১১. ভূতের টিলায় আলোর সংকেত

প্রতিমাদের ডাইনিং টেবিল মস্ত বড় শ্বেত পাথরের, চোদ্দ জন একসঙ্গে বসতে পারে। বিভূতিরঞ্জন বসেছিলেন টেবিলের এক মাথায়। তাঁর দুপাশে তানিয়ার বাবা আর সাদেক হোসেন। সাদেকের পাশের চেয়ারে মা বসেছেন। উল্টোদিকে বসেছে প্রতিমা, তানিয়া আর প্রতিভা। পিসিমা মাছ মাংস খান না। তিনি টেবিলে না বসে তদারকি করছিলেন।

খেতে খেতে কাজের কথার চেয়ে সাদেক খাবারের প্রশংসাই বেশি করলো। কাজের কথার ভেতর প্রতিমারা কে কি করে শুধু এসব জেনে নিলো। তানিয়া আর প্রতিভা লক্ষ্য করেছে অন্য সবার চেয়ে প্রতিমার সঙ্গে কথা বলতেই সাদেকের আগ্রহ বেশি। কারণে অকারণে ও প্রতিমার দিকে তাকাচ্ছিলো। প্রতিমা ভবিষ্যতে কী করবে, দিল্লীর পড়ার স্ট্যান্ডার্ড কেমন এসবও জিজ্ঞেস করলো। এর সঙ্গে তদন্তের কী সম্পর্ক তানিয়া আর প্রতিভা খুঁজে পেলো না।

রাতে তানিয়াকে বলা হয়েছিলো ইচ্ছে করলে ও আলাদা ঘরে থাকতে পারে,ইচ্ছে করলে প্রতিভার সঙ্গেও থাকতে পারে । তানিয়া শেষেরটাই পছন্দ করেছে। যত না আত্মার ভয়ে, তার চেয়ে বেশি প্রতিভার সঙ্গে গল্প করার লোভে।

শীতের রাত, এগারোটার ভেতর যে যার ঘরে গিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। টানা বারান্দা, সিঁড়ি আর ঝুল বারান্দার লাইট সারা রাত জ্বালানো থাকে। প্রতিমার ঘর টানা বারান্দার শেষ মাথায়। ঘরের দক্ষিণে বড় বড় জানালা। জানালার বাইরে খড়খড়ির পাল্লা, ভেতরে কাঁচের পাল্লা। দরজাগুলোেও তাই। প্রতিভা কাঠের দরজা বন্ধ করলেও কাঠের জানালা খোলা ছিলো। ভেতর থেকে জানালার কাঁচের পাল্লা বন্ধ করে দিয়েছে। একমাত্র প্রতিভার ঘর থেকেই পুরোনো মহলের ভূতের টিলা দেখা যায়। প্রতিমার ঘরের মতো প্রতিভার পালঙ্কেও চারজন অনায়াসে শুতে পারবে। বাতি নিভিয়ে লেপের তলায় ঢুকে প্রতিভা বললো, তোর কি ঘুম পেয়েছে তানিয়া?

তানিয়া বললো, বারোটার আগে কখনও আমি ঘুমোই না। শুধু স্কুলে গিয়ে দশটায় ঘুমের অভ্যেস করতে হয়েছে।

স্কুলে দশটায় না ঘুমোলে সাড়ে চারটায় উঠবি কীভাবে।

ঘুমের ব্যাপারটা ছাড়া স্কুলটাকে খারাপ লাগছে না।

স্কুলের কথা রাখ। আমাদের তদন্তকারী অফিসারকে কেমন দেখলি?

কেমন আবার, ভালোই তো দেখতে! এত হ্যাঁণ্ডসাম চেহারা নিয়ে সিনেমায় না নেমে পুলিশ লাইনে কেন এলো তাই ভাবছিলাম।

দিদির ওপর ওর চোখ পড়েছে।

দিদি যা সুন্দর দেখতে, যে কোনও ছেলেই ওর দিকে না তাকিয়ে পারবে না।

শুধু তাকিয়ে দেখা নয়, সাদেক হোসেন মনে হচ্ছে দিদির প্রেমে পড়ে গেছে।

ধ্যাৎ! কী যা তা বলছিস। দিদির চেহারা দেখে বুঝেছি ওকে মোটেই পাত্তা দেয়নি।

কাল এক ফাঁকে কায়দা করে ওকে জানিয়ে দিতে হবে সামনের সামারে যে দিদির বিয়ে হবে।

কী দরকার বলার! সাদেক হোসেন স্বপ্নেও দিদিকে বিয়ে করার কথা ভাববে না।

হঠাৎ প্রতিভা চমকে উঠলো। বাইরের জানালার দিকে মুখ করে শুয়েছিলো ও। তানিয়া শুয়েছে জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। উত্তেজিত গলায় প্রতিভা বললো, তানিয়া, পুরোনো মহলের দিকে তাকিয়ে দেখ!

তানিয়া পাশ ফিরে জানালার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলো–কী দেখবো?

হঠাৎ এক ঝলক আলো দেখলাম।

বলিস কী? পুরোনো মহলে আলো আসবে কোত্থেকে?

আকাশে চাঁদ না থাকলেও তারার আলোতে তরল অন্ধকারের ভেতর পুরোনো মহলের ভূতের টিলা আর চারপাশের গাছপালার গায়ে অন্ধকার জমাট বেঁধে ছিলো।

একটু পরে তানিয়াও দেখলো এক ঝলক আলো ফোয়ারার মতো ওপর দিকে উঠে আবার নিভে গেলো। প্রতিভা আগের মতো উত্তেজিত গলায় বললো, দেখলি?

তানিয়ার বুকের ভেতরও উত্তেজনা চিব ঢিব করছিলো। বললো, মনে হচ্ছে টর্চের আলো। কেউ কাউকে সংকেত পাঠাচ্ছে।

প্রতিভা আর তানিয়া বিছানার ওপর উঠে বসলো। প্রতিভা বললো, দিদিকে ডেকে দেখাই। ওর তো ধারণা পুরোনো মহলে অভিশপ্ত আত্মারা কিলবিল করছে।

প্রতিভা পালঙ্ক থেকে নেমে চেয়ারের ওপর রাখা আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। তানিয়াও ওর কার্ডিগানটা পরে নিলো। বাইরে কনকনে শীত।

খুব সাবধানে দরজা খুললো প্রতিভা। চাপা গলায় বললো, একেবারে দেয়াল ঘেঁষে হাঁটবি। নইলে বারান্দার আলোয় আমাদের দেখে ফেলবে।

প্রতিভার পাশের ঘরটা পিসিমার। তারপর প্রতিমার ঘর। ওরা ভেবেছিলো প্রতিমা বোধহয় ওদের মতো দরজায় ছিটকিনি তুলে বন্ধ করে দিয়েছে। কাছে গিয়ে দেখলো দরজা এমনি ভেজানো, ছিটকিনি লাগায়নি। আস্তে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। তাকিয়ে দেখলো টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে প্রতিমা বই পড়ছে।

দরজা খুলতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকলো। প্রতিমা পেছন ফিরে এদের দুজনকে দেখে অবাক হয়ে গেলো–কী রে, তোরা এখনও ঘুমোসনি?

প্রতিমার কাছে গিয়ে প্রতিভা আগে দেখলো ও কী বই পড়ছে। টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখা বইটা বারবারা কার্টল্যাণ্ডের লাভ আণ্ডার ফায়ার। ও ভেবেছিলো বুঝি ভূতের গল্প পড়ছে প্রতিমা। বললো, শিগগির আমার ঘরে চল দিদি। পুরোনো মহলে এক সাংঘাতিক জিনিস দেখাবো।

প্রতিমা ঘাবড়ে গিয়ে বললো, মাঝ রাতে পুরোনো মহলে সাংঘাতিক কী দেখলি?

চল না! নিজের চোখেই দেখবি।

প্রতিমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। সত্যিই কি কোনও অতৃপ্ত আত্মা সংকেত পাঠাচ্ছে? অনেক সময় এসব আত্মারা উপযুক্ত মাধ্যমের জন্য অপেক্ষা করে। মাধ্যম হওয়ার মতো কাউকে পেলে তার ওপর ভর করে নিজেদের প্রতিহিংসা মেটায়। প্রতিভা আর

তানিয়াকে এ নিয়ে কিছু বলে লাভ নেই। ওরা নিজের চোখেই দেখুক আত্মা বলে কিছু আছে। কিনা।

কোনও রকম শব্দ না করে তিনজন দক্ষিণের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বাইরের তরল, গাঢ়, স্থির অন্ধকারে কিছু দেখা গেলো না। প্রতিমা চাপা গলায় জানতে চাইলো–কী দেখাতে চেয়েছিলি বল না প্রতিভা?

প্রতিমাকে আর সাসপেন্সে রাখা ঠিক হবে না ভেবে প্রতিভা যেই বলতে যাবে ভূতের টিলার আলোর সংকেতের কথা তখনই ঘন গাছপালার ভেতর এক ঝলক আলো ফোয়ারার মতো আকাশের দিকে উঠে এলো। আগের মতো একবার নয়, থেমে থেমে তিনবার আলোর ঝলক দেখলো ওরা। প্রতিভা উত্তেজিত গলায় বললো, দেখলি?

তানিয়া বললো, খুব জোরালো টর্চের আলো মনে হচ্ছে। কোথাও সংকেত পাঠাচ্ছে।

শুকনো গলায় প্রতিমা বললো, সংকেত ঠিকই পাঠাচ্ছে। তবে টর্চের আলো ওরকম নয়।

টর্চের আলো তাহলে কী রকম? জানতে চাইলো তানিয়া।

টর্চের আলো কখনও পাইপের মতো সরু করে ফেলা যায় না। ওপর দিকে টর্চের আলো ফেললে ওটা ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া আলোটা আমার মনে হলো একটু নীলচে আর সবজেটে। সায়েন্স ফিকশন সিনেমায় দেখা অনেকটা লেযার বীম-এর মতো।

প্রতিমার বলার পর প্রতিভা আর তানিয়ারও মনে হলো টর্চের আলো এরকম হতে পারে না। অবাক হয়ে প্রতিভা বললো, পুরোনো মহলে লেযার এলো কোত্থেকে?

কাষ্ঠ হেসে প্রতিমা বললো, লের বীম-এর মতো বলেছি। ওখানে লেযার আসার প্রশ্নই আসে না। ওখানে কেন, বাংলাদেশে কারও কাছে লেয়ার লাইট আছে বলে তো শুনিনি।

তবে ওটা কিসের আলো?

তোরা তো আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলি। আমার মনে হচ্ছে কোনও অতৃপ্ত আত্মা কোনও সংকেত পাঠাতে চাইছে।

কাদের সংকেত পাঠাচ্ছে?

হয়তো আমাদের। ওরা কিছু বলতে চাইছে।

আনন্দময়ী স্কুলে থাকতে তানিয়া ই-টি ছবিটা দেখেছিলো। গ্রহান্তরের অদ্ভুত প্রাণীগুলোর জন্য ওর ভারি কষ্ট হয়েছিলো। বললো, প্রতিমাদি, অন্য গ্রহ থেকে কেউ আসেনি তো?

প্রতিভা ওর কথা হেসে উড়িয়ে দিলো–কী যে বলিস তানিয়া! দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে অন্য গ্রহের মানুষ বুঝি আমাদের রত্নেশ্বরীর ভাঙা মহলে আস্তানা গাড়বে!

তাহলে বল লেযার রে কোত্থেকে আসবে? তুই তো আবার আত্মা বিশ্বাস করিস না?

কাল গিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা কী।

আজও তো গিয়েছিলাম। পায়ের ছাপ ছাড়া তো কিছু দেখিনি।

কাল হয়তো দেখবি তিন আঙ্গুলওয়ালা গোল গোল পায়ের ছাপ। যদি সত্যিই অন্য গ্রহের কেউ আসে!

প্রতিমা বললো, আজ রাতটা জাগলে কেমন হয় রে প্রতিভা। দেখি না কী সংকেত পাঠায়।

ঠিক বলেছিস দিদি। আত্মা হোক কিংবা গ্রহান্তরের মানুষ কী বলতে চায় দেখা দরকার।

তাহলে চল খাবার ঘর থেকে গরম জলের ফ্লাস্ক আর কফির কৌটোটা নিয়ে আসি। কফি না খেলে আমি রাত জাগতে পারবো না।

প্রতিমার প্রস্তাব প্রতিভা আর তানিয়া দুজনই লুফে নিলো। মা বাবা পিসিমা কেউ যাতে টের না পায় সেদিকে খেয়াল রেখে পা টিপে টিপে ওরা নিচের খাবার ঘরে এলো।

রাতে যদি কারও দরকার হয় এই ভেবে রোজ ঘুমোতে যাবার আগে মোক্ষদা খাবার টেবিলে এক ফ্লাস্ক গরম জল রেখে যায়। এতদিন কারও দরকার হয়নি। প্রতিভা চাপা গলায় বললো, আজ মোক্ষদাদির গরম জলের সদ্ব্যবহার হবে।

শুধু গরম জলের ফ্লাস্ক নয়, একটা কাপড়ের ব্যাগে প্রতিমা তিনটা কাপ, চামচ, কফি কৌটো, চিনির বয়েম, আর বিস্কুটের টিন–সব গুছিয়ে নিয়ে বেরুতে যাবে–প্রতিভা চাপা গলায় বললো, দিদি, আমাদের হ্যাঁণ্ডসাম অফিসারটা ঘুমোলো কিনা দেখে আসি।

ঘুমোবে না তো মাঝরাতে কী করবে?

তোর মতো যদি কোনও প্রেমের উপন্যাস পড়ে?

দেবো এক থাপ্পড়! জেগে থাকলে দ্রলোক কী ভাববেন বলতো। নানা প্রতিভা, শেষে এক কেলেঙ্কারি হবে।

কেলেঙ্কারি কেন হবে? আমরা তিনজন আছি না! জেগে থাকলে জিজ্ঞেস করবো কফি খাবেন কি না।

তানিয়া বললো, ওঁর কাছে পিস্তল আছে। পুরোনো মহলের আলোর সংকেত আমরা ওঁকেও দেখাতে পারি। শনির চিঠির সঙ্গে এই আলোর কোনও সম্পর্ক আছে কি না এটা দেখা তো ওঁর কর্তব্য।

তানিয়ার যুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারলো না প্রতিমা। বললো, ঠিক আছে চল! দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকলে তুলতে পারবি না। দরজা ধাক্কানোর শব্দ হলেই নূরু কাকা জেগে যাবেন।

তানিয়ার বাবার পাশের ঘরেই সাদেক হোসেনকে থাকতে দেয়া হয়েছে। ওর সঙ্গে যেসব পুলিস এসেছে ওরা থাকবে বাইরে বনমালীদের পাশের ঘরে। পেয়াদা বরকন্দাজদের জন্য টানা ব্যারাকের মতো আটটা ঘর বানানো হয়েছিলো। আগে আটটাতেই লোক থাকতো। এখন তিনটা ঘর খালি পড়ে থাকে।

দোতালার মতো নিচের তলার টানা বারান্দার লাইট সারা রাত জ্বালানোর কথা থাকলেও ওরা দেখলো লাইট জ্বালানো হয়নি। প্রতিমা সুইচে হাত দিয়ে দেখলো ওটা অন করা, বিরক্ত হয়ে বললো, বারান্দার লাইট নষ্ট হয়ে গেছে কারও খেয়ালই নেই।

সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং আর ঝুল বারান্দার লাইটের আলোয় অবশ্য টানা বারান্দার অন্ধকার অনেকখানি কেটে গেছে। তানিয়ার বাবা যেন টের না পান–সাবধানে পা ফেলে ওরা সাদেক হোসেনের ঘরের সামনে এলো।

প্রথমে মনে হয়েছিলো দরজা বন্ধ, টোকা দিতে গিয়ে প্রতিভা ইতস্তত করলো। সাবধানে খড়খড়ি ফাঁক করে দেখতে চাইলো ভেততে, আলো আছে কিনা, তখনই ও টের পেলো দরজা ভেতর থেকে আটকানো হয়নি, তবে ঘর অন্ধকার। সামান্য টানতেই কাঠের দরজা খুলে গেলো।

ভেতরে ঢুকে বাঁ হাতে সুইচ বোর্ডে হাতে রেখে প্রতিভা প্রথমে লাইট জ্বালালো। মস্ত খাটের ওপর আগাগোড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলো সাদেক হোসেন। তার মানে ঘুম থেকে উঠিয়ে তাকে পুরোনো মহলের ঘটনাটা বলতে হবে।

পায়ে পায়ে খাটের কাছে এগিয়ে গেলো প্রতিভা। ওর পেছনে ব্যাগ কাঁধে প্রতিমা আর তানিয়া। তানিয়া ঘরে ঢুকে দরজা টেনে বন্ধ করে দিয়েছে।

খাটের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিভা চাপা গলায় ডাকলো, সাদেক ভাই!

কোনও সাড়া শব্দ নেই। গলা এক ধাপ তুলে ও আবার ডাকলো, সাদেক ভাই!

এবারও কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। সাদেকের কম্বল ঢাকা মাথায় হাত দিয়ে ঠেলতে গিয়ে চমকে উঠলো প্রতিভা। কম্বল সরিয়ে দেখে ভেতরে পাশ বালিশ আর মাথার বালিশটা মানুষের মতো শুইয়ে রাখা। সাদেক নেই।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওরা তিনজন একে অপরের দিকে তাকালো। তানিয়া চাপা উত্তেজিত গলায় বললো, কোথায় গেলেন সাদেক ভাই?

প্রতিমা বললো, যেখানেই যান, তিনি চান না তার যাওয়ার কথা কেউ জানুক।

প্রতিভা বললো, আমার মনে হয় পুরোনো বাড়িতে তিনিও আলোর সংকেত দেখতে পেয়েছেন। হয়তো সেখানে গেছেন।

টেবিলের ওপর পানির গ্লাস আর ঢাকা দেয়া জগ। আলনায় সাদেকের একটা প্যান্ট আর তোয়ালে ঝুলছে।

খাটের তলায় ওর এয়ার ব্যাগটা। অনুচিত জেনেও প্রতিমা এগিয়ে গিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে ভেতরে হাতড়ে দেখলো। বাড়তি দুটো শার্ট, একটা প্যান্ট, শেভ করার জিনিসপত্র আর সাদেকের পিস্তল ছাড়া ব্যাগে আর কিছু নেই। চেইন বন্ধ করে বললো, আমরা এ ঘরে এসেছি এটা জানতে দেয়া উচিৎ হবে না।

প্রতিভা বালিশগুলো ঠিক করে আগের মতো কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলো। তানিয়া বললো, সাদেক ভাই যদি একা পুরোনো মহলে গিয়ে থাকেন ওঁর কোনও বিপদও হতে পারে। আমার মনে হয় বাবাকে জানানো দরকার।

প্রতিমা মাথা নেড়ে সায় জানালো। ও জানে ওর বাবাকে বললে তিনিও এ কাজই করতেন। লাইট নিভিয়ে দরজাটা আগের মতো বন্ধ করে ওরা পাশের ঘরের দরজায় টোকা দিলো।

এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। তানিয়া খড়খড়ি তুলে চাপা গলায় ডাকলো, বাবা, দরজা খোল।

তানিয়া জানে ওর বাবার ঘুম খুবই পাতলা। সামান্য শব্দ হলেই জেগে যান। দুবার ডাকতে হলো না। তার আগেই লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে ওদের তিনজনকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন বাবা–এত রাতে তোরা কী করছিস?

ভেতরে ঢুকে তানিয়া পুরোনো মহলে আলো দেখা থেকে শুরু করে সাদেক হোসেনের অন্তর্ধান পর্যন্ত সব খুলে বললো। ওর কথা শুনতে শুনতে বাবার কপালে ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত গলায় তিনি বললেন, আমার মনে হয় সাদেক বুঝতে পেরেছে বাড়ির ভেতরই শনির কোনও লোক আছে। ও চায় না রাতে ও যে বাইরে যাচ্ছে বাড়ির কেউ জানুক। তোরা শুয়ে পড়। যা করার আমি করবো। তোরা কাউকে ঘুণাক্ষরেও বলবি না রাতে কী দেখেছিস।

ওরা তিন জন পা টিপে টিপে দোতালায় প্রতিভার ঘরে এলো। দক্ষিণের জানালার সামনে চাদর পেতে বসে কফি আর বিস্কুট খেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। আলোর সংকেত না দেখলেও ঠিক তিনটার সময় ঝুল বারান্দার আবছা আলোয় সিং দরজার কাছে মুহূর্তের জন্য দুটো ছায়ামূর্তি দেখলো ওরা। এর কিছুক্ষণ পর শুধু সাদেককে দেখলো এদিক ওদিক তাকিয়ে সাবধানে বাড়িতে ঢুকতে।

.

সকালে নাশতার টেবিলে রাতের মতো সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছিলো। আজকাল প্রতিমাদের টেবিলে খাবারের বহর দেখে তানিয়া চমকায় না। তবে সাদেক নতুন বলেই প্রতিমার মা যখন ওর প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন আঁতকে উঠলো–এত কে খাবে?

টেবিলে লুচি, আলুর দম, ডিম ভাজা, মোহনভোগ আর ঘরে বানানো ছানার সন্দেশ তো ছিলোই, তার ওপর ছিলো বড় পাথরের বাটি ভর্তি পাকা পেঁপে, কলা, আপেল আর আঙুরের কাস্টার্ড।

প্রতিমার মা বললেন, সারা দিন ছুটোছুটির কাজ করবে, ভালো করে এ বেলা খেয়ে নাও।

তানিয়ার বাবা খেতে খেতে সাদেককে জিজ্ঞেস করলেন, রাতে তোমার ভালো ঘুম হয়েছিলো তো?

মৃদু হেসে সাদেক বললো, এক ঘুমেই রাত কাবার করে দিয়েছি।

তাও ভালল! বিভূতিদের আত্মারা তোমার জানালার পাশে উৎপাত করেনি।

সাদেক একটু গম্ভীর হয়ে বললো, পুলিশের চাকরি করলেও আমি আল্লাহ খোদা মানি। কোরান শরীফে যে জ্বীনের কথা আছে এটা কি আপনি অস্বীকার করতে চান?

কোরান শরীফ যারা পড়েছে তারা সবাই এটা জানে।

তবে বিজয়ীর ভঙ্গিতে সাদেক বললো, জ্বীনদের ভেতর ভালো যেমন আছে, খারাপও আছে। খারাপ জ্বীন সব সময় মানুষের ক্ষতি করতে চায়।

জ্বীন দেখতে কেমন সাদেক ভাই? নিরীহ গলায় জানতে চাইলো তানিয়া।

জ্বীনদের মানুষ এমনিতে দেখতে পায় না যদি না ওরা দেখা দেয়। ভালো জ্বীন মানুষের চেহারা নিয়ে দেখা দেয়। খারাপ জ্বীন সাপের চেহারা নিয়ে পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়িতে থাকে। জন্তু জানোয়ারেরও চেহারা ধরতে পারে তারা।

আপনি কখনও জ্বীন দেখেছেন? প্রশ্ন করলে প্রতিভা।

আমার দাদা ছিলেন নাম করা কামেল পীর। তাঁর দুটো পোষা জ্বীন ছিলো। ওরা দাদার কাছে কোরান শরীফ শেখার জন্য এসেছিলো। ছোটবেলায় ওদের দেখেছি। অসময়ে আমাদের জন্য আঙুর, আপেল এনে দিতো।

আঙুর আপেলের আবার অসময় কী, সারা বছরই তো পাওয়া যায়।

বড় শহরে পাওয়া যেতে পারে। গ্রামে পাওয়া যায় না।  

প্রতিমার বাবা প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, সাদেক, আজ কী করবে ঠিক করেছো?

আমি রত্নেশ্বরী গ্রামটা ঘুরে দেখতে চাই। আপনি টাকা জোগাড় করে রাখুন। আমার ধারণা আজ রাতের ভেতর ওরা জানাবে টাকা কোথায় কিভাবে দিতে হবে। বাড়ির লোকজন সবাইকে জানিয়ে দিন, অচেনা কোনও লোক চিঠি দিতে বা কিছু বলতে এলে ওকে যেন আটকে রাখে।

আটকে রাখলে শনির দল আমাদের ফাঁদে পা দেবে কেন?

আটকে রাখবো চিঠির উত্তর দেয়ার জন্য। আমরা বলবো টাকা একবারে জোগাড় করা যায়নি। এখন পাঁচ পেয়েছি, বাকি পাঁচ দু দিন পরে দেবো। আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে বড় মাথাওয়ালা কেউ রয়েছে। সে কে জানার জন্য একটু সময় দরকার।

তানিয়ার বাবা বললেন, ভালো বুদ্ধি বের করেছে। বিভূতি, টাকা আনতে কখন যাবে?

শুকনো গলায় বিভূতিরঞ্জন বললেন, দশ লাখ টাকা ঘরেই আছে।

বলেন কী? চমকে উঠলো সাদেক–এত টাকা বাড়িতে আছে জানলে ডাকাত পড়বে যে! নগদ টাকা ব্যাংকে রাখলেই তো পারেন।

পারি। তবে তুমি বোধহয় জানো না, সরকার এখন নিয়ম করেছে হিন্দুরা ইচ্ছে করলে ব্যাংক থেকে ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা তুলতে পারবে না।

সাদেক অবাক হলো–এমন কথা তো শুনিনি?

ব্যাংকে পরিচিত লোক থাকলেই জানতে পারবে। দু বছর ধরে এরকম নিয়ম হয়েছে। শুধু তাই নয়, হিন্দুদের ব্যাংক লোন দেয়াও এক রকম বন্ধ হয়ে গেছে।

সাদেক আর কোনও কথা বললো না। একটু পরে তানিয়ার বাবা বললেন, সাদেক যখন এসে পড়েছে আমি বরং আজ ঢাকা থেকে ঘুরে আসি। স্কুলের ব্যাপার নিয়ে ইকবাল বলছিলো কোন এনজিওর সঙ্গে নাকি কথা বলবে।

বিভূতিরঞ্জন জানতে চাইলেন, সন্ধ্যের আগে ফিরছো তো?

সব্যের আগেই ফিরবো। যদি বলো রাতে ইকবালকেও এখানে থাকতে বলতে পারি।

বিভূতিরঞ্জন সাদেককে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী বলো! ইকবাল আমাদের পুরোনো বন্ধু, পাশের গায়ে থাকে।

সাদেক গম্ভীর গলায় বললো, আমি শনির দলকে কোনও ভাবেই ঘাবড়ে দিতে চাই না। বাড়িতে বেশি লোকজন দেখলে ওরা নাও আসতে পারে।

সেক্ষেত্রে আমরাও তো বাড়ি ফিরে যেতে পারি। বললেন তানিয়ার বাবা।

সাদেক মাথা নাড়লো–যারা রায় সাহেবকে হুমকি দিয়েছে তারা ভালো করেই জানে ওঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী। আপনি থাকবেন এটা ওদের হিসেবে আছে।

ছয় পদ নাশতার পর আয়েশ করে চা খেয়ে তানিয়ার বাবা আর দেরি করলেন না। বিদায় নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়ে গেলেন। সাদেক বললো, এক হিসেবে ভালোই হলো। শনির দল ভাববে উনি টাকা আনতে শহরে গেছে।

বল কী! চমকে উঠলেন বিভূতিরঞ্জন–তাহলে তো ফেরার সময় ওরা টাকার জন্য ওর ওপর হামলা করতে পারে।

করবে না! দেখলেই বুঝবে ওঁর কাছে যে টাকা নেই। দশ লাখ টাকা আনতে হলে বড় ব্রিফকেস নয় ব্যাগ দরকার। এত টাকা পকেটে করে আনা সম্ভব নয়।

সাদেক, ধরো ওরা যদি রাতে বড় দল নিয়ে হামলা করে, তোমার ওই পুলিশ কটা সামলাতে পারবে?

নাশতা শেষ হওয়ার পর উল বুনতে বুনতে পিসিমাও যোগ দিয়েছিলেন ড্রইংরুমের বৈঠকে। বললেন, তরে পুজার সুম কইচিলাম, বিভূতি জোয়ান দেইখা চাইরটা পেয়াদা রাখ। একা বনমালী কয় দিক সামাল দিবো? বাকিগুলান তো ঘাটের মড়া, অগরে দিয়া ডাকাইত ঠ্যাকাপি কেমতে। খালি তো গাঞ্জা খায়া ঝিম মাইরা বয়া থাকে।

বিভূতিরঞ্জন বললো, ওরা বাবার আমলের পেয়াদা। ওদের তাড়াই কী করে?

আমি অগো খ্যাদানের কতা কই নাইক্যা। কইতাচি বনমালীর মতন জোয়ান দেইখ্যা আরও চাইরটা পেয়াদা রাখ।

সাদেক গম্ভীর হয়ে বললো, আমার মনে হয় না শনির দল বাড়িতে হামলা করার মতো বোকামি করবে। বাড়িতে ঢুকতে হলে ওদের অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে আসতে হবে। ছাদে আর সিং দরজায় আমার ফোর্স রয়েছে। হামলা করতে এলে পাখির মতো মারা পড়বে। আজ রাতে আমি নিজেও পাহারা দেবো।

বিভূতিরঞ্জন হাঁপ ছেড়ে বললেন, তোমার কথা শুনে ভরসা পেলাম।

তানিয়া আদুরে গলায় বললো, সাদেক ভাই, আমরা কি নদীর তীরে বেড়াতে যেতে পারি?

একটু ভেবে সাদেক বললো, যেতে পারো, তবে বেশি দূরে যেও না।

মা গম্ভীর হয়ে বললেন, যেখানেই যাও, সঙ্গে বনমালীকে নিয়ে যাবে।

সাদেক বললো, বনমালীকে আমি সঙ্গে নিতে চাচ্ছি। গ্রামের লোকজনদের সম্পর্কে ও ভালো বলতে পারবে। দিনের বেলা এদের কিছু করা শনির দলের সাহস হবে না।

ওপরে গিয়ে তৈরি হতে হতে তানিয়াদের ঝাড়া এক ঘন্টা লাগলো। আগের দিনের মতো কাপড়ের ঝোলা ব্যাগে টর্চ আর পানির বোতল নিতে ভুললো না প্রতিমা। প্রতিভা যথারীতি গুপ্তি লাঠি সঙ্গে নিয়েছে। নিচে নেমে শুনলো পিসিমা মাকে বলছেন, শনির ফাড়াকাটলে আমি কূপিত আত্মাগো মুক্তির লাইগা যজ্ঞ কইরা তারপর যামু কইলাম। এই বলে তিনি অদৃশ্য আত্মাদের উদ্দেশ্যে দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।

প্রতিভা নিচু গলায় তানিয়াকে বললো, পিসিমার যজ্ঞের আগেই আমরা আত্মাদের পিণ্ডি চটকাবো।

প্রতিমা গম্ভীর হয়ে বললো, গুরুজনদের নিয়ে হাসাহাসি করার বাজে অভ্যাস এখনও তোর গেলো না!

হাসতে হাসতে প্রতিভা বললো, পিসিমা যদি জানতেন আত্মারা পুরোনো মহলে জুতো পায়ে দিয়ে ঘোরেন তবেই ওঁর ভক্তি শ্রদ্ধা কর্পূরের মতো উবে যেতো।

প্রতিমা কথা না বাড়িয়ে হাঁটার গতি বাড়ালো। দুপুরে খাওয়ার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। তানিয়া নিচু গলায় প্রতিভাকে বললো, আমার মনে হচ্ছে পুরোনো মহলে আজ সাদেক ভাইর জুতোর ছাপ দেখতে পাবো।

কী করে বুঝবি ওটা ওর জুতোর ছাপ?

ড্রইংরুমে গল্প করার সময় আমি সবার পায়ের জুতোর তলা লক্ষ্য করে দেখেছি। সাদেক ভাইয়ের পায়ে ছিলো মোটা খাঁজকাটা তলার নর্থ স্টার কেডস।

রাতে যদি সাদেক ভাই পুরোনো মহলে গিয়ে থাকেন–লুকোচ্ছেন কেন?

তদন্তের ব্যাঘাত হতে পারে ভেবে। তার তো ধারণা আমাদের বাড়িতেই শনির গুপ্তচর রয়েছে।

কে, বনমালীদা!

বনমালীদা কখনও এরকম কাজ করবে না। পুরোনো পেয়াদাদের কেউ হতে পারে। টাকার লোভে হয়তো শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

কী বিপদ! বাড়িতে এসব লোক নিয়ে থাকিস কী করে? কখন কী অঘটন ঘটে বলা যায়?

শনির দলকে ধরতে পারলেই জানা যাবে বাড়িতে ওদের কোনও চর আছে কি না।

পুরোনো মহলের অন্ধকার ঘরে আগের দিন যেখানে পায়ের ছাপ দেখেছিলো আগে ওরা সেখানে গেলো। নতুন পায়ের ছাপ সেখানে ছিলো। টর্চের আলোয় পায়ের ছাপ দেখে তানিয়া চমকে উঠলো। না, সাদেকের নর্থ স্টার কেডস্-এর ছাপ এরকম নয়। আগের দিনের পুরোনো পায়ের ছাপে ময়লা পড়েছে, নতুন ছাপে কোনও ময়লা নেই। প্রতিভা বললো, তানিয়া, এগুলো তো নতুন মনে হচ্ছে। তুই ঠিকই বলেছিলি। সাদেক ভাই কাল রাতে এখানে এসেছিলেন।

তানিয়া শুকনো গলায় বললো, না, এগুলো সাদেক ভাইর জুতোর ছাপ নয়।

তাহলে কার জুতো?

সেটাই খুঁজে বের করতে হবে।

তার মানে কাল যারা এখান থেকে আলোর সংকেত পাঠিয়েছে তাদের কারও জুতোর ছাপ এটা।

প্রতিমা চিন্তিত গলায় বললো, এ ঘরে কিছু একটা আছে। নইলে এখানে এত পায়ের ছাপ কেন?

তানিয়া বললো, এখানে ধুলো বেশি বলে পায়ের ছাপ আমাদের চোখে পড়ছে।

প্রতিভা লাঠি ঠুকে ঠুকে বললো, তবু এ জায়গাটা আমাদের ভালো ভাবে দেখা দরকার।

লাঠি ঠুকতে ঠুকতে প্রতিভা পাশের ঘরে গেলো। চারপাশে টর্চের আলো ফেলে প্রতিমা দেখলো এ ঘরে ধুলো ময়লা কম। সিলিঙে অসভ্য বাদুড়গুলোও নেই। তানিয়া বললো, এ ঘরটা মনে হয় কেউ ব্যবহার করেছে।

নোনা ধরা দেয়ালের ভ্যাপসা গন্ধ ছাড়াও অন্য রকম একটা গন্ধ ছিলো। কেমন যেন নেশা ধরানো গন্ধ, কোত্থেকে আসছে ওরা বুঝতে পারলো না।

ভেতরের দিকে আর একটা ঘর মোটামুটি অক্ষত ছিলো। সে ঘরে যাওয়ার দরজার জায়গাটা বেশ ছোট, যদিও দরজার পাল্লা চৌকাঠ কিছুরই অস্তিত্ব ছিলো না। টর্চ হাতে প্রতিমা আগে ঢুকলো। ওর চেয়ে সামান্য লম্বা হলেই মাথা নিচু করে ঢুকতে হবে।

টর্চের আলোয় ওরা দেখলো, ঘরের আয়তন আরও ছোট, একপাশে এক মানুষ সমান উঁচু একটা বেদির মতো। দ্বিতীয় ঘরের মতো এ ঘরটাও বেশ পরিষ্কার, তবে বাইরে থেকে এক রত্তি আলো ঢোকার উপায় নেই। যেখান দিয়ে ওরা ঢুকেছে আগে ওটাই ছিলো একমাত্র দরজা। কোনও জানালা বা ভেন্টিলেটার নেই।

ঘরের ভেতর বেমানান দেখতে বেদিটার ওপর আলো ফেলে প্রতিমা বললো, এই বেদিটা এখানে কেন?

প্রতিভা ওটার গায়ে লাঠি ঠুকে দেখলো, বেশ নিরেটই মনে হচ্ছে। লাঠি ঠুকে ঠুকে বেদির পেছন দিকে গেলো। আর তখনই চাপা উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে উঠলো–দিদি, এদিকে আয়তো!

প্রতিভার চিৎকার শুনে প্রতিমা আর তানিয়া ছুটে গেলো ওর কাছে। টর্চের আলোয় যা দেখলো–রীতিমতো রোমহর্ষক দৃশ্য।

বেদির পেছনে ছোট একটা দরজার মতো অন্ধকার গহুর। টর্চের আলোয় দেখা গেলো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।

প্রতিভা উত্তেজিত গলায় বললো, মনে হয় গুপ্তধনের সন্ধান পেতে যাচ্ছি আমরা। দিদি চল, নেমে দেখি।

প্রতিমা রাজী হলো না–মনে হচ্ছে সিঁড়িটা গুমঘরে নেমে গেছে। যেখানে ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা যখ বসিয়েছিলেন। আমার মন বলছে এখানে ঢুকলে আর বেরুতে পারবো না।

প্রতিভা বিরক্ত হয়ে বললো, তোর মতো একটা ভীতুর ডিমকে সঙ্গে আনাই ভুল হয়েছে। তানিয়া, তুইও কি মনে করিস নিচে নামলে যখ আমাদের গিলে খাবে?

তানিয়া মুশকিলে পড়লো। প্রতিমা নিচে নামতে চাইছে না, প্রতিভা চাইছে। ওরও ইচ্ছে করছিলো নেমে দেখতে নিচে কী আছে, কিন্তু প্রতিমাকে বাদ দিয়ে নামাটা ঠিক হবে না। প্রতিভাকে বললো, যখের কথা বাদ দে। মাটির নিচের এসব পুরোনো সুড়ঙ্গে বিষাক্ত গ্যাস থাকতে পারে। গ্যাস মাস্ক না নিয়ে নামাটা মনে হয় উচিৎ হবে না।

এটা ঢাকা নয় তানিয়া। রত্নেশ্বরীতে তুই গ্যাস মাস্ক কোথায় পাবি? দিদি বরং বাইরে অপেক্ষা করুক। তুই আর আমি চল সিঁড়ির শেষ মাথা পর্যন্ত নেমে দেখে আসি নিচে কী আছে।

তানিয়া ইতস্তত করে প্রতিমাকে বললো, তুমিও চলো না প্রতিমাদি। যখ যদি থাকেও দিনে দুপুরে ওরা বেরুবে না।

প্রতিমা হতাশ হয়ে বললো, চল, তবে কোনও অঘটন ঘটলে প্রতিভার কান দুটো আমি আস্ত রাখবো না।

ঠিক আছে দিদি। কিছু হলে আমার কান দুটো কেটে ঘোষদের ঘিয়ে ভাজা কুকুরটার গলায় ঝুলিয়ে দিস।

মনে থাকে যেন। বলে টর্চ হাতে প্রতিমা সবার আগে পাতালে নামার সিঁড়িতে পা রাখলো। এর পেছনে প্রতিভা, সবার শেষে তানিয়া।

দিনের বেলা বেরুচ্ছে বলে ওরা কেউ গরম কাপড় আনেনি। আজকাল দিনে বেশ গমই থাকে। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওদের রীতিমতো শীত লাগলো।

প্রতিমা মনে মনে–দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী, রক্ষা কর মা, বলতে বলতে নিচে নামছিলো। প্রতিভা নামতে নামতে গুণছিলো কয় সিঁড়ি নামা হলো। তানিয়া জোরে জোরে শ্বাস টেনে বোঝার চেষ্টা করছিলো অস্বস্তিকর কোনও গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায় কিনা। বিজ্ঞান বইতে অবশ্য পড়েছে কার্বন মনো অক্সাইড গ্যাসে কোনও গন্ধ থাকে না। মৃত্যু কিভাবে আসবে টেরও পাওয়া যায় না। পত্রিকায় এমন খবর মাঝে মাঝে ছাপাও হয়, পুরোনো কুয়ো বা ম্যানহোলে ঢুকে বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মানুষ মারা গেছে।

সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ উঁচু। পনেরো সিঁড়ি নামার পর ওরা একটা বড় সড় ঘরের ভেতর নিজেদের আবিষ্কার করলো। ঘরের ভেতরটা বেশ পরিষ্কার। প্রতিভা চাপা গলায় বললো, দিদি, বুঝতে পারছিস না এ ঘরে লোকজন চলাফেরা করে?

তুই টের পেলি কি করে?

ওই কোণায় দেখ, এক টুকরো ন্যাকড়া পড়ে আছে। দেখে মনে হয় না বেশি পুরোনো।

কাছে গিয়ে টর্চের আলোয় ওরা দেখলো সবুজ রঙের এক টুকরো ন্যাকড়া পড়ে আছে। পাশেই একটা সুড়ঙ্গের মতো সোজা চলে গেছে।

প্রতিভা বললো, এই সুড়ঙ্গ কোথায় গেছে বলতে পারবি দিদি?

আমি কী করে জানবো কোথায় গেছে। খবরদার ওটার ভেতর ঢোকার কথা বলবি না।

ঠাকুরমার কাছে শুনিসনি, পুরোনো মহলের বউ ঝিরা সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে চান করার জন্য বংশী নদীতে যেতো!

তানিয়া অবাক হলো–সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যেতে হবে কেন?

বা রে, রাস্তা দিয়ে গেলে লোকজন দেখে ফেলবে না? ঠাকুরমার মা নাকি গঙ্গা স্নানে যেতেন পাল্কিতে করে। পালকি সুদ্ধো বেহারারা ওঁকে গঙ্গায় ডুবিয়ে আনতে।

তানিয়া প্রতিমার দিকে তাকালো–প্রতিমাদি, চলোই না দেখে আসি সুড়ঙ্গটা নদীর কোন জায়গা দিয়ে বেরিয়েছে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতিমা মনে মনে দুর্গানাম জপতে জপতে সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকলো। মহা উত্তেজিত প্রতিভা আর তানিয়া ওকে নিরবে অনুসরণ করলো। সুড়ঙ্গের ভেতরটা বেশি প্রশস্ত নয়। তানিয়া একবার সুড়ঙ্গের দেয়ালে হাত দিয়ে চমকে উঠেছে। বরফের মতো ঠাণ্ডার আর ভেজা দেয়াল।

মিনিট তিনেকের ভেতর মাথা নিচু করে হাঁটার পর আবার একটা ঘরের ভেতর এলো ওরা। ঠিক আগের ঘরটার মতো, সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। বাঁ পাশে আরেকটা সুড়ঙ্গ। প্রতিমা সিঁড়ির ওপর আলো ফেলে দেখলো আস্ত দরজা রয়েছে সিঁড়ির মাথায় এবং দরজাটা বন্ধ।

প্রতিভা বললো, দরজার ওপাশে কী দেখতে হবে দিদি।

ও যে আবার পাশের সুড়ঙ্গে ঢুকতে চায়নি এতেই খুশি হয়ে প্রতিমা সামনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো। ওর পেছনে প্রতিভা আর তানিয়া। ঠিক তখনই নিচে থেকে বাজখাই গলায় কে যেন চিৎকার করে উঠলো, কে রে?

প্রতিমা এমনই চমকে উঠলো যে হাত থেকে টর্চ গড়িয়ে পড়লো। আরেকটু হলে ও নিজেই হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়তো। সিঁড়ি থেকে নিচে পড়েই টর্চটা নিভে গেলো। জমাট বাধা কুচকুচে কালো অন্ধকারের চাদর দিয়ে কেউ যেন ওদের মুড়ে ফেললো।

নিচে থেকে ওদের ওপর টর্চের জোরালো আলো ফেললো কেউ। এত জোরালো আলো যে তাকাতে গিয়ে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। চোখের ওপর হাত তুলে ওরা আলোটা আড়াল করলো। ধুপধাপ অনেকগুলো পায়ের শব্দ হলো। অচেনা ষণ্ডা মতো তিনটে লোক ছুটে এসে জাপটে ধরলো ওদের। প্রতিমা মুহূর্তের ভেতর জ্ঞান হারালো।