আবার উ সেন – ২.৮

আট

যাত্রার প্রথম দিকে চোখ বুজে কিছুক্ষণ ঝিমাল জেনারেল। তারপর যখন চোখ মেলল, তাকে বেশ প্রফুল্ল এবং সতেজ লাগল। এক সময় নিজের সীটে ঘুরে বসল পাইলট, ইঙ্গিতে নিচের দিকটা দেখাল। কলোরাডোর উঁচু, নির্মল আকাশে রয়েছে ওরা। দূরে পাহাড়শ্রেণীর চূড়া দেখা গেল, এবড়োখেবড়ো পাথুরে কিনারা।

কয়েক মিনিট পর পিটারসন ফিল্ড আর জেনারেলের জন্যে অপেক্ষারত কনভয়ের দিকে নামতে শুরু করল হেলিকপ্টার। ডুপ্রের চেহারায় নির্লিপ্ত ভাব, জেনারেল গম্ভীর। তাকে হেলিকপ্টার থেকে নামতে সাহায্য করল অ্যাডজুট্যান্ট, জানতে চাইল যান-বাহনের সামনে লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে তিনি খুঁটিয়ে দেখতে চান কিনা। কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থেকে লোকগুলোকে দেখল জেনারেল, মাথা ঝাঁকাল, তারপর হাড়সর্বস্ব ক্যাপটেনের দিকে এগোল।

ক্যাপটেন স্যালুট করল জেনারেলকে। ‘ক্যাপটেন ল্যাচাসি, স্যার।’ ল্যাচাসিই পথ দেখিয়ে লাইনের দিকে নিয়ে চলল জেনারেলকে।

‘তোমার সাথে আগে কখনও দেখা হয়েছে আমার, ক্যাপটেন?’ কঠিন দৃষ্টিতে ক্যাপটেনের দিকে তাকাল জেনারেল।

‘না, স্যার।’

স্টাফ কারের দিকে এগোবার সময়, ল্যাচাসি তখন একটু পিছিয়ে পড়েছে, ফিসফিস করে ডুপ্রেকে বলল জেনারেল, ‘ক্যাপটেন ‘লোকটা। আমার বিশ্বাস আগেও আমি ওকে দেখেছি, হেনরি।’

‘আপনি ওর ফটো দেখেছেন, জেনারেল,’ মেজরও নিচু গলায় জবাব দিল। ‘এমন কোন কাগজ নেই যাতে ওর ছবি ছাপা হয়নি। দুনিয়ার সেরা একজন প্লাস্টিক সার্জেন সাধ্যমত চেষ্টা করে চেহারার ওইটুকুই বাঁচাতে পেরেছে। ভিয়েতনামীরা বেচারার মুখ পুড়িয়ে দিয়েছিল।

‘বেজন্মা!’ ঘৃণার সাথে বিড়বিড় করল জেনারেল।

কনভয়ের আয়োজন দেখার মত। প্রথমে দু’জন মটরসাইকেল আউটরাইডার, তারপর একটা এম/ওয়ান-ওয়ান-থ্রী আর্মারড পারসোনেল ক্যারিয়ার। ক্যারিয়ারে রয়েছে ভারী টুয়েলভ পয়েন্ট সেভেন এম. এম., সাথে দু’জন ক্রু সহ কমব্যাট ট্রুপসের একটা সেকশন। ব্রাউনিঙের বাঁকা সুইভেল মাউন্টিং-এ দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্রুরা।

ক্যারিয়ারের পিছনে রয়েছে জেনারেল পিলারের স্টাফ কার, স্টাফ কারের পর আরেকটা এ.পি.সি.।

স্টাফ কারের ড্রাইভারকে আগে কখনও দেখেনি জেনারেল, দ-এর মত তেড়া-বাঁকা দেহ-কাঠামো। সার্জেন্টের ইউনিফর্ম তার গায়ে জোর করে ঢোকানো হয়েছে। তবে ভালই গাড়ি চালায় লোকটা, যখন যেমন প্রয়োজন ভদ্রতাসূচক আচরণ করতেও জানে। নিজের নিয়মিত ড্রাইভার থাকলে খুশি হত জেনারেল, যদিও এই মুহূর্তে তার নাম ঠিক মনে করতে পারল না সে।

পিছনের সীটে জেনারেলের সাথেই বসেছে মেজর ডুপ্রে, কঙ্কালের মুখ নিয়ে সামনে বসেছে ক্যাপটেন ল্যাচাসি, ড্রাইভারের পাশে। হেলিপ্যাড থেকে ধীরগতিতে রওনা হলো ছোট কনভয়টা পিটারসন ফিল্ডের মেইন গেটের দিকে। স্টাফ কারের একদিকে জেনারেলের সরু উজ্জ্বল পতাকা পত পত করে উড়ছে। জেনারেলের ইউনিফর্মেও তারকা আর ফিতের ছড়াছড়ি।

কোন প্রশ্ন না করে ব্যারিয়ার তোলা হলো। অস্ত্র বাগিয়ে ধরে সম্মান প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে উঠল গার্ড, স্যাৎ করে তাকে পাশ কাটাল স্টাফ কার। অন্যান্য অফিসার আর সৈনিকরাও অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে অটল হলো, তারপর একজন ফোর-স্টার জেনারেল যাচ্ছেন বুঝতে পেরে স্যালুট করল তারা সবাই।

প্রায় এক ঘণ্টা পর দেখা গেল পাহাড়ের পাদদেশ ধরে এগিয়ে যাওয়া মিলিটারি রোড ধরে ছুটছে কনভয়। রাস্তা ও আশপাশের এলাকায় কড়া পাহারায় রয়েছে এয়ার ফোর্স আর আর্মি, কিন্তু কেউ ওদেরকে থামাবার চেষ্টা করল না বা কাগজ-পত্র দেখতে চাইল না। ছোট ছোট মিলিটারি পুলিস ডিটাচমেন্টগুলো শুধু অ্যাটেনশন হলো, নির্বাধায় এগিয়ে যেতে দিল কনভয়টাকে।

কনভয়ের আয়োজন সম্পর্কে আরেকবার চিন্তা করল জেনারেল পিলার। দু’জন মটরসাইকেল আরোহী, দুটো ক্যারিয়ারে দু’জন করে চারজন ক্রু, প্রতিটি ক্যারিয়ারে আরও রয়েছে বারো কি তেরো জন করে কমব্যাট ট্রুপসের সদস্য, অফিসার রয়েছে একজন করে। বত্রিশ জন লোক, বেশিও হতে পারে। তার ড্রাইভার, হেনরি আর ক্যাপটেন ল্যাচাসিকে ধরলে পঁয়ত্রিশ জন। বাহ্ চমৎকার! সবার সাথে একটা করে এম সিক্সটিন আর হ্যান্ডগান রয়েছে। মেজর হেনরি ডুপ্রে, ক্যাপটেন পিয়ের ল্যাচাসি আর ড্রাইভারের কাছেও সাইড আর্মস রয়েছে। এরচেয়ে ভাল প্রোটেকশন আর কি আশা করতে পারে জেনারেল?

‘গোটা ব্যাপারটা নিখুঁত হয়েছে, হেনরি-চমৎকার আয়োজন, ‘ বলল জেনারেল, উজ্জ্বল হাসি তার মুখে। ‘ওয়েল অর্গানাইজড। ওয়েল ডান।

‘আমি শুধু টেলিফোনের রিসিভার তুলেছি, জেনারেল। সবই তো জানেন আপনি, স্যার।

দু’মিনিট হলো পাহাড়ে চড়তে শুরু করেছে ওরা, পাশ কাটিয়ে এল একটা সাইড রোডকে, একধারে ছোট একটা সাইনবোর্ডে তীরচিহ্ন সহ লেখা রয়েছে, নোরাড় হেডকোয়ার্টার।

‘ওটা, স্যার,’ জেনারেলকে জানাল মেজর ডুপ্রে, ‘মেইন এন্ট্রান্সের দিকে চলে গেছে। এই রাস্তা ধরে মাইল পাঁচেক উঠব আমরা, তারপর বাঁক নিয়ে পৌঁছুব সাইড এন্ট্রান্সে। আমার বিশ্বাস, পিটারসনের কেউ ইতিমধ্যে খবরটা ওদের কাছে নিশ্চয়ই ফাঁস করে দিয়েছে। কোন সন্দেহ নেই, মেইন এন্ট্রান্স বিল্ডিঙের সামনে জড়ো হয়েছে সবাই।’

‘এই রাস্তার শেষ মাথাতেও থাকবে ওরা,’ বলল জেনারেল। ‘ওদেরকে বোকা মনে করার কোন কারণ নেই। সবাই ওরা জানবে। যেখানেই আমরা পৌঁছুই না কেন, দেখা যাবে সেখানেই আমাদেরকে আশা করছে ওরা।’

প্রায় মিনিট দশেক পর আবার দুই রাস্তার মাথায় পৌছল কনভয়, দ্বিতীয় রাস্তার ধারে একটা সাইন বোর্ড, তাতে তীরচিহ্নসহ লেখা রয়েছে, নোরাড টু।

আমরা এবার সরাসরি যাব, স্যার। আপনি, স্যার, সুস্থ বোধ করছেন তো?’ রাজহাঁসের মত গলাটা বাঁকা করল ডুপ্রে, জেনারেলকে ভাল করে দেখতে চাইছে।

নিজের সীটে ঘুরে বসল কঙ্কালসার ক্যাপটেন ল্যাচাসি। ‘জেনারেলের শরীর কি ভাল নয়?’

‘ক্যাপটেন,’ মেঘের মত গুরুগুরু ডাক ছাড়ল জেনারেল। ‘কয়েকটা কথা মনে রাখলে জেনারেলের অবস্থা তোমার মত হাঁদার কাছেও পরিষ্কার হয়ে যাবে। নতুন একটা পদ দেয়া হয়েছে তাকে, পদটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাসম্পন্ন। স্ত্রীকে একা রেখে বেসে থাকতে হয় তাকে, অফিসারদের পাল্লায় পড়ে রাতে প্রচুর পরিমাণে মদ গিলতে হয়। এরকম অবস্থায় তার সুস্থ থাকার কোন কারণ নেই। অথচ আমি অসুস্থ নই, শুধু একটু অস্বস্তি বোধ করছি।

ক্যাপটেন ল্যাচাসি একটা শব্দ করল, যার অর্থ হতে পারে কৌতুকটার রসাস্বাদ করতে পেরেছে সে।

‘নিজেকে আমার বোকা বোকা লাগছে,’ বলে চলেছে জেনারেল। যেন আমি একটা পুতুল।’ ডুপ্রের দিকে ফিরল সে। ‘তুমি আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে, ঠিক হ্যায়? যদি আমাকে গাইড করো তাহলে আর কোন সমস্যা হবে না।’

‘চিন্তা করবেন না, স্যার-এ-সব আমরা আগেও করেছি।

‘অবশ্যই করেছি,’ হাসল জেনারেল। ‘এটাই তো আমাদের কাজ, বিশেষ করে তেমন বড় ধরনের কোন যুদ্ধ যখন আমেরিকা করছে না।’

মাথার ওপর থেকে হেলিকপ্টারের একঘেয়ে আওয়াজ ভেসে এল। পাহাড়ের আড়ালে রয়েছে বলে দেখা গেল না, তবে কোন সন্দেহ নেই কনভয়টাকে অনুসরণ করেই আসছে ওটা।

ওরা এখন একটা ফাঁকের মধ্যে রয়েছে-দু’পাশে নিরেট পাথর, আকাশ ছোঁয়া দু’সারি পাহাড়ের মাঝখানে। বাম দিকে ঘুরল কনভয়, বেরিয়ে এল ফাঁকটা থেকে, সেই সাথে ধূসর রঙের রাস্তা চওড়া হয়ে গেল, সাদা ধুলো উঠল পিছনে, সামনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাথুরে বিস্তৃতি। সামনে আবার আকাশ ছুঁয়েছে পাহাড়শ্রেণী, প্রায় এক মাইল দূরে নিরেট দর্শন একজোড়া গেট, গেটের দু’পাশে কাঁটাতারের উঁচু বেড়া। বেড়ার গায়ে খানিক পর পর একটা করে স্টীল গার্ডার, প্রতিটির মাথায় বিরতিহীন ঘুরছে একটা করে ক্যামেরা। বেড়ার ওপারে অনেকগুলো বিল্ডিং, আরও অনেক সামনে চেইন পাহাড়ের গম্ভীরদর্শন প্রাচীর।

গেটের সামনে দু’জন জি.আই. দাঁড়িয়ে আছে। কনভয়টাকে ভাল করে দেখার পর তাদের একজন ব্লকহাউসের দিকে ঘুরে গিয়ে চিৎকার করল, ব্লকহাউসটা গেটের ডান দিকে। ব্যারিয়ারের কাছ থেকে কনভয়টা যখন একশো গজ দূরে, ব্লকহাউসের ছোট একটা দরজা দিয়ে একজন অফিসার বেরিয়ে এল। দূর থেকে দেখে মনে হলো হাসছে সে।

কনভয়ের গতি মন্থর হলো, অর্ধবৃত্ত রচনা করে স্টাফ কারের ডান আর বাঁ দিকে চলে এল মটরসাইকেল এসকর্ট। প্রথম এ.পি.সি.ও ঘুরল, ডান দিকে বাঁক নিয়ে লাটিমের মত, থামল গেটের দিকে মুখ করে। নিখুঁত এবং সামরিকসুলভ। আবারও অত্যন্ত মুগ্ধ হলো জেনারেল। লোকগুলো নিজেদের কাজ খুব ভাল বোঝে।

মেজর ডুপ্রের দিকে ফিরে বলল সে, ‘পরিচয় ইত্যাদি সব তোমার দায়িত্ব, হেনরি, কেমন? বরাবরের মত আর কি। কোন ঝামেলা চাই না। আমাকে তোমরা কিছুটা নির্লিপ্ত দেখতে পাবে।’

‘জ্বী, স্যার!’ মেজরকে ভারি তৃপ্ত দেখাল। স্টাফ কারের ইলেকট্রিক জানালা নেমে যাবার সাথে সাথে স্টাফ কারের দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এল একজন নোরাড ক্যাপটেন। বয়সে তরুণ, সত্যি সত্যি মৃদু হাসি লেগে রয়েছে তার ঠোঁটে

হ্যাঁ, ভাবল জেনারেল, এখানেও ওরা তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে তাকিয়ে দেখল এরইমধ্যে একটা অনার গার্ড বেরিয়ে এসেছে, গেটের একেবারে সামনের সমতল জায়গাটায় ঝাঁক বাঁধছে তারা।

যুবক অফিসার চৌকশ ভঙ্গিতে স্যালুট করল।

নীরস, কড়া সুরে কথা বলল মেজর ডুপ্রে, ‘জেনারেল পিলার-ইন্সপেক্টর- জেনারেল ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার/ডিফেন্স-অফিশিয়ালি তোমার বেস ইন্সপেকশন করতে এসেছেন, ক্যাপটেন।’ মসৃণ এবং কড়কড়ে একটা ডকুমেন্ট হস্তান্তর করল সে, ক্যাপটেন সেটার দিকে ভাল করে একবার তাকালও না। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করতে হয় তার জানা আছে।

‘ভেরি গুড, স্যার।’ মৃদু হেসে ঘাড় ফেরাল ক্যাপটেন, গেট খোলার আদেশ জানাল। ‘আপনাকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে আমরা যার পর নাই আনন্দিত, জেনারেল, স্যার। বেস আপনার জন্যে খোলা। আপনার আনন্দের জন্যে যদি কিছু করার থাকে আমাদের…’

‘আমরা এখানে আনন্দ-ফুর্তি করতে আসিনি, ক্যাপটেন,’ ধমকে উঠল জেনারেল। ‘এসেছি তোমাদের অপারেশনস্ রূম দেখতে আর কিছু প্রশ্ন করতে। মাথায় ঢুকেছে, ক্যাপটেন?’

তারপরও যুবক ক্যাপটেনের ঠোঁটে হাসির রেশটুকু অম্লান থাকল। ‘জ্বী, স্যার। আপনি যা বলেন, স্যার। আমরা আপনার যেকোন আদেশের জন্যে একপায়ে খাড়া। দয়া করে ভেতরে চলুন, স্যার।’

‘জেনারেল চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাহাড়ের ভেতর ঢুকবেন,’ মাঝখান থেকে কথা বলল মেজর ডুপ্রে।

‘রাইট, স্যার। আমাদের অ্যাকটিং কমান্ডিং অফিসার আপনাদের জন্যে অপারেশনস্ রূমে অপেক্ষা করছেন। ওখানে আপনাদের পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

গেট খুলে গেল, একটা এ.পি.সি-র পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল ওরা। বাকি সবাই পেরিমিটারের বাইরে থেকে গেল, গাড়ি থেকে নেমে গেটের বাইরে ও ভেতরে বিভিন্ন পয়েন্টে পজিশন নিল তারা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জেনারেলের টীম নোরাড হেডকোয়ার্টারের দু’নম্বর প্রবেশপথ সম্পূর্ণ সীল করে দিল।

স্টাফ কার গেটের ভেতর ঢুকে থামতেই অ্যাটেনশন হলো অনার গার্ড, তারপর প্রেজেন্ট আর্ম পজিশনে স্থির হলো।

‘হেনরি,’ মেজরের মনোযোগ আকৃষ্ট করল জেনারেল পিলার। যুবক অফিসারের হাবভাব লক্ষ করেছ? কেমন যেন হালকা ভাবে নিল আমাদেরকে।’ স্টাফ কার থেকে নামছে সে।

হ্যাঁ। কার সাধ্যি আপনার চোখকে ফাঁকি দেয়। সম্ভবত এর আগে ইন্সপেক্টর-জেনারেলদের সংস্পর্শে খুব বেশি আসেনি ছোকরা, স্যার; ভেবেছে হাসিখুশি ভাব দেখানে সুবিধে হবে এর ওর নামটা আমি জেনে কনের স্যার।

‘হ্যাঁ, যেন ভুল না হয়।’ ডুপ্রের মনে হলো ছোকরা ক্যাপটেনের ওপর খুব চটেছেন জেনারেল।

‘আপনি বোধহয় অনার গার্ড ইন্সপেকশন করতে চান না, তাই না, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল ডুপ্রে। কিন্তু জেনারেল মাথা নাড়ল, অস্বস্তিবোধ করা সত্ত্বেও নিয়ম ধরে সব কাজ সারতে চায় সে। লাইনের সামনে দিয়ে ধীর পায়ে এগোল, দু’জন অন্তর একজনের সামনে থেমে প্রশ্ন করল দু’একটা।

শেষ লাইনের মাথায় পৌঁছে গার্ড কমান্ডারকে বিদায় দিল জেনারেল, তার তীক্ষ্ণ স্যালুটের জবাব দিল, তারপর ফিরল যুবক ক্যাপটেনের দিকে। ‘রাইট, ধমকের সুরে বলল সে, ‘আমি চাই, ক্যাপটেন, আমাকে, আমার অ্যাডজুট্যান্ট আর সঙ্গী ক্যাপটেন সহ, ভেতরে নিয়ে যাবে তুমি।’ ঝট্ করে ডুপ্রের দিকে ফিরল সে। ‘সঙ্গী ক্যাপটেনের কি যেন নাম বলেছিলে…’

‘ল্যাচাসি,’ কঙ্কালসার ক্যাপটেন নিজেই জবাব দিল। ‘ক্যাপটেন ল্যাচাসি।’

‘হ্যাঁ।’ ল্যাচাসির দিকে রাগের সাথে তাক্বাল জেনারেল, যেন লোকটাকে তার পছন্দ হয়নি। হ্যাঁ। তুমি, মেজর হেনরি ডুপ্রে, আর ক্যাপটেন ল্যাচাসি। আর কেউ নয়, শুধু এই আমরা চারজন ভেতরে ঢুকব।’ যুবক ক্যাপটেনের দিকে আবার তাকাল সে। ‘এবং আমি তোমার কমান্ডিং অফিসারের সাথে দেখা করতে চাই।’

জেনারেলের কনুইয়ের কাছ থেকে দ্রুত কথা বলল ডুপ্রে। ‘স্যার, আপনার কি মনে হয় না অন্তত জনাছয়েক লোক সাথে থাকলে ভাল হয়…?’

‘না, মেজর।’ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকল জেনারেল। ‘আমরা যা দেখব সবার তা দেখা উচিত হবে না। ক্লাসিফায়েড, টপ সিক্রেট, এ-সব শব্দের অর্থ বদলে দেয়া একদম পছন্দ করি না আমি। এই আকারের একটা এসকর্ট কেন আমরা সাথে রাখলাম তা-ও আমার জানা নেই। উঁহুঁ, আমরা ছাড়া আর কেউ ভেতরে ঢুকবে না। এসো, রওনা হওয়া যাক। সারাটা দিন এখানে ঘুর ঘুর করতে আসিনি।…শুধু চারজন…।’ কথা শেষ হয়নি, তার আগেই পা বাড়াল জেনারেল, পাঁচিলের মত শক্ত আর সোজা হয়ে আছে পিঠ।

ডুপ্রে আর ল্যাচাসিকে পিছনে ফেলে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে জেনারেল, নোরাড ক্যাপটেন তার পিছু নিয়ে প্রায় দৌড়াচ্ছে। ‘আমাদের কমান্ডিং অফিসার, স্যার…’

‘ইয়েস?’

‘মানে, স্যার…আপনাকে তো আগেই বলেছি, ডিউটিতে রয়েছেন একজন ফুল কর্নেল, অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে। আমাদের কমান্ডিং অফিসার আজ ছুটিতে আছেন, স্যার। ভাবলাম আপনাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার…’

মাথা ঝাঁকাল জেনারেল। ‘তাতে কিছু আসে যায় না। কেউ একজন থাকলেই হলো।’

পাথুরে প্রাচীরে ঠেকে রয়েছে বিল্ডিংগুলো, আসলে প্রবেশপথটাকে আড়াল করার জন্যে ডিফেন্সিভ ক্যামোফ্লেজ হিসেবে কাজ করছে ওগুলো। কংক্রিট আর ইস্পাতের সাহায্যে যতটা সম্ভব মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে, ভেতরে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসের কাজ চলে, পাহাড়ের অভ্যন্তরে ঢোকার টানেলটা সম্পূর্ণ ঢেকে রেখেছে।

নোরাড ক্যাপটেন বক বক করে চলেছে, ‘মেইন এন্ট্রান্সে, অর্থাৎ অপরদিকে, স্যার, একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্ক আছে গাড়ি রাখা ছাড়াও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। এটাকে খিড়কি দরজা বলতে পারেন…’

একজোড়া স্টীল ডোর পেরিয়ে এল ওরা। নোরাড ক্যাপটেন ছোট একটা পর্দার ভেতর হাত গলাতেই কবাট খুলে গেল। দরজার ওপারে বদলে গেল পরিবেশ, আরেক জগতে চলে এল ওরা। প্যাসেজটা সরু হয়ে গিয়ে চৌকো ধাতব টানেলে পরিণত হয়েছে, প্রতিবার শুধু একজন মানুষ যেতে বা আসতে পারবে। টানেলটা শেষ হয়েছে ছোট একটা কমান্ড পোস্টে, চারজন গম্ভীর মেরিনের দখলে রয়েছে সেটা, স্লাইডিং স্টীল প্যানেলসহ পরবর্তী প্রবেশপথটা পাহারা দিচ্ছে তারা।

গম্ভীর এবং সতর্ক হলেও, ইউনিফর্ম পরা মেরিনরা ওদের সাথে সহযোগিতা করল, কোন প্রশ্ন না তুলেই। নোরাড ক্যাপটেনের কথা শেষ হতে তাদের একজন ইন্টারকমে আলাপ করল, তারপর চারজনেই সরে দাঁড়াল একপাশে নিঃশব্দে খুলে গেল বিস্ফোরণ-প্রতিরোধক প্যানেল।

পাহাড়ের ভেতর কি আছে জেনারেল বা তার সঙ্গীদের সে-সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। জেনারেলের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এ-ধরনের অন্যান্য সামরিক স্থাপনায় যা সে দেখেছে এখানেও সেরকম কিছু দেখতে পাবে, যদিও সেগুলো তার চোখে অনেকটা যেন মুভি সেট-এর মত লাগে। বড় বড় এলিভেটর থাকে, স্টাফদের আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাবার কাজে ব্যবহার হয়। কিংবা থাকে খোলা রেলকার, যেমনটা আধুনিক কয়লা খনিতে দেখা যায় আজকাল।

কিন্তু দরজা পেরিয়ে এসে সে-সব কিছুই ওরা দেখল না। ওদের সামনে বিশাল একটা গোলাকার চেম্বার রয়েছে, রিসেপশন এরিয়া বলা যেতে পারে, দেয়ালগুলো নগ্ন পাথর। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, ফলে ভেতরে গা-জুড়ানো ঠাণ্ডা একটা ভাব। মেঝেতে কার্পেটও আছে, যদিও এটাকে পরিচ্ছন্ন একটা গুহা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

চারটে বড় আকারের ডেস্কে চারজন লোক, চেহারা দেখে মনে হয় দুনিয়ার কোন ব্যাপারেই তাদের যেন কোন আগ্রহ নেই। আড়িপাতা যন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র এবং বিস্ফোরক অনুসন্ধানী, ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর দায়িত্বে রয়েছে ওরা। দীর্ঘদেহী, তাম্রবর্ণ কর্নেলের দিকে ভাল করে না তাকিয়ে জেনারেল জানাল, আগে সৈ ডেস্কগুলো চেক করতে চায়। কর্নেলের বুকে অনেকগুলো রক্তবর্ণ মেডেল আর রিবন, তার পিছনে চারজনের ছোট একটা টীম। টীমের একজন ক্যাপটেন, বাকি তিনজন মেজর। সবার বয়সই ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে।

স্যালুট করল কর্নেল, নিজের এবং অফিসারদের পরিচয় জানাল, কমান্ডিং অফিসারের অনুপস্থিতির জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করল সবিনয়ে, সবশেষে সম্ভাব্য সমস্ত বিষয়ে সহযোগিতা এবং সুবিধে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিল সে।

মাথা ঝাঁকাল জেনারেল পিলার, লক্ষ করল কর্নেল আর তার অফিসাররা প্রত্যেকে সাইড আর্মস্ বহন করছে। কর্নেলকে নিজের স্টাফ মেম্বারদের পরিচয় জানাল সে। অপরদিকে কর্নেলও লক্ষ করল, জেনারেল পিলার ড্রেস ইউনিফর্ম পরে থাকলেও তার স্টাফ অফিসাররা পরে আছে কমব্যাট ড্রেস, এবং দু’জনেই সাইড আর্মস বহন করছে। ব্যাপারটা তার কাছে অশুভ ধরনের কিছু মনে না হলেও, অস্বাভাবিক লাগল। কন্ট্রোল রূম থেকে এখানে আসার আগে কর্নেল একটা অস্বাভাবিক ঘটনার রিপোর্টও পেয়েছে মেইন গেট থেকে-জেনারেল পিলারের ডিটাচমেন্ট ট্রুপস দু’নম্বর মাউন্টেইন এন্ট্রান্স সীল করে দিয়েছে, গেটের বাইরে ও ভেতরে পজিশন নিয়েছে তারা।

কর্নেল আরও লক্ষ করল, জেনারেল তেমন কোন প্রশ্ন করছে না। ব্যাপারটা বেশ একটু উদ্ভট। কাজেই সাথের চারজন অফিসারের উপস্থিতি সম্পর্কে নিজেই একটা ব্যাখ্যা দিল সে-ডিউটিতে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় নিয়েছে ওরা।

‘নিয়ম অনুসারে আর একটু পরই শেষ হয়ে যাবে ওদের শিফট,’ বলল কর্নেল, সারা মুখে সগর্ব হাসি। ‘কিন্তু ওরা থেকে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে ইন্সপেকশনের সময় আপনাকে সাহায্য করবে বলে, জেনারেল।’ সে আরও ব্যাখ্যা করল, ডিউটির সময় এই অফিসাররা বিভিন্ন কমান্ড পোস্ট, মেইন কন্ট্রোল রূম আর মনিটরগুলো সুপারভাইজ করে। ‘এখানে ডিউটি দেয়া মানে ছয় ঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ড গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করা।’ কাজ প্রসঙ্গে কথা বলার সময় অস্বাভাবিক সিরিয়াস দেখা গেল তাকে। এই মুহূর্তে যারা ডিউটিতে রয়েছে, নিজেদের কাজ নিয়ে তারা এতই ব্যস্ত, আপনার কোন প্রশ্নেরই উত্তর তারা ঠিকমত দিতে পারবে বলে মনে হয় না, স্যার।’

অফিসাররা থেকে যাওয়ায় কর্নেলকে ধন্যবাদ জানাল জেনারেল, জিজ্ঞেস করল প্রথমে কোন্ জিনিসটা তার দেখা দরকার।

‘যেটা আপনার খুশি, জেনারেল। আমরা এখানে আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। যে-কোন দিকে যান, যেটা খুশি পরীক্ষা করুন। কেউ কিছু মনে করবে না। আমরা সবাই এখানে সিরিয়াস লোক, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি, তবু আপনার সন্তুষ্টির জন্যে সবকিছুই দেখতে দেব আপনাকে, প্রয়োজনীয় যে-কোন তথ্য চাইলেই আপনি পাবেন।’

সিরিয়াস লোক? মনে মনে চিন্তা করল জেনারেল। সিরিয়াস লোকের বোধবুদ্ধি এত কম হয় কি করে? তবে, যারা দায়িত্বে থাকে তাদের কাছ থেকে এ- ধরনের সহযোগিতা প্রায়ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়।

এবার মেজর ডুপ্রে ওদের আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়ল। ‘আমার ধারণা, জেনারেল বিশেষভাবে জানতে চাইবেন কিভাবে আপনারা ফ্লাইং ড্রাগন কন্ট্রোল করেন, স্যার।’

ট্রাফিক পুলিসের মত একটা হাত তুলল জেনারেল। তাড়াহুড়ো করে একটা কিছু গিলিয়ো না তো, হেনরি। এই আউটফিট কিভাবে কাজ করে কর্নেল জানেন। আফটার অল, গোটা দেশের মধ্যে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘাঁটি…’

‘ওয়েল, কর্নেলের কন্ঠস্বর মার্জিত ও শ্রুতিমধুর। ‘কোথাও যদি কোন গোলযোগ দেখা দেয়, আমরাই প্রথম সেটা জানব, স্যার। আমার মনে হয়, এ- প্রসঙ্গেই জানতে চাইছেন আপনি। আমি আপনাকে অনুরোধ করব, প্রথমে আপনি আমাদের মেইন অপারেশনস্ কন্ট্রোল দেখুন…’

‘আপনি যা বলেন,’ রাজি হলো জেনারেল।

আরও এক জোড়া বিস্ফোরক প্রতিরোধক দরজার দিকে ইঙ্গিত করল কর্নেল, সিকিউরিটি ডেস্কগুলোর পিছনে অর্ধবৃত্ত আকৃতির দেয়ালের ঠিক মাঝখানে। ‘আসুন, স্যার।’

কর্নেলকে অনুসরণ করল জেনারেল, তাদের সাথে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ডুপ্রে আর ল্যাচাসি সহ অন্যান্য অফিসাররা। দরজার পর চওড়া একটা প্যাসেজ, শেষ হয়েছে টি-জাংশন করিডরে। ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে খানিক পরপর দু’পাশে সুইং ডোর দেখতে পেল জেনারেল। নাক বরাবর সামনেও আরেকটা দরজা, বড় বড় সাদা হরফে লেখা রয়েছে, মেইন অপারেশনস্।

একপাশে সরে দাঁড়িয়ে জেনারেলকে ভেতরে ঢোকার পথ করে দিল কর্নেল, বাকি সবাই ওদেরকে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে অনুসরণ করল।

প্রশস্ত একটা প্ল্যাটফর্মে পৌঁচেছে ওরা, অনেকগুলো চেয়ার আর উঁচু মোটা কাঁচের পর্দা রয়েছে। এই গ্যালারি থেকে সামনের দৃশ্য যে-কোন মানুষকে মুগ্ধ ও অভিভূত করবে।

ওদের নিচে বিশাল এক অ্যামফিথিয়েটার, প্রায় একশো নারী-পুরুষ প্রত্যেকে সামনে থরে থরে সাজানো কমপিউটর ও ইলেকট্রনিক ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে বসে আছে। কীবোর্ড, স্ক্যানার ইত্যাদি নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত, যে-যার কাজে তারা এতই মগ্ন, ভুলেও কেউ কারও দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না।

ওদের ওপরদিকে, দূরবর্তী বাঁকা দেয়ালে, প্রকাণ্ড আকারের তিনটে ইলেকট্রনিক মারকেটর প্রোজেকশন, প্রতিটিতে পৃথিবীর মানচিত্র। তিনটে প্রোজেকশনের মাথায় শোভা পাচ্ছে সার সার ডিজিটাল ক্লক, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন সময় দেখা যাচ্ছে ওগুলোতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি প্রোজেকশনে অসংখ্য মন্থরগতি রঙিন রেখা রয়েছে-নীল আর সবুজ, চোখ ধাঁধানো সাদা, ঘন কালো, কমলা, আবার কিছু কিছু রেখা বিভিন্ন বর্ণে রঞ্জিত, টেকনিকালার।

আটকে রাখা দম ধীরে ধীরে ছাড়লেও, জেনারেলের নাক দিয়ে বাঁশির মত আওয়াজ বেরিয়ে এল। তার মনে পড়ল এই জিনিসেরই ছোট সংস্করণ আগেও দেখেছে সে, তবে এটার সাথে সেগুলোর তুলনা চলে না। ‘কর্নেল,’ মৃদু কণ্ঠে বলল সে, ‘খুব খুশি হতাম আপনি যদি আমার পাশে এসে দাঁড়াতেন। এই অদ্ভুত প্রদর্শনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই আমরা।’

আনন্দের সাথে মেইন কন্ট্রোলের ব্যবহার ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করল কর্নেল। ইতিমধ্যে কক্ষপথে স্থাপিত স্যাটেলাইট ও অন্যান্য স্পেস হার্ডওয়্যারের সঠিক সংখ্যা জানিয়ে দিচ্ছে প্রোজেকশনগুলো, বাঁ দিকের প্রোজেকশন শুধু বিদেশী স্যাটেলাইটের হিসেব দেবে, ডান দিকেরটা দেবে আমেরিকান স্যাটেলাইটের, আর মাঝেরটা মনিটর করবে যে-কোন নতুন স্পেস-ক্রাফটের উপস্থিতি।

মাঝের প্রোজেকশনের আরেকটা গুণ আছে। মুহূর্তের মধ্যে প্রোগ্রাম করা যায়, ফলে মার্কিন অ-মার্কিন যে-কোন স্যাটেলাইটের পারস্পরিক দূরত্ব, অবস্থান, ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ জানা সম্ভব।

‘এটাকে আর্লি ওয়ার্নিং প্রোজেকশনও বলা হয়,’ ওদেরকে জানাল কর্নেল। ‘বিদেশী শক্তি আকাশে নতুন কিছু পাঠালেই এই সেন্ট্রাল স্ক্রীনে ধরা পড়ে যাবে।’

বিশাল ইলেকট্রনিক ম্যাপগুলো অপারেট ও মনিটর করছে অ্যামফিথিয়েটারে বসা টেকনিশিয়ানরা, বিভিন্ন উৎস থেকে ইনফরমেশন সংগ্রহ করে নিয়মিত যোগান দিচ্ছে তারা। ‘নতুন যে-কোন তৎপরতার খবর আমাদের ট্র্যাকিং স্টেশনগুলোর একটা থেকে আসবে, সেটা হয় গ্রাউন্ড-বেস নয়তো স্যাটেলাইট স্টেশন হবে। আমাদের নিজেদের স্যাটেলাইট ইনফরমেশন যোগান দেবে যার যার কমান্ড পোস্টকে, কমান্ড পোস্টগুলো এই কমপ্লেক্সের ভেতরেই আছে,’ এমনভাবে ব্যাখ্যা করছে কর্নেল, সব যেন পানির মত সহজ। কিন্তু যার বোঝার ক্ষমতা আছে তার পক্ষে বিস্ময়ে স্তম্ভিত না হয়ে উপায় নেই।

কর্নেল বলে চলেছে, ‘একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বিগ বার্ড আর কীহোল টু রিকনিসনস্ স্যাটেলাইটের কথা ধরুন, ডান দিকের প্রোজেকশনে। এই গ্যালারির বাইরের প্যাসেজে রয়েছে ওগুলোর কমান্ড পোস্ট, ওগুলোর কাজ মনিটর করা হবে ওই পোস্ট থেকে। তবে, বলাই বাহুল্য, স্যাটেলাইট থেকে যে তথ্য আসে তার সবই অন্যান্য স্টেশনেও পাঠানো হয়।

‘এখন, যদি আমরা কিছু পাই, ধরুন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে, ট্রেস সাথে সাথে পিক করবে সেটা।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের এস.ডি.এস.-স্যাটেলাইট ডাটা সিস্টেম-ডিটেলস রিলে করতে শুরু করবে। নতুন জিনিসটা কি তা জানার আগেই অ্যাকশন নেব আমরা। তবে এ-ধরনের ঘটনা বিদ্যুৎবেগেই ঘটে, এবং প্রায়ই।

বলে চলেছে কর্নেল। ‘প্রতিটি স্যাটেলাইট সিস্টেমের নিজস্ব হেডকোয়ার্টার রয়েছে, কাজ করছে স্বাধীনভাবে। ওয়েদার স্যাটেলাইটগুলো তথ্য সরবরাহ করছে সরাসরি আবহাওয়া কেন্দ্রগুলোয়, রিকনিসনস্ স্যাটেলাইটগুলো সম্পর্কেও সেই একই কথা।

‘এক অর্থে আমরা যেন অনেকটা পুলিস প্যাট্রল,’ সরাসরি জেনারেলের সাথে কথা বলছে কর্নেল। ওপরে কি রয়েছে দেখতে পাচ্ছি, চেক করছি ব্যাপারটা, প্রাপ্ত তথ্য জায়গামত পাঠাচ্ছি, এবং অ্যাকশন নিচ্ছি।’

ফ্লাইং ড্রাগন সম্পর্কে কিছু বলছেন না কেন, কর্নেল, স্যার?’ জেনারেলের ডান দিক থেকে সবিনয়ে প্রশ্ন করল ডুপে।

গম্ভীর হলো কর্নেল, ওপর-নিচে মাথা দোলাল বারকয়েক। ‘দ্যাট’স আ ভেরি স্পেশাল প্রজেক্ট,’ বলল সে। ‘জেনারেল কি ওগুলোর কমান্ড পোস্ট দেখতে ইচ্ছে করেন? এখানে সম্ভবত সবচেয়ে বড়টাই রয়েছে।

জেনারেল পিলারের হয়ে মেজর ডুপ্রে আর ক্যাপটেন ল্যাচাসি জবাব দিল। হ্যাঁ, ফ্লাইং ড্রাগনের কমান্ড পোস্ট দেখার জন্যে আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছেন জেনারেল।

‘আপনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা, স্যার।’ পথ দেখিয়ে ওদেরকে মেইন অপারেশনস্ গ্যালারি থেকে বের করে আনল কর্নেল। বাঁ দিকের প্যাসেজ ধরে খানিকদূর এগোবার পর একজোড়া সুইংডোরের সামনে দাঁড়াল সে, কবাটে লেখা রয়েছে, কে.এস. কন্ট্রোল। ‘কিলারস্যাট, স্যার,’ ব্যাখ্যা করল কর্নেল, পথ দেখিয়ে নিয়ে এল বড় একটা চেম্বারে।

ভেতরে আধো অন্ধকার। উল্টোদিকের দেয়ালে আলোয় ঝলমল করছে ইলেকট্রনিক মারকেটর প্রোজেকশনের ছোট একটা সংস্করণ-রক্তবর্ণ রেখাগুলো দুনিয়ার ওপরটা অনবরত ঝাড়ু দিচ্ছে। কমপিউটর আর ইলেকট্রনিক সেট নিয়ন্ত্রণ করছে তিনজন টেকনিশিয়ান, একজন অফিসার, দু’জন মাস্টার-সার্জেন্ট।

‘ওই দেখুন,’ হাত তুলল কর্নেল, এরপর কথা বলল গলা চড়িয়ে, যাতে ফ্লাইং ড্রাগন কমান্ড পোস্ট নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত লোক তিনজন তার কথা শুনতে পায়, ‘জেন্টলমেন, জেনারেল পিলার, দা ইন্সপেক্টর-জেনারেল এয়ার স্পেস ডিফেন্স। স্রেফ একটু দেখতে এসেছেন।

সরে এসে জেনারেলের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াল মেজর ডুপে। ঠিক বোধহয় তা নয়,’ বেশ উঁচু গলায় বলল সে। ‘আমার ধারণা, শুধু দেখতেই আসেননি জেনারেল, আরও কিছু ব্যাপার আছে।’

ডুপ্রের দিকে ফিরল জেনারেল, ঠোঁট জোড়া একটা প্রশ্নের আকৃতি পেতে যাচ্ছে।

‘আপনার মনে আছে, স্যার,’ উৎসাহ দিল ডুপ্রে, জেনারেলের যাতে মনে পড়ে। ‘আপনিই তো এখন এখানকার সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার।’

ভুরু কুঁচকে উঠল জেনারেলের, চারপাশে তাকাল সে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেল, বাকি স্টাফরা ভিড় করে রয়েছে দোরগোড়ার কাছে। ক্যাপটেন ল্যাচাসি রয়েছে স্টাফদের পিছনে, বাইরের করিডরে।

‘স্যার, কমপিউটর টেপ আর প্রিন্টআউট,’ বলল ডুপ্রে, জেনারেলের ডান কনুইয়ের কাছ থেকে।

‘ও, হ্যাঁ, অবশ্যই। দুঃখিত, হেনরি।’ হাসল জেনারেল, তারপর গলা চড়াল, ‘আপনাদেরকে বিরক্ত করার কোন ইচ্ছে আমার নেই, জেন্টলমেন, তবু আমাকে জানতে হবে এই কমান্ড পোস্টের চার্জে কে রয়েছেন।’

মাঝখানের কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে বসা অফিসার একটা হাত তুলল। ‘স্যার।’

‘হুক থেকে কমপিউটর টেপগুলো নামাবেন, প্লীজ? প্রিন্টআউটগুলো একটা বাক্সে ভরবেন, প্লীজ? পরীক্ষা করার জন্যে ওগুলো আমি সাথে করে নিয়ে যেতে চাই,’ শান্তকণ্ঠে বলল জেনারেল।

ধীরে ধীরে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অফিসার। ‘ভেরি ওয়েল, স্যার,’ বিড়বিড় করে বলল সে, বড়সড় কনসোল-এর পিছনে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে টেপগুলো কয়েকটা বাক্সে ভরল সে। কমপিউটর প্রিন্টআউটগুলো ভরা হলো চ্যাপ্টা আকৃতির কয়েকটা মেটাল বক্সে। ‘জেনারেল আরও কিছু চান?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘না, ওগুলো হলেই চলবে,’ জেনারেলের হয়ে জবাব দিল ডুপ্রে। ‘এদিকে নিয়ে আসুন।

ফ্লাইং ড্রাগন কমান্ড পোস্ট অফিসার আধো অন্ধকারে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

তারপর হঠাৎ, ক্ষিপ্রবেগে, অপ্রত্যাশিতভাবে, সবাইকে বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিল জেনারেল পিলার। গোড়ালিতে ভর দিয়ে চরকির মত আধপাক ঘুরল সে, ফিরল কর্নেলের দিকে, একটা হাত লম্বা করে দ্রুত উঠিয়ে নিল হোলস্টার থেকে কর্নেলের পিস্তলটা।

ঘোরা শেষ হয়নি তখনও, জেনারেলের গলা থেকে চিৎকার বেরিয়ে এল, ‘স্টপ! বাক্সগুলো দেবেন না! আমার সাথে ওই লোক দু’জন, ধরুন ওদেরকে। ওরা ভুয়া, নকল, ছদ্মবেশী। জলদি! ধরুন! ধরুন!’