আবার উ সেন – ১.১০

দশ

ঝানের কড়া মিন্ট জুলিপ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করল রানা, বদলে আরেকটা ভোদকা মার্টিনি চাইল ও।

‘অবশ্যই, অবশ্যই! ব্যস্ত হয়ে উঠল ঝান। ‘আপনার যা খুশি! খাওয়া আর পান করার ব্যাপারে কোন পুরুষের ওপর আমি জোর খাটাই না। কিন্তু যদি মেয়েদের কথা বলেন…মানে, সেটা আলাদা ব্যাপার।

‘কি বলতে চান?’ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করল রানা।

বারান্দার প্রধান দরজা দিয়ে সাদা কোট পরা একজন বেয়ারা ঢুকেছে, বড়সড় ট্রলি বার-এর পিছনে সতর্ক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ঝান নিজের হাতে অতিথিদের আপ্যায়ন করে তপ্ত হতে চায়। বোতলের ওপর দিয়ে তাকাল সে, হাত দুটো শরীরের দু’পাশে শূন্যে স্থির হয়ে আছে, সরল মুখ বিস্ময়ের মুখোশ। ‘আমি দুঃখিত, মি. রানা। আপনাকে আহত করলাম?’

জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘বললেন পুরুষদের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে জোর খাটান না, তারপর বললেন মেয়েদের ব্যাপারে খাটান’। আমি কথাটার মানে জানতে চেয়েছি।’

শান্ত হলো ঝান, ঢিল পড়ল পেশীতে, আবার হাসল সে। ‘একটা জোক, মি. রানা। জাস্ট এ জোক, অ্যামাঙ মেন অভ দ্য ওয়ার্ল্ড। অর, মে বি ইউ আর নট আ ম্যান অভ দ্য ওয়ার্ল্ড?’

‘সে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আছে বটে।’ চেহারায় অসন্তোষের ভাব ধরে রাখল রানা। কিন্তু তবু আমি বুঝতে অক্ষম মেয়েদের সাথে অন্য রকম ব্যবহার কেন করা হবে।

‘আমি শুধু বলতে চেয়েছি মেয়েদেরকে মাঝেমধ্যে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে প্রলুব্ধ করতে হয়।’ রিটার দিকে ফিরল ঝান। ‘কি, মিসেস লুগানিস, মাঝে মধ্যে প্রলুব্ধ হতে ইচ্ছে করে না?’

হেসে উঠল রিটা! ‘সেটা নির্ভর করে কে, কিসের জন্যে প্রলুব্ধ করতে চায়… মাঝখান থেকে সরু মেয়েলি গলায় পিয়েরে ল্যাচাসি মন্তব্য করল, ‘আমার ধারণা ঝান সেই পুরানো প্রচলিত কথাটার ওপর ভিত্তি করে জোক করার চেষ্টা করছিল-মেয়েরা যখন ‘না’ বলে তখন আসলে তারা বলতে চায় ‘হয়তো’।’

‘আর যখন ওরা ‘হয়তো’ বলে তখন আসলে বলতে চায় ‘হ্যাঁ’,’ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে কথাটা শেষ করল ঝান।

‘আচ্ছা।’ টেবিল থেকে মার্টিনির গ্লাসটা তুলে নিল রানা, শব্দটা এমন নীরস সুরে উচ্চারণ করল যেন ওর ভেতর রসবোধ বলে কিছু নেই। মনে মনে এই মাত্র একটা হিসেব শেষ করেছে ও-মলিয়ের ঝানের মত লোকের সাথে খেলতে হলে বিপরীতধর্মী একটা ভূমিকা গ্রহণ করাই সবদিক থেকে ভাল।

‘তা সে যাই হোক,’ বলে গ্লাসটা উঁচু করল ঝান, ‘আসুন, হাতের কাজটা শেষ করি। তারপর, সম্ভবত, মি. রানা, হোগার্থের শিল্পকর্মের সাথে পরিচিত হওয়া যাবে। লাঞ্চের আগে হাতে সময় রয়েছে।’

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল রানা, তারপর মন্তব্য করল, ‘টাইম ইজ মানি, মি. ঝান।’

‘কি যে বলেন, সময় জাহান্নামে যাক।’ চেহারায় গর্ব নিয়ে বলল ঝান। ‘আমার টাকা আছে, আর আপনার আছে সময়। কিংবা আপনার যদি না থাকে, আমি সেটা কিনে নেব। এত দূরের পথ ভেঙে অতিথিরা যাঁরা আমার এখানে আসেন, তাঁদের আমি আনন্দ-ফুর্তির ভাগ না দিয়ে ছাড়ি না।’ থামল সে, যেন রিটাকে অনুরোধ করছে। ‘আপনারা ক’টা দিন থেকে যাবেন, কি বলেন, মিসেস লুগানিস? প্লীজ! সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, গেস্ট কেবিন খুলে…’

‘দু’একদিনে কিছু এসে যাবে না, কি বলো, রানা?’ আবেদনের ভঙ্গিতে রানার দিকে তাকাল রিটা, চেহারায় আবদারের ভাবটুকু নিখুঁতভাবে ফুটল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা, ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করল। ‘কিন্তু…মানে…’

‘আপত্তি কোরো না, প্লীজ, রানা। তুমি চাইলে গ্রেগকে আমি ফোন করতে পারি…’

‘সিদ্ধান্তটা তুমি নেবে,’ গম্ভীর গলায় জানিয়ে দিল রানা।

‘ব্যস, মিটে গেল!’ হাত দুটো পরস্পরের সাথে ঘষল ঝান। ‘এবার…মানে…হোগার্থ প্রিন্টগুলো এখন কি একবার দেখা সম্ভব?’

রিটার দিকে তাকাল রানা। ‘তোমার যদি কোন অসুবিধে না থাকে, মিসেস লুগানিস।’

মিষ্টি করে হাসল রিটা। প্রিন্টের ব্যাপারে তোমার কথাই শেষ কথা, রানা। আমার স্বামী ওগুলো তোমার হাতে তুলে দিয়েছে।’

ইতস্তত করল রানা। ‘ঠিক আছে, আমি তো কোন অসুবিধে দেখছি না। তবে চাইব, মি. ঝান, ওগুলো আপনি বাড়ির ভেতর দেখবেন।’

‘প্লীজ!’ খুশিতে যেন লাফাতে শুরু করল ঝান, তার বিশাল শরীর এক পা থেকে আরেক পায়ে ঘন ঘন ভর দিচ্ছে। ‘প্লীজ কল মি মলিয়ের। আপনি এখন টেক্সাসে রয়েছেন।

পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করল রানা, ধাপ বেয়ে নেমে গেল স্যাবের কাছে।

বিশেষ ধরনের উত্তাপ-প্রতিরোধক একটা ফোল্ডারে রয়েছে প্রিন্টগুলো। স্যাবের বড়সড় বুটে, একটা শেলফের তলায় ফলস্ কমপার্টমেন্ট, সেখান থেকে ফোল্ডারটা বের করল রানা। শরীর দিয়ে আড়াল করে রাখল, পোর্টিকো থেকে ওরা যাতে দেখতে না পায় কোত্থেকে বেরুল। বুট তালা লাগিয়ে উঠে এল ও।

‘কি সুন্দর গাড়ি,’ স্যাবের দিকে সন্দেহ ভরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল ঝান, তার সরল চেহারার সাথে দৃষ্টিটা মানাল না!

‘এ-ধরনের আর যত গাড়ি আছে, দৌড়ে এটার সাথে সেগুলোর একটাও পারবে না, বলল রানা।

‘অ্যাঁ, তাই নাকি?’ ঝিক্ করে উঠল ঝানের চোখ, দৃষ্টিতে প্রায় ধরা পড়ে এমন একটা আনন্দের তরঙ্গ নাড়া দিয়ে গেল তার বিশাল দেহটাকে। ‘বেশ তো, সেটা না হয় পরীক্ষা করে দেখব আমরা। কয়েকটা গাড়ি আমারও আছে, ট্র্যাকও পাবেন আমার র‍্যাঞ্চে। ইচ্ছে করলেই আমরা একটা আয়োজন করতে পারি, কি বলেন? লোকাল গ্রাঁ প্রি?’

‘নয় কেন!’ ফোল্ডার নেড়ে বাড়ির ভেতর দিকটা দেখাল রানা।

‘ও, হ্যাঁ-হ্যাঁ!’ উত্তেজনায় কেঁপে উঠল ঝান। ‘মিসেস লুগানিসকে পিয়েরের নিরাপদ হাতে রেখে যেতে পারি আমরা। লাঞ্চের পর আপনাদেরকে গেস্ট কেবিনে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা হবে। তারপর ঝান র‍্যাঞ্চে গাইডেড ট্যুরের আয়োজন করা যাবে। বুঝলেন, মি. রানা, আমার র‍্যাঞ্চ নিয়ে আমি গর্বিত।’

লম্বা দরজার দিকে ইঙ্গিত করল সে, পথ থেকে সরে গিয়ে রানাকে আগে ঢুকতে দিল। বিশাল, শীতল হলওয়ে; নকশা-কাটা কাঠের মেঝে, মাঝখানে সোনালি সিঁড়ি। আর যাই হোক, স্টাইলের সাথে বেঁচে থাকতে জানে মলিয়ের ঝান।

‘আমাদের প্রিন্ট-রূমে যাওয়া উচিত, কি বলেন?’ সিঁড়ি বেয়ে একটা চওড়া করিডরে নেমে এল ঝান, প্রচুর বাতাস। রানাকে পাশে নিয়ে দরজা খুলল।

বিস্ময়ের একটা ধাক্কা অনুভব করল রানা। কামরাটা খুব বড় নয়, তবে দেয়ালগুলো অসম্ভব উঁচু, খানিক পর পর ওপর থেকে পর্দা নেমে এসেছে। লাখ লাখ ডলারের সম্পত্তি, দেয়ালের সাথে ঝুলছে। কেনসিংটনে যত কমই শিখে থাকুক রানা, দেয়ালের বেশ কয়েকটা প্রিন্ট চিনতে পারল ও।

কমপক্ষে চারটে ভারি দুর্লভ হলবীনস রয়েছে। কিছু অমূল্য প্লেয়িং কার্ড, যদিও অতিমাত্রায় রঙ চড়ানো। বাক্সটার-এর কালার প্রিন্ট একটাই, সই করা (ইনস্ট্রাক্টর রানাকে জানিয়েছিল,; বাক্সটারের কালার প্রিন্ট সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব)। আরেকটা সেট দেখে মনে হলো আসল বিউইকস। শুধু দেয়ালে নয়, পর্দার ওপরও শোভা পাচ্ছে অনেক প্রিন্ট। আড়ালে রাখা স্পীকার থেকে হালকা যন্ত্রসঙ্গীতের আওয়াজ ভেসে আসছে, ঠাণ্ডা কামরার ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছে বিমল শান্তি। পালিশ করা কাঠের মেঝে, আয়নার মত ঝকঝকে। কামরার এখানে সেখানে কয়েকটা চেয়ার, আর জানালার পাশে একটা মাত্র টেবিল, আর কোন ফার্নিচার নেই। এগুলো, রানা ধারণা করল, অমূল্য অ্যান্টিকস-ই হবে।

‘মোটামুটি ভাল কালেকশন, কি বলেন, মি. রামা?’ কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রানার জবাব পাবার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে থাকল ঝান।

‘বেশ ভাল। বড় বড় সংগ্রাহকদের সম্পর্কে জানি কিভাবে কোন্‌টা সংগ্ৰহ করা হয়েছে তা তারা কাউকে জানায় না, কাজেই সে প্রশ্ন আপনাকে আমি করব না।’ হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা। ‘প্রফেসর লুগানিসের মুখে শুনেছি আপনার নাকি দুটো শখ বা দুর্বলতা আছে…’

‘মাত্র দুটো?’ ঝানের একটা ভুরু উঁচু হলো, চেহারায় বিস্ময়।

‘প্রিন্ট আর আইসক্রীম,’ বলল রানা। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল ও, ওর পিছনে আকস্মিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ঝান।

হঠাৎ শুরু, হঠাৎই আবার থামল হাসি। ‘আপনার প্রফেসর লুগানিস ভুল তথ্য পেয়েছেন। প্রিন্ট আর আইসক্রীম ছাড়াও আরও অনেক শখ আছে আমার-হ্যাঁ, দুর্বলতাও বলতে পারেন। দুর্বলতার প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তাহলে বলি- অনেক মানুষের জীবনে টাকাটাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে দেখা দেয়। আমারও দেখা দিয়েছিল….

‘দিয়েছিল?’

‘প্লীজ, মি. রানা। হ্যাঁ-কিন্তু সে দুর্বলতা এখন আর নেই আমার। আমি ভাগ্যবান, যুবা বয়সেই টাকার পাহাড় বানিয়ে ফেলি। পিয়েরে ল্যাচাসি শুধু আমার সঙ্গী আর বন্ধুই নয়, অভিজ্ঞ ব্যবসায়িক উপদেষ্টাও বটে। প্রথম জীবনে যে টাকাটা আমি রোজগার করি, সেটা পরে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ, এভাবে বাড়তে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, লোকটা প্রতিভা। দুর্বলতার পিছনে যতই আমি দু’হাতে খরচ করতে থাকি, আমার টাকা আর সম্পত্তি ততই বাড়তে থাকে!’

হঠাৎ রানার দিকে হাত বাড়াল মলিয়ের ঝান, প্রিন্টগুলো চাইছে। মুহূর্তের জন্যে দ্বিধায় পড়ল রানা; প্রিন্ট সম্পর্কে লোকটা কতটুকু জানে, এগুলো যে নকল দেখার সাথে সাথে ধরে ফেলবে না তো? তবে এ-বিষয়ে এখন আর উদ্বিগ্ন হয়ে কোন লাভ নেই।

কেন কে জানে, হাতটা আবার ফিরিয়ে নিল ঝান, অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, ‘একটা কথা, মি. রানা। পিয়েরে ল্যাচাসির অদ্ভুত চেহারা-ওটা আপনাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। শুকনো পেনসিলের মত দেখতে ও। জানি, দেখে মনে হয় আপনি ওকে ভেঙে দু’টুকরো করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু চোখ ধোঁকা দিতে পারে, এ-কথা মানেন তো? আমার পরামর্শ, এ-ধরনের কিছু ভাবতেও যাবেন না। আপনার ভালর জন্যেই বললাম কথাটা। বিশ্বাস করুন, বুনো একটা ঘোড়ার চেয়েও বেশি শক্তি রাখে ল্যাচাসি।

‘ওর দুর্ভাগ্য-কার অ্যাক্সিডেন্ট,’ বলে চলল ঝান। ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত নতুন করে গড়তে ওর পিছনে তিন রাজার ভাণ্ডার শেষ করেছি আমি। শরীরটা ভয়ানক জখম হয়েছিল, তবে আসল সর্বনাশটা হয় পুড়ে গিয়ে। দুনিয়ার সেরা সার্জেনদের দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে, তারা প্রায় নতুন একটা মুখ তৈরি করে দিয়েছে ওকে। ল্যাচাসির অন্যতম দুর্বলতা হলো গতি। ও খুব ভাল ড্রাইভার। লোকাল গ্রাঁ প্রি-র আয়োজন করব বলেছি, মনে আছে তো? আপনাকে ওর সাথেই প্রতিযোগিতায় নামতে হবে-পিয়েরে ল্যাচাসির সাথে।

প্লাস্টিক সার্জারী আর প্রায় নতুন একটা শরীর? কৌতূহল এবং বিস্ময় বোধ করল রানা। উ সেন ওর হাতে গুলি খেয়েছিল সত্যি কথা, কিন্তু তারপর কি হয়েছিল জানা নেই রানার, শুধু শুনেছিল ওর পরম শত্রু মারা গেছে। এমন কি হতে পারে উ সেন মারা যায়নি…তার মৃত্যুর মিথ্যে খবর রটানো হয়, পরে হয়তো এক সময় সত্যি কার অ্যাক্সিডেন্টে আহত হয় সে?

উঁহুঁ, এ-সব কথা ভেবে মাথাটাকে ভারী করার কোন মানে হয় না। ঘটনাগুলোকে আপন গতিতে ঘটতে দেয়া যাক, দেখা যাক তা থেকে কতটুকু জানা যায়।

‘হোগার্থ, মি. রানা।’ রানার সামনে হাত পাতল মলিয়ের ঝান। ‘প্লীজ।’

সাবধানে, অত্যন্ত সাবধানে ফোল্ডারটা খুলল রানা। টিস্যু দিয়ে মোড়া প্রিন্টগুলো একটা একটা করে বের করল, পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল টেবিলে রাখার আগে মোড়ক খুলল।

একটা নির্দিষ্ট সাবজেক্ট নিয়ে অনেক কাজ আছে হোগার্থের, ‘দ্য লেডি’স প্রোগ্রেস’ তারই একটা। প্রথম দুটো প্রিন্টে দেখানো হয়েছে ভদ্রমহিলা বিলাস- ব্যসনে অলস জীবনযাপন করছেন। তৃতীয়টায় তাঁর পতন চিত্রিত হয়েছে, যখন জানা গেল তাঁর স্বামী অসংখ্য পাওনাদার রেখে মারা গেছেন অর্থাৎ ভদ্রমহিলা এই মুহূর্তে অসহায় কপর্দকহীন। পরবর্তী তিনটে প্রিন্টে রয়েছে তাঁর অধঃপতনের বিভিন্ন স্তর-মদের নেশা তাঁকে সাধারণ একটা বেশ্যায় পরিণত করল, এবং সবশেষে তিনি তাঁর প্রথম জীবনের অভিশপ্ত চেহারা ফিরে পেলেন: সপ্তদশ শতাব্দীর নিঃস্ব লন্ডনবাসিনীদের একজন-বিধ্বস্ত, হাভাতে, পাপে নিমগ্ন, নোংরা।

প্রিন্টগুলোর দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকতে শুরু করল মলিয়ের ঝান, চেহারা দেখে রানার মনে হলো লোকটা ধ্যানে রয়েছে। অবশেষে আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ‘রিমার্কেবল!’ আবেগে তার গলা বুজে এল। ‘কোয়াইট রিমার্কেবল! ডিটেলসগুলো দেখছেন, মি. রানা, মুখগুলো? আর আরচিনগুলো, এই যে এখানে, জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে? ওহ্ গড, শুধু এগুলোর দিকে তাকিয়ে একজন মানুষ সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে! প্রত্যেক দিন নতুন একটা কিছু পাবেন আপনি। বলুন-বলুন, মি. রানা! কি দাম চান আপনি?’

কিন্তু এখুনি রানা পরিষ্কার কিছু বলতে চায় না। প্রফেসর লুগানিস এখনও ঠিক জানেন না প্রিন্টগুলো তিনি বিক্রি করবেন কিনা। ‘আপনাকে প্রথম স্বীকার করতে হবে, মি. ঝান, যে এ-ধরনের আইটেমের মূল্য নির্ধারণ করা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার। দে আর ইউনিক। আর কোন সেটের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এগুলো জেনুইন। গাড়িতে অথেনটিকেশন ডকুমেন্ট আছে…’

‘এগুলো আমাকে পেতে হবে!’ ঝান রুদ্ধশ্বাসে বলল, ভূতে পাওয়া লোকের মত ঝাপসা দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকাল সে। ‘এর কোন বিকল্প নেই…’

‘কি পেতে হবে তোমাকে, ঝান? কিসের কোন বিকল্প নেই?’ মৃদু, কোমল কণ্ঠস্বর, কোকিলের ডাকের মত পরিষ্কার, ক্ষীণ একটু ফরাসী টান; ভেসে এল দরজার কাছ থেকে। ঝান বা রানা, দু’জনের কেউই দরজা খোলার আওয়াজ পায়নি।

দু’জনেই ওরা টেবিলের দিকে পিছন ফিরল। একটা হার্টবিট মিস করল রানা। এমন পবিত্র রূপ, এমন কমনীয় চেহারা আগে কখনও দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না। ধীরে ধীরে চোখের ঝাপসা দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এল ঝানের, আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার চেহারা, গলা থেকে বেরিয়ে এল সাদর সম্ভাষণ, ‘ডার্লিং, মাই ডার্লিং! এসো, তোমার সাথে মি. মাসুদ রানার পরিচয় করিয়ে দিই। উনি প্রফেসর লুগানিসের প্রতিনিধিত্ব করছেন। মি. রানা, ও আমার বান্ধবী, বান্না বেলাডোনা।’

ধারণা ছিল বেলাডোনার বয়স কম হবে, তবে এত কম আশা করেনি রানা। রাগে পিত্তি জ্বলে গেল ওর, এই মেয়েকে বিয়ে করতে চায় ঝান? মেয়ের বয়েসী একটা মেয়েকে? কত, খুব বেশি হলে বাইশ কি তেইশ হবে বেলাড়ানো। দোরগোড়ায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে সে, যেন ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে, বিশাল জানালা দিয়ে ঢুকে তার সারা শরীরে ফ্লাডলাইটের মত জ্বলছে সোনালি রোদ। এ যেন মঞ্চে নায়িকার আবির্ভাব।

পরনে নিখুঁতভাবে কাটা জিনস, আর রয়্যাল ব্লু সিল্ক শার্ট; গলায় গিঁট বাঁধা উজ্জ্বল বহুরঙা রুমাল। বান্না বেলাডোনা এমন একটা হাসি উপহার দিল রানাকে, চরম নারীবিদ্বেষী পুরুষও হাঁটুর কাছে দুর্বলতা অনুভব করবে।

বেলাডোনা লম্বা, রানার সাথে মানানসই। লম্বা পায়ে দীর্ঘ পদক্ষেপ, সরাসরি যেন রানার দিকেই এগিয়ে আসছে সে। রানা উপলব্ধি করল, এ মেয়ের কাছে যে- কোন পরিবেশই ঘরোয়া, সবখানেই সে স্বচ্ছন্দ, কোথাও আড়ষ্ট হতে জানে না। দেহ-সৌষ্ঠব আর হাঁটা-চলায় একটা মেয়ের মধ্যে যে-সব বৈশিষ্ট্য থাকলে মনে পুলক জাগে, তার সব অকৃপণ হাতে ওকে দান করেছেন ঈশ্বর। ঘরে, ঘরের বাইরে, খেলায়, অবসর মুহূর্তে, শয়নে, নির্জনে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে অভিজাত, সৌন্দর্যের প্রতীক।

বেলাডোনা আরও কাছে চলে এল, রানা অনুভব করল দু’জনের মধ্যে একটা অদৃশ্য সংযোগ ঘটে গেল, অনেকটা যেন কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের মত। অনুভূতিটা রানাকে যেন জানিয়ে দিয়ে গেল, পরস্পরের কাছে দু’জনেরই বহু কিছু পাওয়ার আছে।

কালো আগুনের অস্তিত্ব যদি সম্ভব হয়, কোথাও না হোক বেলাডোনার চোখে তা আছে। আবলুস কালো চোখের সাথে মিল রেখে দীর্ঘ চুল কাঁধে ঢলে পড়েছে, সেখান থেকে অবহেলায় ঠেলে নামিয়ে দেয়া হয়েছে পিঠের বাঁ দিকে। কালো আগুন থেকে জ্বলজ্বলে বুদ্ধির আলো ছড়াচ্ছে, তারুণ্যে ভরপুর বয়সকে ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে সেই আলো। দৈহিক গড়নের সাথে চুলচেরা ভারসাম্য রক্ষা করছে অবয়ব-দীর্ঘ, সরু নাক; আবেদন ভরা মুখ; সরু নিচের ঠোঁট ওপরটার চেয়ে একটু কম সরু, তাতে করে চেহারায় ইন্দ্রিয়পরায়ণতার ছাপ ভালই ফুটেছে। এই ব্যাপারটাও রানাকে কম আকৃষ্ট করল না। বেলাডোনার হাত, করমর্দনের সময় অনুভব করল রানা, কোমল, কিন্তু যখন চাপ দিল তখন রীতিমত কঠিন। এই হাত আদর করতে জানে, আবার শক্ত মুঠোয় ধরতে জানে পাগলা ঘোড়ার লাগাম।

‘হ্যাঁ, মি. রানাকে আমি জানি। এই মাত্র মিসেস লুগানিসের সাথে পরিচিত হলাম। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম…মে আই কল ইউ রানা, প্লীজ?’

‘অফকোর্স।’

‘ওয়েল, আই য়্যাম বেলাডোনা। জানতে পারি, মি. ঝানকে কিসের লোভ দেখিয়ে অপচয় করাতে চাইছ, রানা? হোগার্থ প্রিন্টস?’

হেসে উঠল ঝান, গলার ভেতর থেকে উঠে আসা আনন্দোচ্ছ্বাস জলপ্রপাতের গর্জন হয়ে বাজল কানে। বেলাডোনার সামনে দাঁড়িয়ে জাপানীদের প্রিয় ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল সে, যেন দেবীর সামনে নত হলো ভক্ত। তারপর সে বলল, ‘ওহ্ গড! ওর মুখে অপচয়ের কথা!’ কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল সে, কেঁপে হাসতে লাগল সে, দাড়িবিহীন গ্রীষ্মকালীন সান্তা ক্লজ।

বেলাডোনার আরও সামনে এসে তার কোমরে হাত রাখল ঝান, কাছে টানল, টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল পিঠ উঁচু একটা অ্যান্টিকস্ চেয়ারে। বেলাডোনার চোখে একটা ছায়া পড়তে দেখল রানা, সেই সাথে লক্ষ করল ঝানের স্পর্শ পাবার সাথে সাথে মৃদু শিউরে উঠল সে।

‘এগুলোর ওপর শুধু একবার চোখ বুলাও, ডার্লিং! আসল জিনিস! সারা দুনিয়ায় কোথাও আর এরকম নেই। ডিটেলস দেখো, মেয়েলোকটার মুখ। তারপর লোকগুলোকে দেখো, মদে চুর…’

এক এক করে প্রিন্টগুলো পরীক্ষা করছে বেলাডোনা, তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রানা। মেয়েটার চোখ থেকে শুরু হলো, নেমে এল ঠোঁটে-ক্ষীণ, ঠোঁট টেপা হাসি। শেষ প্রিন্টটায় সুন্দর লম্বা আঙুল ঠেকে রয়েছে। ‘ওটা কিন্তু লাইফ থেকে আঁকা হয়ে থাকতে পারে, মি. ঝান।’ হাসল বেলাডোনা, যেন বীণার তার কেঁপে উঠল। না, কথার সুরে কোন অভিযোগ বা ঘৃণা নেই। ‘লোকটা ঠিক আপনার মত দেখতে।’

দু’কোমরে হাত দিয়ে কৃত্রিম রণভঙ্গিতে সিধে হলো ঝান। ‘তবে রে!’

তাহলে শোনা যাক, রানার দিকে ফিরল বেলাডোনা, কত চাইছেন আপনি?’

‘কোন দাম বলা হয়নি।’ হাসি মুখে বলল রানা, বেলাডোনার চোখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো, ওগুলোয় যেন ব্যঙ্গ ফুটে আছে। ‘এমনকি ওগুলো যে বিক্রির জন্যে এমন কথাও আমি বলতে পারছি না।’

‘তাহলে কেন…?’ বেলাডোনার চেহারা আগের মতই শান্ত।

মি. ঝান প্রফেসর আর তাঁর স্ত্রীকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রিন্টগুলো উনি সবার আগে দেখতে চেয়েছিলেন…

‘কাম অন, মি. রানা! বলুন, সবার আগে অফার দিতে চেয়েছিলাম।’ ঝানের মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ করল না রানা, অথচ বেলাডোনা আর তার মধ্যে কি যেন একটা আছে-বোঝা যায় না, তবে আছে।

ইতস্তত একটা ভাব দেখা গেল বেলাডোনার মধ্যে, তারপর সে বলল, ‘একটু পরেই লাঞ্চ সার্ভ করা হবে। তারপর আপনাদেরকে গেস্ট কেবিনে পৌঁছে দেব আমরা..

‘আর তারপর একটা গ্রাঁ প্রি-র আয়োজন করা হবে-তুমি কি বলো, ডার্লিং?’

‘মার্ভেলাস,’ দরজার সামনে থেমে ঘুরল বেলাডোনা, ‘মি. ঝান। হোয়াই নট? আপনি মিসেস লুগানিসকে সঙ্গ দেবেন, আর আমি রানাকে চারদিকটা ঘুরিয়ে দেখাব। কেমন হবে সেটা?’

কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সাথে ঝান বলল, ‘আপনার ওপর আমার নজর রাখতে হবে, মি. রানা, প্রিয় বান্ধবীকে যদি একা আপনার সাথে যেতে দিই।’ রানার উদ্দেশে চোখ মটকাল সে।

ইতিমধ্যে, যদিও, অদৃশ্য হয়েছে বেলাডোনা।

অনেকক্ষণ হলো ঝান র‍্যাঞ্চে এসেছে ওরা, ভাবল রানা, এবার কিছু কাজ হওয়া দরকার। ঝান আবার কথা শুরু করার আগেই প্রসঙ্গটা পাড়ল ও, প্রশ্ন করল সরাসরি, ‘মি. ঝান, প্রফেসর লুগানিসকে ওভাবে আমন্ত্রণ জানাবার মানে কি জানতে পারি?’

লাল মুখ রানার দিকে ফিরল, চেহারায় বিস্ময় এবং সরলতা। ‘ওভাবে মানে, মি. রানা?’

‘প্রফেসর বলেছেন, এ-ব্যাপারে আমি যেন আপনার কাছে একটা ব্যাখ্যা চাই। সত্যি কথা বলতে কি, উনি চাননি রিটা… মিসেস লুগানিস এখানে আসুক। রিটা জেদ করে এসেছে।

‘কিন্তু কেন? আমি তো কিছুই…’

‘আমাকে ওঁরা যেমন বলেছেন-আপনার আমন্ত্রণ নাকি গায়ের জোরে গেলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।’

‘গায়ের জোরে?’

‘গায়ের জোর। হুমকি। আগ্নেয়াস্ত্র।’

মাথা নাড়ল ঝান, হতভম্ব। হুমকি? আগ্নেয়াস্ত্র? আমি তো শুধু জেটটা নিউ ইয়র্কে পাঠিয়েছি। ল্যাচাসিকে বলেছিলাম আমাদের পরিচিত একটা ফার্মকে দিয়ে আয়োজনটা করাতে-মাঝে মধ্যে এটা-সেটা করে দেয়া ওরা, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড বডিগার্ড সার্ভিস। সাদামাঠা, সাধারণ একটা আমন্ত্রণ; আর প্রিন্ট ও প্রফেসর দম্পতি যাতে নিরাপদে প্লেনে উঠতে পারে তার জন্যে একজন গার্ডের ব্যবস্থা।

‘ফার্মের নাম?’

‘নাম? ডুপে সিকিউরিটি। হেনরি ডুপ্রে হলো গিয়ে …’

‘একজন গুণ্ডাসর্দার, মি. ঝান।’

‘গুণ্ডাসর্দার? কি বলছেন! অসম্ভব! ছোটখাট অনেক কাজ করেছে সে আমাদের…’

‘আপনার নিজস্ব সিকিউরিটি আউটফিট রয়েছে, মি. ঝান। আলাদাভাবে একটা নিউ ইয়র্ক এজেন্সিকে ব্যবহার করা হলো কেন?’

‘আপনি আসলে…,’ শুরু করল ঝান। ‘বাই গড! আগ্নেয়াস্ত্র! হুমকি! আমার নিজের লোকেরা? কিন্তু ওরা স্থানীয় লোক, আগে কখনও বাইরে কোথাও কাজে পাঠাইনি। আপনি বলতে চাইছেন, ডুপ্রের লোকেরা সত্যিকার অর্থে লুগানিসদের হুমকি দিয়েছে?’

‘প্রফেসর ও তাঁর স্ত্রীর ভাষ্য ছিল, ডুপ্রে কথা বলেছে, আর তার সশস্ত্র সঙ্গীরা তাকে সহায়তা করেছে।’

‘ওহ্, গড!’ হতাশায় ঝুলে পড়ল ঝানের মুখ। ‘ল্যাচাসির সাথে আমাকে কথা বলতে হবে। গোটা ব্যাপারটা তার দায়িত্বে ছিল। সত্যি এই কারণেই কি প্রফেসর আসতে পারলেন না?’

‘এটা মাত্র একটা কারণ। আরেকটা কারণ ওদের জীবননাশের চেষ্টা করা হয়।’ চোখে প্রশ্ন নিয়ে রানার দিকে তাকিয়ে থাকল ঝান। ‘কি বললেন?’

‘প্রাণনাশের চেষ্টা, হত্যাকাণ্ড-খুন।’

‘খুনের চেষ্টা? জেসাস ক্রীস্ট, মি. রানা! ঠিক ধরেছেন, অবশ্যই আমি জানব কি ঘটেছে। হতে পারে বুঝতে ভুল করেছিল ডুপ্রে। কিংবা ল্যাচাসি এমন কিছু বলেছিল…গড, আই য়্যাম সরি। আমার কোন ধারণাই ছিল না! যদি দরকার হয়, ডুপ্রেকে আমরা এখানে ডেকে আনাব। বাজি ধরতে পারেন, দিন শেষ হবার আগেই লেজ নাড়তে নাড়তে এখানে পৌঁছে যাবে সে।’

ঝান অভিনয়ে দারুণ পারদর্শী, এটুকু স্বীকার করতে হলো রানাকে। সন্দেহভাজন বন্ধুর আরেকটা গুণের পরিচয় পাওয়া গেল। সেই সাথে জানা গেল তার আমন্ত্রণে যদি ভুলভাল হয় বা ত্রুটি থাকে, সংশোধন করে নেয়ার সামর্থ্য রাখে সে, সামর্থ্য রাখে দায়িত্ব অস্বীকার করার।

বাড়ির ভেতর কোথাও মধুকণ্ঠী একটা পাখি ডেকে উঠল। ‘লাঞ্চ, ঘোষণা করল ঝান, রাগে এখনও একটু একটু কাঁপছে সে।

‘ওরে শালা!’ মনে মনে গাল দিল রানা, হাসিমুখে বেরিয়ে এল প্রিন্ট- থেকে।

ডাইনিং রুমটা ঠাণ্ডা। ঝানের কাছ থেকে জানা গেল, টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে তৈজস-পত্র পর্যন্ত সবই অ্যান্টিকস। চাকর-বাকররা মনিব বা অতিথি কারও দিকেই চোখ তুলে তাকাল না, চলাফেরায় কোন শব্দ নেই। ডাইনিং রূমে ঢোকার আগে ফাঁক বুঝে স্যাবের কাছ থেকে হয়ে এসেছে রানা, গোপন কমপার্টমেন্টে রেখে এসেছে প্রিন্টগুলো।

টেবিলে এত বেশি খাবার দেয়া হলো যেন খাওয়া নয়, অপচয় করাই মূল উদ্দেশ্য। ঝান, রানা আবিষ্কার করল, প্রতিটি অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে থাকতে পছন্দ করে, চেষ্টা করে যাতে পিয়েরে ল্যাচাসি আর বান্না বেলাডোনাকে নেহাতই তার সভার অংশবিশেষ বলে মনে হয়।

ওদের মেজবান নিজের র‍্যাঞ্চ সম্পর্কে ভারি গর্বিত, ঘুরেফিরে ভাল করে দেখার আগেই তার কাছ থেকে বহু কিছু জানতে পারল ওরা। আইসক্রীম ব্যবসা বিক্রি, ঝানের ভাষায়, তার বিরাট একটা বিজয় ছিল। সেই ব্যবসা বিক্রির টাকায় এই বিশাল তেপান্তর কেনে সে।

‘প্রথমে আমরা এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করি,’ বলল সে। পরে অবশ্য এয়ারস্ট্রিপটাকে আরও বড় করা হয়েছে। ‘তাছাড়া উপায় ছিল না। পানির চাহিদা, ঘর-বাড়িতে ব্যবহারের জন্যে অন্তত, প্রতি দু’দিন পরপর প্লেনে করে বয়ে আনতে হয়। আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইন আছে বটে, সেই অ্যামারিলো থেকে, কিন্তু মাঝে মধ্যেই সরবরাহে অনিয়ম ঘটে—পাইপের পানিটা আসলে আমরা সেচের কাজে ব্যবহার করি।’

মরুভূমি কেনার পর সেটাকে ভাগ করে নিয়ে কাজে হাত দেয় ঝান। এক তৃতীয়াংশে ঘাস জন্মানো হয়, পশুচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সেটা। ‘কৃত্রিম প্রাকৃতিক দৃশ্য, তাও আমরা তৈরি করেছি। পশুর বিরাট একটা পাল রয়েছে ওখানে।’ বাকি একশো বর্গ মাইলও সেচ ব্যবস্থার অধীনে আনা হয়, উর্বর মাটি আর পরিণত গাছ আমদানী করা হয়, কখনও প্লেনে করে কখনও ট্রাক্টরে তুলে। ‘বললেন, মি. রানা, আমার নাকি মাত্র দুটো দুর্বলতার কথা শুনেছেন আপনি-প্রিন্ট আর আইসক্রীম। না, মি. রানা, না! বলা যায়, প্রায় সমস্ত কিছুর সংগ্রাহক আমি। যেমন দেখুন না, গাড়ি! কোন্ গাড়ি আপনার প্রিয়, পুরানো না আধুনিক? প্রায় সব গাড়ির নমুনা একটা করে পাবেন ঝান র‍্যাঞ্চে। তারপর ধরুন, ঘোড়া! হ্যাঁ, তাও আছে। তবে ঠিক কথা, আইসক্রীম এমন একটা জিনিস, এখনও আমাকে খোঁচায়…

‘ল্যাবরেটরি আর ছোট একটা ফ্যাক্টরি আছে-হ্যাঁ, আমাদের এই র‍্যাঞ্চেই!’ এই প্রথম কথা বলার একটা সুযোগ করে নিতে পারল পিয়েরে ল্যাচাসি।

‘ও, ওটা!’ ঝান মৃদু হাসল। ‘আমার ধারণা, ওটা থেকেও দু’পয়সা আয়ই হয় আমাদের। বিশ্বাস করবেন, আজও আমি বেশ কয়েকটা কোম্পানীর কনস্যালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছি? নতুন ফ্লেভার সৃষ্টি করতে ভালবাসি আমি, টাকরার জন্যে নতুন স্বাদ। বিলিভ মি, আমাকে খোঁচায়। প্রচুর তৈরি করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মাঝে মধ্যে কোম্পানীগুলো নিতে রাজি হয় না। খুব বেশি উন্নত মান, সেটাই কারণ বলে মনে করি। লক্ষ করেননি, মানুষের স্বাদ-বোধ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে?’ উত্তরের জন্যে অপেক্ষায় না থেকে আরেক প্রসঙ্গে চলে গেল সে। স্টাফদের জন্যে বিশেষ কোয়ার্টার বানানো হয়েছে, দুশো নারী-পুরুষ থাকছে সেখানে। বানানো হয়েছে লাগজারী কনফারেন্স সেন্টার, দুই বর্গমাইল জুড়ে। মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় আলাদা বলে মনে হবে কনফারেন্স সেন্টারটাকে, নিয়মিত যত্নচর্চিত চারা আর গাছের ঘন বেষ্টনী দিয়ে সম্পূর্ণ আড়াল করা। ‘আসলে একটা বনভূমি।’

কনফারেন্স সেন্টারটাও আয়ের বড় একটা উৎস। বড় মাপের কয়েকটা কোম্পানী ওটা ব্যবহার করে, বছরে চার কি পাঁচবার, অবশ্যই ঝানের অনুমোদন সাপেক্ষে। ‘প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তাহলে বলেই ফেলি, দিন দুয়েকের মধ্যে একটা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, আমার ধারণা। ঠিক বলেছি, ল্যাচাসি?’

মাথা ঝাঁকাল পিয়েরে ল্যাচাসি।

‘আর আছে, হ্যাঁ, অবশ্যই-আমার প্রিয়, টারা। এটাকে বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলি আমি, যে প্রাসাদে আমিই রাজা। মুগ্ধ হবার মত, কি বলেন, মি. রানা?’

‘তা বটে!’ রানা ভাবছে, আসলে মতলবটা কি ঝানের? এত কথা বলে কি বোঝাতে চাইছে সে? প্রিন্টগুলো সত্যি যদি সে কিনতে চায়, প্রস্তাব দিতে কত সময় নেবে? প্রস্তাব দেয়ার পর, অতিথিদের জন্যে তার প্ল্যানটা কি হবে? সম্ভাব্য স্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছে লোকটা, কিন্তু ইতিমধ্যে নিশ্চয় সে জেনেছে মাসুদ রানা আসলে কে-উ সেনের উত্তরাধিকারীর কাছে শুধু নামটাই তো অনেক অর্থ বহন করার কথা।

আর কনফারেন্সের ব্যাপারটা কি? দু’দিন পর অনুষ্ঠিত হবে। হার্মিসের একজিকিউটিভ কমিটি মীটিঙে বসবে? একটা ব্যাপার খুব ভাল মেলে, হার্মিসের নতুন নেতার জন্যে ঝান র‍্যাঞ্চ ভারি উপযুক্ত জায়গা-রঙ ঝলমলে স্বপ্নপুরী! দুনিয়ার বাছা বাছা শয়তানগুলো এখানে বসে কুৎসিত ফ্যান্টাসীর সাথে কঠিন বাস্তবতার যোগসাধন ঘটাবে, নিরীহ মানুষের জন্যে তৈরি করবে দুঃস্বপ্ন আর সন্ত্রাস।

যখন অপ্রীতিকর কিছু ঘটে, আর সব বিকৃত মানসের মত, সেটা ভুলে যেতে পারে ঝান-আইসক্রীমের খোঁচা অনুভব করে, প্রাইভেট রেস ট্র্যাকে গাড়ি ছোটায়, কিংবা হয়তো স্রেফ হলিউড ফ্যান্টাসী টারায় বসে অলস সময় কাটায়। গন উইথ দ্য উইন্ড।

‘গুড, মেহমানদের এবার বিশ্রাম পাওয়া দরকার,’ খাওয়াদাওয়ার পাট চুকতেই বলে উঠল ঝান। ‘ল্যাচাসির সাথে আমার আলাপ আছে মানেটা আপনি জানেন, মি. রানা। গাইড দিচ্ছি, আপনাদেরকে গেস্ট কেবিনে পৌছে দেবে। তারপর গ্র্যান্ড ট্যুরের জন্যে চারটের দিকে আমরা ডেকে নেব…ধরুন সাড়ে চারটের দিকে। ঠিক আছে তো?’

রানা আর রিটা বলল, ঠিক আছে; আর এতক্ষণে এই প্রথম কথা বলল বান্‌না বেলাডোনা, ‘ভুলে যাবেন না, মি. ঝান। রানার ওপর আমার দাবি সবার আগে।’

ইতিমধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছে ঝানের অট্টহাসি, আবার শুনতে হলো। ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তুমি কি ভেবেছ সুন্দরী মিসেস লুগানিসের সাথে একা খানিকটা সময় কাটানোর সুযোগ আমি নেব না? ভাল কথা, ডার্লিং, তুমি দুটো কেবিনের ব্যবস্থা করেছ তো?’

হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল বেলডোনা। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে এল ওরা। দরজা দিয়ে বেরুবার সময় রানার বাহুর সাথে ধাক্কা খেলো বেলাডোনা, চোখের দৃষ্টিতে শুধু আনন্দ নয়, আরও কি যেন একটা অর্থ আছে; বলল, ‘তোমার সাথে কথা বলার জন্যে অপেক্ষায় আছি, রানা। চারদিকটা তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাতে চাই।’

কোন সন্দেহ নেই, বান্‌না বেলাডোনা মেসেজ দিচ্ছে রানাকে।

বাইরে বেরিয়ে এসে ওরা দেখল স্যাবের সামনে একটা পিকআপ ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে, পিছনের অ্যান্টেনার সাথে টকটকে লাল একটা পতাকা। ‘আমার লোকেরা কেবিনে নিয়ে যাবে আপনাদের,’ রানার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল ঝান। ‘সময়টা উদ্বেগে কাটাবেন না, প্লীজ, মি. রানা। আপনি যা বলেছেন তার সবটুকু জানব আমি। আর হ্যাঁ, আজ রাতে আপনার সাথে আমি ব্যবসা নিয়ে কথা বলব। প্রিন্টগুলো আমার চাই। আপনি একটা অফার পাবেন। বাই দ্য ওয়ে, ভাববেন না আমি লক্ষ করিনি কি নিপুণ কৌশলে ওগুলো আবার আপনি বাইরে নিয়ে গেলেন।’

‘পেশাগত দক্ষতা, মি. ঝান।’ রাজকীয় লাঞ্চের জন্যে ধন্যবাদ জানাল রানা। স্যাবে চড়ে রওনা হয়েছে ওরা, রানার পাশ থেকে বিস্ময় প্রকাশ করল রিটা, ‘উফ. কি একখানা সেট-আপ!’

‘সেট-আপ- হ্যাঁ, ঠিক বলেছ,’ জবাব দিল রানা।

তুমি আরেক অর্থে বলছ। দু’দিন থেকে যাবার আমন্ত্রণ?’

‘আরও অনেক কিছুর মধ্যে ওটাও, হ্যাঁ।’

‘সবকিছুই আমাদের স্বস্তি আর আরামের দিকে লক্ষ রেখে।’

‘বেশ, ভাল,’ বলল রানা। ‘ঝান ঠিক আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিদের মত। তাদের লোকেরা প্রতিটি কাজে বেপরোয়া দুর্নীতি করছে, কিন্তু সে দুগ্ধপোষ্য শিশু, কিছুই জানে না। ভাব দেখাল, আমাদের বিরুদ্ধে গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছে না।’

‘সাহস করে কথাটা তাহলে তুলেছ!’ ভুরু কোঁচকাল রিটা।

মেজবানের সাথে কি কি কথা হয়েছে সব তাকে বলল রানা।

ইতিমধ্যে বাড়ি ছেড়ে এক মাইলের মত চলে এসেছে স্যাব পিক-আপ ট্রাকটাকে অনুসরণ করছে ওরা।

‘কেবিনগুলো যেমনই হোক,’ রিটাকে সাবধান করে দিল রানা, ‘ধরে নিতে হবে আড়ি পেতে শোনার ব্যবস্থা করা আছে-টেলিফোনেও। কথা বলতে হলে খোলা জায়গায়। ওদের নিয়ে যখন ট্যুরে ৰেরোনো হবে, বলল রানা, পরে খুঁটিয়ে দেখার জন্যে কয়েকটা জায়গা মনে মনে চিহ্নিত করে রাখবে ওরা। তার মধ্যে কনফারেন্স সেন্টার একটা। তবে আরও কয়েকটা আছে। যা ধারণা করেছিলাম হাতে সময় তার চেয়ে অনেক কম, রিটা। কাজে নামতে দেরি করা উচিত হবে না।

‘আজ রাতেই?’

‘আজ রাতেই।’

মৃদু শব্দে হেসে উঠল রিটা। ‘আমার ধারণা আজ রাতে তোমাকে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে।‘

‘মানে?’

‘মানে…বানা বেলাডোনা। সে তার দামী জুতো তোমার বিছানায় তোলার জন্যে এক পায়ে খাড়া। শুধু তোমার সম্মতির অপেক্ষায়, রানা।‘

‘সত্যি?’ রানা ভাব দেখাবার চেষ্টা করল যেন কিছুই বোঝেনি, যদিও বেলাডোনার অর্থবহ দৃষ্টি আর কথাগুলো পরিষ্কার স্মরণ আছে ওর। ঝানের সাথে লোক-দেখানো ভাল সম্পর্ক রাখছে মেয়েটা, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায় ঝানের প্রতি সে আকৃষ্ট নয়। বরং ঘৃণাই করে তাকে। ঝানের স্পর্শ পেয়ে বেলাডোনাকে পরিষ্কার শিউরে উঠতে দেখেছে ও। ঝান যে তাকে র‍্যাঞ্চে আটকে রেখেছে, কথাটা সত্যি। হয়তো সে-বিষয়েই রানার সাথে কথা বলতে চায় মেয়েটা। সাহায্য পাবে কিনা জানতে চাইবে। ‘তোমার কথা যদি সত্যি হয়, রিটা, আমি দেখব আজ রাতে কেউ যাতে আমাদের বিরক্ত না করে। হেভেন ক্যান ওয়েট।’

রানার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল রিটা হ্যামিলটন। ‘হয়তো,’ বলল সে, ‘বাট ক্যান হেল?’

চারদিকে দৃশ্য এরইমধ্যে দু’বার বদলে গেছে। ‘ভেবে দেখো, মরুভূমিকে মরুদ্যান বানাতে কি বিপুল খরচ করেছে লোকটা,’ বলে বিস্ময়ে মাথা নাড়ল রিটা। দশ মাইলের মত পেরিয়ে এসেছে ওরা, এই মুহূর্তে ঢাল বেয়ে একটা রিজ- এর মাথায় উঠছে স্যাব, রিজের মাথায় সারি সারি ফার গাছ।

ট্রাক থেকে সঙ্কেত এল, বাঁ দিকে ঘুরতে হবে। বাঁক নেয়ার পর রাস্তার দু’পাশে ঘন সবুজ গাছপালার সমারোহ দেখা গেল, তারপর হঠাৎ করে ওরা চওড়া একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে গেল।

একজোড়া লগ কেবিন, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, মাঝখানে প্রায় ত্রিশ ফুট ব্যবধান। তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, ছোট ছোট বারান্দা, পরিচ্ছন্ন সাদা রঙ করা।

‘ওরা কোন ঝুঁকি নেয়নি,’ বিড়বিড় করে উঠল রানা।

‘ঝুঁকি নেয়নি…মানে?

যাতে বিপদ হয়ে না উঠি। লক্ষ করছ না, গাছপালার ভেতর দিয়ে একটাই মাত্র পথ? চারদিক ঘেরা; সহজে নজর রাখা যায়। কাজটা কঠিন হবে, রিটা, চাইলেই বেরুতে পারব না। বাজি ধরে বলতে পারি আশপাশের গাছে টিভি মনিটর, ইলেকট্রনিক অ্যালার্ম, সেই সাথে জ্যান্ত মানুষও আছে। তোমার কাছে কিছু নেই তো-অস্ত্রশস্ত্ৰ?’

মাথা নাড়ল রিটা, জানে, ঠিক কথাই বলছে রানা। কেবিনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, সহজে যাতে মেহমানদের ওপর নজর রাখা যায়।

‘ব্রীফকেসে একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন আছে,’ বলল রানা। ‘পরে তোমাকে দেব।’

ক্যাব থেকে মাথা বের করে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ড্রাইভার, চিৎকার করে বলল, ‘কোটা কার আপনারাই বেছে নিন, মিস্টার। হ্যাভ আ নাইস টাইম।’

‘মোটেলে থাকার চেয়ে ভাল,’ খুশি মনে বলল রানা। ‘তবে টারায় আরও নিরাপদ বোধ করতাম।’

নিঃশব্দে হাসল রিটা। ‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস করো, ডিয়ার রানা,’ জবাব দিল সে, ‘তুমি সাথে থাকলে কোথাও আমি নিরাপত্তার অভাব বোধ করব না।

প্রায় বিশ মাইল দূরে, সবুজাভ দেয়াল ঘেরা ছোট্ট একটা স্টাডিতে বসে ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে নিউ ইয়র্কের একটা নাম্বারে ডায়াল করল সও মং। স্টাডিতে প্রয়োজনীয় কয়েকটা ফার্নিচার ছাড়া আর কিছু নেই-ডেস্ক, ফাইলিং কেবিনেট আর খানকতক চেয়ার।

‘ডুপ্রে সিকিউরিটি,’ অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া দিল এক লোক।

‘হেনরিকে চাই আমি। বলো লীডার কথা বলতে চান।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লাইনে চলে এল হেনরি ডুপ্রে।

তাড়াতাড়ি চলে এসো এখানে,’ নির্দেশ দিল সও মং। ‘সমস্যা দেখা দিয়েছে।’

‘ধরুন রওনা হয়ে গেছি,’ সাথে সাথে বলল ডুপ্রে। ‘কিন্তু কনফারেন্স সংক্রান্ত আরও কয়েকটা কাজ বাকি আছে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি দু’দিন পর ওখানে চান আপনি আমাকে। কাজ শেষ করতে পারলে আগেই পৌঁছে যাব।

‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’ সও মং যে খুব রেগে আছে তা তার গলার সুরেই বোঝা গেল। ‘এরই মধ্যে যথেষ্ট ক্ষতি করেছ তুমি। এদিকে রানাকে আমরা সহজ শিকার হিসেবে পেয়ে গেছি এখানে।’

‘যত তাড়াতাড়ি পারি। আপনি চান সব কাজ নিখুঁতভাবে সারা হোক, তাই না?’

‘শুধু মনে রেখো, ডুপ্রে, জলাভূমির মাঝখানে সেই বাড়িটাতে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত কিছু প্রহরী আছে।’

ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিল সও মং, হার্মিসের পরবর্তী চাল সম্পর্কে চিন্তা করছে। প্ল্যানটা করতে সময় আর বুদ্ধি কম খরচা হয়নি, আরেকটু হলেই বজ্জাত ডুপ্রেটা দিয়েছিল সব ভেস্তে। রানাকে খুন করার কোন নির্দেশ তাকে দেয়া হয়নি। নর্দমার পোকাটা চিরকালই খুন-খারাবি পছন্দ করে, যাকে বলে ট্রিগার-হ্যাপি। শেষ পর্যন্ত, সও মং ভাবল, ডুপ্রের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

ফ্লাইং ড্রাগন! শব্দটা মনে পড়ে যেতে আপনমনে হাসতে লাগল সও মং।

পৃথিবীর অনেক ওপরে, ঠিক এই মুহূর্তে, শক্তিশালী এক ঝাঁক ফ্লাইং ড্রাগন রয়েছে আমেরিকানদের। আরও কয়েক ঝাঁক রাখা হয়েছে রিজার্ভ। তারা দাবি করে, তাদের এ-সব অস্ত্রের একটাও মহাশূন্যে নেই। ফালতু কথা, বিতর্ক এড়ানোর কৌশল। আর মাত্র ক’দিনের মধ্যে এই সব ফ্লাইং ড্রাগন অভ হেভেন সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য এবং ডাটা হার্মিসের মুঠোয় চলে আসবে।

আহ্, কি চমৎকার প্ল্যান! বুদ্ধিমত্তার কি অপূর্ব ভেল্কি! কি অবিশ্বাস্য নগদপ্রাপ্তি! তথ্যগুলোর বিনিময়ে একা সোভিয়েত ইউনিয়নই সাত রাজার ধন হাতছাড়া করতে এক পায়ে খাড়া আছে।

ফ্লাইং ড্রাগন নিয়ে যে প্ল্যান করা হয়েছে, তাতে মাসুদ রানার জন্যে নির্দিষ্ট করা ভূমিকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টোপ ফেলে গেলানো হয়েছে, রানা এখন টেক্সাসে, হার্মিসের হাতের তালুতে।

সও মং তার মৃত্যু উপভোগ করবে।

ওয়াশিংটনে খুন করার চেষ্টা হওয়ায়, যদিও সেটা প্ল্যানের মধ্যে ছিল না, যথেষ্ট নাড়া খেয়েছে দুর্ভাগা বাংলাদেশী বীর। তবে সও মঙের মাথায় আরও কিছু বুদ্ধি আছে, শিকারকে বেতাল করার জন্যে। মৃত্যু আসবে রানার জন্যে একেবারে শেষে।

স্বভাবসুলভ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সও মং।