১২. কালো ছায়ার রহস্য

দুপুরে খাওয়ার সময় প্রতিমার মার টনক নড়লো মেয়েরা সেই যে বেরিয়েছে এখন পর্যন্ত ফেরেনি। অন্য দিন খাওয়ার বেশ আগেই ফিরে আসে। পিসিমা চিন্তিত গলায় বললেন, আমার মনে কু ডাকতাচে বউ। তুমি বনমালীরে জলদি পাঠাও অগোরে বিচরাইতে।

বনমালী তো সাদেকের সঙ্গে বেরিয়েছে দিদি। পিসিমার কথা শুনে প্রতিমার মার বুক কেঁপে উঠলো।

বনমালী না থাকুক, ঘাটের মড়া একটারে পাঠাও না।

একজন নয়, প্রতিমাদের খুঁজতে দুজন পেয়াদাকে দু দিকে পাঠানো হলো। একজন গেলো গ্রামের দিকে, আরেকজন নদীর ধারে। বিভূতিরঞ্জন কিছুক্ষণের জন্য খামারে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আরেক পেয়াদা পাঠালেন সাদেক হোসেনকে ডাকতে।

আধঘন্টা পর সাদেক হোসেন হন্তদন্ত হয়ে এসে জানতে চাইলো, প্রতিমারা এখনও ফেরেনি?

প্রতিমার মা, বাবা, পিসিমা সবাই বসেছিলো নিচের তলার বৈঠক খানায়। সাদেকের কথা শুনে পিসিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, কোইথেইকা ভাতে মরা পুলিস কতগুলা আনচ, চক্কের সামনে থেইক্কা তিন তিনটা ছেমরি হাওয়া ওইয়া গেল?

সাদেক বিব্রত গলায় বললো, পুলিশ তো বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। ওদের বলেছি অচেনা কেউ আশে পাশে নজরে পড়লে খবর দিতে।

আরে মর! সাদেকের কথায় পিসিমা আরও বিরক্ত হলেন–তোমার পুলিশ কি এই গ্যারামের? ক্যাঠা চিনা আর ক্যাঠা অচিনা–বুঝবো কেমতে? বাড়ির উপর নজর রাখনের কী ওইচে? গুণ্ডা হালারা কি বাড়ি উঠাইয়া লয়া যাইবো? অগো নজর রাখতে কও বাড়ির মাইনসেপো উপরে।

প্রতিমার মা ভেজা গলায় সাদেককে বললেন, তুমি বনমালীকে সঙ্গে নিয়ে ওদের খুঁজে বের করো বাবা।

প্রতিমার বাবাও বললেন, বনমালীকে সঙ্গে নিয়েই যাও। লোকজনকে বনমালী জিজ্ঞেস করতে করতে যাবে।

দুপুরের খাওয়া সবার মাথায় উঠলো। বিভূতিরঞ্জন বার বার বাড়ি থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করলেন। বনমালীকে সঙ্গে নিয়ে সাদেক গ্রামের ঘরে ঘরে ঢু মারলো। এমন কী মোক্ষদা পর্যন্ত মেয়েদের খুঁজতে বেরুলো।

বিকেল বেলা সাদেক ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে এসে বললো, আমার মনে হচ্ছে এটা শনির দলের কাজ। টাকার ব্যাপারে ওরা নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেয়েদের কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। আপনারা চিন্তা করবেন না। আজ রাতেই ওদের উদ্ধার করবো।

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোক্ষদাকে ডেকে পিসিমা বললেন, ছ্যারারে এক গ্যালাস নেষুর সরবত বানায়া দে।

প্রতিমার মা ভেজা গলায় বললেন, ওর তো দুপুরেরর খাওয়াও হয়নি। তুমি বরং মুখ । হাত ধুয়ে এসো, মোক্ষদা টেবিলে খাবার দিক।

বিভূতিরে লগে বহায়া দ্যও। আমার গলা দিয়া কিছু নামবো না। তুমি এটু জল মুখে দ্যও বউ।

সাদেকের ক্ষিদে পেয়েছিলো। খাওয়ার জন্য ওকে বলতে হলো না। বিভূতিরঞ্জন নাম মাত্র মুখে তুললেন। তাঁরও খেতে ইচ্ছে করছিলো না। সাদেককে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মনে হয় শনির দল আজ যোগাযোগ করবে?

ওদের কথা অনুযায়ী তাই তো করার কথা। আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আজ রাতেই শনিকে গ্রেফতার করবো।

গ্রামে যে ঘুরলে ওরা টের পেয়ে যায়নি তো তুমি পুলিশের লোক?

না। যারা জানতে চেয়েছিলো বনমালীই বলেছে আমি আপনার ভাগ্নে, কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। ওকে আগেই শিখিয়ে দিয়েছিলাম আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে কী বলবে।

তোমার পুলিশ?

না বললে প্লেইন ড্রেস-এ ওদের বুঝবে কিভাবে ওরা যে পুলিশ। ওদের বলেছি জিজ্ঞেস করলে বলবে নতুন পেয়াদার কাজে বহাল হয়েছে।

সাদেকের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিভূতিরঞ্জন চুপচাপ বসে থাকলেন। মেয়েদের জন্য উদ্বেগ, আর দুশ্চিন্তায় ভেতরে ভেতরে একেবারেই ভেঙে পড়েছেন তিনি। দশ লাখ টাকা তার কাছে কিছুই নয়। জমিদারি না থাকলেও জমি যা এখনও দখলে আছে তার দাম কয়েক কোটি টাকা হবে। নিজের মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে তানিয়ার কথাও ভাবছিলেন তিনি। নূরউদ্দিনকে তিনি কী জবাব দেবেন? তাঁর কথাতেই ওরা এ বাড়িতে এসে থাকছে। এ মুহূর্তে তার সবচেয়ে প্রিয় এই বন্ধুটির অভাব তিনি তীব্রভাবে অনুভব করছিলেন।

খাওয়া শেষ করে সাদেক বললো, দশ লাখ টাকা আপনি আলাদা করে একটা ব্যাগে রাখুন।

শুকনো গলায় বিভূতিরঞ্জন বললেন, সকালেই রেখেছি।

ব্যাগ কোথায়?

আমার ঘরের সিন্দুকে।

ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো বনমালী। হাঁপাতে হাঁপাতে হাতে ধরা সবুজ খাম এগিয়ে দিয়ে বললো, এক ব্যাড়ায় আমারে এই চিঠিখান দিয়া ভাইগা গেল।

বিভূতিরঞ্জন কাঁপা হাতে খাম খুলে সবুজ চিঠি পড়লেন–মালাউন বিভূতিরঞ্জন, তোমাকে বলিয়াছিলাম পুলিশে খবর না দিতে। তুমি ভাগিনার পরিচয় দিয়া বাড়িতে পুলিশের লোক আনিয়া রাখিয়াছ। তাই তোমার পেয়ারের বন্ধু মুরতাদ নূরউদ্দিন আর তোমার মেয়েদের আমরা আমাদের কবজায় রাখিতে বাধ্য হইয়াছি। হারামজাদা পুলিশের লোকটিকে বলিবে রাত আটটায় একা টাকার ব্যাগ লইয়া রত্নেশ্বরী মন্দিরের সামনের বটগাছের তলায় রাখিয়া সোজা যেখান হইতে আসিয়াছে সেইখানে চলিয়া যাইতে। আমাদের লোক সারাক্ষণ তোমাদের গতিবিধির উপর নজর রাখিতেছে। কোনও রকম চালাকি করিলে কাল সকালে মেয়ে তিনটির লাশ বংশী নদীতে ভাসমান দেখিবে। ইতি শনি।

চিঠি পড়ার পর সাদেক ধমকের গলায় বনমালীকে বললো, তোমাদের সবাইকে একশ বার বলা হয়েছে অচেনা কোনও লোক দেখলে ওদের আটকে রাখবে। কেন এই লোককে যেতে দিলে?

বনমালী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো, হুজুর, মা কালীর দিব্যি কইতাছি, হারামির পোলারে আমি ধাওয়া করছিলাম। রাস্তায় উষ্ঠা খাইয়া পইড়া যাওনে অরে ধরতে পারি নাই।

এই দ্যাখেন আমার পায়ের নখ উইল্টা গ্যাছে।–বিভূতিরঞ্জন আর সাদেক দুজনেই দেখলো বনমালীর ধুলোমাখা পায়ের বুড়ো আঙুলের চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। বিভূতিরঞ্জন সাদেককে বললেন, শনির লোককে আটকে কী লাভ হতো যখন আমার মেয়েরা ওদের কজায়? বনমালী যাও, ডেটল দিয়ে পা ধুয়ে ব্যাণ্ডেজ করে নাও।

বনমালী চলে যাওয়ার পর সাদেক বললো, বদমাশ শনি আমার ব্যাপারে জানলেও আমার সঙ্গে যারা এসেছে তাদের সন্দেহ করেনি।

তুমি কী করতে চাও?

আপনাদের রহেশ্বরীর মন্দিরে কি রোজ পুজো হয়?

হ্যাঁ, সন্ধ্যায় আরতি দেয়া হয়। নাম গান হয়।

আপনার যদি আপত্তি না থাকে চারজন পুলিশ আজ সন্ধ্যায় ধুতি পরে কপালে তিলক কেটে ভক্ত সেজে মন্দিরে পুজো দিতে যাবে। আমি টাকা নিয়ে বটতলায় যাবো। টাকাটা রেখে আমি চোখের আড়াল হলেই ওদের লোক টাকা নিতে আসবে। আর তখনই পুলিশরা ওদের ঘিরে ফেলবে।

তোমার পুলিশদের কাছে তো আর্মস নেই।

আপনার তো দুটো পিস্তল আছে। ও দুটো ওদের কাছে থাকবে। আমার পিস্তল আমি নেবো। আপনার বন্দুকধারী পেয়াদাদের বলে দেবেন কোনও অবস্থায় যেন বাড়ির বাইরে না যায়। আমি চাই না ওদের লোক ধরা পড়ার পর ওরা বাড়িতে হামলা করুক।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিভূতিরঞ্জন বললেন, ঠিক আছে সাদেক, তুমি যেভাবে বলবে তাই হবে।

সাদেক আত্মবিশ্বাসভরা গলায় বললো, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। এর চেয়ে বড় বড় ক্রিমিনাল আমি একা কাবু করেছি।

সন্ধ্যেবেলায় ভক্ত সেজে দুজন পুলিশ কোমরে পিস্তল আর দুজন দুটো ছুরি খুঁজে মন্দিরে পুজো দিতে গেলো। পিসিমা ওদের শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে পুজো দিতে হয় আর নামগান করতে হয়, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। ওরা বেরিয়ে যাবার একটু পরেই পিসিমার ছেলে অধীর এলো, সঙ্গে দাড়িওয়ালা, চশমাপরা, মাথায় টুপি দেয়া এক হুজুর টাইপের লোক।

ব্যাগ কাঁধে অধীরকে বারান্দায় উঠতে দেখে পিসিমা ছুটে গিয়ে–তুই ক্যামতে আইলি অধীর? জানস না তো কী–বলতেই পেছনে অচেনা হুজুরকে দেখে তিনি জিভ কেটে লম্বা ঘোমটা টানলেন।

অধীর বললো, মামার এমন বিপদ, ঘরে থাকি কী ভাবে? প্রিন্সিপালকে বলে চলে এলাম। মা ইনি হচ্ছেন নূরউদ্দিন কাকার আগের স্কুলের টিচার। তিনিও চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। শুনেছেন মামা আর নূরউদ্দিন কাকা স্কুল করবেন। তাই দেখা করতে এসেছেন।

হুজুরকে নিয়ে অধীর বাড়ির ভেতর ঢুকলো। ঠিক তখনই ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে সারা বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেলো। পিসিমা ভয় পেয়ে ভাঙা গলায় ডুকরে উঠলেন–হায় ভগমান, অখন আবার কারেন ক্যান যায় গা?

পকেট থেকে লাইটার বের করে ওটার আলোতে হুজুরকে নিয়ে অধীর বৈঠকখানায় ঢুকলো। বিভূতিরঞ্জন আর সাদেক ভেতরে বসে চা খাচ্ছিলেন। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে অধীর ওর মামার সঙ্গে হুজুরের পরিচয় করিয়ে দিলো।

প্রথমে উটকো ঝামেলা মনে করে বিরক্ত হয়েছিলেন বিভূতিরঞ্জন। পরে ভাবলেন এ রকম বিপদের সময় বাড়িতে একটা বাড়তি লোক থাকা ভালো। বললেন, নূরউদ্দিন ঢাকা গেছে। এখনই এসে যাবে। আপনি বিশ্রাম নিন। এরপর বনমালীকে ডেকে বললেন, নূরউদ্দিনের ঘরে আলো জ্বেলে এঁকে ওখানে নিয়ে যাও।

ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বনমালী হারিকেন যা ঘরে ছিলো মোক্ষদাকে সঙ্গে নিয়ে সব কটা জ্বালিয়েছে। বৈঠকখানায় একটা হারিকেন রেখে হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। বিভূতিরঞ্জন সাদেকের সঙ্গে অধীরের পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাদেক মৃদু হেসে ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো, আপনি স্যারের আসল ভাগ্নে আর আমি নকল ভাগ্নের পরিচয় দিয়ে এখানে আস্তানা গেড়েছি। স্যারের ভাগ্নে ভাগ্য ভালোই বলতে হবে।

অধীর বললো, আপনি যখন আছেন মামার আর ভয় কী!

বিভূতিরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুই তো জানিস না, আজ দুপুর থেকে প্রতিমা, প্রতিভা আর তোর নূরউদ্দিন কাকার মেয়ে তানিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না।

বলো কী মামা? আঁতকে উঠলো অধীর। সাদেকের দিকে তাকিয়ে জিজেস করলো, আপনি থাকতে তিন তিনটে মেয়ে কোথায় হারালো?

সাদেক গম্ভীর হয়ে বললো, বিকেলে শনির চিঠি পেয়েছি। শনি ওদের আটকে রেখেছে। পুলিশে খবর দেয়াতে নাকি ওরা এটা করেছে।

পুলিশে খবর দেয়ার কথা ওরা জানলো কী ভাবে?

আমি পুলিশের লোক এটা ওরা জেনেছে। তবে আমার সঙ্গে যে চারজন এসেছে ওদের ওরা সন্দেহ করেনি।

আপনার সঙ্গীরা কোথায়?

ভক্ত সেজে মন্দিরে পুজো দিতে গেছে। এই বলে অধীরকে ওর পরিকল্পনার কথা খুলে বললো সাদেক।

অধীর বললো, এ সময় কারেন্ট চলে যাওয়ার পেছনে শনির কোনও হাত নেই তো?

আলো না থাকাতে সাদেকও খুব চিন্তিত ছিলো। বললো, হতে পারে। আমি বরং একটু ঘুরে আসি।

অন্ধকারে যাবেন কী ভাবে?

আমার সঙ্গে টর্চ আছে। এই বলে সাদেক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

মোক্ষদা অধীরের জন্য চা আর জলখাবার এনে টেবিলে রাখলো। অধীর ওকে বললো, মোক্ষদাদি, বাইরে গিয়ে দেখো তো সাদেক চলে গেলো কি না।

মোক্ষদা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অধীর বললো, মামা, তুমি কী ভীষণ বিপদে পড়েছো ধারণাও করতে পারবে না।

বিভূতিরঞ্জন কোনও কথা না বলে প্রশ্নভরা চোখে ওর দিকে তাকালেন। পিসিমা বললেন, কোন হালার সনিরে দস লাখ টাকা দিতে ওইবো, ছেমরি তিনটা লাপাত্তা ওইয়া গ্যাচে–বিপদের আর বাকি কী দেখলি অধীর?

মোক্ষদা এসে বললো, দারোগা চইলা গ্যাছে।

অধীর সোফা ছেড়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে বিভূতিরঞ্জনের হাত ধরে বললো, এক্ষুণি চলো মামা। নূরউদ্দিন কাকার কাছে সব শুনবে।

অধীরের সঙ্গে দ্রুত পা ফেলে যেতে যেতে বিভূতিরঞ্জন বললেন, নূরউদ্দিনকে কোথায় পেলি?

চুপ করো মামা। তোমার বাড়ির দেয়ালেরও কান আছে। এই বলে অধীর ওর মামাকে নিয়ে নূরউদ্দিনের ঘরে ঢুকলো।

টেবিলের ওপর হারিকেন জ্বলছিলো। বিভূতিরঞ্জন দেখলেন আলনায় রাখা নূরউদ্দিনের জামার পকেট হাতড়াচ্ছেন হুজুর। রেগে গিয়ে বললেন, আপনি কী করছেন? ছিঃ ছিঃ একজন শিক্ষক হয়ে–

অধীর ঘরের দরজা বন্ধ করে বিভূতিরঞ্জনের কাছে এসে চাপা গলায় বললো, কাকে কী বলছো মামা? ইনিই তো নূরউদ্দিন কাকা!

এ্যাঁ, বলিস কী? হুজুরের কাছে এসে ভালো করে দেখে বিভূতিরঞ্জন বললেন, তাইতো, এ সবের মানে কী নূরউদ্দিন?

বলছি। গম্ভীর গলায় হুজুররূপী তানিয়ার বাবা বললেন, শনিকে টাকা দেয়ার ব্যাপারে সাদেক কী প্ল্যান করেছে আগে সব খুলে বলল।

সাদেকের পরিকল্পনার কথা বলার আগে প্রতিমাদের অন্তর্ধান আর শনির দ্বিতীয় চিঠির কথা বন্ধুকে জানালেন। সাদেকের পরিকল্পনার কথা শুনে তানিয়ার বাবা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে অধীরের দিকে তাকালেন। অধীর চাপা গলায় বললো, মামা, শনি বাইরের কেউ নয়, সাদেকই হচ্ছে আসল শনি।

ঘরের ভেতর যেন পাঁচশ পাউণ্ডের বোমা ফাটলো। বিভূতিরঞ্জন কী বলবেন কথা খুঁজে পেলেন না। তার চোয়াল ঝুলে গেলো। নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেলেন। অসহায় চোখে বন্ধুর দিকে তাকালেন।

নূরউদ্দিন বললেন, কাল মাঝ রাতে মেয়েরা পুরোনো মহলে আলোর সংকেত দেখে সাদেককে বলতে এসেছিলো। ওকে ঘরে না পেয়ে আমাকে বলেছে। আমার মনে হয়েছিলো সাদেক বোধহয় শনির আলোর সংকেত দেখতে পেয়ে ওদের ধরতে গেছে। তবু সন্দেহ হলো। মেয়েদের ওপরে পাঠিয়ে ওর ঘরে গেলাম। ব্যাগ হাতড়ে দেখি ব্যাগে ওর। পিস্তল রয়েছে। খটকা লাগলো–ব্যাগে পিস্তল রেখে ও নিশ্চয় শনির সন্ধানে যায়নি। ঠিক করলাম সকালে থানায় গিয়ে ওর ব্যাপারে খোঁজ নেবো। আজকাল তো জামাতের লোক পুলিশ, আর্মি–সব জায়গায় রয়েছে। হতে পারে সাদেকের সঙ্গে জামাতীদের সম্পর্ক আছে। সকালে থানায় যাওয়ার আগে ভাবলাম পুরোনো মহলটা দেখে যাই। সেখানে গিয়ে এ ঘর সে ঘর ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে নিচের তলার ভেতরের একটা ঘরে আণ্ডারগ্রাউণ্ড টানেলের সন্ধান পাই। টানেলের শেষ মাথায় একটা বড় ঘর দেখতে পেলাম। মশালের আলোয় কয়েকজন এসে সেখানে কী যেন বলাবলি করছে। তখনই আমার লাইটারের গ্যাস ফুরিয়ে গেলো। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওদের পষ্ট দেখলাম। কথাও পষ্ট শুনলাম। ওরা ছিলো তিনজন। সাদেক, বনমালী আর তোমাদের মন্দিরের পুজারি।

বল কী নূরউদ্দিন! ভাঙা গলায় বললেন, বিভূতিরঞ্জন–বনমালী শনির দলের লোক!

হ্যাঁ বিভূতি। কথা বোলো না, শুনে যাও। হাতে সময় বেশি নেই। ওরা ঠিক করেছে তোমার টাকা আর দেবীর গয়না নিয়ে আজ রাতেই চলে যাবে। কথা সেরে ওরা পাশের ঘরে। ঢুকলো। এমন সময় পেছনে টর্চের আলো দেখে আমি চট করে সরে গিয়ে বাঁ পাশের আরেকটা টানেলে ঢুকে গেলাম। একটু পরে দেখি আমাদের তিন মেয়ে কথা বলতে বলতে টর্চ হাতে সামনের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের সাবধান করতে যাবো তখনই ওরা ধরা। পড়ে গেলো। মেয়েদের পাশের ঘরে আটকে রেখে দুটো বন্দুকধারী পাহারাদার বসিয়ে সাদেকরা চলে গেলো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে। ওদের কথা শুনে মনে হলো এই সিঁড়ি মন্দির থেকে নেমে এসেছে। আমি যে পথ দিয়ে ঢুকেছিলাম সে পথ ধরেই হাতড়ে হাতড়ে বেরিয়ে এলাম। তারপর সোজা মির্জাপুর থানায়। ওসি হাকিম সাহেবকে বললাম তোমার চিঠির কথা। তিনি তো শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। কোনও চিঠিই পাননি তিনি। সাদেক হোসেন বলেও কাউকে চেনেন না। চিঠিই যখন পাননি–ফোর্স পাঠাবারও প্রশ্ন ওঠে না। ওঁকে সব কথা খুলে বললাম। পনেরো জনের ফোর্স নিয়ে ওসি নিজে এসেছেন, জেলে নৌকায় জেলে সেজে। এতক্ষণে মন্দির আর পুরোনো মহল তারা ঘিরে ফেলেছেন। এখন শুধু সাদেককে ধরে তাদের হাতে তুলে দেয়ার অপেক্ষা।

ওকে তো হাতে নাতে ধরতে হবে।

হ্যাঁ, অধীরের ব্যাগে নোটের আকারে কাগজের বাণ্ডিল আছে। বাণ্ডিলের ওপরে নিচে অবশ্য দুটো আসল নোট আছে। দশ লাখ টাকার ঝুঁকি নেয়া উচিৎ না। তুমি অধীরের বাণ্ডিলগুলো তোমার ব্যাগে ঢুকিয়ে নাও। ও টাকা নিয়ে বেরুলে আমরা ওকে অনুসরণ করবো।

তানিয়ার বাবা যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন বাকি ঘটনা সেভাবেই ঘটলো। শুধু মন্দিরের দুজন ভক্ত জেলেদের হাতে বন্দুক দেখে পিস্তল বের করেছিলো। ভক্তদের ভেতর আবার দুজন জেলে থাকায় সুবিধে করতে পারেনি। সাদেককে টাকার ব্যাগ হাতে রহেশ্বরী মন্দিরের সামনে গ্রেফতার করলেন স্বয়ং ওসি। ঠিক তখনই মন্দিরে, রায়বাড়িতে আর বাজারে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠলো।

মন্দিরের প্রতিমা রাখার বেদীর পেছনে পুরোনো মহলের মতো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। বিভূতিরঞ্জন আর নূরউদ্দিন ওসিকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েদের উদ্ধার করতে নামলেন। বন্দুকধারী পাহারাদারদের বলা ছিলো রাত নটার সময় মেয়েদের নেয়ার জন্য বনমালী আসবে লোক নিয়ে। তারপর ওদের ছুটি। মশালের আবছা আলোয় কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা গ্রেফতার হয়ে গেলো। সাদেক, বনমালী আর পুজারিকে নিয়ে শনির দলের দশজনকে গ্রেফতার করে রায়বাড়িতে আনা হলো।

ওসির কঠিন জেরা আর সঙ্গে উত্তম মধ্যম থাকাতে সাদেক সব কথা স্বীকার করতে বাধ্য হলো। রতেশ্বরীর মন্দির লুট করার পরিকল্পনা করেছে ও নব্বই সালের রায়টের সময়। তখন ও মাদ্রাসায় পড়তো। শুনেছে এই মন্দিরে কয়েক লক্ষ টাকার অলঙ্কার আছে। প্রথমে ভয় দেখিয়ে পুরোনো পুজারিকে তাড়িয়ে নতুন পুজারি ঢুকিয়েছে। তারপর বনমালীকে ঢুকিয়েছে পেয়াদার চাকরিতে। ওকে যেন কোনওভাবেই কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য মেয়েদের আটকে রেখেছিলো।

পিসিমা বললেন, আরে হারামজাদা, পুজারির কামে কারে ঢুকাইছিলি ক। তগো দলের মাইনষেরে তো না!

হাতবাঁধা পুজারি পাশে দাঁড়িয়েছিলো। হাউমাউ করে কেঁদে বললো, না পিসিমা, আমি অগো দলের না। আমি রাধানগরের চক্রবর্তী বাড়ির পোলা। আমারে মাসে এক হাজার টাকা বেতন দিব কওনে প্যাটের দায়ে এই কাম করছি। আমারে মাপ কইরা দ্যান।

চোপ রও হারামজাদা। চুরিকা বাস্তে হামোকা মন্দিরমে ঘুসা, ফির জেয়াদা বাত করতা! রেগে গেলে পিসিমা ঢাকাইয়া উর্দু বলেন।

অধীর বনালীকে বললো, তা বাবা বনমালী, তুমি কোন মাদ্রাসার ছাত্র ছিলে?

হাত বাঁধা বনমালী কথা না বলে ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ওসি তাঁর ব্যাটন দিয়ে এমন বেকায়দা জায়গায় বাড়ি মারলেন–বনমালী আই বাপ, বলে চিৎকার করে উঠলো। আরেক বাড়ি দিতেই গড় গড় করে বললো, ওর নাম হাশেম মিয়া। ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ফাজিল পর্যন্ত পড়েছে। খুনের মামলায় আসামী হয়ে ফেরারী ছিলো অনেক দিন। পরে সাদেক হোসেন তাকে এখানে কাজে ঢোকার বুদ্ধি দেয়। ওর সঙ্গে রফা হয়েছিলো, দেবীর গয়নার তিন ভাগের এক ভাগ ওর, এক ভাগ পুজারির। নগদ টাকা পুরোটা সাদেকের।

ওদের জবানবন্দী লিখে নিয়ে ওসি দশটা নাগাদ চলে গেলেন। মোক্ষদা এসে বললো, আইজ রাইতে কি কারো খাওন দাওন লাগবো না?

তানিয়া বললো, খাবো তো বটেই। দুপুরে শয়তানরা শুধু চা আর বিস্কুট খেতে দিয়েছিলো। তোমাকেও বলি বাবা, তুমি গোয়েন্দাগিরি করার জন্য পুরোনো মহলে ঢুকেছিলে, আর আমি ভাবলাম তুমি বুঝি ওদের দলের লোক।

চোখ পিট পিট করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে নূরউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, কেন এমন ভাবলি?

তোমার জুতোর ছাপ দেখে।

প্রতিমা অবাক হয়ে বললো, তুই চিনলি কী ভাবে ওটা যে নুরু কাকার জুতো ছাপ!

তোমাদের বলিনি? সকালে আমি সবার পায়ের জুতোর তলা দেখে মুখস্ত করে নিয়েছিলাম।

নূরউদ্দিন মৃদু হেসে বললেন, ভাগ্যিস তোরা কাল রাতে শনির আলোর সংকেত দেখেছিলি। নইলে শনিকে ধরা কারও সাধ্য ছিলো না।

তুমি যদি গোয়েন্দাগিরিতে না নামতে তাহলে আমাদের এতক্ষণে কোথায় পাচার করতো কে জানে!

পিসিমা বললেন, হ্যাঁর লাইগাই তো কই, ছেমরি গো এত সাহস থাকন বালা না।

বিভূতিরঞ্জন মৃদু হেসে বললেন, মেয়েরা সাহস না দেখালে দেবীর গয়না আর দশ লাখ টাকা যে হাতছাড়া হতো দিদি!

ওইচে, আর সাহস দ্যাখান লাগবো না। ওই ছেমরিরা ওঠ, জলদি খানা খাইবার যা।

প্রতিভা লাফিয়ে উঠলো–চল তানিয়া। খেয়ে দেয়ে আজ রাতে আবার জাগতে হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষের কুপিত আত্মারা আজ রাতে নিশ্চয় আমাদের আশীর্বাদ করতে আসবেন।

প্রতিমা খাবার ঘরে যেতে যতে বললো, এ কথা বলছিস কেন?

বারে, শনি কি ওদের কম জ্বালিয়েছে? আর কিছু না হোক শনির অত্যাচার থেকে তো ওঁদের রক্ষা করেছি।

প্রতিভার কথার ধরন দেখে রাগতে গিয়ে হেসে ফেললো প্রতিমা। তানিয়া ওর সঙ্গে গলা মেলালো।