৫. প্রতিমাদের আরেক জগৎ

রত্নেশ্বরী গ্রামে পাকা দালান বলতে একটাই, সেটা হলো প্রতিমাদের। লোকে রায় বাড়ি বলে, পুরোনোরা বলে জমিদার বাড়ি। পুরোনো আমলের বনেদি চেহারার দোতালা বাড়ি, তবে আগেকার সেই জৌলুস আর নেই। বহু কাল বাইরে রং দেয়া হয়নি, কোথাও দেয়ালের আস্তর খসে লাল ইট বেরিয়ে গেছে, ফাঁকে ফাঁকে বট গাছের নধর চারাও উঁকি দিচ্ছে। দূর থেকে দেখলে গা ছম ছম করে। এ বাড়িতেই থাকে প্রতিমা, ওর বাবা, মা আর ছোট বোন প্রতিভা যখন ছুটি কাটাতে আসে।

তানিয়া লক্ষ্য করেছে বাড়ির বাইরে যতটা জীর্ণদশা, ভেতরটা তেমন নয়। সাদা চুনকাম করা দেয়াল, শ্বেত পাথরের মেঝে, বসার ঘরে ঝাড়বাতি, দামী মেহগনি কাঠের নকশা তোলা আসবাবপত্র, সব কিছুতেই জমিদারি ছাপ লেগে আছে।

দুপুরে খাওয়ার পর প্রতিমার ঘরে এক মানুষ সমান উঁচু বিশাল মেহগনি কাঠের পালঙ্কে শুয়ে ওরা দুজন কথা বলছিলো। পালঙ্কের গায়ে আঙুর লতার নকশার গায়ে হাত বুলিয়ে তানিয়া বললো, জীবনে প্রথম এ দামী খাট চোখে দেখলাম। অনেক বড় জমিদার ছিলে তোমরা?

প্রতিমার কাছে এ ধরনের কথা শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। তানিয়াকে বললো, সকাল থেকে তুই অনেক বার এ কথা বলেছিস। জমিদারদের সম্পর্কে তুই ভাবিস কী বলতো? এই যে দালান কোঠার বাহার দেখছিস প্রত্যেকটা ইটের গায়ে গরিব প্রজাদের ঘাম আর রক্ত মাখা। যে জমিদার যত অত্যাচারী আর যত পাজী ছিলো তাদের বাড়িঘরের বাহারও তত বেশি। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি আমাদের পূর্ব পুরুষরা ভীষণ অত্যাচারী ছিলেন। ঠাকুর্দার যিনি ঠাকুর্দা ছিলেন তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজারা তাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। তার এক ভাই মরেছে অপঘাতে। বংশী নদীর তীরে আমাদের পুরোনো পোড়ো বাড়িটা এখনও আছে। এ বাড়ি বানিয়েছেন ঠাকুরদার বাবা। এসব জমিদারি নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই তানিয়া, বরং জমিদারের বংশধর হওয়াটা লজ্জার কথা। এই লজ্জা ঢাকার জন্যেই বাবা স্কুলে মাস্টারি করেন।

প্রতিমার কথা শুনে তানিয়ার খুব ভালো লাগলো। বললো, সব বড়লোকের ছেলেমেয়েরা যদি তোমার মতো ভাবতে পারতো, তাহলে তো কথাই ছিলো না। আনন্দময়ী স্কুলে আমাদের ক্লাসে পড়তো শায়লা পারভীন। জমিদারের বংশ বলে অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না।

কয়েক ঘন্টার আলাপে তানিয়া আর প্রতিমা আপনি তুমি বলা থেকে তুমি আর তুই-এ নেমে এসেছে। বনেদি জমিদারের রূপসী নিরহংকারী মেয়েটিকে তানিয়ার যেমন ভালো লেগেছে, তেমনি প্রতিমারও ভালো লেগেছে স্কুল মাস্টারের মা হারা সরল ও আত্মমর্যাদা সচেতন মেয়েটিকে।

প্রতিমা বললো, তোর কি ঘুম পাচ্ছে তানিয়া?

মোটেও না। দিনে আমি কখনও ঘুমোই না। তুমি কি ঘুমোব?

না রে! তোর সঙ্গে গল্প করতে ভালোই লাগছে। সারা গ্রামে কথা বলার কেউ নেই। মাসে দু মাসে দেলদুয়ারের মাসিরা বেড়াতে এলে যা একটু সময় কাটে।

তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত তবু ইলেকট্রিক লাইন এসেছে। টেলিভিশনটা অন্তত দেখতে পারো। আমাদের বাড়িতে যে কবে ইলেকট্রিসিটি যাবে কে জানে!

চেয়ারম্যান চেষ্টা করছে নিজের বাড়িতে নিতে। তখন আপনা থেকেই তোরা লাইন পেয়ে যাবি।

ইলেকট্রিকের আলো না থাকলে অন্ধকার যে এত ঘন আর কালো হতে পারে ভাবতেই পারতাম না।

শহরে যখন ইলেকট্রিসিটি চলে যায় তখন অন্ধকার কি সাদা আর পাতলা থাকে?

প্রতিমার কথা বলার ধরন দেখে তানিয়া হেসে ফেললো–হ্যাঁগো প্রতিমাদি, শহরের অন্ধকার কখনও এত ঘন হয় না। শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেও রাস্তায় গাড়ি চলে। গাড়ির আলো আছে, প্রায় বাড়িতে চার্জার আছে। অন্ধকার জমাট বাঁধার সুযোগ পায় না।

ভালো বলেছিস তো তানিয়া। আমি কখনও তোর মতো ভাবিনি। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত পড়েছিস?

হ্যাঁ পড়েছি। কেন বলতো?

টেনের বইতে শ্রীকান্তের একটা অংশ পড়ায়। এসএসসিতে প্রশ্ন আসে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত অবলম্বনে আঁধারের রূপ বর্ণনা কর। মনে হয় তুই ভালোই লিখতে পারবি।

কাল রাতে বিছানায় শুয়ে শহর আর গ্রামের অন্ধকারের পার্থক্য নিয়ে ভেবেছিলো তানিয়া। হঠাৎ মনে পড়াতে বললো, কাল রাত্রে আমার কালো ছায়ামূর্তি দেখার কথা শুনে কাকাবাবু সকালে এমন কথা কেন বললেন প্রতিমাদি?

কোন কথা?

তোমরা নাকি সারা বছর এসব দেখো?

গ্রামে এসব দেখা অস্বাভাবিক নয়। ঘরে ঘরে এমন কথা শোনা যায়।

কী দেখা যায় খুলেই বলো না!

তানিয়াকে সব কথা বলা যায় কিনা কিছুক্ষণ ভাবলো প্রতিমা। কথা শুনে মনে হয় তানিয়া খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে, সাহসীও বটে। ওর বয়সী কোনও মেয়ে পথের পাঁচালী আর অপরাজিত পড়ে মুগ্ধ হয়েছে–এরকম কদাচিৎ দেখা যায়। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিমা বললো, শোন তাহলে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে খুব অত্যাচারী জমিদার ছিলেন তোকে তো বলেছি। ইংরেজদের দালালী করে সেই আমলে ওঁরা বিস্তর টাকা জমিয়েছিলেন। আমাদের আগের বাড়িতে কয়েদখানা ছিলো, গুমঘর ছিলো। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি প্রজারা খাজনা দিতে না পারলে কয়েদখানায় আটক করে চাবকানো হতো। কাটা জায়গায় নুন ছিটিয়ে মজা দেখতো। শাস্তির মাত্রা বেশি হলে, যদি কেউ জমিদারের হুকুম অমান্য করতো তাকে গুম ঘরে ফেলে দিতো। গুমঘরের কোন জানালা ছিলো না। একটাই দরজা ছিলো ছাদের কাছে। সেই দরজার কাছে কেউ পৌঁছতে পারতো না। পারলেই বা কী! লোহা দিয়ে বানানো ছিলো সেই দরজা। বেচারা প্রজারা, বেশির ভাগ ভয়ে হার্টফেল করে মরতো, নাহলে মরতো না খেয়ে। লাশ সেখানেই পড়ে থাকতো। দরজা খুললে ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ বেরুততা। নিচে দেখা যেতো কঙ্কাল আর কঙ্কাল, এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে। কে যেন দেখেছে গুমঘরে অনেক ইঁদুর ছিলো, একেকটা বেড়ালের মতো বড়।

প্রতিমার কথা শুনতে শুনতে তানিয়া যে কখন শোয়া থেকে উঠে বসেছে নিজেও টের পায়নি। একটু থেমে প্রতিমা বললো, তোরা বিশ্বাস করিস কিনা জানি না। মারা যাওয়ার পর মানুষের যদি সকার না হয় তাহলে তাদের আত্মা মুক্তি পায় না। আমরা যেমন কাশীতে গিয়ে আত্মার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দান করি–তবেই আত্মা মুক্তি পায়। নইলে এসব আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। মুক্তির জন্য সারাক্ষণ ছটফট করে। জীবিত মানুষের ওপর ওদের ভীষণ রাগ। গুমঘরে যারা মরেছে তাদের কারোই সদগতি হয়নি। আমাদের পুরোনো মহলের চারপাশে বহু কাল ধরে এসব আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠাকুরদার এক ঠাকুরদা যে অপঘাতে মরেছেন তোকে বলেছি?

হ্যাঁ বলেছে। কী ধরনের অপঘাত?

সুস্থ সবল মানুষ সন্ধ্যেবেলা বেরিয়েছিলেন ঘোড়ায় চেপে। সারা রাত ফেরেননি। সকালে বংশী নদীর তীরে দেখা গেলো লাস পড়ে আছে ধলা কর্তার। অসম্ভব ফর্শা ছিলেন বলে সবাই তাকে ধলা কর্তা ডাকতো। খুবই অত্যাচারী ছিলেন। গ্রামের বউ ঝিরা তাঁর অত্যাচারে বাড়ি থেকে বেরুতে পারতো না। তার লাশের গায়ে আঘাতের কোনও চিহ্ন ছিলো না। চেহারাটা শুধু নীল হয়ে গিয়েছিলো। চোখ দেখে মনে হয়েছিলো মরার আগে ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। তার ঘোড়াটাও পাশে মরে পড়েছিলো। পুরোনো মহলের আশে পাশে হঠাৎ হঠাৎ কালো কালো ছায়ার মতো মানুষ ঘুরে বেড়াতে আমাদের অনেকেই দেখেছে। অল্প কিছুক্ষণের জন্য দেখা যায়। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

তোমাদের এ বাড়িতে গুমঘর নেই?

না। বংশের দুজন পর পর অপঘাতে মারা যাওয়াতে ঠাকুরদার বাবা শুধু পুরোনো মহলই ছাড়েননি, প্রজাদের ওপর অত্যাচার করাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে অত্যাচার না করলে জমিদারিও রাখা যায় না। ঠাকুরদার আমলেও প্রজাদের ধরে এনে মারধোর করা হতো, জমিজমা কেড়ে নিয়ে পথের ভিখিরি বানিয়ে দিতো। এসব কথা ঠাকুরমার কাছে শুনেছি। ঠাকুরমা ছিলেন গরিব পণ্ডিত বংশের মেয়ে। এসব জমিদারি অনাচার দুচোখে দেখতে পারতেন না। তবে এ বাড়িতে মানুষ খুন করার ঘটনা যে কখনও ঘটেনি এমন কথাও বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িটা পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্যাম্প ছিলো। বাবা তো চলে গেলেন নূরু কাকুদের সঙ্গে যুদ্ধে। ঠাকুরদা আর ঠাকুরমারা ছিলেন কলকাতায়। যুদ্ধের পর ফিরে এসে গ্রামের লোকদের কাছে শুনেছেন কাঁচারিবাড়ির সামনে অনেক মানুষকে মেরে এক সঙ্গে মাটিতে পুঁতে রেখেছে। ঠাকুরদা লোকজন লাগিয়ে খুঁড়ে অনেক লাশ পেয়েছিলেন। লাশের যা অবস্থা দেখে বোঝার উপায় ছিলো না কে হিন্দু আর কে মুসলমান। সব লাশ তুলে বংশী নদীর তীরে আলাদা করে কবর দেয়া হয়েছে। ওদের জন্য হিন্দু মতেও পিণ্ডদান করা হয়েছে।

বলতে গিয়ে প্রতিমার গলা ভারি হয়ে গেলো। তানিয়া কিছুক্ষণ পর বললো, তুমি যে বললে পাকিস্তানী সৈন্যরা যাদের মেরেছিলো তাদের তোমার ঠাকুরদা সত্ত্বার করেছিলেন। সংস্কার না করলে কি তাদের আত্মা মুক্তি পেতো না?

পেতো। দেশের জন্য যারা জীবন দেয় তাদের আত্মা মৃত্যুর পর পরই স্বর্গবাসী হয়। ঠাকুরদা সত্ত্বারের ব্যাপারে মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনিও নাকি ঠাকুরদাকে বলেছিলেন, তিনি চাইলে মসজিদে মিলাদ পড়াতে পারেন, তবে শহীদদের জন্য বেহেশতের সেরা জায়গা রাখা আছে। কবর দেয়ার পর ইমাম সাহেব সবার জন্য দোয়া করেছেন।

কথা বলতে বলতে কখন যে বিকেল হয়ে গেছে ওরা টের পায়নি। বাড়ির পুরোনো ঝি মোক্ষদাদি এসে বললো, কর্তামা ডাকতাছে নিচে। চা দেওয়া ওইছে।

তানিয়াকে নিয়ে প্রতিমা নিচের খাবার ঘরে এসে দেখলো সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিভূতি কাকা তানিয়াকে বললেন, চেহারা দেখে তো মনে হয় এক ফোঁটা ঘুম হয়নি।

কাকিমা মৃদু হেসে বললেন, তোমরা বড়রা সারাক্ষণ গল্প করে কাটালে। ছোটরা কোন দুঃখে ঘুমোবে!

টেবিলে খাবারের বহর দেখে আঁতকে উঠলো তানিয়া। দুপুরে খাওয়ার সময় এগারো পদ রান্না নিয়ে অনেক রসিকতা হয়েছে। চার ঘন্টা না যেতেই লুচি, আলুর দম, সুজির মোহনভোগ আর সন্দেশ খেতে হবে–এ কী রাক্ষুসে কারবার! তানিয়ার চেহারা দেখে কাকিমা নরম গলায় বললেন, তোমার যা ইচ্ছে করে তাই খাও। সন্দেশটা আমি নিজ হাতে বানিয়েছি।

তানিয়া করুণ গলায় বললো, আমি শুধু এক টুকরো সন্দেশ খাবো।

তাই খাও মা। বলে কাকিমা ওর প্লেটে দুটো সন্দেশ তুলে দিলেন।

তানিয়ার প্রথমে মনে হয়েছিলো একটার বেশি খেতে পারবে না। চামচে কেটে একটুখানি মুখে দিয়ে দেখলো এত ভালো সন্দেশ জীবনে খায়নি। কথাটা বলতে গিয়ে চেপে গেলো। দুপুরের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে ভালো বললেই কাকিমা আরও দুটো সন্দেশ ওর প্লেটে তুলে দেবেন। খেতে খেতে মনে হলো আনন্দময়ী স্কুলে পড়ার সময় বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে ক্ষিদেয় চোখে কী অন্ধকার দেখতো!

চা খাওয়ার পর বিভূতি কাকা বললেন, নূরউদ্দিন, চলো নদীর ধারে একটু হাঁটি।

প্রতিমা বললো, আমরাও একটু ঘুরতে যাবো বাবা।

যেতে পারো। বিভূতি কাকা মৃদু হাসলেন, সঙ্গে বনমালীকে নিতে ভুলে যেও না।

আমি ভুললেও বনমালী ভুলবে না। এই বলে তানিয়ার হাত ধরে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো প্রতিমা।

বনমালী নিঃশব্দে ওদের অনুসরণ করলো। ওর হাতে পাকা বাঁশের লাঠি। পেটানো শরীর। বছর তিনেকের ওপর রায়বাড়ির পাহারাদারের চাকরি নিয়েছে। খুবই বিশ্বস্ত আর সাহসী পেয়াদা।

তানিয়া এ বাড়িতে ঢুকেই লক্ষ্য করেছে বাইরে যে রকম জীর্ণ দশা বাড়ির ভেতরটা তেমন নয়। সবুজ ঘাসে ঢাকা আঙিনায় হাঁটতে হাঁটতে ও বললো, প্রতিমাদি, বাড়ির বাইরের চেহারাটা এরকম রেখেছো কেন? রঙ করলে রাজপ্রাসাদের মতো লাগবে।

কী হবে করে!

বাড়িটা মজবুত হবে। দেখতেও সুন্দর হবে।

আর সুন্দর! দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিমা বললো, দু বছর আগে ইণ্ডিয়ার বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এখানে হিন্দুদের ওপর কী অত্যাচার হয়েছে কাগজে পড়িস নি?

শুনেছি। কিন্তু তোমাদের তো এ গ্রামের সবাই ভালো বলে জানে!

যাদের ওপর অত্যাচার করছে তারা কি খারাপ ছিলো? আমাদের বাড়িও লুট করতে এসেছিলো পাশের গায়ের লোকেরা। রত্নেশ্বরীর মন্দিরেও আগুন দিতে গিয়েছিলো। এ গাঁয়ের লোকজন বাধা দেয়াতে পারেনি। বাবা অবশ্য আগে থেকে পুলিশ এনে রেখেছিলেন বাড়িতে। নইলে মন্দির আর বাড়ির ইট কাঠ সব খুলে নিয়ে যেতো। রত্নেশ্বরীর মন্দিরে বিগ্রহের অনেক অলঙ্কার আগেই চুরি হয়েছে। সেবারও গুণ্ডাদের লক্ষ্য ছিলো দেবীর গলার নবরতের হার।

অনেক দামী হার?

এখন লাখ চারেকের মতো দাম হবে।

সব সময় দেবীর গলায় থাকে?

না, বিশেষ বিশেষ দিনে ওটা লোহার সিন্দুক থেকে বের করা হয়। রাতে ছ জন লোক মন্দির পাহারা দেয়।

গ্রামের লোকরা যদি গুণ্ডাদের বাধা দেয় তাহলে তো এদের ভালো বলতে হবে।

ভালো বটে, তবে সবাই নয়। এ গাঁয়ের অনেকে পাশের গায়ে গেছে লুট করতে। পাশের গাঁয়ে দুটো মন্দির ছিলো। একটাও আস্ত নেই। দু তিন বছর পর পর যদি এরকম হামলা হয়, বাড়িঘর মেরামত করে লাভ কী বল?

তানিয়া গম্ভীর গলায় বললো, শুনেছি বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ইণ্ডিয়াতে অনেক মুসলমানকে মেরেছে।

ম্লান হেসে প্রতিমা বললো, আমরা কি ইণ্ডিয়া গিয়ে সেখানকার মুসলমানদের মেরেছি? নাকি আমরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছি? যারা ভেঙেছে তাদের কিছু করতে পারবে না, মিছেমিছি এখানকার অসহায় হিন্দুদের ওপর চোটপাট করবে।

এসব ধর্ম টর্ম না থাকলে মানুষ অনেক ভালো থাকতো প্রতিমাদি।

কিছুটা হয়তো থাকতো। তবে জমিদার প্রজা কিংবা কারখানার মালিক শ্রমিক নিশ্চয় থাকতো। সাদা চামড়ার মানুষ আর কালো মানুষদের বিরোধ থাকতো। আরও অনেক বিরোধ থাকতো। থাকতোই বা বলছি কেন? এসব তো এখনও আছে। একটু থেমে প্রতিমা বললো, মানুষ আসলে খুব নিষ্ঠুর প্রাণী। অন্য কোনও প্রাণী মানুষের মতো নিষ্ঠুর নয়।

প্রতিমা যে বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো, নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে ওর বাবা একই বিষয়ে নিয়ে তানিয়ার বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সব শুনে তানিয়ার বাবা বললেন, বিভূতি, তুমি হতাশ হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ আমরা স্বাধীন করেছি কটা জামাতী আর মৌলবাদী গুণ্ডার ভয়ে কুঁকড়ে থাকার জন্য? আমরা সবাই জোট বেঁধে দাঁড়ালে ওরা পালাবার পথ খুঁজে পাবে না।

তুমি জানো না নূরউদ্দিন, ওরা কতটা নৃংশস! গত চার পাঁচ বছরে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার কী পরিমাণ বেড়েছে শুনলে চমকে উঠবে। তোমাকে কি বলেছি সরকার আমাদের বাড়িটাকে অর্পিত সম্পত্তি বলে নিয়ে নিতে চাইছে?

অর্পিত সম্পত্তি মানে?

পাকিস্তান আমলে যেটাকে শত্রু সম্পত্তি বলা হতো এখন বলা হয় অর্পিত সম্পত্তি। কোন হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেলে তার সম্পত্তির মালিক হবে সরকার।

তোমরা তো যাওনি। যাবেও না। তোমাদের বাড়ি কেন সরকার নিতে যাবে?

সরকারের কথা হচ্ছে চোষট্টির দাঙ্গার পর যে সব হিন্দু ইণ্ডিয়া চলে গেছে তাদের কিংবা আরও আগে যারা দেশ ছেড়েছে তাদের সম্পত্তির মালিক সরকার। আমাদের ছোটকা পাকিস্তান হওয়ার পাঁচ বছর পর তাঁর এ বাড়ির অংশ আমাদের কাছে বিক্রি করে চলে গেছেন। এটা সরকারী লোকদের বোঝানো যায় না। আজকাল এমন দাঁড়িয়েছে, কোনও বাড়ির মালিক হিন্দু হলেই সেটা অর্পিত সম্পত্তি বলে ঘোষণা করে দিচ্ছে। এ নিয়ে যে কী হয়রানি হতে হচ্ছে ভাবতেও পারবে না। এ ছাড়া গুণ্ডা বদমাশদের হুমকি তো আছেই।

বহুদিন পর জানুয়ারির হিমেল বাতাসে কুয়াশা ঢাকা বংশী নদীর তীরে হাঁটতে ভালোই লাগছিলো তানিয়ার বাবার। ছোটবেলার অনেক কথা মনে পড়ছিলো। কতদিন স্কুল ছুটির পর বিভূতির সঙ্গে ওদের পুরোনো মহলে গিয়েছেন গুপ্তধন খোঁজার জন্য, সেসব কথা ভাবতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন ছোটবেলার দিনগুলোতে। ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু বিভূতি, যার সঙ্গে একাত্তরের নয় মাস এক তাঁবুর নিচে শুয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন তার এমন বিপদ শুনে তানিয়ার বাবার বুকটা ব্যথায় ভরে গেলো। বন্ধুর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন, বিভূতি, এখন আর তুমি একা নও। আমি আছি তোমার পাশে। আশে পাশের দশ গাঁয়ের মুক্তিযোদ্ধারা একজোট হয়ে আবার লড়বো এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

জানি নূরউদ্দিন। আমার কোনও বিপদ হলে তুমি পাশে থাকবে। আজকাল শুধু গুণ্ডা বদমাশ নয়, অশরীরী আত্মারাও আমাদের পেছনে লেগেছে।

তুমি এসব বিশ্বাস কর বিভূতি?

না করে উপায় কী! ভালো করেই জানো আমাদের পূর্বপুরুষরা কী রকম অত্যাচারী ছিলো। গুমঘরে ফেলে যাদের মেরেছে তাদের অভিশাপ এখনও কাটেনি।

আমি বলছি বিভূতি, হয় তোমাদের চোখের ভুল, নয়তো কোনও খারাপ লোক তোমাদের ভয় দেখাবার জন্য এসব করছে।

তুমি তো গ্রামে থাকবে বলে এসেছে। নিজের চোখেই দেখো। কাল রাতে তানিয়া যে ওদের দেখেছে এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

খারাপ লোক ভয় দেখাবার জন্য করতে পারে।

তোমাকে কেন ভয় দেখাবে?

আমার ভাইটিকে ভালো করেই চেনো। ওরা চায় না আমি গ্রামে থাকি।

হ্যাঁ শুনেছি, ও নাকি এখন জামাত করে।

রত্নেশ্বরীর আকাশে অন্ধকারের কালো ছায়া ঘনিয়ে এলো। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানিয়ার বাবা বললেন, বিভূতি, চলো ফিরে যাই।