দীপনাথ কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে বলে, সজল তোমাকে মারবে! কী যে বলো তুমি বউদি! তোমার মাথাটাই গেছে।
তৃষা হাসে না। বিষণ্ণ আর্তি মাখানো মুখে দীপনাথের দিকে চেয়ে বলে, আমার অবস্থায় না পড়লে কেউ আমার সমস্যা বুঝবে না জানি। কিন্তু আমার ভরসা ছিল, আর কেউ না বুঝুক, তুমি বুঝবে।
একটু অসহিষ্ণু গলায় দীপনাথ বলে, সেই যে কারা রাতে তোমাকে বোমা মেরে গেছে, সেই থেকে তুমি সবাইকে সন্দেহ করতে শুরু করেছ। আমি বলি, তুমি আরও কিছুদিন সংসার থেকে ছুটি নাও, দূরে কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে এসো। তোমার ভীষণ স্ট্রেন যাচ্ছে।
নিবু নিবু গলায় তৃষা বলে, যেখানেই যাই, কপাল আর কর্মফল তো সঙ্গেই যাবে।
দীপনাথ একটু হাসল, তোমার কপাল কি এতই খারাপ বউদি? বেশ তো আছ! জমজমাট তোমার সংসার। মেয়ের বিয়ে দিয়ে শাশুড়িও বনে গেছ।
তৃষা মৃদু স্বরে বলে, সংসারে কোথায় যে দাঁড়াব এখন সেই জায়গাটাই খুঁজে পাচ্ছি না যে। আজকাল কেন যে কেবলই মনে হয়, এসব আমার নয়, এরা আমার নয়, এখানে আমার কোনও জায়গা নেই। একদিন যদি মেরে না-ও ফেলে, তবুও ঘাড় ধরে বের করে দেবে। এরা কেউ কেন আমাকে দেখতে পারে না বলো তো? আমি কী করেছি?
কারা দেখতে পারে না?
তোমার মেজদা, স্বপ্না, মঞ্জু, সজল, কেউ না।
অভিমান নয়, তৃষার গলায় একটা সত্যিকারের আতঙ্ক স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে দীপনাথের কাছে। সে টক করে কিছু বলল না। একটু ভাবল। তারপর একটু লঘু স্বরে বলল, তোমার দাপট কি একটু কমে আসছে বউদি?
তৃষা মাথা নাড়ল। বলল, কমেনি দীপু। কমলে আজ এত ভাবনায় পড়তাম না। আসলে আজকাল আমাকে ওরা কেউ ততটা সমীহ করে না, ভয় পায় না। বিশেষ করে সজল। ওর সঙ্গে কথা বলতে আজকাল আমারই ভয়-ভয় করে। কী কথার কী জবাব দেবে তার ঠিক নেই।
দীপনাথ সোজা হয়ে জিজ্ঞেস করল, সজল কোথায়?
হিংস্র বন্য বিদ্বেষে ভরা দুটি চোখ একটু আড়াল থেকে লক্ষ রাখছিল তৃষাকে। দীপনাথের শূন্য ঘরের দাওয়ার কাছ ঘেঁষে মস্ত এক নারকেল গাছ। তারই পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সজল। সে দূর থেকেই টের পাচ্ছিল, তার মা বড়কাকার কাছে চুকলি কাটছে। কীসের চুকলি তা সে জানে না। কিন্তু মায়ের যে সবসময়েই কিছু গোপন করার আছে তা সে জানে। মা বড়কাকাকে কী বলছে তা জানার জন্য সজল ছটফট করছিল। বলতে কী, বড়কাকাকে তার ভীষণ ভাল লাগে। মা যদি তার সম্পর্কে বড়কাকাকে আজেবাজে কথা বলে বিষিয়ে দেয় তবে সে মাকে ছেড়ে দেবে না। বড়কাকার কাছে মা’র সম্পর্কে সব বলে দেবে। যা জানে সব।
সজল নিজেও টের পায়, তার শবীবে রাগ বড় বেশি। এত রাগ যে, সারা গায়ে বিষ-বিছুটির জ্বালা ধরে যায় মাঝে মাঝে। আর তার বেশির ভাগ রাগই মায়ের ওপর। বাবার খাবারে মা বিষ মেশায় কি না তা সে সঠিক জানে না। কিন্তু বাবাকে রামলাখনের আড্ডায় নিয়ে যাওযার জন্য মা যে রঘু স্যাকরাকে লাগিয়ে দিয়েছিল তা সে জানে। লোকমুখে ছেলেবেলাতেই সে শুনেছে, জ্যাঠামশাইয়ের এইসব বিষয়-সম্পত্তি মা খুব সম্ভবে পায়নি। ছোট কাকাকে মা যে গুন্ডা লাগিয়ে মার দিয়েছিল এও তার অজানা নয়। সবচেয়ে বড় হয়ে যে প্রশ্নটা তার মনে দেখা দেয় মাঝে মাঝে, তা হল, তার বাবা কে?
বড় হয়ে একদিন সে মাকে এই প্রশ্নটা করবে।
সজল দেখে, মা উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। বড়কাকা একটু ভ্রু কুঁচকে বসে বসে কী যেন ভাবছে। মুখটা গম্ভীর। তারপর বড়কাকা দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে দেখে। আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে বারবাড়ির দিকে।
সজল গাছের আড়াল ছেড়ে ক্ষেতের মধ্যে নেমে দৌড়োতে থাকে। ঘুরপথে গিয়ে মুখোমুখি হবে।
খুব তাড়াতাড়িই চলে সজল। বড়কাকা সদ্য ভাবন-ঘরের কাছ বরাবর পৌঁছেছে।
তাকে দেখে খুব ক্ষীণ একটু হাসল বড়কাকা।
সজল ভাল মানুষের মতো জিজ্ঞেস করে, কখন এলে?
অনেকক্ষণ। তুই কোথায় ছিলি?
এইখানেই।
দীপনাথ হাত বাড়িয়ে তার কাঁধটা ধরে। বলে, কত লম্বা হয়েছিস!
এই কাঁধে একটু হাত রাখা আর কত লম্বা হয়েছিস প্রশ্নটুকুর মধ্যে এক অথৈ সমুদ্রের গভীরতা। সজল এইটুকু এ বয়সে বুঝতে পারে, কোনটা স্নেহ, কোনটা স্নেহ নয়। দীপনাথের হাতের স্পর্শটুক আর গলার নরম কোমল লাবণ্য অনেকক্ষণ তার শরীর আর শ্রবণে কাজ করবে। সজল মুখ টিপে হেসে বলে, এখনও তোমার সমান হইনি।
দীপনাথ মুগ্ধ চোখে হাড়োব প্রাণবান চেহারার সজলকে দেখছিল। দেখে তার চোখ আর মন ভরে গেল। চোখে বুদ্ধির ঝিলিমিলি খেলা করছে, বেড়ে ওঠা শরীরে এখনও শিশুর লাবণ্য ও মুখশ্রীতে পৌরুষ সত্ত্বেও এক বিস্ময় নাখানো সরলতা দেখে ভারী খুশি হল। এই তাদের বংশধর, এখনও পর্যন্ত একমাত্র বংশধর। কাঁধে সস্নেহে হাতের ভর রেখে দীপনাথ বলে, আয় ওই বারান্দায় বসি।
ভাবন ঘরের বারান্দায় পাশাপাশি বসে দীপনাথ বলে, খুব ইচ্ছে ছিল কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে তোকে নিয়ে যাব। ভাল স্কুলে পড়াব। কিন্তু সে আর হল না।
কেন কাকা?
দীপনাথ একটা মস্ত শ্বাস ছেড়ে বলে, অনেক অসুবিধে রে। আমাকে মাঝে মাঝে লম্বা ট্যুরে যেতে হয়। রান্নাবান্নার লোক, কাজের লোকও বড় পাওয়া যায় না। তার চেয়ে ভাবছি তোকে নরেন্দ্রপুরে ভর্তি করে দিলে কেমন হয়।
সেখানে জিমনাসিয়াম আছে?
থাকারই কথা। তুই কি ব্যায়াম করতে ভালবাসিস?
সজল মুখ বিকৃত করে বলে, না। শরীর সাজাতে আমার ভাল লাগে না।
তবে?
আমি মার্শাল আর্টটা শিখতে চাই। আর বক্সিং।
সেসব ওখানে বোধহয় নেই। দেখব খোঁজ করে। ওসব শিখতে চাস কেন? সেলফ-ডিফেন্স, না গুন্ডামি করবি?
সজল হাসল, যারা অন্যায় করে আমি তাদের শিক্ষা দিতে চাই।
করুণ একটু হাসি ফোটে দীপনাথের মুখে। খুব ধীরে ধীরে সে বলে, সব অন্যায় কি শুধু গায়ের জোরে ঠেকানো যায়? আগে নিজে ন্যায়বান হতে হয়, সাহসী হতে হয়, মানুষকে ভালবাসতে হয়, মানুষ কোথা থেকে জোর পায় জানিস? ভালবাসা থেকে। মা-বাবাকে যদি ভালবাসিস, দিদিদের যদি ভালবাসিস, সবাইকে যদি ভালবাসিস তা হলে দেখবি গায়ের জোরের তত দরকার হয় না।
তোমার গায়ে কি খুব জোর বড়কাকা?
আমার গায়ে?–দীপনাথ প্রথমে অবাক হয়, পরে হাসে। বলে, দূর বোকা! আমি কি ব্যায়ামবীর, না বক্সার? আমার কোনও জোরই নেই। তবে তুই জোরওয়ালা মানুষ হলে আমাদের আর দুঃখ থাকবে না। তবে সেটা শুধু গায়ের জোর নয় কিন্তু।
গায়ের জোর কি খারাপ?
তা নয়। তবে বেশি গায়ের জোরের কথা মনে রাখলে মনটা শরীরমুখী হয়ে যায়। তখন আর মাথায় সুক্ষ্ম চিন্তা আসতে চায় না।
সজল মাথা নিচু করে চটির ডগা দিয়ে একটা কাকরকে মেঝেতে ঘষছিল। হঠাৎ বলল, তুমি আমাকে খারাপ ভাববো না তো বড়কাকা?
দীপনাথ অবাক হয়ে বলে, তোকে খারাপ ভাবব কেন?
কেউ যদি তোমার কাছে কিছু লাগায় তা হলে তো ভাববে!
তোর নামে আবার কী লাগাবে?
লাগাতে পারে।–বলে সজল একটু হাসল, কিন্তু তুমি বিশ্বাস কোরো না। বরং বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো, আমি খারাপ কি না।
দীপনাথ সস্নেহে হাসে। বলে, তোকে কেউ খারাপ ভাবে না।
সজল একটু ভ্রু কুঁচকে কী ভাবে। তারপর বলে, আমি বোর্ডিং-এ যাব না।
কেন রে? বোর্ডিং-এ কত মজা জানিস?
জানি। আমার যেতে ইচ্ছেও করে। কিন্তু আমি চলে গেলে বাবাকে দেখবে কে?
কেন, তোর বাবাকে দেখার লোকের অভাব আছে নাকি?
বাবা আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।
দীপনাথ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সজল কি মেজদার ছেলে? না বড়দার? লোকে নানা কথা বলে। সেসব কি সত্যি? তবু শ্রীনাথের প্রতি সজলের এই প্রগাঢ় টান বড় ভাল লাগল দীপনাথের। শ্রীনাথের ছেলে যদি না-ও হয়ে থাকে সজল, তা হলেও এই বংশেরই ছেলে। দীপনাথ আর-একবার মায়াভরে সজলের লম্বা চিকন চুলে ভরা মাথাটা একটু নেড়ে দেয়। বলে, ঠিক আছে। কিন্তু এখানে থাকলে শুধু বাবাকে নিয়ে থাকলেই তো হবে না, মা তো ভেসে আসেনি। মাকে দেখবে কে?
বাঃ, মা’র তো বাবার মতো অবস্থা নয়। মাকে দেখার কী আছে?
সজলের চোখে হঠাৎ যে ঝলকানি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল তা বেশ লক্ষ করল দীপনাথ। ঘৃণা, বিদ্বেষ, আক্রোশ সব দগদগ করছে ভিতরে। কিন্তু ওইটুকু বাচ্চা ছেলের মন এত বিষিয়ে গেল কী করে তা ভেবে পেল না দীপনাথ। আবার সজলের জন্ম-রহস্য নিয়ে প্রশ্ন উঁকি দেয় মনের মধ্যে। বড়দা মল্লিনাথের ছিল বুনো শুয়োরের মতো গোঁ, খ্যাপা রাগ, ভয়ংকর সাহস। যার ওপর রেগে যেত তাকে পারলে খুন করে। সজলের চেহারায় এবং স্বভাবে নির্ভুল সেই বড়দার ছাপ।
দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল। মন ভাল নেই। কোথাও বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না।
সন্ধেবেলা বউদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ফেরার ট্রেন ধরল। তৃষা অনেকবার তাকে আটকাতে চাইল, কিন্তু দীপনাথ থাকতে রাজি হল না। অনেক ভাঙচুরের টুকরো চারিদিকে ছড়ানো। জোড়া লাগানোর এক বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। তবু চেষ্টাই তো জীবন!
হাওড়া থেকে সে সোজা চলে এল নার্সিংহোমে।
বোস সাহেব অনেকটা ভাল। ঘরে ভিজিটর কেউ নেই। একা বোস সাহেব আধশোয়া হয়ে একটা থ্রিলার পড়ার চেষ্টা করছে।
আজকাল দেখা হলে বোস আর তেমন খুশি হয় না। কেবল শূন্যগর্ভ এক দৃষ্টিতে দীপনাথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই ভ্যাবলা দৃষ্টির অর্থ বোঝে না দীপনাথ। কিন্তু এটা টের পায়, বোসের ভিতরে খুব বড় রকমের একটা ভূমিক্ষয় ঘটে যাচ্ছে।
আজ কেমন আছেন?
তেমন কিছু খারাপ নয়। তবে এত ওষুধ খাওয়াচ্ছে যে, মুখটা বিস্বাদ।
এবার কিছুদিন কোথাও বেড়িয়ে আসুন।
কোথায় যাব?-হতাশার গলায় বোস বলে।
যে-কোনও স্বাস্থ্যকর জায়গায়।
বোস করুণ মুখ করে বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে আদিগন্ত কলকাতার আলো-অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। গিয়ে লাভ নেই।
দীপনাথ কী বলবে, চুপ করে থাকে।
বোস সাহেব দূরের দিকে চেয়ে থেকেই বলে, আপনি আমার ভাল করতে চাইছেন, সে কথা শুনেছি। কিন্তু আমার কীসে ভাল হয় তা আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করাটা ঠিক নয়। তাতে ভাল না হয়ে খারাপও হতে পারে।
দীপনাথ আস্তে করে বলল, মণিদীপাকে আমি বিয়ে করলে যে ভাল হবে সেটাই বা আপনি তা হলে ধরে নিয়েছিলেন কেন?
বোস একটু হাসল। তবে কিছু বলল না বা দীপনাথের দিকে তাকালও না।
জুয়াড়ির মতো মুখ করে দীপনাথও চুপ করে বসে থাকে।
অনেক অনেকক্ষণ বাদে বোস বলে, আপনারা দুজনে হয়তো সুখী হতে পারতেন।
দীপনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যার ভালবাসা এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে শিফট করে তাকে আমি ভয় পাই বোস সাহেব।
বোস তেমনি দূরের দিকে চেয়ে বলে, দীপা আপনাকে সত্যিই ভালবাসে।
স্নিগ্ধদেবকেও বাসত।
ইউ আর বিয়িং ক্রুয়েল।
আই অ্যাম সামটাইমস্ টুথফুল।
আপনাকে অ্যাভয়েড করতেই বোধহয় দীপা বিকেলের দিকে আসে না।
উনি কি রোজ আসেন?
বোস সাহেব একটা বড় শ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলে, তা আসে। মেকস মি টি, সার্ভস ব্রেকফাস্ট, সিগনিফাইং নাথিং।
দীপনাথ শেক্সপিয়রের ভাঙা উদ্ধৃতির অপব্যবহার শুনে একটু হাসল। বলল, আপনার কাজিনটি একসেপশনাল। কিন্তু তাকে বিয়ে করলেই যে আপনার সমস্যা মিটে যাবে এমন নয়। দেয়ার আর মোর দীপনাথস।
তার মানে?
আপনার যে বয়স এবং স্বাস্থ্যের যা অবস্থা তাতে অত্যন্ত যুবতী কোনও মেয়েকে তেমন কিছুই দেওয়ার নেই আপনার। কথাটা ভেবে দেখবেন।
বোস রাগল না। কিন্তু ঘাবড়ানো মুখে আবার ক্যাবলা চোখে তাকিয়ে রইল দীপনাথের দিকে।
নিঃশব্দে একজন কালো প্রায় কিশোরী নার্স ঘরে আসে। মৃদু ভদ্র স্বরে বলে, ভিজিটিং আওয়ার ইজ ওভাব। প্লিজ…
দীপনাথ ওঠে। দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে তাকায়। নার্স বড় বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। সবুজ আলোর এক অপ্রাকৃত পরিমণ্ডলে বোস এখনও আধশোয়া। এই সবুজের মধ্যেও তার মুখের ফ্যাকাসে রং দেখা যাচ্ছে।
বোস অনুচ্চ স্বরে বলল, ইট ওয়াজ এ নক আউট।
দীপনাথ বেরিয়ে আসে।
পেল্লায় বড়লোকদের এই নার্সিংহোমের পিছল মেঝের ওপর দিয়ে লিফটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয় সুখের এত উপকরণ সাজিয়েও মানুষকে সুখী করা যায় না তা হলে? অ্যাঁ!
অঞ্জু টেলিফোন করল সকালে, হ্যালো দীপা! তোমার জন্য একটা খবর আছে। ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওপাশে একটা ঘর পাওয়া যাচ্ছে। নেবে? দু’লাখ সেলামি।
দু’লাখ! বলে মণিদীপা ঢোঁক গেলে।
দু’লাখ চাইছে। বাট উই মে ট্রাই টু বারগেন। দেড় লাখের নীচে নামবে না ধরে রাখো।
তা হলে ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট যে অনেক পড়বে।
এখন তো সব কিছুই কস্টলি। ইন্টিরিয়র ডেকোরেটররা এক-একটি কাটথ্রোট। তবে আমার চেনা শান্তিনিকেতনের একটি ছেলে আছে। সে অনেক কমে দোকান সাজিয়ে দেবে।
কম মানে কত?
হাজার কুড়ির মধ্যেই। তোমার তো বাপু কেবল শাড়ি বেচা নিয়ে কথা। আমাদের মতো ঝামেলার ব্যাপার তো নয়।
স্টক কিনতে কত লাগবে তোমার কোনও আইডিয়া আছে?
তুমি তো বাপু যোধপুরের বড়লোকদের ঘোল খাওয়াতে চাও। তা হলে কস্টলি শাড়ি বা এক্সক্লসিভ চাই। দ্যাট উইল কস্ট ইউ মোর।
তবু শুনি।
আমার কোনও আইডিয়া নেই। রাফলি অ্যানাদার লাখ। সবশুদ্ধ আড়াই নিয়ে নেমে পড়ো।
আমি তোমার সঙ্গে শিগগিরই দেখা করব।
শিগগির নয়। কালই। কোনও স্পেস পড়ে থাকছে না। দেয়ার আর পিপল টু পে টু লাখস ফর দ্যাট শপ। ভাল কথা, তোমার হাজব্যান্ড কেমন?
ভাল।
কবে আনছ নার্সিংহোম থেকে?
দু’এক দিনের মধ্যেই।
আজ ছাড়ছি। কাল সকালের দিকেই চলে এসো।
আচ্ছা। বলে ফোন ছাড়ে মণিদীপা। তারপর সম্পূর্ণ বে-খেয়ালে সে একটা চেনা নম্বর ডায়াল করে।
হ্যালো! বলেই জিভ কাটে মণিদীপা। মনে ছিল না, বিভ্রম। নইলে দীপনাথের সঙ্গে যে এখন তার টকিং টার্মসই নেই।
ওপাশ থেকে গম্ভীর গমগমে সেই কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, হ্যালো। চ্যাটার্জি স্পিকিং, হ্যালো।
মণিদীপার গায়ে কাঁটা দেয়। বুক ঢিপঢিপ করে। সর্বোপরি গলা কেঁপে যায়।
একটু সময় নিয়ে সে বলে, হ্যালো!
দীপনাথ হঠাৎ বুঝি গলাটা চিনতে পারে। একটু হেসে বলে, কী হল? বলুন! আমি সেই দীন সেবক দীপনাথ।
বাজে বকবেন না।
কোনও প্রবলেম নাকি?
হুঁ। কিন্তু আপনাকে বলে লাভ কী?
এখনও কি মাথায় ব্যাবসা ঘুরে বেড়াচ্ছে?
বেড়াচ্ছে।
কী করতে হবে আমাকে? টাকার জোগাড়?
পারবেন?
কত?
ওঃ সে অনেক। থাক, বলব না।