সুখেনের সঙ্গে সন্ধেটা কাটল একই সঙ্গে আনন্দে বিষাদে। সুখেন একটু মাতাল ছিলই, আরও হল। ফেরার সময় গাড়িতে বসে বলল, আমি আজ আর বীথির কাছে ফিরব না দাদা। আপনার কাছে থাকতে দেবেন?
বীথি চিন্তা করবে না?
কিসের চিন্তা! আমি নেশাখোর মানুষ, আমার জন্য চিন্তা কী?
নেশা করেন কেন?
নেশা করে ভাল আছি। কোনও ঝামেলায় মনটা জড়ায় না।
আপনার কি খুব ঝামেলা?
মেলা। গায়ে মাখি না বলে।
বীথিকে এখন কেমন লাগছে?
ভাল নয়। আপনার কথাই বোধহয় ঠিক। টাকা থেঁচবার ব্যাপারটায় বীথিও থাকতে পারে। তবে মুখে মাখন।
যদি বীথির নেশা কেটে গিয়ে থাকে, তবে এবাব কেটে পড়ুন না!
সুখেন অসহায়ভাবে নিজের কোলে মুখের এক দলা নাল ফেলে বলে, কোথায় যাব? পড়ে থাকার একটা জায়গা চাই তো। একটা মেয়েছেলে দেখাশোনা করছে।
কিন্তু টাকার ব্যাপারটা?
সে বীথির স্বামী-ছেলে নেয়, অন্যেও নিত। আমার তো সব ঘুষের পয়সা, যায় যাক। ঘুষের পয়সা এমনিতেও থাকে না।
সুখেন, ইউ আর ইন এ ট্র্যাপ, সেটা কি জানেন?
সুখেন পাকা মাতাল। অনেকটা টেনেও যুক্তিবুদ্ধি হারায়নি। দীপনাথের দিকে চেয়ে বলে, খানিকটা টের পাচ্ছি।
সেই ট্র্যাপে আপনি আমাকেও ফেলতে এসেছিলেন, বিয়িং এ ফ্রেন্ড।
সুখেন মাথা নাড়ল। বলল, তা নয়। আমি দেখতে (য়েছিলাম, মেয়েমানুষের অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে আপনার একটা ভালমানুষি রোগ হয়েছে কি না।
কী দেখলেন?
তা নয়। আপনার ভালমানুষিটা খাঁটি। কিন্তু তবু একটা খটকা।
কিসের খটকা?
আপনি দাদা ভালমানুষ বটে, কিন্তু বীথির সঙ্গে শুলেন কেন?
দীপনাথ মদ খায়নি। তবু যেন মাথাটা ঝিম করল হঠাৎ। কপালটা চেপে ধরে বলল, তা আমিও জানি না। হয়তো বীথি সুন্দরী বলে।
সুখেন গম্ভীর হয়ে বলে, আপনি অত সস্তা লোক নন। অন্তত আমার মতো তো নন। বীথির মতো সুন্দরী গন্ডায় গন্ডায় আছে। তো কী?
দীপনাথ ড্রাইভারকে সোজা মেসে ফিরতে বলেনি। ময়দানে গাড়ি ঘুরপাক খাচ্ছে নানা পথে। ড্রাইভার এসব কথা শুনতে পাচ্ছে বলে লজ্জা করল দীপনাথের। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে গাড়ি থামিয়ে তারা নামে এবং মাঠের ঘাসে বসে পাশাপাশি। এ সময়টুকু দীপনাথ তার পদস্খলনের কথা ভাবল। কিছু ভেবে পেল না। এত সহজে অচেনা এক মেয়েমানুষের সঙ্গে সে যে শুতে পারে, তাও জীবনের প্রথম মহিলা সংসর্গ, তা তার বিশ্বাস ছিল না। নিজের ওপর তার আর-একটু নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা। বীথি সুন্দরী বলে নয়, বীথি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বলেও নয়, খুব সম্ভব সেই সময়টায় মণিদীপা তাকে প্রায়ই গা-জ্বালানো কথা বলত। হয়তো সেই সময়টায় তার হতাশা এবং ব্যর্থতার কথা সে বড় বেশি ভাবত।
সুখেন মদ খেলেও নিজেকে চমৎকার রাশ টেনে রেখেছে। প্রায় স্বাভাবিক গলায় বলল, বীথির সঙ্গে যা করেছেন সেটা এমন কিছু সাংঘাতিক কাণ্ড নয়। রোজ হাজারে হাজারে লোক প্রাকৃতিক কাজ সারতে মেয়েছেলের কাছে যায়, দরাদরি করে, একেবারে বাজারহাট করার মতো ইজি জিনিস। কিন্তু আপনি যেই কাণ্ডটা করলেন অমনি আমার ভিতরে কী যে একটা হল!
কী হল বলুন তো?
একটা বিশ্বাস ভেঙে গেল। মনে হল সবাই তা হলে রক্তমাংসের মানুষ। আমার মতোই।
আমি তো তাই-ই।
সে তো জানি। তবু কাউকে একটু ওপরের মানুষ ভাবতে ভাল লাগে তো। পৃথিবীর সবাই আমার মতো দোষে-গুণে মানুষ, এটা যদি সত্যি হয় তা হলেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে যায় না।
পৃথিবীর সবাই আপনার আমার মতো নয় সুখেন। ওপরের মানুষ অনেক আছে। কিন্তু সে দলের আমি নই।
কেন হলেন না দাদা?–বলে সুখেন দীপনাথের একটা হাত আলতো করে ধরে। বলে, পরদিন আমার এমন রাগ হয়েছিল বীথির ওপর যে, খামোখা একটু কথা-কাটাকাটি লাগিয়ে একটা থাপ্পড় কষিয়েছিলাম গালে।
বীথির তত সব দোষ নয়।
জানি। কিন্তু আমার বিশ্বাসটা যে চলে গেল তার জন্য কারওর ওপর তো ঝাল ঝাড়তে হবে।
দীপনাথ একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলে, সেই সময়ে আমি স্বাভাবিক ছিলাম না।
আপনাকে আমার এখনও ভক্তি হয়। বীথি আর আমি আপনার কথা অনেক বলি। আপনি বীথির সঙ্গে শুয়েছেন বলে হিংসেটিংসে করব এমন বালাই আমার নেই। মাতাল মানুষ, আমার কোনও টানও তেমন নেই। বীথি যে এখনও কেবল আমাকে নিয়েই আছে তা নয়।
বীথি কি এখনও–?
কথাটা শেষ করল না দীপনাথ। একটু বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল।
সুখেন বলে, নয় কেন? মেলা টাকা, মেলা সুযোগ, মেলা প্রভাব রোজগার করছে বীথি। ওর হাড়ে-হারামজাদা স্বামী কি এমনি-এমনি ছাড়া পেল জেল থেকে? বীথি কলকাঠি না নাড়লে?
আপনি চুপ করে থাকেন?
আমার কিছু করার নেই। কী করব, কেনই বা করব? আমার তো পড়ে থাকার একটা জায়গা আর একটা দেখাশোনার একজন মানুষ, তা পেয়ে গেছি। বাদবাকিটা আনইমপর্ট্যান্ট।
আমি আপনার মতো নির্বিকার মানুষ দেখিনি।
নির্বিকার? না ঘোর বিকার? ব্রহ্মজ্ঞানীরা দুনিয়ার সব কিছুকে মায়ার খেলা বলে মনে করে, আমার মতন লোকদের ফিলিংও তাই প্রায়। আমার কাছে সবটাই তামাশার মতো লাগে।
কিন্তু বীথি কি চিরকাল আপনার দেখাশোনা করবে? টাকা যখন বন্ধ হবে তখন?
ওঃ, সে অনেক পরের কথা। এখনও আমি দু’হাতে রোজগার করি, চার হাতে ওড়াই। বীথি আমাকে এখনও কিছুদিন যত্নআত্তি করবে। তারপর তাড়াবে একদিন বোধ হয়। আবার না-ও তাড়াতে পারে।
বীথির ওপর আপনার এখনও একটা বিশ্বাস আছে তা হলে।
সুখেন মাথা নেড়ে বলে, না। তবে বীথির বয়স চল্লিশ পার। দিনে দিনে বুড়ো তো হচ্ছে। তারপর স্বভাবগুণে বাজারটা এমনই করে ফেলেছে যে, কেউ ওকে বিশ্বাস করে না। এসব মেয়েছেলে বুড়ো বয়সে ভারী একা আর অসহায় হয়ে পড়ে। তখন আর কাউকে না পেলে হয়তো আমাকেই আঁকড়ে ধরে থাকবে।
সেই আশা?
না, আশা-টাশা নয়! আমি সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত। যা হওয়ার হবে। ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
চলুন মেসে ফিরি।
চলুন। আমার ঘুম পাচ্ছে।
আমার ওখানেই যাবেন?
সুখেন হাসল, ইচ্ছে করলে আপনিও আমার ওখানে আসতে পারেন। আমেরিকা যাওয়ার আগে বীথির সঙ্গে যদি আর-একবার ঘনিষ্ঠতা করতে চান।
সুখেন!–একটা ধমক দিল দীপনাথ।
সুখেন খুব হেসে নিয়ে বলল, যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন।
এ কথায় রেগে যেতে পারত দীপনাথ। কিন্তু রাগল না। সত্যিই তো। যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন ভেবেই কি প্রথমবারের পরও আরও বার কয়েক বীথির কাছে যায়নি! প্রথমবারই খিলটা খুলে দিতে যা বাধা ছিল। তারপর অবারিত দ্বার। রাগল না বটে, কিন্তু দীপনাথের একটু দুঃখ হল। সুখেনের কাছে সে এক সময়ে অতিমানব ছিল, আজ আর নেই। না রেগে তাই সে একটু করুণ করে হাসল।
পরদিন সকালে সুখেন ঘুম থেকে উঠে গদাই লস্করি চালে চা খেল, প্রাতঃকৃত্য সারল। তারই ফাঁকে ফাঁকে বলল, তার কোনও দুঃখ নেই। দীপনাথ যেন তার জন্য চিন্তা না করে।
দীপনাথ তার পুরনো বিলিতি কম্বলটা আর কিছু বই, একটা পুরনো পার্কার কলম উপহার দিতে চাইল সুখেনকে। সুখেন নিল না। বলল, ও তো আমি নিলেও রাখতে পারব না। বীথির স্বামী বা ছেলে এসে এক ফাঁকে নিয়ে যাবে। এই সেদিন পঁচানব্বই টাকা দিয়ে এক জোড়া চপ্পল কিনেছিলাম। হাপিস।
দীপনাথের অফিসের গাড়িতে উঠেই এসপ্লানেড অবধি এল সুখেন। তারপর নেমে গেল। দীপনাথের মনে হল, সুখেনের সঙ্গে এই শেষ দেখা। আর হয়তো দেখা হবে না। ওরকম অদ্ভুত জীবনযাপন করতে করতে সুখেন শেষ অবধি কোথায় পৌঁছবে তা ভাবতে ভাবতে বড় ভারাক্রান্ত হয়ে গেল দীপনাথের মন।
জীবনে প্রথম প্লেনে উঠতে ভয় পাচ্ছিল বিলু। মুখ শুকনো, চোখে দুশ্চিন্তা।
প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে আনমনে বসে থেকেও দীপনাথ বিলুকে লক্ষ করল। একটু হাসল। প্লেনে প্রথম প্রথম উঠতে একটু ভয় সকলেরই করে। অস্বাভাবিক নয়। তবে বিলুর তো ভয় থাকার কথা নয়। যার অসুস্থ রোগা স্বামী নিরুদ্দেশ, জীবনে তার আর ভয় পাবার কী আছে!
লাবু লাউঞ্জের কাছে মুখ লাগিয়ে এয়ারোড্রমে দাঁড়ানো প্লেন দেখছিল। মাঝে মাঝে ছুটে এসে দীপনাথকে জিজ্ঞেস করছে, এত বড় প্লেনগুলো সব ওড়ে? কী করে ওড়ে মামা, পড়ে যায় না?… ওই সাদা প্লেনটা বিলেতে যাবে?… আমেরিকায়?… আমরা কখন উঠব?
অবশেষে প্লেন যখন আকাশে উঠল তখন ভয় অনেকটা কেটে গেছে বিলুর। লাবুকে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
দীপনাথ চা ছাড়া কিছুই ছুঁল না।
বিলু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ছবির জন্য কী নিলে?
একটা হার।
কত পড়ল?
হাজার চারেক বোধ হয়।
বাব্বাঃ। কীরকম হার?
নেকলেস।
তা বলবে তো! হার আর নেকলেস কি এক?
ওই হল।
তোমাকে নিয়ে আর পারি না। চার হাজার দাম নিল, সোনা কতটা আছে?
জিজ্ঞেস করিনি। তবে ভাল দোকান থেকে কেনা। ঠকায়নি।
তোমাকে তো টাকা কামড়ায়। আমাকে নিয়ে গেলে পারতে। পছন্দ করে দিতাম।
খেয়াল হয়নি।
কী হয়েছে বলো তো! অমন কাঠ-কাঠ জবাব দিচ্ছ কেন?
কলকাতার আকাশ পেরিয়ে প্লেন উত্তরবাংলায় ঢুকে গেছে এই খানিকক্ষণ হল। আকাশের গায়ে নীলাভ পাহাড়ের পর পাহাড়। একটু পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। রূপালি মৃত্যুহিম মহান পর্বত। জনবসতি নেই, গাছপালা নেই, হাজার হাজার বছরের জমাট তুষার রয়েছে। গ্রানাইট স্তরের মতো কঠিন। পরতে পরতে ঢাকা পড়ে আছে ছোট্ট পাখি, পতঙ্গ, বা শীতের দেশের পশুদের জীবাশ্ম।
স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ ফিরিয়ে বিরক্তির গলায় দীপনাথ বলে, কী বলছিলি?
দীপনাথের মুখ দেখে কথাটা আবার বলতে সাহস হয় না বিলুর। মাঝে মাঝে সেজদাকে ভূতে পায়, বিলু জানে।
একটা জিপ নিয়ে এয়ারপোর্টে হাজির ছিল শতম। লাবুকে বুকে তুলে নিল।
অনেকদিন বাদে প্রীতমদের বাড়িটা গমগম করছিল উৎসবে। কাল বিয়ে। আজ ম্যারাপ বাঁধা শেষ। টুনি বালবের মালা সর্বাঙ্গে জড়ানো বাড়িটার। রঙিন কাপড়ের ফটক। লাউডস্পিকারে সানাই বাজছে।
বিলুকে পৌঁছে দেওয়ার পর পিসির বাড়িতে দীপনাথকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জিপের মুখ ঘোরানো হলে শতম বলল, পাত্রকে একবার দেখে যাবেন নাকি? কাছেই বাড়ি। আপনাদের বন্ধু যখন।
দীপনাথ হাসল। বলল, চল। তবে বন্দুকে আমার মনে আছে। এ সেলফ-মেড ম্যান। সেলফমেড ম্যানরা বেশির ভাগ সময়েই ভাল হয়।
জিপ এসে হাকিমপাড়ায় একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।
বাইরের ঘরেই বদু বিয়ের জন্য বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, কাজেই আসবাবপত্র নেই। একটা বড় শতরঞ্চির একধারে বসল দীপনাথ।
বদুর চেহারাটা কালোর মধ্যে বেশ। বয়সটা বোঝা যায় না তেমন। খুব জোয়ান। চোখের দৃষ্টি আত্মস্থ।
কংগ্রাচুলেশনস বদু।
একটু হেসে বদু নিরাভরণ ভাষায় বলে, দুর! এতে কী আছে! বিয়ে তো একটা করতে হতই। হয় প্রীতমের বোনকেই করলাম। বেচারা!
প্রীতম থাকলে ‘বেচারা’ কথাটা সহ্য করতে পারত না। নিজেকে কখনও বেচারা ভাবেনি প্রীতম। লড়েছে, লড়তে লড়তে হয়তো নেপথ্যে গিয়ে হেরেছে এতদিনে।
পুরনো দিনের কথা উঠে পড়ল অনেক। কিন্তু সারাক্ষণ দীপনাথের মনে হতে লাগল, যে সাহস বদু দেখাল সেই সাহস তো সে নিজেও দেখাতে পারত। ছবিকে বিয়ে করার কথা তার কখনও মনে হয়নি। দেখতে সুন্দর নয় ছবি, আবার হ্যাক ছি করার মতও কিছু নয়। বোধ হয় প্রীতমের এই বোনটিকে তারই বিয়ে করা উচিত ছিল নৈতিক দিক দিয়ে। যা হোক, বদু মহৎ বদু তো করছে!
বদুর মা ভাই বোন সব কোন্নগর আর অন্যান্য জায়গা থেকে এসেছে। তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে অনেকটা সময় কাটাল দীপনাথ।
বদু নিজের পরিবারের সবাইকে ডেকে ছেঁকে শুনিয়ে দিল, আমরা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যা চাকরি করছি দীপুদা তার চেয়ে ঢের বড় চাকরি করে। আমেরিকা যাচ্ছে, জানো?
খুবই নির্ঝঞ্ঝাটে বিয়েটা হয়ে গেল ছবির। শ্বশুরবাড়ি রওনা হওয়ার সময় শুধু কাঁদতে কাঁদতে বেহেড পাগলের মতো আচরণ করল কিছুক্ষণ ছবি। দু’-দু’বার অজ্ঞান হয়ে গেল।
কেবল বিলাপ করে, আমার দাদা কোথায় গেল?… আমার মা বাবাকে কে দেখবে?
বিলু কুড়ি দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। দীপনাথের থাকার উপায় নেই। বউভাতের পরদিন ফেরার প্লেনে বসে জানালা দিয়ে পাহাড়ের দিকে তৃষিতের মতো চেয়ে থেকে সে ভাবল, প্রীতমের পর্ব কি শেষ হয়ে গেল তবে? আর কি প্রীতমের জন্য আমার কোনও দায় থাকল না? শুধু ঈষদুষ্ণ কিছু স্মৃতি ছাড়া?
কোথায় গেলি? এই দীর্ঘশ্বাস আর-একবার বুক ভেঙে বেরিয়ে এল, ঠিক এক মাস পর যখন রাত্রে কলকাতা-বোম্বাই ফ্লাইটে আমেরিকার পথে পাড়ি দিল দীপনাথ। নীচে অন্ধকার ভারতবর্ষ। বিশাল এবং বিপুল। এই দেশের সীমা আগে কখনও ডিঙোয়নি দীপনাথ। এখন ডিঙোতে চলেছে। এই দেশকে সে কখনও আপন বলে ভাবতে পারেনি, এখানে তার কোনও পিছুটানও নেই। তবু বুকের মধ্যে এক-একটা পাক দেয় মাঝে মাঝে।
কী ফেলে যাচ্ছে সে? কাকে রেখে যাচ্ছে? ছেলেবেলা থেকে সে পিসির কাছে মানুষ। নিজের মা বাপকে ভাল করে চেনেনি। ভাই-বোনের সঙ্গে সে রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। না ছিল গভীর কোনও অবিচ্ছেদ্য ভালবাসা। মণিদীপা? তাকে সে নতুন করে কি সম্প্রদান করে আসেনি বোস সাহেবের হাতে?
অনেক হিসেব করল দীপনাথ। না, কেউ নেই, যার জন্য আবার তার এই দেশে ফিরে আসতে হবে। তবে কেন এই বুকের মধ্যে অকারণ উথাল-পাথাল?
পুব থেকে পশ্চিম প্রান্তে পাড়ি দিতে দিতে অন্ধকার ভারতবর্ষের দিকে চেয়ে ছিল দীপনাথ। দক্ষিণে সমুদ্র, পশ্চিমে সমুদ্র, উত্তরে সেই হিম পাহাড়ের ঢেউ। মাঝখানে মোটা থেকে সরু হয়ে আসা এক দেশ। এ দেশ তো তার নয়। সে যেখানেই বীজ বপন করবে সেইখানেই বৃক্ষের উৎপত্তি দেখবে। তবে?
সব মানুষই এক অসমাপ্ত কাহিনি। কোনও মানুষই তার জীবনের সব ঘটনা, সব কাজ শেষ করে যায় না তো! তার নিজের জীবন এখনও অনেকখানি বাকি। অনেকখানি বাকি ছিল প্রীতমেরও।
ওই নীচে অন্ধকার ভূখণ্ডে আরও কত কাহিনি রচিত হচ্ছে, যার সবটুকু শেষ হওয়ার নয়। জীবনের অনেকটা বাকি থাকতে থাকতেই অনেকে খেলার মাঠ ছেড়ে চলে যাবে। দেনা-পাওনার হিসেব মিলবে না। এই খেলার একজন খেলুড়ি তো সেও। কারও জন্যই তার দুঃখ করার কিছু নেই।
তবু বুকের মধ্যে মৃদু ঢেউ। দোল দিচ্ছে। ঘা মারছে। বলছে, কপাট খোলো।
উত্তরে এই অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। পাহাড়ও বহু বহু দূর। তবু দীপনাথ টের পায়, স্বদেশ নয়, শেষ পর্যন্ত এক মহা পূর্বতই কোল পেতে বসে থাকবে তার জন্য। যেদিন তার কোলে যাবে দীপনাথ, সেই দিন পরম পিতার মতো সেই পাহাড় নিজের তুষারপের পরতে পরতে দীপনাথকে মিশিয়ে নেবে। আদরে সোহগে। দুঃখ, দৈন্য, দুর্দশা, অপমান, স্মৃতিভার থেকে শীতল মুক্তি।
কাগজের ন্যাপকিনটা হাতে ধরা ছিল দীপনাথের। সন্তর্পণে সেইটে তুলে দু’চোখের কোল মুছে নিল।
2012 সালে প্রথমবার বইটা পড়ি। অসাধারন একটা লেখা। কিন্তু আপনারা অনেক বানান ভুল করেছেন, কিছু জায়গায় চরিত্রের নাম উলটা পালটা হয়ে গেছে। তবে এরকম একটা কাজ করার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি আরো ভাল করবেন।