বহুদিন বাদে ছবির কাছে একটা আয়না চাইল প্রীতম, আয়নাটা দে তো ছবি, আজ আমি নিজেই দাড়িটা কামাব।
কেন বড়দা? হারু নাপিত তো কামাতে আসবেই।
না, আজ একটু সেলফ-সার্ভিস করে দেখি।
ছবি দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম এনে দেয়। আয়নাটা ভারী অদ্ভুত। প্ল্যাস্টিকের ফ্রেমে বাঁধানো ছোট আয়নাটার দুপিঠেই মুখ দেখা যায়। একপিঠে ম্যাগনিফাইং উত্তল কাচ থাকায় মুখটা বিরাট বড় দেখায়। এ জিনিসটা এই প্রথম দেখল প্রীতম। তার অসুস্থতার অবকাশে কত নতুন জিনিস বেরিয়ে গেছে। নিজের চার-পাঁচ গুণ বড় মুখের দিকে চেয়ে রইল প্রীতম। সে কতটা শীর্ণ, কতটা ফ্যাকাসে তা ঠিক বুঝতে পারল না। তবে সে যে দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড এবং বিপুল শক্তিমান সে কথা আয়নাটা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল। সেই সঙ্গে এ কথাও মনে করিয়ে দিয়ে লাগল যে, দু’-তিন বছর আগেও সে যেমন ছিমছাম স্মার্ট চেহারার মানুষ ছিল এখনও সেইরকমই আছে।
বিনা দুর্ঘটনায় দাড়ি কামিয়ে ফেলে প্রীতম বারান্দায় তার প্রিয় চেয়ারে গিয়ে বসে। হাতে আয়নাটা। আরও স্পষ্ট আলোয় আয়নাটা মুখের সামনে ধরে সে নিজেকে মিথ্যে মিথ্যে করে বলে, তুমি আগের চেয়ে ভাল আছ। তোমার উন্নতি হচ্ছে। তুমি মরবে না।
নিজেকে সে প্রশ্ন করতে লাগল:
জীবাণুদের কোলাহল?
নেই। বহুকাল শুনিনি।
সেই নিঃসঙ্গতার বাঘটা?
ডাকছে না।
মৃত্যুভয়?
একটু আছে। এত সামান্য যে ঠিক ভয় বলা যায় না। মৃত্যু-চিন্তাই হবে হয়তো।
তবে যাও প্রীতম, তুমি মুক্ত। যেখানে খুশি চলে যাও।
যাব?
যাও।
মরমের সাইকেলটা বারান্দায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। লক করা, কিন্তু চাবিটা খুলে নেয়নি মরম।
কিছু না ভেবেই প্রীতম চেয়ার ছেড়ে ওঠে। বারান্দা থেকেই উবু হয়ে চাপে সাইকেলের সিটে। লকটা খুলে নেয়। শরীর কাঁপে, পা কাঁপে। তবে খুব বেশি নয়। সিটে বসে সামান্যক্ষণ দম নেয় সে। প্যাডেলে ডান পা রেখে বাঁ পায়ে যতদূর সম্ভব জোরে একটা চাড় দেয় সে। হ্যান্ডেলটা বার দুই প্রচণ্ডভাবে ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরে গিয়ে আচমকা সোজা হয়।
একটু ঢালু মতো জায়গাটার ওপর দিয়ে হঠাৎ সাইকেলটা গড়িয়ে যেতে থাকে। ভীষণ কাপছে হাতল, ভীষণ দুলছে প্রীতম। কিন্তু চেষ্টাই তো জীবন। প্রাণপণে সে পা দিয়ে প্যাডল করতে চেষ্টা করে।
রাস্তার ধারে ড্রেনের ওপর পাতা কংক্রিটের অপ্রশস্ত সাঁকোটা শুধু কপালজোরে পেরোতে পারে সে। তারপর রাস্তা… বিপজ্জনক… ভয়ংকর… তবু মুক্তি!
আশ্চর্য এই, টলোমলো সাইকেলটা পড়েও গেল না। চৌপথী ছাড়িয়ে গড়গড়িয়ে চলতে লাগল। চলন্ত সাইকেলে প্যাডল করতে খুব বেশি কষ্ট নেই। কিন্তু কষ্ট হ্যান্ডেল সোজা রাখায়। এ পাড়ায় ক্কচিৎ কদাচিৎ এক-আধটা মোটরগাড়ি আসে। রিকশা অবশ্য অনেক। আর সাইকেল। প্রীতমের ভয় করছিল, হয় কোনও সাইকেল বা রিকশার সঙ্গে ধাক্কা খাবে, নয়তো রাস্তা ছেড়ে পাশের নর্দমায় গিয়ে পড়বে।
কিন্তু পড়ছিল না। চৌপথী ছাড়িয়ে মাঠের ধার অবধি চলে এল সে। পিছনে একটা হইচই শোনা যাচ্ছে। আশেপাশের লোক অবাক হয়ে দেখছে। আনন্দধামের বারান্দা থেকে পিনুর মা অবাক গলায় চেঁচাচ্ছেন, ওরে শম্ভু! ও তারক! শিগগির গিয়ে প্রীতমকে ধর। দেখ, কী সর্বনেশে কাণ্ড করছে ছেলেটা!
হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে, সে একটা সর্বনেশে কাণ্ডই করছে আজ। কিন্তু এই আধখানা বেঁচে থাকার নিরন্তর বন্দিত্ব থেকে মুক্তি আর খুব দুরে নয়। অনেকদিন তার জীবনে মৃত্যুর শাসন বড় গুরুভার হয়ে চেপে বসে আছে। সে তো জানে, মরবেই, তাই মৃত্যুর হাত থেকে এই ছুটি নেওয়া।
ওরা তাকে ধরে ফেলবে। পিছনে ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ আসছে। কারা চেঁচিয়ে ডাকছে, প্রীতমদা! প্রীতমদা! থামুন! আমরা আসছি।
প্রীতম তার সর্বস্ব দিয়ে ভর দিল প্যাডেলে। তার দুর্বল পায়ে তেমন জোর নেই যে সাইকেলকে এরোপ্লেনের মতো ছোটাবে। তবু এই অবস্থায় যতখানি জোরে সম্ভব সাইকেল ছুটতে থাকে। হ্যান্ডেলের আঁকাবাঁকা হয়ে যাওয়াটা একটু কমে এল। স্থির হল। সরু রাস্তায় যথাসাধ্য ধার ঘেঁষেই প্রীতম চালিয়ে নিতে পারছে। উল্টোদিকের চারটি রিকশা অনেকটা তফাত দিয়ে পেরিয়ে গেল তাকে। একটা মোটরগাড়িও। উত্তরাভিমুখী প্রীতমের সাইকেল রইল বহমান। কিন্তু এ পাড়ার শতকরা পঞ্চাশজনই তাকে চেনে। অচেনারাও সাইকেলে রুগ্ন চেহারার লোকটাকে দেখে অবাক হয়। সুতরাং সে প্রবলভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। পিছন দিক থেকে একটা-দুটো স্বাস্থ্যবান ছেলে বেগবান সাইকেলে এসে এক্ষুনি তাকে ধরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তাও জানে প্রীতম। তাই সে যতদূর সম্ভব চেনা পরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে যাওয়ার জন্য দুটো বাঁক ফিরল। কিন্তু বুকে হাঁফ ধরে আসছে, গায়ে ঘাম, হাত-পায়ের প্রতিটি সন্ধিতে খিল-ধরার যন্ত্রণা। প্রচণ্ড রোদে তার চোখ ঝলসে যাচ্ছিল। চোখের দৃষ্টিও কিছুটা আবছা এখন।
তবু সব বাধাকে ছাড়িয়ে প্রীতম চলতে থাকে। খানিকটা অন্ধের মত, খানিকটা যন্ত্রের মতো। রাস্তা খুবই সরু। এত সরু যে একটা রিকশা উল্টোদিক থেকে এলেই সে বিপদে পড়বে। সাইকেলের ওপর তার এত নিয়ন্ত্রণ নেই যে, অল্প জায়গা দিয়ে গলে যেতে পারবে। তবু বেপরোয়া প্রীতম প্রবল শ্বাস ফেলতে ফেলতে হেলে প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেলটাকে যথাসাধ্য বেগবান রাখছিল।
আর-একটা মোড় ঘুরতে গিয়ে প্রীতম পড়ল। পড়বে, প্রীতম জানতও। কিন্তু তার জন্য কোনও প্রস্তুতি নেয়নি সে, সাবধান হয়নি। তাই জানা সত্ত্বেও পড়াটা হল আচমকা।
বাঁ হাতে আর-একটা পাথরকুচির রাস্তায় বাঁক নিয়েই সে দেখতে পায় সামনে ইট বোঝাই এক টাটা মারসিডিস লরি থেকে মাল খালাস হচ্ছে। নীর অবরোধ। প্রীতমের সাইকেলে ব্রেক ছিল বটে, কিন্তু সেটাকে যথেষ্ট জোরে চেপে ধরার মতো শক্তি ছিল না তার হাতে। সুতরাং শুকনো একটা নর্দমার খাতে সাইকেল সুষ্ঠু নেমে খানিকদূর গড়িয়ে গেল সে। তারপর ধাক্কা মারল ইটের পাঁজায়। বেঁকে গেল সাইকেল। আরও একটু নিয়ে গেল তাকে। ফাঁকা ঘাসজমির ওপর ঢলৈ পড়ে গেল প্রীতমকে নিয়ে।
ব্যথা-বেদনা টের পেল না প্রীতম। তবে চোখে অন্ধকার নেমে এল। গভীর শ্বাস ফেলে তৃপ্তিতে চোখ বুজল সে। মথিত ঘাস আর ভেজা মাটির গন্ধ, রোদের সুঘ্রাণে ভরে গেল তার শাস। ঘাসপোকাদের শব্দ শুনতে শুনতে সে চেতনা হারাল।
খুব বেশিক্ষণের জন্য অবশ্য নয়। চোখে-মুখে প্রথম জলের ঝাপটা পড়তেই চোখ মেলে সে। হাত তুলে ওদের বারণ করে আর জল দিতে। হাসিমুখে ঘাসে শুয়ে থেকে সে উজ্জ্বল আলোয় মাখা অনেকখানি আকাশকে চেয়ে দেখে। এতখানি স্বাধীনতা বহুকাল ভোগ করেনি সে।
পাড়ার ছেলেরা তাকে ধরে তোলে, প্রীতমদা, এবার বাড়ি চলুন।
ওরা তাকে একটা রিকশায় তোলে। একজন তার পাশে বসে তাকে ধরে থাকে।
পাড়া ভিড়ে ভিড়াক্কার। ভারী লজ্জা করছিল প্রীতমের। আর তার মুখের ওই লাজুক হাসিটি দেখে অনেকেই অবাক মানল, তা হলে কি প্রীতম ভাল হয়ে উঠছে?
মা প্রীতমকে শোওয়ার ঘরে নিয়ে যেতে চাইছিল। শতম বলল, থাক মা। দাদা যা চাইছে তাই করো।
প্রীতম আবার বারান্দায় বসে। কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না, অভিযোগ করে না, শাসন করে না। বোধহয় শতম সবাইকে বারণ করেছে।
খুবই ক্লান্ত ছিল প্রীতম। দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমোল। বিকেলে মনোরম আলোয় বারান্দায় এসে বসল আবার। ছবি চা দিতে এসে সহসা ফিরে গেল না। চেয়ারের পাশটিতে বসে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে একগাল হেসে বলল, তোমার আর কলকাতার জন্য মন খারাপ হয় না, না দাদা?
প্রীতম কথাটা ভেবে দেখল। কলকাতার কথা তার খুব মনে পড়ে। কিন্তু না, প্রথম প্রথম যেমন হত, ফিরে যেতে ইচ্ছে করত, তেমনটা আর হয় না। সে মাথা নাড়ল।
তুমি কলকাতার নোক হয়ে যাওয়ার পর আমরা ধরেই নিয়েছিলাম তুমি আমাদের পর হয়ে গেছ। এভাবে যে অনেকদিন আমাদের কাছে থাকতে পারবে তা কখনও ভাবতেই পারতাম না।
প্রীতম হেসে গভীর শ্বাসও ফেলল সেইসঙ্গে।
ছবি.বলল, বউদির চিঠি আজও এসেছে। তোমার নামে। তুমি বউদির চিঠিগুলো কেন পড়েও দেখো না বলো তো! আগের চিঠিটাও আঁটা খামে তোমার টেবিলে পড়ে আছে। জবাব না দিলে, পড়তে দোষ কী?
প্রীতম উদাসমুখে চুপ করে থাকে। কী জবাব দেবে? বিলুর চিঠি তার পড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, বিলুর চিঠির মধ্যে অনেক মিথ্যে সাজানো কথা থাকবে। ওইসব কথা তার এখন সহ্য হয় না।
প্রীতম বলে, তোদের কাছে তো চিঠি দেয়ই।
তা দেয়। তবু, তোমার কাছে তো আলাদা করে কিছু বলার থাকতে পারে।
থাকলে কী করব? আমার তো এখন আর ওর জন্য কিছু করার নেই।
তুমি ভীষণ অন্যরকম হয়ে গেছ।
কীরকম রে?
কেমন যেন। তোমাকে বাপু আজকাল ভয় করে।
ভয় পাস?
ভয় পাই তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না বলে। লাবুসোনার জন্যও তুমি আজকাল ভাবো না দাদা?
প্রীতম চট করে এ কথার জবাব দিল না। সারা গায়ে একটু ব্যথার টাটানি রয়েছে এখনও। তার অবশ প্রায় অনুভূতিহীন শরীরে এই ব্যথাটুকু খুব উপভোগ করছিল সে। দুরের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, লাবুকে নিয়ে ভাববার কিছু তো নেই। যদি কোনও অ্যাকসিডেন্ট বা অকালমৃত্যু না ঘটে তা হলে ওর জীবন তো নিরাপদই। ওর মা ভাল চাকরি করে, আমারও কিছু টাকা রয়ে গেছে। তার চেয়ে বরং স্বার্থপরের মতো এখন আমার নিজেকে নিয়েই চিন্তা করতে বেশি ভাল লাগে।
বলে প্রীতম একটু হাসল।
কথাটার অর্থ ছবি খুব ভাল ধরতে পারল না, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। বলল, কিন্তু বউদি যে আমাদের কথা বিশ্বাস করে না, তার কী করবে? প্রতি চিঠিতেই আমরা লিখি, দাদা ভাল আছে। কিন্তু বউদির সন্দেহ, তুমি ভাল নেই। ভাল থাকলে নিজের হাতেই চিঠি লিখতে।
খুব চিন্তা করে বুঝি?
খুব। লেখে, তোমরা আমাকে সব কথা জানাচ্ছ না।
এবার লিখে দিস, দাদার জন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। দাদার তো আয়ু বেশি নয়, তাই বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড সে নিংড়ে নেয়। তার সময় কই যে তোমাকে চিঠি লিখবে?
ছবি হেসে বলে, এসব কথা লেখা যায় বুঝি!
প্রীতমও হাসে, তা হলে কিছুই লিখিস না।
বউদিকে নিজের হাতে তোমার একটু লেখা উচিত। একটিবার লেখো। ওই যা যা সব বললে তাই না হয় লেখো। অত ভাষা তো আর আমাদের কলমে আসবে না।
তোর বউদি যদি আমাকে নিয়ে ভাবনায় পড়ে থাকে তবে একটু ভাবতে দে না। ভাবলে ভালবাসা বাড়ে।
সন্ধেবেলা ঘরে এসে টেবিলের ওপর বিলুর চিঠিটা পড়ে থাকতে দেখল প্রীতম। কিন্তু একবারও খুলে পড়তে ইচ্ছে হল না তার।
আগের মতো প্রীতম এখন ঘরবন্দি থাকে না। সকলের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খায়। অনেক রাত অবধি পারিবারিক আড্ডায় জেগে অংশ নেয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, সে সেই শৈশবের শিলিগুড়িকে পেয়ে গেছে বুঝি। এখন আর তাই বিলুকে মনে পড়ে না, লাবুর জন্য চিন্তা নেই, মন কেমন করে না তেমন।
টেলিগ্রামটা এল বেশ রাতে। অ্যারাইভিং টুয়েলভথ অ্যাটেন্ড। বিলু।
টেলিগ্রামটা পিয়োনের হাত থেকে নিয়ে ঘরে এসেই মরম চেঁচায়, বউদি কাল আসছে। হুররে।
খবরটা মরমের মুখ থেকে বেরোতে না বেরোতেই বাড়িতে একটা আনন্দের কোলাহল পড়ে যায়। মা খুশি, বাবা খুশি, ছবি খুশি। শুধু প্রীতমই এই খবরে তেমন উত্তেজনা বোধ করে না। বরং তার একটা ভ্রু একটু উর্ধ্বমুখী হয়। বিলু, কে বিলু?
রাতে ঘুমঘোরে প্রীতমের মনে হয়, তার কোনও অভাব নেই। তার কিছু প্রয়োজন নেই। আর কাউকে ছাড়াও তার চলে যাবে। সকালে বাচ্চা নিয়ে যে মহিলাটি সামনে এসে দাঁড়াবে সে এই পৃথিবীর আর হাজার হাজার মহিলার মতোই একজন। তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু লাবু! লাবু তো তার মেয়ে! প্রীতম আধোঘুমেই ভাবে, তাই বা ভাবছি কেন?
লাবু আমারই বা কেন হবে? লাবু এই পৃথিবীতে আসার একটি মাধ্যম খুঁজেছিল। প্রীতম সেই মাধ্যম মাত্র। সে তো লাবুর সৃষ্টিকর্তা নয়। লাবুর প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা যে, লাবু তারই। প্রীতম শুধু এক বিভ্রম এক মায়াবশে ভাবে, লাবু আমার মেয়ে। কিন্তু সত্য ঘটনা তো তা নয়।
খুব সকালেই স্কুটার হাঁকিয়ে বউদিকে আনতে নিউ জলপাইগুড়ি চলে গেল শতম। বাড়িতে গোছগাছ করতে লাগল ছবি আর মা।
গোছগাছের জন্যই সাতসকালে বিছানা ছাড়তে হয়েছে প্রীতমকে। ছবি তাকে ঠেলে তুলে বিছানা টানটান করে ভাল বেডকভার দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। টেবিলে পেতেছে নিজের হাতে কাজ করা সবুজ ঢাকনা। আজ সব জানালায় দরজায় টানটান পরদা।
একটু বিরক্তমুখে কাচা ধুতি পরতে হয়েছে প্রীতমকে। গায়ে সাদা কটকটে গেঞ্জি। চুল পাট করে সেজেগুজে বসে আছে বারান্দায়। ছবি চা দিতে এলে তেতো মুখে বলল, আজ কি পাত্রীপক্ষ আমাকে দেখতে আসছে রে? তোরা যা শুরু করেছিস!
আসছেই তো দেখতে। যা অগোছালো হয়ে থাকো, বউদি দেখে গিয়ে আমাদের নিন্দে করবে।
এমনিতে বুঝি করে না?
করলে করে। তবু যতদূর পারি মন রাখার চেষ্টা করি।
তোর বউদি হল কলকাত্তাই মাল। কলকাত্তাইরা অত সহজে খুশি হয় না।
কী যে সব বলল না দাদা!
প্রীতম ভ্রু কুঁচকে চা খায়। তারপর হঠাৎ উদাসী এক হাওয়া আসে। প্রীতম চরাচরের দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে আলো আর ছায়া, সবুজ আর নীল, প্রাণ আর জীবনের খেলা দেখতে থাকে। সামনের মাঠে খোঁটায় বাঁধা গোরুর পাশে ছাগল চরছে। ঘাস পতঙ্গ পাখি, তুচ্ছ সব ওড়াউড়ি, অস্তিত্ব, শব্দ তাকে এক গভীর প্রাণের রাজ্যে নিয়ে যেতে থাকে। সেখানে নামহীন অস্তিত্ব আর বুদ্ধির জগৎ। বিলু নেই, লাবু নেই, কেউ নেই।
এই গভীর ধ্যানের মধ্যে স্কুটারের পি শব্দ হঠাৎ হানা দেয়। স্কুটারের পিছু পিছু গুড়গুড় করে আসে একটি অটোরিকশা। বাড়ির সামনে থামে।
লাবু চেঁচিয়ে ডাকে, বাবা!
ভোরের সুন্দর আলোয়-ধোয়া মুখে একটু হাসে প্রীতম। হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধ স্বরে বলে, আয়।
লাবুকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে প্রীতম টের পায়, আজ এরকমই সস্নেহে সে একটি ছাগলছানাকেও কোলে নিতে পারে। তার স্নেহ অনেকটা নৈর্ব্যক্তিক হয়েছে এখন।
লাবু অনেকটা লম্বা হয়েছে। অনেক বেশি সুন্দরও। তার মুখে এখন নিখুঁতভাবে প্রীতমের মুখের আদল চেপে বসেছে। খুব দামি আর সুন্দর একটা ফ্রক তার পরনে। দু’হাতে লাবুর মুখখানা তুলে নিবিষ্ট চোখে দেখছিল প্রীতম।
লাবুও মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে বাবার দিকে। বলল, তুমি ভাল আছ বাবা?
ভালই মা। তুমি?
আমিও ভাল আছি বাবা।
বাড়িসুদ্ধ লোক বেরিয়ে এসেছে বাইরে। মা বাবা ছবি মরম রূপম। ভাইরা সুটকেস, বাসকেট, বিছানা নামাচ্ছে অটোরিকশা থেকে। ছবি গিয়ে বউদির হাত ধরে টেনে আনছে।
ভারী সুন্দর এই দৃশ্য। কিন্তু প্রীতম নড়ল না। এক হাতে মেয়ের হাতটা ধরে নির্বিকার বসে রইল। বিলুর দিকে চেয়ে সে স্পষ্টই বুঝতে পারে, বিলু সেই আগের মতো নেই। সামান্য মেদবৃদ্ধির ফলে তার চেহারাটা পরিপূর্ণ শ্রীময়ী। মুখে ক্লান্তির আস্তরণের নীচে তৃপ্তির চিহ্ন। বিলু আর তার নেই।
প্রীতমের দীর্ঘশ্বাস এল না। দুঃখ হল না। উদাসীনতার এক গৈরিক রং আজ তার মন ছেয়ে আছে। সে দেখল। মনে মনে ক্ষমা করল। সবাইকে।
ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় কেটে যাওয়ার পর বিলু শাড়ি পালটে, মুখ হাত ধুয়ে বারান্দায় আসে। আর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলে, আমার একটা চিঠির জবাব দাওনি।
আমি ভাল আছি বিলু।
সে কথাটাও তো জানাতে পারতে!
তুমি কেন এত জানতে চাও?
চাইব না!— বিলু অবাক হয়, রোগা মানুষটাকে এতদূরে ফেলে রেখে কলকাতায় থাকি, জানতে চাইব না?
প্রীতম বিরক্ত হয় না, কিন্তু গভীর বিষণ্ণতার গলায় বলে, বেশ তো আছি।
বেশ আছ জানি। মাঝে মাঝে অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়ে পড়ো, তাও শুনেছি। কিন্তু আমি কেমন ছটফট করি, তা জানো?
প্রীতম কৌতূহলভরে বিলুর দিকে তাকায়। সন্দেহ নেই, প্রীতমের জন্য বিলুর উদ্বেগ আছে, দায়িত্ববোধ আছে, দুঃখ আছে। কিন্তু এও জানে প্রীতম, বিলুর জীবনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে সে নেই। বিলুকে চাকরির ঘানিতে ঘোরাচ্ছে কে? বিলুকে কলকাতার জালে আটকে রেখেছে কে? সে কি এক শূন্যগর্ভ নিরাপত্তার বোধ? বিলু কি জানে না, কেউই কোথাও কখনওই নিরাপদ নয়?
প্রীতম বলল, চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে না।
পড়তেও নয়? শুনলাম আমার চিঠি এলে তুমি নাকি তা খুলে পড়তেও চাও না।
ছবি বলেছে বুঝি! আসলে ভুলে যাই। মনে রাখলে কষ্ট পাব বলে জোর করে ভুলে যাই। নইলে তোমার চিঠি পড়তে লোভ হয় খুব। কিন্তু পড়লেই দুর্বল হয়ে যাব যে।
এ কথায় বিলু বোধহয় একটু ভিজে যায়। তবু বলে, ও কথার মানে হয় না। চিঠিতে কত জরুরি কথাও থাকতে পারে তো।
জরুরি! কী আর এমন জরুরি থাকতে পারে বলো তো জীবনে? ঘর-সংসার-সম্পর্ক সবই তো ছেলেখেলা বিলু।
সন্নিসি ঠাকুর, আমার মুখ চেয়ে না হয় একটু ছেলেখেলাই করলে। তোমার অসুখটা তো আমার কাছে ছেলেখেলা নয়। মেয়েটাও দিনের মধ্যে দশবার বাবার চিঠি এসেছে কি না জানতে চায়। ওকে কী বলি বলো তো!
তুমি বেশ সুন্দরী হয়েছ বিলু।
আচমকা এ প্রশংসায় একটু কুঁকড়ে গিয়ে বিলু বলে, যাক বাবা, আমাকে দেখেছ তা হলে। আমি তো ভাবলাম, সন্নিসির বুঝি বউয়ের মুখ দেখাও বারণ।
প্রীতম ক্ষীণ একটু হাসল। তারপর বলে, বেশ লাগে এখন তোমাকে দেখতে।
থাক, আর বলতে হবে না। নিজের দোষ ঢাকতে এখন এরকম অনেক মিথ্যে কথা তোমাকে বলতে হবে।
প্রীতম গম্ভীর মুখে হঠাৎ বলে, একটা কথা বলব বিলু?
বলো।
তোমার এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। আমার গেছে। কেন আমার স্মৃতি নিয়ে তোমার নিজের জীবনকে নষ্ট করছ?
বিলু নড়ে বসল। তারপর বলল, ওরকম একটা কথা তুমি আগেও বলেছ। আর বোলো না।
শোনো, আমি অভিমান থেকে বলছি না। আমারও একটুও ঈর্ষা হবে না, অধিকারবোধেও লাগবে না। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই।
যদি সুখী না হই? তুমি চাইলেই কি সুখের পাখি এসে আমার কোলে বসবে?
তবু আমি চাইছি।
বোলো না। আমি এখনও অত আত্মকেন্দ্রিক নই।
বিলু, তুমি বড় পাপবোধে কষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু যাকে পাপ বলে ভাবছ তা পাপ না-ও হতে পারে।