১০. পুলিশের তৎপরতা

মির্জাপুর থেকে বনমালী ফিরলো বিকেল নাগাদ। থানার ওসি বলেছেন ওদের আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। বনমালীর সঙ্গে প্রতিমাদের পিসিমাও এসেছেন। তানিয়া দোতালার ঝুল বারান্দার ওপর থেকে সাদা থান পরা, পানের বাটা হাতে পিসিমাকে পালকি থেকে নামতে দেখলো। দূর থেকে পালকি দেখেই প্রতিমা নির্ঘাত পিসিমা, বলেই নিচে নেমে গেছে।

তানিয়াকে সঙ্গ দেয়ার জন্য প্রতিভা নিচে নামেনি। ওদের পিসেমশাই মারা যাওয়ার পর পিসিমা একটু বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দু বেলা স্নান করেন, খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সব কিছুতে বাছবিচার আর ছোঁয়াছুয়ি মেনে চলেন। তানিয়াকে ওদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে দেখলে পিসিমা কী ভাববেন এ নিয়ে প্রতিমা আর প্রতিভা দুজনই চিন্তিত ছিলো।

পিসিমা যখন এলেন তখন প্রতিমা আর তানিয়ার বাবার পাশের গ্রামে গেছেন পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে। যাওয়ার আগে বাড়ির ছাদে বন্দুক হাতে দু জন পেয়াদা পাহারা বসিয়ে দিয়ে গেছেন। মার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পিসিমা ওপরে উঠে এলেন। অধীর কলেজের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত বলে আসতে পারেনি। প্রতিভা গিয়ে পিসিমাকে প্রণাম করলো। তানিয়াকে দেখে পিসিমা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, এইটা ক্যাঠা?

পিসিমার বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়। কথা বলেন পুরো ঢাকাইয়া টানে। প্রতিমা বললো, নূরু কাকার মেয়ে তানিয়া!

প্রতিমার মা মৃদু গলায় বললেন, নূরু ঠাকুরপো গ্রামে থাকাতে আপনার ভাই কিছু ভরসা পেয়েছে দিদি, নইলে যে কী হতো ভেবে মরি!

নুরু কি গ্যারামে থাকবার আইচে?

হ্যাঁ দিদি। বউটা মরে গেলো। চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন।

পিসিমাকে বসার জন্য চেয়ার এনে দিয়েছিলো মোক্ষদাদি। চেয়ারে বসে হাতের রূপোর বাটা থেকে এক খিলি পান মুখে ফেলে পিসিমা আদর করে তানিয়াকে কাছে ডাকলেন, অই ছেমরি, দূরে খাড়ায়া রইচস ক্যা? আমার বগলে আয়। দ্যাখতে তো পুরা মায়ের মতন ওইচস!

তানিয়া কাছে যেতেই পিসিমা ওর চিবুক নেড়ে আদর করে বললেন, তর বাপে আমারে দিদি কয়। তুই কী কবি?

তানিয়া মৃদু গলায় বললো, পিসিমা বলবো।

পিসিমাও কইবার পারস, ফুপুও কইবার পারস। পিসিমার কথা শুনে প্রতিমা আর প্রতিভা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।

মোক্ষদাদি জিজ্ঞেস করলো, পিসিমা, আপনেরে লেম্বু দিয়া শরবত বানায়া দি?

জিগাইতাচস ক্যালা? জলদি আন। রইদের মইদ্দে আইতে গিয়া আমার চান্দি জ্বলতাচে। চেয়ারের পাশে রাখা পিকদানিতে পানের পিক ফেলে পিসিমা প্রতিমার মাকে বললেন–বনমালী কইলো শনির চিঠি পায়া বিভূতি বহুৎ পেরেশান ওইচে। চিঠিখান আমারে দ্যাখাও তো!

চিঠি নিয়ে ওঁরা বেরিয়েছেন, পাশের গ্রামের ইকবাল ঠাকুরপোর সঙ্গেও নাকি পরামর্শ করবেন।

বনমালীর কাছে হুনলাম, ইকবাইলারে লইয়া বিভূতি ছেমরিগো ইশকুল খুলতাচে?

হ্যাঁ দিদি। নূরু ঠাকুরপোও তো আছে।

বাপ ঠাকুদ্দায় ট্যাকা পয়সা যেগিনি রাইখা গেছিল এমতি উড়াইবো?

প্রতিমা বললো, পিসিমা, তুমি বোধহয় জানো না, ঠাকুরদারও ইচ্ছে ছিলো গ্রামে স্কুল করার।

কয় কি ছেমরি! আমার বাপেরে আমি জানুম না–তুই জানবি? বিভূতি পুরা বাবার খাসলত পাইচে।

মোক্ষদা শরবত আনার পর পিসিমা মুখের পান ফেলে শরবত খেয়ে সুস্থির হয়ে প্রতিমার মাকে বললেন, বউ কতা হুন। পুরানা পাইক বরকন্দাজ যেগিনি আছিলো হেগুলায় কী করতাছে?

পাইক বরকন্দাজ মানে বনমালীকে নিয়ে পাঁচজন। ছাদে আর সিং দরজায় পাহারা বসিয়েছি।

পুজার সুম দেখচি। ওই ভাতে মরাগো দিয়া কিচু ওইবো না। নূরু আর ইকবাইলাগো কও আইয়া কয় রাইত থাকতে–গ্যাছে বার রায়টের সুম যেমতে আছিলো।

নূরু ঠাকুরপোকে বলতে পারি। ইকবাল ঠাকুরপোকে বলি কিভাবে? তার এত বড় সংসার। তাছাড়া এটা তো রায়ট নয় দিদি?

রায়ট না–লাগতে কখন? তুই কইবার না পারলে আমি কমু। নাইলে ইসকুল মিসকুল কিছু করবার দিমু না। রায় শুনিয়ে পিসিমা নিজের ঘরে গেলেন। প্রতিমারা জানে রায়দের বিষয় সম্পত্তিতে ওদের বাবা আর পিসিমার সমান ভাগ। ঠাকুরদা মারা যাবার আগে সেভাবেই উইল করে গেছেন।

.

সন্ধ্যে নাগাদ তানিয়ার বাবা আর প্রতিমার বাবা বাড়ি ফিরলেন। একটু পরই চারজন সাদা পোশাকের পুলিস সঙ্গে নিয়ে থানার এক অফিসার এলো। সবাই তখন নিচের তলার বৈঠকখানায় বসে চা খাচ্ছিলো। পুলিসদের ঝুল বারান্দার নিচে দাঁড় করিয়ে জিনস পরা তরুণ অফিসার ঘরে ঢুকলো। পকেট থেকে কার্ড বের করে দেখিয়ে বললো, আমি সাব ইন্সপেক্টর সাদেক হোসেন। আপনাদের অভিযোগের তদন্ত করতে এসেছি।

তানিয়ার বাবা ওকে বসতে বললেন। প্রতিমার বাবা গম্ভীর হয়ে মেয়েদের বললেন, তোমরা ওপরে যাও।

তানিয়াদের চা খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। ওরা জানতে আগ্রহী ছিলো ইন্সপেক্টর কিভাবে তদন্ত করেন। অনিচ্ছার সঙ্গে ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তানিয়া দোতালার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলো। প্রতিভা ওর কার্ডিগানের ঝুল টেনে চাপা গলায় বললো, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? অফিসার কী করে দেখতে হবে না!

তানিয়া প্রশ্নভরা চোখে প্রতিভার দিকে তাকালো। প্রতিমাও ওর দিকে ঘাড় ফেরালো। প্রতিভা ফিস ফিস করে বললো, খাবার ঘরের দরজার খড়খড়ি খোলা আছে। ও ঘরের লাইট নিভিয়ে দিলে বসার ঘর থেকে কেউ আমাদের ওখানে দেখতে পাবে না।

তানিয়া কোনও কথা না বলে প্রতিভাকে অনুসরণ করলো। মোক্ষদাদি যাচ্ছিলো সাব ইন্সপেক্টর সাদেক হোসেনের জন্য চা আনতে। প্রতিমা চাপা গলায় ওকে বললো, আমরা খাবার ঘরে আছি। ঘরের বাতি নেভানো থাকবে। খেয়াল রেখো, কেউ যেন এদিকে না আসে।

প্রতিমাদের বাড়ির বাইরের দরজাগুলো পুরু সেগুন কাঠের। ভেতরের দরজাগুলো খড়খড়ি ওয়ালা, পুরোনো দিনের বাড়িতে যেমন থাকে। তানিয়া ওদের আনন্দময়ী স্কুলের জানালা দেখেছে এরকম খড়খড়ি ওয়ালা। জানালা বন্ধ থাকলেও শাটার্স খুলে বাইরে দেখা যায়।

ওরা যখন বসার ঘর আর খাবার ঘরের মাঝখানের দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো সাদেক হোসেন তখন নিবিষ্ট মনে শনির চিঠি পড়ছিলো। তানিয়ারা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য করলো–চিঠি পড়তে পড়তে সাদেকের কপালে ভাঁজ পড়েছে। অফিসারের বয়স খুব বেশি হলে চব্বিশ পঁচিশ হবে। গায়ের রঙ তামাটে, ধারালো বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ওদের মনে হলো সাদেক যদি শনিদের গ্রেফতার না করা পর্যন্ত এখানে থাকতো তাহলে খুব ভালো হতো। অন্ততঃ ওরা দরকার মতো সাহায্য করতে পারতো।

চিঠি পড়া শেষ করে সাদেক প্রশ্ন করলো, এ চিঠি কে লিখেছে কিছু অনুমান করতে পারেন?

তানিয়ার বাবা বললেন, চিঠির ভাষা দেখে তো মন হয় এটা জামাতীদের কাজ।

আপনাদের গ্রামে জামাতের কোনও লোক আছে?

আমার বাড়িতেই আছে! তিক্ত গলায় বাবা বললেন, আমার ভাই আজিমউদ্দিনের কথাবার্তা শুনে ওকে জামাতী বলেই মনে হয়।

আরও পরিস্কার করে বলুন।

শনির চিঠিতে এটা তো স্পষ্ট হয়ে গেছে, গ্রামে মেয়েদের স্কুল করাটা ওরা পছন্দ করছে না। যুক্তি হচ্ছে মেয়েরা বেপর্দা বেহায়া হয়ে যাবে, কাজটা হচ্ছে কুফরি। আমাকে ওরা বলছে মুরতাদ। এ সবই জামাতীদের ভাষা। আজিমউদ্দিনও আমাকে বলেছে মেয়েদের স্কুল করা ঠিক হবে না। মেয়েরা বেপর্দা বেহায়া হয়ে যাবে।

সাদেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো–আজিমউদ্দিন ছাড়া এ গ্রামে জামাতের আরও কোনও লোক আছে?

মসজিদের ইমামের কথাবার্তাও ওর মতো। মাস তিনেক আগে ইমামটা ফতোয়া দিয়ে গ্রামের এক মেয়েকে একশটা জুতোর বাড়ি মেরেছে।

কেন?

মেয়েটার স্বামী মারা গেছে। মার সঙ্গে থাকে। ছোট ছোট ভাই বোন রয়েছে পাঁচটা। কাজ করে পাশের গ্রামে প্রশিকার স্কুলে। পুরুষদের সঙ্গে কেন কাজ করে এই নিয়ে ইমামের রাগ।

বিভূতিরঞ্জন বললেন, আমি শুনেছি ইমাম নাকি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। মেয়েটা রাজী না হওয়ায় এরকম ফতোয়া দিয়েছে।

তানিয়ার বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, জামাতীরা রাজনীতির ব্যাপারে সুবিধে করতে না পেরে এখন ফতোয়াবাজি করে বেড়াচ্ছে। আমি অবশ্য ইমামকে বলে দিয়েছি, আবার যদি শুনি ও কোনও ফতোয়া দিয়েছে–ধরে পুলিসে দেবো। তারপর থেকে ইমাম আমাকে আড়ালে মুরতাদ বলে।

সাদেক চিন্তিত গলায় বললো, বোঝা যাচ্ছে সাধারণ অপরাধী নয়। এদের পেছনে রাজনৈতিক দল রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে জামাতে ইসলামী এ ধরনের কাজ করবে কেন? তাদের কি টাকার অভাব আছে?

তাদের রাজনৈতিক মতলব হচ্ছে গ্রামে মেয়েদের স্কুল হওয়া বন্ধ করা। এরকম চিঠি পেলে বিভূতি যদি ভয়ে সব কিছু বিক্রি করে ইণ্ডিয়া চলে যায়–তাতেও ওদের লাভ।

আমি বলতে চাইছি অন্য কোনও দল জামাতের ভাষা ব্যবহার করে এসব করছে না তো?

আপনি বোধহয় জানেন না সাদেক সাহেব, একাত্তরে ওদের আলবদররা কাউকে ভয় দেখাবার জন্য শনি নাম দিয়ে চিঠি লিখতো। এটা ওদের পুরোনো কৌশল।

বিভূতিরঞ্জন বললেন, ওরা কোনও দল করে কিনা সেটা তো ওদের ধরলেই জানা যাবে। মাত্র দুদিন সময় দিয়েছে। এর মধ্যে ধরা কি সম্ভব হবে?

সম্ভব হতে পারে যদি ওরা আমাদের টোপ গেলে।

কিভাবে?

ওদের বোঝাতে হবে আপনারা ভয় পেয়েছেন, পুলিসে খবর দেননি। কাল টাকা জোগাড় করে বাড়িতে এনে রাখুন। পরের চিঠিতে ওরা নিশ্চয় জানাবে টাকাটা কোথায় কিভাবে দিতে হবে। আমাদের সাদা পোশাকের পুলিশ সারাক্ষণ পাহারা দেবে। ওদের চোখ এড়িয়ে টাকা নিয়ে কেউ পালাতে পারবে না।

তাহলে তো এ দুদিন আপনাকেও এখানে থাকতে হবে।

হ্যাঁ, ওসি সাহেবের সেরকমই নির্দেশ। বলেছেন ডাকাতদের গ্রেফতার করে একবারেই যেন ফিরি।

বিভূতিরঞ্জন বললেন, আপনার কথায় ভরসা পাচ্ছি সাদেক সাহেব।

সাদেক হোসেন মৃদু হেসে বললেন, আমাকে আপনারা তুমি বললেই খুশি হবো। আপনারা এই এলাকার নাম করা মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে আমার জন্মও হয়নি। আপনাদের জন্য কিছু করতে পারলে আমি গর্বিত হবো।

সাদেকের কথা শুনে পাশের ঘরের মেয়েরা রীতিমতো রোমাঞ্চিত হলো। প্রতিভা ফিশ ফিশ করে বললো, অফিসারটা খুব ভালো না রে দিদি! ইচ্ছে করছে ওর এ্যাসিস্টেন্ট হয়ে যাই। তোর ইচ্ছে করছে না তানিয়া?

তানিয়া মৃদু হাসলো–শোন কী বলছে!

আমি বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। ভারিক্কি গলায় বললো সাব ইন্সপেক্টর সাদেক হোসেন। চিঠিটা প্রথম কে পেয়েছিলো?

আমাদের মোক্ষদা। দাঁড়াও, ডাকছি ওকে। এই বলে বিভূতিরঞ্জন গলা তুলে ডাকলেন– বনমালী!

বনমালী ধারে কাছেই ছিলো। এক ডাকেই দরজা দিয়ে মাথা গলালো–আইজ্ঞা কর্তা!

মোক্ষদাকে একটু পাঠিয়ে দাও।

দরজার ফাঁক থেকে বনমালীর মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। একটু পরে লম্বা ঘোমটা। মাথায় মোক্ষদা এসে সাদেকের সামনে দাঁড়ালো। ব্র চেহারা কিংবা কাপড় চোপড় দেখলে বাইরের কেউ তাকে কাজের লোক ভাবতে পারবে না। সাদেকও ভাবলো মোক্ষদা বুঝি রায়দের কোনও আত্মীয়। বললো, চিঠিটা আপনি কিভাবে পেলেন মোক্ষদা দেবী?

মোক্ষদার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। আজ পর্যন্ত কেউ ওকে দেবী বলেনি। সাদেকের কথা শুনে ও একেবারে গলে গেলো–ঘুম থেইকা উইঠা পুজার ফুল তুলতে বাইর হইছি। এক পোলা আইসা কইলো কর্তাবাবুর চিঠি। বাবু ঘুম থেইকা উঠলে যেন দেই।

ছেলেটাকে আপনি আগে কখনও দেখেছেন?

না, এই গেরামের পোলা না।

দেখতে কেমন?

সবুজ লুঙ্গি পরা, গায়ে খদ্দরের চাদর আর মাথায় ছাই রঙের উলের টুপি আছিল। গায়ের রঙ ময়লা, তয় আমাগো বনমালীর নতন না। মুখে অল্প অল্প নতুন দাড়ি।

তানিয়ার বাবা বললেন, তুমি মাদ্রাসার ছেলেদের তো দেখেছে। ওরকম কি মনে হয়?

একটু ভেবে মোক্ষদা মাথা দোলালো–হ, মারদাসার পোলা হইবার পারে। মারদাসার পোলারা তো দাড়ি কামায় না।

ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন। এই বলে সাদেক বিভূতিরঞ্জনের দিকে তাকালো–বনমালী কি সব সময় বাড়িতে থাকে?

হ্যাঁ। দরকারে মাঝে মাঝে বাইরেও পাঠাই।

কতদিন ধরে ও এ বাড়িতে আছে?

বছর তিনেক হবে!

লোক হিসেবে কি বিশ্বস্ত?

কী যে বলো। বনমালীর মতো বিশ্বাসী লোক আজকাল দেখা যায় না।

ওকে একটু ডাকুন।

একবার ডাকতেই বনমালী দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা গলালো–আইজ্ঞা কর্তা?

ভেতরে এসো। বললেন বিভূতিরঞ্জন।

এ বাড়িতে তুমি কতদিন ধরে আছো বনমালী? গম্ভীর গলায় জানতে চাইলো সাব ইন্সপেক্টর সাদেক হোসেন।

তিন বছর নয় মাস।

এর আগে কোথায় ছিলে?

শম্ভুগঞ্জের সরকারগো আড়তে।

ওদের কাজ ছেড়ে দিলে কেন?

ছাড়ি নাই তো! হ্যারা সব কইলকাতা চইলা গেল। আমারেও যাইতে কইছিল। আমি কইলাম মরতে হইলে বাপ ঠাকুদ্দার দ্যাশেই মরুম।

তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?

ঢাকার বিক্রমপুরে।

গত কয়েক দিনে এ বাড়ির আশেপাশে অচেনা বা সন্দেহজনক কাউকে দেখেছো? বনমালী একটু ভেবে বললো, না হুজুর! ভালো করে ভেবে বলো। দিনে বা রাতে সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়েনি?

কথাটা পুলিশকে জানানো উচিৎ হবে কিনা বনমালী একটু ভাবলো। তারপর বললো, কাইল রাইতে তেনারা আইছিলেন।

সাদেকের কপালে ভাজ পড়লো–তেনারা কারা?

বনমালী ভয়ার্ত চোখে ওর কর্তাবাবুর দিকে তাকালো। সাদেক বুঝতে পারলো না বনমালী কেন ভয় পাচ্ছে। একটু ইতস্তত করে বিভূতিরঞ্জন বললেন, তুমি এসব বিশ্বাস করবে কি না জানি না সাদেক। আমাদের এই তল্লাটের দুর্নাম আছে। আমাদের পূর্বপুরুষ খুব অত্যাচারী জমিদার ছিলো। গ্রামের বহু নিরীহ প্রজাকে ওরা অকারণে খুন করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের কয়েকজনও অপঘাতে মরেছেন। আমরা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করি, কেউ যদি অপঘাতে মারা যায় তার আত্মা পৃথিবী ছেড়ে যায় না। শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আত্মা আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।

তানিয়ার বাবা বললেন, বিজ্ঞানের এই যুগেও তুমি এসব বিশ্বাস করো বিভূতি? আমার তো মনে হয় যারা তোমাকে চিঠি পাঠিয়েছে তারাই আত্মা সেজে ভয় দেখাচ্ছে।

চিঠি তো পেলাম আজ। এখানে অশরীরী আত্মার বিচরণ আমার জন্মেরও আগে থেকে। আমাদের পুরোনো মহলটা সে কারণেই ছাড়তে হয়েছিলো।

সাদেক বললো, হিন্দু ধর্মে কী আছে জানি না। তবে বিজ্ঞান সব রহস্যের সমাধান করেছে এটাও সত্য নয়। আজকাল ইউরোপ আমেরিকার অনেক মনোবিজ্ঞানী টেলিপ্যাথি আর স্পিরিচুয়ালিজমের ওপর কাজ করছেন। তারা বিশ্বাস করেন মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। মৃতের আত্মার কাছ থেকে বার্তা পাওয়া সম্ভব।

তানিয়ার বাবা মৃদু হেসে বললেন, তুমি বোধহয় রহস্য কাহিনী পড়তে ভালোবাসো। আমার মনে হয় শনির দলকে ধরতে হলে আত্মারা তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারবে না। নিজের বুদ্ধি আর শক্তির ওপর নির্ভর করে এগুতে হবে।

বনমালী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের কথা শুনছিলো। পুলিস অফিসার যে আত্মার কথা অবিশ্বাস করেনি–এটা ওর ভালো লাগলো। সাদেক ওকে বললো, বনমালী, এবার তুমি যেতে পারো।

বনমালী বেরিয়ে যাওয়ার পর সাদেক বললো, যদি আপত্তি না থাকে রায়বাড়ির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমি একটু পরিচিত হতে চাই।

বিভূতিরঞ্জন উঠে দাঁড়ালেন–তুমি বোসো, আমি সবাইকে খবর দিচ্ছি।

দোতালার কাঠের সিঁড়িতে ওঁর পায়ের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমারা খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ওঁর পেছন পেছন ওরাও দোতালায় উঠে এলো। টানা বারান্দা দিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় প্রতিমা দেখলো, ওর বাবা পিসিমাকে বলছেন, দিদি তোমারে আর প্রতিমার মারে একটু নিচে আসতে হইবো। অফিসার তোমাগো লগে কথা কইবো।

মা আর পিসিমা খাটে বসে পান খেতে খেতে গল্প করছিলেন। ভাইয়ের কথা শুনে পিসিমা হাসলেন–কোইথেইকা পুইচকা ছারা একটা আইচে–হ্যায় বলে অপিচার! বৌ, ল যাই, দেইখ্যা আহি ছ্যারা কী কইবার চায়।

বিভূতিরঞ্জন বোনকে সাবধান করলেন–ওরে ছ্যারা ম্যারা কইয়া চটায়া দিও না দিদি। ডাকাইতগুলিরে না ধরা পর্যন্ত ওরে থাকতে রাজী করাইছি। তোমার কথা শুইনা চইলা গেলে আর ডাকাইত ধরা লাগবে না। এই বলে প্রতিমার মার দিকে তাকালেন মেয়েদেরও সঙ্গে এনো। আর মোক্ষদাকে বলো টেবিলে খাবার দিতে।

বাবাকে ঘর থেকে বেরুতে দেখে প্রতিমারা চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেলো। মিনিট পাঁচেক পর মা নিচে এসে বললেন, টেবিলে খাবার দেয়া হচ্ছে। খেতে খেতেই তোমাদের আলোচনা সারতে পারবে।