৬. নতুন স্কুল নতুন বন্ধু

ভাই পারু,

বলেছিলাম নতুন স্কুলের প্রথম দিনই তোকে চিঠি লিখবো। প্রথম দিন দূরে থাক কাল পর্যন্ত দম ফেলার সময় পাইনি। ভাবতে পারিস ঘুম থেকে উঠতে হয় সূর্য ওঠার আগে! সকাল বিকাল যে রকম ড্রিল করায় মনে হয় ক্যান্টনমেন্টের আর্মিদের হার মানাবে। প্রথম দিন ড্রিল করে মনে হয়েছিলো আরেক দিন এরকম করতে হলে নির্ঘাৎ মরে যাবো। এখনও মরিনি। মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে সয়ে যাবে।

স্কুলে কড়াকড়ির কথা আগে শুনেছিলাম বটে, এসে দেখি পান থেকে চুন খসার জো নেই। সব কাজ নিজেদের করতে হয়। এমন কি রান্নার কাজও পালা করে করতে হয়। সবচেয়ে খারাপ লাগে বারোয়ারি বাথরুম পরিষ্কার করতে । খারাপ লাগলেও উপায় নেই, সবাইকে করতে হয়। আনন্দময়ী স্কুল থেকে এসে আমি এই স্কুলের নাম রেখেছি নিরানন্দময়ী স্কুল। গত শনিবার বাবা আর বিভূতি কাকা আমাকে এখানে রেখে গেছেন। এত বড় নামী স্কুলে পড়বে ভেবে রীতিমতো রোমাঞ্চ হচ্ছিলো। শনিবার আমাদের হোস্টেলের মিসেস পেরেরা নিয়ম কানুন সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। তখনও ভালোই লেগেছিলো, মনটা শুধু খুঁত খুঁত করছিলো রাত সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠতে হবে বলে। রোববার থেকে শুরু হয়েছে পরিপূর্ণ হোমস জীবন। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে রাতে বিছানায় শুয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। আমাদের আনন্দময়ী স্কুলে আমি ইংরেজিতে কখনো আশির নিচে নম্বর পাইনি। এখানকার ইংরেজির বহর থেকে মনে হচ্ছে পাশ করতেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। টিচারদের সঙ্গে ক্লাসে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। আমাদের আনন্দময়ী স্কুলের মতো টিচারদের আপা দিদি এসব বলা যাবে না। বলতে হবে মিস না হলে মিসেস। কী অস্বস্তি লাগে ষাট বছরের রাশভারি মহিলা অঙ্কের টিচারকে মিসেস সরকার ডাকতে। এখানে সবার আগে বন্ধুত্ব হয়েছে ক্লাস নাইনের প্রতিভার সঙ্গে। বাবার বন্ধু আমাদের গ্রামের বিভূতি কাকার ছোট মেয়ে প্রতিভা। এই নিরানন্দময়ী স্কুলে প্রতিভা আমার একমাত্র আশ্রয়। বিভূতি কাকারা এক কালে মস্ত জমিদার ছিলেন। গত শুক্রবার সারাদিন কাটিয়েছিলাম ওঁদের বাড়ি। কাকা কাকিমা ছাড়া বাড়িতে থাকেন বড় মেয়ে প্রতিমাদি। বিভূতি কাকার দুটো মেয়েই ডানা কাটা পরি। প্রতিমাদিকে প্রথম দেখে ভেবেছিলাম বুঝি কলেজে পড়েন। পরে শুনি গত বছর দিল্লী থেকে এম এ পাশ করে এসেছেন। জমিদারের বাড়ির মেয়ে হলে কী হবে, দুজনের ভেতর এক রত্তি অহংকার নেই। আমাদের শায়লা কথায় কথায় কেমন মনে করিয়ে দেয় ওর দাদা জমিদার ছিলেন। কেউ অন্যায় কিছু করলে বলে দেখতে হবে তো কোন বংশের মেয়ে। অথচ নিজে যে লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো তা নিয়ে কোন লজ্জা নেই। প্রতিমাদি আর প্রতিভাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাবা কী করেন বলে স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আসলেই তাই । প্রতিমাদি বলেছেন, জমিদারের ছেলে–এই অপবাদ ঘোচানোর জন্য বিভূতি কাকা গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করেন। ওদের দেখে মনে হয়েছে জমিদারদের বংশে ভালো লোকও জন্মাতে পারে। খাওয়ার সময় দেখেছি মুসলমান বলে ছোঁয়াছুয়ির কোন বালাই নেই। আরতিদের বাড়িতে ওর ভাইয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে তোর মনে আছে কী হয়েছিলো। হিন্দু মেয়েদের এক টেবিলে আর মুসলমান মেয়েদের আলাদা টেবিলে খেতে দিয়েছিলো। হিন্দুদের ভেতর যারা উঁচু জাতের তারা বসেছিলো বাড়ির ভেতরে। বিভূতি কাকারাও ব্রাহ্মণ। ওদের ভেতর এ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি নেই। সেদিন খাবার টেবিলে বাবা ছোঁয়াছুয়ি নিয়ে কী একটা কথা বলাতে কাকিমা বলেছিলেন, আমাদের হিন্দু না ভেবে শুধু মানুষ ভাবুন না নূরুদা। তাহলে দেখবেন অনেক ঝামেলা মিটে যাবে। এ কথাটা আমারও মনে হয়, আমাদের ভেতর যদি ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ না থাকতো তাহলে অনেক ভালো হতো।

এতক্ষণ তো আমার কথা বললাম। এবার তোদের কথা বল। রাতে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুলেই তোদর কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে তোর কথা। তোর মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি জানি আমাকে ওভাবে ফেয়ারওয়েল দেয়া, এত সব উপহার সবই তোর জন্য। শুয়ে শুয়ে ভাবি তুই আমার জন্য এত কিছু করেছিস, কিন্তু তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমি জানি একদিন আনন্দময়ী স্কুলের সবাই আমার কথা ভুলে যাবে, শুধু তুই আমাকে মনে রাখবি। আমিও তোকে কোনদিন ভুলতে পারবো না………….  

নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম ছুটির দিন দুপুরে তানিয়া ওর বিছানার পাশে পড়ার টেবিলে বসে পারুলকে চিঠি লিখছিলো। চিঠি লেখা তখনও শেষ হয়নি, ঘাড়ের ওপর গলা বাড়িয়ে প্রতিভা বললো, এত মনোযোগ দিয়ে যাকে চিঠি লিখছিস তানিয়া? কাকে কোনও দিন ভুলবি না? ছেলে বন্ধু বুঝি। ঢাকায় ফেলে এসেছিস?

ঝট করে খাতার আড়ালে চিঠি লুকিয়ে তানিয়া লজ্জাভরা গলায় বললো, কী আবোল তাবোল বকছিস প্রতিভা! ছেলে বন্ধু কেন হবে? চিঠি লিখছিলাম আমাদের আনন্দময়ী স্কুলের পারুলকে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু!

প্রতিভার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনই ওরা তুমি থেকে তুইতে নেমে এসেছে। প্রতিভাই প্রথম বলেছে, নতুন স্কুলে আমি তোমার প্রথম বন্ধু। কী আপত্তি নেই তো?

তানিয়া বলেছে, বন্ধু হলে আর তুমি তুমি বলা কেন। তুই বললেই তো হয়।

তুই যদি বলিস তাহলে আমিও বলবো।

তুই যদি আপত্তি না করিস–

গত কদিনে ওদের সম্পর্ক আরও গম্ভীর হয়েছে। পারুলের কথা তানিয়া পরিচয়ের প্রথম দিনই প্রতিভাকে বলেছে। পারুলকে চিঠি লিখছে শুনে প্রতিভা বললো, কী লিখেছিস দেখাবি না?

পারুলের চিঠি, তুই কেন দেখবি!

ঠিক আছে। তানিয়ার বিছানায় বসে ভারি গলায় প্রতিভা বললো, আমি তোের কে? আমাকে কেন তোর বন্ধুকে লেখা চিঠি দেখাবি!

তানিয়া জানে কী অসম্ভব অভিমানী মেয়ে প্রতিভা। এরপর নিজে থেকে কথা বলবে না। তানিয়া কিছু জিজ্ঞেস করলে গম্ভীর হয়ে দায়সারা জবাব দেবে। নিজে কষ্ট পাবে, তানিয়াকেও কষ্ট দেবে।

তানিয়া হেসে খাতার নিচে লুকিয়ে রাখা চিঠিটা বের করে বললো, অমনি রাগ হয়ে গেলো! নে পড়।

প্রতিভা উদাস গলায় বললো, করুণা করছিস? চাই না তোর করুণা। তোর চিঠি তুই পড়গে।

চেয়ার থেকে উঠে প্রতিভার পাশে বসে তানিয়া বললো, তুই তো জানিস প্রতিভা, তুই যদি আমার ওপর রাগ করিস তখন আমার কী রকম খারাপ লাগে। প্লীজ, রাগ করিস না।

কোন অধিকারে তোর চিঠি পড়বো?

বন্ধু হওয়ার অধিকারে। পারুলকে আমি তোর কথা লিখেছি।

সত্যি! প্রতিভার সব রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো। দেখি তো কী লিখেছিস!

এক নিঃশ্বাসে চিঠি পড়া শেষ করে প্রতিভা আনন্দে আত্মহারা হয়ে–তুই আমাকে এত ভালোবাসিস, বলে জড়িয়ে ধরলো তানিয়াকে।

তানিয়া হাসলো, আরে ছাড় ছাড়। মিসেস পেরেরা দেখলে কী ভাববেন বলতো!

পাশের বিছানায় ঘুমোচ্ছিলো তানিয়াদের ক্লাসের ফারজানা। ওদের খুনসুটি শুনে কখন যে ওর ঘুম ভেঙেছে তানিয়ারা টের পায়নি। ফারজানা হাই তুলে বললো, তানিয়ার বন্ধু ভাগ্য দেখে আমার হিংসে হচ্ছে।

ফারজানার পাশের বিছানা থেকে চুমকি বললো, আমারও।

ফারজানা আর চুমকির কথা শুনে তানিয়ারা হাসতে হাসতে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তানিয়ার চিঠি তখনও প্রতিভার হাতে। পিটি গ্রাউন্ডের পাশে কাঁঠাল গাছের নিচে বাধানো বেদিতে বসে তানিয়া বললো, চিঠিটা পোস্ট করতে দিয়ে দিই।

স্কুলের নিয়ম হচ্ছে ছাত্রীরা ওদের চিঠি খোলা খামে হোস্টেল সুপারের কাছে জমা দেবে। সব চিঠি সেন্সর হয়ে জায়গা মতো যাবে। তানিয়ার কথা শুনে প্রতিভা হেসে ফেললো–আসলে তুই এত সরল না! স্কুল সম্পর্কে যেসব কথা লিখেছিস এর পরও আশা করিস এ চিঠি ডাকে দেয়া হবে?

এসব কথা বাদ দিলে লিখবো কী। পারুলরা জানতে চাইবে না নতুন স্কুল কেমন?

তুই ভাবিস না। বনমালী আসার সময় হয়েছে, ওকেই দিস ঠিক মতো স্ট্যাম্প লাগিয়ে ডাক বাক্সে ফেলে দেয়ার জন্য।

শুক্রবারে ছুটির দিনটায় স্কুলের লৌহকঠিন শৃঙ্খলায় কিছু নরম থাকে। লৌহকঠিন শৃঙ্খলা শব্দটা মিসেস পেরেরা প্রায়ই ব্যবহার করেন। সামান্য অনিয়ম দেখলেই কপালের চামড়ায় কয়েকটা ভাঁজ ফেলে বলবেন, এটা শৃঙ্খলার ব্যাপার। আমাদের লৌহকঠিন শৃঙ্খলার ভেতর মানুষ হতে হবে। তবেই আমরা শক্ত মাটির ওপর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো।

ছুটির দিনের শেষ দুপুরে সারা স্কুল সুনসান। মেয়েরা সবাই যে যার বিছানায়। তানিয়ার চিঠি পড়ে প্রতিভার ভালো লেগেছে নিজের প্রসঙ্গটুকু, খারাপ লেগেছে স্কুলের ব্যাপারে তানিয়ার মন্তব্য। প্রতিভা মনে করে ভারতেশ্বরী হোমস-এর চেয়ে ভালো স্কুল বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। তানিয়াকে বললো, স্কুল কি তোর ভালো লাগছে না?

আমি কখনও বোর্ডিং-এ থাকিনি প্রতিভা। নিচু গলায় তানিয়া বললো, বায়োয়ারি বাথরুম পরিষ্কার করাটা আমার মোটেই ভালো লাগে না।

কোনও কাজকে ছোট ভাবতে নেই তানিয়া।

আমি ছোট কাজ বলছি না। আমার খারাপ লাগে তাই বলছি।

কিছুদিন পর দেখবি স্কুল ঠিকই ভালো লাগবে।

ঠিক আছে, তখন পারুলকে ভালো লাগার কথা লিখবো।

.

তানিয়ার মা মারা যাওয়ার পরই ওর বাবা ঠিক করেছিলেন মেয়েটার লেখাপড়া শেষ হলে ভালো একটা ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিয়ে নিজে শহরের পাট চুকিয়ে গ্রামে গিয়ে থাকবেন। স্কুলের চাকরি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শহরে আর নয়। কদিন পরে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একাই তো থাকতে হবে। তানিয়াকে বোর্ডিং স্কুলে দিলে একা থাকার সময়টা শুধু এগিয়ে আসবে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তানিয়াকে ছেড়ে একা কিভাবে থাকবেন ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিলো ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েটার সঙ্গে মোটেই ভালো ব্যবহার করেননি। আসলে স্নেহ মমতা সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ভালোবেসে কী লাভ যদি ধরে রাখা না যায়? তানিয়ার মাকে হারিয়ে বাবার জীবনটা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়েছিলো।

গ্রামে এসে ছেলেবেলার বন্ধু বিভূতিকে নিয়ে মাছ আর সবজির খামার আরম্ভ করলেন। খামার করতে গিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে ছুটির দিনে তানিয়াকে দেখতে যাওয়ার সময়ও তাঁর হয়নি। প্রতিভাদের বাড়ির বনমালী অবশ্য প্রতি শুক্রবার আসে। কাকীমা ওর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি নাড়, নারকেলের চিড়া, নিমকি আর মোহনভোগ পাঠান। মোহনভোগটা রাখা যায় না, সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। নিমকি, নাড়, চিড়া–এগুলো কৌটোয় ভরে অনেক দিন রাখলেও নষ্ট হয় না। অনেক দিন রাখা সম্ভব হলেও রাখা যায় না। তানিয়া ছাড়াও প্রতিভার আরও বন্ধু আছে। ওদেরও দিতে হয়।

বিভূতিরঞ্জনের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে দুটো থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করেন না তানিয়ার বাবা। তানিয়াকে স্কুলে রেখে ফেরার পথেই তিনি বন্ধুকে বলেছেন, নূরউদ্দিন শোন, ভেবে দেখলাম তোমার বাড়িটাই খামারের অফিস করার জন্য উপযুক্ত জায়গা। ভিটেটাতো পাকা আছেই। দুটো ঘর বাড়িয়ে দেয়াল তুলে ফেল। ওপরে টিনই থাকলো। খামারের অফিসটা মজবুত হওয়া দরকার।

আমি ভেবেছিলাম টাকা যেটা দেবে নদীর ধারে কয়েক বিঘা জমি লীজ নেবো। একটা পাহারাদারও রাখা দরকার। এত টাকা কোথায় পাবো? চিন্তিত গলায় কথাগুলো বলেছিলেন বাবা।

আমার এত জমি থাকতে লীজ নিতে যাবে কেন? পাহারাদার একটা নয়, দুটো লাগবে। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা পাহারা লাগবে। এ ছাড়া একজন পিয়নও লাগবে ছুটোছুটির কাজ করার জন্য।

পিয়নের দরকার হবে কেন? ছুটোছুটির কাজ আমিই করতে পারবো।

নিশ্চয় পারবে। তবে পিয়নের কাজে যে সময়টা ব্যয় করবে সে সময়টা যদি খামারের আয় বাড়ানোর জন্য মাথা ঘামাও সেটা অনেক লাভের ব্যাপার হবে। .

গ্রামে রাজমিস্ত্রি পাওয়া যাবে?

গ্রামে পাওয়া যাবে না। মিস্ত্রি, ইট, বালি সব মীর্জাপুর থেকেই আনতে হবে।

দুদিনের ভেতর জিনিষপত্র সব জোগাড় হয়ে গেলো। তিন দিনের মাথায় মিস্ত্রিরা কাজ আরম্ভ করলো। তানিয়ার বাবা আর বিভূতি কাকা–দুই বন্ধু মিলে সারাক্ষণ তদারক করলেন। বুয়ার ছেলে কালার চাকরি হয়ে গেলো খামারে। বুয়ার উৎসাহের অন্ত নেই। শুনেছে জমিদার বাবু ঘন ঘন চা খান। ডাক না পড়লেও ঘণ্টায় ঘন্টায় কালাকে ডেকে চা বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কতগুলো ঘটনার পর বিভূতিরঞ্জনের মনে হয়েছিলো রত্নেশ্বরীকে তিনি যত আপন ভাবুন, গ্রামের অনেক মানুষই তাঁকে আপন ভাবে না। ছেলেবেলার বন্ধু নূরউদ্দিনের সঙ্গে খামার করতে গিয়ে নতুন করে নিজের গ্রামটাকে আপন ভাবা আরম্ভ করলেন।

বাইশ দিন পর তানিয়াদের পুরোনো বাড়ির জায়গায় নতুন যে বাড়িটা উঠলো দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে গেলো। রঙের কাজ শেষ হওয়ার পর প্রতিমা আর ওর মা এসেছিলেন দেখতে। ছবির মতো সুন্দর বাড়িটা দেখে প্রতিমা বললো, বাবা তোমরা আলাউদ্দিনের প্রদীপ পেয়েছিলে? সেদিন কী দেখলাম আর এখন কী দেখছি!

বিভূতিরঞ্জন বললেন, মিস্ত্রি বেশি লাগিয়েছিলাম। রাজমিস্ত্রি আর কাঠমিস্ত্রি এক সঙ্গে কাজ করেছে।

তানিয়ার বাবা মৃদু হেসে বললেন, পানির মতো টাকাও খরচ করতে হয়েছে।

প্রতিমার মা বললেন, টাকা খরচ করলেই কি জিনিষ ভালো হয়! রুচিও থাকা দরকার।

বাড়ি বানাবার বাজেট প্রথমে দেড় লাখ ধরা হয়েছিলো। রঙের কাজ শেষ হওয়ার পর টাকার অঙ্ক দু লাখ ছাড়িয়ে গেলো। পুরোনো বাড়ির টিনগুলো শুধু কাজে লেগেছে। তারপরও ঘর বাড়ানোর জন্য নতুন টিন কিনতে হয়েছে। রঙ করার পর নতুন আর পুরোনো সব এক রকম হয়ে গেছে। পুরোনো বাড়ির বাঁশের বেড়াগুলো টিনের নিচে সিলিং দেয়া হয়েছে। এতে গরম কম লাগবে। তানিয়ার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমও হয়েছে। তবে ইলেকট্রিসিটি আসা পর্যন্ত শাওয়ার আর বেসিনের কল ব্যবহার করা যাবে না, বালতির পানিতে কাজ সারতে হবে।

প্রতিমা ওর মাকে নিয়ে বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখলো। বুয়া মহা উৎসাহে ওদের বীজতলা পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনলো। পেঁপের চারা গজিয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় টিয়া পাখির পালক বিছিয়ে রেখেছে কেউ। তানিয়ার ঘরটাও ভালো লাগলো প্রতিমার। জানালা খুললে একদিকে বাঁশঝাড়, আরেক দিকে পুকুর। মনে মনে ভাবলো তানিয়া দেখলে খুবই অবাক হবে। বাবার কাছে শুনেছে তানিয়ার মা মারা যাওয়ার পর নূরু কাকু মেয়েকে নিয়ে কী কষ্টই না করেছেন।

প্রতিমার মা জানতে চাইলেন, গৃহপ্রবেশ কখন হবে নূরুদা?

তানিয়ার বাবা বিব্রত হলেন–প্রতিভা আর তানিয়া আসুক।

বিভূতিরঞ্জন বললেন, আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি রোজার বন্ধ শুরু হতে। তানিয়াকে দারুণ একটা সারপ্রাইজ দেয়া যাবে।

প্রতিমা বললো, বাবা, বনমালী আবার তানিয়াকে বলে দেয়নি তো?

না, আমি বারণ করে দিয়েছিলাম।

নূরুদা আপনি কি রোজা রাখেন? তানিয়ার বাবার কাছে জানতে চাইলেন প্রতিমার মা।

ছোটবেলায় মাঝে মাঝে রাখতাম। বড় হয়ে কখনও রাখিনি।

তাহলে গৃহপ্রবেশের রান্নাটা আমিই করবো। তানিয়া আর প্রতিভা যেদিন আসবে সেদিনই গৃহপ্রবেশ হবে।