২. বাবার চাকুরি হারানো

তানিয়ার বাবা স্কুল থেকে সোজা বাড়ি ফেরেন না। স্কুলের কাছে এক বড়লোকের বখাটে ছেলেকে পড়াতে যেতে হয় ছটায়। বাড়ি ফিরতে ওঁর আটটা নটা বেজে যায়। বাবা না ফেরা পর্যন্ত তানিয়া খুব ভয়ে ভয়ে থাকে।

বছর দুয়েক আগে ওদের পাড়ার শিপলু বিপলুদের বাবা রশীদ চাচা বাড়ি ফিরতে রাত করেছিলেন। ক্লাস ফাইভে পড়া জমজ দু ভাই নটার পর থেকে পাড়ার ঘরে ঘরে গিয়েছিলো, হয়তো কারও বাড়িতে ওদের বাবা আড্ডায় বসে গেছেন এই ভেবে। রাশভারি রশীদ চাচা মোটেই আড্ডা দেয়ার মতো মানুষ ছিলেন না। রাত সাড়ে দশটার দিকে এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে পাড়ার লোকজনের কপালে ভাজ পড়েছিলো। ভেবেছিলো কাউকে বুঝি হাসপাতালে নিতে হবে। সেই এম্বুলেন্সে রশীদ চাচার লাশ এসেছিলো হাসপাতাল থেকে। অফিসে ওভার টাইম করতে হয়েছিলো। কাজ শেষ করে বেরুতেই বড় রাস্তায় চলন্ত ট্রাকের ধাক্কা খেয়েছেন। অফিসের লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়ার পথেই সব শেষ। সেই থেকে বাবার বাড়ি ফিরতে দেরি হলে তানিয়ার বুকের ভেতর ধুকপুকুনি শুরু হয়।

সেদিন তানিয়া স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখলো বাবা পেছনের বারান্দায় পুরোনো বেতের চেয়ারটায় বসে কী যেন ভাবছেন। তানিয়া কড়া নেড়েছে, বুয়া দরজা খুলে দিয়েছে, কোনও কিছু তাঁর কানে যায়নি। বুয়া শুধু দরজা খোলার সময় চাপা গলায় তানিয়াকে বলেছে, খালুর মনে অয় শরীলডা ভালা না। কুন আওয়াজ কইরো না।

বাবার শরীর খারাপ শুনে তানিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। ঘরে পড়ার টেবিলে বইগুলো রেখে পেছনের বারান্দায় বাবার কাছে গেলো। ভয়ে ভয়ে বললো, বাবা, তোমার কি স্ত্রীর খারাপ?

বাবা সামান্য চমকে উঠে তানিয়ার দিকে তাকালেন। ম্লান হেসে বললেন, না রে মা, শরীর খারাপ না। তুই কাছে একটু বোস।

মা মারা যাওয়ার পর বাবা কখনও এত নরম গলায় তানিয়ার সঙ্গে কথা বলেননি। আগের মতো মা বলেও ডাকেননি। বাবার কথা শুনে তানিয়ার প্রথমে ভালো লাগলেও পরে ঘাবড়ে গেলো। বাবা হঠাৎ এভাবে কথা বলছেন কেন, ও বুঝতে পারলো না। বারান্দার রঙ ওঠা লাল মেঝের ওপর বসে তানিয়া বললো, তোমার কী হয়েছে বাবা?

শুকনো হেসে বাবা কোনও রকম ভূমিকা না করে দুম করে বললেন, স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।

বলো কী বাবা? হঠাৎ চাকরি ছাড়লে কেন? বাবার কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো তানিয়া, ভয়ও পেলো।

হঠাৎ না রে মা! কদিন ধরেই ভাবছিলাম আমার চাকরি করা উচিৎ হবে কি না।

কেন এরকম ভাবছিলে বাবা?

এ মাসের পয়লা তারিখে আমাদের স্কুলে নতুন যে হেডমাস্টার জয়েন করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সে রাজাকার ছিলো।

তানিয়া জানে একাত্তরে ওর বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। মা থাকতে বাবা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতেন। এক একটা কাহিনী অনেক বার শুনেছে তানিয়া। বাবার বন্ধু আশফাঁক বুকে গুলি খেয়ে বাবারই কোলে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে বলেছিলেন, আমি জানি বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে। দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করার লড়াই অনেক কঠিন। কথা দে, তুই যদি বেঁচে থাকিস সেই কঠিন লড়াই চালিয়ে যাবি! বাবা ওঁর বন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন। যতবার বাবা এই ঘটনার কথা বলেছেন ততবারই কেঁদেছেন। কখনও বিড়বিড় করে বলেছেন, আশফাঁক, তোরা দেশের জন্য একাত্তরে শহীদ হয়ে বেঁচে গেছিস। আমরা বেঁচে আছি আধমরা হয়ে। এর চেয়ে তখন মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিলো।

বাবার কথা শুনে তানিয়া কী বলবে ভেবে পেলো না। চুপচাপ শুধু বসে থাকলো। বাবা বললেন, লোকটা এসেই বললো, এ্যাসেম্বলির সময় রোজ রোজ জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে কেন? পতাকাই বা তুলতে হবে কেন? ওসব বিশেষ দিবস টিবসে মানায়, রোজ রোজ করতে হবে না। আমিও শুনিয়ে দিয়েছি দুকথা!

তানিয়া বললো, স্কুলের অন্য টিচাররা কিছু বলেননি?

ম্লান হেসে বাবা বললেন, সবাই জানে এই হেডমাস্টার স্কুল কমিটির নতুন সেক্রেটারির ভাই। গত ঈদে সেক্রেটারি মোটা টাকা ডোনেশন না দিলে কারও বেতন হতো না। সেক্রেটারিও জামাত করে।

তার মানে তোমাদের স্কুলে এখন জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয় না? জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না?

কোনও কথা না বলে বাবা শুধু মাথা নাড়লেন। তানিয়া আবার বললো, স্কুলের ওপরের ক্লাসের ছাত্ররাও কিছু বলেনি?

তিক্ত গলায় বাবা বললেন, বাড়িতে বাপ মার কাছে দেশকে ভালোবাসার শিক্ষা পেলে তো বলবে? স্কুলে, বাড়িতে সবখানে এক অবস্থা!

তুমি যে চাকরি ছাড়লে–-সামাদ চাচা, জাফর চাচা কেউ কিছু বলেননি?

বারণ করেছিলো অনেকে। আমি বলেছিলাম, চলুন সবাই মিলে শিক্ষা দফতরে চিঠি লিখি। সাংবাদিকদের বলে খবরটা কাগজে তুলে দিই। কেউ রাজি হলো না। সবারই চাকরি হারাবার ভয়!

তানিয়া কোনও কথা বললো না। একটু চুপ থেকে বাবা আবার বললেন, আশফাঁককে কথা দিয়েছিলাম স্বাধীনতা রাখার জন্য লড়বো। দেশে যখন রাজাকারদের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী বানানো হলো তখন কিছু বলিনি। স্বাধীনতার শত্রুরা যখন মিটিঙ মিছিল করে তখনও কিছু বলি না। স্কুলের ঘটনাটা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। বল, এভাবে আর কত দিন পড়ে পড়ে মার খাবো?

তানিয়া বলতে চাইলো, বাবা, তুমি চাকরি ছেড়েছে। সংসার কিভাবে চলবে তুমি ভাবোনি। রাজাকার হেডমাস্টারও তার জায়গায় থেকে গেলো। আরও কিছু কথা তানিয়ার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ও ভালোভাবেই জানে এসব কথা শুনলে বাবা কষ্ট পাবেন। চাকরি ছাড়তে বাবার নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছে। এখন দরকার বাবাকে সান্ত্বনা দেয়া, সাহস দেয়া। মা বেঁচে থাকলে তাই করতেন।

তানিয়া আস্তে আস্তে বললো, তুমি ঠিক কাজ করেছো বাবা। রাজাকাররা দেশ চালাবে এটা দেখার জন্য নিশ্চয় তোমরা মুক্তিযুদ্ধ করোনি!

তানিয়ার কথা শুনে বাবার বুক গর্বে ভরে গেলো। স্কুলের হেড মৌলবি প্রায়ই আড়ালে ইয়ার্কি মারেন–দাদার আমলে ঘি খেয়েছেন, এখনও হাতে গন্ধ শোকেন। কখনও বলেন, দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করেছেন না দেশটাকে ইণ্ডিয়ার কাছে বেচে দেয়ার জন্য যুদ্ধ করেছেন সেটাই তো ভেবে দেখা দরকার। আবার কখনও বলেন, পাকিস্তান যদি না ভাঙতে আমাদের এই দুর্গতি হতো না। হেড মৌলবির এসব কথা সব টিচারের ভালোও লাগে না। তবু সবাই চুপ করে থাকেন। তবে বাবার সামনে হেড মৌলবি এসব কথা বলেন না।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর তানিয়া আস্তে আস্তে বললো, এখন কী করবে কিছু ভেবেছো বাবা?

মাথা নেড়ে সায় জানালেন বাবা, আমাদের রত্নেশ্বরীর গ্রামের বাড়িতে জমি জমা যা আছে–দেখি সেখানে থেকে ছোট খাট একটা খামার করা যায় কিনা। গত বছর তোর মা মারা যাওয়ার পর বিভূতিও বলছিলো গ্রামে গিয়ে থাকতে। তোকে মির্জাপুরে ভারতেশ্বরী হোমস-এ ভর্তি করে দেবো। স্কুলের হোস্টেলে থাকবি। মাসে দুবার এসে দেখে যাবো।

ওখানে তো পড়ার অনেক খরচ বাবা?

তোর মা মারা যাওয়ার পর জয়াদির সঙ্গে একবার কথা বলেছিলাম। বলেছিলেন মির্জাপুরের মেয়ে হিসেবে তোর বেতন আর হোস্টেল খরচ অর্ধেক করে দিতে পারবেন। পরে ভেবে দেখলাম, একা থাকতে তোর কষ্ট হবে। তাই তখন আর ভর্তি করাইনি।

তানিয়া বাবার কোলে মাথা গুঁজে বললো, একা থাকতে তোমার কষ্ট হবে না বাবা?

মেয়ের নরম চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বাবা বললেন, কষ্ট হলেও এ ছাড়া উপায় কী মা! গ্রামে যে স্কুল আছে সেটা তো ছেলেদের!

বাবাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে ভেবেও এত নামী স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে–তানিয়ার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। বললো, ক্লাস তো শুরু হয়ে গেছে বাবা। এখন কি আমাকে নেবে?

জয়াদিকে বুঝিয়ে বললে নেবেন। আমি কাল পরশু গিয়ে কথা বলে আসবো। যেতে যখন হবেই–ভাবছি এ মাসেই চলে যাবো।

.

পরদিন স্কুলে এসে সবার আগে পারুলের সঙ্গে কথা বললো তানিয়া। পারুল ম্লান হেসে বললো, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তানি! সত্যিই চলে যাবি?

বাবা তো তাই বললেন। নামী স্কুলে পড়ার আনন্দের পাশাপাশি সাত আট বছরের পুরোনো বন্ধুদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টও তানিয়ার কম ছিলো না। বাবার চাকরি হারাবার কষ্টও ভুলতে পারছিলো না ও।

কবে যাবি ঠিক হয়েছে? জানতে চাইলো পারুল।

এ মাসের ভেতরই। বাবা আজ মির্জাপুর গেছেন খোঁজখবর আনার জন্য।

ক্লাস সিক্সে থাকতে সুমনা গিয়েছিলো। এবার যাচ্ছিস তুই।

সুমনা যে ক্লাস টেন পর্যন্ত থাকবে না এটা তানিয়ারা আগে থেকেই জানতো। ওর বাবার ছিলো বদলির চাকরি। তানিয়ার যাওয়াটা ওর বন্ধুদের সবার কাছেই একটা দুর্ঘটনার মতো মনে হলো। ক্লাসের পরীক্ষায় তানিয়া দশের ভেতর থাকতে পারে না এটা সত্যি, কিন্তু গান, আবৃত্তি আর খেলাধুলোয় শুধু ক্লাসে নয় স্কুলের সবাই ওকে এক ডাকে চেনে। গত চার বছর স্কুলের পুরস্কার বিতরণী উৎসবে তানিয়া তিন চারটা গান না গেয়ে স্টেজ থেকে নামতে পারেনি, যদিও অন্যরা একটার বেশি গাওয়ার সুযোগ পায়নি। তানিয়ার মা নিজে গাইতে পারতেন। তারপরও ওকে বুলবুল একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতে গত তিন বছর ধরে তানিয়া ফার্স্ট হচ্ছে।

টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসের ভেতরই তানিয়ার বন্ধুরা সবাই ওকে ঘিরে বসলো। অনেকেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না, তানিয়া হঠাৎ করে এভাবে চলে যাবে। ক্লাসের মনিটর রেহানা তানিয়ার খুব কাছের বন্ধু নয়, বড়লোকের মেয়ে বলে তানিয়াও ওকে এড়িয়ে চলে। সেই রেহানাও বললো, তুই চলে গেলে আমাদের স্কুলে ফাংশনের কী হবে?

লিলির বাবা রাজনীতি করেন। সরকারী দলের হোমরা চোমরা একজন। ও বললো, বাবাকে বলতে পারি তোর বাবার স্কুল কমিটিকে বলার জন্য যেন র চাকরি না যায়।

তানিয়া জানে লিলির বাবার সে ক্ষমতা আছে। বললো, স্কুল কমিটি তো বাবাকে চাকরি ছাড়তে বলেনি। বাবা নিজে রিজাইন দিয়েছেন।

লিলি তবু বললো, হেডমাস্টারটার জন্যেই তো তোর বাবা চাকরি ছেড়েছেন। হেডমাস্টারকে বরখাস্ত করাও কঠিন কোনও কাজ নয়।

তানিয়া মাথা নাড়লো–বাবার জন্য কারও চাকরি যাবে এটা তিনি পছন্দ করবেন না।

সীমা বললো, তানিয়া যখন চলেই যাবে ওর জন্য আমরা সবাই মিলে ফেয়ারওয়েল পাটি দেবো।

সবাই কোরাসে সীমার কথায় সায় জানালো। তানিয়া লজ্জা পেয়ে বললো, আমার জন্য ফেয়ারওয়েল পার্টি করতে হবে কেন?

সীমা বললো, তুই কথা বলবি না।

রেহানা গম্ভীর গলায় পারুলকে বললো, তুই তানিয়াকে নিয়ে বাইরে যা। আমরা নিজেরা একটু পরামর্শ করবো।

পারুল একটু হেসে তানিয়ার হাত ধরে বললো, চল, তোকে আজ ফুচকা খাওয়াবো।

মা মারা যাওয়ার পর থেকে তানিয়া নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে বসে, বন্ধুদের বাড়িতেও খুব একটা যায় না–হঠাৎ নিজেকে ওর গুরুত্বপূর্ণ একজন মনে হলো। ক্লাসের মেয়েরা ওকে নিয়ে আলোচনা করছে ভাবতেই বুকটা আনন্দে ভরে গেলো।

ঘন্টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে ক্লাসে ঢুকলো ওরা দুজন। সীমাদের মিটিঙ তখন শেষ হতে চলেছে। রেহানা বললো, আগামী শুক্রবার দুপুরে সীমাদের বাড়িতে পার্টি হবে তানিয়ার জন্য।

পারুল বললো, শুক্রবার মানে তো পরশু?

হ্যাঁ, পরশু শুক্রবার। সীমা গিয়ে তানিয়াকে নিয়ে আসবে। তোর বাবা নিশ্চয় আপত্তি করবেন না?

কাকের কথা বাদ দিলে বাবার যে মেজাজ গত এক বছর ধরে তানিয়া দেখছে তাতে ওর ভয়ই ছিলো ওকে বোধহয় পার্টিতে যেতে দেবেন না। তানিয়া যখন রাতে খাবার সময় ফেয়ারওয়েল পার্টির কথা বাবাকে বললো, শুনে তিনি খুশিই হলেন–বেশ তো যাবি! স্কুলে। আমার বন্ধুরাও চেয়েছিলো আমাকে ফেয়ারওয়েল দিতে। আমি মানা করেছি। কোনও অনুষ্ঠান করলে রাজাকার হেডমাস্টারটাই সভাপতি হবে। কী দরকার সে অনুষ্ঠানে যাওয়ার!

.

শুক্রবার সকাল নটায় সীমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ালো তানিয়াদের গলির মুখে। বড় গাড়ি ওদের সরু গলিতে ঢোকে না। সীমাও এসেছিলো গাড়ির সঙ্গে। তানিয়া অবাক হয়ে বললো পার্টি তো দুপুরে। এত সকালে এসেছিস কেন?

সীমা বললো, পার্টি কি শুধু খাওয়ার জন্য? তোর বাবা কোথায়? আজ সারাদিন তোকে রেখে দেবো।

তানিয়া হেসে বললো, বাবা ভোরে মির্জাপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেছেন। ফিরতে রাত হবে।

তাহলে আর চিন্তা কি! বুয়াকে বলে চল জলদি।

জলদি বললে হবে না। বুয়া বাজারে গেছে। ফিরতে আরও আধ ঘন্টার কম নয়। তুই বোস।

সীমার স্বভাব চড়ুই পাখির মতো। চুপচাপ বসে থাকা ওর স্বভাবের বাইরে। বললো, তুই তাহলে রেডি হয়ে নে। ততক্ষণে আমি বরং মিলিকে তুলে আনি। বলে আর ও অপেক্ষা করলো না।

তানিয়া ওর ঘরে ঢুকে আলমারির ভেতর থেকে ওর সবচেয়ে প্রিয় পোশাকটা বের করলো। মা মারা যাওয়ার এক মাস আগে নিজের হাতে বানিয়েছিলেন। হালকা বেগুনি রঙের ভেতর সাদা হাজারি বুটির দামী একটা জামদানি শাড়ি ছিলো মার। মাত্র একবার পরেছেন, রিকশার খোঁচা লেগে বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গিয়েছিলো। সেই শাড়ি দিয়ে মা ওকে ঘন কুচি দেয়া লম্বা ঝুলের কামিজ বানিয়ে দিয়েছিলেন। আঁচলের ঘন নকশার খানিকটা বুকের কাছে, বাকিটা ওড়নার দুই মাথায় কেটে বসিয়েছিলেন। মার নিজের হাতে বানানো কামিজের সেটটা পরলো তানিয়া।

এক ঘন্টা পর সীমা এসে তানিয়াকে দেখে চোখ কপালে তুললো–তানি তোকে একটা পরির মতো লাগছে। কী দামী ড্রেস পরেছিস? কোত্থেকে কিনেছিস বলতো?

কিনিনি। মা বানিয়ে দিয়েছেন। বলতে গিয়ে তানিয়ার গর্ব হলো।

নিজের জিনস-এর প্যান্ট আর টপস-এর দিকে তাকিয়ে সীমা বললো, তোর পাশে আমাকে চাকরানির মতো লাগছে।

মোটেই না সীমা। তোকে খুব স্মার্ট লাগছে।

সীমাদের পার্টিতে সবাই তানিয়ার পোশাকের প্রশংসা করলো। তিন চার জন ছাড়া ক্লাসের সব মেয়েই এসেছিলো সীমাদের বাড়িতে। সীমার মা প্রায়ই তাঁর তিন ছেলেমেয়ের বন্ধুদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ান। তার একটা মাত্র শখ, আর তা হলো দেশ বিদেশের রকমারি রান্না। সুযোগ পেলেই প্রাণ ভরে মিটিয়ে নেন।

ক্লাস মনিটর রেহানা ঠিক করেছিলো সবাই মিলে চাঁদা তুলে পার্টি করবে। সীমার মা শোনা মাত্র নাকচ করে দিয়েছেন। ধরা গলায় রেহানাকে বলেছেন, মা মরা মেয়েটা স্কুল ছেড়ে, তোদের সবাইকে ছেড়ে একেবারে চলে যাচ্ছে। এক বেলা তাদের খাওয়াতে পারবো না আমাকে এমন ছোটলোক ভাবছিস কেন?

জিব কেটে রেহানা বলেছে, ছিঃ খালাম্মা, আপনাকে ছোটলোক ভাববো কেন? আমরা চেয়েছিলাম তানিয়ার জন্য আমরা সবাই কিছু করি।

সীমার মা মুখ টিপে হেসে বলেছেন, তোদর বাজেট কতো?

মাথা পিছু পঞ্চাশ ঠিক করেছিলাম। কয়েকজন অবশ্য কম দিয়েছে। সব মিলিয়ে নয়শ চল্লিশ টাকা উঠেছে।

ঠিক আছে। এ টাকা দিয়ে তানিয়াকে আমরা চমৎকার উপহার কিনে দেবো।

সারাদিন সীমাদের বাড়িতে মেয়েরা হুল্লোড় করে কাটালো। বিকেলে চায়ের পর্ব শেষ হওয়ার পর তানিয়াকে গান গেয়ে শোনাতে হলো। একেক জনের পছন্দ মেটাতে গিয়ে বারোটা গান গাইতে হলো ওকে। গান শুনে সীমার রাশভারি বাবাও গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার গলায় সুর আছে, দরদও আছে। গানের চর্চা ছেড়ো না। সবার প্রশংসা শুনতে শুনতে তানিয়ার বার বার কান্না পাচ্ছিলো। সব শেষে রেহানা যখন বিদায় জানিয়ে দুঃখভরা গলায় ছোটখাট একটা বক্তৃতা করলো, তানিয়া চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। রাতে বাড়ি ফেরার সময় উপহার হিসেবে ওকে যখন জিনস-এর স্কার্ট-টপস সেট, প্যাস্টেল রঙের বড় বাক্স, রঙিন পেন্সিল, জলরঙের বাক্স আর মোটা ড্রইং খাতা দেয়া হলো তানিয়া আরেক দফা কাঁদলো।