৪. রাতে কারা আসে

তানিয়া ঘুমিয়েছিলো অনেক রাতে। শেষ রাতে স্বপ্ন দেখলো, ওদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় দারুণ সুন্দর একটা মেয়েদের স্কুল। নীল সাদা ইউনিফর্ম পরে ছোট ছোট মেয়েরা ছুটোছুটি করছে। মরিয়ম আপার মতো চশমা পরে তানিয়া ক্লাসে ভূগোল পড়াচ্ছিলো। বললো, কে কে হোমওয়ার্ক আনননি উঠে দাঁড়াও। ওর কথা শুনে করুণ মুখে লাইলি উঠে দাঁড়ালো। মরিয়ম আপার মতো তানিয়া বলতে যাবে–ইউ নটি গার্ল হোমওয়ার্ক কেন করোনি, তখনই বুয়া ঢং ঢং করে ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দিলো। মেয়েরাও সবাই দুদ্দাড় করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো।

ভোরে বুয়ার ডাকে তানিয়ার ঘুম ভাঙলো। বুয়া জানালা খুলে দিয়েছে। বাইরে সব কিছু সাদা কয়াশায় ঢাকা। মশারি তুলতে তুলতে বুয়া বললো, তুমি খোয়াব দেখতাছিলা।

তুমি জানলে কীভাবে? হাই তুলে জিজ্ঞেস করলো তানিয়া।

কী জানি ওয়াক ওয়াক কইরা ইংরেজি কইতাছিলা। বুয়া হাসতে হাসতে বললো, ল্যাখাপড়া শিখলে ইংরেজি খোয়াব দেখন যায়।

আমি কী দেখেছি জানো? তুমি গার্লস স্কুলে ঘন্টা বাজাচ্ছো।

তোবা তোবা! আমি ক্যান ব্যাডাগো সামনে ঘন্টা বাজামু? মাইনষে কইবো কী!

মেয়েদের স্কুল। আমাদের বাড়ির সামনে হয়েছে। তোমাকে সবাই দপ্তরি আপা বলছিলো।

লাজুক হেসে বুয়া বললো, হইলে তো ভালই হয়। এবার ওঠো। তোমার গরম পানি ঠাণ্ডা ওইয়া যাইতাছে।

বুয়া উঠেছে অন্ধকার থাকতেই, যখন মোরগরা প্রথম ডেকেছে। ওদের ঘর থেকে একটু দূরে রান্নাঘর। লাইলির মা ওদের বাড়িতে নাশতা খেতে বললেও বুয়া জানে তানিয়া শীতকালে গরম পানি না হলে মুখ ধুতে চায় না। বাপ আর মেয়ে দুজনেরই ঘুম থেকে উঠে নাশতা করার আগে এক কাপ চা চাই। অন্যের বাড়িতে এসব আবদার না করে নিজেরা করা ভালো, এই ভেবে ভোর না হতে বুয়া রান্নাঘরে ঢুকেছে।

তানিয়ার বাবার সব দিকে খেয়াল থাকে। মাটির চুলোটা পরিষ্কার করিয়ে রেখেছেন। এক পাশে শুকনো লাকড়ি। শুধু হাড়ি পাতিলের কাঠের বাক্সটা খোলা হয়নি। ওটার চাবি বুয়ার আঁচলে বাধা। ঢাকার বাড়ির রান্নাঘরের মিটসেফটাও জায়গা মতো রাখা। তানিয়ার মা মারা যাওয়ার আগের বছর ভারি শখ করে বানিয়েছিলেন মিটসেফটা। কথাটা মনে পড়তেই বুয়ার বুকটা টন টন করে উঠেছিলো। এরকম সাজানো সংসার ফেলে অসময়ে চলে গেলো। বুয়াকেও কী কম যত্নে রেখেছিলেন! কখনও বুঝতে দেননি ও যে বাড়ির চাকর। নিজের পরনের শাড়ি ওকে পরতে দিতেন। দুই ঈদে ভালো শাড়ি কিনে দিতেন। গায়ের চাদর, সুয়েটার, স্যাণ্ডেল দুই জোড়া–কী দেননি বুয়াকে! একা রান্নাঘর গোছাতে গোছাতে এসব কথা ভাবছিলো বুয়া।

তানিয়ার গরম পানি করতে করতে আকাশ ফর্শা হয়ে গেলো। বাপ বেটি দুজনেরই সকালে ওঠার অভ্যাস। তানিয়া স্কুলে যাওয়ার আগে এক ঘন্টা পড়ার টেবিলে কাটায়। বাবা বলেন, ভোরবেলার পড়া বেশি মনে থাকে। তানিয়া নিজেও জানে কথাটা মিথ্যে নয়। মনে রাখার জন্য রাতে যা তিন চার বার পড়তে হয় ভোরে একবার পড়লেই চলে।

গ্রামের বাড়িতে প্রথম সকালে তানিয়া অবশ্য পড়তে বসেনি। মুখ ধুয়ে গায়ে উলের গরম চাদর জড়িয়ে সামনের বারান্দায় এসে বসেছে। বাবা বেতের সোফা বিক্রি করে দিয়ে শুধু ডাইনিং টেবিলের গোটা চারেক কাঠের চেয়ার আর ড্রইং রুমের তিনটা বেতের চেয়ার রেখেছেন। দুটো স্টিলের আলমারি ছিলো, একটা বিক্রি করে দিয়েছেন। জিনিষপত্র বিক্রি করে বাবা পনের হাজার টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকায় তানিয়ার স্কুলের পোষাক, খাতাপত্র কিনতে হয়েছে। জয়াদি ওর টিউশন আর বোর্ডিং ফি মাপ করে দিয়েছিলেন। তারপরও অন্য সব জিনিষপত্র কিনতে তিন হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।

কাল শনিবার তানিয়া নতুন স্কুলে যাবে। শুনেছে ভীষণ কড়াকড়ি নাকি সেখানে। ওদের ক্লাসের আরতির বড় বোন পড়তো ভারতেশ্বরী হোমস-এ। তানিয়া সেই স্কুলে ভর্তি হবে শুনে আরতি ওকে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়েছে। শুনে তানিয়ার মনে ভয় আর আনন্দের একটা মিশ্র অনুভূতি হয়েছে।

উঠোনে এক পাল বাচ্চা নিয়ে দুটো মুরগি চরে বেড়াচ্ছিলো। বাচ্চারা ঘাসের ভেতর খাবার খুঁজছে। মায়েরা একটা কিছু পেলে কঁক কঁক করে বাচ্চাদের ডাকছে। আর বাচ্চারা কিচ কিচ করে ছুটে গিয়ে মাকে ঘিরে ধরছে। তানিয়া ভাবলো রোজার বন্ধে বাড়ি এলে হাঁস আর মুরগি পুষবে।

মা পুষতেন কুকুর। কালো সরাইলের কুকুর ছিলো ওদের। মা মারা যাওয়ার সাত দিন পর কুকুরটা মরে গিয়েছিলো। এতে অবশ্য বুয়া খুশি হয়েছিলো। কুকুর একেবারে পছন্দ করে না বুয়া। বলে, কুত্তা হইলো নাপাক জিনিষ। গায়ে লাগলে ওজু নষ্ট হয়। আমগো নবীজি পুষতেন বিলাই । ইন্দুরেরও ডর নাই, পুষলে সুন্নতও হয়।

বাবা বললেন, গ্রামের বাড়ি কেমন লাগছে তানিয়া?

হঠাৎ বাবার গলা শুনে চমকে উঠলো। বাবা কখন ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পায়নি। বললো, ভালো লাগছে বাবা। তুমি যে ফার্মের কথা ভাবছো সেখানে হাঁস মুরগি থাকবে?

আমি মাছের খামারের কথা ভাবছিলাম। তুই যদি চাস হাঁস মুরগিও থাকতে পারে।

বাবাকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুয়া ওর ঘর থেকে বেতের চেয়ার বের করে দিলো। বললো, খালু চা দেই?

বাবা মৃদু হেসে বললেন, দিতে চাইলে দাও। শহরের সব অভ্যাস কী গেরামে রাখতে পারুম!

এইটা কি কন খালু? আমি কি মরছি?

বুয়া চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলো। তানিয়া ভাবছিলো কাল রাতের কথা বাবাকে বলবে কিনা। বুয়ার অবশ্য ধারণা ওটা তানিয়ার চোখের ভুল। একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললো, বাবা জানো কাল রাতে আমি অদ্ভুত এক জিনিষ দেখেছি।

বলিস কী? বাবা অবাক হলেন–কখন, কোথায় দেখলি?

রাত তখন বারোটার মতো হবে। আমার ঘুম আসছিলো না। জানালার দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখি দুটো কালো ছায়ার মতো, জানালার কাছে নড়াচড়া করছিলো। বুয়ার গলা শুনে হাওয়া হয়ে গেলো।

বাবা হেসে বললেন, গ্রামের বাড়িতে এসেই রহস্য আর এ্যাডভেঞ্চার খোঁজা শুরু করেছিস?

রহস্য বলছো কেন বাবা? চোর-টোরতো হতে পারে!

গ্রামে চোররা খোঁজ খবর নিয়ে আসে। জানে আমার বাড়িতে এক রত্তি সোনা কিংবা নগদ হাজার খানেক টাকাও পাবে না। এ বাড়িতে কখনও চোর আসবে না।

বাবার কথা শুনে তানিয়া দমে গেলো। চোর যদি না হয় তাহলে তো খুবই ভয়ের কথা। ঢাকা থাকতে বুয়া প্রায়ই গ্রামের এই বাড়ি নিয়ে দুঃখ করতো। গিরস্তের বাড়ি, বেশি দিন খালি রাখতে নাই। খালু বছরে একবার যায় দুই তিন দিনের লাইগা। সারা বছর খালি থাকে। এইডা ভালা কথা না। খবিস জ্বীনেরা এই রকম বাড়ির তালাশে থাকে।

চা খাওয়া শেষ হতেই লাইলি আর রাজন এলো তানিয়াদের ডাকতে। দুজনে দুটো মোটা খদ্দরের চাদর গায়ে জড়িয়ে শীতে কাঁপছিলো। বাবা বললেন, লাইলি রাজন ভেতরে এসে বস। তোমাদের গরম কাপড় নেই?

রাজন লজ্জায় আধখানা হয়ে গেলো। লাইলি বললো, আমাগো গরম সুয়েটার ইশকুলে যাওনের সময় পরি।

তানিয়া ওর বাবার কানে কানে বললো, আমার দুটো সুয়েটার ছোট হয়ে গেছে। ওদের দেবো?

বাবা হেসে বললেন, ওদের জিজ্ঞেস কর।

তানিয়া ওদের জিজ্ঞেস করার দরকার মনে করলো না। ঘরে গিয়ে ওর সুটকেস থেকে সুয়েটার দুটো বের করলো। একটা ক্লাস ফোরে থাকতে মা বুনে দিয়েছিলেন। আরেকটা একটু বড়, দোকান থেকে কেনা। ক্লাস সেভেনে থাকতেই ও হঠাৎ লম্বা হয়ে যাওয়াতে এক সঙ্গে অনেকগুলো জামা কাপড় ছোট হয়ে গেছে। কিছু অবশ্য বুয়া নিয়েছে তার নাতি নাতনিদের জন্য।

তানিয়ার সুয়েটার দুটোর বড়টা মেরুন রঙের, ছোটটা সবুজের ভেতর হলুদ ফুল তোলা, মোটেই পুরোনো মনে হয় না। রাজন আর লাইলি সুয়েটার পেয়ে দারুণ খুশি। তানিয়া বললো, এখনই পরে ফেল।

লাইলি রাজনের এত সুন্দর সুয়েটার ঘরে পরতে ইচ্ছে করছিলো না। ওরা স্কুলে যাওয়ার সময় যে সুয়েটার পরে সেগুলোর চেয়ে এগুলো অনেক সুন্দর। তবু তানিয়ার মন রাখার জন্য ওরা সুয়েটার পরলো। শীতে কুঁকড়ে যাওয়া ওদের জবুথবু চেহারা ঝলমল করে উঠলো।

বুয়া যে লাইলি রাজনকে সুয়েটার দেয়া পছন্দ করেনি এটা ওর চেহারা দেখেই তানিয়া বুঝে ফেলেছিলো। তবে বাবার ভয়ে বুয়া এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করলো না। রাগ দেখিয়ে বুয়া ওদের সঙ্গে নাশতা করতে যায়নি। বলেছে হাতের কাজ সেরে পরে যাবে।

তানিয়াদের চাচী খেতে দিয়েছিলেন রসে ডোবানো চিতই পিঠা। এত মজার পিঠা তানিয়া কখনও খায়নি। মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিঠার টুকরো মাখনের মতো গলে যাচ্ছিলো। তানিয়ার প্রশংসা শুনে চাচী ওর প্লেট পিঠা আর রসে ভরে দিলেন।

চাচা ভোর না হতেই বেরিয়েছেন। তানিয়া বলাতে লাইলি রাজন দুজনই ওদের সঙ্গে খেতে বসেছে। খেতে খেতে তানিয়া হালকা গলায় বললো, জানো লাইলি কাল রাতে না চোর এসেছিলো।

কখন আইছে? কী চুরি করছে?

চুরি করতে পারেনি। বলে তানিয়া রাতে ছায়ামূর্তি দেখার ঘটনাটা খুলে বললো। শুনে লাইলি রাজনের কপালে চোখ উঠলো।

তানিয়ার কথা শুনে বাবা মৃদু হেসে বললেন, তানিয়া, কেন বেচারাদের ভয় দেখাচ্ছিস। বললাম না আমাদের বাড়িতে চোর আসতে পারে না!

ওরা যদি চোর না হয় তাহলে তো আরও ভয়ের কথা বাবা! বুয়া বলছিলো আমাদের বাড়িতে খবিস জ্বীন থাকতে পারে।

এটা ভালো বলেছিস। বাবা শব্দ করে হাসলেন, যদি এটা দশ কান হয় জীবনেও বাড়িতে চোর ডাকাত আসবে না।

চাচী শুকনো গলায় বললেন, ভাইজান, জ্বীন ভূত নিয়া ঠাট্টা করন ভালা না। আপনের ঘরে সোমথ মেয়্যা। কখন কী হয় কিছুই কওন যায় না।

চাচীর কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন বাবা–আপনি তো জানেন না, আমরা হইলাম পীরের বংশ। আমার পরদাদা দুইটা জ্বীন পালতেন।

বাবাকে এসব ব্যাপারে কিছু বলা যে অর্থহীন এটা বুঝতে চাচীর দেরি হলো না। কথা না বাড়িয়ে লম্বা ঘোমটা মাথায় দিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন।

লাইলিদের বাড়িতে নাশতা সেরে বাবা তানিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরুলেন পুকুর দেখাতে। বাবার ভাগে মস্ত বড় পুকুর পড়েছে। পুকুর ভর্তি মাছ, সারাক্ষণ ঘাই মারছে। বাবা বললেন, আজ আমরা পুকুরের তাজা মাছ খাবো।

কে ধরবে তুমি? কথাটা শুনে তানিয়া আনন্দে উত্তেজিত হলো।

আমি কি মাছ ধরতে পারি না ভেবেছিস? আফটার অল আমি তো গাঁয়েরই ছেলে। এ পুকুরে ছেলেবেলায় কম মাছ ধরেছি!

কী দিয়ে ধরবে?

কেন, জাল দিয়ে রান্নাঘরে জাল দেখিসনি?

গত রাতে বুয়া হারিকেন হাতে তানিয়াকে সবগুলো ঘর ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। অন্ধকারে রান্নাঘরে রাখা জাল ওর চোখে পড়েনি।

চলো না বাবা, এখনই ধরবে। আমি দেখবো।

চল। বলে বাড়ির উঠোনে পা রেখে বাবা থমকে দাঁড়ালেন।

তানিয়া বাবার পেছন পেছন আসছিলো। সামনে তাকিয়ে দেখে বারান্দায় বেতের চেয়ারে ধুতি পাঞ্জাবি পরা মাঝবয়সী এক সুদর্শন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাঁর পাশে অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। দেখে মনে হয় কলেজে পড়ে। পরনে চওড়া নকশা পাড়ের টিয়া রঙের টাঙ্গাইল শাড়ি। গায়ে লাল আলোয়ান জড়ানো।

বাবা উচ্ছ্বসিত গলায়–আরে, বিভূতি যে! কখন এলে? বলে এগিয়ে গেলেন।

তানিয়া বুঝলো ইনিই বাবার স্কুল জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বিভূতিরঞ্জন। বাবার কাছে এঁর অনেক গল্প শুনেছে। ওঁর বাবা ঠাকুর্দারা জমিদার ছিলেন। এখন অবশ্য আগের অবস্থা নেই, তবু যা আছে আরও দুতিন পুরুষ বসে খেতে পারবে। শখ করে গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করেন, তবে বেতন নেন না। পরির মতো সুন্দর মেয়েটির কথাও তানিয়া শুনেছে। ওর নাম প্রতিমা। ওর ছোট বোনের নাম প্রতিভা।

বাবা এগিয়ে গিয়ে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হুট করে কলকাতা চলে গেলে, ফিরলে কবে?

কাল সন্ধ্যায়। তোমার চাকরি নেই জেনে একটুও খারাপ লাগেনি, যখন শুনেছি তুমি এখন থেকে গ্রামে থাকবে। এরপর তার চোখ পড়লো তানিয়ার ওপর–বাহ, মেয়ে কত বড় হয়েছে। ঠিক মার মতো দেখতে।

তানিয়াকে কেউ যদি মার মতো বলে ওর খুব ভালো লাগে। মা ছিলেন অসাধারণ রূপসী।

প্রতিমা এগিয়ে এসে তানিয়ার হাত ধরে বললো, এই মিষ্টি মেয়েটির নাম তানিয়া না? কোন ক্লাসে পড়ো।

ক্লাস এইটে। তানিয়া মৃদু হেসে বললো, আপনি তো প্রতিমা-–প্রতিমাদি।

ঠিক ধরেছো। তোমার কথা বাবার কাছে শুনেছি। তুমি জন্মেছো হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। আমরা তোমাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। এত্তটুকুন ছিলে।

আপনিও তখন ভালো করে কথা বলতে শেখেননি। তানিয়া মনে মনে হিসেব করেছে, খুব বেশি হলে প্রতিমা ওর চার পাঁচ বছরের বড় হবে।

বিভূতি কাকা বললেন, মেয়েকে শুনলাম ভারতেশ্বরী হোমস-এ ভর্তি করেছো? প্রতিভাও এখন ভারতেশ্বরীতে পড়ে।

প্রতিভা এবার কোন ক্লাসে?

ক্লাস নাইনে উঠেছে। তানিয়াকে কোন ক্লাসে দিয়েছো?

এইটে। প্রতিভা যখন ভারতেশ্বরীতে তানিয়ার আর ভাবনা কী। আমি চিন্তিত ছিলাম, মেয়ে কখনও একা আমাদের ছেড়ে কোথাও থাকেনি।

তুমি এ নিয়ে ভেবো না। তানিয়া কবে থেকে স্কুলে যাবে?

ভাবছি কালই নিয়ে যাবো।

ঠিক আছে। আমিও যাবো তোমার সঙ্গে। প্রতিভার সঙ্গে তানিয়ার আলাপ করিয়ে দেবো। জয়াদির সঙ্গে কথা বলেছিলে?

তিনিই তো সব করে দিলেন। বিভূতি, তোমাদের চা দিতে বলি?

বলতে পারো। গিন্নি বলে দিয়েছেন দুপুরে তোমরা আমাদের বাড়িতে খাবে।

দুই বন্ধুর কথার মাঝখানে প্রতিমাকে নিয়ে তানিয়া ওর ঘরে গেছে। বাবা তানিয়াকে ডেকে বললেন, বুয়াকে বল আমাদের সবাইকে চা দিতে।

তানিয়া রান্নাঘরে গিয়ে দেখে বুয়া মাদুর পেতে এক লোককে রুটি আর ডিম ভাজি খেতে দিয়েছে। তানিয়াকে দেখে লোকটা জড় সড় হয়ে গেলো। বুয়া একগাল হেসে বললো, আমার পোলা, কালা। ও আইসা পড়ছে দেইখ্যা আর ওই বাড়িতে যাই নাই।

তানিয়া হেসে বললো, ছেলে একা কেন, তোমার নাতি নাতনিরা কোথায়?

হ্যারা বিকালে আসবো। খালুর কাছে দেখলাম মেহমান আসছে, চা দিমু?

চায়ের কথাইতো বলতে এলাম। কৌটোয় চানাচুর আছে না? খানিকটা দিও।

বুয়ার ছেলে বললো, মেহমান কারে কইতাছ মা? আমগো জমিদার বাবু তো!

বুয়া ব্যস্ত হয়ে বললো, হায় হায়, আগে কবি না? বয়স ওইছে, চোখে ভাল ঠাহর করি না। এতক্ষণ চা না দিয়া জমিদার বাবুরে বসায়া রাখলাম। বাবুর লগে হ্যাঁর মেয়াও তো আইছে। দুইটা ডিম ভাইজা দিমু?

দিতে পারো। বলে তানিয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ওর সামনে বুয়ার ছেলে লজ্জায় খেতে পারছিলো না। ঘরে এসে বাবাকে বললো, জানো বাবা, বুয়ার ছেলে এসেছে ওকে দেখতে।

বাবা মৃদু হেসে বললেন, ভালোই হয়েছে। মাছ ধরতে কালাকে লাগবে।

তুমি এখন মাছ ধরবে? তানিয়া বুঝতে পারছিলো না বিভূতি কাকাদের রেখে মাছ ধরতে যাওয়াটা ঠিক হবে কি না।

বিভূতি আমাদের দুপুরে ওদের বাড়িতে খেতে বলেছে। আমি বলেছি এক শর্তে। মাছ হবে আমার পুকুরের।

প্রতিমা বললো, শুধু দুপুরে নয় নূরু কাকু। রাতেও আমাদের ওখানে খাবেন সারাদিন আমাদের বাড়িতে থাকবেন।

বিভূতি কাকা হেসে বললেন, অনেক কথা জমে আছে নূরউদ্দিন। একদিনে কুলোবে না।

বাবাও হাসলেন–বাকি জীবন তো গ্রামেই কাটাবো বিভূতি। কত কথা বলতে পারো দেখবো।

তানিয়া লক্ষ্য করেছে বাবা যখন থেকে গ্রামে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন থেকে তাঁর স্বভাবের রুক্ষতা হারিয়ে গেছে। চেহারার একটা কোমল ভাব এসেছে, যেমন ছিলো মা বেঁচে থাকতে।

বুয়া বড় ট্রেতে করে চার জনের জন্য ডিমের অমলেট, বিস্কুট আর চানাচুর এনে বারান্দার বেতের টেবিলে রাখলো। বিভূতি কাকা বললেন, এত কে খাবে!

বুয়ার মাথায় লম্বা ঘোমটা টানা। বললো, আপনেগো খাতির করতে পারি সেই ক্ষমতা কি আমাগো আছে?

বাবা বললেন, তোমার কালাকে পাঠিয়ে দাও। আজ যদি ও কাজে না যায় এ বাড়িতে কাজ করুক।

আমাগো কাম থাকলে বাইরে যাওনের দরকার কী? বলে বুয়া চা আনতে গেলো।

একটু পরেই কালা এসে দাঁড়ালো বারান্দার নিচে। নিচু গলায় বললো, নানায় ডাকছেন?

ডাকছি আগে মাছ ধরনের লাইগা। দেখছ তো জমিদার বাবু আইছেন। আট দশ সেরি একটা ধরতে পারবা না? নাকি আমারও নামন লাগবো?

আমিই পারুম। আর কী করতে ওইবো?

বাড়ির পিছে জংলা সাফ করবা। পিছনের জমিতে পেঁপে আর কাগজি লেবুর বাগান করুম।

রান্নাঘর থেকে জাল কাঁধে নিয়ে কালা পুকুরে গেলো। প্রতিমা বললো, বাবা, তানিয়াকে নিয়ে মাছ ধরা দেখতে যাবো?

বিভূতি কাকা কিছু বলার আগে বাবা বললেন, যাও মা। এটা তো তোমাদের নিজেদের বাড়ি।

তানিয়াকে নিয়ে প্রতিমা পুকুরের দিকে যাওয়ার পর বিভূতি কাকা মুখ টিপে হেসে বললেন, মনে হলো একটু খোঁটা দিলে নূরউদ্দিন!

খোঁটা দেবো কেন? বাবা মৃদু হাসলেন–তুমি আমার কাছে দশ হাজার টাকা পাও বিভূতি।

ওই দশ হাজার তুমি নিয়েছিলে পাঁচ বছর আগে পুকুর পরিষ্কার করার জন্য। ওই টাকার সঙ্গে আমি আরও লাখ খানেক ইনভেস্ট করতে চাই, যদি তোমার খামারের পার্টনার করে নাও আমাকে।

বাবা অভিভূত গলায় বললেন, সত্যি বলছো বিভূতি? আমি গত সাত দিন ধরে ব্যাংকে দৌড়োদৌড়ি করছি লোনের জন্য। এক লাখ টাকা লোনের জন্য দশ হাজার টাকা ঘুষ চায়। ভাবতে পারো কী মগের মুলুকে বাস করি!

আমি থাকতে তুমি ব্যাংকে দৌড়োবে কেন? দরকার হলে দু তিন লাখও ইনভেস্ট করতে পারবো। তুমি গ্রামে থাকবে, এটা যে আমাদের জন্য কত বড় ভরসার কথা তুমি নিজেও জানো না।

কিছু কথা আমার কানে এসেছে। ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঘন্টা খানেক পর ছয় সাত সেরি দুটো রুই মাছ হাতে ঝুলিয়ে কালা এসে দাঁড়ালো বারান্দার নিচে। বললো, আগের রাইতে যদি চার ফালাইতাম দশ সেরি মাছ দশটা ধরতে পারতাম। বড় মাছ বহুৎ সেয়ানা।

বাবা বললেন, এই দুইটা জমিদার বাড়িতে দিয়া আয়।

বিভূতি কাকা আঁতকে উঠলেন–তুমি ক্ষেপেছো নূরউদ্দিন! আমাদের বাড়িতে খাওয়ার লোক কোথায়? একটা তুমি রাখো। কালা, একটা তোমার মাকে দিয়ে এসো।

জমিদার বাবুর কথার ওপর আর কারও কথা চলে না। কালা একটা মাছ রান্নাঘরে রেখে আরেকটা নিয়ে জমিদার বাড়ি রওনা দিলো।

ততক্ষণে তানিয়া আর প্রতিমাও এসে গেছে। প্রতিমা বললো, নূরু কাকু, চলুন। আমাদের বাড়িতে বসে গল্প করবেন। জানো বাবা, কাল রাতে তানিয়া ভূত দেখেছে।

বিভূতি কাকা শুকনো গলায় বললেন, আমরা এত বছর ধরে দেখছি, নুরউদ্দিনরা একবার দেখেছে–এ আর এমন কী।