৯. রায়বাড়িতে শনির হুমকি

সকালে ঘুম থেকে উঠে তানিয়া ভেবেছিলো বাড়িতে নাশতা খেয়ে কালাকে বলবে নটার দিকে ওকে রায় বাড়িতে পৌঁছে দিতে। অবশ্য কাল রাতে আসার সময় প্রতিমা আর প্রতিভা দুজনেই বলেছে–ঘুম থেকে উঠেই চলে আসবি। জলখাবার আমাদের সঙ্গে খাবি। তানিয়ার মনে হয়েছে সকালের নাশতাটা বাবার সঙ্গে খাওয়া উচিৎ।

ঢাকার বাড়ির মতো বুয়া সকাল সাতটায় টেবিলে নাশতা দেয়। ঢাকার বাড়িতে ছিলো রুটি আর ভাজি। গ্রামে আসার পর একটা করে ডিম এর সঙ্গে যোগ হয়েছে। খামারের মুরগি ডিম দেয়া শুরু করেছে। প্রতিদিনই পাঁচ ছটা ডিমের খোসা ভেঙে যায়। ফার্মের ডিমের খোসা এমনিতেই নরম। বুয়া ভাঙা ডিমগুলো রান্নার কাজে লাগায়।

বাবার সঙ্গে তানিয়া নাশতা খেতে বসেছে–এমন সময় বনমালী হন্তদন্ত হয়ে এসে বাবাকে বললো, কর্তাবাবু আপনেরে চিঠি দিছে।

নটার ভেতর বিভূতিরঞ্জন খামারে চলে আসেন। দুপুর পর্যন্ত দুই বন্ধু খামারের তদারকি করেন। মুরগির বাচ্চা, ডিম আর মাছ বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। কালা ছাড়াও খামারে আরও দুজন লোক রাখতে হয়েছে। দিন দিন কাজ বাড়ছে। হঠাৎ বন্ধুর চিঠি পেয়ে বাবা অবাক হলেন। নাশতা অর্ধেকও শেষ হয়নি–হাত মুছে তিনি বন্ধ খাম খুলে চিঠি পড়লেন। বিভূতিরঞ্জন লিখেছেন–

ভাই নূরউদ্দিন, চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি বনমালীর সঙ্গে চলে এসো। আজ খামারে যাওয়া হবে না। কালাদের কাজ বুঝিয়ে তোমাকে হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে। সাক্ষাতে সব বলব। ইতি বিভূতি।

বুয়া দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, কালাকে একটু আসতে বলো।

তানিয়া অবাক হয়ে জানতে চাইলো, বিভূতি কাকা চিঠিতে কী লিখেছেন।

আমাকে যেতে লিখেছেন।

হঠাৎ চিঠি? কোনও বিপদ টিপদ হয়নি তো?

জানি না। বাড়ির খবর সব ভালো তো বনমালী?

শুকনো গলায় বনমালী বললো, সকালে কর্তা বাবুর মুখ খুব গম্ভীর দ্যাখলাম। আমারে ডাইকা খালি কইছেন চিঠিটা আপনেরে দিতে।

বাবা উঠে ভেতরে গেলেন কাপড় বদলাবার জন্য। তানিয়া চাপা গলায় বললো, কী হয়েছে বনমালীদা? তুমি কিছু জানো না? কিছু শোননি?

বনমালী গম্ভীর গলায় বললো, কাইল তোমরা ভূতের ভিটায় গিয়া ভালা কর নাই।

কেন বনমালীদা?

তেনারা কুপিত হইছেন। কাইল, আমি সারা রাইত জাইগা আছিলাম। একটুও ঘুমাইতে পারি নাই। খালি রাম নাম করছি। একটু অসাবধান হইলে তেনারা আমারে গলা টিপা মারতেন। মনে হয় কর্তাবাবুও তেনাগো দেখছেন।

তানিয়ার মনে হলো বনমালী সব কথা বিভূতি কাকাকে বলে দিয়েছে। বাবাকে হয়তো এ ব্যাপারে সাবধান করে দেয়ার জন্য তিনি ডেকেছেন। বনমালীকে ও জিজ্ঞেস করলো, আসার সময় প্রতিমাদির সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?

বাবুর লগে তোমারেও লইয়া যাইতে কইছে।

তানিয়া রহস্য করে বললো, না গেলে!

যাইবা না ক্যান! আমগো কর্তাবাবুর যদি কুন বিপদ হয় তোমরা দেখবা না?

নিশ্চয় দেখবো।

বাবা কাপড় বদলে ঘর থেকে বেরুতেই তানিয়া বললো, বাবা আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। প্রতিমাদি যেতে বলেছেন।

ঠিক আছে, তৈরি হয়ে নে। আমি কালাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে এক্ষুণি আসছি।

তানিয়ার তৈরি হতে আধঘন্টা লাগলো। ততক্ষণে কালাদের সব কাজ বুঝিয়ে বারান্দায় বসে বাবা চা খাচ্ছিলেন। তানিয়া ঘর থেকে বেরুতেই তিনি আর দেরি করলেন না। কালার মাকে শুধু বললেন, বুয়া, দুপুরে আমরা ও বাড়িতে খাবো।

তানিয়াদের বাড়ি থেকে রায়বাড়ি বেশি দূর নয়। ওদের পুকুর আর গোরস্থান পেরিয়ে খানিকটা যেতে হয় ধানক্ষেতের পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে। তারপর কুমোরপাড়া। রতেশ্বরীর কুমোরদের মাটির কাজের প্রশংসা টাঙ্গাইল অবধি শোনা যায়। কুমোর পাড়া পেরুলে স্কুল। স্কুলের পরই শুরু হয় রায়বাড়ির আম কাঁঠাল আর লিচুর বিশাল বাগান। চারজন মালি দিন রাত বাগান পাহারা দেয়। বাগানের পশ্চিমে রায়বাড়ির সদর পুকুর। পুকুরের পরই মূল বাড়ি।

যেতে যেতে তানিয়া লক্ষ্য করলো বাবার চেহারা খুবই গম্ভীর। ও নিজেও ভেবে পাচ্ছিলো না বিভূতি কাকা বাবাকে চিঠি দিয়ে এভাবে ডাকলেন কেন। তানিয়ার একটাই ভয়–কাল ওদের পুরোনো মহলে যাওয়া নিয়ে যদি কথা ওঠে!

দূর থেকে তানিয়া দেখলো বিভূতি কাকা দোতালার ঝুল বারান্দায় পায়চারি করছেন। বাবা দোতালায় উঠলেন না। নিচের তলায় বৈঠকখানায় বসলেন। বনমালী ওপরে গেলো খবর দিতে। সেই ফাঁকে প্রতিভা এসে দরজার পাশ থেকে চাপা গলায় ডাকলো–এ্যাই তানিয়া, ওখানে বসে আছিস কেন? ওপরে আয়।

বাবাও ইশারায় তানিয়াকে যেতে বললেন। বিভূতিরঞ্জন নিশ্চয় মেয়ের সামনে গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় আলোচনা করবেন না। তানিয়া বেরিয়ে যেতেই বিভূতিরঞ্জন এসে ঘরে ঢুকলেন।

সেগুন কাঠের চওড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে প্রতিভা ওর বন্ধুকে বললো, জানিস না তো কী ভয়ঙ্কর এক বিপদের খাড়া ঝুলছে আমাদের মাথার ওপর।

কী বিপদ?

ঘরে চল বলছি। তানিয়াকে নিয়ে সোজা প্রতিমার ঘরে এলো প্রতিভা। পালঙ্কের বাজুতে হেলান দিয়ে গম্ভীর মুখে বসেছিলো প্রতিমা। তানিয়াকে দেখে বললো, ওপরে উঠে বোস! আমাদের ভীষণ বিপদ!

তানিয়া আর প্রতিভা খাটে উঠে বসলো। প্রতিমা বললো, ভোর না হতেই সাংঘাতিক এক চিঠি এসেছে।

কোত্থেকে এসেছে চিঠি? তানিয়া অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কার চিঠি?

কোত্থেকে এসেছে জানি না। কে লিখেছে, কারা লিখেছে–কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

খামের ওপর পোস্ট অফিসের ছাপ নেই? চিঠির নিচে নাম নেই?

নামের জায়গায় লেখা আছে–শনি। চিঠি ডাকে আসেনি। ভোরবেলা মোক্ষদাদি পুজোর ফুল তুলতে বেরিয়েছিলো। এক ছেলে এসে বললো, এটা কর্তাবাবুর চিঠি। বাবু ঘুম থেকে উঠলে চিঠিটা দিও। এই বলে ছেলেটা ভোরের কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে।

চিঠিটা কোথায়?

বাবার কাছে।

তোমরা দেখেছো?

তানিয়ার প্রশ্নের জবাব দিলো প্রতিভা দেখবো না কেন? পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে গেছে।

কী লেখেছে বল না?

চিঠি সবুজ রঙের খামে সবুজ কাগজে লেখা। খামের ওপরে শুধু বাবার নাম লেখা। ভেতরে লিখেছে–মালাউন বিভূতিরঞ্জন, তোমার উপর আমরা অনেক দিন ধরিয়া নজর রাখিতেছি। ভাবিয়াছিলাম তোমার জ্ঞাতি ভাইদের দ্বারা বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার অপরাধে ও লজ্জায় তুমি তোমাদের আসল দেশ হিন্দুস্থান চলিয়া যাইবা। তুমি যাও নাই। এতদিন চুপচাপ ছিলা বিধায় কিছু বলি নাই। এখন তুমি মুরতাদ নূরউদ্দিনের সঙ্গে ফার্মের ব্যবসা করিতেছ, গ্রামের মেয়েদের বেপর্দা বেহায়া বানাইবার জন্য স্কুল খুলিতেছ। এইসব কুফরি কাজের জন্য তোমাকে দশ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হইবে। দুই দিন সময় পাইবে। টাকা জোগাড় করিয়া রাখ। ভবিষ্যতের জন্য তোমাকে সাবধান করিয়া দিতেছি। শয়তান নূরউদ্দিনের সহিত কোন সম্পর্ক রাখিলে তোমার মেয়ে দুইটিকে হারাইতে হইবে। নিজেদের জীবনও খোয়া যাইবে। পুলিশে খবর দিলে জরিমানার টাকা দ্বিগুণ হইবে। পুলিশের সাধ্য নাই আমাদের গায়ে হাত দেয়। ইতি শনি।

তানিয়া জানে প্রতিভার স্মরণশক্তি খুবই প্রখর। চিঠির কথাগুলো ও এমনভাবে বললো–যেন দেখে দেখে পড়ছে। প্রতিমার কাছে জানতে চাইলো, পুলিশকে খবর দেয়া হয়েছে?

না। বাবা বললেন আগে নূরু কাকুর সঙ্গে পরামর্শ করবেন। তারপর যা করা দরকার করবেন।

.

চিঠি পড়ে তানিয়ার বাবা তার বন্ধুকে বললেন, এক্ষুণি থানায় খবর পাঠাও বিভূতি। থানায় একটা জিডি করানো দরকার। ওসি তো তোমার পরিচিত। লিখে দাও সাদা পোশাকে কিছু পুলিস পাঠাবার জন্য, যারা বাড়ির আশে পাশে নজর রাখতে পারে। অফিসার যে আসবে সেও যেন প্লেইন ড্রেস-এ আসে।

বিভূতিরঞ্জন বললেন, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না নূরউদ্দিন। যা লিখতে হয় তুমিই লেখো। আমি সই করে দেবো।

প্রতিমার মা কাগজ আর কলম এনে দিলেন। বাবা মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সম্বোধন করে একটা অভিযোগ পত্র লিখে বিভূতিরঞ্জনের দিকে এগিয়ে দিলেন–পড়ে দেখ, ঠিক আছে কি না। তারপর নিচে সই করো।

বিভূতিরঞ্জন না পড়েই চিঠি সই করে দিলেন। চিঠিখানা ভাঁজ করে বাবা জানতে চাইলেন, থানায় কাকে পাঠাবো?

বনমালী থাকতে আর কে যাবে? এই বলে বিভূতিরঞ্জন গলা তুলে বনমালীকে ডাকলেন।

দুবার ডাকতেই বনমালী এসে ঘরে ঢুকলো। বিভূতিরঞ্জন বললেন, এক্ষুণি থানায় গিয়ে এ চিঠিটা দিয়ে এসো। ওসি হাকিম সাহেবের হাতে দিও।

প্রতিমার মা বললেন, আসার সময় দিদিকে বোলো, অধীরকে নিয়ে একবার যেন আসেন।

বনমালী চিঠি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বাবা জানতে চাইলেন, দিদি কি এখন মির্জাপুরে থাকেন?

দিদি মানে বিভূতিরঞ্জনের বড় বোন। বাবা জানতেন তিনি চট্টগ্রামে ছেলের কাছে থাকেন। প্রতিমার মা বললেন, অধীর করটিয়া কলেজে বদলি হয়ে এসেছে ছ মাস হলো। দুর্গা পুজার সময় দিদিকে নিয়ে ওরা সবাই বেড়াতে এসেছিলো। দিদি কালীপুজো পর্যন্ত ছিলেন।

বিভূতিরঞ্জনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো একেবারেই ভেঙে পড়েছেন তিনি। দু বছর আগে বাবরী মসজিদ ভাঙার পর যখন বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করা হলো–ভেবেছিলেন, বিষয় সম্পত্তি সব বিক্রি করে দেশান্তরি হবেন। তখন নূরউদ্দিন আর তার একাত্তরের বন্ধুরা বুঝিয়েছেন–এসব গুণ্ডা বদমাশ আর স্বাধীনতার শত্রুদের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এটা আমাদের দেশ। আমরা ভয় পেলে ওরা পেয়ে বসবে। দিদি তো চলে যাবেনই। জমি বিক্রি করতে গিয়ে বাঁধলো ঝামেলা। কেউ জমি কিনতে চায় না। এক লাখ টাকার জমি–বলে আট দশ হাজার হলে নিতে পারি। অধীরের শ্বশুর আরও ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। বলেছেন যেদিন জমি বিক্রির টাকা তোমাকে দেবে সেই রাতেই ওটা লুঠ হয়ে যাবে। জমি বিক্রির কথা মুখেও এনো না। অধীরের শ্বশুর তার পুরোনো বন্ধু। বন্ধুদের কথায় বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেননি, দেশও ছাড়তে পারেননি। ঠিক করেছিলেন জমানো টাকায় বাকি জীবন চলে যাবে। প্রতিমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একদিন প্রতিভাও বিয়ে করে চলে যাবে, হয়তো বা দেশ ছেড়ে। একা কিভাবে দিন কাটাবেন এসব নিয়ে যখন ভাবছিলেন তখন শুনলেন পুরোনো বন্ধু নূরউদ্দিন গ্রামে থাকবে পাকাপাকি ভাবে। তখনই আবার নতুন করে কাজ কর্ম শুরু করার কথা ভেবেছেন তিনি। স্কুল করার ইচ্ছে তারও ছিলো। খামার করার ব্যাপারটা তাঁর খুবই ভালো লেগেছিলো। সবে মাত্র খামারের বিক্রি শুরু হয়েছে, এসময় এমন হুমকি তাঁর মন ভেঙে দিয়েছে।

তানিয়ার বাবা বললেন, তোমাকে এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না বিভূতি। দরকার হলে ইকবালদের সবাইকে খবর দেবো। আমরা কি একাত্তরে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি! সব কি ভুলে গেছি?

বিড় বিড় করে বিভূতিরঞ্জন বললেন, তোমরাই আমার ভরসা।

প্রতিমার মা বললেন, নূরুদা, আপনাকে একটু চা দেবো?

শুধু আমাকে কেন, বিভূতিকেও দিন। চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে সকাল থেকে মুখে কিছু দেয়নি।

ঠিক ধরেছেন। আপনি এসেছেন, এবার যদি কিছু মুখে তোলে। এই বলে প্রতিমার মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

একটু পরে প্রতিমা, তানিয়া আর প্রতিভা এসে দাঁড়ালো দরজার পাশে। প্রতিমা বললো, বাবা, আমরা কি একটু ঘুরে আসবো? তানিয়া কখনও নদীতে মাছ ধরা দেখেনি।

বিভূতিরঞ্জন একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখেছো তো চিঠিতে কী লিখেছে। এখন আবার ঘুরতে যাবে–সাহস তো কম নয়!

তানিয়ার বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, বিভূতি, কোথাকার কোন গুণ্ডার উড়ো চিঠি পেয়ে তুমি মেয়েদের ঘরে আটকে রাখবে এটা তো কোনও কাজের কথা হলো না। মেয়েরা নিশ্চয় ঘুরতে যাবে। গুণ্ডারা যদি টের পায় ওদের চিঠি পেয়ে আমরা ঘাবড়ে গেছি তাহলে পেয়ে বসবে। গ্রামের লোকজন আছে না? আমাদের মেয়েদের গায়ে হাত তুলবে–এতই সোজা?

তানিয়ার বাবা কথাটা মিথ্যে বলেননি। গ্রামে দু এক ঘর বাদ দিলে প্রায় সবাই রায় বাবুকে সম্মান করে। আপদে বিপদে তিনি সবার পাশে দাঁড়ান। বিশেষ করে যখন স্কুল করার কথা জানাজানি হয়েছে, যেখানে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়তে ছেলেমেয়ে কারও পয়সা লাগবে না–শুনে সবাই দারুণ খুশি। তানিয়ার বাবাকে শুধু আপত্তির কথা জানিয়েছে ওর চাচা আজিমউদ্দিন।

তানিয়ার বাবার কথা শুনে প্রতিমার বাবা কোনও কথা বললেন না। তানিয়া জানতে চাইলো–কাকা আমরা যাবো?

যাও। মৃদু গলায় বললেন বিভূতিরঞ্জন। তবে বেশি দূরে যেও না।

বেশি দুরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ওদের গন্তব্য ছিলো পুরোনো মহল। বনমালী মির্জাপুর গেছে। প্রতিমারা হিসেব করে দেখেছে থানা আর পিসিমার বাড়ি ঘুরে আসতে

আসতে বিকেল হবে। সেই ফাঁকে পুরোনো মহল জরিপের কাজ সেরে ফেলা যাবে।

আগের দিনের মতো প্রতিভা গুপ্তি লাঠি সঙ্গে নিয়েছিলো। প্রতিমা নিয়েছে তিন ব্যাটারির লম্বা টর্চ। ওটা ঝোলা ব্যাগে লুকিয়ে নিতে হয়েছে। কেউ যদি বেলা এগারোটায় টর্চ হাতে ঘুরতে দেখে নির্ঘাত পাগল ভাববে।

পুরোনো মহলের ভূতের টিলায় ওঠার সময় প্রতিভা লক্ষ্য করলো আশে পাশে কেউ ওদের ওপর নজর রাখছে কি না। সন্দেহজনক কাউকে দেখা গেলো না। অনেক দূরে এদিকে পিঠ ফিরিয়ে মাঠে বসে ঘোষদের বাড়ির রতন গরু চরাচ্ছে। গাছের পাতায় মৃদু বাতাসের আনাগোনা ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। টুপ করে ওরা হারিয়ে গেলো পুরোনো টিলার ঝোঁপের আড়ালে। তানিয়াদের সঙ্গে দূরবীন ছিলো না। থাকলে দেখতে পেতো বংশী নদীর এ পারে বাঁধা ছইওয়ালা নৌকার ভেতরে বসে এক লোক চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ওদের দেখছে।

আগের দিন অন্ধকারের জন্য পুরোনো মহলের যে ঘরে ঢুকতে পারেনি প্রতিমার টর্চের আলোয় অন্ধকার কেটে গেলো। ভেতরে ভ্যাপসা গন্ধ। আস্তর খসে পড়া ইট বের করা দেয়ালে জালের মতো ছড়িয়ে আছে গাছের শেকড়। ওপরে কালো কালো কী যেন ঝুলছিলো। টর্চের আলো ফেলতেই কতগুলো বাদুড় ঝটপট ডানা মেলে ঘরের ভেতর উড়তে লাগলো। প্রতিমা সাংঘাতিক ভয় পেলো। ওর মনে হচ্ছিলো কালো বাদুড় উড়ে এসে ওর ঘাড়ে বসে রক্ত শুষে খাবে। প্রতিভা আর তানিয়াও কম ভয় পায়নি। এই নিস্তব্ধ জায়গায় যে জীবিত কোনও প্রাণের চিহ্ন থাকতে পারে ওরা আশা করেনি। প্রতিভা ওর গুপ্তি লাঠি তুলে শূন্যে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে লাগলো। কিছুক্ষণ ওড়াউড়ির পর বাদুড়গুলো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

ওরা তিন জন এক সঙ্গে হাঁপ ছাড়লো। প্রতিমা চাপা গলায় বললো, কী সাংঘাতিক বাদুড় একেকটা। আরেকটু হলে আমার প্রাণ পাখি বেরিয়ে যেতো।

বিপদমুক্ত হয়ে মাটিতে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠলো প্রতিমা–এ্যাঁ, এসব কী?

তানিয়া আর প্রতিভা তাকিয়ে দেখলো ঘরময় বহু দিনের জমে থাকা ধুলোর আস্তরণের ওপর মানুষের পায়ের ছাপ। জুতো পরা পা আর খালি পা দুটোই আছে। তানিয়া একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলো জুতোর ছাপ এক রকম নয়, দু রকম। ছাপগুলো পুরোনো নয়, মনে হয় একটু আগের। চাপা উত্তেজিত গলায় তানিয়া বললো, প্রতিমাদি, লক্ষ্য করেছো? মানুষের পায়ের ছাপ। অতৃপ্ত আত্মারা নিশ্চয় হরেক রকম জুতো পায়ে ঘোরে না। অন্ততপক্ষে তিন জন লোক এ ঘরে এসেছিলো আজ।

প্রতিমা জানতে চাইলো, আজই এসেছিলো–এটা তোর মনে হলো কেন?

সারা ঘরে খেয়াল করে দেখো, সব জায়গায় বাদুড়ের পায়খানা ছড়িয়ে রয়েছে। পায়ের ছাপে বাদুড়ের পায়খানা এখনও পড়েনি।

এ রাম! আঁতকে উঠলো প্রতিভা আমার ঘেন্না লাগছে দিদি। এক্ষুণি বাইরে চল।

ওরা বাইরে আসতেই পুব দিকের ঝোঁপগুলো অস্বাভাবিকভাবে নড়ে উঠলো। প্রতিমা ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠলো, এ্যাই, কে ওখানে! বেরিয়ে এসো।

প্রতিভা আর তানিয়া ছুটে গেলো সেদিকে। কাউকে দেখতে পেলো না। বাতাসে নিঃশ্বাস টেনে তানিয়া বললো, সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি।

প্রতিভা গম্ভীর গলায় বললো, নিশ্চয় কেউ আমাদের ওপর নজর রাখছে। শিগগির বাড়ি চল।