৮. গুপ্তধনের সন্ধানে

রতেশ্বরী গ্রামের রায়দের পুরোনো মহলকে লোকে বলে ভূতের টিলা। প্রতিমাদের বাড়ি থেকে হেঁটে গেলে মিনিট পনেরো লাগে। ধ্বংসস্তূপের ভেতরও কতগুলো ঘরের কাঠামো দাঁড়ানো ছিলো। দোতালার অনেকখানি ছাদ ভেঙে পড়লেও একতলার কয়েকটা ঘরে ছাদ ছিলো। দরজা জানালার জায়গায় বড় গহ্বরের মতো, জংলি লতা আর ঝোঁপ ঝাড়ে ছেয়ে গেছে। সব। দূর থেকে দেখলে মনে হয় গাছগাছালি ঢাকা উঁচু টিলা। মহলের পুব দিকটা পুরোটাই ধ্বসে পড়ে টিলার আকার নিয়েছে।

দুপুর তখন ঠিক বারোটা। প্রতিমা, তানিয়া আর প্রতিভা পুরোনো মহলের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে টিফিনের খাবার খাচ্ছিলো। তানিয়াকে গ্রাম দেখাবে বলে প্রতিমা আর প্রতিভা বাড়ি থেকে বেরুবার ছাড়পত্র পেয়েছে। মা বলেছিলেন বনমালীকে সঙ্গে নিতে। প্রতিমা রাজী হয়নি। সন্ধ্যে বা রাত হলে না হয় কথা ছিলো। দিনের বেলা পেয়াদা নিয়ে হাঁটলে গ্রামের লোক ঠাট্টা করবে। মা বলে দিয়েছেন যেখানেই যাক দুটোর আগে ফেরা চাই। তানিয়া যেন দুপুরে খেয়ে যায়। তানিয়া অবশ্য বাড়িতে বলেছে সারাদিন ও প্রতিভাদের সঙ্গে কাটাবে। বাবা আর বিভূতি কাকা খামার আর স্কুলের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে মেয়েরা নিজের মতো সময় কাটাচ্ছে দেখে মনে মনে ওঁরা খুশিই হয়েছিলেন।

প্রতিমা ওর কাঁধের ঝোলা ব্যাগে পানির বোতল আর খাবার নিয়েছে। প্রতিভা নিয়েছে ওর ঠাকুরদার গুপ্তি লাঠি। দেখতে বেড়াবার ছড়ির মতো, ভেতরে সরু বেয়নেটের ফলার মতো অস্ত্র লুকোনো থাকে। হাতলের বোতামে চাপ দিলে অস্ত্রটা বেরিয়ে আসে। তানিয়া সঙ্গে এনেছে একটা ড্রইং খাতা আর পেন্সিল। বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই ওরা ঠিক করেছে পুরোনো মহলের একটা নকশা তৈরি করতে হবে।

দু ঘন্টা ধরে দোতালার যে সব দেয়াল দাঁড়িয়েছিলো প্রতিভা লাঠি ঠুকে ঠুকে দেখেছে কোথাও ফাপা শব্দ হয় কিনা। দোতালায় তেমন কোনও আলামত পাওয়া যায় না। অনেকক্ষণ এক টানা হাঁটার পর ওরা যখন পুরোনো মহলের নাট মন্দিরের চাতালে বসলো, তখনই প্রতিভা বললো, দিদি, ব্যাগে করে কী এনেছিস বের কর। আমার ক্ষিদে পেয়েছে।

তানিয়া বললো, এই ফাঁকে আমি নকশার কাজটা সেরে নিতে পারি।

আগে কিছু মুখে দে! প্রতিমা ওর ব্যাগ থেকে মাংশের বড়া আর ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কিট বের করলো। সঙ্গে কলাও এনেছিলো।

খেতে খেতে প্রতিভা বললো, আমাদের স্কুলের টিফিনের মতো মনে হচ্ছে না তানিয়া?

টিফিনে তোকে মাংশের বড়া দেবে? তবেই হয়েছে।

প্রতিমা বললো, একটা ভুল করে ফেলেছি।

কী ভুল? একসঙ্গে প্রশ্ন করলো তানিয়া আর প্রতিভা।

ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রান্নাঘরে রেখে এসেছি।

সারাক্ষণ বাবার মতো চা চা করবি না তো দিদি! এই ভর দুপুরে চা খেতে বয়েই গেছে।

তানিয়া চারপাশে তাকিয়ে বললো, মনে হচ্ছে বহু বছর পর এখানে মানুষের পা পড়লো।

প্রতিমা বললো, আমাদের মামাতো ভাইটা এসেছিলো চোদ্দ পনেরো বছর আগে। ও মারা যাওয়ার পর ভুলেও কেউ এ বাড়ির ছায়া মাড়ায়নি।

খাবার শেষ করে নকশা আঁকতে গিয়ে পশ্চিম দিকে এসে আটকে গেলো তানিয়া। পশ্চিমের দিকটায় কামরার ছাদ এখনও ভেঙে পড়েনি। নকশা আঁকার জন্য জায়গাটা আবার দেখা দরকার। বললো, প্রতিমাদি, পশ্চিমের ওদিকটা ভালো মতো দেখতে চাই।

মুখ টিপে হেসে প্রতিমা বললো, চল যাই। তুই দেখছি গুপ্তধন বের না করে ছাড়বি না।

ক্ষয়ে যাওয়া লাল সুড়কির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে প্রতিমা বললো, এ বাড়ির সিঁড়ি মেঝে সব দামী ইটালিয়ান মার্বেল পাথরের ছিলো। অনেক দিন ধরে চোররা পাথর চুরি করেছে। যা বাকি ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময় লোপাট হয়েছে।

পশ্চিমের ঘরে ঢুকে তানিয়া লক্ষ্য করলো অন্য সব ঘরের চেয়ে এখানে জঞ্জাল কম। কথাটা প্রতিমাকে বললেও তেমন গুরুত্ব দিলো না ও–এ ঘরে ছাদ আছে তাই আবর্জনা কম। ওদিকের ঘর তো ছাদ ভাঙা রাবিশে ভরে আছে।

পাশের ঘরের সঙ্গে মিলিয়ে এ ঘরের দরজা জানালার নকশা আঁকতে গিয়ে তানিয়া লক্ষ্য করলো জানালা থেকে বংশী নদীটা চমৎকার দেখাচ্ছে। প্রতিমা বললো, এ বাড়ির অন্দর মহলের জানালা দরজায় নানা রঙের কাঁচ বসানো ছিলো। বন্ধ দরজা জানালার ওপর যখন রোদ পড়তো ঘরের ভেতর মনে হতো হোলির উৎসব হচ্ছে।

ওপরে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে দেখলো তানিয়া। ছাদের ওপর গজানো বট গাছের শেকড় জালের ভেতর ছড়িয়ে রয়েছে সারা সিলিং আর দেয়ালে। প্রতিভা লাঠি ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করছিলো–কোথাও অন্যরকম শব্দ হয় কি না। হঠাৎ ও বললো, দিদি, এটা এলো কোত্থেকে?

প্রতিমা আর তানিয়া ওর দিকে এগিয়ে গেলো-ওটা কী?

প্রতিভার হাতে ধরা আধখানা পোড়া সিগারেট। দেখে মনে হয় অনেক দিনের পুরোনো। বললো, এখানে সিগারেটের টুকরো আসবে কোত্থেকে?

তানিয়া সিগারেটের টুকরোটা নিয়ে সাবধানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। নাম পড়া যাচ্ছে না। এমনই নরম হয়েছে যে, যে কোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে। বললো, প্রতিমাদি বলেছিলে পুরোনো মহলে নাকি অভিশপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। আত্মারা কি সিগারেট খায়?

প্রতিভার এত বড় আবিষ্কারের কোনও গুরুত্বই দিলো না প্রতিমা হতে পারে ঝড় বাদলের রাতে সিগারেট খোর কেউ এখানে আশ্রয় নিয়েছিলো।

তানিয়া বললো, গ্রামের কেউ জেনে শুনে এ বাড়িতে আশ্রয় নিতে আসবে বলে তোমার মনে হয়?

অন্য কোনও এলাকার হতে পারে।

প্রতিভা বললো, সিগারেটের টুকরোটা খুব বেশি হলে মাস দুয়েকের পুরোনো হবে। গত দুতিন মাসে এদিকে ঝড় বৃষ্টি হয়নি।

প্রতিমা এবার একটু চিন্তিত গলায় বললো, তোরা কি বলতে চাস এ বাড়িতে মানুষের আনাগোনা আছে?

তানিয়া বললো, অতৃপ্ত আত্মারা যদি সিগারেট না খায় তাহলে বলতেই হবে দুমাস আগেও কেউ এখানে এসেছিলো।

প্রতিমা গম্ভীর হয়ে বললো, তানিয়া, আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা নিয়ে রসিকতা না করলে আমি খুশি হবো।

তানিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বললো, সরি প্রতিমাদি। প্রতিভা বললো, যে বা যারা এসেছিলো তারা নিশ্চয় এ ঘরে অপেক্ষা করেছিলো।

ঠিক বলেছিস। বলে তানিয়া পাশের ঘরে গেলো। সেখানে জানালার ধারে ও তিনটে পোড়া সিগারেটের টুকরো আর একটা দেয়াশলাইয়ের খালি বাক্স দেখতে পেলো। এ ঘরের জানালা থেকেও নদী দেখা যায়।

প্রতিমা বললো, সিগারেটের টুকরো আর দিয়াশলাইয়ের বাক্সটা যত্ন করে রাখতে হবে।

ওর ব্যাগের ভেতর টিস্যু পেপার ছিলো। ওদের আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলো যত্ন করে টিস্যু পৈপারে মুড়ে নিজের ব্যাগে রাখলো প্রতিমা।

দোতালা থেকে নিচে নেমে আবার ওরা নাটমন্দিরের চাতালে বসলো। প্রতিভা চিন্তিত গলায় বললো, দিদি ব্যাপারটা যতটা সহজভাবে দেখছিস আসলে তা নয়। ভূতের ভয়ে এর ত্রিসীমানায় মানুষজন আসে না বলে আমরা জানি, অথচ এখানে দিব্যি মানুষের যাতায়াত রয়েছে।

তানিয়া বললো, আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি অন্য কেউ আগে থেকে সেই উদ্দেশ্যে এখানে ঘুরছে না তো?

প্রতিমা একটু ভেবে বললো, অসম্ভব কিছু নয়। আমি শুনেছি কামরূপ কামাখ্যার সাধু সন্ন্যাসীদের ভূত, প্রেত, যখ কোনও ক্ষতি করতে পারে না। অসম্ভব সাহসী হয় ওরা।

প্রতিভা ওর দিদির সঙ্গে একমত হতে পারলো না সত্যিকারের সাধু সন্ন্যাসীদের কোনও গুপ্তধনের ওপর লোভ থাকার কথা নয়। কেউ যদি ভূত প্রেত যখ বিশ্বাস না করে তারাও আসতে পারে।

তানিয়া বললো, এমনও তো হতে পারে, যারা গুপ্তধন খুঁজছে তারাই যখ আর ভূত সেজে লোকজনদের ভয় দেখাচ্ছে?

প্রতিমা বললো, তুই বলতে চাস কেউ সত্তর আশি বছর ধরে গুপ্তধন খুঁজছে?

তা কেন হবে? সিগারেটের টুকরো দেখে তো মনে হচ্ছে দুতিন মাসের ভেতরই লোকজন যাতায়াত করছে। এমনও হতে পারে সপ্তায় বা মাসে এক দিনের বেশি ওদের পক্ষে আসা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে যে তুই বলছিস ভূত সেজে কেউ ভয় দেখাচ্ছে? লোকে ভূত দেখছে সত্তর আশি বছর আগে থেকে। আমাদের মামাতো ভাইটা যে এখানে এসে যখের পাল্লায় পড়ে মুখে রক্ত উঠে মরলো সেও তো চোদ্দ পনেরো বছর আগের কথা।

প্রতিভা বললো, এসব বিষয় নিয়ে আমরা বাড়িতে বসেও আলোচনা করতে পারবো। এখানকার কাজ নিশ্চয় এখনও শেষ হয়নি।

নিচের তলার একটা ঘরওতো দেখা হলো না!

ভরদুপুরেও মহলের নিচের তলার ঘরগুলোর ভেতরে অন্ধকার জমাট বেঁধে ছিলো। দরজা জানালার চিহ্ন না থাকলেও ফাঁকা জায়গায় ঝোঁপঝাড় গজিয়ে যাওয়ায় ভেতরের ঘরে সূর্যের আলো যেতে পারছিলো না। তানিয়া আর প্রতিভা উৎসাহ দেখালেও অন্ধকার ঘরে ঢাকার ব্যাপারে প্রতিমা মন থেকে সাড়া পাচ্ছিলো না। কে জানে অন্ধকারে কিসের ওপর পা পড়ে কিংবা কার স্পর্শ লাগে! শুকনো গলায় ও বললো, আজ অনেক হয়েছে। হেঁটে হেঁটে আমার পা ব্যথা করছে। তাছাড়া এসব ঘরে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবে না। টর্চ জাতীয় কিছু সঙ্গে আনা দরকার।

প্রতিমার পা ব্যথা করছে শুনে প্রতিভা বিরক্ত হয়ে বলতে যাচ্ছিলো তাহলে তুই এখানে বসে থাক, আমরা ঘুরে আসি। তবে অন্ধকারের কথাটা ওর কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলো। দিনের বেলা বেরুচ্ছে–টর্চ আনার কথা কারও মাথায় আসেনি।

তানিয়া বললো, কাল বরং টর্চ নিয়ে আসবো। আজ আর নিচের ঘর দেখার দরকার নেই।

হঠাৎ প্রতিভার মনে হলো পুব দিকের ধ্বংসস্তূপের ওপাশে কাঁটা ঝোঁপটার পেছনের ছোট গাছগুলো এমনভাবে নড়ছে যেন কেউ ওখানে লুকিয়ে রয়েছে। দিদি ও দিকে দেখ! আঙুল তুলে চাপা গলায় প্রতিভা বললো, মনে হচ্ছে ওখানে বসে কেউ আমাদের দেখছে।

প্রতিভার কথা শেষ না হতেই সব কিছু স্থির হয়ে গেলো। এক ফোঁটা বাতাস নেই। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। প্রতিমা বললো, বনবেড়াল নয় গুইসাপ হবে। এসব ঝোপে বড় কোনও জন্তু জানোয়ার থাকতে পারে না।

মানুষও তো হতে পারে!

এখানে মানুষ কোত্থেকে আসবে?

ঠিক তখনই দক্ষিণের ফাঁকা জায়গাটায় বনমালীর গলা শোনা গেলো–প্রতিমাদিদি, তোমরা এইখানে কী কর? আমি কখন থেইকা তোমাগো টোকাইতাছি!

প্রতিভা বিরক্ত হয়ে বললো, টোকানোর কী আছে। আমরা ছেলেমানুষ নাকি হারিয়ে যাবো? মাকে বলেছি বেড়াতে যাচ্ছি, দুটোর ভেতর ফিরবো। এখন মোটে একটা বাজে।

প্রতিমা গম্ভীর গলায় বললো, আমাদের খুঁজতে কে বলেছে তোমাকে?

ক্যান, কর্তায় কইছে। ঘোরনের এত জায়গা থাকতে তোমরা এইখানে কী কামে আইছ?

তানিয়া এরই ভেতর ঠিক করে ফেলেছে এ ধরনের প্রশ্নের কী জবাব দেবে। বললো, আমরা এক ধরনের গাছ খুঁজছি। স্কুলে পরীক্ষার জন্য দরকার হবে।

কি গাছ? আমারে কইলে তো আমিই আইন্যা দিতে পারি। তার লাইগা ভর দুপরে ভূতের ভিটায় আসনের কী কাম?

তুমি চিনবে না। ব্যানিয়ানট্রি। খুব দুর্লভ জাতের গাছ।

আমাগো বেণীমাধব কবিরাজরে কইলে হ্যায় সন্ধান দিতে পারবো। এই তল্লাটের ব্যাবাক গাছ হ্যাঁর চিনা আছে। লও দিদিরা। বাড়িত লও। ভর দুপুরে এই সব খারাপ জায়গায় আওন ঠিক না। তার উপরে তোমরা ম্যায়ামানুষ।

বনমালী যেন ওদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে–প্রতিভা উঠে দাঁড়ালো। বললো, চল দিদি। বনমালীদা ঠিকই বলছে। কাল বেণী কাকুকে জিজ্ঞেস করবো এখানে তানিয়ার ব্যানিয়ানট্রি কোথাও পাওয়া যাবে কি না। বলতে গিয়ে অতি কষ্টে হাসি চাপলো।

প্রতিমা আর তানিয়াও হাসি চেপে গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো।

প্রতিমাদের হাসি চাপার ধরনটা বনামালীর ভালো লাগলো না। বাড়ির পথে যেতে যেতে অভিমান ভরা গলায় বললো, ওরা না হয় ছোট। প্রতিমাদিদি, তুমি তো জান ভূতের ভিটার ধারে কাছে জন মানুষ আসে না। একটা অঘটন ঘটলে কর্তাবাবুরে আমি মুখ দ্যাখাইতে পারুম? এইদিকে আসবা, আমারে কইলে তো পারতা।

বনমালীর বয়স চল্লিশের ওপর। তবে ওর শক্ত পেটানো স্বাস্থ্য দেখে তিরিশের বেশি মনে হয় না। তিন বছর আগে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙার পর যখন বাংলাদেশের সব জায়গায় হিন্দুদের ওপর গুণ্ডারা হামলা করছিলো, টাকা পয়সা লুট করে বাড়িতে আগুন দিয়ে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন বনমালী রাতের পর রাত বন্দুক হাতে রায়বাড়ি পাহারা দিয়েছে। এক রাতে তিনটে বড় নৌকায় গুণ্ডারা এসেছিলো রায়বাড়ি লুট করার জন্য। বনমালীর গুলির বহর দেখে সবাই পালিয়েছে। তখন থেকে প্রতিমারা ওর অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছে। ওর অভিমান দেখে প্রতিমা নরম গলায় বললো, এইদিকে আসার কোনও প্ল্যান ছিলো না বনমালীদা। গাছপালা, ঝোঁপঝাড় দেখে তানিয়া বললো, এখানে খুঁজবে। দিনের বেলায় দেখে আমি আপত্তি করিনি। তুমি আবার বাবাকে বলে দিও না।

প্রতিভা বললো, আচ্ছা বনমালীদা, তুমি কীভাবে জানলে আমরা পুরোনো মহলে আছি?

কইলাম না তোমাগো টোকাইতে বাইর হইছিলাম! জিতু মাঝির পোলা নাওয়ে বইসা আছিল। আমারে কয় বনমালীদা কারে দোকাও? আমি কই প্রতিমা দিদিগো। হ্যাঁগো লগে শহরের থনে আইছে নূরু কাকার ম্যায়াও আছে। তখন পোলায় আমারে কইলো তোমাগো ভূতের টিলায় যাইতে দেখছে।

এরপর এ নিয়ে কেউ আর কথা বাড়ালো না। বাড়িতে ঢোকার সময় বনমালী শুধু মনে করিয়ে দিলো—বাইরে যাইতে হইলে প্রতিমা দিদি আমারে কইবা। প্রতিভা দিদি তোমারেও কই, দ্যাশের অবস্থা ভালো না। একটা অঘটন ঘটলে কর্তাবাবুরে আমি মুখ দ্যাখাইতে পারুম না।

প্রতিমা বললো, ঠিক আছে, এর পর থেকে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরুবো।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে প্রতিমার ঘরের বিশাল পালঙ্কে এসে বসলো ওরা তিন জন। প্রতিভা বললো, দিদি, তুই সব কিছুতে ঝামেলা বাঁধাস।

আমি আবার কী করলাম? অবাক হয়ে জানতে চাইলে প্রতিমা।

তুই বনমালীদাকে কেন বলতে গেলি এরপর থেকে আমরা ওকে নিয়ে বেরুবো।

নাবলবো না! ছোট বোনের পাকা পাকা কথা শুনে বিরক্ত হলো প্রতিমা–বনমালীদা যদি বাবাকে একবার বলে আমরা পুরোনো মহলে গিয়েছিলাম, বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ করে দেবে।

বনমালীদাকে সঙ্গে নিয়েও আমরা পুরোনো মহলে যেতে পারবো না।

তানিয়ার ব্যানিয়ানট্রি খোঁজার জন্য পুরোনো মহলে গেলে বনমালী আপত্তি করবে না।

মহলের নিচের তলার অন্ধকার ঘরে বুঝি টর্চ জ্বালিয়ে লাঠি ঠুকে ব্যানিয়ানট্রি খুঁজবো?

প্রতিভার কথা শুনে তানিয়া হেসে ফেললো–প্রতিভা ঠিক বলেছে প্রতিমাদি। গাছ যত দুর্লভই হোক টর্চ জ্বালিয়ে দেয়ালে আর মেঝেতে লাঠি ঠুকে ঠুকে যে আমরা যে গাছ খুঁজছি না এটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না।

বনমালীদাকে না নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুলেই ও হইচই বাঁধিয়ে দেবে।

তানিয়া একটু ভেবে বললো, বনমালীদাকে কোনও দরকারী কাজে কাল বাইরে কোথাও পাঠানো যায় না?

তেমন দরকারী কাজ কোথায়! চিন্তিত গলায় বললো তানিয়া। কয়েক মুহূর্ত ভেবে প্রতিভা ইউরেকা! বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

তানিয়া আর প্রতিমা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। প্রতিভা বললো, আমার হোমওয়ার্কের খাতা ভুলে স্কুলে ফেলে এসেছি। বাবাকে বলবো কালই ওটা আমার দরকার। বনমালীদার হাতে মিসেস পেরেরাকে চিঠি লিখে পাঠালে তিনি আমার ড্রয়ার থেকে খাতা বের করে দেবেন। বনমালীদার ফিরতে ফিরতে দেড়টা দুটো বাজবে।

প্রতিমা গম্ভীর হয়ে বললো, তুই কি সত্যিই হোমওয়ার্কের খাতা হোস্টেলে ফেলে এসেছিস?

হোমওয়ার্কের খাতা কেন ফেলে আসবো? মিসেস পেরাকে লিখবো আমার ফিজিক্স কেমিস্ট্রির প্র্যাকটিক্যাল খাতা দুটো পাঠাতে।

তানিয়া মৃদু হাসলো–ভালো বুদ্ধি বের করেছিস প্রতিভা।

প্রতিমা বললো, রোজ রোজ বনমালীকে হোমওয়ার্কের খাতা আনার জন্য বাইরে পাঠানো যাবে না। যা কিছু করার কালই করতে হবে।

একদিনে কি গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া যাবে? এত বড় বাড়ি–পুরো একমাস খুঁজলেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

প্রতিভা ঠিক বলেছে প্রতিমাদি। দেড়শ বছরের পুরোনো ভাঙা বাড়ির ধ্বংসস্তূপে গুপ্তধন খোঁজা যা তা ব্যাপার নয়। আমাদের চেষ্টা করতে হবে বনমালী কিংবা অন্য কারও চোখ এড়িয়ে কিভাবে কাজটা করা যায়।

তানিয়ার কথার জের টেনে প্রতিভা বললো, একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে পুরোনো মহলে কারও নিয়মিত যাতায়াত আছে কি না। আমার মনে হয় আরও কেউ গুপ্তধন খুঁজতে সেখানে যায়।

প্রতিমা বললো, এমনও হতে পারে ওরা গুপ্তধন নিয়ে কেটে পড়েছে। তোরাই তো বলছিস দেড় দুই মাসের ভেতর কেউ ও বাড়িতে যায়নি।

হতে পারে প্রতিমাদি। তবু পুরোনো জমিদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপে গুপ্তধন খুঁজছি–ভাবলেও রোমাঞ্চ হয়।

সেই সঙ্গে যদি অভিশপ্ত কিংবা অতৃপ্ত আত্মার দীর্ঘশ্বাস সেই ধ্বংসস্কৃপের ভেতর ভেসে বেড়ায় তাহলে তো ডবল রোমাঞ্চ।

প্রতিমা গম্ভীর গলায় বললো, তানিয়াকে একবার বলেছি। তোকেও শেষবারের মতো বলছি প্রতিভা। আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মাদের নিয়ে যদি ঠাট্টা ইয়ার্কি করিস ভালো হবে না। ওঁরা আমাদের নমস্য।

প্রতিমা হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে পূর্বপুরুষদের আত্মাদের উদ্দেশে প্রণাম জানালো।