০৭৭. যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যে অভিষেক

মুনি বলিলেন, রাজা কর অবধান।
অনন্তর শুন পিতামহ উপাখ্যান।।
ধৃতরাষ্ট্র নরপতি বুঝিয়া বিধান।
যুবরাজ করিতে করেন অনুমান।।
কুরুকুলে জ্যেষ্ঠ কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির।
সকল জনের প্রিয় ধর্ম্মশীল ধীর।।
যুধিষ্ঠিরে অভিষেক কৈল যুবরাজ।
হইল পরম প্রীত সকল সমাজ।।
যুধিষ্ঠির-সৌজন্যেতে সবে রৈল বশে।
পৃথিবী হইল পূর্ণ ধর্ম্মপুত্র-যশে।।
ভীমার্জ্জুন দুই ভাই রাজাজ্ঞা পাইয়ে।
চতুর্দ্দিকে রাজগণে বেড়ায় শাসিয়ে।।
জিনিলে অনেক দেশ, কত লব নাম।
বহু রাজা সহ হৈল অনেক সংগ্রাম।।
উত্তর পশ্চিম পূর্ব্ব জম্বুদ্বীপ আদি।
জিনিয়া আনিল দোঁহে বহু রত্ন নিধি।।
কুরুকুলে ক্রমে যেই অসাধ্য আছিল।
ভীমার্জ্জুনে দুই ভাই আয়ত্ত করিল।।
নানারত্নে কৈল পূর্ণ হস্তিনা-নগর।
পৃথিবী পূরিল যশে দুই সহোদর।।
নকুল দুর্জ্জয় যোদ্ধা সর্ব্বগুণে ধীর।
কৌরব-কুমার মধ্যে সুন্দর শরীর।।
সহদেব হইল মন্ত্রী অতুল ভুবনে।
সর্ব্বজ্ঞ হইল দেব-গুরু আরাধনে।।
পাণ্ডবের প্রশংসা করয়ে সর্ব্বজন।
ধন্য ধন্য বলি ক্ষিতি হইল ঘোষণ।।
কুরুবংশে কুলক্রমে যত রাজগণ।
পাণ্ডব-সূর্য্যেতে যেন তারা আচ্ছাদন।।
দিনে দিনে বাড়ে তেজ শুক্লপক্ষ শশী।
পাণ্ডবের কীর্ত্তি লোক গায় অহর্নিশি।।
ধৃতরাষ্ট্র শুনিয়া হইল ছন্নমতি।
পাণ্ডবের যশ কীর্ত্তি বাড়ে নিতি নিতি।।
বিধির লিখন কেবা খণ্ডাইতে পারে।
হিংসা জন্মিল চিত্তে অন্ধ-নরবরে।।
মম-পুত্রগণ-গুণ কেহ নাহি বলে।
পাণ্ডবের যশ প্রচারিল ভূমণ্ডলে।।
এই সব ভাবনা করয়ে অনুক্ষণ।
নয়নে নাহিক নিদ্রা না রুচে ভোজন।।
কুরুবংশে বৃদ্ধ মন্ত্রী জাতিতে ব্রাহ্মণ।
কণিকেরে ডাকি আনাইল ততক্ষণ।।
একান্তে কণিকে আনি বলিল তাহাকে।
পরম বিশ্বাস তেঁই জানাই তোমাকে।।
দিবানিশি আমার হৃদয়ে নাহি সুখ।
তোমার মন্ত্রণা-বলে খণ্ডিবে সে দুঃখ।।
পাণ্ডবের যশ কীর্ত্তি বাড়ে দিনে দিনে।
চিত্ত স্থির নহে মম ইহার কারণে।।
ইহার উপায় তুমি বলহ সত্বর।
কণিক শুনিয়া তবে করিল উত্তর।।
আমার বচন যদি রাখ নররায়।
খণ্ডিবে সকল চিন্তা, হইবে বিজয়।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, তুমি যে কর বিচার।
মম দৃঢ় বাক্য, সেই কর্ত্তব্য আমার।।
কণিক বলিল, রাজা শুন রাজনীত।
পূর্ব্বপার আছে হেন শাস্ত্রের বিহিত।।
কার্য্য না থাকিলে তবু সাধিবেক দণ্ড।
আত্মবশ করিবেক সব রাজ্যখণ্ড।।
আত্মছিদ্র লুকাইবে পরম যতনে।
পরছিদ্র পাইলে ধরিবে ততক্ষণে।।
সময় বুঝিয়া রাজা করিবেক কর্ম্ম।
ক্ষণে গুপ্ত ক্ষণে ব্যক্ত যেন হয় কূর্ম্ম।।
দুর্ব্বল দেখিয়া শত্রু দয়া নাহি করি।
শরণ লইলে তবু না রাখিবে বৈরী।।
বালক দেখিয়া শত্রু না করিবে ত্রাণ।
ব্যাধি অগ্নি রিপু ঋণ একই সমান।।
শত্রুকে বলিষ্ঠ দেখি করিবে বিনয়।
অপমান বহুক্লেশ সহিবে হৃদয়।।
সদাই থাকিবে তারে স্কন্ধেতে করিয়া।
সময় পাইলে মার ভূমে আছাড়িয়া।।
পূর্ব্বর বৃত্তান্ত এক শুন নরপতি।
বনেতে শৃগাল বৈসে বিজ্ঞ সর্ব্বনীতি।।
সিংহ ব্যঘ্র নকুল মূষিক ও শৃগাল।
পঞ্চজন সখা বনে আছে চিরকাল।।
একদিন বনে চরে একটি হরিণী।
অতিশয় মাংস গায়ে, আছয়ে গর্ভিণী।।
শৃগাল দেখিয়া বলে, মৃগের ঈশ্বরে।
য্ত্ন করি সিংহ না পারিল ধরিবারে।।
শৃগাল বলিল, তবে শুন সখাগণ।
ধরিব হরিণী, শুন আমার বচন।।
বলেতে সমর্থ কেহ নহিবে তাহার।
মূষিক হইতে মৃগী করিব সংহার।।
শ্রান্ত আছে হরিণী, শুইবে কোন স্থান।
ধীরে ধীরে মূষা তথা করহ প্রয়াণ।।
দূরে থাকি যাবে তথা করিয়া সুড়ঙ্গ।
নিঃশব্দে যাইবে যেন না জানে কুরঙ্গ।।
সুড়ঙ্গ-ফুকরে তার চরণ যথায়।
কাটিবে পদের শির করিয়া উপায়।।
পদ-শির কাটা গেলে অশক্ত হইবে।
অবশেষে সিংহ তারে অবশ্য ধরিবে।।
এত শুনি সম্মত হইল সর্ব্বজন।
যা বলিল জম্বূক করিল ততক্ষণ।।
কাটা গেল পদ-শির মূষিক-দংশনে।
হীনশক্তি দেখি সিংহ ধরিল তখনে।।
হরিণী পড়িল সবে হরিষ বিধানে।
শৃগাল আপন চিত্তে করে অনুমান।।
বুদ্ধিবলে মৃগে আমি করিলাম হত।
সিংহ ব্যাঘ্র খেলে মাংস আমি পাব কত।।
সকল খাইতে মাংস করিব উপায়।
প্রযত্ন করিব, পাছে যে হয় সে হয়।।
ইহা ভাবি শৃগাল করিয়া যোড়কর।
নীতি বুঝাইয়া কহে সবার গোচর।।
দেখ দৈবযোগে আজি পড়িল হরিণী।
মাংস শ্রাদ্ধ করি, আছি পিতৃলোকে ঋণী।।
স্নান করি শুচি হৈয়া সবে এস গিয়া।
ততক্ষণে মৃগী আমি থাকি আগুলিয়া।।
বুদ্ধিমন্ত শৃগালের যুক্তি-অনুসারে।
ততক্ষণে গেল সবে স্নান করিবারে।।
সবা হৈতে শ্রেষ্ঠ সিংহ বলিষ্ঠ বিশেষে।
গিয়া স্নান করি এল চক্ষুর নিমিষে।।
স্নান করি আসি সিংহ দেখয়ে জম্বুকে।
অত্যন্ত বিরসে বসি আছে হেঁটমুখে।।
সিংহ বলে, সখে কেন বিরস বদন।
স্নান করি, এস মাংস করিব ভক্ষণ।।
শৃগাল বলিল, সখা কি কহিব কথা।
মূষিকের বচনে জন্মিল বড় ব্যথা।।
যখন আপনি গেল স্নান করিবারে।
কুবচন বলে যে, কহিতে লজ্জা করে।।
মহাবলী সিংহ ইহা বলে সর্ব্বজন।
আমি মারিলাম মৃগ, সে করে ভক্ষণ।।
সিংহ বলে, হেন বাক্য সহে কোন্ জন।
কোন্ ছার মূষা হেন বলিবে বচন।।
না খাইব মাংস আমি খাউক আপনি।
নিজ বীর্য্যবলে মৃগ ধরিব এখনি।।
হেন বাক্য বলে, তার মুখ না চাহিব।
আপন অর্জ্জিত বস্তু আপনি খাইব।।
এত বলি গেল সিংহ গহন কাননে।
স্নান করি ব্যাঘ্র তবে আইল সে স্থানে।।
আস্তে ব্যস্তে কহে শিবা শুন প্রাণসখা।
ভাগ্যেতে তোমারে সিংহ না পাইল দেখা।।
দৈবাৎ তোমারে ক্রোধ হইয়াছে তার।
নাহি জানি কে কহিল, কিবা সমাচার।।
এখনি গেলেন তেঁই তোমা ধরিবারে।
আমারে বলিল, তুমি না বলিহ তারে।।
চিরকাল সখা তুমি, না বলি কেমনে।
বুঝিয়া করহ কার্য্য যেবা লয় মনে।।
এতেক শুনিয়া ব্যাঘ্র শৃগাল-বচন।
হৃদয়ে বিস্মিত হৈয়া ভাবে মনে মন।।
নাহি জানি কোন্ দোষ করিলাম তার।
ক্রোধ করিয়াছে কোন্ না বুঝি বিচার।।
মহা চিন্তাকুল হয়ে, ভাবিতে লাগিল।
কি করিব কোথা যাব অন্তরে ভাবিল।।
হেথায় থাকিলে হবে বড়ই প্রমাদ।
স্থান তেয়াগিয়া যাই কি কাজ বিরাদ।।
এত বলি ব্যাঘ্র প্রবেশিল ঘোর বনে।
কতক্ষণে মূষিক আইল সেই স্থানে।।
মূষিকে দেখিয়া শিবা যুড়িল ক্রন্দন।
আইসহ সখা তোমা করি আলিঙ্গন।।
কেন সখা নকুলের হইল কুমতি।
ছাড়িতে নারিল পূর্ব্ব আপন প্রকৃতি।।
আচম্বিতে সর্প সঙ্গ হৈল তার দেখা।
যুদ্ধে হারি তার কাছে হৈল তার সখা।।
স্নান করি এখানে আইল দুই জন।
সর্পেরে না দিনু মাংস করিতে ভক্ষণ।।
পঞ্চ জন মিলিয়া যে মারিলাম মৃগী।
এখন নকুল আনে আর এক ভাগী।।
সখা না পাইল, ভাগ নকুল কুপিল।
তোমারে ধরিয়া খেতে নকুল বলিল।।
দুই জন মিলি গেল তোমা খুঁজিবারে।
হেথা এলে ধরিহ বলিয়া গেল মোরে।।
এত শুনি মূষিকের উড়িল পরাণ।
অতি শীঘ্র পলাইয়া গেল অন্য স্থান।।
হেনকালে নকুল আসিয়া উপনীত।
ক্রোধে শিবা কহে তারে সময় উচিত।।
সিংহ-আদি তিন জন করিল সমর।
হারিয়া আমার যুদ্ধে গেল বনান্তর।।
তোর শক্তি থাকে যদি, আসি কর রণ।
নহিলে পলাহ তুমি লইয়া জীবন।।
সহজে নকুল ক্ষুদ্র শিবা বলবান।
বিনা যুদ্ধে পলাইয়া গেল অন্য স্থান।।
হেনমতে চারি ঠাঞি চারি বুদ্ধি কৈল।
বুদ্ধে সবা জিনি মৃগ আপনি খাইল।।
কণিক বলিল, রাজা কর অবধান।
এমত করিলে রাজা হয় রাজ্যবান।।
বলিষ্ঠে বুদ্ধিতে জিনি মারিবেক বলে।
লুব্ধ জনে ধন দিয়া মারিলেক ছলে।।
শক্ররে পাইলে রাজা কভু না ছাড়িবে।
জন্মাইয়া বিশ্বাস বিপক্ষেরে মারিবে।।
জানিবে, যে শত্রু মম জীবনের বৈরী।
তাহারে মারিবে আনাইয়া দিব্য করি।।
ছলে বলে শত্রুকে পাঠাবে যম-ঘর।
হেনমতে আছে রাজা বেদেরে বিচার।।
বিশ্বাসিয়া দিব্য করি মারে শত্রু সব।
নাহিক ইহাতে পাপ, কহেন ভার্গব।।
এ সব বুঝিয়া রাজা করহ উপায়।
এবে না করিলে শেষে দুঃখ পাবে রায়।।
এত বলি কণিক চলিল নিজ ঘর।
চিন্তিতে লাগিল মনে অন্ধ নৃপবর।।
পুণ্য-কথা ভারতের শুনিলে পবিত্র।
কাশীরাম দাস কহে অদ্ভুত চরিত্র।।
জন্মেজয় বলে, কহ কহ মুনিবর।
বিস্তারিহা কহ মোরে ঘুচুক আঁধার।।
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
কহিব অপূর্ব্ব আমি ভারত কথন।।