয়ে দিন।’

একাই কফি বানিয়ে নিয়ে এল রিটা হ্যামিলটন।

কাপে চুমুক দিয়ে কলিন ফর্বস বললেন, ‘তাড়াতাড়ি করো, রিটা। দেখছ না, মি. রানা অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।

মলিয়ের ঝান যে বড় ধরনের কিছু একটা করতে যাচ্ছে সে-ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আমাদের,’ বলল রিটা হ্যামিলটন। সংক্ষেপে ঘটনাগুলো জানাল সে রানাকে। মলিয়ের ঝান আর তার র‍্যাঞ্চের ওপর নজর রাখছিল এফ.বি.আই. খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার কয়েকটা ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিসকে তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগান দেয়। এরপর আই.আর.এস. এবং এফ.বি.আই. একসাথে কাজ করার একটা অজুহাত খুঁজে পেল। গত জানুয়ারি মাসে, দুটো ব্রাঞ্চ থেকে দু’জন করে চারজন এজেন্ট ওখানে যায় মলিয়ের ঝানের সাথে কথা বলার জন্যে। গেল কিন্তু ফিরে এল না। এফ.বি.আই. তাদের আরও দু’জন লোককে পাঠাল। তারাও গায়েব হয়ে গেল। এরপর অ্যামারিলো পুলিস ঝানের সাথে যোগাযোগ করল, তদন্ত করতে কোন বাধা দিল না ঝান। তার কথা, এ-ব্যাপারে বিন্দু-বিসর্গ কিছুই সে জানে না, কাজেই পুলিসকে কিছুই সে বলতে পারবে না। কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না, বাধ্য হয়ে র‍্যাঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে এল পুলিস। এরপর ব্যাপারটা চলে এল সি.আই.এ-র হাতে, তারা একটা মেয়েকে পাঠাল। কিন্তু মেয়েটারও কোন খবর নেই।

তারপর, এই হপ্তাখানেক আগে, ব্যাটন রুজ, লুসিয়ানার কাছে জলাভূমিতে একটা লাশ পাওয়া গেল,’ বলে চলেছে রিটা হ্যামিলটন। ‘ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়, নিউজ মিডিয়াকে কিছুই জানতে দেয়া হয়নি। লাশটা এমনিতে চেনার উপায় ছিল না, তবে এক্সপার্টরা পরীক্ষা করে জানিয়েছে মেয়েটা সি.আই.এ-র পাঠানো সেই এজেন্টই। তারপর থেকে এক এক করে বাকি সবার লাশ পাওয়া গেছে, ওই একই জায়গার কাছাকাছি। দুটো লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, বাকিগুলোকে দাঁত পরীক্ষা করে চেনা গেছে। মলিয়ের ঝানের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের জন্যে যাকেই পাঠানো হয়েছে টেক্সাসে, তারই লাশ পাওয়া গেছে লুসিয়ানায়।’

‘হ্যাঁ,’ একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল রানা, ‘মাথা গরম হওয়ার মত একটা ব্যাপার বটে। কিন্তু সে আপনাদের। এর মধ্যে আমি কেন নিজেকে জড়াতে যাব?’

‘স্যার,’ রিটা হ্যামিলটন বলল, ‘মি. রানাকে ওটা আপনি দেখান।’

এবার কোটের বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন কলিন ফৰ্বস, বাড়িয়ে ধরলেন রানার দিকে। ছেঁড়া একটা কাগজ, ফটোকপি করা। টাইপ করা লেখাগুলো ঝরঝরে, পড়তে কোন অসুবিধে হলো না। তবে ছেঁড়া বলে অনেক বাক্যই অসম্পূর্ণ লাগল। বোঝা যায় একটা চিঠির অংশবিশেষ। রানা যা পড়ল তা হুবহু এরকম :

ans should, of course, be destroyed. But he wished make certain you had full knowledge of our substan- । backing, world-wide. The ।nitial thrust will most telling in Europe, and the Mid – East. But, ntually, it will leave the United States wide pen. With careful manipulation we can successfu ivide and rule-or at least I look forward to our next meeting.

সই করা হয়েছে এক টানে, তবে নামটা পরিষ্কার পড়া গেল। সও মং।

রানার পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল, শক্ত হয়ে গেল পেশী।

‘কোথায়…?’

‘কোথায় পাওয়া গেছে?’ জিজ্ঞেস করল রিটা হ্যামিলটন। ‘যে মেয়েটার কথা বললাম, তার কাপড়ের ভেতর। লাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।’

কলিন ফর্বস বললেন, ‘আমাদের ল্যাংলির অ্যানালিস্টরা ভাবছে, হার্মিস নামে একটা টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনের সাথে হাত মিলিয়েছে মলিয়ের ঝান। আমার জানামতে এ-ব্যাপারে আপনি একজন এক্সপার্ট, মি. রানা।’

‘সও মং মারা গেছে,’ ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা।

‘আমাদের রিপোর্টও তাই বলে,’ সমর্থন করলেন সি.আই.এ. চীফ। ‘কিন্তু বংশধরদের কেউ হতে পারে না? তার কোন ভাই? কিংবা আর কেউ? যখন বললেন বড় একটা কাজে আপনি ব্যস্ত, আমি ধরে নিয়েছিলাম হার্মিস আর সও মংই আপনার ব্যস্ততার কারণ হবে, নাকি আমার ভুল হয়েছে? সাম্প্রতিক হাইজ্যাক ঘটনাগুলোর জন্যে তো ওরাই দায়ী, নাকি?’

রানা কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকল।

‘আমরা কি জানতে পারলাম সেটা একটু খতিয়ে দেখা যাক,’ বললেন কলিন ফর্বস। ‘কেউ একজন সও মং নাম ধারণ করে অসম্ভব ধনী এক টেক্সান-এর সাথে জোট বেঁধেছে।’ রানার হাতের কাগজটার দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। ‘ওটা থেকে আমরা জানতে পারছি যে মলিয়ের ঝান, এবং হার্মিস, দুনিয়া জুড়ে আগুন লাগাবার একটা ষড়যন্ত্র করছে। ঈশ্বর সাক্ষী, এমনিতেই দুনিয়ার অবস্থা নরকতুল্য হয়ে আছে-সরকারগুলো দুর্নীতির আখড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে, অবক্ষয়ের শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে সমাজ, ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষ, সম্পদ আর মেধা পাচার অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলছে, শরণার্থী সমস্যা হয়ে উঠছে প্রকট; এরমধ্যে আবার যদি বড় ধরনের কোন ফ্রিল্যান্স অপারেশন শুরু হয়, সভ্যতাকে কেউ আমরা রক্ষা করতে পারব না। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, দুনিয়া জুড়ে সমস্যা সৃষ্টি করার ক্ষমতা হার্মিস রাখে।’

রানা ভাবছে। সও মং বা হার্মিস যে একটা বিপজ্জনক হুমকি তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবং বসেরও ধারণা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লাগতে হলে বাইরের সাহায্য দরকার হবে ওর। কিন্তু ছদ্মবেশী সও মং আস্তানা গেড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কাজেই একদিক থেকে সমস্যাটা সি.আই.এ-র। কিন্তু সি.আই.এ-র সাহায্য নেয়ার ইচ্ছে ওর নেই, এমনকি নতুন ডিরেক্টরের অনুরোধেও নয়। অতীতে দেখা গেছে, শেষ পর্যন্ত কোন না কোন ঘাপলা করে ওরা, কথা দিয়ে কথা রাখে না। হার্মিসের বিরুদ্ধে একা কাজ করাই সব দিক থেকে ভাল। পরিষ্কার ভাষায়, সবিনয়ে সেকথাই কলিন ফবসকে জানিয়ে দিল ও, বলল, ‘দুঃখিত, মি. ফর্বস। ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধে আছে, আপনাদের সাহায্য আমি নিতে পারি না।

‘তারমানে আমি ফেল করলাম,’ মৃদু হেসে বললেন সি.আই.এ. চীফ। দেখা যাক ইনিও ফেল করেন কিনা বলে কোটের পকেট থেকে

থেকে এবার প্রেসিডেনশিয়াল সীল মারা এনভেলাপটা বের করলেন তিনি। এনভেলাপটা রানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখুন না, প্লীজ।’

প্রেসিডেনশিয়াল লেটারপ্যাডে টাইপ করা একটা চিঠি, নিচে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর। এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা পড়ে ফেলল রানা।

জনাব মাসুদ রানা,

আমাকে জানানো হয়েছে হার্মিস সম্পর্কে আপনি একজন বিশেষজ্ঞ। ব্যাপারটা আমার কাছে এতটাই সংবেদনশীল বলে মনে হয়েছে যে সাধারণ চ্যানেল ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেজন্যেই আমার বন্ধুর মেয়ে রিটা হ্যামিলটনকে দিয়ে কাজটা করাতে চাই। আপনার কাছ থেকে আমরা বিশেষ যে উপকারটি কামনা করি তা হলো, রিটা হ্যামিলটনকে আপনি সহকারিণী হিসেবে নেবেন, তারপর আমেরিকায় এসে মলিয়ের ঝান সেট-আপে অনুপ্রবেশ করবেন। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

এই সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা যায় না। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল রানা। ‘আমার দুটো প্রশ্ন আছে,’ রাজি হয়েই কাজের কথা পাড়ল ও। ‘মলিয়ের ঝানের বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে কি জানেন আপনারা?’

‘এর আগে দু’বার বিয়ে করেছে সে,’ উত্তর দিল রিটা হ্যামিলটন। ‘দু’জনেই মারা গেছে। স্বাভাবিক মৃত্যু-প্রথমটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে, দ্বিতীয়টা ব্রেন টিউমারে সম্ভবত আবার সে বিয়ে করবে-গুজব, ওয়াশিংটন থেকে একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে বন্দী করে রেখেছে সে। মেয়েটার নাম বেলাডোনা, ফরাসী। শোনা যায়, বন্দী করে রাখলেও, বেলাডোনার ওপর কোন অত্যাচার করে না ঝান। বেলাডোনা তার বিয়ের প্রস্তাবে স্বেচ্ছায় সম্মতি দেবে, এই আশায় অপেক্ষা করে আছে সে। ফ্রান্সে জন্ম হলেও আমেরিকার নাগরিক বেলাডোনা। ঝানের সাথে তার পরিচয় হয় প্যারিসে। খুবই নাকি সুন্দরী। অবশ্য এ সবই শোনা কথা।’

‘শোনা কথা চেক করে দেখা যায় না?’

পকেট থেকে নোট বুক বের করে কিছু লিখলেন কলিন ফর্বস। ‘চেক করা হবে।

‘আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন, মি. রানা?’ জিজ্ঞেস করল রিটা হ্যামিলটন, একটু যেন চ্যালেঞ্জের সুরে!

‘মলিয়ের ঝান তার প্রথম মিলিয়ন বানাল কিভাবে? তারপর তো, ধারণা করি, সতর্ক ইনভেস্টমেন্টের ফল, তাই না?

‘আইসক্রীম, হাসি মুখে বলল রিটা হ্যামিলটন। ‘আপনি তাকে আইসক্রীম ব্যবসার প্রথম রাজা বলতে পারেন। এই ব্যবসায় এমন সব উদ্ভাবন আছে তার, অবিশ্বাস্য। তার দেখাদেখি অবশ্য আরও অনেক বড় আইসক্রীম ফ্যাক্টরি অনেকেই তৈরি করেছে, তবে সে-ই পথ প্রদর্শক। নিজের সব ব্যবসা বিক্রি করে দিলেও ছোট একটা আইসক্রীম কারখানা এখনও রেখেছে সে। র‍্যাঞ্চের ভেতর এমনকি এখনও তার একটা ল্যাবরেটরি আছে। নিত্যনতুন পদ্ধতি আর উপকরণ দিয়ে সবাইকে চমকে দেয়ার প্রবণতা একটুও কমেনি। আনকোরা নতুন ফ্লেভার আপনি শুধু তার কাছ থেকেই আশা করতে পারেন।’

মৃদু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন কলিন ফর্বস। ‘তার কাছাকাছি পৌঁছানো একটা সমস্যা, এটা পরিষ্কার।’

‘মেয়েটা আর আইসক্রীম ছাড়া,’ রিটা হ্যামিলটন বলল, ‘মলিয়ের ঝানের আরেকটা দুর্বলতা আছে।’

তার দিকে তাকাল রানা।

‘প্রিন্টস। দুর্লভ প্রিন্টস। তার কালেকশনের নাকি তুলনা হয় না। এটা আসলেও তার একটা মস্ত দুর্বলতা। ল্যাংলিতে একজন নিরপরাধ লোককে ইন্টারোগেট করা হয়, তারপর ছেড়ে দেয়া হয়, এই তো মাত্র কিছুদিন আগের কথা-ইনিই প্রথম এবং শেষ ব্যক্তি যিনি ঝান র‍্যাঞ্চে ঢুকে আবার জীবিত বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। দুর্লভ প্রিন্টের তিনি একজন নামকরা ডিলার।’

‘মি. রানা, দুর্লভ প্রিন্ট সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন নাকি?’ সকৌতুকে জানতে চাইলেন সি.আই.এ. চীফ। ‘আমি কিন্তু একেবারেই অজ্ঞ।’

‘আমিও, মি. ফস,’ বলল রানা, তারপর সিগারেট ধরিয়ে শেষ করল কথাটা, ‘তবে চেষ্টা করলে খুব তাড়াতাড়ি জেনে নিতে পারব।’

‘সে আমাদের রিটাও পারবে,’ দুর্লভ হাসিটুকু আবার কলিন ফর্বসের মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। অনুমতি চাইলেন তিনি, ‘আপনার ফোনটা একটু ব্যবহার করতে পারি. মি. রানা?’