৩. নিজেদের অচেনা বাড়ি

অনেকটা পথ বাসে, এরপর রিকশায়, সবশেষে এক ঘন্টা নৌকায়-রত্নেশ্বরীর বাড়ির আঙিনায় পা ফেলার আগেই ঝুপ করে অন্ধকার নামলো। মাঘ মাসের সন্ধ্যা দেখতে না দেখতেই ফুরিয়ে যায়।

তানিয়ার বাবা বিয়ের পরই গ্রামের বাড়ি ছেড়েছেন। বছরে একবার এসে ধান বিক্রির টাকাটা নিয়ে যান। তাঁর দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাই পাশের বাড়িতে থাকেন। তিনিই তানিয়ার বাবার জমিটুকু চাষ করান।

তানিয়া খুব ছোটবেলায় একবার গ্রামের বাড়িতে এসেছিলো। মা আসতে চাইতেন না বলে ওরও আর আসা হয়নি। গত সপ্তায় বাবা যখন ঠিক করলেন গ্রামের বাড়িতে চলে আসবেন তখন তানিয়াকে বলেছিলেন, মেঝে পাকা বটে, ঘরটা টিনের। ইলেকট্রিসিটি নেই, হারিকেন আর কুপির আলোয় রাতের কাজ সারতে হয়। রাতে শেয়াল ডাকে, গরমের সময় উঠোনে সাপ বেরোয়, ঘাসের ভেতর ছিনে জেঁক কিলবিল করে–পারবি তো থাকতে? বাড়ির বর্ণনা শুনে তানিয়া খানিকটা দমে গেলেও শুকনো হেসে বাবাকে বলেছে, কেন পারবো না বাবা? গ্রামে বুঝি মানুষ থাকে না!

নৌকা থেকে নামার পরই মাগরেবের আজান শুনেছিলো তানিয়া। মাইক ছাড়া কফ জড়ানো গলায় খালের কিনারের মসজিদের আঙিনায় দাঁড়িয়ে একজন বুড়ো হুজুর আজান দিচ্ছিলেন। মসজিদ বলতে তানিয়া সব সময় যে রকম দেখেছে–পাকা গম্বুজওয়ালা নানা রঙের সিরামিকের টুকরো বসানো ফুল লতা পাতার নকশা করা, তেমন কিছু নয়। মাটির মেঝেতে হোগলা পাতার মাদুর বিছানো, বেড়ার ঘর, চালে টিন। মুসল্লিও ছয় সাত জনের বেশি নয়।

আজানের শব্দ শুনে বাবা চাপা গলায় তানিয়াকে বলেছেন, মাথায় ওড়না দাও।

আসার সময় তানিয়া জিনস-এর স্কার্ট পরতে চেয়েছিলো। বাবা বারণ করেছেন–এসব পোষাক স্কুলে পরবে। গ্রামে সালোয়ার কামিজ আর ওড়না পরবে।

তানিয়া মাথায় ঘোমটা টেনে পেছনে তাকিয়ে দেখলো, বুয়ার মাথায়ও মস্ত ঘোমটা।

ঢাকার বাড়ি ছাড়ার আগে ঘরের জিনিষপত্র বেশির ভাগই বাবা বিক্রি করেছেন। খুব দরকারী যেগুলো সেগুলো গত কাল ট্রাকে আর নৌকায় নিয়ে এসেছিলেন। বাবা, তানিয়া আর বুয়ার হাতে ছিলো ওদের কাপড় চোপড়ের তিনটা স্যুটকেস।

মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বয়স্ক একজন বাবাকে বললেন, নূরউদ্দিন আসলা বুঝি! ওইটা কে, তোমার মেয়্যা?

বাবা যেতে যেতে শুধু বললেন, হ কাকা?

গ্রামের বাড়িতে আসার কথা শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো বুয়া। তানিয়াকে সুযোগ পেলেই বুঝিয়েছে শহরের থেইকা গেরামে অনেক ভালা থাকবা। তোমাগো পুকুরে কত মাছ! তরি তরকারি গাছ থনে তুইলা খাইবা।

বুয়ার খুশি হওয়ার কারণ ছিলো–এ গ্রামেই ওর বাড়ি। ওর ছেলে কালা বউ আর নাতি নাতনি নিয়ে গ্রামেই থাকে। কালা কামলার কাজ করে। ওর বউটা ভালো নয়। বিয়ের পর ছেলে বউয়ের কথায় ওঠে আর বসে। এসব কথা বুয়া বহুবার তানিয়াকে বলেছে। বুয়াকে যখন বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী কালার মা বুয়া, শহর ছাইড়া থাকতে পারবা? তুমি তো গেরামে থাকতে চাও না?

বুয়া জিভ কেটে বলেছে, খালু যে কী কন! বউয়ের জ্বালায় গেরাম ছাড়ছিলাম, পোলার সংসারে থাকুম না বইলা। আমি অহন নিজে কামাই কইরা খাই। দেইখেন বউ আইসা আমারে তোয়াজ করবো।

নৌকা থেকে নেমে মিনিট দশেক হাঁটতে হয়েছে ধান ক্ষেতের সরু আলের ওপর দিয়ে। আলের ওপর হাঁটতে বাবা আর বুয়ার অসুবিধে না হলেও তানিয়ার কাছে ধান কাটা, ঘন সাদা কুয়াশা জমা শুকনো ক্ষেতের ওপর দিয়ে হাঁটাটাই বেশি নিরাপদ মনে হয়েছে। তবে নৌকা থেকে নামার পরই কনকনে শীত ওর পুলোভার ফুটো করে ভেতরে ঢুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিলো।

বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে বাবা গলা তুলে ডাকলেন, আজিমউদ্দিন কই রে!

লম্বা ঘোমটা টানা একজন মহিলা হারিকেন হাতে বেরিয়ে এসে মুখ ঘুরিয়ে বাবাকে বললেন, আপনেগো দেরি দেইখা তাইনে হাটে গেছে। আইসা পড়বো।

হারিকেনের আলোয় বাবা বারান্দায় উঠে মাঝের ঘরের তালা খুললেন। ঘোমটা টানা মহিলা ভেতরে ঢুকে টেবিলের ওপর হারিকেন রাখলেন। বাবা তানিয়াকে বললেন, তোমার চাচী, সালাম করো।

তানিয়া এগিয়ে এসে চাচীর পা ছুঁয়ে সালাম করলো। চাচী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাইচা থাকো মা।

বুয়া ভেতরে ঢুকে বললো, অ খালা, আমারে আগে পাকঘর দেখাও। জলদি পাক তুইলা দেই।

চাচী বাবাকে বললেন, আইজ রাইতে আপনেরা আমাগো বাড়িতে খাইবেন। কাইল সকালেও। কালার মা কাইল নাশতা কইরা পাক বসাইও।

বুয়া এক গাল হেসে বললো, আল্লায় আপনের ভালা করুক খালা। আমার ভাত না খাইলেও চলে, তয় পান ছাড়া চলে না।

দরজার পাশে চাদর গায়ে দুটো আট দশ বছরের ছেলে মেয়ে উঁকি মেরে তানিয়াদের দেখছিলো। চাচী ডাকলেন, অই রাজন লাইলি ওইহানে খাড়াইয়া রইছস ক্যান। ঘরে আইসা চাচা আর বুজিরে সালাম কর। বাদে কালার মা বুয়ার লাইগা পান আইনা দে।

বড়টি লাইলি, ছুটে এসে ঝুপ ঝুপ করে বাবা আর তানিয়াকে সালাম করলো। তানিয়াকে আজ পর্যন্ত কেউ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেনি। ছোট রাজন লাজুক পায়ে যখন সালাম করতে ঘরে ঢুকলো তানিয়া ওর হাত ধরে বললো, না, না, সালাম করতে হবে না। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো রাজন?

কেলাশ টুতে। লজ্জা জড়ানো গলায় বললো রাজন।

লাইলি কোন ক্লাসে পড়?

আমি পড়ি কেলাশ ফোরে বুজি। চটপটে উত্তর দিলো লাইলি।

লাইলির কথা শুনে মজা লাগলো তানিয়ার। ওকে আজ পর্যন্ত কেউ বুজি বলে ডাকেনি। ছোট খালার ছেলেমেয়েরা কিংবা মামার ছোট মেয়েটা ওকে তানিয়া আপু বলে। নিচের ক্লাসের মেয়েরাও আপা বলে। ওদের ক্লাসে পড়ে আরতি। আরতির ছোট বোন ক্লাস ফোরে পড়ে। ও বলে তানিয়াদি। তানিয়ার হাত ধরে লাইলি বললো, বুজি, চল, আমাগো বাড়িতে চল।

বুয়া বললো, এতখানি পথ আইছি, একটু জিরাইয়া লই। যামুনে একটু পরে।

চাচী নিচু গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাইজান, আপনেরে একটু চা দেই?

বাবা বললেন, দিতে পারেন।

চায়ে দুধ দিমু না আদা তেজপাতা দিমু?

বুয়া বললো, খালু খায় লেম্বু চা। লেম্বু না থাকলে হুদা লাল চা। লন আমি বানায়া দিমু। তানিও একটু চা পাইলে মনে অয় খুশি ওইবো।

চাচী বুয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাজন আর লাইলিকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ওদের কথা বলার শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ পাথরের মতো নিথর শব্দহীন হয়ে গেলো। একেবারে শব্দহীন বলা যাবে না, মাঝে মাঝে ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিলো।

জানালার বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ঘরের ভেতরও হারিকেনের আলো যেখানে পৌঁছোয়নি সেখানে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। বাবা খাটে বসে তানিয়াকে বললেন, আয় বোস। কেমন লাগছে রে মা?

তানিয়া ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললো, কাল পরশু তোমার অনেক খাটুনি গেছে বাবা, তাই না? ঘরের জিনিষপত্র সব জায়গা মতো গুছিয়ে ফেলেছো?

বাবা মৃদু হেসে বললেন, দুটো কামলা ছিলো, তোর আজিমুদ্দিন চাচা ছিলো। কোনও অসুবিধে হয়নি। পেছনের বারান্দায় বেড়া দিয়ে ঘিরে তোর জন্য একটা বাথরুম বানিয়ে দিয়েছি। হাত মুখ ধুয়ে নিতে পারিস।

তা না হয় যোব। তুমি আমার জন্য বাথরুম বানাতে গেলে কেন বাবা? আমি তো পরশু স্কুলে চলে যাবো।

স্কুলে লম্বা ছুটি হলে তোকে বাড়িতে আসতে হবে। এক মাস পরই রোজার বন্ধ শুরু হচ্ছে।

বাবার পাশে খাটে বসে পা দোলাতে দোলাতে তানিয়া বললো, বুয়া বলে দেশের এই চাচা নাকি ভালো না, তোমাকে জমি নিয়ে ঠকিয়েছে। চাচীকে তো ভালো মনে হলো বাবা। ছেলেমেয়ে দুটোও বেশ দেখতে।

বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, জমি জমার বিষয় নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। পেছনের বারান্দায় গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে এসো। বালতিতে পানি আছে।

বাবার কথা শুনে তানিয়ার সব উচ্ছ্বাস কর্পূরের মতো উবে গেলো। ম্লান মুখে উঠে পড়লো। ওর চেহারার পরিবর্তন দেখে বাবার মনে হলো এভাবে বলাটা ওঁর উচিৎ হয়নি। তাঁর চাচাতো ভাইটি যে সুবিধের নয় এটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন। গ্রামের বাড়িতে কদিন থাকলে তানিয়াও টের পাবে। ওকে বললেন, হারিকেন নিয়ে যাও মা। চাচা ভালো না হলে কি হবে, ভাই বোনরা তো তোমাকে পছন্দ করেছে।

বাবার নরম গলা শুনে তানিয়ার মন ভালো হয়ে গেলো। সুটকেস খুলে তোয়ালে আর সাবান বের করে বাবাকে বললো, হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়েছে।

বাবা মৃদু হেসে বললেন, শহরের চেয়ে গ্রামে শীত বেশি লাগে।

মুখ ধোয়ার সময় তানিয়ার মনে হলো বরফ গলা পানিতে ও হাত ডুবিয়েছে। ও এমনিতে শীত কাতুরে। কোন রকমে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেললো। বুয়াকে আজই বলতে হবে–কাল যদি গরম পানি না দেয় ওর মুখ ধোয়া, গোসল করা কিছুই হবে না।

ঠাণ্ডার ভেতর বুয়ার বানানো লেবুর রস দেয়া চা খেতে তানিয়ার দারুণ লাগলো। বাবাও খুব তৃপ্তি করে চা খেলেন।

রাতে ওরা যখন পাশের বাড়িতে খেতে গেলো তখনই লাইলি রাজনের বাবা হাট থেকে ফিরলেন। বাবাকে দেখে লম্বা সালাম দিয়ে বললেন, ভাইজানের দেরি দেখে একটু হাটে গেছিলাম।

বুয়ার চোখের ইশারা পেয়ে তানিয়া চাচার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। চাচা দরাজ গলায় বললেন, আল্লা তোমার হায়াত দারাজ করুক মা।

ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে খেতে দেয়া হয়েছে তানিয়াদের। চাচা আর রাজন শুধু ওদের সঙ্গে বসেছে। অনেক বলেও লাইলিকে বসাতে পারেনি তানিয়া।

খেতে খেতে বাবা বললেন, অবেলায় হাটে কী কিনতে গেছিলা আজিমউদ্দিন?

কিছু কিনতে না ভাইজান। একটা মিটিং ছিলো। জবাব দিলেন চাচা।

কিসের মিটিঙ?

গ্রামে একটা ওয়াজ মাহফিল হইবো। তারই এন্তেজামের জইন্য মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হুজুর মিটিঙ ডাকছিলেন।

ওয়াজ করতে পয়সা লাগে না?

খুব লাগে। এক লাখ টাকার বাজেট হইছে।

কও কী আজিমউদ্দিন! এত টাকা কই পাইবা?

আল্লার কামে কী টাকার ঠ্যাকা হয়! গ্যারামের মাইনষে দিবো। চেয়ারম্যান সাবেই তো দশ হাজার ককুল করছেন।

চেয়ারম্যান মানে ওই রাজাকার ইমানালী? 

হ ভাইজান। গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন চাচা।

বাবা একটু পরে বললেন, আশেপাশে তিন চাইর গেরামে মেয়্যাগো একটা হাই ইশকুল নাই। ওয়াজের পিছে টাকা খরচ না কইরা ওই ট্যাকা দিয়া একটা গার্লস ইশকুল করলে তো পারো।

ইশকুল করবো সরকারে। আমরা ওয়াজ করুম সোয়াব কামানের লাইগা। আপনে মেয়্যাগো ইশকুল বানানোর কথা আগেও কইছেন। হেয়্যা কোন সোয়াবের কাম না, গুনার কাম।

কী পাগল ছাগলের মতো কথা বল আজিমউদ্দিন। ইশকুল করন গুনার কাজ হইবো ক্যান?

ভাইজান বেয়াদবি মাফ কইরেন। আমি এই সকল বিষয়ে আপনের লগে কতা কইতে চাই না।

বাবা আপন মনে বললেন, তুমি আর মানুষ হইলা না!

চাচার কথা চেহারা পোষাক কিছুই ভালো লাগে নি তানিয়ার। গায়ের রঙ কালো, দাঁত উঁচু। থুতনিতে এক মুঠো কাঁচা পাকা ছাগুলে দাড়ি অথচ গোঁফ কামানো। মাথায় গোল টুপি, গলায় সাদার ভেতর কালো চেক বড় রুমাল ঝোলানো। পাঞ্জাবির ঝুল হাঁটুর নিচে থেমেছে অথচ লুঙ্গি পরেছেন গোড়ালির এক বিঘত ওপরে।

খেয়ে উঠে চাচা বিরাট ঢেকুর তুলে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ!

খাওয়ার পর বাবা দেরি করলেন না। চাচীকে বললেন, লাইলির মা, যাই । আপনার রান্না খুব ভালো হইছে।

চাচী ফিশ ফিশ করে বললেন, ভাইজান পান খাইবেন না?

না, আমি পান খাই না। পান কালার মা বুয়ারে দিয়েন।

ঘরে এসে বাবা তানিয়াকে বললেন, তোমার চাচা জমি জমা নিয়ে আমাকে কিভাবে ঠকাচ্ছে ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার খারাপ লাগে, আমারই ভাই হয়ে

আজিমউদ্দিন জামাতীদের সঙ্গে ওঠাবসা করে। বলে কিনা স্কুল করা গুনার কাজ!

তানিয়া বললো, যখন গ্রামে থাকবে ঠিক করেছো তখন তুমিই তো পারো গ্রামে একটা মেয়েদের স্কুল খুলতে!

আমার টাকা থাকলে ঠিকই খুলতাম।

গ্রামের সবাই নিশ্চয় চাচার মতো নয় বাবা। তোমার সঙ্গে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁরা কোথায়? তাদের বলো টাকা দিতে।

ভালো বলেছিস মা! আমাদের সঙ্গে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলো তাদের অনেকে বেশ টাকা পয়সা বানিয়েছে। দেখি ওদের বলে যদি রাজী করাতে পারি। সামনের বছর আজিমউদ্দিনের মেয়ে লাইলিই তো স্কুলে যেতে পারবে না। প্রাইমারি স্কুলে এটাই ওর শেষ বছর।

বুয়া বললো, বাপ বেটি কী সারা রাইত পুটুর পুটুর করবো? ঘুমান লাগবো না?

ঢাকার বাড়ির মতো এখানেও তানিয়ার পাশের ঘরে বাবা নিজের খাট পেতেছেন। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বুয়া তানিয়ার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোয়। বেচারি বেশি রাত জাগতে পারে না। আজ অবশ্য খাটুনিও কম যায়নি। সন্ধ্যার পর থেকেই বুয়ার হাই উঠছিলো।

কাপড় বদলে তানিয়া বিছানায় ওর কম্বলের নিচে ঢুকলো। বুয়া গায়ে দেয় ভীষণ ভারি একটা লেপ। লেপটা পুরোনো হলেও খুব যত্ন করে বুয়া। রোজ রোদে দেয়, শীত চলে গেলে ন্যাপথলিন আর নিমপাতা দিয়ে সিন্দুকে তুলে রাখে।

শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুয়া মিহি শব্দে নাক ডাকতে লাগলো। তানিয়া জানে এক ঘন্টা পরই শুরু হবে বিকট শব্দে নাক ডাকানো। নিজের পরিচিত বিছানা হওয়া সত্ত্বেও জায়গা বদলের জন্য তানিয়ার ঘুম আসছিলো না। তার ওপর বাইরে অসংখ্য ঝিঁঝির ডাক কাণে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিলো। মাঝে মাঝে অনেক দূরে হুক্কা হুয়া করে শেয়াল ডাকছিলো। পুরোনো ঢাকার বাড়িতে ট্রাকের আর গাড়ির শব্দ, অনেক রাত পর্যন্ত গলিতে লোকজনের হই হুল্লার শব্দ এর চেয়ে অনেক বেশি হলেও তানিয়ার ঘুমোতে অসুবিধে হয়নি।

হারিকেনের আলো কমিয়ে বুয়া টেবিলের নিচে রেখেছে। বাইরে সন্ধ্যার পর যতটা অন্ধকার ছিলো এখন অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের এক ফালি চাঁদ উঠেছে। তানিয়া তাকিয়েছিলো খোলা জানালার দিকে। ঘরের দেয়াল বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো হলেও কাঠের ফ্রেমের জানালায় লোহার শিক লাগানো।

হঠাৎ ওর চোখে পড়লো জানালার বাইরে দুটো কালা ছায়ামূর্তি। ভূত বিশ্বাস না করলেও তানিয়া ভয় পেলো। চোর ডাকাত নয়তো? হাতের কনুই দিয়ে বুয়াকে গুঁতো দিলো। বার তিনেক গুঁতো খেয়ে বুয়া বললো, কী ওইছে তানিয়া? ঘুমাও নাই?

বুয়ার কথা শুনে ছায়ামূর্তি দুটো সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেলো। তানিয়া বললো, জানালার বাইরে কারা যেন ঘোরাফেরা করছে।

বুয়া ভয় পাওয়া গলায় বললো, জানালার বাইরে কারা ঘুরবো? কী না কী দেখছো, অহন ঘুমাও।

বুয়া তিনবার কুলহুয়াল্লা পড়ে নিজের আর তানিয়ার বুকে ফুঁ দিলো। তানিয়া বললো, জানালাটা বন্ধ করে দাও বুয়া।

বুয়া বললো, আমি তো বন্ধ করতে চাইছিলাম। খালু কইলো ঘর মেলা দিন বন্ধ আছিল। আইজ জানালা খোলা থাউক।

না বুয়া, বন্ধ করে দাও।

কথা না বাড়িয়ে বুয়া জানালা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাক ডাকা আরম্ভ করলো।